এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সমাজ  বুলবুলভাজা

  • যে লাইন ভোটের নয়

    মঞ্জীরা সাহা
    আলোচনা | সমাজ | ১০ এপ্রিল ২০২১ | ২৩৪৮ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • দুপুর সাড়ে বারোটা। হাওড়া স্টেশন। নতুন কমপ্লেক্স। বুকিং কাউন্টার থেকে সোজা লম্বা লাইন বেরিয়ে এসেছে। লাইনের পাশ দিয়ে অনেকগুলি ব্যাগের লাইন । বিভিন্ন সাইজ। ভারী হাল্কা উঁচু নীচু ব্যাগ। পিঠ ব্যাগ লাঠি দিয়ে হাতল করা ব্যাগ চটের ব্যাগ প্লাস্টিকের ব্যাগ। জলের জেরিকেন। দু চারখানা বড় ছোট ঝুরি। ব্যাগগুলো জিনিসে ঠাসা। উপচে উঠেছে জিনিসে। কতগুলো ব্যাগের খোলা মুখ দিয়ে ভেতরের সার্ট গেঞ্জি গামছা জিন্সের প্যান্ট উঁকি ঝুঁকি মারছে। দু একটি ব্যাগের সাথে কোদাল কাস্তে বাঁধা।

    ওই উঁচু নীচু লাইনের ভেতর থেকে কারুর পায়ের ধাক্কায় একটা র‍্যাশণ ব্যাগ উলটে গেল পড়ে। ব্যাগের হাতল দুটো সায়ার দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। স্টিলের দুধের ক্যানটা ছিল ডান দিকের উপরে। গড়াতে লাগলো। প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে ঠোকা খেতে খেতে মুখটা গেল খুলে। ঝনঝন করে আওয়াজ হয়ে উঠল। লাফাতে লাফাতে ছিটকে একেবারে চেকারের কালো বুটের কাছে। স্টিলের ক্যানের মুখটা আরো একটু দূরে। মুখ খুলে গিয়ে ভেতর থেকে দুধ না অন্য কিছু বেরিয়ে এলো। ডাঁটাশাকের চচ্চড়ি। চচ্চড়িগুলো বেরিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। দু একজনের জুতোর পাড়ায় পাড়ায় চেপ্টে যেতে থাকল।
    টিকেটের লাইনের সামনের জন কিছুটা এগিয়ে গেছে । পেছন থেকে লাইন ঠেলছে। সামনের মোটা লোকটার সাথে অনেকটা গ্যাপ হয়ে গেছে। ওদিকে আরো দু তিন জনের চটিতে চচ্চড়ি লেগে গিয়ে পায়ে পায়ে ছড়াছড়ি। খোলা মুখের ক্যানের ডাঁটা চচ্চড়ির নীচের ডাল মাখা হলুদ ভাত লেডিস জুতো পরা চারখানা পাএর মধ্যিখানে হাট হয়ে খুলে আছে।

    রেশণ ব্যাগটা সোজা করে দাঁড় করিয়ে বাইরে বেরোনো জিনিসপত্র চেপে চেপে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে আরেক হাতে পিঠ ব্যাগটা তুলে ছুটলো লাইন ছেড়ে। পিছনের ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এসে লাইনের গ্যাপ ভরে দিল।

    গেটের কাছে টিকেট দেখানোর লোক জমে গেছে আরো। ভিড়ের মধ্যে ছেলেটা হাঁটু পেতে বসে পড়ে পা গুলো ঠেলে সরিয়ে ক্যানটা বাইরে বার করে আনলো। ঢাকনা আনলো জলের কলের নীচের জমা জল থেকে তুলে। ক্যানের মুখ আটকে ব্যাগে পুরে নিয়ে ছুটে এসে আবার নিজের জায়গায় ।
    না। ঢুকতে দিচ্ছে না আর সামনেরর দাড়িওয়ালা লোকটা। মারলো ধাক্কা লাইন থেকে ।

    -আয়া কাহাসে? হাঁ হাঁ!
    -লাইন পে নেহি থা, কাঁহাসে আব আ পড়া?
    -যা ভাগ ইধারসে।
    -যা লাইন দে না গিয়ে । মাঝখানে এসে ঢুকছে।
    সাথে আরো কয়েকটা সরু মোটা গলার ধমক চিৎকার মিলে যেতে থাকল।

    লাইন পেছনে অনেক দূর চলে গেছে। দাঁড়িয়ে পড়ল গিয়ে একেবারে শেষ মাথায়। উল্টোদিকের কাঠের বন্ধ বুকিঙ কাউন্টারের গা ঘেঁষে। টিকেট পেতে পেতে আধা ঘণ্টা। ছুটলো ব্যাগ মাথায় করে নতুন কমপ্লেক্সের ভিতর।

    ডান ধারের চেয়ারে বসে এক ভদ্রলোক ইংরাজি কাগজ হাতে এক মনে পড়ে যাচ্ছে। রঙিন রঙিন ক্রিকেটারের ছবির মাঝে আই পি এল এর খবর।
    -ও কাকা, করমণ্ডল ছাড়বে কয় নম্বর প্যালাটফর্মে ?

    ও কাকা বলেন না!

    কিছুক্ষণ পর কাগজের পেছন থেকে উত্তর এলো, বোর্ডে দেবে সব। বোর্ড দেখে নাও, যাও।

    নতুন কমপ্লেক্স তখন বেশ ফাঁকা ফাঁকা। ডিজিটাল বোর্ডে অনেকগুলো গাড়ির খবর। কিন্তু অক্ষর গুলো মাথায় সাজিয়ে নিয়ে শব্দ তৈরি করতে খুব অসুবিধে হচ্ছে মাথার ভিতর। এক দল সামনে দিয়ে হুড়মুড় করে দৌড়াচ্ছে। ওরা সামনে দিয়ে ছুটতে ছুটতে ডান ধারে চলে গেল। জোরসে ছুটছে ওরা। মাথায় বড় বড় ব্যাগ। দু তিন জনের হাতে রঙ শেষ হয়ে যাওয়া রঙের কোম্পানির বালতি ঝুলানো। ওরই বয়সী ছেলে বেশিরভাগ ওই দলে। এই সব আঠেরো কুড়ি বাইশ এরকম। হাতে ঝুড়িও আছে কয়েকজনের। বিরাট দল। ছেলেটার মনে হচ্ছে ওরা নিশ্চয়ই জানে ওই ট্রেনের খবর। একটা বেজে গেছে। ওরাও নিশ্চয়ই ওই ট্রেনই ধরবে বলে ছুটছে। ছেলেটার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওরা জানে। একলা ওই কেবল জানে না ট্রেনের খবর।

    ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ। ওই তো বেরিয়ে গিয়ে আরো পিছনের দিকে ছুটছে।

    একদম পিছনে ওর বয়সী একটা ছেলে। মাথায় প্লাস্টিকের চটের ব্যাগের উপর রঙচঙে প্রিন্টেড ছবি মারা। মিকি মাউস আর একগাদা লাল নীল বেলুন ওড়ার ছবি। মোটা ব্যাগের নীচে তেলে চপচপ অনেকদিনের না-কাটা চুল। তার নীচে একটা কচিকলা পাতা গেঞ্জি। ওকে ধরে এক বয়স্ক লোক ওর সাথে সাথে চলেছে। গায়ে ঢোলা রঙ ওঠা ঘোচকানো একটা সার্ট। ছেলেটার সাথে হাঁটায় তাল মিলাতে পারছে না। তাই দৌড়োচ্ছে। আস্তে জোরে। আবার একটু স্লো। একটু স্পিড। এই লোকটির জন্য ছেলেটাও পিছিয়ে পড়ছে দল থেকে।

    ওকে ফলো করতে করতে এই ছেলেটাও ছুটছে মাথায় ক্যানসহ র‍্যাশন ব্যাগটা তুলে নিয়ে। আবার ডান দিকে ঘুরে গেল দলটা। কীরকম আঁশটে আঁশটে গন্ধে ভরা জায়গাটা। মাছের পেটি ডানপাশে স্তূপ করা। কোনো দূর পাল্লার ট্রেন থেকে নামিয়ে রেখেছে ওখানে। পুরো দল ওই বেলুন ছবিওয়ালা ব্যাগ সহ ছেলেটাও স্টেশনের পুরোনো কমপ্লেক্সে ঢুকে গেল। এবার আরও জোরে ছুটছে। সোজা ছুট দশ নম্বরের দিকে। প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ে সামনের দিকের ছেলেগুলি দাঁড়ানো ট্রেনের পাশ দিয়ে ছুটছে। প্ল্যাটফর্মের মুখে ওই বেলুন ছবির ব্যাগ ওয়ালা ছেলেকে আটকে দিয়েছে সাদা ড্রেসের টি টি। কী একটা টিকিট পকেট থেকে বার করে নিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে ওই ছেলেটা। টি টি চোখ পাকিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে যাচ্ছে ওদের দিকে তাকিয়ে। বাকিরা প্ল্যাটফর্মের মুখের আরো জনা তিন চার টি টি কে টিকেট দেখিয়ে ছুট দিল সামনের দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের দিকে।

    এদিকে ওই পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের লোক আর সাথে কুড়ি পঁচিশ বছরের ছেলেটার সঙ্গে টি টির জোর ঝগড়া লেগে গেছে। ছেলেটা বলছে ভাঙা বাংলায়। বাকি বয়স্ক লোকটির একটি কথাও বোঝা যাচ্ছে না। চোখ গুলো টসটসে লাল। চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাও মুখ চোখ টেনে টেনে কী সব ভাষায় বলে যাচ্ছে। কথা গুলিতে অনেকটা পুরুলিয়ার ভাষার টান। অযোধ্যা পাহাড় বেড়াতে গেলে যে ভাষা ওখানকার লোকাল চা এর দোকানে অন্যান্য দোকানে ঢুকলে কানে আসে অনেকটা সেরকম।

    এই ছেলেটি কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে ততক্ষণে এক পুলিশের কাছে জেনে নিয়েছে ওটা করমণ্ডল এক্সপ্রেস নয়। সরাইঘাট এক্সপ্রেস। ছাড়বে তিনটে পঞ্চাশে। ফিরে এসে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে।
    ওরা দুজন টি টি র কাছ থেকে ফিরে এলো। দাঁড়িয়ে পড়ল থামের পাশে। স
    বাই আছে অন্য কোনো এক ট্রেনের অপেক্ষায়। বয়স্ক লোকটির সঙ্গের ছেলেটা মালগুলো ওই বয়স্ক লোকের কাছে রেখে দৌড়ালো বাইরে। ব্যাগের যে দিকে বেলুনের ছবি, মাটির দিকে আছড়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ছোট দুটো টিকিট নিয়ে ওই বয়স্ক লোককে দু এক কথায় কীসব বুঝিয়ে দিল। ব্যাগটা তুলল মাথায়। ব্যাগের লাল নীল হলুদ সবুজ বেলুন গুলোর রঙ বদলে কীরকম ধুলো ধুলো হয়ে গেল। ছুটলো আবার ওই দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে।

    আবার একটা নতুন টিকিট দেখাচ্ছে সেই টি টিকেই। এবার ছাড়লো ওদের। ছুটলো ট্রেনের দিকে। সরাইঘাট এক্সপ্রেস । গৌহাটি যাচ্ছে।
    ঘড়িতে তিনটে বেয়াল্লিশ। ওরা দুজন জেনারেল কামরার গেট গুলিতে, জানালাগুলিতে উঁকিঝুঁকি মেরে চলেছে। বাইরে থেকে বিপরীত দিকের জানালা দেখা যাচ্ছে না। আলো দেখা যাচ্ছে না। ফাঁক ফোঁকর দেখা যাচ্ছে না। শুধুই ভেতরে মানুষের হাঁটু জামা খোলা ঘামে ভেজা বুক কনুই উঁকি মারা চোখ খোঁড়া লোকের ক্র্যাচ। মেঝে গেট দুই সিটের মাঝখানে বাঙ্কে শুধু শরীর আর শরীর। ওরা দুজন জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে গেটের সিঁড়িতে পা তুলে দিয়ে নেমে গিয়ে চলেছে কামরার পর কামরা।

    সরাইঘাট এক্সপ্রেসে জেনারেল কামরা কম। দু খানা জেনারেল কামরার পরেই শুরু হয়ে গেল এসি কামরা। ট্রেন হুইসিল দিচ্ছে। ফিরতে নিল এ সি কামরার দিক থেকে আবার জেনারেল কামরার দিকে। ভিড়ের ভিতর কখন কোন কামরায় যেন ঠেলা দিয়ে উঠে পড়ল ওরা দুজন। পেছনের ইঞ্জিন থেকে ট্রেনের বগি গুলো আলগা করে দিয়েছে আগেই। সবুজ পতাকা দেখাচ্ছে ইঞ্জিন থেকে। ট্রেন ছাড়ছে।

    ওরা দুজন বাবা ছেলে। গৌহাটি যাবে। কাঠের মিস্ত্রি ওরা। পুরুলিয়ার ভেতরের কোনো এক গ্রাম থেকে। প্রথমে ভ্যানে চড়ে বাস স্ট্যান্ড। বাসের ছাদে চড়ে পুরুলিয়া স্টেশন। সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে হাওড়া। গ্রামের কেউ খবর দিয়েছে কাজ আছে। সে আসেনি সঙ্গে। ঠিকানা নিয়ে এরা চলেছে।
    ছেলেটার পিছনের দিকে দেখা যাচ্ছে পিছনে ফুড প্লাজার বোর্ড। ব্যাকলিট ডিজিটাল বোর্ডে ঝলমল করছে রঙিন পিৎজা বার্গার। দ্রুত বদলে যাচ্ছে ছবিগুলো। আরো সব কেক পেস্ট্রি। আসল সাইজের থেকে অনেক অনেক বড় বড় সাইজে। অনেক বেশি বেশি রঙিন। ছেলেটা সেদিকে পিছন ঘুরে বসেছে। দু হাতের চেটো জোড়া করে জল ভরে ভরে প্যান্ট গুটিয়ে খাবার জলের কল থেকে পা ধুয়ে এসেছে হাঁটু অবধি। কলারের রুমাল খুলে ঘাড় চোখ ডলে ডলে ধুয়েছে। কুলকুচি করেছে জোর একটা আওয়াজ করে। সেই ক্যানটা আবার ব্যাগ থেকে বার করেছে। ঢাকনা খুলছে। ডাল দেওয়া ভাতগুলোকে সব কটা আঙুল চেটো লাগিয়ে চটকে চটকে মাখছে। কাটা পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা কামড়ে গ্রাস তুলছে মুখে। খেতে গিয়ে সব কটা দাঁত জিভ চোয়াল টাগরা বেশি বেশি করে নড়ে উঠছে।

    বোর্ডে কখন যেন দিয়ে দিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস পরিবর্তিত সময়ে বাইশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। আশপাশের যে ছেলেরা চট বিছিয়ে কাগজ বিছিয়ে ওর পাশে শুয়ে বসে ছিল তারা সব ততক্ষণে উঠে গিয়ে লাইন দিয়ে দিয়েছে বাইশ নম্বরে। ওর ডাল মাখা হাত চাটতে চাটতে লাইন চলে গেছে অনেক অনেক দূর। পুলিশকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে করতে ছুট দিল সেই শর্টের রাস্তায় নতুন কমপ্লেক্সের দিকে।

    করমণ্ডল ঢোকেনি। ছেলেদের লাইন বাইশ নম্বরের গা ঘেঁষে। শেষ দেখা যাচ্ছে না। লাইনে বেশির ভাগ ছেলে পনেরো কুড়ি পঁচিশের মধ্যে। আরো বেশ অনেকক্ষণ পরে ট্রেন ঢুকল। একে একে জেনারেল বগির গেট খুলছে পুলিশ। লাইন করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। প্রথম বগি ফুল দ্বিতীয় বগির গেট খুলছে। এভাবেই উঠতে উঠতে হঠাৎ কে যেন মাঝের দরজা খুলে দেওয়ায় হুড়মুড় করে লাইনের মাঝখান থেকে উঠে পড়ল। পুলিশ দিল আবার দরজা লাগিয়ে। আবার আগের নিয়মে ওঠা শুরু। সব জেনারেল বগি প্যাকড আপ। তাও লাইন। শেষ কোথায় লাইনের। না । কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না এখনো। ছুটতে ছুটতে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। লাইন ভেঙে গেছে এবার। স্পিড বাড়ছে ছোটার। একদল সেকেন্ড বগিটাতে ভিড় দেখে প্রথমটার দিকে এগিয়ে আসছে। আরেক দল দ্বিতীয় বগির দিকে ছুটছে। নয়তো অন্য অন্য বগির গেট। তিন নম্বর বগির গেট। চার। পাঁচ। এই গেট থেকে ওই গেট ওই গেট থেকে সেই গেট। ভিড়ে মিশে গেছে ছেলেটিও। শুধু দৌড় চলেছে ওখানে।
    ট্রেনটা বিকেল পাঁচটার দিকে চেন্নাই সেন্ট্রাল পৌছোনোর কথা ছিল। গিয়ে রাত আটটায় আরেক ট্রেন। সেটা কেরালা যাবে। এটা পাঁচটায় পৌঁছবে না। ছাড়ছেই আজ দেরিতে। ওরা ছুটছে কেবল। ব্যাগগুলোও এপাশ ওপাশ হচ্ছে। ব্যাগের সাথে ব্যাগ ধাক্কা খাচ্ছে। ধাক্কা খাচ্ছে ড্রাম জলের বালতি। ব্যাগ ছিঁড়ে পড়ছে। ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে। আবার উঁকি। ওদের বড় ছোট কুতকুতে ট্যারা নানারকম চোখ শুধু একটা জিনিসই খুঁজে বেড়াচ্ছে। একখানা জায়গা।

    ওদের দেখে বোঝা যাচ্ছে নানা রকম কাটা চুলে ঢাকা বা ন্যাড়া ন্যাড়া মাথা গুলোর ভেতর কেবল একটাই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। একটা বসার জায়গা। মেঝেতে সিটে বাঙ্কে বাথরুমের দরজার সামনে যেখানে হোক। শুধু এই করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনের ভেতরে হলেই চলবে ওদের। একটা জায়গা। এই করমণ্ডলে তারপর এর পরের ট্রেনে। তারপর কোম্পানির ঘরে। মাঠে। তাঁবুতে। স্টেশনে। একখানা কোথাও।

    একটু আগে এরা সব শুয়েছিল স্টেশনের এধার ওধারে। একটু আগেই যে যা ভাবছিল সেগুলো নিশ্চয়ই এখন সব ভুলেছে। একটু আগেই এদের কেউ হয়তো ভাবছিল দু মাস আগে বিয়ে করা বৌটার কথা। কেউ হয়তো ভাবছিল রোজা ভাঙার টাইমের কথাটা। ব্যাগের ভেতরের মুড়ি আর কাঁচা পেঁয়াজ আছে। বাড়ি থেকে কিসব যেন আনতে ভুল হয়ে গেল। গার্লফ্রেন্ড ছবি পাঠিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপে একটু আগেই। আজ দাসপাড়া শনি পুজোতে নেমন্তন্ন ছিল। আরো কত কত কথা নিশ্চয়ই। একটু আগের কথাগুলো বদলে এখন শুধু একটাই কথা। একটা জায়গা।

    এই লাইনের বেশিরভাগ ছেলে চলেছে নিজের ঘর নিজের বিছানা নিজের পাড়া ছেড়ে অন্য অন্য জায়গায় কাজে। এক্টা কাজে। ধান মাঠে চড়ে পিলারে খুঁটিতে হাইটেনশন লাইনে ড্রেনে বিল্ডিঙের মাথায় যেকোনো একখানা কাজ।

    রোজ হাওড়া স্টেশনে এলেই দেখা যায় গ্রাম থেকে এসেছে এরকম কত কত ছেলে। মুখগুলো জামা কাপড় সব কীরকম অন্যরকম। শহরের চেনা চেনা মুখের মতো নয়। এরকম মুখের লাইন পড়ে ত্রিবান্দ্রম এক্সপ্রেস সরাইঘাট এক্সপ্রেস চেন্নাই মেল কালকা পূর্বা গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস আরো কত কত গাড়ির পাশ দিয়ে।

    ছেলেটি যেখানে বসে খাচ্ছিল তার পিছনের ফুড প্লাজার উপর ডিজিটাল বোর্ডে বিদেশি খাবারগুলোর পাশে আরেক বিজ্ঞাপন চলছিল। এখনো চলেছে

    ভোট ভোট ভোট
    সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন
    ছয় দফা ভোট। ভোট হবে ছয় দিন।
    ভোট ভোট ভোট
    একটা ভোটও যেন বাদ না পড়ে।

    ভোট হয়েছে। এক্সিট পোল হয়েছে। ভোট গণনা হয়েছে। বিজেপি সিপিএম কংগ্রেস তৃণমূল জিতেছে হেরেছে। টিভিতে সে পরিসংখ্যার বিশ্লেষণ হয়েছে। মাঝে বিজ্ঞাপনের বিরতি হয়েছে। পারফিউম স্নো পাউডার সাবানের বিজ্ঞাপন। কোল্ডড্রিঙ্কের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে চিন্তার কথা আশার কথা জানিয়েছেন বুদ্ধিজীবীরা। ভোটের খবর বেরিয়েছে কাগজে কাগজে। সকাল থেকে সব কাগজে মুখ গুঁজে রেখে পড়েছে। ফেসবুকে হোয়াটসঅ্যাপে লাইক কমেন্ট হয়েছে। গ্রুপে গ্রুপে ধার করা মেসেজ শেয়ার হয়েছে। নেতা নেত্রীদের জোক কার্টুন ছড়িয়েছে। পুরোনো সরকার ভেঙেছে। নতুন সরকার এসেছে।

    দফায় দফায় ভোটের দিনগুলিতেও ওভাবেই ওই ট্রেনগুলিতে লাইন পড়েছে। রোজ রোজ লাইন পড়েছে। ট্রেনগুলি চলে গেছে অন্য অন্য শহরের দিকে। গাদাগাদি ভিড় নিয়ে চড়া রোদে লু-এর ভেতর জেনারেল কামরা গুলো চব্বিশ ঘণ্টা বেয়াল্লিশ ঘণ্টা চলছে। থেমেছে। আবার চলেছে।

    এরপর হ্যাপি নিউ ইয়ার হ্যাপি নিউ ইয়ার বলতে দু হাজার কুড়ি এসে গেছে। দু হাজার কুড়ির সাথে সাথে ভাইরাস এসেছে। বিদেশের ভাইরাসের খবরে পাত্তা না দিয়ে ফ্লাইটে করে রোগ নিয়ে মানুষদের আসতে দিয়েছে। ঘুরে বেড়াতে দিয়েছে। তারপর হঠাৎ ভয় পেয়েছে সরকার। তাই চব্বিশ ঘণ্টার নোটিসে সারাদেশের ট্রেন বাস রোড সব বন্ধ করে দিয়েছে। সিল করে দিয়েছে সব বর্ডার। দেশে দেশে বর্ডার। রাজ্যে রাজ্যে বর্ডার। ব্যবস্থা করেছে বাইরে বেরোলেই গ্রেপ্তার করার আর দেদার লাঠির বাড়ি মারার। জারি করেছে লকডাউন। মাসের পর মাস জারি করে রেখেছে লকডাউন। রাজ্যে রাজ্যের হাইওয়েতে বর্ডারে এসে জমা হয়েছে লাখে লাখে মানুষ। ট্রাকের মাথায় পাইপের ভেতর জঙ্গলের মাঝে মানুষ দিন কাটিয়েছে। হাজার কিলোমিটার হেঁটেছে। সাইকেল চালিয়েছে । ট্রাংক বাক্স গ্যাস সিলিন্ডার কোদাল ঝুড়ি বালতি বাচ্চা বুড়ো কাঁধে নিয়ে হেঁটেছে। শ’য়ে শ’য়ে কিলোমিটার হাঁটার পর রাস্তায় বাচ্চা প্রসব করেছে লেবারের বৌ। তারপর আবার হেঁটেছে শয়ে শয়ে কিলোমিটার। সবাই দেখেছে কেবল। রেল লাইনে শুয়ে হাইরোডে ঘুমিয়ে থেকে চাকার তলায় পিষে গেছে সেই মানুষগুলো, যারা লক ডাউনের আগে বছরের প্রতিদিন লাইন দিয়েছে স্টেশনে, কন্সট্রাকশান সাইটের মুন্সির টেবিলের সামনে ধান মাঠের মালিকের সামনে হপ্তা নিতে দিনমজুরি নিতে।

    ভোট আসছে আবার। ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। ভাইরাস ভাইরাস রব চাপা পড়েছে ভোট ভোট রবে। লক ডাউন উঠে গেছে কবেই। ঢাক ঢোল বহুরূপী সাজ সেলিব্রিটি রঙিন বেলুন চিৎকার চ্যাঁচামেচি সাথে করে জমাট বাঁধা ভিড় এখন মাঠে মাঠে রোডে রোডে পাড়ায় পাড়ায়।
    পরিযায়ী শ্রমিকদের খবরগুলো চাপা পড়ে গেছে নতুন নতুন খবরের কাগজের তলায়। ওরা আবার যাচ্ছে।

    লুকিয়ে লুকিয়ে ওরা চলে যায় লকডাউনের ভেতরেই। ট্রাকে ট্রাকে। লক ডাউন আনলক হলে যায়। ট্রেনে চাপে। আবার যায়। কামরার নামটা বদল হয়। জেনারেল থেকে টু এস। ভাড়া বাড়ে অনেক। আবার লাইন দেয় ওদের কন্সট্রাকশন কোম্পানিগুলিতে মাঠে তেল খোঁড়ার কাজে তাঁতকলে ব্যাগের কারখানায় পাথর ভাঙার ধুলোয়। দিল্লি ব্যাঙ্গালোর মুম্বাই আরো আরো শহরের লেবার মার্কেটের লাইনে দাঁড়ায়। কতো কতো লাইন। লাইন আর লাইন। ওরা দাঁড়ায়নি দাঁড়াবেনা ওদের পাড়ার ইস্কুলের বুথে ভোট দেওয়ার লাইনে।





    লেখাটির কিছু অংশ ডিসেম্বর ২০২০-তে প্রকাশিত ‘লেবার ট্রেন’ বইটিতেও রয়েছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১০ এপ্রিল ২০২১ | ২৩৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন