এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • নিউনর্মাল (করোনার দিনগুলি) (৫৯-৬৯)

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ২৬ জুলাই ২০২১ | ২১০৫ বার পঠিত
  • পর্ব উনষাঠ

    এই যে এই অডিওতে যা বলছে সব সত্যি? মানে এটা ম্যানমেইড ভাইরাস? এর পেটেন্ট নেওয়া আছে। ওয়েবসাইট দিয়ে দেবে বলছে! পৃথিবীর ধনকুবেরদের ষড়যন্ত্র? অডিও বলছে পৃথিবীকে কর্পোরেট স্টেট বানাতে চায় এরা।

    - কী জন্য? হোয়াই?
    - ডিপপুলেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড। বলছে তো তাই। মানুষ কমিয়ে দেবে?
    - তো? স্রেফ স্মোকিং এর জন্য এর চেয়ে বেশি লোক মারা যায়।
    - সিম্পলি বাজে বোকো না। আনআইডেন্টিফায়েড কেস কত আছে, হিসেবের বাইরে, তুমিও জানো, আমিও জানি। ফার্মিং উইদাউট ফার্মার্স, এজুকেশন উইদাউট টিচার্স, হেল্থ উইদাউট ডকটর্স, এইসব কথা উঠে আসছে কেন? প্রোগ্রাম অব ডিপপুলেশন শুরু হয়ে গেছে। এরপর আর মানুষ দরকার নেই। অ্যাপ উইল ডু এভরিথিং। এরপর ম্যান উইল বিকাম আ প্রডাক্ট। এরা বলছে সমস্ত প্রফিট আর প্রডাকশন হবে কৃত্রিমভাবে।
    - তুমি ওদের শেখানো বুলি বন্ধ করবে টুপুর?

    ঈশান একটু উষ্নভাবেই বলে উঠলো।
    তারপর হাসলো।

    - কী বলতে চাইছো বলো। এরপর ভালোবাসার জন্যেও হয়তো মানুষের আর মানুষকে দরকার হবে না। অ্যাপ দেবে সবকিছু।
    - আর ইউ টকিং অ্যাবাউট সেক্স ডলস? দে আর অলরেডি ইন!
    - নাহ্

    ঈশান একটা জোরে নিঃশ্বাস ফেললো।
    আই অ্যাম নট টকিং অ্যাবাউট সেক্স। ইমোশনাল চাহিদার কথা বলছি। সেটাও কী অ্যাপ করে দেবে টুপুর?

    টুপুরের মরিচ রঙের চুল অনেকটা উঁচু করে বাঁধা। গরম যথেষ্ট। ঘাড়ের ওপর চুল ভালো লাগে না একেবারে। কানে দুটো অক্সিডাইজড রূপোর গয়না। চোখে ফিকে কাজল। বাকী মুখ দেখা যায় না। দুজনেরই নাক থেকে থুৎনি পর্যন্ত এন ফর্টিফাইভে ঢাকা।

    নার্সিংহোম ফেরত দুজনে হেঁটে চলেছে রবীন্দ্র সরোবরের ফুটপাথ বরাবর। ঘন সবুজের ব্যাকগ্রাউন্ডে ঈশানের কালচে মেরুণ খদ্দরের পাঞ্জাবী। টুপুর আড়চোখে দেখল।

    - ভালোবাসা মানে বলতে চাইছো ইমোশনাল শেল্টার তো! আয়াম টায়ার্ড অব লিসনিং টু দ্যাট। তোমার মনের মতো হয়ে উঠতে হবে, তোমার পছন্দমতো কথা বলতে হবে, তোমার ক্রাইসিসে শেল্টার দিতে হবে এটসেটরা এটসেটরা। হুঁ। মনে হয় অ্যাপ করে দিতেই পারবে এসব। বেটার দ্যান হিউম্যান বিংন্গস। হিউম্যান হ্যাপাগুলো থাকবে না।

    মাস্কের নিচে মানুষের ঠোঁট কী বলছে বোঝা যায় না। কিন্ত চোখ কী বলছে বোঝা যায়। কিন্ত আপাতত দুজনের চোখেই রোদচশমা। তাই কে কী বলছে, বলার অন্দরে কী ভাবছে বোঝা গেল না।

    অডিওটি খুব পপুলার হয়েছে কিছুমহলে। বন্দনা শিভাকে রেফার করছে ওরা। কৃত্রিমভাবে প্রফিট ও প্রডাকশন বাড়ানোর দুষ্ট ধনতান্ত্রিক হিসেব দিচ্ছে। বেশি প্রডাকশনের অর্থ জিনিসের দাম কম। মানুষের কাজ যন্ত্র করে দেবে। মানুষের ভালোবাসাও কী যন্ত্র বেসে দেবে?

    বিকেলের রোদ। তবু বেশ চড়া। আরো গরম আসছে।
    কারা যেন বলেছিল এই ভাইরাস গরমে বাঁচে না?
    যা গরম পড়তে চলেছে তাতে ভাইরাসের আগে মানুষ ঘায়েল হবে। একে হাতে কাজ নেই। পেটে খিদে।

    - হিউম্যান হ্যাপা মানে?

    ঈশান একবার ঘড়ি দেখে নিলো টুক করে। পোস্ট কোভিড ট্রমা সেন্টারে যেতে হবে একবার। কোথাও বসে একটা ঠান্ডা কিছু খেলে হত। স্টেট ব্যাঙ্কের আগেই জুস শপটা বেশ ছিল। এখন বন্ধ। খোলেই নি আর লকডাউনের পরে।
    - মানে এই যে আমার এখন ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে। তোমার হয়তো জুস। একজনের ইচ্ছের কাছে আরেকজনকে সারেন্ডার করতে হবে। তবেই পেরেম টিকবে।
    ভ্যাঙ্গালো। মাস্কের অন্দরে।
    - কেন? তুমি ফুচকা খাও, আমি জুস। টু বি মোর সেনসিবল, এখন বাইরে দুজনেই কিছু খাবো না। সংযত হব। তবেই প্রেম টিকবে।
    হাসলো। দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে। ঢাকা মুখেও বেশ বোঝা গেল।
    এতটা সংযত হওয়া কী ঠিক?

    টুপুর ঘামছিল। জঘন্য একটা চ্যাটচ্যাটে ভাব। এইরকম ঘামলেই রক্তিমের কথা মনে আসে। বিশ্রী একটা অনুভূতি। মাস্কের নিচে মুখের অংশ ঘেমে একশা। ঈশান কী বুঝতে পারছে যে ওর রক্তিমের ফ্যাকাশে হাসি, নির্লিপ্ত যৌনতা ও সেডিজমের সঙ্গে হাঁটছে এখন? মনের ডাক্তার আফটার অল। বুঝলে বুঝুক। এখন টুপুর যা, তার জন্য রক্তিমের অনেক অবদান। এই সংযম। এই মেচুওরিটি। অত তিক্ততার মধ্যে দিয়ে না গেলে টুপুর আজও ছেলেমানুষ থাকতো। ভালনারেবল। যেন এখন খুব শক্ত হয়ে গেছে! রাস্তার পাশে একজন উন্মাদ মানুষী বসে আছে। ওখানেই থাকে। বা চায়ের দোকানের পাশে। একটা কুরকুরের ছেঁড়া প্যাকেট হাতে। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। কে ছাঁটল? টুপুর ভাবলো। এই দীর্ঘ করোনাকালে ওর মুখে মাস্ক কোনোদিন ছিল না।রাস্তাতেই শুয়ে থাকে। ওর করোনা হয়নি। বা হলেও ও বোঝেনি। ও বেঁচে আছে দিব্যি। বাবা কী পারবে বাঁচতে?

    ঈশান একটু অন্যমনস্ক। বুকের মধ্যে রক্ত চলকে উঠল টুপুরের। বুঝতে পারলো ও বেসিক্যালি ভালনারেবল। এখনও।

    ক্রসিং এ দাঁড়িয়ে যখন! ওরা, সামনে দিয়ে মিছিল গেল। ইলেকশন। নেতা ভোল ও দল পাল্টে বড় অভিনেতা হয়েছেন। তাঁর মুখে মাস্ক আছে। কিন্ত মিছিলের অনেকের মুখেই নেই।

    ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে মুম্বইয়ের কাছে অমরাবতীতে ডাক্তাররা আতঙ্কিত হয়েছিলেন। অমরাবতী একটি কার্পাস উৎপাদনের জায়গা। সেখানে হঠাৎই বেড়ে গেছিল কোভিড রোগীর সংখ্যা।
    জানুয়ারিতে সব প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। কোভিড রোগী প্রায় নেই।
    ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে পাল্টে গেল সব কিছু।
    সাংবাদিক সুনীল যাদব লিখলেন, জানুয়ারিতে যে হাসপাতালের বেড শূন্য, ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা ভরে গেল। সুনামির মত রোগ ধেয়ে এল। পাবলিক হেল্থ এক্সপার্ট অনিল ভান বললেন, উই ডিডন্ট লার্ন এনিথিংগ ফ্রম দ্য ফার্স্ট ওয়েভ।

    একটা বিপদ থেকে বেরিয়ে মানুষ ঝট করে দ্বিতীয়বার বিপদের কথা ভাবে না। তখন মাস্ক পরছে না অনেকেই। পরলেও থুৎনির নিচে। সোশ্যাল গ্যাদারিংএর মা বাবা নেই আর। জমকালো বিয়েবাড়ি। শ্রাদ্ধ। অন্নপ্রাশন। অসংযত মেলামেশা।

    ভ্যারিয়ান্টসের কথা জানতো না সাধারণ মানুষ। শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট আর জ্বরে তো এমনিতেই মানুষ ভোগে। ডরনা ক্যা হ্যায়?

    পর্ব ষাঠ

    - যেদিন পুরীর মন্দিরের ধ্বজা পুড়ে গেল, সেইদিন থেকেই আমি জানি অসৈরণ ঘটবে। বোঝলেন? ঐসব ভগমানে আগে আগে ঠারে ঠোরে বলে দেয়।
    - সেই তো। পিথীবী পাপে ভরে গেল বলে কথা। মেয়েছেলেতে সিগারেট খায়। হাতে টাটু আঁকে।
    বলতে বলতে মাঝবয়সী মহিলা টুপুরের দিকে ইঙ্গিত করলো।
    - এদের পেটে ছেলেপিলে হলে কী হবে বলোতো?
    - এই পাপেই তো করোনা আসলো গো। মানুষের পাপ। জগরনাথের চুড়ো পোড়া কী চাট্টিখানিক কথা?
    - তুমি চাল, ডাল, গুড় কিনা চললা কোথায়?
    - নবদের বাড়ি পাঠায়ে দেব। নবর বাপ মরেছে তো করোনায়।ফল টল দিতে পারবো না। অনেক দাম পড়ে যাবে । এই চাল, ডাল, গুড়ের সঙ্গে খানিক আলু, বেগুন দিয়ে দেবো।
    - নবর বাপের শ্রাদ্ধ করবে না? করোনায় মরলে শ্রাদ্ধ তো করে! গুণে গুণে লোক ডাকতে হবে বলছে?
    - কে জানে কী করবে? আমি তো যাবো না ডাকলেও। নাতির হাতে জিনিসগুলো পাঠায়ে দেব।
    - কেন গো? করোনার জন্য খাবা না?
    - নাহ্। আমরা হলাম বৈষ্ণব। আমাদের মধ্যে ন্যাড়া করে পৈতা হয়। নবদের ছোঁয়া খাই না।
    দ্যাখ দ্যাখ। ঢ্যাঙা মেয়েছেলেটা কেমন সিগারেট ফুঁকছে। বিয়েওয়ালা না কুমারী বলতো?
    মাঝবয়সিনী হেসে গড়িয়ে পড়ল। তার কপাল থেকে সিঁদুর টানা। ঘামে চকচক মুখ।
    - কী যে বলো ! বিয়েছাড়াও তো হতে পারে! ঐ মেয়েছেলেকে নিয়ে কে সংসার করবে বলো? বারমুখো। বারমুখো!

