এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • প্রলয়

    মো. রেজাউল করিম লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১১ জুন ২০২০ | ১২৬৪ বার পঠিত
  • বড়ো মেয়ে শমরিতা রিতু পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার পর থেকে হায়দার আলীর স্বপ্ন মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। তাঁর বংশে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি। এসএসসি, এইচএসসি’তে জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাস করার পর হায়দার আলীর স্বপ্ন নতুন মাত্রা পায়। মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন তিনি। জেলা আদালতে করণিকের চাকুরি করেন। দুটো মেয়ে। স্বল্প বেতনে সুদূর উত্তরের জেলা শহর কুড়িগ্রামেও ভালোভাবে সংসার চালানো বেশ কষ্টকর। মেয়েকে ঢাকা কিংবা অন্য শহরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কথা শুনে রিতুর মা বরাবরই ভয় পেয়েছেন। এমনিই সংসারে টানাটানি। তার ওপরে বড়ো শহরে রেখে মেয়েকে পড়াতে হলে বাড়তি টাকা আসবে কোত্থেকে? জেলা শহরের কলেজেই তো পড়াশোনা করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে কেন? হায়দার আলী বলেন, ‘শোনো রিতুর মা, এখন আর আগের যুগ নেই। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে জ্ঞান-বুদ্ধি বেশি হয়।’
    `এখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে কেন?’
    `শোনো, তুমি এখনও আমাদের মেয়ের মেধা সম্পর্কে ধারণা করতে পারছ না। আমি আমার অফিসের স্যারের সাথে ওকে নিয়ে অনেক কথা বলেছি। তুমি কি মনে করেছ ডিগ্রি পড়তে পড়তে আমি ওর বিয়ে দিয়ে দিব? কখনোই না। ও এমএ পাস করবে। বিসিএস পাসও করবে। তারপরে সরকারি অফিসে অফিসারের চাকরি করবে।’
    `তো অনার্স পর্যন্ত এখানেই পড়। এমএ পড়ার জন্য ঢাকা বা রাজশাহী যাবে?’
    `না। এখন এমন একটা যুগ এসেছে, বড়ো শহর, বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লে শুধু পড়াশোনা করে সুবিধা করা যায় না। তুমি খরচের কথা ভাবছ তো? আমার বাপের জমি পেয়েছি না? ও থেকে কিছু বিক্রি করে দিব।’
    রিতুর মা জানেন এই মানুষটা মেয়ে দুটোকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন। মেয়েদের ব্যাপারে তিনি যা ভাবেন, সেটাই চূড়ান্ত- এর হেরফের হবে না। তিনি চুপ করে যান।
    দশ বছর মেয়াদি একটা ডিপিএস এর সাত বছর পূর্ণ হয়েছিল। রিতুর মাকে না জানিয়ে হায়দার আলী সেটা ভাঙিয়ে হাজার পঞ্চাশেক টাকা পেলেন। মেয়েকে নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করলেন মাসব্যাপী। রাজশাহী, কুষ্টিয়া, খুলনা, ঢাকা। ভর্তির সুযোগ পেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতি বিভাগে। স্যারের কথায় হায়দার আলীর অগাধ আস্থা। তাঁর পরামর্শে সেখানেই মেয়ের ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। এদিকে যাতায়াত খরচ, হোটেল ভাড়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ফরম কেনা নানা কাজে ডিপিএস ভাঙিয়ে যে টাকা পেয়েছিলেন তার পুরোটাই শেষ। ভর্তি ফি, হলে থাকার ব্যবস্থা, কিছু কাপড়-চোপড় এসব ব্যবস্থা করতে ব্যাংকে তাঁর স্বল্প সঞ্চয়ও শেষ হয়ে গেল। এবারে তিনি ভাইদের সাথে রফা করে তাঁর ভাগের সবটুকু জমি বিক্রি করে দিলেন। টাকাটা ব্যাংকে ত্রৈমাসিক সঞ্চয়ী হিসাবে রাখলেন। তবুও হায়দার আলী খুশি। তাঁর বংশে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি। যত কষ্টই হোক মেয়েকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন। মেয়ে ঠিকই সরকারি অফিসার হবে। গোটা জীবন তিনি অন্য মানুষকে স্যার স্যার করে তাঁদের হুকুম তামিল করেছেন। তাঁর মেয়ে যখন সরকারি অফিসার হবে, তখন পুরুষ মানুষ পর্যন্ত মেয়েকে স্যার স্যার করবে।
    বাবার সীমিত সামর্থ্যরে কথা চিন্তা করে রিতু প্রথম মাস থেকেই একটা টিউশনির খোঁজ শুরু করল। কিছুদিনের মধ্যেই সে বুঝল, এ শহরে টিউশনির বাজার বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রদের দখলে। এক বাসায় ইংলিশ মিডিয়ামের দুটো ছাত্র/ছাত্রীকে পড়াতে পারলেও বাবার কাছ থেকে টাকা নেয়া লাগত না। কিন্তু মাস দুয়েক চেষ্টা করেও তা যোগাড় করা গেল না। অবশেষে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের পাতায় দেখে মোহাম্মদপুরে বাংলা মিডিয়ামের প্রাথমিক পর্যায়ের দুই বোনকে পড়ানোর সুযোগ পেল। পড়াতে হবে সপ্তাহে তিন দিন। পরিবারটি বেশ রক্ষণশীল। তাই তারা মেয়ে গৃহশিক্ষক খোঁজ করছিল। সাথে সাথেই বাবাকে ফোন করে জানাল। কণ্ঠস্বর তখন তার এমনই যেন সে সরকারি চাকরি পেয়ে গেছে। বাবা বললেন, ‘কী দরকার ছিল, আমিতো চালিয়ে নিচ্ছিলাম-রে মা। তোর পড়াশোনার ক্ষতি হবে নাতো?’ হায়দার আলী কোনোদিন মেয়েদেরকে ‘মা’ ডাক ছাড়া নাম ধরে ডাকেননি। রিতু বাবাকে আশ্বস্ত করল, ‘না বাবা, তোমার মেয়ে তোমার আশা পূর্ণ করবে। তুমি মোটেও চিন্তা করো না।’
    হলজীবনে রিতু অনেক ঘটনার সাথেই পরিচিত হয়। লেখাপড়ার ক্ষতি হতে পারে এমন সবকিছুই সে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তবে মাঝেমধ্যেই মিছিলে যেতে হয়। সকলের সাথে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিতে হয়। না করে কী করবে? ওদেরকে ছাড়া হলে সিট পাওয়া যেত না। বাইরে মেসে থাকার খরচ যোগান দেয়া তার বাবার পক্ষে অসম্ভব। হলে রাতের বেলা ঘণ্টাখানেক মিছিল করতে হলেও লেখাপড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল করতে তার একেবারেই ইচ্ছে করে না। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ সময়ই পারে না। আর এক কাহিনি। ধাড়ি ধাড়ি ছেলেমেয়ে জন্মদিন উদযাপন করে। বিশেষ করে নেতা-নেত্রীর চ্যালাগুলো ধুমধাম করে জন্মদিন উদযাপন করে। ধনী পরিবারের মেয়েগুলোও জন্মদিন উদযাপন করে। তবে তা নিয়ে হলে খুব বেশি হৈচৈ হয় না। এগুলো তার জন্য খুব পীড়াদায়ক। কেননা, জন্মদিনের উপহার কেনা তার জন্য কত যে কষ্ট সে ছাড়া তা অন্য কেউ বুঝবে না। শুনেছে ছোটোকালে তাদের দু’বোনেরও জন্মদিন উদযাপন করা হয়েছে বাড়িতে। ছবিও আছে। কিন্তু বড়ো হওয়ার পরে আর হয়নি। বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিকীতে উপহার দেয়ার কথা দু’বোন চিন্তা করেছে অনেকবার। কিন্তু টাকার অভাবে তা হয়ে ওঠেনি। আর এখন সামান্য পরিচিত নেতা-নেত্রীর জন্মদিনে অন্তত দু’শ টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।
    বড়ো নেতার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে হবে বনানীর এক রেস্টুরেন্টে। হলের সামনে অনেক মটরসাইকেল জড়ো হয়েছে। মেয়েগুলো যে যার মতো একটা মটরসাইকেলে উঠে বসছে। প্রচ- অনিচ্ছা নিয়ে সে দাঁড়িয়ে। নেত্রী বললেন, ‘কী রিতু পরে তো আর কাউকেই পাবে না। তুমি পাভেলের বাইকে উঠে পড়।’ পাভেল একই বর্ষে সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র। শুধু পরিচয়টুকু আছে। দেখে ধনীর ঘরের সন্তান বলেই মনে হয়। ঢাকার বাইরের ছেলে। হলেই থাকে। তারপরেও মটরবাইক হাঁকিয়ে গোটা ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ায়।
    রিতু মটরবাইকে চড়তে একেবারেই অভ্যস্ত না। আর পাভেলের মটরবাইক পুরনো দিনের মটরবাইকের মতো না। পেছনের দিকটা খুব উঁচু। তার ভয়ই লাগছিল। গোটা পথেই মনে হচ্ছিল এই বুঝি সে পড়ে যাবে। এভাবেই গোটা পথ পাড়ি দিয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে যখন পাভেলের মটরবাইক থেকে নামল তখন সন্ধ্যা। এ এলাকাতে রিতু আজই প্রথম এল। সাঁঝের আলো-আঁধারিতে সুউচ্চ, আলোকোজ্জল ভবনগুলোকে তার কাছে স্বপ্নজগতের মতোই লাগছিল। দেখে মনে হয়, ছবিতে দেখা বিদেশি কোনো নগর বুঝি-বা। বাড়ির কথা মনে পড়ে যায় রিতুর। ছোট্টো শহরে সন্ধ্যেবেলায় সড়কে দুপাশের খাম্বার কোনোটাতে বৈদ্যুতিক বাল্ব আছে, কোনোটিতে নেই। দোকানের বাল্বগুলোই বরং রাস্তাকে আলোকিত করে। রাস্তায় অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশার প্যাঁ-পুঁ শব্দ। তার মধ্যে দিয়ে বাবা তার হাত ধরে হেঁটে চলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার জন্য নতুন কাপড় কিনে দেয়ার জন্য। সেদিন বাসায় ফিরে মিতুর জন্য খুব খারাপ লাগছিল। কেননা, বাবা তো দুই সেট সেলোয়ার-কামিজ কিনে দিলেন তার জন্য। মিতুর জন্য কিছু তো কেনা হলো না। পাভেলের কথায় রিতু সম্বিত ফিরে পেল। ‘রিতু তোমার ফোন নম্বরটা দাও। ডিনার শেষে সবাই একসাথে বের হবে। তখন আমারে খুঁজে পাবে না। আমি কল দিব।’
    `পাভেল আমিতো তোমার বাইকে যেতেই চাচ্ছি না।’
    `কেন?’
    `তোমার এই অদ্ভুত বাইকের পিছনে বসে থাকা খুব কষ্টের।’
    `তুমি তো এখন বিশ বছর আগের পুরনো মডেলের বাইক পাবা না। রাতের বেলা যাবে কেমন করে?’
    অনেক দ্বিধা নিয়েও রিতু ফোন নম্বরটা দিল।
    সেদিনের পরে তুমুল আড্ডাবাজ পাভেল মাঝেমধ্যে রিতুকে ফোন দিয়েছে। সামান্য কথা হয়েছে। ক্যাম্পাসে মিছিলের সময় দেখা হয়েছে। তেমন কথা হয়নি। তবে ক্যাম্পাসে মিছিলের দিন দেখা হলেই পাভেলের যেন তাকে মনে পড়ে। সে রাতেই পাভেলের কাছ থেকে রিতু ফোন পায়। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিতুর প্রথম বর্ষ পার হলো। পাভেল রিতুর জন্মদিন জানতে চেয়েছে। রিতুর তা বলতে অনীহা। ‘কেন রিতু? কী সমস্যা?’
    `আমার জন্মদিন দিয়ে তুমি কী করবে?’
    `এমনি। তুমি না বললে আমি রেজিস্টার অফিস থেকে যোগাড় করব। তুমি বিশ্বাস করো যে আমি তা পারব?’
    `একজন আর একজনের জন্মদিন জানতে চায় ভালো মন নিয়ে। তুমি আমাকে হুমকি দিয়ে তা জানতে চাচ্ছ। এটা আমি ভালোভাবে নিচ্ছি না।’
    `সরি রিতু। সময়মতো জানিয়ে দিও।’ বলে পাভেল মটরবাইকে স্টার্ট দিয়ে চলে গিয়েছে।
    সেদিন রাতে রিতু এসএমএস করে জানিয়ে দিয়েছে। এখনও নয় মাস পরে তার জন্মদিন। রিতুর ধারণা পাভেল তার জন্মদিনে উইশ করতে চায়।
    নয় মাস পরে নিজের জন্মদিনে সকাল নয়টার দিকে হল থেকে বের হতেই রিতু দেখে পাভেল হলগেটে দাঁড়িয়ে আছে। রিতুই এগিয়ে যায়। ‘কী ব্যাপার পাভেল, তুমি সাতসকালে এখানে দাঁড়িয়ে?’ পাভেল কাগজের একটা ছোটো বাক্স এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এর মধ্যে একটা স্মার্ট ফোন আছে। তোমার জন্মদিনের উপহার। আমি চার্জ দিয়ে রেখেছি। ফেসবুক, ই-মেইল সবকিছু ইনস্টল করা আছে। ব্যবহার করতে সমস্যা হলে রাতে ফোন দিও।’ পাভেল রিতুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মটরবাইকে উচ্চশব্দ তুলে চলে গেল। রিতু বেশ বিব্রত। স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে তার মন চায়। কিন্তু এভাবে অন্যের কাছ থেকে সেটা পাবে তা তার ধারণায় ছিল না, এমনটি সে আশাও করে না।
    এর পরে বছর গড়িয়েছে। পাভেলের সাথে রিতুর ঘনিষ্ঠতা আরও কিছুটা বেড়েছে। পাভেলের পক্ষ থেকে রিতুর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টায় ঘাটতি নেই। কিন্তু রিতুর জীবনযুদ্ধ এসব তেমন একটা ভাবায় না। সকালে উঠে পড়ার ফাঁকে রান্না, ক্লাস, টিউশনিতে যাওয়া, সন্ধ্যার আগে হলে ফেরা, আবারও রান্নার ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা তাকে অন্য কিছু ভাবতে তেমন সময়ও দেয় না। তবুও পাভেল তার পেছনে লেগে আছে। সে বুঝে। কিন্তু রিতুর ব্যক্তিত্বের কাছে পাভেল খুব বেশি এগুতেও পারে না।
    তৃতীয় বর্ষের শুরুতে কয়েকদিন ক্লাস করেই একদিন রিতুর জ্বর এল। শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উচ্চমাত্রায় জ্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার থেকে ঔষধ নিল। তিনদিন পরেও জ্বর ছাড়ে না। মেডিকেল সেন্টারের ডাক্তার এলেন হলে হাউস টিউটরের কক্ষে। রিতুর জ্বর প্রবল। গোটা শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা। দুই চোখের কোণ যেন রক্তলাল। ডাক্তার সাহেব রিতুকে হাসপাতালে ভর্তির সুপারিশ করে চলে গেলেন।
    রিতুর বন্ধু-বান্ধবীরা গ্রিন রোডের একটি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করল। রিতু কোনোদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে যে অগ্রিম টাকা দিতে হয় তা তার জানাও নেই। আর সে তখন প্রায় বেহুঁশ। পাভেলই অগ্রিম টাকা জমা দিল। তার বাবাকে খবর দেয়া হলো। বাবা পরদিন বিকেলে এসে হাজির, সাথে মা। তিন দিন পর হাসপাতাল ছাড়ার পালা রিতুর। পাভেল অগ্রিম কুড়ি হাজার টাকা জমা দিয়েছিল। হাসপাতালের বিল হয়েছে মোট চল্লিশ হাজার টাকা। ঢাকা শহরের বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় সম্পর্কে রিতুর বাবার তো কোনো ধারণাই নেই। তিনি এনেছেন দশ হাজার টাকা। আর এর চেয়ে বেশি টাকা তার পক্ষে একদিনের নোটিশে যোগাড় করা সম্ভবও ছিল না। পাভেলই বাকি টাকার ব্যবস্থা করল। বেশ কদিন হাসপাতালবাসের পরে রিতু হলে ফিরতে পারল। বাবা হলের ভেতরে ঢুকতে না পারলেও মা হলে ঢুকে দেখে গেলেন মেয়ের আবাসস্থল। রিতুর বান্ধবীরা মাকে আশ্বস্ত করল, তারা সাথে আছে রিতুর খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
    সেই থেকে রিতু পাভেলের প্রতি দুর্বল। সুস্থ হয়ে রিতু পাভেলকে অনেকবার বলেছে, সে একবারে পারবে না, কয়েক দফায় টাকাটা দিয়ে দিতে চায়। কিন্তু পাভেলের এক কথা, ‘আমার কাছে থাকলে খরচ হয়ে যাবে। টাকাটা রেখে দাও। দরকার হলে আমিই চেয়ে নিব। বারবার এক কথা বোলো না তো।’
    পাভেলের সাথে রিতুর দেখাসাক্ষাত ঘন ঘন নয়, দৈনিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। রিতু পাভেলের মটরবাইকে উঠতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রায় দিনই সে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত পাভেলের মটরবাইকে যায়, কোনোদিন ফেরেও। অন্তরঙ্গতা থেকে এই বয়সে যা হওয়ার তাই হলো। দিনের দেখাতেও কথা শেষ হয় না। রাতে মোবাইল ফোনে ঘণ্টাখানেক কথা। তবেই শোয়া। হলের সকলে জেনেও গেছে। রিতুর বাহ্যিক পরিবর্তনে অনেকে টিপ্পনীও কাটে। ও এখন আর সেই প্রথম বর্ষের মেয়েটি নেই। ঢোলা সেলোয়ারের পরিবর্তে জিনস এর প্যান্ট পরে। মাঝে মাঝে কড়া মেকআপও নেয়। চুল ছোটো করে ছেঁটেছে। তবে পড়াশোনায় মনোযোগের ঘাটতি নেই।
    দেখতে দেখতে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলে এল। পড়াশোনায় মনোযোগী হলো রিতু। পরীক্ষার এক মাস টিউশনি অফ করল। রাতে ফোনালাপও সংক্ষিপ্ত করল। রান্না করে খাওয়াও বন্ধ করল। পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফলের ব্যাপারে সে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। পরীক্ষার ফলাফল জানা মাত্রই মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বাবাকে ফোন করল। বাবা তখন অফিসে। ফলাফল জানাল প্রিয় বাবাকে। এর পরে বাড়িতে মায়ের সাথে কথা বলল, আরও কথা বলল মিতুর সাথে। হায়দার আলী এক রকম দৌড়ে স্যারের ঘরে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকে মেয়ের ফলাফল জানালেন, ‘স্যার এখন তো ফার্স্ট ক্লাস সিস্টেম নেই। ও পেয়েছে ৩.৮। এটা কি স্যার ফার্স্ট ক্লাস এর সমান?’
    `আরে বলেন কী হায়দার সাহেব। ফার্স্ট ক্লাস এর মধ্যেও খুব ভালো।’
    `স্যার, আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার সীমা-পরিসীমা নাই।’
    `কেন হায়দার সাহেব? টাকা দিলেন আপনি। পড়াশোনা করল আপনার মেয়ে। আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা কেন?’
    `আপনি উৎসাহ না দিলে আমি যে সাহসই পেতাম না। ও কি এখন বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারবে স্যার?’
    `হ্যাঁ, পারবে বৈকি। তবে মাস্টার্সেও ভর্তি হতে বলেন। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে বলেন। দুটোই চলবে একসাথে।’
    হায়দার আলী বাসায় ফিরলেন দু’রকম মিষ্টি নিয়ে। চিৎকার করে বললেন, ‘আমি বলেছিলাম না, আমার মেয়ে সরকারি অফিসার হবে। শুনেছ মেয়ের ফলাফলের কথা? ও-তো ফার্স্ট ক্লাস এর মধ্যেও ওপরের সারিতে আছে।’ সে রাতে বহুদিন পরে বাসায় মোরগ-পোলাও রান্না হলো। হায়দার আলী চোখ মুছতে মুছতেই তা খেলেন।
    পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দলবেধে কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তাবে রিতু না করতে পারল না। প্রথমে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে। বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের পাসপোর্ট না থাকা ও খরচ বেশি হবে, এসব বিবেচনায় তা বাতিল হয়ে গেল। অবশেষে কক্সবাজারেই যাওয়া হলো। রিতু বাবা-মাকে জানাতে ভুল করেনি। একই ব্যাচের অনেক ছেলেমেয়ে একসাথে যাচ্ছে জেনে হায়দার আলী আপত্তি করেননি। যদিও মায়ের প্রবল আপত্তি ছিল। কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় যাওয়া হলো না। তিন দিনের ঘোরাঘুরি কক্সবাজার ও টেকনাফেই সীমাবদ্ধ থাকল। অসুস্থতার অজুহাতে পাভেল ও রিতু দু’দিনই হোটেলে থেকে গেল। রিতুর মোটেও ইচ্ছা ছিল না। সে কখনোই ভাবেনি। কিন্তু পাভেল নাছোড়বান্দা। ‘তাহলে তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?’
    `অবশ্যই করি পাভেল। কিন্তু যখনকার কাজ তখনই করতে হবে, আগেও না পরেও না।’
    `এটা কোন বই এ লেখা আছে?’
    `এটা আমার আত্মবোধ। কোথায় কোন বইয়ে লেখা আছে সেটা এখন নাইবা বললাম। কেননা সেটা তোমার কাছে যে বিবেচ্য নয় তা বেশ বুঝতে পারছি।’

    `ঠিক আছে রিতু আমি এখনই ঢাকায় চলে যাব। তুমি তোমার ঘরে বিশ্রাম করো। ওরা যথাসময়ে চলে আসবে।’
    `এটা তুমি কী বলো পাভেল?’
    `হ্যাঁ, রিতু ঢাকায় আমার জরুরি কাজ আছে। যেতেই হবে।’
    রিতু আত্মবিসর্জন দিল। এর পরে ঢাকায় এসে অনেকটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে পাভেল রিতুর মেলামেশা। প্রথমদিকে রিতুর খারাপ লেগেছে। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। ক্লাস, পড়াশোনা কোনো কিছুতেই রিতুর কোনো ঘাটতি নেই। বরং এখন মিছিল-এ যায় না। তেমন কোনো চাপও আসে না। হঠাৎ করেই রিতু শরীরে পরিবর্তন অনুভব করল। পাভেলকে জানাল। ও বলল, এত চিন্তা কোরো না। আমি তো আছিই। আমি সবসময়ই সাবধানতা অবলম্বন করেছি। রিতুর পাশে বসেই নেটে খোঁজাখুঁজি করে বলল, এ ধরনের পরিস্থিতি হতেই পারে। আর কয়েকটা দিন অন্তত ধৈর্য ধরো। আগেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যেতে হবে না। আরও দশদিন পার হওয়ার পরে রিতু পাভেলকে বলল, আমি চা খেতে থাকি। তুমি মটরবাইকে টান দিয়ে ফার্মেসি থেকে দুই সেট কুইকটেস্ট কিট নিয়ে এস। আমি আর বিলম্ব করতে রাজি না। পাভেল এনে দিল। কী হবে কাল যদি ফলাফল হয় পজিটিভ? মস্তিষ্কের নিউরণগুলো বুঝি-বা বিদ্রোহ করছে। মাথার আর্টারিগুলো মনে হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে। চিন্তা করতেও অক্ষম হয়ে পড়ে সে। রাতটা কাটল রিতুর প্রায় নির্ঘুম।
    পরদিন সকালে রিতু দুটো কিট ব্যবহার করে নিজেই পরীক্ষা করল। দুটো সেটে একই ফলাফল। সবুজ দাগ দেখা যাচ্ছে। রিতু তখনও সকালের নাস্তা করেনি। বাথরুমের মেঝে কেঁপে উঠল যেন। মনে হচ্ছে গলার কাছে বড়ো একটা কিছু দলা পাকিয়ে রয়েছে। নিজের পেটের দিকে তাকাল। সমস্ত গা গুলিয়ে উঠল। নিজের প্রতি নিজের ঘেন্না চলে এল। এমনটি সে কোনোদিন অনুভব করেনি। মনে হচ্ছে যেন গলা থেকে তরল অগ্নি কণ্ঠনালী বেয়ে নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ছে সমগ্র শরীরে, আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা যেভাবে দ্রুতলয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে সবকিছুকে গ্রাস করে নেয়। টলতে টলতে সে ঘরে গিয়ে বিস্কুট খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করে। ক্যান্টিনে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তার নেই। মোবাইলটা তুলে নেয় হাতে। পাভেলকে ম্যাসেজ দেয়, ‘আই অ্যাম ‘পি’। রেজাল্ট ইন বোথ স্ট্রিপ ইজ সেম। কান্ট থিংক এনিথিং। মাই ফোন উইল বি সুইচড অফ। কুড নট স্লিপ লাস্ট নাইট। উইল গেট স্লিপ নাও। প্লিজ কাম টু দ্য হলগেট অ্যাট আফটারনুন।’ ঘুম ভাঙে একটার দিকে। মনে হলো গোসল করে শুচিশুদ্ধ হবে সে। তারপরে ক্যান্টিনে খেতে যাবে। নাহ। গোসল করেও নিজেকে শুচিশুদ্ধ মনে হচ্ছে না। খেতে বসেও ঘেন্নায় বমি উঠে আসছে। নিজ পেটের ভ্রূণটির সাথে ভাত মিশে যাচ্ছে নাতো? আধপেটা খেয়ে উঠে আসে ঘরে। ঘড়ির কাঁটা যেন ইচ্ছে করে ধীর গতিতে চলছে। বিকেল হতে চায় না। পাভেল না আসা পর্যন্ত কিছুই ভালো লাগছে না। কোনো চিন্তাও করতে পারছে না। যেন কত শত ঘণ্টা পর বিকেল হলো। হল গেটে যেতেই পাভেলও এসে পৌঁছল। আজ ওরা সকলের থেকে একটু দূরেই গাছের আড়ালে বসল। রিতুর মুখে কোনো কথা নেই। যেন কোনো এক দুর্ঘটনায় বাকশক্তি হারিয়েছে। পাভেল বলল, ‘রিতু ভেঙে পড়ো না। আমি আছি।’ পাভেলের কথা শুনে আষাঢ়ের আকাশে যেন বান ডাকল। রিতু দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠল।
    পাভেলেরও দিনটা ভালো কাটেনি। প্রায় মাসখানেক হলো তার মা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি নামি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দীর্ঘ এক মাসের চিকিৎসাতেও তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায় তার বাবা বেশ কদিন আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিদেশে যাবেন। আগামী পরশু তার মায়ের বিদেশে যাওয়ার কথা। তাকে সাথে যেতে হবে। মাঝে একটা দিন মাত্র। রিতু ফোন করতে নিষেধ করায় সে ফোন করেনি বটে। কিন্তু সারাটি দিন উদভ্রান্তের মতো এখানে সেখানে গিয়ে মনটাকে থিতু করতে চেয়েছে। পারেনি। রিতু যেভাবে কাঁদছে কী বলে সান্ত¡না দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মনে হলো রিতু কিছুক্ষণ কাঁদুক। এই মুহূর্তে বাধা দেয়া উচিত না। পরক্ষণেই মনে হলো নাহ, রিতু তাকে ভুল বুঝতে পারে। দ্বিধা-সঙ্কোচ নিয়েই পাভেল বলল, ‘রিতু কালই তোমাকে কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যাব। তুমি ভেঙে পড়ো না। সমস্যা হয়ে গেছে। এখনতো সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমি আছি, কেঁদো না প্লিজ।’
    ‘তুমি তো কাল বাদে পরশু বিদেশে যাচ্ছ। একদিনে কি ঐ কাজ হয়?’
    পাভেলও জানে একদিনে হবে না। সেও চুপ হয়ে গেল। তিনজন মানুষের বিমানের টিকেট কেনা আছে। ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট নেয়া আছে, হোটেল বুকিং দেয়া আছে। বাবার বয়স হয়েছে। উনি একা সামলাতে পারবেন না। কী করা? হঠাৎই রিতু ঝাটকা মেরে বলে উঠল, ‘আমি তো এসব চেয়েছিলাম না। তুমি ব্রেকআপের ভয় দেখিয়ে আমাকে প্যাঁচে ফেলেছিলে কক্সবাজারে।’
    পাভেল রিতুকে সত্যি ভালোবাসে। তার মনে হলো, এই মুহূর্তে তাকে কথা বলতে দেয়া উচিত। বলুক, যা ইচ্ছে তাই।
    পরদিন ধানমন্ডির একটা ক্লিনিকে গেল দু’জনে। গাইনি বিভাগে। চিকিৎসক ‘পি টেস্ট’ করে আগামীকাল দেখা করতে বললেন। রিতু তো জানেই ফলাফল পজিটিভ আসবে। পরদিন তো পাভেল পিতামাতার সাথে উড়াল দিয়েছে। রিতু একাই গেল। চিকিৎসক বললেন, ‘আপনার হাজবেন্ডকে আজ দেখছি না যে?’

    ‘জি, ও অফিসের কাজে দেশের বাইরে গিয়েছে।’

    ‘ঠিক আছে। আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি। আপনার হাজবেন্ড আসলে আলট্রাসনোগ্রাম করে যাবেন।’
    ‘ম্যাডাম একটা কথা বলতে চাই।’
    ‘বলুন।’
    ‘আমরা তো এখন বেবি নিতে চাই না।’
    ‘তাহলে আগে সাবধান হলেন না কেন? প্রথমবারের মতো কনসিভ করেছেন। ইচ্ছে করে প্রথমবারেই অ্যাবরশান করতে হয় না। সারাজীবন আফসোস করা লাগতে পারে। তাছাড়া এখন আপনার প্রায় তিন মাস। এখন এটা করা ঝুঁকিপূর্ণ। আর এই হাসপাতালে সেটা হবেও না। অখ্যাত-অজ্ঞাত ক্লিনিকে যেতে পারেন। সরি।’
    সে রাতেই রিতু ম্যাসেঞ্জারে পাভেলকে সব জানাল। পাভেল বলল, ‘আমি তো এখানে এক মাসের জন্য এসেছি। চিন্তা করো না। বাবাকে আমি বুঝিয়েছি পরীক্ষার কথা বলে। আমি এক সপ্তাহের মধ্যে আসছি। আমার পরিবর্তে এক খালাত ভাইকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। ও ভিসা আবেদন করেছে। ভিসা হয়ে গেলেই ও চলে আসবে।’ পাভেলের মায়ের অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এখানকার ডাক্তার অপারেশনের আগে সময় নিয়েছেন দশ দিন, পনেরো দিনও হতে পারে।
    বাড়ির সকলকে যেন দেখা যায়, সে জন্য রিতু টিউশনির টাকা দিয়ে একটা অ্যানড্রয়েড ফোন কিনে দিয়েছে বাবাকে। প্রতিদিন রাত দশটায় পরিবারের সকলের সাথে কথা হয়, দেখাও হয়। ‘রিতুকে দেখেই হায়দার আলী বললেন, ‘কিরে মা তোর চেহারা এমন হয়েছে কেন? কালই বলতে চেয়েছিলাম, বলিনি। সত্যি করে বল কোনো সমস্যা হয়েছে?’
    ‘বাবা পড়াশোনার চাপ যাচ্ছে খুব। নেটওয়ার্ক বোধ হয় ভালো না। আমিও তোমাকে ভালো দেখতে পাচ্ছি না।’
    ‘কিন্তু নেটওয়ার্ক কি প্রতিদিন খারাপ থাকেরে মা? বাবা-মায়ের চোখকে সন্তান ফাঁকি দিতে পারে না এটা বুঝিস না কেন?’‘দুদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে বাবা। পড়াশোনা একটু কমিয়ে দিব।’ রিতু আরও গভীর চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়ে। অ্যাবোরশানের দিন কিংবা পরেও কয়েকদিন বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া যায় কিভাবে? অসুস্থ বললে তো বাবা ছুটে আসবে। তাকে কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না।
    কদিন ঘোরাঘুরি করে রিতু দুটো ছোটো ক্লিনিক খুঁজে বের করেছে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে এখানে এমআর ও ডিঅ্যান্ডসি করা হয়।’ সাতদিনের দিন পাভেল জানাল আর কটা দিন দেরি কর। আমার ভাইটা এখনও ভিসা পায়নি। আর মায়ের অবস্থাও বেশ খারাপ। এক সপ্তাহ মাত্র ‘জান’। রিতু সিদ্ধান্ত নিল সে একাই যাবে। পাভেলের এখন দেশে আসা অনিশ্চিত। সে আর দেরী করতে চায না।
    রিতু বিকেলবেলা মোহাম্মদপুরে চিহ্নিত একটা ক্লিনিকে গেল। ছোটো একতলা বাড়িতে ক্লিনিক। সিস্টারদের চাহনি দেখে কেমন যেন মনে হয়। একজন নারী ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাম করলেন। তিনি বললেন, আপনারতো তিন মাস চলছে। সাথে অভিভাবকও নেই। হাঁ। আমরা এ রকমের অভিভাবকহীন রোগীর গর্ভপাতও করি। ফি লাগবে দশ হাজার টাকা। এখানে এক রাত থাকা লাগবে। আপনার শরীরতো দুর্বল। এক রাতের বেশি থাকতে হলে প্রতি রাতের জন্য দুই হাজার টাকা দেয়া লাগবে। আপনার স্বামী, পিতা, মা ছাড়া এটা করতে হলে আপনাকে বন্ড সই করতে হবে। রিতুর পৃথিবী আবারও দুলে উঠল। পনের কিংবা বিশ হাজার টাকা লাগতে পারে। এত টাকা তার কাছে নেই। আর কোনো দুর্ঘটনা হয়ে গেলে, সে যদি মারাই যায়, তাহলে বাবা-মায়ের জন্য তা হবে ভয়ঙ্কর লজ্জার ব্যাপার। তার মনে হলো, বেশি চিন্তা করাটাই হবে পাগলামি। পাভেল এখন নাগালের বাইরে। সমস্যার সমাধান করে ফেলতেই হবে। মুহূর্তের মধ্যে সে ভিন্ন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে বলল, ‘ঠিক আছে। আমার স্বামী কয়েকদিনের মধ্যেই এসে পড়বে। তাকে সাথে করেই নিয়ে আসব। আমার ঘুমের খুব সমস্যা হচ্ছে। অনেক দিনের সমস্যা। ঘুম আসতে চায় না রাতে। ভোরে ঘুম আসে। ক্লাস ধরতে অসুবিধা হয়, কোনো কোনো দিন পারিও না। আমি কি ঘুমের কোনো ঔষধ খেতে পারি?’
    ‘এ সময় ঘুমের ঔষধ দেয়া হয় না। আপনি যেহেতু গর্ভপাত করবেনই সে কারণে ঔষধের নাম লিখে দিচ্ছি। আপনি কি ঘুমের ঔষধ খেয়েছেন কোনোদিন?’
    ‘জি, ডায়াজিপাম গ্রুপের ঔষধ খেয়েছি। কাজ হয় না।’
    ‘এই বয়সে ঘুমের ঔষধ তো কারোর প্রয়োজনই হওয়ার কথা না। আর আপনি কিনা বলছেন ঔষধে কাজ হয় না। চিকিৎসক প্যাডের একটা কাগজ টেনে নিয়ে ঔষধের নাম লিখে দিলেন। বললেন, ‘দু’ তিন দিন খেয়ে দেখেন। কাজ অবশ্যই হবে। ঘুম হলে আর খাবেন না। কন্টিনিউ করলে অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়বেন।’’
    রিতু ঔষধ কিনে আজ একটু আরাম করেই সিএনজি অটোরিকশায় করে হলে ফিরল।
    রাতে বাড়িতে কথা বলার আগে খুব ভালো করে মুখ ধুয়ে, চুল বেঁধে, হালকা প্রসাধনী মেখে তবেই ফোন করল। সকলের সাথে কথা বলল। ইচ্ছে করেই রাতে খায়নি আজ সে। পাভেলকে টেক্স্ট করল, ‘আই কুড মেক দ্য সিচুয়েশন ডিফিকাল্ট ফর ইউ। বাট নট ডুয়িং ইট। বাই।’
    রাত এগারোটা বাজে। তার রুমমেট বেশ কদিন হলো হলে থাকে না। বাবা-মা এসেছে খালার বাসায়। সেখানেই আছে ও। পেটের মধ্যে চোঁ চোঁ করছে। হাঁ। এটাই নির্ভরযোগ্য সময়। দুই গ্লাস পানি নিয়ে বসল। না দুই গ্লাস লাগল না। এক গ্লাসের পানি দিয়েই ষোলোটা ট্যাবলেট খেয়ে নিল। বমি আসছে। শুয়ে পড়ল।
    পরদিন সকালে রিতুর ঘরের দরজা বন্ধ। বেলা হলে পাশের ঘরের মেয়েরা টোকা দিয়েছে। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেলা একটা নাগাদ হল সুপারের উপস্থিতিতে দরোজা ভাঙা হলো। বিছানায় রিতু শুয়ে আছে। মেয়েরা ডাকাডাকি করল। রিতুর ঘুম ভাঙে না। হল সুপার রিতুর হাতের পালস্ দেখলেন। হায় হায়, ওর শরীর ঠান্ডা। পালস্ নেই। এখনই পুলিশে খবর দিতে হবে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১১ জুন ২০২০ | ১২৬৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    এসো - Rashmita Das
    আরও পড়ুন
    এসো - Rashmita Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন