এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • ছোটো গল্প: খেসারত

    Rezaul Karim লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৩৭২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • মো. রেজাউল করিম

    তখন ছিল অঘ্রান মাস- ধান কাটার আগের মৌসুম; এ-সময়ে এলাকায় দিনমজুরের কাজ একেবারে থাকে না। উলিপুরের বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের গড়গড়িয়া গ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে থাকা নদীভাঙা মানুষগুলো নৈরাশ্যের অতলে নিমজ্জিত। বাঁধের এ-অংশকে কে, কবে হঠাৎপাড়া নাম দিয়েছে, তা তাদের অজানা, এটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। এ বাঁধে অনেক নিঃস্ব মানুষ আছে, একসময় যারা ছিল সম্পন্ন গেরস্ত; অনেকে আছে যারা একবার নয়, পাঁচ কি সাতবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে এখন নিঃস্ব। জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা তাদের কাছে পরিষ্কার। তারা ভাবে জন্ম-মৃত্যু যেমন আল্লাহর হাতে, তাদের জীবিকাও তাঁরই হাতে। ঈদের আগের দিনগুলোতে যারা শহরে রিকশা চালাতে যায়, তাদের আয়-রোজগার হয় কিছুটা বেশি, যদিও তা দিয়ে বিগত দিনের কর্জ পরিশোধ করে ঈদের দিনের জন্য এক ঠোঙা সেমাই আর একটু চিনি বা গুড় কেনা হয়। অনেকেই আছে শারীরিক দুর্বলতার কারণে রিকশা চালানোর মতো কঠিন কর্মে নিয়োজিত হতে পারে না। ওরা দুই দিন দিনমজুরিতে গতর খাটায় তো তিন দিন ঘরে শুয়ে-বসে দিন কাটায়। নদীভাঙন, ঘরদোর খুলে নিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে কিংবা এক বাঁধ থেকে অন্য বাঁধে গিয়ে বসত নির্মাণ- এগুলো তাদের কাছে জীবনেরই স্বাভাবিক ঘটনা। রোগ-শোকে তারা ব্যতিব্যস্ত হয় না, মৃত্যুকে মনে করে নদীভাঙনের মতোই মানবজীবনের এমন এক ঘটনা, যা ঘটবেই। চা খাওয়ার মতো টাকা হাতে না থাকলেও হঠাৎপাড়ার মুদি দোকানের সামনে পুরুষ মানুষগুলো বসে থাকে, দু’একজন কথা বলে, অন্যেরা জড় পদার্থের মতো শোনে; কী এক অদৃশ্য কারণে নিজে মুখ খোলে না।

    হঠাৎপাড়ায় মুদি দোকানদার ও মোবাইল ফোনের দোকানিকে তারা এলাকার জ্ঞানী মানুষ মনে করে। কেননা, মুদি দোকানদারের কাছে রেডিও আছে। সে-ই দেশের খবরাখবর তাদেরকে দেয়। মোবাইল ফোনের দোকানি ফোনে টেলিভিশনও দেখতে পায়, তবে সেই টেলিভিশন দেখতে নাকি টাকা লাগে, যে-কারণে সেটা সে যখন তখন চালায় না। কুড়িগ্রামের ছওয়াল দ্যাশের রাজা এরশাদ মৃত্যুবরণ করলে সে তার ফোনে তার জানাজা দেখিয়েছিল। হঠাৎপাড়ার বাসিন্দারা আফসোস করে বলেছিল ‘ছওয়ালডা রাজা থাহলে তাদের একটা কিছু গতি করিত।’

    বানেছা স্বামী মোন্তাজ ও দুই ছেলে নিয়ে নদীর পাড়েই থাকত। সে যখন ছোটো তখন নদীতে হেঁটে যেতে শরীরের ঘাম ছুটত। নদী একসময় তাদের বাড়ির কাছে চলে এলো। একদিন পুরো গড়গড়িয়া গ্রামই ব্রহ্মপুত্র নদে তলিয়ে গেল, পাঁচ শতক জায়গার ওপরে ওদের বাড়িটিও চলে গেল নদীগর্ভে। ভাঙনের আগের দিন ওদের ছোট্ট বাড়ির টিন ক’খানা খুলে আনতে পেরেছিল। ওরা আশ্রয় নিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে। ছেলেমেয়ে দুটোর ইশকুলে যাওয়াও বন্ধ হলো। বানেছার স্বামী মোন্তাজউদ্দিন কাজকর্ম করত। কখনও রিকশা চালাত, কখনও দিনমজুরের কাজ করত। কিন্তু নদীভাঙনের পরে বাঁধে এসে তার আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেল। কিছুদিন পরে স্বামী মোন্তাজউদ্দিন কাজ করতে চলে গেল ঢাকা। মাজেদা ছোটো দুটো ছেলে নিয়ে বাঁধেই ছিল। মোন্তাজ প্রতি সপ্তাহে বিকাশের মাধ্যমে মোবাইল ফোনের দোকানে টাকা পাঠাত। সেই টাকা দিয়েই মা আর দুই ছেলের খাওয়া-দাওয়া চলে যেত।

    চৈত মাসে ঢাকায় নাকি কী এক রোগ এলো। সরকার সব অফিস-আদালত বন্ধ করে দিল। মোন্তাজ মোবাইল ফোনে রাতে জানাল ঢাকায় কাজ নাই, সে কালই বাড়িতে চলে আসবে। পরদিন দুপুর থেকেই মোন্তাজের ফোন বন্ধ। তিন দিন পর মোন্তাজের সাথেই কাজ করত বাবুল, মোবাইল ফোনের দোকানে ফোন করে জানাল, সে হাসপাতালে আছে। ওরা ট্রাকে করে কুড়িগ্রামে রওনা দিয়েছিল। ট্রাকটি টাঙ্গাইলের কাছে উল্টে গেলে সাত জন ওখানেই মারা গেছে। বাবুল আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। মোন্তাজের লাশ কে, কোথায় দাফন করেছে তা তার জানা নাই।

    বানেছার শুরু হলো দ্বিতীয় জীবন। প্রথম দু’তিন দিন বানেছার রান্না করতেও ইচ্ছে করেনি। দু’চোখে ছিল ঘোর তমিস্রা। ছোটো ছেলে দুটোর কান্নায় আশেপাশের ঘর থেকে কালচে লাল রঙের মোটা দানার ভাত আর ডাল দিয়ে গিয়েছে। এলাকার মেম্বর এসে পাঁচশ টাকা দিয়েছে, বলে গিয়েছে বছরখানেক পরে বিধবা ভাতা পাবে সে। মেম্বরের দেয়া টাকায় বানেছা চাল আর ডাল কিনে দুই ছেলে নিয়ে বাঁধের ওপরে গজিয়ে ওঠা কচুশাক, বেতো শাক যোগাড় করে কদিন খেলো। কখনও-বা বাঁধের পাশে জলাজঙলায় হাঁটু পানিতে নেমে শাপলা ফুল তুলে এনেছে, শাপলা-ডাঁটার ঝোল পেলে ছেলেগুলো বেশ হড়হড়িয়ে খায়। ছোটো ছেলেগুলো শুকনা শাকভাজি দিয়ে দিনের পর দিন ভাত খেতে পারে না। পাঁচশ টাকার চাল-ডালে আর কয়দিন খাওয়া যায়। বানেছার বাবা-মা খবর পেয়ে দিন তিনেক পরে এসেছিল। তারাও বাঁধে থাকা মানুষ, তারা থাকে হাতিয়া ইউনিয়নের এক বাঁধে। বানেছা বাবা-মাকে এক মুঠ মুড়ি কিংবা এক খিলি পানও দিতে পারেনি। বৃদ্ধ বাবা পরদিন অনেক পথ হেঁটে এসে দুশ টাকা দিয়ে গেল, কোথায় পেল কে জানে!

    মেম্বর লোকটা ভালোই, এলাকায় তার কোনো বদনামও নেই। দিন সাতেক পরে সে আবারও বানেছার খোঁজ নিতে এসে সব কিছু শুনে তাকে তার বাসায় কাজ করতে বলল। বেয়ান বেলায় যেতে হবে, সাঁঝবেলা পর্যন্ত কাজ- গেরস্ত বাড়িতে কত রকমের কাজ- উঠোন ঝাড় দেয়া, গরুর দুধ দোয়ানো, হাঁস-মুরগিগুলোকে খাওয়ানো, পুকুর ঘাটে কাপড় কাচা আরও কত কী! ছেলে দুটো নিয়েই সমস্যা। ওরা কার কাছে থাকবে? পাশের ঘরের রমেলা খালা নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘কাম কইবার নোয়াইস তো খাবু কি? তোর ভাতার তো আজার ধন রাখি যায় নাই। মেম্বরের বাড়ির কামত লাগি পড়। ফজরত উঠপু। ছাওয়া গুলাক ডাইল-ভাত আন্দি দিবু। উমরাতো দুদের ছাওয়া নোয়ায় যে ঘুম হাতে উঠিয়ায় খাবার বসপে। গোটালে দিন বানদোত খালাইবে। বানদোত কত ছাওয়া পোয়া খেলিছে। উমরাও খালাইবে, ঘুরবে। সানঝের আগৎ ফিরি আসবু তুই। মেম্বরের বাড়িত কাম করা কোপালত নেকা থাকা নাগে। ইলিপ আসলে আগত তুই পাবু। বিধুয়াভাটার লিস্টট নাম উঠিল বলি। মেম্বর মেলা ভাল মানুষ। তার বাড়িত কাম করি বাচি থাকপু।’ অনেকগুলো কথা একবারে বলে খালা ঠোঁটের দুই কষা বেয়ে গড়িয়ে আসা পান চিবানোর রস আঙুলের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ঘরের পেছনে জলাজঙলার দিকে তাকিয়ে রইল, এতক্ষণ তার কণ্ঠে দরদ থাকলেও এখন তার দৃষ্টিতে অজানা এক নৈরাশ্য; মনে হয় যেন বিগত জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর সাদাকালো ক্যানভাসে অস্পষ্ট পটচিত্রের দিকে অর্থহীন দৃষ্টিতে কত বছর একইভাবে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি।

    বানেছা কথা বাড়ানোর সাহস পায় না। সন্ধ্যার কিছু পরেই বাঁধে রাত নামে। জেগে থাকা অর্থ কেরোসিনের তেল খরচ করা। কেরোসিন তেলের দাম ঊর্র্ধ্বমুখী, অহেতুক জেগে থেকে তেল খরচ করার সাধ্যি আছেই-বা কজনার এ-বাঁধে?  জোছনা রাতে অবশ্য কেউ কেউ ঘরের সামনে বসে সিগারেট ফুঁকে, কেউ-বা বাচ্চা কোলে হেঁটে বেড়ায়। কতক্ষণ আর এভাবে কাটে? ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। তারপরে তো শুধুই ঝিঁঝিঁর শব্দ, আর জোনাকির আলোÑ যেন রাতের আকাশের তারাগুলো মাটির ওপরে শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারা রাত বদ্ধ ঘরের মধ্যে থেকে গরমে সকলেরই নাভিশ্বাস, সূর্য ওঠার সাথে সাথেই মানুষগুলো কিলবিল করে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়, শরীর যেন জুড়িয়ে যায় বাতাসের শীতল পরশে।

    বানেছা মেম্বরের বাড়িতে কাজে লেগে পড়ে। বড়ো ছেলেটার বয়স দশ, ছোটোটার আট। আঁধার থাকতে বানেছা উঠে পড়ে। ঘরের বাইরে বাঁধের ঢালে পাটকাঠি ঘেরা, ওপরে চাটাই দেয়া ছাউনিতে ভাত ও ডাল রান্না করে চৌকির পাশে মাটিতে দুই ভায়ের জন্য থালায় সাজিয়ে টিনের দরজাটা ভিড়িয়ে রমেলা খালাকে বলে, ‘খালা কামত গেনু। ছাওয়া দুকনাক দেখি থোন।’ খালা শোনে, কিন্তু মুখ খুলে কোনোদিন রা-টি করে না, বরাবরের মতোই অর্থহীন দৃষ্টিতে জলাজঙলার দিকে তাকিয়ে থাকে। বানেছা মেম্বরের বাড়িতে গিয়ে পান্তা খেয়ে কাজ শুরু করে। সারাদিন বিরামহীন কাজ করে বিকেল বেলায় মেম্বরের বউ গামলা ভরে ভাত-তরকারি দেয়। বলে, ‘গোটালে দিন না খায়া আছিস। ভাত খায়া বাড়ি যাবু তাক নোয়ায় ছাওয়া গুলাক খিলাবার জন্য নিয়া যাবু। মোকও গামলা ভরি ভাত দেওয়া নাগে। মেম্বরও একখান মানুষ দিছে মোক। কাম কইরবার নাগছে একজন আর ভাত খিলাও তিন জনোক।’ বানেছা শোনে, ভাবে যা বলছে তা-তো মিথ্যে না। বলবেই তো। ভাত দেবে বেশি করে, দুটো কথা শোনাবে না, তা কী হয়?

    এগুলো কোনো সমস্যা না, সমস্যা অন্যখানে। পাশের বাড়ির মামুন, বড্ডো পুংটা চ্যাংড়া। বানেছার চেয়ে বয়সে পাঁচ-সাত বছরের ছোটোই হবে। ছোটো থাকতে ওর বাপ মরার পরে মা আর একজনের সাথে নিকেতে বসেছে। সৎ বাপ ফেলে দেয়নি, কিন্তু লেখাপড়াও শেখায়নি। সৎ বাপ তাকে কোনোদিনই ভালো চোখে দ্যাখেনি। সেও বড়ো হয়ে মা-বাপের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছে। শুধু রাতটুকু ঘুমানোর জন্যই বাড়িতে যায়। সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়ায়। এ-বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। ছোটোখাটো ফুটফরমায়েশ তামিল করে মেম্বরের বউ এর কাছ থেকে পাঁচ-দশটা টাকা পায়, কখনও পেট ভরে খাবারও পায়। তবে মেম্বরের জোয়ান মেয়ে থাকায় ঘরে ঢোকা ওর জন্য বারণ। রান্নাঘরে কথায় কথায় বানেছা শুনেছে, মামুনের মেয়েদোষ আছে। একবার তাকে নিয়ে শালিস হয়েছে, বিচারে কুড়ি বার কান ধরে উঠবোস করানো হয়েছে। মেম্বরের কাছে আবারও তার নামে অভিযোগ এসেছে; এবারে বিচার তো হবেই, এ-বাড়িতেও তার ঢোকা নিষেধ হয়ে যাবে।

    মামুন ঘরের বারান্দায় বসে বানেছার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, সে তাকানোতে লাজশরমের কোনো বালাই নাই। গরু-ছাগল মরে গেলে মালিক দেহাবশেষ গাঁয়ের শেষ প্রান্তে ফেলে সরে না আসা পর্যন্ত চিল-শকুন যেমন শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মামুনও বানেছার দিকে সেভাবেই তাকিয়ে থাকে। ও যখন উঠোন ঝাড় দেয়, তখন পেছন দিক থেকে শ্যেনদৃষ্টিতে বানেছার নিতম্ব আর ক্ষীণকায় কটিদেশ দ্যাখে। আবার যখন মুখ ফিরিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে ঝাড় দিতে দিতে এগিয়ে আসে তখন ঈষৎ সরে যাওয়া আঁচলের ভেতর দিয়ে ব্লাউজের ভেতরে স্তনযুগলের উপরাংশ দ্যাখে। বানেছা সব বুঝে, কিন্তু মেম্বরের বউকে বলতে ভয় পায়, যদি তাকে কাজ থেকে বিদেয় করে দেয়- এই ভয়ে!

    ক’দিন হলো মামুনের জ্বালা-যন্ত্রণা বেড়ে গিয়েছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এটা-সেটা বলে। প্রথমদিকে ইশারা-ইঙ্গিতে বললেও এখন সরাসরিই বলে- রাতগভীরে তার ঘরে যেতে চায়, অশ্লীল মুখভঙ্গি, দেহভঙ্গি করে। উঠোনে কেউ নেই দেখে বানেছা একদিন মুখ ঝামটা মেরে বলে, ‘পিচ্ছি চ্যাংড়া তুই আসিস। তোর চেটের কূটকুটানি এক্কেবারে মিটি দেইম এলা।’ মামুন মজা পায়। সে বানেছার মুখ থেকে আরও কথা শুনতে চায়। সে যদি অশ্লীল কথা বলে তাহলে মামুন আরও খুশি। তার মন পুলকিত হয়, শরীর শিহরিত হয়। পরদিন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে, ‘আইজ নোয়ায় কাইল আইতোত তোর ঘরত।’ বানেছা ভাবে সত্যি কী আসবে মামুন? আগে থেকেই মেম্বরের বউকে বলা কি ঠিক হবে? যদি এ-বাড়ির কাজ থেকে বিদায় করে দেয়? কিছু একটা করা দরকার।

    ভাদর মাসের ভ্যাপসা গরমে ঘুম আসতে চায় না। বছরের এই সময়ের গরম অসহ্য- বাতাস থাকে না, গরমটা  চৈত মাসের মতো শরীর পুড়িয়ে দেয় না, কিন্তু কেমন যেন শরীরে আঠাআঠা ঠ্যাকে। ছোটো চ্যাংড়াগুলো শীতে খুব কাবু হয়ে পড়লেও গরমে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে সহজেই। বানেছা হাতপাখা ঘুরায়, সেই বাতাসে চ্যাংড়া দুটো ঘুমিয়ে পড়ে, বানেছাও।

    রাত বোধ হয় তখন গভীর। ঝিঁঝিঁদের বিরতিহীন শব্দযন্ত্র বন্ধ হয়েছে। বাঁধের সকলেই হতদরিদ্র, সঙ্গত কারণেই হঠাৎপাড়ায় চোর আসে না, এখানে সকলেই সম্বলহীন। চারদিকে সুনসান নীরবতা। দশমীর চাঁদের আলোয় হালকা মায়াবী আলো-আঁধারি। ঘরের ভেতরে বানেছা দুই ছেলে নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার ঘুম ভেঙে যায়, সে ভাবে বোবায় ধরেছে। ছোটো বয়সে তার মা শিখিয়ে দিয়েছে, বোবায় ধরলে হাত-পা নাড়তে হবে, আর মাথা নাড়িয়ে মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে হবে। সে অনায়াসে হাত-পা নাড়ে। কিন্তু মুখে শব্দ করা দূরের কথা, মাথাও নাড়তে পারে না। ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের সামান্য আলোয় ঘরে ছাদটুকু অন্তত দেখা যাচ্ছে। বানেছা বুঝতে পারে তার মুখ শক্ত হাতে চেপে ধরে রাখা হয়েছে, চোখের ওপরে মামুনের মুখের আবছায়া, তার ডান হাতে একটা হাসুয়া। বানেছা হাত দুটো ঘাড় অবধি তুলে তাকে থামার ইশারা দ্যায়। ছোট্ট ঘরে দুটো মানুষ যুঝমান, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। ছেলে দুটো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মামুন তখন শান্ত হয়েছে। সে হাসুয়াটা রেখে ধীরে ধীরে বানেছার কাপড় খোলে, ওষ্ঠযুগল বানেছার ওষ্ঠে ডুবিয়ে দেয়। বানেছা মামুনের বিশেষ অঙ্গে হাত দেয়, মামুন তখন পাগলপারা। এইতো চাঁদমুখো বানু, এই যদি ছিল তোমার মনে, কেন এতদিন আমায় কষ্ট দিলে? মামুন আরও নিবিড় হয়। বানেছার ঘাড়ের পাশে মুখ ডুবিয়ে কান কামড়ে ধরে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সে তখন। বানেছার ডান হাত তখন অন্য কাজে ব্যস্ত। হাঁ, ঠিক জায়গায় সে ওটা পেয়ে যায়। বানেছা ব্লেডটা ভালো করে ধরে মামুনের বিশেষ অঙ্গে পোঁচ দিয়ে দেয়। সাথে সাথে গগনবিদারী চিৎকার।

    ঘরের ঠুনকো দরজা ভেড়ানো ছিল, সেটা ঠেলে মামুন দৌড় দেয় বাঁধ ধরে। এলাকার মানুষের যখন ঘুম ভাঙে মামুন তখন যন্ত্রণায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। মামুন দৌড়াচ্ছে আর গগনবিদারী চিৎকার। দু’একজন মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আসে, একজন টর্চ জ্বালিয়ে দ্যাখে বস্ত্রহীন একটি ছেলে দৌড়াচ্ছে, তার শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। মামুন আর পারে না, বসে পড়ে সে, এক সময় জ্ঞান হারায়। ভিড় বাড়তে থাকে। শোরগোল, হৈচৈ-এর মধ্যে করিৎকর্মা দু’একজন কাপড় দিয়ে তার যৌনাঙ্গ ঠেসে ধরে, অনেক কসরত করে তাকে বিছানার চাদরে আবৃত করে। প্রথমে সে এ-পাড়ার কেউ না বলে সনাক্ত হলেও পরে তার পরিচয় জানা যায়। কোথায় তার এ-অবস্থা হলো কেউ জানার আগ্রহও প্রকাশ করল না। সকলেই যেন বিরক্ত মাঝরাতে তাদের ঘুম ভাঙার কারণে। কে একজন তার ইঞ্জিনচালিত ভ্যান নিয়ে এলো। অচেতন মামুনকে ভ্যানে তোলা হলো, ভ্যানটি উলিপুর হাসপাতাল অভিমুখে চলল। ভ্যানের পেছনে বসা তরুণ ছেলেটি বলল, ‘আকাম করতে গিয়ে ধরা খায়ছে, তার জন্য আমি রাত জাগি কষ্ট করি ক্যানরে?’

    ‘ভ্যানওয়ালা বলে, ‘মুই তো ভাড়া পাবার নোয়। মুই উয়াক নিয়া আইতে জাগো কেনে? উয়াক নদীত ফেলি দিলিই তো হয়।’ কেউ আর কোনো কথা বলল না। আধাঘণ্টা পর ভ্যান যখন হাসপাতালে পৌঁছল, তখন ভোরের আলো তার আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছে।

    ওদিকে বানেছা ভয়ার্ত ছেলে দুটোকে শান্ত করে আবারও শুইয়ে দিল। এক টুকরো মাংস ঘেন্নাভরা চাহনিতে তুলে নিয়ে ঘরের পেছনের জলাজঙলায় ছুঁড়ে দিল। বিছানার চাদর ও মামুনের লুঙ্গি চুলার মধ্যে ফেলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। রমেলা খালা ঘর থেকে বের হয়ে  এসেছেন, সবই আঁচ করতে পেরেছেন তিনি ততক্ষণে। খালা আজ মুখ খুলেছেন, ‘আইগ্না ঘর দুয়ার গোটালে প্যাঁক দি লেপি দে। অক্তের দাগ যেন চোখত না পড়ে।’ বানেছা অন্ধকারে বাঁধের ঢাল থেকে কাদাপ্যাঁক তুলে এনে ঘর থেকে বাঁধ পর্যন্ত পায়ে হাঁটা পথ পুরোটাই লেপে দিল। খালা ততক্ষণে বাঁধের ওপরে দৃশ্যমান রক্ত নিড়ানি দিয়ে তুলে ফেলেছেন। অর্ধেক রাত ঘুমিয়েছে বানেছা, ঘটনার পর আর ঘুমাবার সুযোগ পেল না।। তারপরেও ছেলেদের জন্য রান্না করে যথারীতি মেম্বরের বাড়িতে কাজে গেল।

    পরদিন সকালে মুদি দোকান ও মোবাইল ফোনের দোকানে জনসমাগম কিছুটা বেশিই দেখা গেল। কাল রাতের ঘটনা আলোচনায় আসল। বাঁধের নৈরাশ্যবাদী মানুষগুলো আজ অন্যদিনের তুলনায় কথা কিছু বেশিই বলল। কেউ বলল, ‘এটা তার ভাগ্যে লেখা ছিল’, কেউ বলল, ‘উচিত শিক্ষা হয়েছে’, কেউ বলল, ‘বেচারা আর বিয়ে করতে পারবে না।’ কেউ-বা বলল, ‘বিয়া, বাচে কিনা তাক কায় জানে?’ ভ্যানওয়ালা বলল, ‘হাসপাতালত হুঁশ ফিরিল। কায় উয়াক আকাম করিল, কেনেবা করিল তাক কয় না। হাসপাতালের চেঙড়িগুলান খালি হাসোছল।’

    পরদিন কুড়িগ্রামের স্থানীয় পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেল, মামুন বেঁচে আছে, তবে তার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। তাকে রংপুর মেডিকেলে পাঠানোর চেষ্টা চলছে। তার কোনো আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে না আসায় হাসপাতাল সমাজসেবা থেকে চিকিৎসার খরচ বহন করা হচ্ছে। উলিপুর থানার অফিসার-ইন-চার্জ জানিয়েছেন, ‘ঘটনাটি তিনি শুনেছেন, কেউ মামলা করলে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা হবে।’’
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৩৭২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন