এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি  বুলবুলভাজা

  • দিল্লির কৃষক আন্দোলন - বাঁচতে গেলে লড়তে হবে

    দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য
    আলোচনা | রাজনীতি | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০০৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৬ (৫ জন)
  • ২৬ জানুয়ারির কৃষক আন্দোলনের যে রূপ ভারত তথা সারা দুনিয়া দেখেছে, তা নিয়ে নানারকম মতামত, বিশ্লেষণ, কাটাছেঁড়া চলছে। চলমান আন্দোলনের সপক্ষে ও বিপক্ষে গড়ে উঠছে বিভিন্ন মতামত। সপক্ষের মতামতগুলি সবকটি যে একইরকম, তেমনও নয়। বিরোধী স্বরগুলিও সবই সরকারের পক্ষাবলম্বী এমনও নয়। এ লেখা একভাবে ব্যাখ্যা করেছে গোটা প্রেক্ষিতটিকেই।

    ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে যা ঘটেছে তা নিয়ে ভারতের সমাজ মোটামুটি দ্বিধাবিভক্ত। একদল যেমন বলছেন এত দিন ধরে চলা, এত বড় কৃষক আন্দোলনের মধ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতেই পারে, তেমনি একদল বলছেন কৃষক আন্দোলন নৈতিকতা হারিয়েছে, তাই তাঁদের পিছিয়ে এসে সরকারের বিল মেনে নেওয়া উচিৎ।

    এই প্রসঙ্গে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে খারাপ যা কিছু ঘটেছে তার দায় কার? কৃষকের নাকি সরকারের? প্রথমেই বলে রাখি, কৃষি বিল কৃষকদের পক্ষে ভাল না খারাপ, সে নিয়ে আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। যেভাবে স্কুল কলেজের শিক্ষানীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র শিক্ষক বা ছাত্রের মতামতই সবার আগে বিচার্য হওয়া উচিৎ। তাদের মতামত সঙ্গে না নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা বা কোনও ব্যবসায়ীর মতামত চাপিয়ে দেওয়া উচিৎ নয়, তেমন ভাবে কৃষি আইন আনতে গেলে কৃষকদের মতামতকে সঙ্গে নিয়েই করা উচিৎ, কিছু ব্যবসায়ী বন্ধুদের স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে কৃষকদের উপরে কিছুই চাপিয়ে দেওয়া সরকারের উচিৎ নয়।

    আমার মতে ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে যা কিছু খারাপ ঘটেছে তার দায় পুরোপুরি ভাবেই সরকারকে নিতে হবে। কৃষক আন্দোলন একদিনে হঠাৎ করে এই দিকে যায়নি। দীর্ঘ দু’মাস ধরে সরকার গড়িমসি করে যাচ্ছিল। কৃষকদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল। কৃষকরা যে ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে ট্র্যাকটর নিয়ে মার্চ করতে চলেছেন, সে কথা তো সবাই প্রায় ২-৩ সপ্তাহ আগে থেকেই জানত। তাও সরকার কৃষকের দাবি না মেনে প্রথমে তাঁদের আদালতের দিকে ঠেলে দিল, তারপরেও লাভ না হওয়াতে আইন কিছু দিনের জন্যে পিছিয়ে দিল, বাতিল করল না। সবাই বুঝতে পারে, সরকার কেন বার বার কৃষকদের ধৈর্যের পরীক্ষার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিগত দু মাস ধরে কৃষক আন্দোলনের ব্যাপারে সোশ্যাল মিডিয়াতে বার বার মিথ্যে প্রচার চলছে। বারংবার মিথ্যে প্রচার করে, কৃষকদের সন্ত্রাসবাদী, দালাল, ধান্দাবাজ ইত্যাদি বলে আন্দোলনের নৈতিক দিকটা নষ্ট করে দিতে পারলে ওদের আর অসুবিধে হবে না, কর্পোরেটের স্বার্থও সুরক্ষিত থাকবে। মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়াতে বার বার বলা হচ্ছে, এটাতে নাকি গরিব কৃষক বা ক্ষেত মজুরদের সমর্থন নেই, তাই তাঁদের এই মিছিলে দেখা যাচ্ছে না। বারবার বলা হয়েছে, এই আন্দোলন নাকি আসলে কৃষকরা করছে না, কিছু দালাল করছে। এই আন্দোলন নাকি খালিস্তানি জঙ্গিদের ভারত বিরোধী কাজ। এমন কি বলা হয়েছে, পাঞ্জাবি কৃষকদের লাল কেল্লাতে ওড়ানো ধর্মীয় পতাকা (নিশান সাহিব) আসলে নাকি খালিস্তানি জঙ্গিদের পতাকা। সত্যিটা হল, এগুলো সবই মিথ্যে। কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে যে প্রশ্ন গুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসছে, সেগুলো সম্পর্কে কিছু কথা বলছি।

    এবারই কি প্রথম লাল কেল্লাতে শিখদের ধর্মীয় পতাকা ওড়ানো হল?

    একদমই তা নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৭৮৩ সালে শিখ খালসা বাহিনী মুঘলদের কাছ থেকে দিল্লির লাল কেল্লা দুর্গ দখল করে এবং তখন প্রথম বারের জন্য লাল কেল্লাতে শিখদের ধর্মীয় নিশান সাহিব পতাকা ওড়ানো হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে সরকারি উদ্যোগেই সেই ঘটনা স্মরণ করতে প্রতি বছর ২১-২২ মার্চ দিল্লির লাল কেল্লাতে ফতেহ দিবস পালন করা হয় এবং লাল কেল্লাতে নিশান সাহিব পতাকার উত্তোলন হয়। তাই ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন ভারতে লালকেল্লার গায়ে শিখদের ধর্মীয় পতাকা ওড়ানোর দায় এই কৃষক আন্দোলনকারীদের উপরে বর্তায় না।

    এই কৃষক আন্দোলন কেবলমাত্র কিছু দালালের আন্দোলন, এতে সাধারণ গরিব কৃষকদের সমর্থন নেই

    এটা ঠিক যে দিল্লিতে যে সব কৃষক আন্দোলন করছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কৃষক। একদম নিম্নবিত্ত কৃষক, য়াঁদের দুবেলা ঠিক মতো খাবার যোগান নেই তাঁদের এই আন্দোলনে তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যা বুঝতে হবে, যে আন্দোলন করতে গেলেও পেটে ভাত লাগে। বিশ্বের যে কোনও আন্দোলনই শুরু হয় মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে দিয়ে, একদম নিম্নবিত্তদের একদম প্রথম থেকে আন্দোলনে অনেক সময়েই অংশগ্রহণ করতে পারে না। যে চাষি দুবেলা খেতে পায় না, সে মাসের পর মাস কোনও কাজ না করে রাস্তার ধারে বসে থেকে প্রতিবাদ করবে কী করে?

    সরকার প্রথমেই ভেবে নিয়েছিল যে – “কৃষকরা আর কদিন আন্দোলন করবে?” সদর্থক ভাবে আলোচনা না করে সরকার প্রথমেই কৃষকদের পেটে টান পড়ার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল, পাঞ্জাব, হরিয়ানার দিকে প্রান্তিক চাষি প্রায় নেই। সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে পাঞ্জাব, হরিয়ানার চাষিরা দিল্লির নিকটবর্তী অন্যান্য রাজ্য, যেমন- উত্তরপ্রদেশ,রাজস্থান, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের অধিকাংশ কৃষকের মত গরিব নন। সর্বোপরি, এই মিছিলে শুধু পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকেই চাষিরা এসেছেন, তা নয়। ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকেও কিছু অবস্থাসম্পন্ন চাষি অনেক সরকারি বাধা সত্ত্বেও এই আন্দোলনে যোগ দিতে দিল্লি এসেছেন। কিন্তু মুশকিল হল ভারত এত বড় দেশ সেখানে বেশি দূর থেকে দিল্লি গিয়ে মাসের পর মাস থাকার মত খরচ একজন প্রান্তিক চাষির পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব না।

    তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশের একদম গরিব কৃষক শ্রেণির এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। আমাদের সমাজের শহুরে মানুষের এক বড় অংশই কৃষক বলতে শুধুমাত্র দুবেলা ভালো করে খেতে না পাওয়া কৃষকদের কথাই মনে করে। তাই হরিয়ানা, পাঞ্জাবের সম্ভ্রান্ত কৃষকদের দেখলেই অনেকের মনে হয়, “এরা কেমন কৃষক, যাদের নিজেদের গাড়ি আছে? যারা লঙ্গরে পিৎজা খেতে পারে”! এখানেও সরকার বিপন্ন কারণ ২ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এই আন্দোলন বন্ধ হওয়ার নাম নেই। তাই এর পরের ধাপে আন্দোলনকে জনবিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করতে হয়। যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নন তাঁদের আলাদা করে দেওযা গেলে আন্দোলন থেকে আলাদা হয়ে গেলে যে কোনও আন্দোলন বেশি দিন টিকিয়ে রাখা মুশকিল।

    লাল কেল্লাতে কৃষকের প্রবেশ কতটা নিন্দনীয়?

    এই পর্যন্ত যা যা ঘটেছে বলে খবর আছে তাতে বিশাল কিছু নিন্দনীয় ব্যাপার ঘটেছে বলে মনে হয়নি। লাল কেল্লাতে গিয়ে পতাকা না তোলা হলেই ভালো হত, কিন্তু আমি মনে করি অধিক উত্তেজনার ফলে অথবা এই কৃষক আন্দোলনকে নষ্ট করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবেই এটি ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে বিজেপি সমর্থক ও কর্মী দীপ সাধু এবং তার দলবলের ভূমিকার ব্যাপারে নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে। কিন্তু যেহেতু কিছুই প্রমাণিত নয় তাই এটি যে কেবলমাত্র ষড়যন্ত্রের ঘটনা সেই দাবি করছি না। তবে, রহস্যজনক যে কৃষক মোর্চার যারা এই কাজ ঘটিয়েছে এমন কয়েকজনকে চিহ্নিত করে দিল্লি পুলিশের কাছে নাম জমা দেওয়া সত্ত্বেও কেন (এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত) তাদের গ্রেফতার করা হল না?

    লাল কেল্লার মতো জায়গাতে কৃষকের প্রবেশ যদি নিন্দনীয় হয় তাহলে পাশাপাশি এটাও সরকারকে স্বীকার করতে হবে, লাল কেল্লাকে দু’বছর আগে ডালমিয়া গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া অনেকগুণ বেশি নিন্দনীয়। ২০১৮ সালে সরকার লাল কেল্লাকে ডালমিয়া গোষ্ঠীর কাছে লিজ দিয়ে দেয়। চুক্তি অনুযায়ী ডালমিয়া গোষ্ঠী লাল কেল্লা প্রাঙ্গণে ‘আধা বাণিজ্যিক’ কাজ করতে পারবে। লাল কেল্লার ঐতিহাসিক মূল্য খর্ব হয়ে থাকলে এই লিজের মাধ্যমেই হয়েছে। কৃষক আন্দোলন একটা প্রাইভেট কোম্পানির লিজ নেওয়া পাবলিক প্লেসে ঢুকে পড়েছিল মাত্র। অবশ্যই, এর জন্যে ডালমিয়া গোষ্ঠী সরকারের কাছে, এবং সরকার কৃষক আন্দোলনকারীদের কাছে ওই দিনের প্রবেশ মূল্য আদায়ের বা কেল্লার ভিতর পরিষ্কারের জন্য কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করতেই পারে।

    ধৈর্যের পরীক্ষা এবং কৃষক আন্দোলনকে কলিমালিপ্ত করার চেষ্টা

    সরকার প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ধীর গতিতে চলে, আলোচনায় না গিয়ে কৃষকদের হতাশ করে জয় পেতে। সরকার চেয়েছিল, কৃষকদের মাসের পর মাস ধরে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে চলতে। যাতে রাগে, বিরক্তিতে ওরা কোনো বড় ভুল করে বসে। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে বিরক্তিকর হল, মিডিয়ার ভূমিকা। গোদি মিডিয়া বহুদিন ধরেই প্রত্যক্ষ ভাবেই সরকারের প্রচারের মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং এটা ভাবতেও অবাক লাগে, সরকার বনাম কৃষকের এই সংঘাতেও তারা সোজাসুজি কৃষকদের বিরুদ্ধে মিথ্যে কথা বলে চলেছে। প্রায় এক দশক আগে নির্ভয়া কাণ্ডের সময়ে দিল্লির প্রতিবাদী জনতা (যাঁদের অধিকাংশই কলেজ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলেন) রাগে, বিরক্তিতে রাষ্ট্রপতি ভবনের মধ্যে আন্দোলন করে ঢুকে পড়েন। দিল্লি পুলিশের সঙ্গে সেখানে তাদের হাতাহাতি হয়, জল কামান চালিয়ে তাদের প্রতিরোধ করা হয়। ওই আন্দোলনের সময়েও ক্ষমতাশীল কংগ্রেসের বিরোধী দলের অনেক কর্মী সেই জমায়েতে শামিল ছিল। কিন্তু দেশের মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়া কখনই সেই আন্দোলনকে ভারত বিরোধী তকমা দেয়নি, কখনই যুব-ছাত্র সমাজের আন্দোলনকে ‘বিরোধী গোষ্ঠীর চক্রান্ত’ বলে দেগে দিয়ে মূল আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেনি। আজ মিডিয়া উঠে পড়ে লেগেছে কীভাবে এই আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করা যায়। ২৬ জানুয়ারির এই ঘটনার ঠিক পরের দিনই (২৭ জানুয়ারি) বাংলাতে শিক্ষিকারা প্রতিবাদ করতে গিয়ে গেট টপকে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ঢুকে পড়েছেন। স্বভাবতই এখানেও পুলিশ বাধা দিচ্ছে, কিন্তু কেউই ওই শিক্ষিকাদের দেশদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছে না।
    মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যে কোনও সরকার বিরোধী আন্দোলনকে হত্যা করার যে কাজ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার করে আসছে, এই ঘটনা শুধুমাত্র তারই আর একটা উদাহরণ মাত্র। এই পদ্ধতির হাত থেকে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক, লেখক থেকে সাধারণ জনগণ কেউই বাদ যায়নি। কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সরকার আরও একবার সেই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছে মাত্র। এটাই হয়তো বিগত ১০ বছরে ভারতের সমাজের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।

    সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একজন ভারতের নাগরিকের কথা বলা, মতামত দেওয়ার স্বাধীনতা আছে। শান্তিপূর্ণ জমায়েত করার অধিকার আছে। নিজেদের দাবি মেটানোর জন্য ইউনিয়ন, বা সংগঠন তৈরির অধিকার আছে। দেশের মধ্যে যে কোনো মুক্ত জায়গাতে কোনও বাধা ছাড়াই যাবার অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ, কৃষিবিলের বিরুদ্ধে কৃষকদের নিজেদের দাবিতে একটা সংগঠন তৈরি করা, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলাতে সাংবিধানিক ভাবে অন্যায় কিছু নেই। প্রশাসনিক ভাবে পুলিশের ব্যারিকেড না মেনে বা কিছু অঞ্চলে মিছিল করার অগ্রিম অনুমতি না নিয়ে কিছু বেআইনি কাজ হতেই পারে। কিন্তু সেটাই তো আইন অমান্য। এ তো গান্ধীবাদী পদ্ধতিতেই প্রতিবাদ করা। কৃষকদের সঙ্গে পুলিশের হাতাহাতির যে উদাহরণ এসেছে, যে ভাবে কৃষক বা পুলিশ আহত হয়েছে তা যে কোনও আন্দোলনের ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত নয়, আইন অনুযায়ীই সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণেই যদি কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনকে অনৈতিক বলে দেওয়া হয়, তাহলে তো ভারতের সব রাজনৈতিক দলেরই অফিসে এতদিনে তালা পড়ে যাওয়ার কথা ছিল।

    লাল কেল্লাতে প্রবেশ করে কৃষকরা কি অন্যায় করেননি?

    যদি কৃষকরা লাল কেল্লার ঐতিহাসিক কাঠামোর কোনও অংশ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করতেন, যদি লাল কেল্লা থেকে জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করতেন, যদি লাল কেল্লাতে ঢুকে জাতীয় পতাকার উপরে অন্য কোনও পতাকা ওড়ানোর চেষ্টা করতেন, তাহলে অবশ্যই কৃষকরা ভারতের সংবিধানের উপরে আঘাত করেছেন বলা যেত, এবং কৃষক আন্দোলন যাঁরা করছেন তাঁদের এই ব্যাপারে দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্ন আসত। কিন্তু এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এগুলোর কিছুই ওখানে ঘটেনি। আবারও বলার, উত্তেজনার বশে লাল কেল্লাতে ঢুকে পতাকা না ওড়ালেই ভাল হত, কিন্তু এত দিন ধরে চলতে থাকা, এত বড় আন্দোলনের মধ্যে এইটুকু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটতেই পারে।

    গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের মতো অহিংস আন্দোলনের মধ্যেও চৌরিচৌরাতে লোক সমেত একটা থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মূল-আন্দোলনের মুখ ঘুরে গেলেও আমি মনে করি, ওটা কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছিল না। কারণ, সবাই গান্ধী নয়, সবাই গান্ধী হতে পারবে- সেটা আশা করাও উচিৎ না। এই ক্ষেত্রেও লাখ লাখ কৃষকের ২-৩ মাস ধরে আন্দোলন চললে এই রকম কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটতেই পারে। লাখ-লাখ কৃষকদের আন্দোলনের মধ্যে সবাই যে যোগেন্দ্র যাদব, মেধা পাটেকর হবে, এটা আশা করাও ভুল। চৌরিচৌরা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। কিন্তু জনরোষে একটা অহিংস আন্দোলনের মধ্যেও ওটা ঘটেছিল- এটাই বাস্তব। অনেকে হয়ত বলবেন, চৌরিচৌরার ঘটনা তো ব্রিটিশের বিরুদ্ধে হয়েছিল, এখন তো আমরা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক। তাই এই দুই ঘটনার তুলনা তুলে আনা ভুল। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে একবার কৃষকদের জায়গাতে দাঁড়িয়ে ভাবুন। যে কৃষক খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছেন, পুরো পরিবার সমেত আত্মহত্যা করছেন, তাঁদের কাছে কি আদানি-আম্বানির লুট আর ব্রিটিশের লুটের মধ্যে কোনও পার্থক্য রয়েছে? তাঁদের দিক থেকে দিনের শেষে দুইই সমান। এ কথা ঠিক যে আন্দোলনকারী কৃষক পরিবারগুলির না খেতে পেয়ে মারা যাওয়ার পরিস্থিতি হয়নি, তাঁদের কিছু মাস বা বছর খানেক এই ভাবে পড়ে থেকে লড়াই করার ক্ষমতা আছে। এই দুই আর্থসামাজিক পরিস্থিতির তুলনা করতে একটা পুরনো উদাহরণ দেওয়া যাক। যাকে ‘ফুটন্ত ব্যাঙের পরীক্ষা’ বলা হয়।

    একটা কড়াইয়ে ঠান্ডা জলের মধ্যে একটা জ্যান্ত ব্যাঙ রেখে ওই কড়াইকে উনোনের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হল। আস্তে আস্তে কড়াইয়ের জল গরম হতে থাকল আর ব্যাঙ শরীরের শেষ শক্তি দিয়ে সহ্য করে যেতে লাগল। প্রথমেই যদি ব্যাঙ সেটা সহ্য করার চেষ্টা না করে লাফ দিয়ে কড়াই থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত, তাহলে তা সহজ হত, কারণ সে শক্তি তখনও অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু সহ্য করতে করতে একটা সময় এল, যখন আর তার লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার শক্তি নেই, তাই কড়াইয়ের মধ্যেই সেদ্ধ হয়ে সে মারা গেল।

    এই উদাহরণটি মধ্যবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত চাষিদের দ্বারা চালিত এই কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা খুব ভালো লক্ষণ যে শেষ শক্তি পর্যন্ত ওঁরা লড়াই জারি রেখেছেন। এই বিল চুপ করে মেনে নিয়ে ‘সহ্য করতে করতে’ ওই দুবেলা ঠিক মত না খেতে পাওয়া কৃষকদের দলে চলে গেলে তখন আর প্রতিবাদ করারও শক্তি এঁদের থাকবে না। ওঁদের দশা হবে, কড়াইয়ের মধ্যেই জ্যান্ত সেদ্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাঙের মত। যা এখন সমাজের একদম প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা - ওঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করারও সামর্থ্য নেই।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ১৬:১১102199
  • সর্বান্তকরণে সমর্থন করলাম।

  • বাইরে দূরে | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ১৮:৩৫102213
  • আমি সম্পুর্ণ সহমত

  • Chayan Mukherjee | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ২১:৪৪102215
  • পূর্ণ সমর্থন এবং সহমত জানাই। 


    একটা অপদার্থ ফ্যাসিস্ট সরকার গুটিকয়েক কর্পোরেট হাঙর বন্ধুদের চাকরগিরি করছে আর তাদের হয়ে দালালি করছে। কৃষকেরা এরকম একটা সরকারের সাথে যথেষ্ট ভদ্রতা আর সংযম দেখিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালাচ্ছেন তবে এরকম ইতর অপদার্থ  সরকারের সাথে  বেশিদিন ধৈর্য আর সংযম না দেখিয়ে সময়মত নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করাটাই আগামী লক্ষ হওয়া উচিৎ।  

  • Dhiman Mandal | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ২২:৪২102217
  • কোন আন্দোলনই মোলায়েম ভাবে হয়না।

  • পাঠক | 2409:4065:107:be7b:cd7e:5e7e:243:71b1 | ৩১ জানুয়ারি ২০২১ ১০:০১102224
  • অনেকাংশে একমত কিন্তু যে প্রশ্নগুলি সবচেয়ে বেশি উঠে আসছে ,সেগুলির বেশ কিছুর দেখা পেলাম না,  যেমন এম এস পি নীতিতে কি অন্য জায়গার কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না , এখন হচ্ছেন না ,  এখনকার থেকে তাঁদের অবস্থা বদলাবে কিনা।  এফসিআই এর পঞ্জাব হরিয়ানা থেকে সিলেক্টিভ প্রোকিউরমেন্ট ,বাংলা ইত্যাদিদের বঞ্চনা নিয়ে যে প্রশ্ন ছিল,যেগুলো কাউন্টার হিসেবে অনেক বেশি ঘুরে বেড়াচ্ছে,প্রতিভা সরকারের লেখায় বেশ কয়েকজন যে প্রশ্নগুলি তুলেছেন,সেগুলির উত্তরও আশা করেছিলাম।


    সমাজের প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা নিয়ে বলতে তাঁরা নিজেরা না আসতে পারেন,এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নানা সংগঠন সেই দাবিদাওয়া চোখে পড়ার মত করে ওঠাচ্ছেন না কেন সেই প্রশ্নও উঠছে। 


    দিল্লি থেকে বেশি দূরের প্রান্তিক চাষিরা আসতে পারবেন না যুক্তি দিলে আবার প্রশ্ন আসে,কাছাকাছি উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশের প্রান্তিক চাষিরা কেন আসতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে প্রান্তিকতার কারণটিই রাখা ভাল , দূরত্বের কারণ বাদ দিয়ে।   কিন্তু উত্তরপ্রদেশে তো কম সম্পন্ন চাষি নেই ! বিশেষত ঃ আখ চাষিরা।  তাঁরা কেন আসছেন না এই প্রশ্নগুলির উত্তর আসলেও ভাল হত।  মহারাষ্ট্র থেকে আগে কিন্তু একেবারে প্রান্তিক চাষিদেরই বিশাল লং মার্চ দেখেছি আমরা।  সংগঠনের সমর্থন থাকলে অনেক জায়গা থেকেই চাষিদের আনা যায়,ট্রেনে করেও,অন্তত দুই তিনদিনে তাঁরা নিজেদের দাবিদাওয়া সহ অবস্থান করে যেতে পারেন।  এখন যে একেবারেই হচ্ছেনা,তা নয়। কিন্তু তেমনভাবেও হচ্ছেনা,যাতে এই প্রশ্নগুলি ওঠা বন্ধ হয়।  


    তুচ্ছ সংযোজন, লেখায় কিছু ভুল বানান আছে,  দূর্গ, পরিস্কার ইত্যাদি,সংশোধন করে দিলে ভাল হয়।

  • বিপ্লব রহমান | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:০৮102269
  • মোদি সরকারের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন একটি প্রচণ্ড প্রতিবাদ! লাল সেলাম! 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন