এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনের অগ্রতাপস―ডিরোজিও # চার

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৮ আগস্ট ২০১৬ | ২৩৯১ বার পঠিত
  • ।। ৬ ।।
    ডিরোজিওর এই সমস্ত মতাদর্শগত সাফল্যের পেছনে মৌল উৎসগুলি কী কী? তিনি কি প্রচলিত বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো রকম ঈশ্বরের ধারণায় বিশ্বাস করতেন? অথবা, তিনি কি পুরোপুরি নাস্তিক ছিলেন? তাঁর কি সুনির্দিষ্ট কোনো দার্শনিক বোধ তৈরি হয়েছিল? নাকি, তিনি যখন যা মনে হত সেই মতো বলতেন বা আচরণ করতেন? তাঁর ছাত্রদের কাছেই বা তাঁর মতাদর্শগত বার্তা ঠিক কী ধরনের ছিল? খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি তাঁর মনোভাব ঠিক কী ধরনের ছিল? ভারতের খ্রিস্টান মিশনারিরাই বা তাঁর সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করত?

    এবার সেই সব প্রশ্নে ঢুকতে হবে।

    হিন্দু কলেজের পরিচালক মণ্ডলির তরফ থেকে যে তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে, তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান হল এই যে তিনি ছাত্রদের মন থেকে ঈশ্বর বিশ্বাস মুছে দিচ্ছেন। এর জবাবে উইলসনকে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “কারও কাছে আমি কখনও প্রকাশ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করিনি বা সেরকম কিছু বলিনি। তবে এই ব্যাপারে আলোচনা করা যদি অপরাধ হয়, তাহলে আমি অবশ্যই অপরাধী। কিন্তু এই প্রশ্নে বিভিন্ন দার্শনিকদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত আলোচনা করার কথা স্বীকার করতে আমি ভয়ও পাই না, লজ্জাও বোধ করি না। কেন না, কে কীভাবে এর সমাধান করেছেন তার কথাও আমি বলেছি। এরকম একটি গুরুতর বিষয় নিয়ে এভাবে যুক্তিতর্ক করাটা কি নিষিদ্ধ? যদি তাই হয়, তাহলে তো অন্য পক্ষের হয়ে যুক্তি করাটাও সমানভাবে অন্যায়। এক পক্ষের কথা অন্ধের মতন বিশ্বাস করব, আর তার অন্য পক্ষের বিরোধী যুক্তির প্রতি চোখ কান বন্ধ করে রাখব—এটা কি কোনো বিষয়ে সত্য জানার উৎকৃষ্ট পন্থা হতে পারে? আর বিশ্বাস যাই হোক, তার ভিত কী করে শক্ত হবে যদি না প্রতিপক্ষের মতামত বুঝে নিয়ে তাদের খণ্ডন করা হয়?”

    কী অসাধারণ যুক্তি! আগে থেকেই কোনো বিষয়ে তোমার মত গঠন করে ফেল না। উদ্দিষ্ট বিষয়ে দু পক্ষের মত শোনো, তাদের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার কর, তারা একে অপরের বক্তব্য কীভাবে খণ্ডন করে দেখ, তারপর তুমি তোমার সিদ্ধান্ত নাও। রেনেশাঁস উত্তর ইউরোপীয় নতুন সংস্কৃতি এই যে নতুন আধুনিক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছিল, যা উনিশ শতকের যাত্রারম্ভে সবে এদেশের একদল মুষ্টিমেয় মানুষ একটু একটু করে আত্মস্থ করতে শুরু করেছিল, এক সদ্য-যুবক তার সারমর্ম কী সুন্দর ও বলিষ্ঠভাবে সেদিন তুলে ধরেছে!

    কীভাবে সে এর প্রয়োগ করেছে? তাঁর কথাতেই শোনা যাক।

    “আমি তাই হিউমের রচনায় ক্লিন্থিস ও ফিলো-র মধ্যে বিখ্যাত সংলাপের ঢং-এ ধর্মীয় মতবাদের ব্যাপারে যেভাবে অত্যন্ত শানিত ও শীলিত যুক্তি করা হয়েছে তার সারমর্মের সাথে কলেজের ছাত্রদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য জ্ঞান করেছি। আবার আমি তাদের হিউমের বিরুদ্ধে ডক্টর হার্বার্ট রিড এবং ডুগাল্ড স্টুয়ার্টের উত্থাপিত শক্তিশালী যুক্তিগুলিও পড়িয়েছি। যেগুলি এখনও হিউমের বিরুদ্ধে আলোচনায় একই ভাবে ব্যবহৃত হয়। This is the head and front of my offending. ছাত্রদের ধর্মবিষয়ক ধ্যানধারণা যদি আমার এই শিক্ষাদানের ফলে নড়বড়ে হয়ে গিয়ে থাকে, তার দায় আমার নয়। আমার সাধ্য কি আমি কোনো দিকে তাদের বিশ্বাস তৈরি করে দিই; আর যদি একদল ছাত্রের নাস্তিকতার জন্য আমাকে দায়ী করা হয়, সে ক্ষেত্রে বাকি যারা আস্তিক হয়ে রইল তাদের জন্যও কৃতিত্ব তো আমাকেই দিতে হবে।”

    অনেকে আজ একথা শুনে হয়ত বিস্মিত হবেন যে ডেভিড হিউম তাঁর Dialogues Concerning Natural Religion গ্রন্থে (১৭৭৯) দুজন নয়, আসলে তিন জনের মধ্যে (দেমিয়া, ক্লিন্থিস ও ফিলো) সংলাপের আকারে ভগবানের অস্তিত্ব ও তার প্রমাণ বিষয়ে তর্কবিতর্ক উপস্থিত করে শেষ পর্যন্ত কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষেই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। আর বইটি লেখা হয়েছিল, একজন (প্যাম্ফিলুস) তার বন্ধু (হেরমিপ্পুস)-কে পত্রাকারে এই সংলাপের গল্প বলছে—এইভাবে। সুতরাং এই বই সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে কারোর পক্ষেই সরাসরি নাস্তিকতায় উত্তীর্ণ হওয়ার কথা নয়। তার উপর ডিরোজিও আবার হিউম-বিরোধী যুক্তিতর্কও ছাত্রদের পড়িয়েছেন। ফলত, তথ্য সাপেক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে নাস্তিকতা শিক্ষা দেওয়ার অভিযোগ বড়ই দুর্বল হয়ে পড়ার কথা। মুশকিল হচ্ছে, হিউমের বইটিতে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে যতটুকু সংশয়বাদের অবতারণা করা হয়েছে, সেটাও তখনকার রক্ষণশীলদের পছন্দ ছিল না। যেমন এদেশের, তেমনই ওদেশের। এখনও বোধ হয় তাদের পছন্দ নয়। কেন না, সব দেশে সব কালেই ধর্মবিশ্বাসীদের মূল তত্ত্ব: বিশ্বাসে মেলায় কৃষ্ণ, তর্কে বহু-উউউউ দূর . . .।

    পরিশেষে তিনি উইলসনকে লেখেন, “বিশ্বাস করুন স্যর, মানুষের অজ্ঞানতা ও মতামতের পরিবর্তনশীলতা সম্বন্ধে আমি এত সজাগ যে অত্যন্ত ছোটখাটো বিষয়েও আমি কখনও জোর দিয়ে কিছু বলতে পারি না। সংশয় আর অনিশ্চয়তা আমাদের এতটাই ঘিরে রাখে যে অনুসন্ধিৎসু মনের ভেতরে গোঁড়ামি সাহস করে ঢুকতেই পারে না; তো আমি কোন ছার যে বলব, “এটা এরকম”, এবং “ওটা ওরকম নয়”। কেন না, বিজ্ঞানের সমস্ত গবেষণা ও মনীষীদের সুদূরতম ভাবনাচিন্তার সাথে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করার পরেও আমাদের দুঃখ ও হতাশার সাথে শেষ অবধি মেনে নিতে হয় যে বিনয়ই সর্বোচ্চ জ্ঞানের পরিচায়ক, কারণ জ্ঞানের মধ্য দিয়েই মানুষ তার অজ্ঞতাকে চিনতে পারে।” প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রের বিদ্যা-বিনয় সহসমীকরণ (বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্‌) এবং গ্রিস দেশের এক মহাজ্ঞানীর অজ্ঞতার স্বীকৃতি যেন এখানে কোরাসে বেজে ওঠে।

    নাস্তিক তিনি ছিলেন না, তাই কলেজের পাঠ দানের সময় বা বাইরের সভাসমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে তাঁর নাস্তিকতা প্রচার করার প্রশ্নই ওঠে না। নিজেও তিনি ছিলেন সংশয়বাদী, তাই শুধু চেয়েছিলেন ছাত্রদের মধ্যে একটা কৌতূহলী মন, জিজ্ঞাসু মনন গড়ে তুলতে। তারা নিজেরা বিচার করে সিদ্ধান্ত নেবে, ঈশ্বর আছে না নেই, সতীদাহ প্রথা ভালো না খারাপ, আচার বিচার পালনের প্রয়োজন আছে কিনা, ইত্যাদি। তিনি শুধু জানবার ইচ্ছা এবং সত্য জানার পথটা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাতেই এত হৈচৈ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

    আজ তথ্যানুসন্ধান করতে করতে বারবার মনে হয়, ডিরোজিওর ছাত্রদের সম্পর্কে যা সেদিন প্রচার হয়েছিল, যার অনেক কিছুই আজও আমরা নির্বিচারে সত্য বলে ধরে নিই, তার সবটা সম্ভবত সত্য ছিল না। তারা সকলেই গরুর মাংস খেয়ে হাড়গুলি ব্রাহ্মণদের বাড়িতে ছুঁড়ে ফেলত—একথা সত্য নয়। এরকম ঘটনা হয়ত এক আধবার ঘটেছিল। কিন্তু প্রচার হয়ে গেল, তারা সব সময় এরকমই করত। প্রচারটাকে ভালো করে যাচাই না করেই মেনে নেওয়া হল, তার ভিত্তিতে ডিরোজিও, তাঁর আন্দোলন এবং তাঁর ছাত্রদের মূল্যায়নও হয়ে গেল, তারা সদিচ্ছা নিয়েই অনেক “বাড়াবাড়ি” করেছিল। তথ্য কিন্তু অন্য রকম বলছে। মৃত্যুর তিনমাস আগে নিজের পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশে লিখলেন, “প্রতিপক্ষকে কটু ভাষায় গালাগাল দিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। . . . দেশীয় প্রগতির একজন সুহৃদ হিসাবে এই জাতীয় মনোভাব দেখে বেদনা বোধ করছি; গালাগালি নয়, চাই পরস্পরের মধ্যে সৌজন্যমূলক ব্যবহার।” প্যারিচাঁদ মিত্র (১৮১৪-৮৩) তাঁর সম্বন্ধে লেখেন, “He used to impress upon his pupils the sacred duty of thinking for themselves—to be uninfluenced by any of the idols mentioned by Bacon—to live and die for truth—to cultivate and practise all the virtues shunning vice in every shape.” কৃষ্ণ মোহন (তখন তিনি সদ্য খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন) ১৮৩৫ সালে তাঁর নিজের পত্রিকায় লেখেন, “ডিরোজিও কখনও বলেননি, তুমি নাস্তিক হও, উচ্ছৃঙ্খল হও। বরং তিনি বলতেন, তুমি জিজ্ঞাসু হও, উচ্চ নৈতিক আদর্শের উপর জীবনের প্রয়োজনবোধকে স্থাপন কর। নাস্তিকতা বড় মূল্যবোধের পরিপন্থী নয়।”

    আসলে এই ভুল ধারণাটা শুধু বাংলার রক্ষণশীল সমাজপতিরাই প্রচার করেছে তা তো নয়। ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে যুক্তিবাদের পাশাপাশি যেভাবে স্বাধীনতার আদর্শ দেশের প্রতি ভালোবাসা জেগে উঠছিল, তাতে শাসকদেরও ভয় পাবারই কথা। ভয় ধরতে যে শুরু করেছিল, তার কিছু প্রমাণও আছে। আলেকজান্ডার ডাফ অনুযোগ করেছেন, ডিরোজিওর ছাত্ররা কোনো কিছুতেই বিশ্বাস রাখছে না, সব কিছুতেই তারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। তাঁর জীবনীকার স্মিথ সাহেব এক অদ্ভুত তথ্য দিলেন, এদের দেখেই নাকি ভালো ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে মার্কিন ব্যবসায়ীরা টমাস পেইনের বইপত্র কলকাতায় আনছে। (আসলে পেইনের বই ১৮১০ সাল থেকেই এদেশে আসছিল, বিক্রি জমে যাচ্ছিল বলে)। শ্রীরামপুরের বিশপ কোরি জানালেন, “হিন্দু কলেজ যারা স্থাপন করেছিল তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে চলেছে, এর ছাত্ররা অনেকেই সমস্ত ভালো জিনিসকে দূর-ছাই করছে।” বড়লাট বেন্টিঙ্ক সাহেবকে সাবধান করে দিলেন, “ওরা শুধু জাতপাত ভেঙে ফেলছে তাই নয়, ব্রিটিশ স্বার্থকেও বিনষ্ট করতে চাইছে।” ১৮৩০ সালে চিঠি লিখে আরও বিশদভাবে লাটকে বোঝালেন, “The young men say, they will no longer be guilty of the hypocrisy of upholding Hindooism. Christianity they have been warned against as an English prejudice; and they seem to hate Christianity and England heartily.” সবচাইতে স্পষ্ট ভাষায় ডাফ বলেছিলেন কাজের কথাটা: “When discussions in science and government happen to come up, France is eulogized undoubtedly, not England; which, if referred to, is always depreciated. Thus our rulers are preparing a scourge for their own backs.”

    সত্যিই তো! কী সাংঘাতিক ভেবে দেখুন। হিন্দুদের জাত আর ব্রিটিশদের ভাত এরা একসঙ্গে মারতে চায়! এদের বেশি বাড়তে দিও না।

    আর সে ভয় এদের নিতান্ত অমূলক ছিল না। ক্যালিডোস্কোপ নামক পত্রিকায় সিপাহি বিদ্রোহের ২৭ বছর আগে, ১৮২৯ সালের এক সংখ্যায় ডিরোজিও তাঁর একটি নিবন্ধে লিখলেন, “সাধারণভাবে বিচার করলেও সকলেই বুঝতে পারবেন যে কেবলমাত্র সামরিক সৈন্যবাহিনীর দ্বারা এই দেশকে পদানত করে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করুন; দেখবেন, ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থন করার পরিবর্তে ভারতবাসী সাম্রাজ্য ধ্বংসের জন্য বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।” ডিরোজিওর মৃত্যুর পরে তাঁর যে শেষ কবিতা ১৮৩২ সালের এক সঙ্কলন গ্রন্থে ছাপা হয় তার নাম ছিল Independence। তার শেষ স্তবকে লেখা ছিল,

    And wilt thou tremble so, my heart,
    When the mighty tyrant breathe on thee?
    And shall thy light like this depart?
    Away! it cannot be.

    তাঁর আর এক ছাত্র, কৈলাশ দত্ত, হিন্দু কলেজে পড়ার সময়, ১৮৩৫ সালে (তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর) বার্ষিক পরীক্ষায় এক অসাধারণ রচনা লিখেছিল, যার শিরোনাম A Journal of Forty-eight Hours in the Year 1945 (সন ১৯৪৫-এ আটচল্লিশ ঘন্টার এক রোজনামচা)। তাতে দেখা গেল, ১৯৪৫ সালে হিন্দু কলেজের ছেলেরা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে; তারা বলছে, “Let us unfurl the banner of freedom and plant it where Brittania now proudly stands.” তাদের নেতাকে পরের দিন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী গ্রেপ্তার করে বধ্য ভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে, আর সে তখন বিদ্রোহীদের উদ্দেশে শেষ বার্তা জানাচ্ছে, “I have shed my last blood in defence of my country, and through the feeble spark within my frail frame, I hope you will continue to persevere in the course we have so gloriously commenced.”

    ১৯৪২-এর ভারত-ছাড়ো আন্দোলন, ১৯৪৪ সালে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযান, ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহ এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতালাভের ক্যালেন্ডার হাতের কাছে রাখলে এক ডিরোজিও-ছাত্রের এই রচনাটির তাৎপর্য কেমন অন্যরকম হয়ে ওঠে! এরকম উদাহরণ আরও ভুরি ভুরি দেওয়া যায়। এগুলো সামনে রাখলে তবেই বোঝা যাবে, কেন সেদিন ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পাশাপাশি কোম্পানির শাসনের মুখপাত্ররাও ডিরোজিয়ানদের বিরুদ্ধে নানাভাবে বিষোদ্গার করে তাদের সম্পর্কে এদেশের জনমানসে একটা দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ মনোভাব গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিল।

    অথচ হিন্দু কলেজের এই শিক্ষকের নিজের জীবনের মূল্যবোধ কেমন ছিল? এই প্রশ্নটাও গুরুত্বপূর্ণ। আর নৈতিক মূল্যবোধ যতটা বড় কথা বড় ভাবের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ফুটে ওঠে চলমান জীবনের ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে। এখানে এরকম দুটো ঘটনার কথা বলে ফেলি।

    রাম গোপাল ঘোষ ছাত্রাবস্থায় (বয়স তখন ১৫) একদিন এই গুরুর কাছে লকের দর্শন বুঝতে বসেছিলেন। সেই সময় তিনি এক বেফাঁস মন্তব্য করে বসেন, “জন লকের জিহ্বাটা শিশুর মতো, আর মাথাটা অতিবৃদ্ধ প্রবীণের।” গুরু কিন্তু বাক্যটিকে স্মরণে রেখেছিলেন। কিছু দিন পরে এক প্রবন্ধে লকের দুরূহ কথাকে সহজ করে প্রকাশ করার ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি তাঁর এই ছাত্রের নাম ও তার এই মন্তব্যের উল্লেখ করে বলেন, “I have never heard anything better said of Locke.” মন্তব্যটি কিন্তু তিনি তাঁর নিজের নামে চালিয়ে দেবার কথা ভাবেননি। দিলে হয়ত কেউ কখনও জানতেও পারত না।

    তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ১৮২৯ সালের এক দিনের লেখা একটি ঘটনার কথা ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট ১৮৩৫ সালে প্রকাশ করে: “১৯ অক্টোবর একটি ছাত্রকে আমি বকলাম, সে অসত্য বলেছে এই ধারণায়। পরে বুঝতে পারলাম, ভুলটা আমারই। পরের দিন সারা ক্লাশের সামনে আমি আমার অপরাধ কবুল করলাম। কেউ কেউ বললেন, এইসব করে আমি ছেলেদের বেশি আস্কারা দিই। আচ্ছা, এর থেকে কম আর আমি কী করতে পারতাম? আমিই তো ছেলেটির আঁতে ঘা দিয়েছিলাম। সে ক্ষতিপূরণ তো আমাকেই করতে হবে।” এত বড় দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষক সমাজে এই রকম দুঃসাহস আজও কতজন দেখাতে পারেন?

    মনস্বী শিবনারায়ন রায়ের (১৯২১-২০০৮) এই মন্তব্যটি সুতরাং মনে রাখতেই হয়, “বিজ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে বিবেকিতার অনুবন্ধী সম্পর্কের এই আদর্শ কলকাতার তরুণ ছাত্রসমাজে উনিশ শতকের সূচনায় প্রবর্তন করেন ধর্মতলা অ্যাকাডেমির দার্শনিক শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ড এবং তাঁরই প্রিয় ছাত্র হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তরুণ ছাত্রদের তাঁরা শুধু মুক্তবুদ্ধির চর্চায় দীক্ষিত করেননি। বাক্যের সঙ্গে কর্মের, আদর্শের সঙ্গে আচরণের, ঘোষিত বিশ্বাসের সঙ্গে জীবনযাত্রার ঐক্যসাধনেও তাঁরা তাদের অনুপ্রেরিত করেছিলেন। এই দুই আদর্শ শিক্ষকের প্রভাবে এবং ডিরোজিও শিষ্য ‘ইয়ং বেঙ্গল’ তরুণদের উদ্যোগে কলকাতার শিক্ষিত সমাজে যে নৈতিক-বৌদ্ধিক রূপান্তরের সম্ভাবনা সূচিত হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র এবং অক্ষয়কুমারের চারিত্রিক বিকাশে তারা সহায়ক হয়।”
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৮ আগস্ট ২০১৬ | ২৩৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Soumyadeep Bandyopadhyay | 193.83.235.87 (*) | ১৮ আগস্ট ২০১৬ ১২:৪১55743
  • বাহ লিখেছিলাম :(
  • Soumyadeep Bandyopadhyay | 193.83.235.87 (*) | ১৮ আগস্ট ২০১৬ ১২:৪১55742
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন