এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ভ্রমণ কাহিনী নয় -১

    Prativa Sarker লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০১ নভেম্বর ২০১৮ | ১৭১৪ বার পঠিত
  • আমাদের দেশের রাজনীতি পাঁচ হাজার বছরের হারাপ্পান কঙ্কালকেও রেহাই দেয় না। কবর থেকে তুলে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পর যেই দেখে পালে বাতাস লাগছে না, অমনি সব রিপোর্ট চেপে দেয়।
    ধর্মীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মরীয়া চেষ্টা অথবা দুর্বলের ওপর চূড়ান্ত অত্যাচার যে কোন ধর্মকে মৌলবাদী করে তোলে। সে দুর্বল সংখ্যালঘু অথবা দলিত হতে পারে, মেয়েরাও হতে পারে। আবার কোন সম্প্রদায়ের ওপর রাষ্ট্রীয় মদতে নামিয়ে আনা অত্যাচারও হতে পারে।

    পাঞ্জাবে বীরের জাত সুদর্শন শিখ নারীপুরুষের সান্নিধ্যে এবার ধর্মীয় ভারত দেখবো বলে বেরিয়ে এই উপলব্ধি নিয়ে ঘরে ফেরা।

    নাহলে ধর্ম মেনে চলা সাধারণ মানুষগুলোকে আমার মঙ্গলগ্রহের জীব কোনদিনও মনে হয়নি। যেহেতু স্বপরিবারের আস্তিকতা পার হয়ে নাস্তিকতা নিজের চেষ্টায় অর্জন করেছি, শুধু ধর্মের কারণে কাউকে গাল দেওয়া বা ঘৃণা করা আমার হাস্যকর লাগে। এতোবড় দেশের কোণে কোণে ধর্মপ্রাণ বেশিরভাগই গরীব অসহায় মানুষ, মৌলবাদের দাপট হালে বাড়লেও অনুপাতে অনেক কম, আমার এতো স্পর্ধা নেই তাদের তুচ্ছ জ্ঞান করে অনবরত গালি দিয়ে যাই। বড়জোর তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে পারা যায়, ব্যবহারিক উদাহরণ তুলে ধরা যায়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সঠিক শিক্ষা প্রসারের চেষ্টা করা যায়, কিন্তু জন্মের সংস্কার টুসকিতে না পাল্টালে জোর করা যায়না, তাচ্ছিল্য করা যায়না । একমাত্র মৌলবাদী সন্ত্রাসী যারা মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তারা ছাড়া কারো ওপর জোর খাটানো যায় না।

    আমি অমৃতসরের যে রেল লাইন পেরিয়ে ওয়াগা গেলাম দুদিন বাদে সেখানে আমোদলোভী ৬১ জন মানুষ কচুকাটা হয়ে পড়ে রইল। রেলের গাফিলতি না প্রশাসনের দোষ সে চর্চা চলবে, কিন্তু এই মানুষগুলোকে বেশ হয়েছে বলতে পারব না। তারা নীলছবি দেখে দশেরা উদযাপন করেনি, গণধর্ষণের আনন্দ চায়নি, শুধুমাত্র ধর্মীয় লোকাচার পালন করছিল। যে রাবণ সাজে দশ বছর ধরে সেই যুবকটিও ট্রেণের ধাক্কায় মারা গেছে। তাকে আমি ধর্মান্ধ বলে গাল দিতে পারব না।

    এটা বুঝতে হবে বৃহত্তর ভারতে ধর্ম মেক আপের মতো আলগা কোন ব্যাপার নয়, যাপন এবং সংস্কৃতির আরেক নামমাত্র। ধর্মের কুফল বোঝাবার চেষ্টা আর ধর্ম উৎপাটন কোনটা তাদের ক্ষেত্রে কতটা কাজ দেবে সেটা এখনো অপরীক্ষিত । বরং ধর্মকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা খুব চালু। ফেবুর নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সৌখিন জ্ঞান বৃহত্তর ধার্মিক ভারতের কোন কাজে আসবে বলে মনে হয়না।

    স্বর্ণ মন্দিরে দাঁড়িয়ে এইসব ভাবছিলাম যখন, তখন সচেতনভাবে আমার মাথায় কাপড় ছিল। কারো কোন ভাবাবেগে আলপটকা আঘাতে বিশ্বাস রাখিনা। যদি ঠিক করতাম যাব না, তাহলে যেতামই না। গেছি যখন, তখন আর পাঁচজনের থেকে আমি আলাদা, আমার বাবা অমুক, আমি ধর্ম মানি না, তাই আমি মহান, এইসব স্টেটমেন্ট দেবার জায়গা স্বর্ণমন্দির নয়। এইসবের জন্য ফেবু আছে তো !

    আমি বৈপরীত্য বোঝার চেষ্টায় ছিলাম। আমার সামনে সূর্যালোকে ঝলমল করছে স্বর্ণমন্দিরের চূড়া, অপূর্ব রাগনির্ভর গুরবাণীর সুর ভাসছে আকাশে, অগুন্তি মানুষ পরমপ্রিয়কে পাবার জন্য বিহবল চোখমুখ নিয়ে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে। লাইন একটু এগোলেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে করসেবকরা খালি হাতে পায়ের ধুলো সাফ করছে পূণ্যার্থীর চলে যাবার রাস্তায়। আমি জলের মধ্যে মাছ হয়ে মিশে গেলাম, তবু অকাল তখতের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেল সন্ত্রাসী ভিন্দ্রানওয়ালেকে, অপারেশন ব্লুস্টার যার রাজনৈতিক মদতের বাড়বাড়ন্ত শেষ করেছিল রক্ত আর মৃত্যুর আঁচে।
    আসলে ধর্মচর্চা আর ধর্মীয় সন্ত্রাসের সীমানা মিলেমিশে যায় বার বার। ধর্মের নামে সমস্ত ধর্মোপদেশের বিরুদ্ধাচরণ করাই যেন বীরত্ব। ক্ষমতার লোভ সব তছনছ করে দেয়। উপরন্তু আছে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা যা গুবলেট করে দেয় সবকিছু। সাবধান থাকতে হয় তাই, খুব সাবধান থাকতে হয় !

    আজকের স্বর্ণমন্দিরের কোথাও সেই রক্তের ছিটেফোটা লেগে নেই। ঘি চপচপে হালুয়া প্রসাদের বাটোয়ারা চলছে। একসাথে বসে খাবার এতো বড় লঙ্গর আমি জীবনে দেখিনি। বিশাল সোনার হার্মোনিয়াম বাজছে গুরু গ্রন্থসাহেবের পাশে। গ্রন্থীদের কি সুন্দর সৌম্য চেহারা ! ছড়ানো হাতের মুঠির মতো বিশাল সাদা বাতাসা প্রণামীর বিনিময়ে। যারা রেললাইনে কাটা পড়ল তাদের কেউ কেউ সেদিন পার্থিব বিপদমুক্তির প্রার্থনায় একই লাইনে দাঁড়িয়েছিল না, এমনটা নিশ্চিত করে বলতে পারিনা।
    আনন্দপুরসাহিবেও একই দৃশ্য দেখেছি। নীল পোশাক পরা, সুউচ্চ পাগড়ি মাথায় গর্বিত নিহাং, পবিত্র সেনানী সব। অথচ এইই ছিল ভিন্দ্রানওয়ালের আঁতুড়ঘর। এই ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরিতে কাদের মদত ছিল, কেনই বা ছিল সেসব এখন জলের মতো স্পষ্ট। সেই ফাঁদে পা দেবে একজন গ্রন্থী, ধর্মাচরণে পারদর্শী ও ধর্ম শাস্ত্রবিশেষজ্ঞ যে কিনা গুরুবাক্যকে বেদবাক্য বলে জানে, এও বড় আশ্চর্য।
    বার বারই দেখা গেছে সন্ত্রাস সাধারণের জন্য কোন চিরস্থায়ী স্মৃতি, মোহ কিছুই রাখে না ! বরং উল্টো, শান্তিপ্রিয় জনগণ পাঞ্জাবে সুশাসনের খোঁজে সেই কংগ্রেস সরকারকেই নির্বাচিত করেছেন। ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে ভগত সিংহের গ্রাম দেখান ড্রাইভারসাহেব, কিন্তু একবারও কোন বিতর্কিত নাম উচ্চারণ করেন না।
    তাই ভুল করুন বা ঠিক করুন, ভিন্দ্রানওয়ালের কথা জালিয়ানওয়ালাবাগের মাটিতে দাঁড়িয়ে আর মনে পড়ে না। আমার চেতনা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বীর উধম সিং, রক্তমাখা ঐ দিনটিতে যিনি সমবেত জনগণকে তেষ্টার জল বিলুচ্ছিলেন।
    বাবা মা মারা যাবার পর দাদার হাত ধরে এতিমখানায় এসে উঠেছিলেন উধম। চোখের সামনে হাজার হাজার নিরপরাধ নরনারীর লাশ লুটিয়ে পড়বার স্মৃতি চিরকাল মাথার ভেতর সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন। সুযোগ মিলতেই ইংল্যান্ড গমন আর লন্ডনে জালিয়ানওয়ালাবাগ ম্যাসাকারের সময় পাঞ্জাবের গভর্ণর ডায়ারকে এক বুলেটেই ঝাঁজরা ক'রে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বদলা নেওয়া। এই ডায়ার কিন্তু গুলি চালাবার হুকুম দেওয়া জেনেরাল ডায়ার নয়। উধম সিং বদলা নেবার আগেই তার দেহান্ত হয়েছিল। তবু এই অসমসাহসিকতা কাঁপিয়ে দিয়েছিল অত্যাচারী শাসকের হাড়মজ্জা। উধম সিংকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সে অনুতপ্ত কিনা। বীর বিপ্লবী জবাব দেন, আবার সুযোগ পেলে বিদেশী বানিয়াদের আবার গুলিতে ঝাঁজরা করবেন।
    ফাঁসি হয় উধম সিংয়ের। অনেক পরে দেহাবশেষ এনে সংরক্ষিত করা হয় জালিয়ানওয়ালাবাগের মিউজিয়ামে। ঝকঝকে সেই স্বর্ণবর্ণ পিতল-কলসের সামনে দাঁড়িয়ে বড় আক্ষেপ জাগে। এঁদের বলিদানের প্রতি কি সুবিচার করলাম আমরা ! কোথায় সঅনুচর ভগত সিংয়ের অমৃতসর, মান্টোর বিচরণ
    ভূমি, আর কোথায় ধূলিধূসরিত পণ্যমুখর গতানুগতিক অমৃতসর যেখানে জালিয়ানওয়ালাবাগের সংকীর্ণ গেট থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ে ম্যাকডোনাল্ডসের বিশাল কাচের বিপণি।
    এই দীন দুনিয়ায় এখন কেউ স্বপ্নও দেখে না। সবার আমোদ এখন ওয়াঘা বর্ডারের যুদ্ধু যুদ্ধু খেলায়।
    এইসবের ক্লাইম্যাক্স কঙ্কাল কান্ডে। যার বয়স আবার পাঁচ হাজার ! সিন্ধু সভ্যতার সেই পাঞ্জাবের কথা বলছি পরের কিস্তিতে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০১ নভেম্বর ২০১৮ | ১৭১৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন