এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায় স্বপ্ন 'মধু'র মোহে

    Sumeru Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ মে ২০১৬ | ২৪৯৬ বার পঠিত
  • বলে লাভ নেই, ভদ্দোরলোকের কুঞ্জ দোষ ছিল। কথায় কথায় জোকার দিয়েছেন, কুঞ্জবন অযথা শিহরিত বা ফালতু হম্বি তম্বি কুঞ্জ সাজাও গো, কুঞ্জের মাঝে কে গো রাধে, কে গো রাধে/ ললিতায় বলে রাধার বন্ধু আসিয়াছে। তাই আমাদের কল্পনায় এই কুঞ্জ খুব নম নম ভাব করে করে ফেললে হবে না, লতা পাতা, ফুল, ফল, পাখি, ছোট্ট ছোট জীব ঘুরছে, উড়ছে এমনই এক দেশ তৈরি করা হবে, শ্রীরাধিকার বাড়ির গায়ে। এ যেন সঙ্গীত সাবানের বুদবুদে রং উড়িয়ে সুরের গায়ে চিনির দানার মত কথা সাজাচ্ছেন, খাঁটি জহুরি। সখি গো একা কুঞ্জে বসে আমি পথ পানে চাইয়া/ নড়িলে গাছের পাতা উঠি চমকিয়া। এই কুঞ্জ এক মায়াপুরি, এই কুঞ্জ প্রভাত থিয়েটার, এই কুঞ্জ রামোজি ফিল্ম সিটি। কদাচ কালো কাঁচে ঢাকা গাড়ির কাঁচ সরিয়ে নেমে আসছেন দিল ধক ধক প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। কুঞ্জে না রহিহ রাধা, কুঞ্জে না রহিও / নয়নের সাধ মিটিলে তবে তুমি যাইও। উফ, টর্চারের অন্য নাম হয়ে কতিপয় সখ ও আহ্লাদের প্রকরণগুলি এই ভাবে জমা হয় কুঞ্জে, ঘাস বোনা হয়, সোনিয়া মির্জার ব্যাক হ্যান্ড রিটার্নে মালতী লতা বৃষ্টির ভারে দুলে ওঠে, কদাচ শিশিরে সূর্যোদয়, সুর বিকশিত হয়, নিদ্রিত ফুলের ঘুম ভাঙ্গায় বাউল প্রজাপতি। বীরভূম জেলার সপ্তগ্রামের মানুষ নরহরি দত্ত ছিলেন রাজা মহীপালের সভা চিকিৎসক। সেটা দশম শতাব্দী, তার নাতি চক্রপাণি দত্ত সেই বাজারে দুইখানা বই লিখেছেন, আয়ুর্বেদদীপিকা ও ভানুমতী। চক্রপাণি দত্ত রাজবৈদ্য ছিলেন সিলেটের রাজা প্রথম গোবিন্দকেশব দাসের। এই বংশের আরও ১৪/১৫ দফা পরের কুলপ্রদীপ রাধারমণ, ফ্যামিলি বিজনেস চিকিৎসার ধার ও মাড়ালেন না, সংগীতে মগ্ন হয়ে পড়লেন।

    আমি আজ কুঞ্জবন দেখতে চলেছি। রাস উৎসবের অনেক আগে থেকেই প্রসেঞ্জিৎ মহাপাত্রের নেমন্তন্ন ছিল, তার বাবা রাধাগোবিন্দ মন্দিরের প্রধান সেবাইত, প্রসেঞ্জিৎ দুটো কলেজে পার্ট টাইম পড়ায় আর এদিক ওদিক ইন্টারভ্যু দেয়, স্বভাবে কবি। তাই রিষড়া স্টেশনে নেমে নৌকো পেয়িয়ে খড়দা। গঙ্গার ঘাটের কাছেই রাসমেলা। মন্দির সাজানো হচ্ছে। মেলা বসেছে, পেরেকের ঠোকাঠুকি, ঘাম রোদ্দুর ইত্যাদি, কুঞ্জ মোটামুটি এখন জোহানেসবার্গে। বাপ্পাদা আসছে দমদম থেকে কাজেই সোদপুর হয়ে আসবে। আমি আর প্রসেঞ্জিৎ মন্দিরে একঘুল্লি ঘুরে ঠিক করি, চমৎকার, ধরা যাক দু এক বোতল বিয়ার এবার। প্রথমে ঠিক হোয় এক পেটি তুলে বসা হবে বিটি রোডের উপর এক সনাতন ঠেকে, ওরে ব্বা ব্বা সে এক তিন দিক ঘেরা ধোবার ঘর, তাতে উনুনে সার সার ইস্ত্রি গরম হচ্ছে আর এক চার ফুটের মানুষ সেগুলো নিয়ে বেঠোভেনের মত জামা কাপড়ে মগ্ন। আমকে পাত্তাই দিল না। ঢুকে মনে হল সূর্যের অন্দরমহলে ঢুকেছি, ছিটকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে দেখলাম বেটার, দুপুর দুটোয় পিচ আইসক্রিমের মত গলছে। সুতরাং গন্তব্য বদলে সোদপুরের নীলমণি এসি বার। আহ, নিজেকে আর কি বলব, আহ ঠাণ্ডা বিয়ারকেই মনে হচ্ছে শ্রীরাধা, মহাজাহতিক মোক্ষ লেবেলের কিছু একটা, আমি শিক্ষামন্ত্রী হলে তখনই মিড ডে মিলে দু বোতল কর চিলড বিয়ার গরমকালে মাস্ট করে দিতাম। টপাটপ বিয়ার নামছে, অফিশিয়ালি আমরা এখানে ওয়েট করছি বাপ্পাদার জন্য। সে রেকর্ডার মাইক্রোফোন নিয়ে আসছে। ন্যাড়া-নেড়ি সমপ্রদায়ের কীর্তন রেকর্ড করা হবে। এরা নিত্যানন্দের ফলোয়ার। তিনি গৌড়ীয় মত অনুসারে বলরামের অবতার, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ও অন্তরঙ্গ পার্ষদ বা সঙ্গী। তাদের পারিবারিক কবরস্থল আছে খড়দায়। এদের দাহ করা হয় না, কবর দেয়া হয়। রাধারমণ মারা গেলে তার ইচ্ছা অনুসারে তাকেও দাহ না করে কবর দেওয়া হয়েছিল, নালুয়া হাওরে তার বাড়ির পাশে।

    আমাদের বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল। সূর্য ডুবে গেছে ঘণ্টা তিনেক। তিনজনে টলমল করে এগোচ্ছে ভিড়ের দিকে। যে রাস্তায় রাস যাবে সেখানে কাতারে কাতারে মানুষ অপেক্ষারত। সদা করছে ঘুগনি চপ ও ফুচকার দোকান। প্রসেঞ্জিৎ এর কাকার ছেলে সুরজিত ও এসে যোগ দিয়েছে। তার ভিড়ে কিঞ্চিত আগ্রহ বেশি। আমরা পাত্তা দিই না, ঘুর পথে একবার গিয়ে দাঁড়াব গঙ্গার ঘাটে, একটু হাওয়া আর বিয়ারের থলি হালকা করা প্রয়োজন। সুতরাং রাসযাত্রা। এই সব রাস্তা শুনশান। উপরে চাঁদ, সঙ্গী আমরা আমরাই। কয়েকটি অস্থায়ী বই এর দোকান পর পর , ঐ লালে দুনিয়া কাঁপানো দশদিন টাইপ, কমলায় শ্যামাপ্রসাদ, সবুজে কনকাঞ্জলি ও বাকী পঞ্চাশ মমতাশ্রয়ী। আমাদের তাড়া আছে ভাই। বাকি রয়েছে আমাদের কুঞ্জ দর্শন, গান টান রেকর্ডিং সেদিন হয়নি বলাই বাহুল্য। ফুচকা, মাংসের চপ ইত্যাদি খাওয়া হল মেলায়। আমরা স্টেডিই আছি, চাঁদটাই যা মাঝে মাঝে দুলছে, একবার ঘুরে এলাম মন্দিরের সামনে। এখনও ফাঁকা। সামনে বাংলার বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে, বাচ্চারা ভেঁপু নিয়ে বুভুজেলা বাজাচ্ছে, মন্দিরের প্রধান দ্বারে টানানো হয়েছে সাদা নেট, তাতে ঝুলছে নানা শোলার পুতুল কলার কাঁদি, কাঁঠাল, আনারস, মাছ, নৃত্যরতা, তোতাপাখি থেকে শুরু করে আরও অনেককিছু, সেজে উঠেছে কুঞ্জ। আমি বাংলাদেশকে দেখতে পাই, দিনাজপুর, ভোলা, খুলনার ডুমুরিয়া, চট্টগ্রামের রাউজান, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে মেলা, কবিগানসহ নানা আয়োজন রাস উৎসবে - তারসানাই এর সুর কানে আসে, বাপ্পা দা বলে ওঠে রাধারমণ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ মে ২০১৬ | ২৪৯৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ekak | 53.224.129.43 (*) | ১৩ মে ২০১৬ ০৫:৪৭53715
  • বাহ । আর এই কুঞ্জ ব্যাপারটা বেশ ইয়ে !
  • Prativa Sarker | 11.39.36.224 (*) | ১৫ মে ২০১৬ ০১:০৯53716
  • কি দারুণ লেখার স্টাইল আর বিষয় বৈচিত্র। পড়লেই এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে। এই পাগলামোগুলো আমার খুব পছন্দ, হয়তো সারা জীবন করা হলো না বলেই।
    আর ঐ কুঞ্জ কারণে কিনা জানি না একটা গান গুনগুনিয়ে উঠলো মনের ভেতর ---তোমারও রাগিণী জীবন কুঞ্জে বাজে যেন সদা বাজে গো...।
    এই পাগলামিগুলোই রাগিণীটাকে বাজায় গভীর ভাবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন