"আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুনি উঠলো রাঙা হয়ে,
জ্বলে উঠলো আলো
পূবে পশ্চিমে
গোলাপের দিকে চেয়ে বললাম, 'সুন্দর'
সুন্দর হল সে,
তুমি বলবে এ যে তত্ব কথা,
এ কবির বাণী নয় |
আমি বলব, এ সত্য,
তাই এ কাব্য"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ("আমি", শ্যামলী কাব্যগ্রন্থ, ১৯৩৬)
এই লেখাটা শুরু করেছিলাম নজরুলের ভাঙার গান, "কারার ঐ লৌহকপাট" কে আল্লারাখা রহমানের অন্য সুরে সুরারোপিত করা নিয়ে, যে গানটি শুনে এপার ওপার বাংলার বহু মানুষ কিছুটা বিহ্বল, কিছুটা বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, এ কি, নজরুলের বিদ্রোহের গানের এ কি রূপ? আবার তার বিপ্রতীপে অনেককেই বলতে বা লিখতে দেখলাম, এ বাপু বড্ড বাড়াবাড়ি, বাঙালী আর সব কিছু মেনে নিয়েছে, এইটা নিয়েই যত কলরোল। আবার আরো অনেকে একে সামাজিক আগ্রাসন বলে দাগিয়েছেন, গুরুচণ্ডালীর পাতায় এ নিয়ে লেখাও বেরিয়েছে । প্রিয় গানের কথা অপরিবর্তিত রেখে সুরের অদলবদল ঘটতে দেখলে আমরা যতটা শ্রোতা হিসেবে বিচলিত হই, আমরা গানের সুর অপরিবর্তিত রেখে কথা বদলে দিলে ততটা হই না হয়ত, এই রকম একটি মন্তব্য করে লেখাটা শুরু করেছিলাম এই বলে যে, এর একটা গাণিতিক স্নায়ুবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করা যায়। তখন লেখার সূত্রে "ইয়ানি বনাম লরেল" নামে ইন্টারনেট মিম আর সাইন ওয়েভ স্পিচের উল্লেখ করে দেখাবার চেষ্টা করেছিলাম আমরা যখন কোন কিছু শুনি, বা ধরুণ আমাদের যাবতীয় স্নায়বিক সংবেদনা (sense perception), তখন, মস্তিষ্কে এবং ইন্দ্রিয়ে তিনটি ব্যাপার কাজ করে - এক, আমাদের মস্তিষ্কে প্রারব্ধ অজস্র মডেল আর অগুন্তি অনুমান বিভিন্ন স্নায়ুতে স্নায়ুতে বিচিত্র পূর্বাভাস গড়ে ওঠে, তারপর সেই পূর্বাভাসের নিরিখে নতুন ইন্দ্রিয়গত সমস্ত সংবেদনাকে মস্তিষ্ক মিলিয়ে নেয়, তারপর অজস্র মডেলের আর অনুমানের মধ্যে কেবলমাত্র একটিকে সে বেছে নেয় । তখনই সংবেদনা আর চেতনা জাগে, আমরা যা শোনার শুনি, যা দেখার দেখি, যা আস্বাদ গ্রহণে আস্বাদন পাই, স্পর্শকে অনুভব করি | যেহেতু আমরা প্রত্যেকে স্বতন্ত্র, প্রত্যেকে আমরা নিজেদের মতন করে জগৎকে দেখি, ভাবি, নিজের নিজের প্রারব্ধ ধারণা নিয়ে জীবন কাটাই, এ খুবই স্বাভাবিক যে আমার যে ব্যাপারটা ভাল লাগবে আপনার নাও লাগতে পারে । একই দৃশ্য, একই শ্রাব্যকে আমরা নিজেদের প্রেক্ষিত, ধারণা, নিজেদের জীবনের গল্প থেকে উঠে আসা প্রেক্ষিত থেকে দেখি, শুনি ।
আমার চেতনা।
আমার নিজের চেতনা |
সেই চেতনার রঙ |
আমি নিজের মতন করে সেই চেতনার রঙে রাঙাই, রাঙি |
আবার গান শোনার প্রসঙ্গে ফিরে আসব,
তবে তার আগে, চেতনার আর সংবেদনার কথায় একটা ছবি দেখাই |

সূত্র: https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/b/bb/MooneyFace.png
ছবিটা দেখে কি মনে হয়?
বেশ খানিকক্ষণ যদি ছবিটার দিকে দেখেন, হয়ত প্রথমেই চোখে ধরা পড়বে না, কিন্তু যদি বলে দিই যে এ ছবিটিতে জনৈকার মুখ দেখা যাচ্ছে, তখন কি ছবিটা দেখতে পাওয়া গেল? এবং একবার সেই মুখ যদি আপনার “মনের আয়নায়" ধরা পড়ে, তখন সে মুখ আর “না দেখা" সম্ভব নয়, তাই না? এই ধরণের ছবি প্রথম ব্যবহার করেন ১৯৫৭য় ক্রেগ মুনি; তিনি পরীক্ষা করেছিলেন, এইরকম ৪০টি ছবি দেখিয়ে বোঝবার চেষ্টা করছিলেন যে বিভিন্ন বয়সী মানুষকে যদি এমন ধরণের ছবি দেখানো হয় যার কিছুটা বোঝা যাচ্ছে, কিছুটা নয়, তাহলে তারা পুরো ছবিটা ধরতে পারে কি না? এর প্রথাগত নাম, ক্লোজার, বাংলায় আমরা হয়ত “নিবন্ধন” বলতে পারি, তো মুনি এই বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন,
“CLOSURE IS the perception of an object or event which is not completely or immediately represented"
সে পরীক্ষার শেষে তিনি দেখলেন যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই জাতীয় ছবি দেখে ক্লোজ করার কিছুটা ক্ষমতা বাড়ে বটে, তবে সে ক্ষমতা ছবি কতটা জটিল তার ওপরে কিছুটা নির্ভর করে, আর প্রতিটি মানুষের “নিজস্ব ক্ষমতা”র ব্যাপার তো থাকেই (“inherent ability”) । এ থেকে অন্তত একটা ব্যাপার স্পষ্ট অন্তত ষাটের দশক থেকে জানা আছে যে, একই দৃশ্য দুজন মানুষ দুরকম ভাবে দেখবেন, বয়স, নিজের নিজের মতন করে।
এক শ্রেণীর ছবি আমাদর অবাক করে দেয় যে এ কি করে সম্ভব। এই লেখাটি প্রকাশ করার সময় ডিসি ডাচ শিল্পী
মরিস এসচারের আঁকা একটি অনবদ্য ছবি দেখালেন
এমন ধরণের ছবি দেখলে মনে হবে চোখের ভুল, এবং এ ব্যাপারটি যে কেবল চোখের বা দৃষ্টির ব্যাপার তাই নয়, কানে শোনার ক্ষেত্রে, এমনকি খাবারের স্বাদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি হয়।
আরেকটা ছবি দেখা যাক,
প্রথম ছবিটাতে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে কিসের ছবি?
dog2.png
“প্রাণ চায় চক্ষু না চায়”
আমরা দেখি কিভাবে? (ব্যাপারটা শুধু দেখার বলে নয়, শোনার, খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা, স্পর্শ, সমস্ত সংবেদনার এক ব্যাপার) | বাইরের প্রতিফলিত আলোয় যে ছবি আমাদের রেটিনার পর্দায় ফুটে ওঠে, আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক সেই ছবি দেখতে পায় না। রেটিনা থেকে নির্গত স্নায়ু বাহিত বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পৌঁছয় মস্তিষ্কের “নীচের” অংশে, যেখানে রেটিনা থেকে নির্গত স্নায়ু মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। একে ধরে নেওয়া যাক “নীচ থেকে ওপরের" সংবেদনা। কিন্তু মস্তিষ্ক "জানে কি করে" যে বাইরের কোথা থেকে উদ্গত আলোয় কোন বস্তু থেকে এই সংবেদনা এসেছে? সে কি মানুষ, না গাছ, না অন্য কিছু? "দেখতে পাওয়া" মস্তিষ্কের ব্যাপার, তার সঙ্গে চোখের একটি আনুষঙ্গিক সম্পর্ক রয়েছে বটে, তবে সেটাই সবটা নয়। দেখা যদি শুধুই চোখের ব্যাপার হত, অন্ধকারে ঘুমের মাঝে চোখ বন্ধ অবস্থায় আমরা স্বপ্ন দেখতাম না | যে মানুষ জন্মান্ধ, সেও কিন্তু স্বপ্ন দেখে |
দেখা নিয়ে চোখ বনাম প্রাণের ব্যাপারটি বৌদ্ধ সুরঙ্গমা সূত্রে বুদ্ধদেবের সঙ্গে আনন্দের কথোপকথনে ভারি সুন্দর করে বিধৃত রয়েছে | এর সূত্রপাত বুদ্ধদেবের অন্যতম শিষ্য শুধু ও সম্পর্কে ভাই, আনন্দের সঙ্গে মাতঙ্গী নামে (রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যে চণ্ডালিকা) দেহোপজীবিনীর সঙ্গে আলাপ এবং তার পর আনন্দ সাংঘাতিক বিমর্ষ হয়ে পড়েন, এবং জেতবনে বুদ্ধদেবের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে চান। তার পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধদেব সুরঙ্গমা সূত্রের উথ্থাপন করেছিলেন। চৈনিক বৌদ্ধ লেখাপত্রতে সে একরকম, আমি এখানে জ্যাক কেরুয়াকের “Wake Up" বইটি থেকে তার অংশবিশেষ উদ়ধৃত করছি:
বুদ্ধদেবের ভাষ্য অনুযায়ী দৃষ্টি যদি শুধুই চোখের বা শারীরিক ব্যাপার হত, তাহলে যেভাবে আমরা বহির্জগৎ কে দেখি, সেভাবেই আমরা অন্তর্জগৎকেও "অবলোকন" করতে পারতাম। কিনতু আমরা শরীরের অভ্যন্তর আর শরীরের বহির্জগৎকে একভাবে তো দেখি না।
সে না হয় বুদ্ধের বাণী ছিল, যদিও আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান তাকে আরেকভাবে ধরার চেষ্টা করেছে, Interoception নামে | জীবজগতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা সজ্ঞানে নিজের চোখ নিজে থেকে বন্ধ করতে পারে। এবং এই চোখ বন্ধ করার একমাত্র উদ্দেশ্য অন্তর্জগৎকে অনুধাবন করা। যাদের এই অন্তর্জগতের চেতনার বোধ এবং আমাদের দেখার স্নায়ুতত্ত্ব নিয়ে এর পরে আসছি। তার আগে Binocular rivalry নিয়ে দু চার কথা বলা যাক।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।