    টুপুর একটা গভীর শ্বাস নিয়ে সিগারেটের শেষ অংশটি কেডসের তলায় পিষে ফেলতে লাগলো। যেন ঐ দুটো পিঁপড়েকে পিষছে।
    মুদির দোকান থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাছতলাতে দাঁড়িয়ে সে মাস্ক খুলে স্মোক করছিল। মাথা ধরে আছে। খুব। শ্যামাকে বলেছে দোকানে জিনিসগুলো তুলতে। দশ কেজি চাল। তিরিশটা স্যানিটারি ন্যাপকিন। ডাল। গুঁড়ো দুধ। গুড়। এইধরনের মুদির দোকানগুলোতে শস্তা পড়ে অনেক। পাড়ার দোকানে নয়। মেধাদের বাড়ির কাছেই একটা বস্তির সামনে থেকে কেনাকাটা সারছে ও। শ্যামাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। একা টানতে পারবে না অত জিনিস। মেধাদের গ্যারেজে জমবে সব। মোটামুটি একশ কেজি মত চাল, পঞ্চাশ কেজি ডাল এইভাবে সংগৃহীত হলে ছোটা হাতী নেবে ওরা।
    মহিলাদুটি বস্তি থেকেই এসেছিল। নাইটির ওপর ওড়না জড়ানো মাঝবয়সিনী ও কটকটে গোলাপি শাড়ি, কপালে তিলক কাটা আরেকটু বেশি বয়সিনী। দুজনের কেউই মাস্ক পরেনি। দু'জনের ঢলাঢলি করে চলে যাওয়া দেখলো টুপুর। কোমর দুলিয়ে হস্তিনীচালে চলা। ইচ্ছে করছিল পশ্চাদ্দেশে আচ্ছা করে লাথি কষায়। জাহির থাকলে বলতো, মার না শালা পাছায় লাথ। সেটা তো পারবি না।
    জাহির নেই।
    পারবে না। টুপুর জানে। শ্যামার ওপরেও রাগ হল। এই যে তাকে নিয়ে এত বাজে কথা বলে গেল, টুপুর রেগে গেলে মেয়েছেলে বলে, শ্যামা কী পাশে দাঁড়িয়ে শোনেনি? সে উল্টোদিকে অত দূরে দাঁড়িয়ে শুনতে পেল, শ্যামা পাবে না তা তো হয়না। অথচ কিছু বললো না।
    বিচ।
    বলেই নিজেকে কন্ট্রোল করলো টুপুর। বিচ একটা সেক্সিস্ট গাল। মেয়েছেলে শব্দটাও। সে নিজে অনায়াসে দুটো শব্দ ব্যবহার করছে! করে। মায়ের বন্ধুদের বিচ বলেছে কতসময়ে। হুড়মুড় করে একরাশ কালো মেঘ এসে পড়েছে আকাশে।
    শ্যামা স্যানিটারি ন্যাপকিন গুনছে। সে শুনেছে সব কথাবার্তা। আমল দেয় নি। টুপুর ঐরকম শ্যামা জানে। টুপুরের রাগ হবে তাও শ্যামা জানে। কিন্ত ফালতু ঝামেলা বাড়াতে চায় না সে।এখানে টুপুরের সঙ্গে জিনিস পৌঁছে সে যাবে দুবাড়ি বাসন মাজতে। অত টাইম নেই তার মুখ করার।
    শ্যামা দুহাতে দুটো বিশাল থলি নিয়ে রাস্তা পার হল। মাঝদুপুরেও খুব ফাঁকা নয় রাস্তা। শ্যামা বেঁকে গেছে। টুপুর এগিয়ে একটা থলি নিয়ে নিল।
    - তুমি কিছু বললে না ওদের ?
    টুপুর রোদ চশমার নিচে আগুন। স্লিভলেস টপ। বাহু থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টিটা আসা দরকার।
    শ্যামা থলি নামিয়ে ওডনা দিয়ে ঘাম মুছলো। এইসব রাগকে পাত্তা দেয় না সে।
    আরো রোগা হয়েছে শ্যামা। চোখ কিছুটা বসেছে। শাড়ি প্রায় পরেই না আর আজকাল। পা দিয়ে ঘাম বেয়ে সায়া লেপ্টে যায় পায়ে। শস্তা সুতীর লেগিন্স ভালো শ্যামার। ছিটের কামিজ। ম্যাচিং ওড়না।
    মনে মনে হাসলো।
    কাজ করবি ওরকম চোখে পড়ার মত, চোখে পড়ার জন্যেই তো করিস, আর লোকে দু' কথা বলবে না? মাইরি!
    মুখে বললো, ছাড়ো তো ছোটলোকের কথা। হাতী চলে বাজারমে কুত্তা ভৌকে চার। চলো, দেরি হচ্ছে আমার!
    টুপুরের মুখে মাস্ক। শ্যামারও।
    বৃষ্টি আসবেই। দু চার ফোঁটা পড়তেও শুরু করেছে। পা চালাতে হবে টুপুরের।
    ঈশানের কাছে শোনা রাগ কন্ট্রোল করার মেথডগুলো হাতড়াচ্ছে টুপুর। খুঁজে পাচ্ছে না। মাথার মধ্যে "বিচ" শব্দটা কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপড়ে ফেলতে পারছে না কিছুতেই।
    মাস্কের নিচে দাঁতে দাঁত ঘষলো।
    - শালা চৌত্রিশ বছরে এই ক্লাসটাকে মাথাতে তুলে গেছে। সবাই সবাইকে সবকিছু বলতে পারে। বিচ ! বিচ ! বিচ! দিস ইজ হেল। হেল।
    রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল এক পূর্ণগর্ভা কুক্কুরী। সে বিচ শব্দটিকে গ্রাহ্য করলো না।
    বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। ঘাম ও বৃষ্টির জল মেখে, দুটি ভারি থলি নিয়ে হাঁটছে দুটি নারী।
    কাদের জন্য বহন করছে সে এইসব খাদ্য, হাইজিনিক সামগ্রী? মাস? সে অবশ্যই তবে নিজেকে ক্লাস ভাবে। মানুষমাত্রেই কী নিজেকে অপ্রতিম প্রতিপন্ন করতে চায়? না। শ্যামার অত সময় নেই। কিন্ত টুপুর তো নিজেকে ক্লাস ভাবতে চায়নি। মালবিকা, ত্রিদিবের সম্প্রদায় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে। যেরকম ভাবে পারে। ঐ মেয়েছেলেদুটো সিঁদুর। সে ট্যাটু। ওরা শাখাপলা। সে সিগারেট। এইগুলো কী বিচ্ছিন্নতাবাদী? সে তবে কোন ক্লাস? মালবিকা-ত্রিদিবের খেয়ে পড়ে বড় হলে কী মাস হওয়া যায়? জাহির সঙ্গে থাকলে বলতো, শোন, একবছর সোঁদরবন গিয়ে, হপ্তায় দুদিন পান্তা আর রুটি গুড় খেয়ে, মাল খেয়ে ক্লাস বিসর্জন দেওয়া যায় না। চেষ্টাও করিস না। জাহির কী ওকে বিদ্রুপ করতো মনে মনে? সে তো স্বাভাবিকভাবেই করছে যা পারছে। যেটুকু পারছে।
    সে ডিক্লাসড হবার চেষ্টা করে নি। জানে সম্ভব নয়। কিন্ত যেটুকু যা পারছে, করছে খুব সৎভাবে চেষ্টা করছে। কিন্ত এখন মনে হচ্ছে সে কোথাও নেই। না ঘরকা না ঘাটকা। শি বিলংগস টু নোহোয়ের। ভয়েড। অ্যাম্পিউটেড।
    নিজেকে ফালাফালা করতে করতে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। চোখে জল।
    ঈশান যেন বলছে, আশেপাশে পাঁচটা জিনিস দ্যাখো। তাতে কনসেনট্রেট করো। রাগের অবজেক্ট থেকে দূরে চলে যাও।
    ঈশান তার কাজের কোনো খবর রাখে না। ভীষণ অভিমান হচ্ছে টুপুরের।
    দোকান থেকে অনেকটা দূরে সে। অনেকটাই। কিন্ত কনসেনট্রেশন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মেধাদের গ্যারাজ দেখা যাচ্ছে। কে দাঁড়িয়ে সামনে? বৃষ্টির মধ্যে দেখা যায় না। জাহির?
    ঠাস করে ধারাপাত চড় বসালো গালে।
    স্টুপিড। জাহির নেই।
    সেকেন্ড ওয়েভ কোভিড নাইন্টিনে আন্ডার থার্টি মৃতদের অন্যতম একজন। জাহির।
    এখন ঘাম, বৃষ্টি ও চোখের জল মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে।
    বৃষ্টির মধ্যেই ফোন এলো। নার্সিংহোম থেকে।

    পর্ব একষট্টি

    ফ্ল্যাট খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় নি। রিণা খুব নিপুণ বর্ননা দিয়েছিল। পথনির্দেশ। চৌমাথা থেকে লেফ্ট টার্ণ।
    "খাইখাই" মিষ্টির দোকান ধরে পাঁচ মিনিট হেঁটে বাঁদিকের গলি।
    ছ নম্বর বাড়ি।
    বাবু আসতে চায়নি। ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্ত মহিলা এত আর্নেস্টলি বললেন যে না করতে পারলো না। প্রথমে টুপুরকে ফোন করেছিলো রিণা। তারপর বাবুকে। ত্রিদিবের ফোনে।
    টুপুর কুমিরখালি যাবে। জিনিসপত্র যোগাড় করছে। মালবিকার দেখাশোনা অনেকটাই করছে মেয়েটা। নার্সিংহোম দৌড়োদৌড়ি তো আছেই।
    অস্থিরতা এবং অস্বস্তি। দুটো মিলে পেটের মধ্যে একটা ট্রাবল দিচ্ছিল। শরীরে বেশি ঘাম। পোস্ট কোভিড সিম্পটমস ফিরে আসছে যেন। নার্ভ আর ডাইরেক্ট সিস্টেমের ওপর কোভিড জোরে আঘাত দেয়। বিরক্ত হলে, অতিরিক্ত স্ট্রেইন হলে নার্ভ দুর্বল বোধ করে। অসুস্থ বোধ করে।
    দিল্লিতে শীতকালে বেশ কমে গেছিল এই সমস্যাগুলো। বৃষ্টি আসছে। বাবু দেখলো হলুদ রঙের বাড়িটা।মাধবীলতার ঝাড় সমেত আশেপাশে বহুতলগুলির মধ্যে মরুদ্যানের মত জেগে আছে।
    রিণা যোশি বিয়ে করেছে কিন্ত নিজের ফ্ল্যাট এখনো ছাড়েনি। মাঝে মাঝে এসে থাকেও। যেমন আজ।
    কিন্ত বাড়িতে রিনা একা নেই। বাচ্চা এবং বর দুজনেই আছে। বাচ্চার স্কুল নেই। সে মা তাকে যেখানে রাখে সেখানেই থাকে লেপ্টে। তবে একবছরের বেশি স্কুল না যাওয়ার ফলে ববি একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে গেছে। ভীষণ গেম খেলার নেশা হয়েছিল। সেটা দূর করার জন্য রিণা অনেক গল্পের বই কিনে দিয়েছে বটে কিন্ত মোবাইল গেমের নেশা একবার হলে তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব শক্ত। ববি একটু মনমরা হয়েই আছে। স্কুল নেই। বাইরে খেলা নেই। মা ঠেসে প্রোটিন খাওয়ায়। ববির একটু ভুঁড়ি হয়েছে।
    বাবু রিণার ড্রয়িং রুমে বসে দেখলো পর্দার ফাঁক দিয়ে একটা নাদুশ নুদুশ ছেলে, পায়ের ওপর পা দিয়ে শুয়ে আছে। রিণার বর বোধহয় ফ্রেশ হচ্ছিল। বাথরুমে জলের শব্দ। বিছানার দিকে একনজর তাকিয়ে বাবু কেমন কুঁকড়ে গেল। ঐ বিছানায় কী বাবা রিল্যাক্স করতো?
    রিণা যোশি একটা মহার্ঘ্য কাফতান পরেছিল। অফফ হোয়াইটের ওপর জয়পুরি ব্লক। চুলগুলো স্ট্রেইট। চকচক করছে। দেখেই বোঝা যায় সেট করা। দরজা খুলে বাবুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল।
    কেউ প্রথম এলে রিণা তাকে আগে জল আর মিষ্টি দেয়। বাবুকে রট আয়রনের সোফাতে বসিয়ে সে কিচেনে গেল। বাবুর মুখ মাস্কে ঢাকা। খোলার কোনো প্রশ্ন নেই।এমনিতেই সে অপরিচিতদের সঙ্গে তেমন স্বচ্ছন্দ নয়। রিনা বুঝতে পারছিল বাবু ত্রিদিবের ছেলে কিন্তু বাপ ছেলে অপোজিট পোলস। ঘরে একটা মিষ্টি গন্ধ। রুম স্যানিটাইজার। রিনার রুচি ভালো। বাবু জলের গ্লাস তুলে নিল। মিষ্টিটা নিল না।
    যা কথা বলার রিণাই বললো।
    দেওয়ালে একটা যামিনী রায় প্যাটার্ন আছে। যামিনী রায় নয়। নকলনবিশ কেউ এঁকেছেন। ছবিটার নিচে একটা মোড়া টেনে বসলো রিনা। অনেকটা দূরে মুখোমুখি। মোটামুটি একতরফা কথা বলে গেল রিণা।
    - কবে হল?
    - এতদিন?
    - আমার এর মধ্যে ফোন করাই হয়নি। অফিসের ভীষণ চাপ। শুধু ওয়র্ক ফ্রম হোম তো না। অফিস যেতেও হয়।
    - তিনুদা তো আসতো আগে মাঝে মাঝেই। অনেকদিন আর যোগাযোগ নেই। ভীষণ খারাপ লাগছে।
    দেবরূপ সোজাসুজি রিণার চোখে তাকাল। খারাপ লাগাটা কত জেনুইন বোঝার জন্য। ঠাহর পেল না।
    এ মহিলা দেখা করতে চাইল কেন? ফোনে বলা যেত না!
    সে অনিচ্ছুক ভাবে মালবিকাকে রিণার পাশে বসালো। রিণার বয়স কত হবে? মালবিকার চেয়ে অনেক জুনিয়র। কিন্ত একেবারে ছেলেমানুষ না। মালবিকা নিজেকে তেমন গুছিয়ে রাখেন নি। পার্লার স্পা যেতেন কিন্ত বাবু বুঝতে পারে, মা ভেতরে ভেতরে কেমন হয়ে যাচ্ছিল।
    রিণার বর স্নান সেরে বেরিয়ে একবার হাই বলে গেল। হ্যান্ডসাম। বেশ লম্বা। লাল টি শার্ট।
    সুণিপুণভাবে রিণা সব তীর তৈরি রেখেছে। যদি কোনো অতর্কিত আঘাত আসে, তার অস্ত্র তৈরি।
    বাবা এখানে আসতো ভাবতে বাবুর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। একটু ঘেন্না। সম্পর্কটা কেমন ছিল? ভাবতে না চাইলেও এসে যায়।
    ভদ্রমহিলা লাটাই গুটিয়ে নিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। ভীষণ সংসারী সংসারী ভাব ।
    বৃষ্টি নেমে গেল ঝমঝম করে।
    রিণা বলল, তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল দেবরূপ।
    রিণার হাতে হিরের আংটি ঝকঝক করছে।
    কে?
    রিণা নিজেও কিনতে পারে।
    ত্রিদিবদার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে কথাগুলো খুব মিথ্যে না। আমার একটা দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। ত্রিদিবদারও। বাট দ্যাট ওয়জ টাইমপাস ফর হিম। ফানটাইম। আমি হয়তো একটু ডিপেন্ড করে ফেলেছিলাম। ইমোশনালি। তারপর দেখলাম সব ফাঁকি।
    খুব জ্বর এসেছিল। ছেলেকে নিয়ে একা থাকতাম। লকডাউনের সময় গতবছর। তিনুদা এসে দরজা থেকে ফিরে গেল। একবার বললো না কিছু লাগবে কীনা। রেগে গেল, জ্বরের মধ্যে কেন ডেকেছি! শিট! যেন জ্বর হলেই কোভিড। ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। ছেলেটার কী হবে!
    প্লিজ কিছু মনে কোরো না। তিনুদা ইজ আ বিট কাওয়ার্ড। অন্তত ঐ অবস্থাতে চলে যাওয়ার পর আর কোনো মোহ ছিল না আমার।
    করোনা টট মি আ লেসন। গ্রিম লেসন। দূরে থেকেও তো ও ভরসা দিতে পারতো। দেয় নি। সিম্পলি ভয় পেয়েছিল। কিছু হলে ফেঁসে যাবে।
    ও জানে সব।
    রিণা পাশের ঘরে বরের দিকে ইঙ্গিত করলো।
    বাবু মায়ের কথা ভাবছিল।
    রিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের হিরের আংটিটা নড়াচড়া করলো।
    বাবুর মহিলার ওপর মায়া হচ্ছিল।
    বৃষ্টি মায়া তৈরি করে। বাড়িটার সামনে গাছপালা আছে। সবুজের একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। বিদ্বেষ ভুলিয়ে দেয়।
    রিণা বলল,
    আই ডোন্ট হ্যাভ এনি গ্রিভান্সেস। ইট হ্যাজ কাম টু অ্যান এন্ড। আই উইশ হি গেটস ওয়েল।
    বাবু বৃষ্টি দেখছিল। বললো, যাই?
    - এই বৃষ্টি মাথায় করে যেও না। কফি করি?

    রিণার বর কম কথা বলে। একটু বেশি ইংরিজি বলে। তবে শিষ্ট। কফিতে ক্রিম দিয়েছিল রিণা। কী করে জানলো বাবুর পছন্দ? ত্রিদিব বলেছিলেন?

    টিপ টিপ বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালো লাগে।
    রিণার বাড়ির বাইরে এসে ফোন খুলল বাবু।
    মালবিকার জন্য বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। এত বছর সংসার করে মা কী পেল?
    এই প্রথম ওর মনে হল ও লাকি। ভাগ্যবান।
    পুণের ফ্ল্যাট। বাবু আর অদিতির পাঁচ বছর লিভ ইনে কোনো ফাঁক ছিল না। হ্যাপিনেস ম্যাটারস।
    মালবিকার সংসার ছিদ্রময়।
    বাবু কোনভাবে মনে মনেও মালবিকাকে সান্তনা দিতে পারছিল না। পাশ দিয়ে একটা বেড়াল তুরতুর করে হেঁটে যাচ্ছে। মুখে ছানা। ঘেঁটি ধরে নিয়ে চলেছে।
    ফোন।
    টুপুর। ভয়ানক টেন্সড।
    - দাদা, নার্সিংহোম থেকে ফোন এসেছিল। তোর ফোন বন্ধ ছিল। বাবার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেছে। সত্তর।

    পর্ব বাষট্টি

    অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমেছে দ্রুত।
    নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
    ও টু ফর এভরিওয়ান। বাবু ফোন করেছিল রাস্তা থেকেই। ঈশান চলেও এসেছে।
    প্রাইভেট নার্সিংহোমে কয়েকটি কোম্পানি সাপ্লাই দেয়। তাদের কাছে কমে আসছে অক্সিজেন ভান্ডার।
    ওটু ফর এভরিওয়ান দুঘন্টার মধ্যে সার্ভিস দিয়েছে। সেই দুঘন্টা যেন দুযুগ।

    ত্রিদিবের ব্লাড প্রেশার একটু স্বাভাবিক। অক্সিজেন চালু হয়েছে। বাবু বসেছিল বাইরে। একটা সাইবার ক্যাফে অর্ধেক খোলা আছে। ঈশান এখনো বেরোয় নি নার্সিংহোম থেকে।
    রিণা যোশির কথা ভাবছিল। বাবা কুড হ্যাভ বিন মোর এমপ্যাথেটিক। বাবু বুঝতে পারছিল মহিলা গোটা সম্পর্কটা ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন। বিশেষ করে ত্রিদিবের ফোনে অনেকটাই রিভিল্ড। স্টিল। যেটা বললেন, তার মধ্যে একটা মিনিমাম অনেস্টি আছে। দ্যাট ইজ ইমপরট্যান্ট। তাকে ডেকে না বললেই বা কী এসে যেত ! মালবিকা! পুওর মা !
    বাবার একটা ফালতু সম্পর্কের জন্য মা নিজে কষ্ট পাচ্ছে ! শি শুড হ্যাভ অ্যাক্টেড আদার ওয়াইজ। শি শুড হ্যাভ বিন কারেজিয়াস। আ বিট ডমিনেটিং।
    ভেবে হেসে ফেলল বাবু।
    সে নিজেও খানিকটা মালবিকার ধাঁচের। অভিমানী। নিশান্ত। নিশান্ত ঠাকরেকে নিয়ে কী বাড়াবাড়ি কান্ড করেছিল অদিতির সঙ্গে!
    দোজ ওয়ের ডেজ। বাবুর কোভিড ডেজ!জ্বরে আচ্ছন্ন বাবু।
    বাবা এই সময়টা পার হয়ে যাবে ঠিক। বড্ড বেশিদিন ভুগছে!

    এইরকম বৃষ্টির দিনে মালবিকা ত্রিদিবের হাত ধরে কোপাইতে হেঁটেছেন। নাচের ছন্দ ছিল তখন চলনে। মোবাইল ফোন ছিল না । চিঠি লিখতেন দুজনে দুজনকে। ইনল্যান্ড লেটার। নীল ইনল্যান্ড লেটার। ওপরে মালবিকা মন্ডলের নাম। ত্রিদিবের নিজের হাতে লেখা।
    বৃষ্টিতে সব লেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছে ফাউন্ডেশন পেনে লেখা সমস্ত অক্ষর।
    রয়্যাল ব্লু সুলেখা। বেগুনি চেলপার্ক। মালবিকার।
    ত্রিদিবের কালো।
    - চুল কেটে ফেলবো, বুঝেছো? বয়েজ কাট করবো।
    আতংকিত হয়ে তাকাচ্ছেন ত্রিদিব।
    - নাআআ। চুল কাটবে কী? এত সুন্দর লম্বা চুল কেউ কাটে ? তাছাড়া ঐসব বয়েজ কাট ফাট একদম চলবে না আমাদের বাড়িতে।
    মালবিকা খিলখিল করে হেসে উঠছেন। সরু নাকের পাটার ওপরে বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু জল। ত্রিদিব মুগ্ধ হয়ে দেখছেন। বর্ষার কোপাই, ভিজে গাছপালা, পায়ে লাগা কাদামাটি এক অপাপবিদ্ধ প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকছে। ক্লাস বাঙ্ক করে এসেছেন মালবিকা। ত্রিদিব এসেছেন মহামূল্যবান দুটি ছুটি নিয়ে।
    - মা তোমার চুল দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবে, জানো! আর আপত্তি করতে পারবে না।
    চারদিকের আলো আলো নীলাভ সবুজেও মালবিকার মুখখানা জুড়ে অন্ধকার নেমে আসছে।
    মালবিকা মন্ডল যতই শিক্ষিত ও সপ্রতিভ হোন, ত্রিদিব সেনগুপ্তের মা বিবাহ আপত্তি জানাবার সামাজিক অধিকার রাখেন তাহলে! আর তাঁর পুত্র, মালবিকার প্রেমিক, এমবিএ তে দুরন্ত রেজাল্ট করা ত্রিদিব হেসে হেসে সেই কথা বলছে! মালবিকা যদি মালবিকা মন্ডল না হয়ে মালবিকা মুখার্জি বা মিত্র বা বসু হতেন তাহলে এই আপত্তির জায়গা থাকতো না। কী কঠিন সত্য!

    ভীষণ রাগ হচ্ছে মালবিকার! অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বৃষ্টিতে চোখের জল ধরা পড়ে না যেন।
    অথচ পুরুষটি কী আত্মবিশ্বাসী। কী তুমুল স্বার্থপর!
    তাহলে অতটা অপাপবিদ্ধ নয় প্রেম! মালবিকার বুকের মধ্যে হাহাকার উঠছে। বৃষ্টির মধ্যে ছোট ছোট ঘূর্ণি।
    ত্রিদিব বলছেন, চলো চা খাই!
    মালবিকা ভেজা চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। স্নিগ্ধ, স্মিত মুখ। যেন সব অভিমান জলে ধুয়ে ফেলে প্রসন্ন মুখ ফিরিয়েছেন! পুরুষটি তাই চায়। ত্রিদিব মালবিকার বাহু ধরে কাছে টেনে নিচ্ছেন। প্যাশন ও প্রবৃত্তির কাছে হেরে যাচ্ছে অভিমান।

    শাশুড়ির ছবির দিকে তাকালেন মালবিকা। কাঁধে রূপোর ব্রোচ। আলতো ঘোমটা টেনে বসেছেন। সাদা কালো ছবিতেও তাঁর দৃষ্টি প্রখর। যেন তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মালবিকার দিকে।
    তখন কি তবে ডিসিশন ভুল ছিল! ত্রিদিবের হাতে সমস্ত অধিকার তুলে দিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিলেন। সমস্ত রকম সমর্পণ।
    ছবিতে সিনিয়র মিসেস সেনগুপ্ত তাকিয়ে আছেন।
    - স্লিভলেস পরবে না, বুঝেছো? স্কুলে ফ্যাশন প্যারেড করতে যাও নাকী! আমিও তো স্কুলে পড়িয়েছি। সাদা শাড়ি পরে গেছি রোজ!
    - লুচির ময়ানে একটু চিনি দিতে হয়। এটাও জানো না?
    - অত রিভাইভ দিয়ে মাড় দিচ্ছো কেন শাড়িতে ! পয়সা নষ্ট। অবশ্য তোমার তো বাবার বাড়িতে কাঁচা টাকার ব্যাপার। ভাতের মাড় রেখে দেবে। ছেঁকে শাড়িতে দেবে।

    ছোট ছোট হুল। কিন্তু বিঁধে যেত। ত্রিদিব ট্যুওরে গেছেন। ল্যান্ডফোনে ফোন আসতো। শাশুড়ি হেডমিস্ট্রেসের মতো সামনে বসে। মালবিকা সব অভিযোগ, অপমানবোধ গিলে ফেলে হাসিমুখে ফোন ধরছেন।
    ভালো আছি। ভালো আছি।
    বাবু ছোট তখন। টুপুর জন্মায় নি।
    বাবু কচি হাতে মালবিকার হাঁটু জড়িয়ে ধরছে!
    - মা, মা বাবা ভালো আছে ?

    মালবিকা যেন তন্দ্রা ভেঙে জেগে উঠছেন। কেউ বুঝি তাঁকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে। আজকাল তাঁর এইরকম হয়। গণতন্ত্র মেনোপজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মালবিকা একটু স্থিতি চাইছেন। নার্ভগুলো শান্ত হোক একটু, বৃষ্টির জলে। কেন যে এত অস্থির লাগে! তাঁর মা, ঠাকুমাদের সময় তাঁরা কী করতেন কে জানে? অনায়াসে যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বে চলে যেতেন কী তাঁরা? বাড়ির লোক কিছু টের পেতো না। মালবিকা কখনো খেয়াল করেন নি। তাঁরা কী অবহেলায় হটফ্লাশেজ, ইচিং, ত্বক কুঁচকে যাওয়া, মুড ফ্লাকচুয়েশন, হরমোনাল ডিসঅর্ডার সঙ্গে করে মুখ বুঁজে সংসার করে যেতেন। কিংবা হয়তো খুব সহজে হত না। ভুগতেন। আর সহ্য করে যেতে হবে ভেবে সহ্য করতেন। খিটমিট করতেন, কথায় কথায় কান্না। বা রাগ। মালবিকা আচ্ছন্ন এখনো।দোজ হু সে মেনোপজ ইজ দি এন্ড অব ফিমেল ইউথ আর রং। মালবিকা টের পান। তাঁর শরীর এখনো উদ্ভাসিত হয়। ত্রিদিব ছাড়া আর কাকে বলবেন ! কোনোদিন বলতে পারেন নি। শি ওয়জ টেকন ফর গ্রান্টেড। স্নাত হয়ে উঠছেন মালবিকা ব্যথাতুর জাগৃতিতে। হোয়ের হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ারস গন! ত্রিদিব গাইতেন গানটা বেসুরো গলাতে। হোয়ের? কোথায় গেল ফুল্ল সেসব দিন!

    আঃ! কে ডাকছে!
    টুপুরের গলা।
    সে কোথা থেকে এলো! বাবু ছোট। টুপুর তো জন্মায়নি এখনো! গর্ভের অতল থেকে ভ্রূণ যেন ডেকে উঠছে
    - মা, মা, মাগো!
    মালবিকা চোখ খুললেন। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। সাদা ।
    টুপুর ঝাঁকাচ্ছে তাঁকে।
    - অক্সিজেন পাওয়া গেছে মা ! বাবাকে অক্সিজেন দিতে শুরু করেছে !
    মালবিকা দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।
    দুচোখ ভরে আত্মজাকে দেখছেন। যেন দেখা শেষ হচ্ছে না।
    টুপুর দেখছে মা তাকে দেখছে। চোখের আরো গভীর থেকে দেখছে। মায়ের চোখের তলায় কালি।
    এই কালি ছিল না। হোস্টেলে থাকাকালীন সব কালি, কুন্চন কমে এসেছিল।
    এই কিছুদিনের ধকল স্পষ্ট।
    মালবিকা দেখলেন মেয়েকে। এই প্রথম মনে হল, রক্তিমের সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে ভালো করেছে টুপুর।
    খুব ভালো করেছে। বেঁচে গেছে মেয়েটা ।
    - তুই তবে কেন কাঁদছিস? অক্সিজেন পাওয়া গেছে, তুই কাঁদছিস কেন? কেন কাঁদছিস মা?
    টুপুর অবাক হচ্ছে।
    মা সাধারণত এই টোনে কথা বলে না তো
    টুপুর ফোঁপাচ্ছে।
    - শঙ্খ ঘোষের কোভিড ধরা পড়েছে মা!
    মালবিকা অবাক হয়ে দেখলেন, এক কালজয়ী কবির অসুস্থতার জন্য তাঁর কন্যার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। এতদিন ধরে তার বাবা নার্সিংহোমে। ত্রিদিবের জন্য একবারও কাঁদে নি সে।
    তাঁর নিজের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের গভীর পার্থক্য প্রতিটি রক্তকোষের মধ্যে টের পাচ্ছেন মালবিকা।
    মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলছেন,
    কাঁদিস না। কাঁদিস না বাবা ! উনি ভালো হয়ে যাবেন !

    পর্ব তেষট্টি

    হাওড়ার হাটে ছাপা নাইটি পার পিস একশো কুড়ি। হাতাওয়ালা না। আবার স্লিভলেসও না। শ্যামা যাদের কাছে নাইটি বিক্রি করে তারা হাতাওয়ালা নাইটিও পরে না। স্লিভলেসও পরে না।ম্যাগিহাতার মত সামান্য তিনকোণা বেরিয়ে থাকে কাঁধের থেকে। শ্যামা দেড়শো টাকায় বিক্রি করে। শাড়ি নেয় কিছু তাঁতের। বড়বাজার থেকেও নেয়। পাড়টা ঢালা। দু' শোতে নেয়।আড়াইশোতে বিক্রি করে। একটু ভালো ছাপা। তিনশো পাইকিরি। বিক্রির দাম সাড়ে তিনশো। মাঝে একটু দোকান খুলতে শুরু করেছিল। আড়ালে আবডালে ব্যবসা চালাচ্ছিল সবাই। শ্যামার কিছু সুরাহা হয়েছিল। শুধু মাস্ক বানিয়ে আর স্যানিটাইজার তৈরি করে আর হচ্ছে না। সবাই ঘরে ঘরে বানাচ্ছে। তাছাড়া এখন টিভিতে বলছে সার্জিকাল পরুন। এন নাইন্টিফাইভ পরুন। কাপড়ের মাস্ক আর বড়ঘরে কিনছে না।শাড়ি আর নাইটির সবসময়ই চাহিদা আছে। শ্যামা বেশি করে ঐ দুটো তুলে রাখে। ফুলছাপ নাইটি আর তাঁতের শাড়ি। লকডাউনে, আনলকে বিক্রি হবেই। করোনার সময়ে লোকে কী নতুন কাপড় পরবে না? শ্যামা হনহন করে হেঁটে বাড়ি ঢুকল।

    তিনটি নারীর সংসার এখন বস্তির ঘরে। শ্যামা, হরপ্রীত আর করুণা। টুপুর শ্যামার ঘরেই করুণার থাকার ব্যবস্থা করেছে। বাবলু এই তিন নারীর মধ্যে একটি পুরুষবালক। তার স্কুল নেই। চাল, ডাল, সয়াবিনের প্যাকেট নিতে সে মাসে একবার স্কুলে যায়। মালবিকার বাড়ির জন্য বাবলুর মাঝে মাঝে মন কেমন করে। ঐ বিশাল বাড়িটার আনাচে কানাচে সে ঘুরঘুর করতো। টুপুর তাকে ধরেবেঁধে খানিক পড়িয়েছিল। মামাটা ভালো ছিল বেশ। বাবলুকে দেখে হাসতো। মামী তো ঘুমিয়েই পড়ে থাকতো। ছাতে একা একা ঘুরে বেড়াতো বাবলু। ঐ বাড়ি থেকে চলে আসার পর নিজেদের ঘর ফাঁকা ফাঁকা লাগতো তার। ঠাকুমা নেই। ঘরটায় ফাঁকা তক্তপোষ। বাবলুর ঢুকতেই ভয় করতো। শ্যামা সারাদিন থাকে না। হরপ্রীত থাকে না। দুজনেই ফেরে রাত করে। বাবলুর একা থাকতে ভালো লাগতো না। বস্তিতে ঘুরে বেড়াত। একটু বড় ছেলেরা ধরে বেঁধে দুদিন বিড়িও টানিয়ে দিল। বাবলু ভয়ে কিছু বলতে পারেনি।

    করুণা আসার পর থেকে বাবলুর চরে বেড়ানো বন্ধ হয়েছে। করোনা নাকী আবার শুরু হয়েছে। আবার লকডাউন হবে। তাহলে বাবলু কী আর স্কুলে যাবে না? অঙ্কের জন্যে একটা পাড়ার ছেলে ঠিক করেছে শ্যামা। সপ্তাহে দু' দিন বাবলু অঙ্ক করে। অন্যান্য সাবজেক্ট একটু বলে দেয়। পাঁচশো টাকা নেয় ধরে তারজন্য। করুণা আসার পর থেকে বাবলুকে দুপুরে, সন্ধেতে বই হাতে নিয়ে করুণার কাছে বসতে হয়। শ্যামার হুকুম তবে সে বসেই থাকে। বসে বসে ঢোলে আর করুণার হাতের নিপুণ কাজ দেখে।

    কাঁথার ফোঁড় তোলে করুণা। এইসব শাড়ি, কুর্তা পিস যারা কেনে লকডাউনে তাদের উনিশবিশ হয় না। কালো, সাদা, লাল, হলুদে বিচিত্র সব ফোঁড় তুলে যায় করুণা। বাবলু হাঁ করে দেখে।
    শাশুড়ির তক্তপোষটা করুণাকে ছেড়ে দিয়েছে শ্যামা। একটা তোষক আর চাদর করুণা নিজেই এনেছে। তার আত্মসম্মানবোধ অতি প্রখর। সে থাকাখাওয়া বাবদ শ্যামাকে দুহাজার টাকা দেয়। দিনকালের তুলনায় সেটা কিছুই না।তবু দেয়। না হলে সে থাকবে না। এর চেয়ে বেশি তার ক্ষমতা নেই। তবে শুধু সেলাই করে করুণার পোষায় না। সে লেখাপড়া জানে। শ্যামাকে সে বলেছে বস্তিতে বাবলুর বয়সী কয়েকটা ছেলেমেয়ে জোগাড় করে সে পড়াতে পারবে। শ্যামা কয়েকজনকে বলেও রেখেছে। এখন বাবলুর জন্য একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন চাই শুধু। এখন সব অনলাইন চলছে। লেখাপড়াও। শ্যামার ফোন নিয়ে টানাটানি করে ছেলে। তার চেয়ে একটা ফোন দেওয়া ভালো।

    ভোটের পর নাকী লকডাউন হবে আবার। শ্যামার ভয় লাগছে। আটদফায় ভোট হচ্ছে এবার। তার আগে জমায়েত হচ্ছে। তাতে করোনা ছড়াচ্ছে না অবশ্য। হাওড়া হাট বসলে ছড়াবেই। সে শ্যামাও বোঝে। তার ধারণা ছিল করোনা একবার হলে আর হয় না। এবার কীসব সেকেন্ড ওয়েভ টয়েভ শুনছে। শ্যামা অত বোঝে না। সে শুধু জানে যে ছেলেটার জন্য বেঁচে তো থাকতে হবে। এর মধ্যে কোচবিহারের দিকে ভোটে গোলাগুলিও চলেছে, শুনেছে শ্যামা। কোন পার্টি আসবে কিছু বোঝা যায় না। ভোটের আগে লোক বাড়ি বাড়ি বলতে শুরু করেছে। শ্যামা একটু এড়িয়েই চলে। আগে জিতুক, তারপর সেদিকে ঢলে পড়বে ঠিক করেছে।

    সন্ধের বেশ খানিকটা পর তিনটি নারীর সংসার বেশ জমে ওঠে। এইসময়টা বাবলু খানিক ছাড় পায়। বিকেলে স্নানের অভ্যেস এখনো যায়নি শ্যামার। পাঁচটায় স্নানে যায়। তারপর পাইকিরি জিনিস তুলে একবার গা ধোয়। হরপ্রীত খুব ভোরে স্নান করে সকালে বেরিয়ে যায় বলে। একমাত্র করুণা বাড়িতে থাকে ঘর আগলে। বাবলু এখন আগের মত ফ্যানাভাত ডিমসেদ্ধ খায় সকালে। বাবার কথা সে আর জিজ্ঞেস করে না। একবছরে অনেককিছু দেখে ফেলেছে সে। বাবা ছেড়ে চলে গেছে। স্কুল বন্ধ হয়েছে।ঠাকুমা মরে গেছে। শ্যামার করোনার সময়ে তাকে থাকতে হয়েছে হরপ্রীতের মালিকের বাড়ি। তারপর আবার বেড়ালছানার মতো ঘেঁটি ধরে শ্যামা তাকে মালবিকার বাড়ি নিয়ে যায়। এতকিছু একবছরে ঘটে গেলে ছেলেপুলে চুপ মেরে যায়। বড়ো হয় রাতারাতি। বাবলুরও তাই হয়েছে। যেহেতু বাড়িতে বাপ নেই এবং তিনটি নারী নিজেদের মতো করে থাকে, বাবলু কিছুটা নরমধাঁচের। সে ভাত রাঁধতে পারে। মাড় গালতে পারে। একদিন করুণা তাকে মাছের ঝোল রাঁধতেও শিখিয়ে দিল। পাড়াপড়শি তেমন মাথা ঘামায় নি। সুখনলালের না থাকাটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
    ঘরে ঢোকার আগে পা কচলে ধুলো শ্যামা। মুখ হাত ধুয়ে আঁচল দিয়ে মুছলো।
    ভারি আশ্চর্য একটা কাঁথা বানাচ্ছে করুণা। এটা অর্ডারের কাঁথা। হরপ্রীত অর্ডার দিয়েছে। অমৃতসরে পাঠাবে সে। সবুজ সুতোতে খুদে খুদে ফোঁড়। নানারকমের সবুজ। কাঁচা হলুদ সবুজ। কচি কলাপাতা সবুজ। শ্যাওলা সবুজ। টিয়া সবুজ। সমুদ্র সবুজ। ঢেউ খেলানো শস্য ক্ষেত। যেন হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আর শস্য ক্ষেত ঘিরে সারি সারি মাথা। পাগড়ি আছে। পাগড়ি নেই। কাঁথাতে ইতিহাস আঁকা হচ্ছে অন্নদাতাদের।
    শ্যামা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

    করুণা সেলাই ছেড়ে উঠবে এখন। কন্ঠার হাড় বার করা মেয়েটার মুখে মায়া আছে বেশ। শ্যামা ভাবে।
    করুণা পটল বাটা করেছে। রসুনের গন্ধটা আহামরি। ডালসেদ্ধ। আরেকটা টুপুর শ্যামার ব্যাগে টিফিন বাটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে, কুচো মাছের একটা ঝাল।
    হরপ্রীতের একটা ভাজা। তিন নারী ও একটি বালক।
    টিভি চলছে একটু জোরেই। জি টিভি হিন্দি। নীল বসনা সুন্দরী বেতের চেয়ারে বসে আছেন। সামনে হাঁটু গেয়ে সুদর্শন নায়ক। গান হচ্ছে, ও তেরে নয়না!
    শ্যামার মনে হচ্ছে, এ যেন কতদিনের অভ্যেস। তার জীবনে কী সুখনলাল বলে কেউ ছিল আদৌ।
    মিটমিটে টিউবের আলোতে একটি ক্ষণিকের নিরাপত্তা বলয় তৈরি হয়েছে। ওরা চারজন তার উষ্ণতাটুকু গিলে নিতে চাইছে। তীব্রভাবে।
    ভাইরাস অর নো ভাইরাস।

    পর্ব চৌষট্টি

    ঝলসানো। পোড়া কাঠের মত উমনো ঝুমনো দুপুর। বৃষ্টি থেমে গেলে এইরকম দম আটকানো গরম পড়ে। ইলেকশন শুরু হয়ে গেছে আটদফাতে। পিএম ভার্সাস সিএম। শ্যামা কোনো পার্টি বোঝে না। টুপুর বলেছে, নোটাতে দেবে নাকী?

    সেটা কোন পার্টি তাও শ্যামার জানা নেই।

    ছেলের জন্য মোবাইল দাম করতে গেছিল। মাইক্রোম্যাক্স পেয়েছিল সাড়ে পাঁচ হাজারে। একটু দরাদরি করলে পাঁচ তিনে হয়ে যাবে। কিন্ত বাবলু বেঁকে বসেছে। মাইক্রোম্যাক্সের মডেল তার পছন্দ নয়। দুই জিবি। নেট জোরে চলবে না। বাবলুর তিন জিবির ফোন চাই অন্তত। ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপ করতে চায় সে। শ্যামা জিবি টিবি বোঝে না। ফোনটা কিনতেই হবে ছেলের জন্য। দেবরূপের কাছে কিছু টাকা দিয়ে গেছে। বাকীটা দেবরূপ দিয়ে দেবে বলেছে। বাবলুর গেম খেলার খুব ইচ্ছে। স্কুলে একটা অনলাইন পরীক্ষার কথা শোনা গেছে মিড ডে মিলের দিন। সেটার জন্য ফোন তো দরকার।

    মাঝেমধ্যে ক্লাস নিয়েছে দেবরূপ কিন্ত মোস্টলি ইরেগুলার ছিল। অনেকদিন বাদে ল্যাপটপে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছে ও। ত্রিদিব এখন স্টেবল। অক্সিজেন স্যাচুরেশন বেড়েছে। সুগার কন্ট্রোলে এসেছে অনেকটা। এইভাবে চললে সামনের সপ্তাহে তাঁকে বাড়িতে আনা যেতেই পারে।

    জুম প্রো তে একটা বড় মিটে ইনভিটিশন ছিল। জয়েন করতে করতে ও দেখলো মালবিকা ভেজা চুলে, একটা হাল্কা গোলাপি শাড়িতে ধূপ দিচ্ছেন। দৃশ্যটা ভীষণ ভালো লাগল ওর। মালবিকাকে অনেক দিন বাদে খুব রিল্যাক্স্ড দেখাচ্ছে। এইসব দৃশ্য দেখলে শরীর স্নিগ্ধ হয়ে চোখ জুড়ে ঘুম আসে।

    ঘুম খুব ডিস্টার্বড হয়ে গেছে। কোভিডের পরেই গন্ডগোল করছিল ঘুম। অদিতি চলে যাবার পর আরো ডিস্টার্বড। অনেক রাত কেটে যায় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। বাবু কোনোদিন পেসিমিস্টিক নয়। ভীষণ পজিটিভ ছিল। সেটা কুরে কুরে খেয়েছে কোভিডকাল। নির্ঘুম। সাইকিয়াট্রি ও বিহেভেরিয়াল সায়েন্স ঘুম আর স্বাস্থ্য, ঘুম আর ইমিউনিটি নিয়ে দিনরাত বকবক করছে। স্লিপ ট্র্যাকাররা কাজ করছে ইনসমনিয়ার সমাধান সন্ধানে। সেইসব সন্ধানে হয়তো কোনোদিন কিছু হচ্ছে না। মালবিকাকে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাবু জুড়ে ঢুকলো।
    এপ্রিলের গোড়া থেকেই কম্বিনেশন কোভ ট্রায়াল শুরু হয়েছে পৃথিবীজোড়া গবেষণাগারগুলিতে। ইতিমধ্যেই একশো সাতাশটি ক্যান্ডিটেট ভ্যাকসিন এসেছে। এদের মধ্যে সাঁইত্রিশটি ভ্যাকসিন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের অধীনে আছে। উনিশটি ভ্যাকসিন অথরাইজড। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন ভ্যাকসিন ব্রেকথ্রু ইনফেকশনের কথা বলছে। এই ইনফেকশন তখনই হয় যখন এসএআরএস কোভটু আরএনএ বা অ্যান্টিজেন ভ্যাকসিনেশনের চোদ্দদিন পরে মানুষের শরীরে পাওয়া যায়। একবার ভ্যাকসিন আর ভাইরাসের দুনিয়ায় ঢুকে গেলে ঘটমান বর্তমান তুচ্ছ হয়ে যায়। জুমে চিফ মেডিক্যাল অফিসার প্রফেসর জোনাথন ভ্যান থম ডিমনস্ট্রেট করছেন। নামটা শুনে বাবুর ক্যাপটেইন ভ্যান ট্রপের কথা মনে পড়লো। বাবা সাউন্ড অব মিউজিক দেখিয়েছিল। ও তখন ফাইভ। লিজা তার পুরুষসঙ্গীর সঙ্গে গোলাপি ডান্সফ্রকে ঘূর্ণি তুলে নেচে চলেছে, আই অ্যাম সিক্সটিন ইউ আর সেভেন্টিন। ইটস ট্রুলি দ্য ওয়ার্ল্ড অব মেন। লিজা আর এই ছেলেটির বিবাহ হলে কী তাদের দাম্পত্য ত্রিদিব আর মালবিকার মত মোহহীন, প্রেমহীন হত? কে জানে? কাঁচের ঘিরে বজ্র বিদ্যুতের নির্ঘোষ। ভিতরে এক বিদ্যুৎলতা।
    প্রফেসর ভ্যান টাম বলে চলেছেন। লস অব ভ্যাকসিন প্রোটেকশনের দুটি কারণ আছে। ইমিউনিটি কম বা কমে আসছে। আর ভ্যারিয়ান্টস।
    কোভিড নাইন্টিনের ভ্যারিয়ান্টস। মডার্ণা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ। মডার্ণার সিইও স্টিফেন বেনেল আসছেন।
    উই মাস্ট বি প্রো অ্যাক্টিভ অ্যাজ দ্য ভাইরাস ইভলভ্স। ক্লিনিকাল ট্রায়ালের পর্যায়ের পর পর্যায় চলেছে। ভ্যাকসিনেটেড ভলান্টিয়ারদের অ্যান্টিবডি নিয়ে কাজ হচ্ছে। সেখানে দেখা গেছে যে এঁদের অ্যান্টিবডিগুলো মডেল এসএআরএস কোভটু কে নিউট্রালাইজ করে দিচ্ছে। মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত।
    আটজন ট্রায়াল ভলান্টিয়ারের সিরাম নিয়ে মডেল করোনা ভাইরাস বা সিউডোভাইরাসকে নিরস্ত্র করা গেছে। নিরস্ত করা গেছে।
    এখন সমস্যার গতি অন্যদিকে। বেনেল একটি ব্লু স্যুট পরেছেন। কী চমৎকার দেখতে তাঁকে। এত সুন্দর চেহারা আর ঝকঝকে ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলে ভাইরাসের কথা মনেই আসে না। অথচ তিনি বলে যাচ্ছেন, আলফা ভাইরাস, বিটা ভ্যারিয়ান্ট, ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের কথা। ইউকে তে ডেটা ভ্যারিয়ান্ট ইতিমধ্যেই ছড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাতে বিটা। তুলনামূলক ভাবে আলফা ভ্যারিয়ান্ট কম ছড়িয়েছে।
    টোট্যালি আনপ্রিপেয়ার্ড অ্যাম আই টু ফেস দ্য ওয়ার্ল্ড অব মেন।
    লিজা গাইছে। ছেলেটি মোহাবিষ্ট হয়ে ঘুরছে। অথচ এই মোহ ক্ষণস্থায়ী। মানুষ টোট্যালি আনপ্রিপেয়ার্ড টু ফেস দ্য ওয়ার্ল্ড অব ভাইরাস।
    মালবিকার ধূপ দেখানো শেষ হল।
    - বাবু খেতে বসবি?
    অনেকদিন বাদে তারা আজ নিশ্চিন্তমনে খাবে। মা'কে কী বলবে রিণা যোশির কথা? সে যে আর তাদের সাংসারিক মানচিত্রে এক্জিস্ট করে না, সেটা মায়ের কী জানা দরকার?
    তারপর ভাবল, থাক। মালবিকাকে যেচে কিছু বলার দরকার নেই এখনি।
    বেনেল বলে যাচ্ছেন,
    মডার্ণা ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে, তা কোভিডের সমস্ত ভ্যারিয়ান্টসকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম হয়েছে।
    তবে কী আশার আলো দেখতে চলেছে পৃথিবী?
    কিন্ত ভারতে তো কোভ্যাক্সিন আর কোভিশিল্ড শুধু।
    মালবিকাকে ভ্যাকসিন নিতে যেতে হবে। জোর করেই বলেছে বাবু। যা অবস্থা, যা শুনেছে তাতে ভ্যাকসিন ক্রাইসিস হবেই।
    ড. ত্রিপাঠী চলে এসেছেন জুমে। বিদেশে, ইউকে তে কম্বিনেশন নমস্কার কোভ ট্রায়াল চলছে।
    অ্যাস্ট্রাজেনকা এক ডোজ পিফাইজার পরের ডোজ। এতে নাকী আরো বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। আগে পিফাইজার পরে অ্যাস্ট্রাজেনকা দিলে দুডোজ অ্যাস্ট্রাজেনকার সমান কাজ হচ্ছে।মূল ব্যাপার অ্যান্টিবডি তৈরি। টি সেলস।
    ত্রিপাঠি বলছেন, মিক্সিং ডোজেজ মিনিট গ্রেটার ফ্লেক্সিবিলিটি। অনেক দেশেই মিক্সড ডোজ দিচ্ছে। স্পেইন। জার্মানি।
    টি সেলস হেল্প টি সেলস টু ব্লক অ্যান্ড কিল কোভিড।
    মিক্সড ভ্যাকসিনে কিছু স্বল্প মেয়াদী উপসর্গ হবে। গায়ে হাত পায়ে ব্যথা। মাথা ব্যথা। জ্বর। বাট ইট উইল হেল্প।

    ইট উইল হেল্প। এটাই শেষ কথা।
    বাবু খেতে এসে টেলিভিশন খুলে দিল।
    মে মাসে আবার ঝড় আসছে। ইয়াশ। সংবাদপাঠক ভীষণ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছেন। যেন ঝড় এসে গেছে।
    সবাই খুব হাইপার এখন।
    অথচ কেউ টিভিতে এই কম্বিনেশন ভ্যাকসিনের কথা কেউ বলছে না। ভলান্টিয়ারদের কথা কেউ বলছে না। আশ্চর্য!
    মালবিকার মুখে একটা শান্ত ভাবে। ডিম দিয়ে একটা স্পেশাল বেগুনভাজা করেছেন। বাবুর পছন্দের।
    ছেলেমেয়ের প্লেটে তুলে দিচ্ছেন প্রসন্নমুখে।
    টুপুর একটা বই মুখে দিয়ে এসেছিল।
    মালবিকা পটলপোস্ত এগিয়ে দিচ্ছেন।
    টুপুর চেঁচিয়ে উঠল।
    - মা, তুমি ভুলে গেছো। অ্যাজ ইউজুয়াল! আমি বেগুন খাই না !

    টিকটিকি দেখল, একটা ঝড় আসতে চলেছে। টুপুরের মুখ থমথমে।

    পর্ব পঁয়ষট্টি

    মোটামুটি একটা ছক কষে ফেলেছে। উড়িষ্যা সম্ভবত ঝড়ে বেশি আক্রান্ত হবে এবার। কিন্ত পশ্চিমবঙ্গের একেবারে দক্ষিণভাগ আম্ফানের রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ইয়াশ এর তান্ডবের কিছুটা অন্তত তাদের ওপরে এসে পড়বেই। হেমপাড়া, শরৎপাড়া, মিশনপাড়া, দক্ষিণপাড়া। দুহাজারের ওপরে জনসংখ্যা। চারশো'র বেশি পরিবার। প্রশাসন কিছুটা করছেন।আঞ্চলিক লোকেরাও। মশারি, শুকনো ফল, শুকনো খাবারের স্টক পাঠাবে ওরা আগেই। এক একেকটা প্যাকেট তৈরি হচ্ছে মেধাদের বাড়ির গ্যারাজে। ছাতেও কিছু। এক প্যাকেটে দুকেজি চাল, পাঁচশ ডাল, তিন কেজি তেল, চিনি। এইসব জিনিস প্যাকেট করতে সময় লাগে। রূপম এখন একা করছে। জাহিরের অভাবটা এইসময়গুলোতে স্পষ্ট। হা হা করে একটা খোলা হাসি হাসতো। তাপ্পিমারা জিনস আর সাদার ওপর কালো জেব্রা আঁকা টি পরা জাহিরের দেওয়ালে হেলান দেওয়া অবয়ব। ঝাঁকড়া চুল। ঈষৎ ফোলা চোখ, রাত্রিজাগরণ জনিত। সব অস্পষ্ট দেখতে পায় টুপুর বস্তাতে গুঁড়ো হলুদ, গুঁড়োদুধ, বিস্কিট আর স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট ঢোকাতে ঢোকাতে।
    জাহিরের চোখদুটো অরিজিৎ সিং এর মতো। লাগতো খানিকটা। চোখদুটো এখন নেই। জাহিরের যদিও দেহদান করা ছিল, কিন্ত শেষ পর্যন্ত ওর শরীরের কী হল কেউ জানে না। ওরা অনেক চেষ্টা করে জানতে পারেনি। ইলিনাও নয়। কেউ জানতে পারেনি।
    অথচ মৃত্যুর পরে শরীরে কোনো ভাইরাস থাকে না। কিন্ত ভয় থাকে। কেমন অদ্ভুত আতংক যেন তৈরি হয়েছে। জাহিরের স্বপ্নালু চোখ, খুব টানা ভ্রূ যেটা পুরুষের মধ্যে কম দেখা যায়, লম্বা আঁখি পল্লব, হাতের তিল সমস্ত মনে পড়লেই বিকল হয়ে যাচ্ছে ও। ইলিনা আন্টির কথা ভাবে না ও। ভাবতেই পারে না। যায় মাঝে মধ্যেই। তারপর মন থেকে কাট অফ করে দেয়। দম আটকে যায়।
    ও বাড়িতে জাহিরের কোনো ছবি নেই। ভাগ্যিস নেই। একজন কখনো দুজন আয়ার ভরসায় ইলিনা। প্রায় সারাদিন শুয়ে থাকেন। শবদেহ যেন। টুপুর বেশি কাছে যায় না। বাইরের পোশাক । ইচ্ছে করে গিয়ে ইলিনার হাতটি ধরে। ধরে না। একটা টুল নিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে।
    যেমন এখন আছে। গ্যারাজে। প্যাকিং করতে করতে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ব্ল্যাংক হাতে ভরতে থাকে নুন। চিনি।
    কে বেঁচে থাকবে, কে থাকবে না, কতক্ষণ বেঁচে থাকবে কিচ্ছু জানা নেই।

    আরো একবার ঝড় এলে হুগলি নদী নোণাজলে ডুবে যাবে। ফ্লাড শেল্টার তৈরি হতে শুরু হয়েছে আবার। এই মানুনগুলির অভ্যেস হয়ে গেছে বাড়িঘর ডুবে গেলে শেল্টারে চলে যাওয়া। পরিবার, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি সব কিছু নিয়ে উঠে যাবে। কিছু মরবে। কিছু টিকটিক করে বাঁচবে। রূপম একটা ঝাঁকুনি দেয় ওকে।
    অন্যদিকে পাঠাতে হবে মনকে। রিমোট কোথায়? হাতড়াচ্ছে ও। মালবিকাকে ঠিকঠাক দেখাশোনা করতে হবে। ঈশান আছে। দাদা। তার শরীর এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। পোস্ট কোভিড ইফেক্ট থেকে গ্যাছে। ত্রিদিব। বাবাকে বাড়ি নিয়ে আসতে হবে।
    ভাবো। চিন্তাকে ইমিডিয়েটের মধ্যে কনফাইন করো। আর কী কী করতে হবে? হিঙ্গলগন্জে জাহিরদের সেই বিশাল বাড়ি। দাদু। পাশে ঈদগাহর মাঠ। আর কখনো কী সেখানে যাওয়া হবে? রূপমের মুখটা পাল্টে জাহিরের মতো হয়ে যাচ্ছে কেন !
    বাড়িতে আপাতত দুটো তিনটে জরুরি কাজ। ফ্রিজ থেকে জল গড়াচ্ছে অবিরত। মেকানিক ডাকতে হবে। হলঘরের ডেস্কটপ অচল। সেটা ঠিক করালে মালবিকা অন্তত অনলাইনের ক্লাস নিতে পারবেন। মালবিকার ল্যাপটপ আপাতত দেবরূপের দখলে। তার নিজের ল্যাপটপ সর্বদা ঘাড়ে থাকে। ত্রিদিবেরটা পড়ে আছে। কিন্ত সেটা মালবিকার হাতে দেয় না টুপুর। যদি কিছু অপছন্দের চোখে পড়ে! মা কে আগলে রাখে সে। সে নিজেই এখন পক্ষীমাতা। তার অন্যমনস্ক হলে চলবে না। ইলিনা আন্টি শুয়ে থাকুন। দুচোখ ফ্যানে নিবদ্ধ। হাত বুকের কাছে। পাশে একটা কোলবালিশ। মাঝে মাঝে তার ওপর হাতটা আছড়ে পড়ে।
    পড়ুক। টুপুর ভাববে না।
    তোমার ওপর নাই ভুবনের ভার। ঈশান মাঝেমাঝেই বলে। প্যাকিং চলুক।
    জাহির একটা অ্যাপ বানাচ্ছিল। ডিজিটাল লার্ণিংএর। সাবজেক্ট ওরিয়েন্টেড।
    - তুই এইসব করছিস কেন জাহির? এগুলো তোর আমার মতো খাতাপিতা ঘরে মানায়। আমাদের ক'টা ছেলেপিলে এগুলো অ্যাফোর্ড করতে পারবে?
    - যারা পারবে তারা তো করুক। ভাই কিছু তো হোক।
    - ডোন্ট্যু থিংক ডিজিটাল লার্ণিং ইজ বেসিক্যালি ডিজিটাল ডিভাইড? তুই মানিস না প্রতীচি ট্রাস্টের রিপোর্ট?
    জাহির ওর অরিজিৎ সিং এর মতো চোখ তুলে বললো, না।

    বাহাত্তর পাতার রিপোর্ট বেরিয়েছে। অমর্ত্য সেনের প্রতীচি ট্রাস্টের। কিন্ত এটাও কলকাতা বেসড। সারা পশ্চিমবঙ্গ মানে শুধু কলকাতা! দুহাজার কুড়ির এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সার্ভে ভিত্তি করে রিপোর্ট। প্রাইমারি স্কুলের চল্লিশ শতাংশ ছেলেমেয়ে অনলাইন ক্লাস করতে পারে নি।
    ডিজিটাল ডিভাইডের দুটি কারণ দেখিয়েছেন ওঁরা। শিক্ষকরা। যাঁরা রিপোর্ট পেশ করেছেন।
    অ্যাফোরডেবিলিটি। আর নিয়মিত অ্যাক্সেসিবিলিটি। আনইটেরাপটেড ডেটা কী পাওয়া যাবে এদেশে যে ছেলেমেয়েরা পড়বে? ন্যাশনাল রিসার্চ কোঅর্ডিনেটর সাবির আহমেদ বলেছেন। কলকাতাতেই যদি এই হাল হয় তবে গ্রামে গন্জে কী হবে? আগে মিসিং ছেলেমেয়েদের এনরোলিং হচ্ছিল। এখন স্কুল মিসিং।
    - তুই ভাবিস না ইনস্টিটিউশনাল লার্ণিং খুব জরুরি? আমরা তো নিজেরাও সেই সিস্টেমের প্রডাক্ট।

    জাহিরের মুখ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে সার্ফের প্যাকেটে। রাশীকৃত। জাহিরের মুখটা বাবলুর মতো হয়ে যাচ্ছে। শ্যামার ছেলে বাবলু। আজকাল ফ্যা ফ্যা করে ঘোরে নাকী।
    সেকেন্ড ওয়েভ পঞ্জাবে পিকে গেছে। তারপর মহারাষ্ট্রে। সূত্রার গাণিতিক মডেল বলেছে মিড এপ্রিলে চরমে পৌঁছাবে ইনফেকশন। পনেরো তারিখের পর।
    ওরা কী সব জানে? মণীন্দ্র আগরওয়াল। আইআইটি। কানপুর। ইনফেকশন ট্র্যাজেকটরি দেখিয়েছেন।
    কক্ষপথ। সংক্রমণের পথ থাকে।সেই পথ ধরে মহাকাল এলো।
    বাবলুর মুখটা আবার পাল্টে রূপমের হয়ে গেছে।
    কী রে! বারবার কী হচ্ছে তোর? নিউজ আপডেট দেখ। শঙ্খ ঘোষ নেই !
    আজ একুশে এপ্রিল।
    টুপুর কিছু বললো না। তাকিয়ে আছে।
    সব মুখগুলো পাল্টে যাচ্ছে কেন? কে নেই? আজ কত তারিখ?
    রূপম দেখলো, ও বিড়বিড় করছে।
    - পিতল মুখে শূন্যে ঝোলে সূর্য সারা দুপুর
    ঘরেতে তার তাপ পৌঁছায়, জ্বর হয়েছে খুকুর।

    পর্ব ছেষট্টি

    দোলমা রান্নাটা আর্মেনিয়ানদের ট্র্যাডিশনাল, আমেলিয়ার ভীষণ পছন্দের রান্না। ক্যাটভিনে অসাধারণ সুস্বাদু দোলমা বানায়। সে রেস্তঁরা বন্ধ। তাই সুনন্দিতার রান্নাঘরে আজ দোলমার প্রস্ততি চলছে। তার অনেকগুলো কারণ। প্রথমত আমেলিয়ার দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিনের পরে কিছু শারীরিক অসুবিধে হয়েছিল। সেগুলো সেরে গেছে। এখন তিনি বেশ ভালো আছেন। ত্রিদিবের সুস্থতার খবর এসেছে। সুনন্দিতার এটা প্যাশন। কারু সুস্থতার বার্তা পেলে তিনি কিছু স্পেশ্যাল খাবার বানান। নিকি লকডাউনে জাপানি ভাষার একটা সার্টিফিকেট করে ফেলেছে এবং কৃষকরা তাঁদের দাবী এখনো অব্যাহত রেখেছেন। বাবু হয়তো শিগগিরি ফিরবে ত্রিদিবকে বাড়িতে সেট করে। যদিও দিল্লিতে সেকেন্ড ওয়েভ ভীষণ দাপটে, পরমপ্রতাপকে একদম বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, তিনি ওয়র্ক ফ্রম হোম করছেন এবং দোলমার সুবাদে বিচলিত হয়ে উঠছেন, সুনন্দিতা এই সময়গুলো একটু আনন্দময় করে রাখতে চাইছেন। এই দোলমা বস্তুটা ফ্যামিলি ফেভারিট। বিয়ের পরে শিখেছেন অনেক পরিশ্রম করে। সুনন্দিতা ভাবছেন, বাবু এলে আরেকবার বানাবেন। এখন এতকিছুর উপলক্ষ্যে একটা সেলিব্রেশন তো হোক! ফুড ইজ আ ফাইন সেলিব্রেশন। সবচেয়ে বড় কথা মানি ফিরে এসেছে। সে সঙ্গে না থাকলে এইসব ঝক্কি খাবার করা মুশকিল।

    কিচেনের লম্বা টানা জানালাতে কিছু গাছ রেখেছেন সুনন্দিতা । চোখের আরাম। মনের আরাম। মানির দেখে দেখে ইচ্ছে ছিল অমন গাছ লাগাতে তার নিজের এক চিলতে রান্নাঘরে। যদি কখনো হয়। টিনের কৌটেতেই লাগাবে। বা প্লাস্টিকের কৌটোতে।

    এখন আর ভাবে না নিজের রান্নাঘরের কথা। কোমরে বিশুর মারের দাগ ও ব্যথা দুইই আছে। মানি বিশুর কথা না ভাবার চেষ্টা করে। কী হবে ভেবে? ঐ লোক শুধরাবে না জীবনে। মাঝখান থেকে তার নিজের টাকাগুলো যাবে। না হবে মনের সুখ। না হবে শরীরের সুখ।পরমপ্রতাপের গ্যারাজের ওপর মেজেনাইন ফ্লোরে পনেরোদিন আটক ছিল মানি মালদা থেকে এসে ।কোয়ারানটাইন। তখন খুব ব্যথা শরীরে। ছ্যাঁকাপোড়া সহ্য করে একা ঘরে বন্দি থাকা বড় জ্বালা। ছাড়া পেয়ে বাড়িতে ঢুকে মানি হাঁপ ছেড়েছে। এই সারিবদ্ধ রান্নাঘর বাগানে টানা শার্সির পাশে সুদৃশ্য মানিপ্ল্যান্ট যা কীনা জানালা বেয়ে উঠে গিয়ে বিস্তার লাভ করেছে, কিছু স্যাকুল্যান্টস, ধনেপাতা, লঙ্কা, বিশাল রেফ্রিজারেটর, হাল্কা শব্দে চলতে থাকা মাইক্রোয়েভ, চার বার্ণারের গ্যাসআভেন, চিমনিপ্রসূত নরম আলো মানিকে অর্থজনিত নিরাপত্তা দেয়। তার একটা নিছক শারীরিক আরাম আছে। মন শান্ত করে মানি পেঁয়াজ কুচি করতে থাকে আরো।

    আমেলিয়া বায়না ধরেছিলেন চার্চে যাবেন। কে বোঝাবে তাঁকে যে এখন বাইরে যাওয়া যাবে না। দিল্লির কিষেনগন্জের একটু বাইরে প্রাচীন আর্মেনিয়ান চার্চ আমেলিয়ার পছন্দের জায়গা।সতেরোশো উনচল্লিশে নাদির শাহর ভারত আক্রমণের পরে এই চার্চটি কোনোমতে অক্ষত ছিল। সতেরোশো তেরোতে ফাদার স্টিফানাস তৈরি করেছিলেন। কবরখানাও আছে। সতেরোশো আশির একটি ফলকনামা আছে তাতে। প্রাচীনতম কবর। ভারত সরকারের আর্কিওলজি বিভাগ দেখভাল করে। আমেলিয়ার জেদ হয়েছিল বাবুকে নিয়ে যাবেন। কোথায় বাবু আর কোথায় বাইরে যাওয়া !
    তাঁর মন ভোলাতে আজ আর্মেনিয়ান মহার্ঘ্য খাদ্য আর গয়না।
    আমেলিয়া আজ গয়না পরেছেন। কোভিড সুনন্দিতাকে শিখিয়েছে, কোনোকিছু ফেলে রাখার দরকার নেই। যা আছে, ব্যবহার করে ফেলো। শুকদেব দহলজির দেওয়া শাল, টি সেট দেখলে চোখে জল আসে তাঁর।
    কিচ্ছু জমিয়ে রাখবেন না আর।
    আমেলিয়াকে সাদা লেস বসানো একটি গাউন পরানো হয়েছে। সাধারণত আর্মেনিয়ানদের গয়না বেশ ভারি। কিন্ত সুনন্দিতা পছন্দ করে গুয়োগোকো কোম্পানির হাতিকি কালেকশনের কিছু রূপোর গয়না কিনেছিলেন নিজের জন্য। আমেলিয়ার জন্যেও। এই গয়নার তেমন ইলাবোরেট ডিসপ্লে নেই। তাই আমেলিয়া ভ্রূ কুঁচকেছিলেন। সুনন্দিতা অনেক কষ্টে তাঁকে বুঝিয়েছেন গয়নার জগতেও রেনেসঁ হয়। গয়নাগুলো এখন অনেক হাল্কা। পরিচ্ছন্ন। আমেলিয়ার পরতে কষ্ট হবে না।

    হোয়াই শুড আই ওয়ের দিস? আর্মেনিয়ান জুয়েলরি ইজ ইসথেটিক্স অব দ্য আর্মেনিয়ান নেশন! তিনি তো ট্যাটেওসিয়ান লন্ডন ব্র্যান্ড পছন্দ কর্নাটকের! তাঁকে এমারেল্ড ও টারকয়েজ খচিত গহনাটি দেখানো হলে অবশ্য তিনি প্রীত হন! নতুন গয়না পরে খুব খুশি মুখে খাটে একটি পিংক কুশনে হেলান দিয়ে বসে আছেন। নেকলেসটা রূপোর। মাঝখানে আর্মেনিয়ানদের প্রতীক।ডালিম। কার্পেটের ডিজাইন আর নিচে প্রাচীন ক্যালিগ্রাফি। আর্মেনিয়ানদের গয়না ভারতীয় গয়নার থেকে একদম আলাদা।
    নিকি আমেলিয়ার গয়নাকে পছন্দচিহ্ন দেখিয়ে গেছে। সে গয়না পরে না তবে পছন্দ করে।
    খোদ আর্মেনিয়ানদের দুটি নারী দিবস। আটই মার্চ থেকে শুরু করে সাতই এপ্রিল তাদের নারী মাস। সাতই এপ্রিল আরেকটি নারী দিবস যেখানে আর্মেনিয়ানরা মেয়েদের সৌন্দর্য আর নারীত্বকে সেলিব্রেট করে। পুরুষেরা প্রিয় নারীকে ফুল, নানাকিসিমের উপহার দেয়। সে মা, বোন, প্রেমিকা, যে কেউ হতে পারে। সাতই এপ্রিল দিনটা মা মেরির। বাইবেলে বলে মেরি যখন ইসায়াহ র বই পড়ছিলেন। পয়গম্বর এসে তাঁকে খৃষ্টজন্মের পূর্বাভাস দিয়ে যান। সোভিয়েত আমলে এসব দিন পালন করার রেওয়াজ উঠে গেছিল। হালে আবার চালু হলেও যুদ্ধ আর করোনা সব তুলে দিয়েছে। তবু আমেলিয়ার এইসব মনে থাকে। যদিও এপ্রিল শেষ হতে চললো এবং সাত তারিখের দিকে তাঁর শরীর তেমন ভালো ছিল না, কিছুই পালন করা হয়নি। বেটার লেট দ্যান নেভার বলে তিনি সাজগোজ করেছেন। বিউটি হ্যাজ টু বি সেলিব্রেটেড।

    মানি দ্রুত হাতে চিকেন কিমার সঙ্গে পেঁয়াজ কুচি, লবঙ্গ, রসুনকুচি, ধনেপাতা আর পার্সলে পাতা মেশাচ্ছে। সুনন্দিতা পাশ থেকে টোম্যাটো সস আর নুন, গোলমরিচ দিয়ে দিলেন আন্দাজমত। বাসমতী চাল ভেজানো আছে। সাধারণত এটা বিফ দিয়ে হয়। কিন্ত আমেলিয়ার এখন আর বিফ সহ্য হয়না। এই জিনিস রেডি করা পর্যন্ত মানি করে। তারপরের কারিকুরিটা সুনন্দিতার। হাত দিয়ে গোটাটা মেখে নেওয়া চালসহ। চাল ছাড়াও করেন সুনন্দিতা কিন্ত আজ দোলমা ডিনার। ইট হ্যাজ টু বি হেভি। এরপর আসল কাজ। টিনড গ্রেপ লিভস। কৌটো খুললেন সুনন্দিতা। সুবাস ছড়াচ্ছে আঙুরপাতার। একটা টকটক গন্ধ! মস্ত একটা পাত্র চেপেছে গ্যাসে। তার নিচে সুনিপুণ ভাবে বিছিয়ে দিচ্ছেন আঙুরপাতা। মানি জানে এরপর আলাদা করে ট্রেতে একেকটা পাতা নেবেন সুনন্দিতা। তাতে ঐ মশলামাখানো মাংস আর চাল পুর দেবেন। দীঘল আঙুল তাঁর। রোল বানাবেন ছোটছোট।
    ছেলে দুটো মাংস খেতে বড় ভালোবাসে।
    থাক। ওদের বাপ খাওয়াক। মানি ভাববে না। চোখ তাও কড়কড় করে।
    মানি শ্বাস চেপে একটা একটা করে রোল চাপায় পাত্রে। ধীরে ধীরে আঙুরপাতা মোড়া চাল মাংস রোলে পাত্র পূর্ণ হয়ে যায়। ভীষণ মূদু সুস্বাদু গন্ধের মধ্যেও মানি একফাঁকে চোখ মুছে নেয়।
    সুনন্দিতার মানির দিকে আজ খেয়াল করেননি। এই রান্না খুব মন দিয়ে করেন তিনি। একটু এদিক ওদিক হলে আমেলিয়া বলবেন, ইটস নট লাইক ক্যাটভিন।
    এনিওয়ে হোয়েন উইল বাবু কাম? নিকি, এনি নিউজ অব দ্য ওয়ার? কল বাবু প্লিজ!
    আনন্দ হলে, উদ্বেগ হলেই বাবুর খোঁজ পড়ে।
    যুদ্ধের খবর জানতেই হবে। নিকি বা বাবু ছাড়া তাঁর চলবে না।
    পারভেজ আছে যে আর্মেনিয়াতে! পঞ্জাবের লোধি গ্রামে মেহতাদের ঘনিষ্ঠ পারভেজ আলি খান। চারবছর আগে সে বউ আর দুটি মেয়ে নিয়ে আর্মেনিয়ান রাজধানী ইয়েভরেনে চলে গেছে। রেস্তঁরা খুলেছে সেখানে। ইন্ডিয়ান মেহেক রেস্তঁরা।
    নাগরনো কারাজাখের যুদ্ধে যে আর্মেনিয়ানরা পালিয়ে এসে শরণার্থী হয়ে রাজধানীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বারো ঘন্টা শিফ্টে কাজ করে তাদের ভারতীয় রান্না করা খাবার, পিওর ইন্ডিয়ান ফুড সরবরাহ করছে পারভেজ আর তার পরিবার। আমেলিয়ার ভীষণ কৌতুহল। অসম্ভব টান। কী করছে তারা। কেমন আছে? আর্মেনিয়ান প্রায় একশো ভারতীয় পরিবার। চার হাজার ভারতীয় ডাক্তারির ছাত্র। যারা পেরেছে বন্দেভারত ফ্লাইটে চলে এসেছে।
    সাতাশে সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে যুদ্ধ। সঙ্গে করোনা ভাইরাস। তিরিশ হাজারের ওপর শরণার্থী রয়েছেন ইয়েভরেনে। পারভেজ প্রথমে ভেবেছিলেন ড্রাই ফুড দেবেন। কিন্ত দিনের পর দিন ড্রাই ফুড খেয়ে লোকে থাকবে কী করে! কন্যাদুটি, আক্সা ও আল্সা অতি উদ্যোগী। কর্মচারীদের নিয়ে তারা রান্না শুরু করেছে।
    পারভেজ ভেবেছিলেন প্রাগে একটা রেস্তঁরা খুলবেন। করোনার জন্য সে আর হয়ে উঠল না।
    অর্থটা পারভেজ যুদ্ধ বিতাড়িত, করোনা আক্রান্ত মানুষদের খাওয়ার কাজে লাগাচ্ছেন।
    তাঁর কথা উঠলেই আমেলিয়ার মুখ উজ্জ্বল। উদ্ভাসিত। পরমপ্রতাপ এবং তাঁর সহযোগী বিল্ডাররাও পারভেজকে অর্থ পাঠাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে ভারত আর্মেনিয়ানদের এই দুঃসময়ে সাহায্যই করে চলেছে।
    ইন্ডিয়ান রেস্তঁরা হেল্পিং ডিসপ্লেসড আর্মেনিয়ানস। নিকি খবরটা শোনালেই আমেলিয়া উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। উজ্জ্বলতার কোনো বয়স হয় না।

    কলকাতায় বাবু স্কাইপেতে আমেলিয়ার মুখের দিকে চেয়ে এটাই বুঝলো।
    ভাইরাস, অসুখ, নার্সিংহোম, টেনশন সামলে সে বিধ্বস্ত। আজ আর্মেনিয়ান চার্চে গেছিল। তাদের লাইব্রেরি দেখে এসেছে। ফাদার খুব খুশি। আমেলিয়ার কথা বলেছে বাবু তাঁকে।
    বাবু মনকে ডাইভার্ট করতে চাইছে।
    টেল মি সামথিং অ্যাবাউট ইওর পিপল ফাদার।
    ভাইরাস বিধ্বস্ত শরীর। মন। বাবু অন্য কিছু ভাবতে চাইছে। প্লিজ।
    সামথিং এলস।

    চার্চের মিউজিক টিচারের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছেন ফাদার। মাস্কে ঢাকা মুখ পরস্পরকে হেলো বলে। করমর্দন হয় না। সামান্য ঝুঁকে পড়া মাত্র। চশমার আড়ালে চোখ।
    এখন কোভিডকাল।

    পর্ব সাতষট্টি

    ফরেভার ফ্রিডম। অ্যান্ড ব্রাদারহুড ফরেভার।

    ভাচাগাম ওআদেভোসিয়ামের চোখদুটি সর্বদা হাসে। সংগীত সাধক যাঁরা তাঁদের কারু কারু চোখে ঐ দীপ্তি থাকে। আ রেয়ার কাইন্ড অব পিউরিটি। শুধু সাধকের চোখেই যা দেখা যায়।
    মির্জা গালিব স্ট্রিটের বাসিন্দা ভাচাগাম দেবরূপের সঙ্গে করমর্দন করতে পারেন নি। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোভিড নাইন্টিন। কিন্ত ভাচাগাম একজন উষ্ন মানুষ। তাঁর চোখ কথা বলে। প্রসন্নতা দিয়ে তিনি দেবরূপকে স্বাগত জানালেন।

    বাবু ভালো লাগছিল। অনেকদিন বাদে টেনশন মুক্তির স্বাদ।
    - সো ইউ আর আ ভাইরোলোজিস্ট?
    - প্লিজ নো মোর টক অ্যাবাউট ভাইরাস। আই যাস্ট নিড সাম রিলিফ। আই টক অ্যাবাউট ভাইরাস ইন দ্য ক্লাস অ্যান্ড আই হ্যান্ডল আ কোভিড পেশেন্ট আউট অব দ্য ক্লাস। লেট মি গেট আউট অব ইট।
    পিয়ানো শিটগুলো সামনে রাখা।
    ভাচাগানের আঙুল খেলছে পিয়ানোতে। ঈষৎ দুলছে মাথা।
    দ্য মাদার অব অল, গ্লোরি টু হার।
    দ্য ক্রস ইজ দ্য সাইন অব খ্রাইস্ট।
    সাইন আর খ্রাইস্ট বলার সময় ভাচাগান দুলে উঠছেন, কন্ঠ এবং শরীর সমেত। দেবরূপের অনিল থমাস ও পলির কথা মনে পড়ল।
    ভাচাগানের সহাস্য চোখ বুঁজে এসেছে। আ স্মাইল অন হিজ ফেস। বিশ্বাসী মানুষদের মুখেই এমন হাসি দেখা যায়।
    দ্য ক্রস ইজ দ্য স্পিরিচুয়াল ওয়েপন। ডোন্ট ওয়রশিপ দ্য মেটিরিয়াল। রাদার ওয়রশিপ দ্য পাওয়ার অব গড।

    দেবরূপের একটু বিপন্নবোধ হচ্ছে। সে নরেন্দ্রপুরের ছাত্র। একবার তাকে বিবেকানন্দ সাজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছিল ঘন্টা তিনেক। ক্লাস সিক্সে। ব্যাপারটা তার বিশেষ ভালো লাগেনি। খৃষ্ট বা রামকৃষ্ণ, কাউকে নিয়েই তার মাথাব্যথা নেই তেমন। কিন্ত এখন সে একটা আশ্রয় খুঁজছে। নিজের কাজের জন্য তাকে একটা নির্দিষ্ট পড়াশোনা করতেই হয়। তার বাইরে সে কিচ্ছু পাচ্ছে না। নেটফ্লিক্স বা আমাজনে কনসেনট্রেট করার মত ক্ষমতাও নেই এখন। সামথিং এলস।
    কিন্ত ভাচাগান যে এই গভীর বিশ্বাসে গেয়ে যাচ্ছেন, এতে কী কিছু পাওয়া যাবে? সে বুঝে উঠতে পারছে না।
    ভাচাগান হিন্দি আর বাংলা মিশিয়ে কথা বলেন।
    টুডে আর্মেনিয়া ইজ ইন ট্রাবল। নোবডি ওয়ান্টস ওয়ার।বন্ধুদের ডেকেছেন ভাচাগান। অর্থ ডোনেট করার জন্য। নাগারকো যুদ্ধে একটা বড় পপুলার ইন্ডিয়ান সাপোর্ট কাজ করছে। দেবরূপের জানা ছিল না।
    ভাচাগানের আঙুল খেলে যাচ্ছে পিয়ানোর ওপর। সরু, লম্বা আঙুল।
    সুশীল চৌধুরি একটি কিতাব লিখেছিলেন আর্মেনিয়ানদের ওপর। আর্মেনিয়ানস ইন ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ইন্টারকন্টিনেন্টাল ওয়র্ল্ড অব ট্রেড।
    ষোলোশো নিরানব্বই সাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরসরা আর্মেনিয়ানদের কম্যুনিটির ওপর রিপোর্ট লিখলেন। মোস্ট এনশিয়েন্ট মার্চেন্টস অব দ্য ওয়ার্ল্ড। পৃথিবীর প্রাচীনতম ব্যবসায়ীরা। পরিশ্রমী। চুপচাপ। প্রুডেন্ট। সারা ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে এরা ঘুরে বেড়ায়। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিটি গ্রাম এদের নখদর্পণে। ব্রিটিশদের কাছে সার্টিফিকেট পাওয়া কঠিন।কিন্ত আংরেজের সন্তানরা জানতো এবং মানতে, ইফ ইউ ক্যাননট বিট দেম, জয়েন দেম।
    ষোলোশো অষ্টাশিতে চুক্তি হল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং খাজা ফানাওস কালান্টারের মধ্যে। ইয়েস। খাজা। বহু আর্মেনিয়ানদের ইসলাম কবুল করতে হয়েছিল বিভিন্ন পর্যায়ে। ইআইসি র সঙ্গে চুক্তি ছিল নিজেদের মূলধন এবং ঝুঁকি নিয়ে, বাংলায় ব্যবসা চালাবে আর্মেনিয়ানরা। তিরিশ শতাংশ লাভ। খাজা ওয়াজিদ তখন নামকরা ব্যবসায়ী। মিড এইটিন্থ সেঞ্চুরি। ডাচ, ফরাসী এবং ইংরেজদের সাপ্লায়াল ছিল আর্মাণীরা।
    বুঝেছো তো?
    বার্ডস অব প্যাসেজ।
    তারা এসেছিল বাইবেল খ্যাত আরাহাট থেকে, কিনতে এসেছিল সুগন্ধি মশলা আর সূক্ষ্ম ভারতীয় মসলিন। তারপর তারা থেকে গেল এই দেশেই।
    খোজা পিটার অ্যারাথুন। খোজা গ্রেগরির ভাই।মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী। রবার্ট ক্লাইভ তাঁকে কনফিডেনশিয়াল এজেন্ট হিসেবে নিযুক্ত করলেন মিরজাফরের সঙ্গে ফন্দি এঁটে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে উৎখাত করার জন্য। ব্ল্যাকহোল ট্র্যাজেডি। অলস, কুচক্রি মিরজাফরকে ছেড়ে পিটার অ্যারাথুন যোগ দিলেন মির কাশেমের সঙ্গে। বক্সারের যুদ্ধে। সতেরোশো ষাঠে বেঙ্গল আর্মিতে রীতিমত আর্মেনিয়ান কন্টিজেন্ট ছিল।
    মেসরভ জেকব শেঠ। আর্মেনিয়ানস ইন ইন্ডিয়া ফ্রম দি আর্লিয়েস্ট টাইমস টু দ্য প্রেজেন্ট ডে।
    বাবু উপুর হয়ে পড়ছে। ফাদার দুটি বই দিয়েছেন তাকে লাইব্রেরি থেকে। নিজের বিছানাতে। কতদিন বাদে নিজস্ব বিছানা। ঘরবন্দি। নাহলে সে কস্মিনকালেও এই বই ছুঁয়ে দেখতো না। দিল্লিতে সুনন্দিতার বাড়িতে না থাকলে ও আমেলিয়াকে দেখতো না! আর অদিতি বেঁচে থাকলে পুণে ছেড়ে দিল্লিতে যাবার কোনো কথাও ছিল না।
    সবকিছু ঘুরেফিরে যে কেন একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতেই ফিরে আসে! কোভিড হানা দেবার আগে কে কবে এসব ভেবেছিল!
    সে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। ত্রিদিবের বাড়ি আসার কথা দুদিন পরে। কী অগাধ আরামের মেজাজ সারাবাড়ি জুড়ে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন স্বাভাবিক হয়েছে ত্রিদিবের। তবে সিডেটিভ চলছে।ঘুমোচ্ছেন।
    বাবু এবার দিল্লি ফেরার কথা ভাববে। বাবা মা নিজেদের জায়গা বুঝে নিক। আমেলিয়ার কাছে বলতে হবে অদিতির কথা। আমেলিয়া তার কাছে এক বিস্ময়।
    তাঁর চোখ মুখে, কুন্চিত অথচ উজ্জ্বল ত্বকে, পোশাকে, আঙুলে এক বিপুল সাংস্কৃতিক ইতিহাস খুঁজে পায় বাবু। কিছুমাত্র জানবে না বই পড়ে। যাস্ট টু গেট ডাইভার্টেড। টু টেল হার, আমি আপনাকে জানার চেষ্টা করেছি আমেলিয়া। আপনি আমাকে একটু জানবেন?

    ক্রুতিকা লিখেছে, মিসিং ইউ। গতকাল প্রোফাইল পিকচার পাল্টেছে বাবু। দীর্ঘদিন বাদে। সাদাশার্ট। চুল কাটা হয়নি এখনো। স্যাঁলোতে যত কম যাওয়া যায়। ক্রুতিকা কমেন্ট করেছে, সেক্সি অ্যান্ড হ্যান্ডসাম।
    শুড আই গিভ ইট আ লাইক অর নট! ও ভাবছে। ভাবনার কত নতুন দিক খুলে গেছে এখন!! হাসছে ও। নিজের প্রোফাইলে ক্রুতিকা একটা হল্টারনেক ব্লাউজ ও ঘননীল শাড়িতে। স্মোকি আইজ। পুরোনোদিনের মডেলদের মতো সাজ। শোভা দে টাইপ। ল্যাবে ও শুধু চোখের মেকাপটা করে।
    না। বাবু কোনো উত্তেজনা বোধ করছে না। করে নি কখনো। পাশাপাশি কাজ করেছে। অথচ ক্রুতিকা যথেষ্ট অ্যাট্রাকটিভ। সো হোয়াই নট? আজকাল উদ্বিগ্ন বোধহয় তার।
    হ্যাজ অদিতি টেকন অ্যাওয়ে অল হিজ প্যাশন? সেও কী সম্ভব!
    ক্রুতিকার চোখদুটো আবেদনপূর্ণ। মোহময়ী হয়ে ওঠার সমস্ত তরিকা সে জানে। ল্যাবে সাধাসিধে পোশাকে থাকার নিয়ম চুটিয়ে ভাঙে সোশ্যাল মিডিয়াতে।

    একটা মেসেজ এলো। মেসেন্জার।
    বিদ্যুত তরঙ্গ খেলে গেল শরীরে। এমনও হয়!
    সিন্ডরেলা।
    - হাউ আর ইউ?
    - ফাইন! অ্যান্ড ইউ?
    সিন্ডরেলা পাশ কাটালো।
    - হোয়েন ইজ নেক্সট ক্লাস?
    জেনারেল অ্যায়েরনেস ক্লাসগুলো হচ্ছে না এখন ।
    - ডোন্নো। ফ্যাকাল্টি উইল ফিক্স সুন।
    - ডু ইউ ব্রুড ইভন নাউ?
    ফোন বন্ধ করে রেখে দিল ও।উত্তর দিল না।
    ব্রুডিং। এই শব্দটা ওর কাছে কিছুই অর্থ বহন করে না।তুমি কী জানো সিন্ডরেলা! ব্রুডিং মানে কী ! আমার রক্তে বহমান বিষন্নতাবোধ। টুকরো টুকরো পুণে। ফ্লোরাল স্কার্ট। শরীর শুধু একা একা শরীর হয় না। শরীরের মন থাকে। তার নিজস্ব ওঠা নামা থাকে। অদিতি হ্যাড কাম টু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট।
    ও আর অদিতি ছবি দেখতো। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। উত্তরা দেখছিলো সেদিন। শীতকাল ছিল। ওয়ানপট ডিনার বসানো ছিল আভেনে। শিৎকার শেষে সিল্যুয়েটে গৃহ। ল্যান্ডস্কেপ। উত্তরা ঘাড় ফেরায়। দুটা ডানা না থাকলে উড়বা কী করা? শরীর তো একটা ডানা। আরেকটা ডানা মন।
    ওরা তর্ক করেছিল। একটা গ্রাম্য অশিক্ষিত মেয়ে পারে এভাবে কথা বলতে? দেবরূপ বলেছিল। অদিতি ফিল্মের কাজ করা মেয়ে। ল্যাংগোয়েজ অব ফিল্মের কথা বলেছিল। বলেছিল শরীরের ভাষার কথা। আর ওদের মন মিশে যাচ্ছিল এক আদিম রসায়নে। তার একটা গভীর বিষন্নতা আছে। তাকে তুমি নিছক ব্রুডিং বলতে পারো না সিন্ডরেলা। কোর্স শেষ হলে কোন নামে সার্টিফিকেট নেবে তুমি? কাঁচের জুতো খসে পড়বে! ঘোড়ার গাড়ি কুমড়োর খোলা হয়ে যাবে! তখন তুমি কোথায় যাবে সিন্ডরেলা? জাগিয়ে দিলে আচমকা, আর ফিরে আসতে আসতে দেখলাম দীর্ঘ জলপ্রপাত। বহুদিন বাদে স্নান তৃষ্ণা। সিন্ডরেলা, তুমি কে? তুমি কী করে জানলে এই অন্তর্লীন বিনাদময়তার কথা? যাকে তুমি ব্রুডিং বলো? তোমার কী পোষা পরি আছে? হু আর ইউ?

    দরজা নক করে মালবিকা ঢুকলেন।
    - বাবাকে পরশু আনবি বাবু। তোর চুলটা কেটে দিই? কী কাকতাড়ুয়ার মতো হয়ে আছে?
    মালবিকা ছেলেকে স্যাঁলোতে যেতে দেবেন না। বাড়িতে কাঁচি আছে। বাবুর মা আছে।
    ভাচাগানের পিয়ানো বাজছে শরীরময়। ও খুঁজছে শরীরের গভীরে মন কোথায় থাকে? তুর্কি সেনা ধেয়ে আসছে আরহাটে।
    আর্মেনিয়নদের খৃষ্টধর্মের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ইসলাম। আরব হানা। তুর্কি হানা। সাফাবিদ আক্রমণ। ধেয়ে আসছে পঙ্গপালের মতো।
    খাজা। সম্মানীয় ব্যক্তি। খাজা উপাধিপ্রাপ্ত আর্মানি মুসলিম। ইফ ইউ ক্যাননট বিট দেম, জয়েন দেম।
    ইলেকশনের আগে ঘনঘন দল ছাড়ছেন টপ গ্রেডেড নেতারা।
    কী ভাবছেন? বিট করতে পারবেন না, তাই জয়েন করছেন? ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়, এক মিথ। সময় পুনরাবৃত্ত হয় না।
    অদিতির সঙ্গে অতিবাহিত সময় চক্রাকারে ফিরে আসবে না। তবু দেবরূপ আজ বিদ্যুতস্পৃষ্ট হল। একজোড়া সোনালি গ্লাস স্লিপার।

    কে?

    - থাক মা। এখন চুল কাটবো না।
    - দাড়ি রেখেছিল মুখে একগাদা।
    কে যেন বলেছিল তাকে দাড়ি রাখলে খৃষ্টের মতো দেখায়।
    মালবিকা স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছেন।

    কে?

    পর্ব আটষট্টি

    অনিল টমাস তাঁর বেডরুমসংলগ্ন বারান্দায় বসে।

    আবছা আলোতে কৃষ্ণ কিরীডম গাছটিকে মুকুট পরিহিত কোনো ঐশ্বরিক মূর্তির মতো দেখায়। পাশে ঝাউগাছগুলি প্রজা যেন।
    অনিলের মন ভালো নেই। তিনি এবং তাঁর পরিবার এখনো পর্যন্ত শারীরিক ভাবে সুস্থ আছেন, কিন্ত এই সেকেন্ড ওয়েভের ধাক্কা, অনবরত গৃহবন্দিত্ব, আতংক এবং আইসোলেশনে তিনি বিধ্বস্ত।

    কেরলে ট্রিপল লকডাউন রেস্ট্রিকশন চলছে। থিরুভানন্তপুরম, থ্রিশূর, এর্নাকুলমে এবং মোল্লাদের বিশেষত। এগুলো হাই রিস্ক এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ।
    অনিলকে খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে তাঁর ফুসফুসজনিত কারণে। আগে সবার ধারণা ছিল কোভিড একবার আক্রমণ করলে আর ফিরে আসে না। এখন দেখা যাচ্ছে একবার পজিটিভ রোগীও দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হতে পারেন। ভ্যাকসিনেটেড হলেও মানুষ করোনা আক্রান্ত হতে পারে। পলি এবং অনিল একেবারেই গৃহবন্দিত্ব নিয়েছেন বাচ্চাদের নিয়ে। পলির মা এবং বোনও এখন এই বাড়িতে।

    পিনায়রি ভিজয়ন প্রেস কনফারেন্স ডেকে চারটি জেলার কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করেছেন। এই জেলাগুলি ভয়ানকভাবে সেকেন্ড ওয়েভে অ্যাফেক্টেড। এই ভয়াবহতা ভীষণভাবে আশাতীত ছিল। ফার্স্ট ওয়েভে প্রথমদিকে কেরল যতটাই সফল ছিল, শেষের দিকে ততটাই ব্যর্থ।কেস ফেটালিটি রেট বলেছে, আরো অনেক আই সি ইউ দরকার। আসলে করোনার এই ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়ান্ট সম্পর্কে সাধারণ মানুষ একেবারেই অবহিত ছিলেন না। কোনো রাজ্যেই নয়। কেরলে কাজের কাজ যেটা হল, সেটা হল প্রত্যেকটি কোভিডের মৃত্যুর ডিটেইলড অডিট রিপোর্ট।

    তাতে নথিভুক্ত থাকল রোগীর নাম, বয়েস, মৃত্যুর কারণ, সম্পর্কিত ফ্যাক্টরগুলি, বাড়িতে মৃত্যু না হাসপাতালে, কতদিন রোগী ভুগেছেন, আইসিইউ না অক্সিজেন বেড, ভ্যাক্সিনেশনের স্লট।
    কেরালা সোশ্যাল সিকিউরিটি মিশনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. মহম্মদ আশিল বললেন, ডেথ উইল কাম ডাউন ইন দ্য নেক্সট টু অর ফোর উইকস ডিউ টু ডেথ ল্যাগ। তাঁর বক্তব্য, সরকারী অফিশিয়াল মৃত্যুর চেয়ে বাস্তবে মৃত্যুর ঘটনা তিন থেকে পাঁচগুণ।

    এটা যে ভীষণ সত্যি সেটা অনিল হাড়ে হাড়ে জানেন। এই ছোট্ট জায়গা চেঙ্গালাতে তাঁর অতি প্রিয় বন্ধু চক্ষু চিকিৎসক জনাথন অতি অকালে করোনাতে চলে গেছেন। জনাথন ডিসুজা একেবারে শক্তসমর্থ মানুষ ছিলেন। কখনো তাকে গাড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায় নি। একহয় পদব্রজে নয়তো সাইকেলে তিনি চার্চ সংলগ্ন হাসপাতালে এবং রোগী দেখতে যেতেন। এই হাই রেস্ট্রিকটিভ ট্রিপল লকডাউন মোড চালু হবার আগেই অনিলের জীবনে তিনটি বেদনাবৃত্তান্ত ঘটে গেছে। জনাথন চলে গেছেন। মারা গেছেন ফাদার ম্যাথ্যু। যিনি সুখে দুঃখে এই পরিবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনিলের সুস্থতা উপলক্ষ্যে, হোম কোয়ারানটাইন থেকে মুক্তি উপলক্ষ্যে যে ছোট্ট গ্যাদারিং হয়েছিল, ফাদার ম্যাথ্যু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনিলের এখন সেইসব দিনের কথা মনে পড়লেই হাত পা কাঁপতে থাকে। দুবাই থেকে সোজা ডিটেকশন সেন্টার। তারপর আউটহাউসে সেই অসহায়দিনগুলো। ঐ আউটহাউস তখন জেলাশাসক। পলি কী সাংঘাতিক শক্তিতে সামলেছিলেন সবকিছু।

    অনিল বলে উঠতে পারেননি, শুধু পজিটিভ নয় পলি। আমার লাংগসে একটা স্পট আছে। দ্যাট মাইট বি ক্যানসেরাস। দ্যাখো, আমি এই আতঙ্কে ভুগছি!

    শুধু এই বাগান সঙ্গী ছিল। আর দূর থেকে পলির নিরবিচ্ছিন্ন যত্ন। দেবরূপের ফোনের অপেক্ষা। দেবরূপের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে জড়িয়ে যায় আরেকটা নাম। অনিল ভুলতে চান।
    ছোট ছোট ফার্ণগুলো নিবিড় সবুজ। চাঁপাগাছে এখন প্রচুর ফুল। কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল। শুধু এই কাঁঠাল যে নামাতো, অনিলের অসুখের সময় যে নিয়মিত হোম ডেলিভারি দিয়ে গেছে নিত্য প্রয়োজনের জিনিসপত্র, সেই মুরুগণ নেই। চকচকে বার্ণিশ করা মুখটি। সদাহাস্যময়। তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা গেছে। মুরুগণ ছাড়া যে তাঁদের জীবন চলবে, এটাই একসময় ভাবা যেত না। সমস্ত পরিবার থম মেরে গেছিল। সময় এত দ্রুত চলে যায় অথচ অভাববোধ যায় না।

    পলি আর এমিলি তাঁদের প্রিয় নালুকেতু সংলগ্ন হলে বসে বহু পুরোনো একটি ছবি দেখছেন। তাতে তেমন নাচগান নেই। নায়িকা মৃক ও বধির। তিনি আঙুলের মুদ্রায় নায়ককে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ফিল্ম দেখা যত না উদ্দেশ্য তার থেকে বড় উদ্দেশ্য হল সময়টা পার করা। পলির মা কে বিশেষ যত্নে রাখতে হয় বয়সজনিত কারণে। নেহাত তাঁদের বাড়িটি বড়। বাগান সমৃদ্ধ। এখানে বেশির ভাগ বাড়িই খোলামেলা। গাছ আছে। অনিল ভাবেন বড় শহরগুলিতে ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা কেমনভাবে জীবন কাটাচ্ছেন!

    আবার মুম্বাই যাওয়া বন্ধ। চেক আপ হচ্ছে না। আপাতত অনিল টেলিমেডিসিনে আছেন। ত্রিদিবের জন্য বড় চিন্তা হয়। হি শুড সারভাইভ। পুওর দেবরূপ। কী ঝড় যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে!

    নালুকেতুর ডানদিকে একটি ক্ষুদ্রায়তন শৌখিন বাঁশঝাড়। তার ওপর দিয়ে মৃদু বাতাস বয়ে এলো। কিন্ত এখন হাওয়া বাতাসও আর শান্তি দেয় না।
    করোনা ভাইরাস আর শুধুমাত্র ড্রপলেট নয়। বায়ুবাহিতও বটে। এত টেনশন নিয়ে বাঁচা যায়।
    অনিলের কন্যাটি গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে ক্রিয়েটিভ রাইটিং ক্লাস করছে। রাস্কিন বন্ড বলছেন। পুত্রটি জাপানি ভাষা শিখছে ল্যাপটপে। এদের শৈশবের অমূল্য দুটি বছর চলে গেল। সারাদিন প্রায় ল্যাপটপে বসে থাকে। অনিলের খুব কষ্ট হয় দেখে। তাও বাগান আছে বলে এরা দু দন্ড খেলে। অন্যরা কী করে ! চেঙ্গালাতেই আনপ্রিপেয়ার্ড আনঅফিশিয়াল মৃত্যুসংখ্যা অফিশিয়াল অধিক তিন শতাংশ! সারা ভারতবর্ষে কে জানে!
    অনিলের ছেলেটি লম্বা হয়েছে একবছরে। সে হঠাৎই দৌড়ে এসে বলল, গেংকি দেস কা?
    তার মুখে মিটমিটে হাসি। সে মাঝেমাঝেই সবাইকে জাপানি ভাষায় প্রশ্ন করে। ভাগ্যিস শৈশব এমন করে হাসতে পারে !

    পর্ব উনসত্তর

    মানি এসে যাওয়ায় সুনন্দিতা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। আমেলিয়ার প্রাতঃকালীন প্রক্ষালন ইত্যাদির দায়িত্ব পুরোটাই মানির। সুনন্দিতার নাচের ক্লাস যেহেতু একেবারে বন্ধ এবং সেকেন্ড ওয়েভ অকল্পনীয়ভাবে জাঁকিয়ে এসেছে, অক্সিজেন শর্টেজ সমেত, সুনন্দিতা নিজের নাচের চর্চাটুকু সকাল বিকেল বরাদ্দ রেখেছেন।

    সন্ধের প্র্যাক্টিসে ফিউশন অভ্যেস করেন। শমক দাভারের সঙ্গে বেশ কিছু কম্পোজিশন করেছিলেন একসময়। মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতায় শো। সেইসব দিনের কথা ভাবলে কেমন আশ্চর্য লাগে। মেকাপ রুম। পায়ে ঘুঙুরের তোড়া। পর্দার পিছনে উত্তেজনা। সামনে দর্শক। গুরুবন্দনা! সব এই একবছরে অতীত হয়ে গেল।

    এটা একজন শিল্পীর পক্ষে মেনে নেওয়া ভীষণ কঠিন। অ্যাকাডেমির সদস্যরা বেশির ভাগ ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত। স্বচ্ছল। কিন্ত গেটম্যান, মালি, লাইটের ছেলেমেয়েরা, গার্ড এবং অফিস ওয়ার্কাররা অ্যাকাডেমির হল ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের শীততাপনিয়ন্ত্রিত আটশো আসনের হলটিতে সারা বছর বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠান হয়। ফিক্সড ডিপোজিট ধরাই থাকে। কর্মচারীদের মাইনে ঠিকমত হয়ে যায়। এই অতিমারী কালে শিল্পচর্চা একেবারে বন্ধ। প্রথম ওয়েভ কমে আসাতে একটু আধটু অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল কিন্ত দ্বিতীয় ঢেউ থাবা মেরে সব বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে শুকদেব দহলজি ও ভার্গব শ্রীবাস্তব এঁদের বৈতনিক ব্যবস্থা বজায় রেখেছিলেন। কিন্ত তাঁর মৃত্যুর পরে একটা অব্যবস্থা দেখা দিয়েছে।অ্যাকাডেমির একটি প্রশাসনিক কমিটি আছে। যদিও সুনন্দিতা সেই কমিটিতে নেই, তবু হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে খবর চলে আসে। অতিসম্প্রতি গেটম্যান মোহন এবং সুইপার সুরেশ মারা গেছে। তাদের পরিবারের হাতে কিছু টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে। মোহনের ছেলে হয়তো বাবার কাজটি পাবে। তবে আবার ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙাতে হয়েছে অন্যান্য কর্মচারীদের মাইনে দেবার জন্য। এইভাবে কতদিন চলবে কেউই বুঝে উঠতে পারছেন না। খুব তাড়াতাড়ি হল খুলে অনুষ্ঠান হওয়ার কোনও সম্ভাবনাও নেই।

    এই অবস্থার মধ্যে সুনন্দিতার নিজের নাচের কথা ভাবতেও অপরাধবোধ হয়। পরমপ্রতাপকে বলে তিনি মোহন এবং সুরেশ যাদবের বাড়িতে ব্যক্তিগতভাবে টাকাও পাঠিয়েছেন। কিন্ত একটা পরিবার তো এইভাবে দানের অর্থে চলে না! এই অতিমারীকালে চাকরির অভাব আরো প্রকট।

    রুটি বেলতে বেলতে মানি জিজ্ঞেস করলো, ওদিকে নাকী খুব ঝড় আসছে বৌদি?

    কুক আসা আবার বন্ধ। রান্নাঘরের ভার সুনন্দিতা আর মানির হাতে। সুনন্দিতা রুটি সেঁকতে সেঁকতে আবারো অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

    কীরকম যেন হয়ে গেছে চতুর্দিক। মে মাসের শেষের দিকে ইয়াশ নামক সাইক্লোন আসবে শোনা যাচ্ছে। ট্রপিক্যাল ডিস্টার্ব্যান্স। কিন্ত আরো বড় ডিস্টার্ব্যান্স আছে। আড়ালে আবডালে নয়।প্রকাশ্যে। পশ্চিমবঙ্গে ভোট আসছে। ভোট এলেই সুনন্দিতার ভীষণ টেনশন হতে থাকে। ইতিমধ্যেই ইলেকশন কেন্দ্র করে শীতলকুচিতে ফায়ারিং ও হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। দিনহাটা থেকে শীতলকুচি আর কতটুকু দূর।

    সুনন্দিতা প্রানপণে নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখেন। পরমের পোশাক ইস্ত্রি করেন। নিকির সমস্ত কাজ নিজে হাতে। রান্নার প্যাশন অনেকটা বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁকে। কাজ না থাকলেই মাথায় দুশ্চিন্তা কিলবিল করে। তাঁর মা একা আছেন দিনহাটার বাড়িতে। ভাবতে লাগলেন সেখানেও যদি গন্ডগোল হয়! হয়তো মা একটু রাস্তার ওপারে বাজার থেকে কচুর লতি বা সবজি আনতে গেলেন, তখনই গোলাগুলি চলে গেল! এই বুঝি মায়ের গায়ে লেগে গেল! এই বুঝি মা লুটিয়ে পড়ল! কামতাপুর অঞ্চলে প্রবল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা। মুসলমান রাজবংশী সম্প্রদায় সংখ্যালঘু। এখন কে কাকে কখন মারছে বা মারবে কোনো ঠিক নেই। সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট দুহাজার উনিশেই এসেছে। দুহাজার কুড়িতে রীতিমত বাংলাভাষাতে বুকলেট ছাপা হয়েছে, ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস। অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী মুসলমানের চিহ্নকরণ। লিখিতভাবে হিন্দু, শিখ, জৈন পার্শিরা সুরক্ষিত থাকবেন। সুনন্দিতা ভয়ে শিঁটিয়ে থাকেন। কখন কী অবস্থান ও অবস্থা হবে, ভীষণ অনিশ্চিত। পশ্চিমবঙ্গে একটা খাপ সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সেটা ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতে সময় লাগে না। দিল্লিতে বসেই টের পান তিনি। সেটা ভয়ঙ্কর।ভিক্টিমাইজেশনের টেনডেন্সি। তুমি জানতেও পারবে না। তিন দিনের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি হয়ে যাবে।

    সুনন্দিতার ছোটবেলার দিনহাটা, শীতলকুচি আর আগের মতো নেই। যদিও ভবিষ্যতের বীজ তখনই লুকিয়ে ছিল। টের পাননি, এই যা।

    টেনশনে ঘাম হতে থাকে। প্রেশার আবার বাড়ল নাকী! সুনন্দিতার প্রেশার একটু ওপরের দিকেই। মা' কে নিয়মিত রাতে ফোন করেন। তবু চিন্তা যায় না। তাঁর মধ্যে, ঘন নীল তসরের শাড়ি, হল্টারনেক ব্লাউজ আর রূপোর আর্মেনিয়ান গহনা পরা, গ্র্যান্ড মিসেস মেহতার মধ্যে একটা রোগাসোগা মফস্বলী মেয়ে এখনো বাস করে। সে খুব কিশোরী অবস্থায় বুঝে গেছিল উত্তরবঙ্গে থাকলে তার নাচ বিকশিত হবে না। সে কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হয়েছে গতানুগতিকতার প্রবাহে। বিকাশের অন্য কোনো ধারণা ছিলই না তার। ক'জনের বা থাকে? দিনহাটা থেকে বিশ্বভারতী, বিশ্বভারতী থেকে কলকাতা। মুম্বাই। দিল্লি। জায়গা পাল্টেছে। সময় সুনন্দিতাকে গড়েপিটে নিয়েছে। চোস্ত হিন্দিতে কথা বলেন তিনি। সপাট পঞ্জাবি স্টাইল ইংরিজি। মানি তাঁর বাংলার সঙ্গী। ইদানীং কালে বাবু। দিল্লি প্রবাসে বাঙালি বন্ধুরাও এখন হিন্দি বা ইংরিজি বেশি বলেন। সুনন্দিতার কোনো অসুবিধে নেই। কিন্ত সেই ডাকাবুকো মফস্বলী মেয়েটি তাঁকে এখনো পীড়িত করে। খসখস শব্দ হয় বুকের মধ্যে। লিভ লাইফ কিং সাইজ একটা আপেক্ষিক ধারণা। মেহতা হাউসে তাঁর মা কখনোই এসে থাকবেন না। আমেলিয়ার রাজত্ব পরম মাথা পেতে মেনে নিয়েছেন।

    মানি আবার জিজ্ঞেস করলো, খুব বড় ঝড় বৌদি? গেলবারের আম্ফানের মতো?

    সুনন্দিতার হাতে গোল হয়ে রুটি ফুলে উঠছে ।

    পশ্চিমবঙ্গে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সময়সীমা পাঁচবছর শেষ হতে চললো। তিরিশে মে শেষ তারিখ। প্রবল বিক্রমে ৱ্যালি চলেছে যদিও এপিডেমোলজিস্টরা এই জমায়েতকে সুপারস্প্রেডার বলেছেন। তবলিঘি জমায়েতকে ম্লান করেছে কুম্ভমেলা। তার সঙ্গে এদিকে পাল্লা দিয়ে জনসমাগম। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ৱ্যালি করা সাংবিধানিক অধিকার। কেন্দ্র ও রাজ্য পরস্পরকে দোষারোপ করে চলেছে রোগ ছড়ানোর জন্য।
    এইসব কখনও শেষ হবে না। সবাই জানে।
    সুনন্দিতা সযত্নে রুটি তুলতে থাকেন একটি প্রাচীন অথচ ঝকঝকে তামার পাত্রে।
    নিকি তার অটোমেটিক হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে এসেছে। এই সুপ্রশস্ত রান্নাঘর এতটাই আধুনিক, সুসজ্জিত যে দেখে রান্নাঘর মনে হয় না।
    নিকি যেন থটরিডার।
    মা'কে দাঁতে ঠোঁট চেপে রুটি করতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
    - আর ইউ থিংকিং অ্যাবাউট দিদান? ওরিড অ্যাবাউট দিনহাটা?
    মেয়ের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে সুনন্দিতা। এই মেয়ে কখনো তাঁদের দিনহাটার ছড়ানো রান্নাঘর দেখেনি। একদিকে মাটির নিকোনো উনুন। বিশাল। কাঠের তাকে কাঁসার বাসন উপুর করে রাখা। একদিকে ঘুঁটে। কয়লা। কেরোসিনের ডিব্বা। বড় দুটো মিটসেফ। ফ্রিজ কোথায় তখন! টুকটুক করে আমলকি পাতা ঝরে পড়ে টিনের চালে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে দ্রুত চলে যায় বেজি। মা বলেন, থাক। কিছু বলিস না। সাপখোপ আসবে না। বারকোশে জল ঢেলে মিটসেফে খাবার তুলে রাখতেন ঠাকুমা। পুঁই শাকের মেটুলি আর ছানার ডালনার গন্ধ ভেসে আসে। এখনো তিনি পনিরের চেয়ে ছানার ডালনা পছন্দ করেন বেশি। বাড়ির সবাইকে ধরে খাওয়ান। এরা তো ছানার তরকারি খেতে জানতো না আগে। রাত্রিবেলা বাড়িঘর ভরে যায় আতপচালের গন্ধে আর দুপদাপ শব্দে। ভাম। ভয়ের কিছু না।
    এখন সর্বত্র ভয়। গা ছমছম করে না। শুধু ভয় কাজ করে।
    উত্তরাধিকারকে নিজের অতীত দেখাতে না পারা বড় যন্ত্রণা দেয়। যাকে কেন্দ্র বলে ভেবেছিলেন তার ব্ল্যাকহোল গুলো মনের মধ্যে খাবলা দেয়।
    নিকি বললো, তুমি ধরেছিলে না কেন? ফোন এসেছিল তোমার। ত্রিদিব আংকলকে বাড়ি নিয়ে গেছে ওরা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৬ জুলাই ২০২১ | ২১০৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২৭ জুলাই ২০২১ ১৪:২১496132
  • এইটে বড্ড লম্বা। পড়তে পড়তে কেমন হাঁপিয়ে গেলাম। একটা ধারাবাহিক হিসেবে থাকলে বোধহয় সুবিধে হত। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন