‘আমরা আর তোমরা’র গল্পঃ একটি মিঠেকড়া আলাপন
ওরা থাকে ওধারে
আমরা-ওরা এই শব্দযুগলের ধারণাটি অনেক পুরনো। ছোটবেলা থেকেই শিখে ফেলি--ওরা খারাপ, ওদের সঙ্গে খেলতে যাবি না। হ্যাঁ, বড়রা শিখিয়ে দেয়। এখন বড় হয়ে গিয়েও রেহাই নেই। আমার থেকে আরও বড়রা শেখাচ্ছেনঃ
‘আমরা ভাল লক্ষী ছেলে,
তোমরা ভারি বিশ্রী,
তোমরা খাবে নিমের পাঁচন,
আমরা খাব মিশ্রী।
খেয়াল হয়, বুড়ো হয়েছি। তাই মাথায় নানান চিন্তা।
বিদেশ থেকে আসা এক ছোটবেলার বন্ধুকে ধরলাম।
আচ্ছা, আমরা মানে কী? আমরা বলতে ঠিক কাদের বোঝায়?
-এটা কোন কথা হল? আমরা মানে আমরা। মানে যারা একইরকম। আর ওরা মানে যারা আমাদের মত নয়, অন্যরকম।
কোন মাপকাঠিতে এক? লম্বায়, গায়ের রঙে? নাকি ভাষায়? অথবা ধর্মে?
--সবগুলোই মাপার একক হতে পারে, অবস্থা বুঝে।
বুঝলাম না।
--যখন যে মাপকাঠিতে যাদের সঙ্গে মেলে, তারা হবে ‘আমরা’। যেমন, স্বদেশ আর বিদেশ। স্বদেশের লোকজন আমার জন্যে ‘আমরা’। আর বিদেশের লোকজন আমার চোখে ‘ওরা’। বিদেশ যাত্রার জন্যে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়ালে যাদের একই দেশের পাসপোর্ট আছে তারা হল ‘আমরা’। যারা ‘আমরা’ নয়, তারা সবাই ‘ওরা’।
আবার যাদের আমেরিকান ভিসা আছে , তারা একধরণের ‘আমরা’। আবার যাদের শেনগেন ভিসা, তারা অন্যধরণের ‘আমরা’। যেমন আমেরিকানদের জন্যে সমস্ত আমেরিকান নাগরিক ‘আমরা’ আর বাকি সবাই ‘ওরা’।
তাই ? তাহলে ওদের দেশে সাদা মানুষ কালো মানুষ সবাই ওদের জন্যে ‘আমরা’, একই আইন, একই ব্যবহার।
--সে আর বলতে!
তাহলে মাঝে মধ্যেই কালোদের প্রতি আমেরিকান পুলিশের ব্যবহার আইন না মেনে বর্বরতার মাত্রা ছাড়ায় কেন? ‘ব্ল্যাক লাইভস্ ম্যাটার’ আন্দোলনে লাখে লাখে কালো মানুষদের পথে নামতে হয় কেন?
--সেটাই তো কথা। তখন বুঝতে হবে অবস্থা বিশেষে আমেরিকান পুলিশের চোখে সমস্ত সাদা আমেরিকান ‘আমরা’ হয়ে গেছল, আর ‘কালো’রা ‘ওরা’।
তাই বলে কালো আমেরিকানকে অমন করে মেরে ফেলতে হবে? ও যে বারবার বলছিল—শ্বাস নিতে পারছি না!
--সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, ‘আমাদের’ জন্যে আছে আদর ভালোবাসা প্রাণের টান। আর ‘ওদের’ জন্যে বিরক্তি, তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা।
দেখ, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাংলা ব্যাকরণের বইয়ে দুটো প্রত্যয়ের – টি এবং টা—ফারাক বোঝাতে গিয়ে উদাহরণ দিয়েছেন। ধর, দুটো বাচ্চা উঠোনে খেলছে। কিন্তু আমাদের চোখেঃ
মোদের বাড়ির ছেলেটি,
নাচে যেন ঠাকুরটি।
ওদের বাড়ির ছেলেটা,
লাফায় যেন বাঁদরটা।
বুঝলাম, কিন্তু এই একরকম আমরা ভেঙে অন্যরকম আমরা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক কেমন যেন লাগছে। চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার সব নাগরিক ছিল ‘আমরা’। আবার ঘরের মধ্যে সাদা আমেরিকান ‘আমরা’ থাকল, কিন্তু ‘কালো’ আমেরিকান হঠাৎ ‘ওরা’ হয়ে গেল। আবার গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে একই আমেরিকার নাগরিক সমাজের ভেতর ‘আমরা’ ‘ওরা’ গজিয়ে উঠল!
- না বোঝার কী আছে। যেমন বোম্বাই বা কর্ণাটকের বিরুদ্ধে রণজি ক্রিকেটে সব বাঙালী এককাট্টা। তখন ‘আমরা বাঙালী’। কিন্তু ডার্বি ম্যাচে বাঙালদের জন্যে ইস্টবেঙ্গল হল ‘আমরা’ আর মোহনবাগান হল ‘ওরা’। আর ঘটিদের জন্যে ‘মোহনবাগান’ হল ‘আমরা’, ইস্টবেঙ্গল ‘ওরা’। নিজেদের ঘরের মধ্যে বাপের বাড়ির লোকজন হল আমরা আর শ্বশুরবাড়ির সবাই ‘ওরা’ বা অপর। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এতদিন ধরে পাশাপাশি থাকা ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক এক পলকে ‘আমরা’ থেকে ‘ওরা’ হয়ে পরস্পর বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে।আরে অন্যে পরে কা কথা, সাম্যবাদের আদর্শে দীক্ষিত নেতাও একসময় "আমরা ওরা"র কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন।বলে ওঠেন, "আমরা ২৩৫, ওরা ৩০।
বুঝেছি, এই বিভেদের ব্যাপারটা আবহমান কাল থেকে রয়েছে। ঋগবেদের সময়ে বহিরাগত বিজয়ী আর্যরা এদেশের স্থানীয় অধিবাসীদের অনার্য, দাস, দস্যু বলে নাক সিঁটকেছেন। এমনকি পণি বলে তৎকালীন বণিক গোষ্ঠীও এই ঘৃণার আক্রমণ থেকে বাদ পড়েন নি।
--সমগ্র খৃষ্টান ইউরোপে ইহুদীরা ব্রাত্য, এবং নির্যাতন ও নির্বাসনের শিকার।
ওদের বিরুদ্ধে এই জাতক্রোধের কারণ --আরে, ওরাই তো আমাদের যীশুখৃষ্টকে ক্রুশে চড়িয়েছিল—গোছের ভাবনা।
সে তো কোন যুগে; তার জন্যে দু’হাজার বছর ধরে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে? এটা কোন কথা হল!
--আচ্ছা! এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? আমাদের দেশেও কি মুসলমানেরা ‘অপর’ নয়? ওদেরও কি বাইরে থেকে আসা বিদেশি বর্বর আক্রমণকারী বলা হয় না?
বটেই তো। কয়েকশ’ বছর আগে মোগল পাঠানের দল মন্দির ভেঙেছে, লুঠতরাজ করেছে এবং হত্যা ও ধর্ষণ করেছে বলে আজ সব মুসলমানকে সন্দেহের চোখে দেখা হয় না? ওদের থেকে প্রতিপদে দেশের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রমাণ চাওয়া হয় না? কথায় কথায় – ‘মিঞা তুই পাকিস্তানে যা’—বলা হয় না!
--কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আসলে ওরা ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করালো এবং যার ফলে প্রচুর মানুষ প্রাণ, সম্মান এবং ভিটেমাটি হারিয়ে পথে নামল। কাজেই সাধু সাবধান!
এরা যেখানে সংখ্যালঘু সেখানে মাথা নীচু করে থাকে। কিন্তু কোন এলাকায় বা জেলায় ঘেট্টো বানাতে পারলেই ওদের হাবভাব বদলে গিয়ে সিঙ্ঘি অবতার হয়ে ওঠে। ওদের বাড়তে দিলে ফের দেশভাগ হবে, সেটা কি ভাল কথা? তুমি সেকুলার সেকুলার বলে গলা ফাটাও আর এদিকে ধর্মীয় উন্মাদদের দেশ ভাগ করাকে জনগণের ইচ্ছে বলে সমর্থন কর!
আর এরা কি বহিরাগত? লুটেরা?
--অবশ্যই। ওরা কি বাইরে থেকে আসেনি? মহম্মদ বিন কাসিম অষ্টম শতাব্দীতে সিন্ধু নদের ওপার থেকে এসে হিন্দু রাজা দাহিরকে পরাজিত করে ভারতে ঢোকেনি? আর পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাবর? ও কি উজবেকিস্তানের ফরগণা উপত্যকার লোক নয়?
তাহলে আমার একটা প্রশ্ন; এই যে তুমি ভারতের আই আই টি থেকে যোগ্যতার সঙ্গে পাশ করে আমেরিকায় গিয়ে সিলিকন ভ্যালিতে ভাল চাকরি করছ, ওদেশে বাড়ি গাড়ি হয়েছে, সম্মানের সংগে সপরিবারে দিব্যি আছ— তুমি কি বহিরাগত লুটেরা?
কেন নও? তুমি তো আমেরিকার বাইরে থেকে এসে ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে ডলার কামিয়ে ভারতের ব্যাংকে পাচার করে আমেরিকার তুলনায় বেশি ইন্টারেস্ট কামাচ্ছ? তোমারও লাভ, ভারতেরও লাভ। এদেশের বিদেশি মুদ্রা ভান্ডার তোমার মত লোকেদের জন্যে ই ফুলে ফেঁপে উঠছে।
কিন্তু একজন নিম্নবিত্ত আমেরিকানের জায়গা থেকে দেখ। সে দেখছে তুমি তার রোজগারে ভাগ বসিয়েছ। কোম্পানি কম টাকায় তোমাকে আউটসোর্সিং করে একজন পড়াশুনো করা আমেরিকান যুবকের পাতে জল ঢেলে দিয়েছে।
--বাজে কথা। আমি এখন ওদেশের নাগরিক, রীতিমত ট্যাক্স দিই। আমার এবং আমাদের মত অনেক প্রবাসী ভারতীয়র টাকায়, সে যত ভগ্নাংশই হোক, ওদেশের রাষ্ট্র পরিচালিত হয়; অনেক সামাজিক কল্যাণের কাজ হয়। আর আমার কারিগরি দক্ষতা আজ আমেরিকার মত দেশের উন্নয়ন এবং সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়ক। আমি কেন লুটেরা হব? লুটেরা হল ওরা যারা একদেশের সম্পদ ছলেবলে কৌশলে, বিশেষ করে রাষ্ট্র ক্ষমতার পেশিবলে, নিজের দেশে নিয়ে যায়।
তাহলে দুটো কথা।
এক, তোমার সংজ্ঞা মানলে বলতে হয়-- লুটেরা হল ইংরেজ; মুসলমান বা তুর্কিরা নয়। বাবর হোক বা ইব্রাহিম লোদী, এদেশ থেকে সোনাদানা, ধনসম্পদ, ময়ুর সিংহাসন ইংল্যান্ডে কে নিয়ে গেছে? ক্লাইভের সময় থেকে প্রতি বছর ইংল্যাণ্ডে কর আদায়ের কত বড় হিস্যা ব্রিটেনে গেছে এবং ভারতের হস্তশিল্প ধ্বংস করে ওদেশের শিল্প বিপ্লবে সহায়ক হয়েছে। আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ ও প্রাণহানির খতিয়ান?
--থামো, থামো। গজনীর সুলতানের সতেরোবার সোমনাথ আক্রমণ এবং সোনাদানা লুঠ করে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ভুলে গেলে?
দেখ, মহম্মদ ঘোরী নিশ্চয়ই লুঠেরা, ও তো এদেশের ক্ষমতা দখল বা সাম্রাজ্য বিস্তার করতে আসেনি। কিন্তু কয়েকশ’ বছর ধরে যে সুলতানি এবং মোগল শাসন—তারা এদেশেই রয়েছে। সম্পদ নিয়ে উজবেকিস্তান বা তুর্কমেনিস্তান চলে যায় নি তো!
ওরা বরং এদেশের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। ভারতে মুঘল শাসনকালে (১৫২৬-১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ) বিদেশি বাণিজ্য, কৃষির ও কর ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দেশের জিডিপি বা গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট ছিল বিশ্বের অর্থনীতির ২৫.১% । সুবে বাংলা ছিল সাম্রাজ্যের উন্নত কৃষি, জাহাজ নির্মাণ, রপ্তানি বাণিজ্যের সমন্বয়ে সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাজ্য।
[1] আর মুঘলেরা আকবরের সময় থেকে কৃষির উপর ফসলের প্রায় ৫০% কর ধার্য করে এবং বাণিজ্যের জন্যে ব্যাপক যাতায়াত ব্যবস্থা, দেশজুড়ে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে একই রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করে। তৎকালীন ভারতের পেশোয়ার থেকে কলকাতা অবধি বিস্তৃত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিল্লির মুসলিম শাসনের সময়ই ভাল ভাবে সংস্কার করা হয়
[2]।
কিন্তু বৃটিশ সাম্রাজ্যের সময় ঔপনিবেশিক লুঠের ফলে ভারতে শিল্পের ভ্রুণ অবস্থা মার খায় এবং ওরা দেশের অর্থনীতিকে এমন ছিবড়ে করে দেয় যে ১৯৫২ নাগাদ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ভারতের জিডিপি ৩% হয়ে যায়। এই বিষয়ে অর্থনীতির কেম্ব্রিজ ইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গাস ম্যাডিসনের গবেষণার সঙ্গে মনমোহন সিং সহমত।
[3]--আরে জিডিপি বেড়েছিল তো কি হয়েছে, ভারতের কৃষকদের অবস্থা কি ভাল হয়েছিল? ফসলের ৫০% খাজনা দিয়ে চাষির হাতে কী থাকে? মোগল সম্রাটরা বিলাসব্যসনে দিন কাটাতেন, স্মৃতিসৌধ, প্রাসাদ বানাতেন। তাজমহল বা লালকেল্লা দেখে কেউ তখনকার কৃষকদের অবস্থা বুঝতে পারবে?
তাহলে ফের দুটো কথা বলতে হচ্ছে।
এক, তখন চাষ করতে খরচ খুব কম হত, পরিশ্রমটাই ছিল আসল। কোন কেমিক্যাল সার বা পোকা মারার ওষুধ দেয়া হত না। বীজধান কিনতে হত না। তাই ৫০% খাজনা দিয়েও যা থাকত সেটা খুব কম নয়। আজকের সঙ্গে তুলনা কর।
এখন চাষের উপর আয়কর নেই। কিন্তু সমস্ত ইনপুট-- উচ্চফলনশীল বীজ, কেমিক্যাল সার, কীটনাশক কিনতে গেলে অপ্রত্যক্ষ কর বা জিএসটি, সেচ কর, মজুরি, বাজারে বিক্রি করতে গাড়িভাড়া সব জুড়ে দেখলে চাষির মাঝে মধ্যে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। তাই প্রতি বছর ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের দাবিতে বিভিন্ন রাজ্যের চাষিরা পথে নামে, একবছর ধরে পঞ্জাব, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানের চাষিরা রাজপথে ধর্নায় বসে।
চাষির আয় দ্বিগুণ হওয়ার প্রতিশ্রুতি এখন আরেকটি জুমলা হয়ে গেছে।
দুই, মানছি সম্রাটদের বিলাসব্যসন বা উঁচু মিনার দেখে চাষিদের অবস্থা বোঝা যাবে না। কিন্তু দিল্লীশ্বরদের ব্যাপারটাই ওই রকম-- স্মৃতিস্তম্ভ বানাবেই।
এখন যে ১৮২ মিটার উঁচু স্ট্যাচু অফ ইউনিটি এবং নতুন সংসদ ভবনের সেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরি হয়েছে তা দেখে কি কেউ আন্দাজ করতে পারবে যে আমাদের দেশের গত এক দশকে (২০১২-২১) তৈরি সম্পদের ৪০% মাত্র ১% লোকের কুক্ষিগত, ৫% ভারতীয়ের হাতে দেশের ৬০% সম্পদ; আর সম্পদের মাত্র ৩% চুঁইয়ে চুঁইয়ে তলার ৫০% জনতার কাছে পৌঁছয়?
[4]
--বেশ, তুমি বলতে চাইছ যে আমাদের পুরনো দুর্দশার জন্যে দায়ী বৃটিশ, আমাদের রাগ মোগলদের ছেড়ে ওদের উপরই বেশি হওয়া উচিত।
ঠিক তাই। অথচ, তোমাদের সাদা চামড়ার সায়েবদের নিয়ে কোন কথা নেই। কবে মোগল শাসন শেষ হয়ে গেছে। তারপর দুশো বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। যাতে ভালোর চেয়ে খারাপ বেশি হয়েছে। কিন্তু তোমরা ইতিহাসের চাকা পেছনে ঘুরিয়ে খামোখা প্রলাপ বকছ।
--- আমরা তো জিডিপি নিয়েই খুশি। বলতে থাকি – ভারতের জিডিপি ৩ ট্রিলিয়ন হয়ে গেছে। শীগগিরই বিশ্বে চার নম্বর থেকে তিন নম্বর (জিডিপির হিসেবে) স্থান দখল করবে!
হ্যাঁ, তোমরা এখন গত এক দশকে ভারতের জিডিপি বৈশ্বিক জিডিপি’র ৮.৭% হয়ে গেছে বলে খুশিতে ডগমগ, যদিও চিনের ও আমেরিকার অনুপাত ১৮.২% এবং ১২.৪%।
[5]কিন্তু যে কথাগুলো এড়িয়ে যাও তা হল--এত দশক পরেও আমাদের দেশের বেকারত্বের সূচক 7.33%
[6] আর বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে গত এক দশক ধরে গড় সূচক হচ্ছে 7.83% ; অর্থাৎ কর্মক্ষম এবং কাজ করতে ইচ্ছুক জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে সাত প্রতিশত লোক কাজের অভাবে বসে রয়েছে।
শুধু এই নয়, গরীবের জন্যে এত ভাল ভাল কথা এত সব যোজনা সত্ত্বেও ২২.৯ কোটি গরীব মানুষ আজ ভারতে বাস করে। এই একটা ব্যাপারে আমরা এগিয়ে। বিশ্বের কোন দেশে এত বেশি গরীব থাকে না। কোভিড মহামারীর প্রকোপ কমার পরও একবছর ৮০ কোটি মানুষকে বিনে পয়সায় র্যাশন দেওয়া হয়েছে। মানে সরকার মেনে নিয়েছে যে ১৪০ কোটির ভারতবর্ষে ৫৬% লোক নিজের জন্যে দু’বেলা পেটভরে খাওয়ার জোগাড় করতে অক্ষম!
এসব নিয়ে কোন চিন্তা নেই, খালি একে পাকিস্তান পাঠাও, তাকে পাকিস্তান পাঠাও! আর দেশের এই অবস্থার জন্যে নেহেরুকে দায়ী করা, ইংরেজকে নয়।
--কিছুই বোঝ নি। ইংরেজ তো চলে গেছে। ওদের সঙ্গে ঝগড়া করতে কি ইংল্যাণ্ডে দৌড়তে থাকব? কিন্তু মুসলমানরা রয়ে গেছে। একশ’ ঊনচল্লিশ কোটি লোকের দেশে ১৯.৭ কোটি মুসলিম, জনসংখ্যার ১৪.২%
[7] , ভাবা যায়!
এটা আমার মুখের কথা নয়, সংসদে শ্রীমতী স্মৃতি ইরানী, অল্পসংখ্যক বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী একটি প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন।
তাতে কী হল? ওদের এদেশের নাগরিক বলে মেনে নিতে বাধা কোথায়? তুমি যদি আজ আমেরিকায় গিয়ে গ্রীন কার্ড, পরে নাগরিকত্ব পেয়ে যেতে পার, তাহলে যারা দুই প্রজন্ম ধরে এই দেশে আছে, ভোট দিচ্ছে, চাকরি করছে, ব্যবসা করছে—ওদের মন থেকে স্বীকার করতে পারছ না কেন?
--মূল প্রশ্নে ফিরে এস। আমরা এবং ওরা। ধর্মের ভিত্তিতে একটু চোখ খুলে দেখ। আমাদের ভারত তিন টুকরো হল—দুপাশে দুই পাকিস্তান, মাঝখানে ভারত। ওদের ধর্ম আরবের মরুভূমির। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আলাদা। আমাদের সিন্ধু -গঙ্গা-যমুনার তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতা। তেলে-জলে মিশ খায় না।
উঃ এত বাজে বকতেও পারে। তোমার সিন্ধু নদ ও তার অববাহিকার বেশির ভাগটাই এখন পাকিস্তানের অংশ। মহাভারতের গান্ধার এখন কান্দাহার, পুরুষপুর আজ পেশোয়ার। এমনকি মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা-কালিবংগান ভারতে নয়, পাকিস্তানে।
তাহলে সেই ঐতিহ্য রক্ষার খাতিরে মিলেমিশে থাকা যায় না? মারামারি করতেই হবে?
--তাই তো বলছি। যদি ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে ভারত -পাকিস্তান হল তাহলে এপারের বৃহৎ অংশের নাম হিন্দুস্থান হবে না কেন? আশি প্রতিশত বড়, নাকি ১৪% ? বহুসংখ্যকের মত গুরুত্ব পাবে না – এটা কেমন গণতন্ত্র?
উফ, এবার একটু আমার কথাটা শোন।
বর্তমানের পাকিস্তান, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম জনসংখ্যা ১৯৪৭ সালে ছিল ৩.২৫ কোটি আর ২০০৬-০৭ সালে সেটা হয়েছে ১৫.৭ কোটি। আর ২০১৭ সালে ২০ কোটি (৯৬.৫%) এবং হিন্দু ৪৪ লক্ষ (২.১৪%) (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)
ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুয়ায়ী ছিল ৩.৫৪ কোটি (১০%), ২০১১ সালে ১৭.২ কোটি, এখন ২০২৩ সালে অনুমানিত ১৯.৭ কোটি (১৪%)।
মানে যে মুসলমানেরা ভারতে রয়ে গেল তারা পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম জনতার চেয়ে সংখ্যায় কম ছিল না। আর এখনও প্রায় সমান সমান।
অর্থাৎ যারা স্বেচ্ছায় দাঙ্গার আতংকের মাঝেও সাহস করে ভারতে রয়ে গেলেন, তারা জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বকে অস্বীকার করলেন এবং এই দেশের মাটিকে ভালবাসার প্রমাণ দিলেন। এঁদের একাংশ বিজ্ঞান সাহিত্য সঙ্গীত ও শিল্পকলার চর্চায় ভারতের মুখোজ্বল করলেন। ক্রিকেট, ফুটবল, হকির কথা ছেড়েই দিলাম। তারপরেও অবিশ্বাস?
যে মেষপালক কারগিল এলাকায় পাকিস্তানি অনুপ্রবেশের খবর দিল তার ধর্মীয় পরিচয় কী ছিল? ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের প্যাটন ট্যাংকের ঢাকনা খুলে ভেতরে গ্রেনেড ফেলে আত্মঘাতী প্রতিরোধে রুখে যে সৈনিক রুখে দাঁড়ালেন তার নাম হামিদ।
--দূর! ওসব বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রমী উদাহরণ দিয়ে কোন লাভ নেই। ‘ওরা’ ওরাই থাকবে, ‘আমরা’ হবে না। আমরা পূবমুখো, সুর্য তো পূবে ওঠে, ওরা নামাজ পড়ে পশ্চিমে মুখ করে। আমরা কীভাবে হাত ধুই আর ওরা কীভাবে ‘ওজু’ করার সময় হাত ধোয় দেখেছ? একেবারে উলটো।
মাইকেল ঠিক বুঝেছিলেন। তাই ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে ভক্তপ্রসাদের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন—তেঁতুল নয় মিষ্টি, নেড়ে নয় ইষ্টি!
তাই বলছি, যদি জনসংখ্যা অদলাবদলি হত, তাহলে সব মুসলমান ওপারে, সব হিন্দু এপারে। ব্যস, কোন দাঙ্গা হত না। কেমন? ঠিক বলেছি না?
দেখছি, তোমার মাথাটা একেবারে গেছে। যদি ধরেও নেই যে ওদের সঙ্গে আমাদের ফারাকটা খুব বেশি তাহলেও কি পাশাপাশি থাকা যায় না? ওরা ওদের মত করে থাকবে আর আমরা আমাদের মত ?
অনেকক্ষেত্রেই তো আমরা আজকাল ফ্ল্যাট বাড়িতে একে অন্যের ঘরে উঁকি মারি না, অনেক ক্ষেত্রে নাম পরিচয়ও জানি না।
না হয় ওদের ঘরে ঈদের দিন বিরিয়ানি বা ফিরনি খেতে গেলাম না, কোলাকুলি করলাম না। ওরাও বিজয়াদশমীর দিন বা দোলের দিন আমাদের বাড়ি এল না। তাতেও পাশাপাশি বা এক পাড়ায় কেন থাকা যাবে না? ওদের বাড়ি ভাড়া দেওয়া যাবে না? ওদের দোকান থেকে জিনিসপত্তর কেনা চলবে না? ড্রাইভার বা কাজের মাসি রাখার সময় তার ধর্ম পরিচয় বড় হয়ে উঠবে!
--উপায় নেই। একটু গৈরিক রাষ্ট্রবাদ বোঝার চেষ্টা কর। ভারতে শিক্ষার অভাব এবং আর্থিক পশ্চাদপদতার বিচারে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় কোনটি সে নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বেশি বেকার সবচেয়ে বেশি গরীব কোন সম্প্রদায়ে? সাচ্চার কমিটির রিপোর্ট যথেষ্ট সোচ্চার। তাই তারা যদি এদেশ ছেড়ে চলে যায় তাহলে এক ঝটকায় আমাদের দেশ দারিদ্র্যের সূচকে বেশ কিছুটা ওপরে উঠবে এবং আমাদের মাথা পিছু জিডিপির হারও অনেক বেশি হয়ে যাবে। তারপর ভারত নিজে নিজেই হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে যাবে। প্রায় হয়েই গেছে, তোমাদের মতন কয়েকজনকে বোঝানো বাকি, আর হাতে গোণা ক’জন না বুঝলেও কিছু আসে যায় না।
আর মানছি, সব মুসলমান টেররিস্ট নয়, কিন্তু গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টেররিস্ট কোন ধর্মের লোক? বোকো -হারাম এবং আইসিস কাদের সংগঠন? কাজেই যে কাজটা অসমাপ্ত রয়ে গেছে, সেটা আমাদের পুরো করতে হবে।
সেই কাজটা কী?
--“আর্য সনাতন বঙ্গভূমিতে রাখিব না আর যবন চিহ্ন”।
তাই বাবরি মসসজিদের পর ভারতে আরও পাঁচশ মসজিদ ভাঙা হয়েছে?
[8] এত ঘৃণা কেন?
-- মানুষ যুক্তি মেনে বিশ্লেষণ করে কাজ করে না। সে প্রেরণা পায় তার মানস জগতে মৌলিক আবেগের (basic emotion) তাড়নায়। যেমন, প্রেম, ভয়, আনন্দ, ঘৃণা এইসব।
তোমরা ঘৃণার শক্তি চেন না। প্রেম-ভালবাসা নয়, ঘৃণাই মানুষকে শক্তি যোগায় লড়াইয়ের ময়দানে শত্রুর মাথাটা ধড় থেকে এক কোপে নামিয়ে দিতে। সামনের লোকটাকে তুমি যদি মানুষ ভাব, তাহলে মারতে পারবে না, হাত কাঁপবে। আর যদি ওকে ইঁদুর, আরশোলা, কেঁচো বা সাপ ভাবতে পার তবে অনায়াসে মারবে। নিজের বাঁচার তাগিদে অপরকে মেরে ফেলবে।
হ্যাঁ, বোকো-হারাম, আইসিস বা তালিবানের মত সংগঠনের মানস জগতেও ঘৃণা স্বরাট। ঠিকই বলেছ, তীব্র ঘৃণা মস্তিষ্কের কোষে কোষে শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় দৌড়ে না বেড়ালে কোন বানু’র তিন বছরের বাচ্চাকে আছড়ে মেরে ফেলা যায় না, সেই গর্ভবতী নারীর সামনে তার পরিবারের অধিকাংশকে হত্যা করে তাকে গণধর্ষণ করা যায় না। ঠিক বললাম?
তা’ তোমার কল্পনার হিন্দুরাষ্ট্রে মুসলমানের জায়গা হবে না?
--মুসলমানেরা থাকতে পারে, যদি তারা পোশাকে আশাকে চলা ফেরায়, খাওয়াদাওয়ায় আচরণে বেশি মুসলমানপনা না দেখায়। অর্থাৎ ওদের মুসলমান বলে সহজে চেনা না যায়। ওরা থাকবে আমাদের দয়া ও শুভেচ্ছার ভরসায়।
বুঝতে পেরেছি, কানহাইয়া কুমারেরা জামিন পেয়ে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে, কিন্তু উমর খালিদেরা বিনা বিচারে জেলের ভেতর থাকবে। মায়া কোদনানি, বাবু বজরঙ্গী, বিট্টু বজরঙ্গীরা প্রথমে জামিন তারপর প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাবে, কিন্তু ৮৩ বছরের ফাদার স্ট্যান স্বামী জেলের ভেতর মারা পড়বে।
কিন্তু এখনও বুঝলাম না এত বছর পরেও ভারতে ‘হিন্দু বিপন্ন’ শ্লোগানের মানে কী?
--দুটো মানে। ভেতরের সত্যি হল ‘আমরা’ যদি ‘বিপন্ন’ না হই, তাহলে ‘ওরা’ আমাদের শত্রু ভাবব কেন? ওদের ঘৃণা করব কী করে?
আর আপাতদৃষ্টিতে ওরা জনসংখ্যায় আমাদের ছাড়িয়ে গিয়ে একদিন আমাদের ‘অপর’ করে দিতে পারে এই আশংকা কী নেই? এবার তোমাদের মত মানুষজনকেও বেছে নিতে হবে তুমি কাদের সঙ্গে, কী বল।
--একটাই কথা। ঘৃণা শেষ কথা নয়, কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অ্যাসিডের মত, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তোমরা ঘৃণা দিয়ে শুরু করেছ, কিন্তু শেষ অন্য কেউ করবে,--এখনও মণিপুর জ্বলছে।
======================================================
[1] Sanjay Subrahmanyam (1998).
Money and the Market in India, 1100–1700. Oxford University Press. এবং Roy, Tirthankar (2012). "Consumption of Cotton Cloth in India, 1795–1940".
Australian Economic History Review.
52 (1):
[2] Roy, Tirthankar (2012). "Consumption of Cotton Cloth in India, 1795–1940".
Australian Economic History Review.
52 (1): 61–84.
[3] Manmohan Singh,
Of Oxford, economics, empire, and freedom , The Hindu, July 2005.[4] The Indian Express, 7 April, 2023.
[5] https://www.worldeconomics.com London.
[6] Global Economy.com
[7] ইকনমিক টাইমস্, ২১ জুলাই , ২০২৩।
[8] The Siasat Daily, 6 December, 2020
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।