এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  NRC/CAA

  • এই দুনিয়ার সকল ভাল, আসল ভাল, নকল ভাল, ডিটেনশন সেন্টারও ভাল

    জয়ন্ত ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | NRC/CAA | ১২ জানুয়ারি ২০২০ | ১৬৫৬ বার পঠিত
  • এ এক অদ্ভুত শিউড়ে ওঠা সময়ের কাহিনী। আমরা সেই সময় অতিবাহিত করছি যখন আমাদের মনে পড়ে যায়
    “পিচ্ছিল নেপথ্যে আজও রয়েছে মানুষ –
    একা – নরক দর্শন করে,
    তবু অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়;
    রক্ত মানস কর্দমের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, নদী সাঁতরিয়ে
    নরক উত্তীর্ণ হতে ক্লান্তিহীন যাত্রা তার”।

    আমাদের প্রধানমন্ত্রী তামাম ভারতবাসীকে স্বস্তিবচন শুনিয়েছেন যে ভারতে কোন ডিটেনশন সেন্টার নেই। ফলে প্রায় কুড়ি লক্ষ আসামবাসী বা ভারতবাসী (অন্ততঃ এতদিন অব্দি এ কথাই জানতো) যে ডিটেনশন সেন্টারে যাবার দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছে তাদের আর যাবার প্রয়োজন নেই। অন্ততঃ এমনটাইতো মনে হয় এরকম স্বস্তিবচন শুনে। আমরা তো বিশ্বাসী জনতা, বিশ্বাস করে বুকে বল পাই, দেহের মাঝে কিরকম একটা বাহুবলী ধরণের অ্যড্রেনালিন-সঞ্জাত অনুভূতি প্রবাহিত হতে শুরু করে। আমাদের বুকে হিল্লোল ওঠে –
    “হাসছি মোরা হাসছি দেখ,
    হাসছি মোরা আহ্লাদী,
    তিনজনেতে জটলা ক’রে
    ফোকলা হাসির পাল্লা দি।
    হাসতে হাসতে আসছে দাদা,
    আসছি আমি, আসছে ভাই,
    হাসছি কেন কেউ জানে না,
    পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই।”

    এরকম হাসি নিয়ে ভরসা করেই তো স্বাধীনতার তথা সাম্প্রদায়িকতায় বিক্ষত দেশভাগের ৭২ বছর পরেও পরম নিশ্চিন্তে বেঁচেই আছি। আমরা রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে সর্বত্র ভরসাকে খুঁজে বেড়াই –
    “আমরা তো এতেই খুশি ;
    বলো আর অধিক কে চায়?
    হেসে খেলে,
    কষ্ট করে আমাদের দিন চলে যায়”।

    অবশ্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সমস্ত বড়ো সংবাদপত্র ও মাধ্যমের খবর অনুযায়ী আসামে এই মুহূর্তে ৬টি ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হয়েছে বিভিন্ন জেলের মধ্যে – গোয়ালপাড়া, কোকরাঝার, তেজপু্‌র, ডিব্রুগর আর শিলচরে। যদি না-ডিটেনশন সেণ্টার-কে সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলে হিসেব বলছে এই কারাগারের দেয়াল ২২ ফুট উঁচু, কংক্রিটের তৈরি। প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের হঠাৎ করে না-নাগরিকের না-ভোটার হয়ে যাবার পরেও, কয়েকহাজার মানুষের ডিটেনশন সেন্টারে যাত্রার পরেও আমরা আমাদের সংশয় অতিক্রম করে আমরা বিশ্বাস করে শান্তি পাচ্ছি এই জেনে যে ভারতে কোন ডিটেনশন সেন্টার নেই, মন্ত্রীসভায় কোনদিন এনআরসি নিয়ে আলোচনা হয়নি। আমরা ভীরু, নিরুপদ্রব, নিরীহ গোবেচারা গোছের সব স্তরের বা দরিদ্র মধ্যবিত্ত মানুষ। সর্বশক্তিমানদের কথায় অবিশ্বাস করে আমাদের লাভ কি? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হল – “আমরা তো সামান্য লোক / আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক”। যদিও ৫.০১.২০২০ অব্দি সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ২৯জন “সামান্য লোক” শুধু না-নাগরিক/না-ভোটার হবার কারণে না-ডিটেনশন সেন্টারে মারা গিয়েছে।

    আমাদের কথা ভেবেইতো শঙ্খ ঘোষ (কি মুশকিল! তিনি আবার আমাদের বিবেকের প্রতিনিধিত্বও করছেন ঋজু স্বরে) সেই কবে লিখেছিলেন –
    “পেটের কাছে উঁচিয়ে আছো ছুরি
    কাজেই এখন স্বাধীনমতো ঘুরি
    এখন সবই শান্ত, সবই ভালো।
    তরল আগুন ভরে পাকস্থলী
    যে-কথাটাই বলাতে চাও বলি
    সত্য এবার হয়েছে জমকালো।

    গলায় যদি ঝুলিয়ে দাও পাথর
    হালকা হাওয়ায় গন্ধ সে তো আতর
    তাই নিয়ে যাই অবাধ জলস্রোতে–”

    সন্ত্রাস, ত্রাস এসমস্ত উস্কানিমূলক অবান্তর কথাবার্তায় একেবারে আমল দেননি শঙ্খ ঘোষ। নিতান্ত মোলায়েম গলায় আমাদেরকে জানিয়ে দিলেন –

    “নেই কোন সন্ত্রাস
    ত্রাস যদি কেউ বলিস তাদের ঘটবে সর্বনাশ–
    ঘাস বিচালি ঘাস
    ঘাস বিচালি ঘাস।”

    বাস্তবতার আরও কিছু দিক
    ১লা জানুয়াড়ী, ২০২০ – একেবারে বছর শুরুর দিনে – এবারের অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার ডুফলো ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে লিখলেন “CAA, NRC introduce meddlesome officialdom into a question as fundamental as citizenship”। তাঁদের পর্যবেক্ষণে ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন “maximum governance, minimum government” তথা “সর্বাধিক প্রশাসন, ন্যূনতম সরকার”-এর শ্লোগান দিয়ে। সর্বাধিক প্রশাসনের মধ্যে কেউ হয়তো বেন্থামের প্যান-অপ্টিকনের প্রতিধ্বনি শুনতে পান। কিন্তু সেটা বড়ো কথা নয়। কথা হল সরকার জনজীবনে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এবং নাগরিক সমাজে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করবে। কিন্তু প্রশাসন সর্বত্র দেখাশোনা করবে। সে দেখাশোনার একটি অঙ্গই হয়তো আজকের এই পরিস্থিতি। বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডুফলো আরও প্রাঞ্জলভাবে বিষ্যটিকে ব্যাখ্যা করলেন এভাবে – “আমরা যারা সার্ভের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে করতেই জীবন কাটিয়ে দিলাম, তারা জানি যে উত্তরদাতাদের কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া কত কঠিন হতে পারে। আমাদের মনে আছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক বছর কুড়ির মহিলার কথা। তিনি সেখানেই জন্মেছিলেন। “এ গ্রামে নয়”, দক্ষিণ বা পূর্ব দিতে হাত দেখিয়ে “ওই দিকে, দু-এক ঘণ্টা দূরে।” আপনি এখানে এলেন কী করে? “আমার মা ছিল পাশের গ্রামের, মায়ের বিয়ে হয়েছিল যে গ্রামে আমি জন্মেছিলাম, সেইখানে। কিন্তু আমার বাবা আবার বিয়ে করে, আমাদের বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেয়। আমার বয়স তখন ছয় কিংবা আট। আমরা আমাদের গ্রামে ফেরত যাই, কিন্তু আমাদের মামারা আমাদের নিতে চায়নি। শেষে এ গ্রামের এক মহিলা আমাদের একটা ঠাঁই দিয়েছিলেন।” গ্রামের নামটা বলতে পারবেন? “মা জানত, কিন্তু মা তো মরে গেছে!” আমরা জন্মস্থানের জায়গায় অজ্ঞাত কোড বসিয়েছিলাম (যদ্দূর মনে পড়ে ৯৯৯৯)। প্রত্যাশা করা হচ্ছে এনআরসির সময়ে নিজের নাগরিকত্বের মর্যাদা স্থির করবার জন্য এই মহিলা তাঁর সম্পর্কে সমস্ত তথ্য দিতে পারবেন। আর যদি তিনি না সেসব তথ্য না দিতে পারেন, তাহলে তো হাতে রইল সিএএ- অভিবাসী, হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও জৈনদের জন্য। মুসলিমদের জন্য নয়।”

    তাহলে এদেশের মাটিতে, বাতাসে, জলে-জমিতে, পাড়ার সবার সাথে বড়ো হয়ে ওঠা মানুষগুলো হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলো যে তারা রাষ্ট্রহীন। কিছু সরকারি আধিকারিক তাদের সর্বশক্তিমান আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা বলে রাষ্ট্রহীনতা নির্ধারণ করে দেবার অধিকারি হল। ওঁরা বলছেন – আমাদের ফিল্ড ওয়ার্ক থেকে আমরা যা শিখেছি, তাতে এ এক ভয়াবহ জুয়া। আরও বললেন – “এর মধ্যে কোনও ন্যূনতম সরকরা বা সর্বোচ্চ প্রশাসনের ব্যাপার নেই। এ হল মানুষের নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার প্রশ্নে অবাঞ্ছিত সরকারি হস্তক্ষেপ। যদি তুমি দেশের নাগরিক না হও, তাহলে এতদিন তুমি কোথায় বাঁচলে? কেউ যদি তোমাকে না চায়, তাহলে তুমি কে? এ প্রশ্নটাই বহু তরুণতরুণীকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে।”

    কিসের ভয় পাচ্ছে সরকার? অনেকে উদ্বাস্তু তথা রাষ্ট্রহীন হলে বাকীদের অর্থনৈতিক সুযোগ, সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ কিংবা ন্যায় বিচারের সুযোগ বাড়বে? অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ বলে এমনটা ঘটেনা। কি ঘটে তাহলে? সে কথা আমরা খানিকটা পরে আলোচনা করবো। ওঁদেরই কথায় - অভিবাসন নিয়ে এই যে প্যারানোইয়া, তা হল এমন এক দৈত্য, যাকে পত্রপাঠ বোতলে ভরে ফেলা উচিত।

    তারপর? ওঁদের বক্তব্য শেষ করছেন – “ভারতের সেই দর্শনকে আলিঙ্গন করা, যেখানে ভারত বহু সভ্যতার জননী। যাঁরা গণতান্ত্রিক, খোলামেলা, সহিষ্ণু, সকলকে গ্রহণ করতে সক্ষম হিসেবে যাঁরা জাতীয় উদ্যোগে যোগ দিয়েছেন, তেমন সকলের জন্য আমরা দরজা খুলে দেব না কেন! কেন দরজা খুলে দেব না পাকিস্তানের নিপীড়িত আহমেদি ও শ্রীলঙ্কার হিন্দুদের জন্য! আমরা ১.৩ বিলিয়ন মানুষ, আর কয়েক মিলিয়ন নিমেষে মিশে যাবে। আমরা সত্যিই সারা বিশ্বের ধ্রুবতারা হয়ে উঠব।”

    এ আশাবাদ ভারতের কোটি কোটি জনতা এখনো হৃদয়ে ধারণ করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। ভারতের তিনটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের – জেএনইউ, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়া মিলিয়া – ছাত্রছাত্রীরা যখন পুলিশের বেধড়ক লাঠির বাড়ি খায়, রক্তাক্ত হয়, অঙ্গহানি ঘটে, যখন উত্তরপ্রদেশের অহিন্দু মানুষ একের পরে এক গুলি খেয়ে মরে যায়, কয়েক হাজার জেলবন্দী হয় নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে, যখন রামচন্দ্র গুহ কিংবা প্রিয়ংকা গান্ধিও বাদ যান না তখন এ আশাবাদ ধারণ করা অসম্ভব এক বাস্তব হয়ে ওঠে।

    একটি সমাজে, বিশেষ করে স্ট্রেসের সময়ে, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য, সুরক্ষার বোধ এবং স্বাধীনভাবে বাঁচার আনন্দ কতকগুলো বিষয়ের ওপরে নির্ভরশীল। গবেষকেরা দেখিয়েছেন একটি social support system বা সামাজিক অবলম্বন দেয় যে সমাজব্যবস্থা তা নির্ভর করে – (১) আবেগময় অবলম্বন, (২) আশার আলো, (৩) পেছনের দিকে না তাকিয়ে সামনে কি সম্পদ আছে তার দিকে তাকানো, (৪) কি কি চ্যালেঞ্জ রয়েছে জীবনে সেগুলোকে খুঁজে বার করা এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম ঠিক করা, (৫) একজন মানবসন্তানকে তার নিজের আভ্যন্তরীন অনুভূতি অকপটে খুলে ধরার পরিসর তৈরি করা, (৬) সামাজিক স্ট্রেসের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য বিকল্প পথের সন্ধান দেওয়া, (৭) বিশেষ মানুষটিকে স্মরণ করানো তার সংকটপূর্ব অস্তিত্বের কথা, এবং (৮) পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেবার জন্য উৎসাহ জোগানো। আমরা একটু তলিয়ে দেখলে বুঝবো এধরনের পদ্ধতিগুলো হয়তো বা এমনকি হিটলারের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ক্ষেত্রেও সত্যি হতে পারে। ইউরোপে মোটের উপরে সমধর্মী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষাকাঠামো, সামাজিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে যারা তাদের ক্ষেত্রে একথাগুলোর তবু কিছু অর্থ থাকতে পারে, কিন্তু আসামের বা ভারতের যেকোন অঞ্চলের দরিদ্র, সামাজিক সুযোগ (entitlements and empowerment) থেকে বঞ্চিত পাঁচমেশালি অবস্থানের মানুষগুলোর ক্ষেত্রে এগুলো কী ভুমিকা পালন করবে? আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইউরোপ প্রায় ২০০ বছর ধরে ধীরে ধীরে নেশন-স্টেট হিসেবে গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে নাগরিক হবার ধারণা, নাগরিকত্বের ধারণা। আমাদের সমাজে এখনো সমূহের শক্তি ও প্রাণোচ্ছলতা (community resilience) ব্যক্তির চাইতে বেশি। এজন্য না-নাগরিকত্ব যে কি সে বিষয়টাই যারা “নিজভূমে পরবাসী” তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনা। সব হারানোর যন্ত্রণা বা suffering-এর মধ্য দিয়ে ভাসাভাসাভাবে বোঝার চেষ্টা করে ভোটার কার্ড দেখিয়ে ভোট দিলেও এবং সরকারের তথা রাষ্ট্রের দেওয়া আধার কার্ড থাকলেও না-ভোটার হয়ে গেল কি করে? তাহলে যে ভোটার কার্ড দিয়ে এখনকার আইন প্রণেতাদের নির্বাচিত করেছিলাম তাহলে তারাও না-ভোটার হয়ে যাবে? ওদের মনে হয়তো প্রশ্ন আসে, আবার মিলিয়েও যায়। ফলে সমগ্র দেশের অধিকাংশ ভারতবাসীর জন্য কি অপেক্ষা করে আছে তা ওরা হয়তো ভেবে উঠতেও পারেনা। গবেষণা দেখিয়েছে, যেমনটা মাইকেল মার্মট তাঁর The Health Gap গ্রন্থে বলছেন, যে যেসব কমিউনিটি তাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পেরেছে এবং সমবেতভাবে ভবিষ্যৎকে নিজেদের মতো করে গড়ে নিতে পেরেছে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক কম।

    ডিটেনশন সেন্টারের মধ্য দিয়ে তো ভারতের এতদিন ধরে তৈরি ভারতীয় সমাজের সমাজবদ্ধতার বিশিষ্টতাই ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে সেখানে আরও অনেক বেশি মানুষ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকবে এটা খুব অপ্রত্যাশিত নয়। এখানে ফ্যাসিস্ট জার্মানি বা ইতালির সাথে ভারতের পার্থক্য। ওখানে racial extermination হয়েছিল – ভারতে তা নয়। এখানে সরাসরি মেরে ফেলা বা নিকেশ করা হচ্ছেনা। এখানে বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করে তোলা হচ্ছে। ঐ দেশগুলোতে রাষ্ট্র তৈরির ঐতিহাসিক মেকনিজমের ফলে কমিউনিটি ভেঙ্গে নাগরিক তৈরি হয়েছে, লক্ষ-কোটি ব্যক্তি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এদেশে নর্মদা বাঁধ তৈরি বা প্যাটেলের মূর্তি বসানোর সময়ে কয়েক লক্ষ মানুষ water refugee হয়েছে। সাংস্কৃতিক, সামাজিক ভূমি থেকে উন্মূল হয়ে গেছে, কিন্তু আসামের মতো (এবং ভবিষ্যতে সমগ্র ভারতবর্ষেই হয়তো) না-ভোটার, দেশের মধ্যে থেকে দেশহারা হয়ে যায়নি। এরকম বাস্তুচ্যুত মানুষদের (যদিও নিজের দেশেই তারা না-ভোটার কিনা PLoS-এর গবেষণাপত্রে আসেনি) অ্যাকাডেমিক পরিভাষায় মিহি করে বলা হয় internally displaced persons (IDPs) বা নিজভূমে পরবাসী মানুষ। মান্য গবেষণা পত্রিকা PLoS-এর এক হিসেবে পাচ্ছি ২০১১ সাল অবধি UNHCR (United Nations High Commissioner for Refugees) গোটা পৃথিবী জুড়ে এরকম ১৫,৬২৮,০৫৭ জন মানুষকে উদ্ধার করেছে। আর ভারতের একটি রাজ্যেই এ সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ। এবং এটা ভারতের নিজস্ব সমস্যা হিসেবে গৃহীত বলেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপের পরিসর আপাতত প্রায় কিছুই নেই। এ এক অনন্যসাধারণ অবস্থা যা ভারতের জনবিন্যাস, সামজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন চিরদিনের মতো বদলে দেবে। আনুগত্য আদায়ের নতুন governance হিসেবে কাজ করবে। এরকম ঘটনা ইউরোপের কোন দেশেই কখনো ঘটেনি। এক নতুন ইতিহাসের জনক এই প্রক্রিয়া।

    হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী হয়েছিলেন মনস্তত্ত্ববিদ চিকিৎসক ভিক্টর ফ্রাংকেল। অদ্ভুতভাবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তও হন গ্যাস চেম্বারে না গিয়ে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন বিখ্যাত গ্রন্থ Man’s Search for Meaning। এ বইয়ে এক জায়গায় বলছেন – “intenfication of inner life helped the prisoner find a refuge from the emptiness, desolation and spiritual poverty of his existence, by letting him escape into the past.” গ্যাস চেম্বারে প্রবেশের আগেও যেখানে ফ্রাংকেল বন্দীদের inner life-কে তীব্র করে বেঁচে থাকার বিশেষ অর্থ তৈরি করতে চেয়েছেন, এবং খানিকটা সফলও হয়েছেন। কিন্তু গোয়ালপাড়া ক্যাম্পের ২৯তম মৃত নির্মল কোচ? তার জীবনের কি অর্থ ছিল তার কাছে, একমাত্র পরিবারের সাথে সহস্র প্রতিকূলতার মাঝেও আনন্দ ভাগ করে নেওয়া ছাড়া! মৃত্যুর পরে একজন না-ভোটার হিসেবে ১৩০-৩২ কোটি ভারতবাসীর মধ্য থেকে খসে গেল মাত্র। আমাদের কিই বা এসে যায়?

    এরকম এক পরিস্থিতিতে ফ্রাংকেল যা বলেছেন বা স্ট্রেসের পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য যে পদ্ধতিগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোই কতটুকুই বা এখানে বাস্তবে কার্যকর? এখানে সঙ্গতভাবেই উল্লেখ করা যায় ফ্রাংকেলের আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা। তিনি যখন প্রথম ক্যাম্পে ঢোকেন তখন আরেক বন্দী তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রতিদিন যেন গাল, মুখ পরিচ্ছন্ন থাকে। রোজ যেন দাঁড়ি কাটেন। কারণ? নাহলে তাঁকে মুসলিমদের মতো দেখাবে – Do you know what you mean by a ‘Moslem’? A man who looks miserable, down and out, sick and emaciated, and who cannot manage hard physical labor any longer ... that is ‘Moslem’. Sooner or later, usually sooner, every ‘Moslem’ goes to the gas chamber. কিমাশ্চরযম! এরকম miserable, emaciated, sick মানুষগুলোও আগে গ্যাস চেম্বারে ঢোকে! কারণ তাদের পরিচয়-চিহ্ন হল দাঁড়ি। এ যেন বর্তমান ভারতবর্ষে পোষাক দিয়ে চেনার মতো ব্যাপার। এবং উভয়ক্ষেত্রেই হতভাগ্য জীবটি ধর্মের দিক থেকে মুসলিম।

    আরেকটা ঘটনার কথা স্মরণ করা যায়। পোল্যান্ডের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন জানুস করজাক (Janus Korczak)। তিনি ৮ জন শিশুকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর হাত থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি সফল হননি। তিনি নিজে তাঁর পরম স্নেহের শিশুদের নিয়ে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যাত্রার ৪ দিন আগে, ১৮ জুলাই, ১৯৪৪-এ শিশুদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের ইংরেজি অনুবাদ The Post Office (হিটলারের জমানায় নিষিদ্ধ ছিল জার্মানিতে) অভিনীত করান। করজাক বলেছিলেন যে এ নাটক অভিনয়ের উদ্দেশ্য ছিল ওই শিশুগুলো যেন ডাকঘরের অমলের মতো আনন্দ নিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে পারে। করজাকের লেখা Ghetto Diary এক সহৃদয় রক্ষী মারফত বাইরে আসে এবং পরে প্রকাশিত হয়। সে ডায়ারিতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে। আমাদের ডিটেনশন সেন্টারের মাঝে এ কাহিনী কোথায় প্রবেশ করবে? এতো ইউরোপীয় “এনলাইটেনড” নাগরিক নয়, অর্ধভুক্ত, হতাশ্বাস, নিঃসহায় প্রায়-অশিক্ষিত জনপিণ্ড!

    এখানে স্বতন্ত্র একটি বিষয় আমাদের ভাবিয়ে তুলতে পারে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় চিনের ডিটেনশন সেন্টার নিয়ে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮-তে প্রকাশিত নিবন্ধের শিরোনাম – China’s Detention Camps for Muslims Turn to Forced Labor। এ লেখায় বলা হল যে এই ক্যাম্পগুলো “holds Muslims and forces them to renounce religious peity and pledge to the party ... The program aims to transform scattered Uighurs, Kazakhs and other ethnic minorities ... into a disciplined, Chinese-speaking industrial work force, loyal to the Communist party and factory bosses, according to the official plans published online.” আমেরিকার প্রচারমাধ্যম বলে পুরোপুরি মেনে নিতে খানিকটা অস্বস্তি হয় বটে, কিন্তু আমাদের দেশের সাথে কোথাও একটা সাযুজ্য দেখা যায়। একই পত্রিকায় ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯-এ প্রকাশিত নিবন্ধের শিরোনাম – Inside china’s Push to Turn Muslim Minorities Into an Army of Workers। এ লেখায় বলা হল এই ক্যাম্পগুলো “crucial to the government’s strategy of social re-engineering alongside the indoctrination camps”। কি হয় এই ক্যাম্পগুলোতে? Ouartz পত্রিকায় ২১ অক্টোবর, ২০১৯-এ প্রকাশিত একটি খবর বলছে চিনে সস্তায় তৈরি কাপড়ের পোষাক আমেরিকায় বিক্রী হয়। বেশিরভাগ পোষাক তৈরি হয় এসমস্ত ক্যাম্পে। বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টার থেকে জানানো হচ্ছে – China: Ethnic minorities detained in internment camps reportedly subject to the forced labour in factories supplying to major apparel brands. আন্তর্জাতিক মানে অনৈতিকভাবে তৈরি হওয়া এসব সুতীর পোষাকের আমদানি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আমেরিকায় বিভিন্ন সংগঠন সরকারি-বেসরকারি স্তরে চাপও দিচ্ছে।

    অনেকেরই হয়তো নজরে পড়েছে কদিন আগে ভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর – কাশ্মীরে ৫৭,০০০ একর জমি সরকার নেবে শিল্প গড়ে তোলার জন্য। আমরা যদি রাজনৈতিক ক্রমকে একটু ভালো করে নজর করি তাহলে ঘটনাগুলো পরপর এরকম – আগস্টে কাশ্মীরের জমির রক্ষাকবচ তুলে নেওয়া হল, ডিসেম্বরে বিপুল পরিমাণ জমি চিহ্নিত করা হল। কে নেবে এই জমি? কে গড়বে শিল্প? স্মরণে রাখবো ভারতের অর্থনীতির এরকম মন্দার বাজারেও মুকেশ আম্বানির পুঁজি ২০১৭-তে ৪ লক্ষ কোটি থেকে বেড়ে ২০১৯-এ ১০ লক্ষ কোটি হয়েছে – প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কি ব্যাপারটা এরকম যে কর্পোরেটদের জন্য ৩৭০ ধারা বাতিল করা হল যাতে কাশ্মীরে পুঁজি প্রবেশ করতে পারে যার ফলে হয়তো কাশ্মীরের ডেমোগ্রাফি এবং ভৌগলিক বৈচিত্র চিরদিনের মতো বদলে যাবে। এরকম প্রেক্ষিতে নির্মীয়মান ডিটেনশন সেন্টারগুলো কি চিনের মতো forced labor camp হয়ে উঠবে কর্পোরেট মুনাফার জোগান দিতে? ভবিষ্যৎ উত্তর দেবে।

    মেডিসিনের চোখ দিয়ে
    আমাদের আলোচনার পরের অংশটুকুতে মূল ঝোঁক থাকবে এরকম বাস্তুচ্যুত, অবলম্বনহীন মানুষদের বাস্তব অবস্থা, নিঃসহায় suffering বা ক্লিষ্টতা, এদের জীবনের নিঃশেষিত নির্বাপিত সমস্ত আশা আর ভরসাকে মেডিসিনের চোখ দিয়ে কিভাবে দেখবো। আমাদের দেশে চিকিৎসকেদের, কিছু ব্যতিক্রমী অসরকারি চিকিৎসক ছাড়া, রাষ্ট্রকে অতিক্রম করে কিংবা রাষ্ট্রের সাথে সংলাপে গিয়ে স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান বা তদন্ত চালানোর আগ্রহ রাখেন না কিংবা সফল কোন পদক্ষেপ নিতে আদৌ প্রস্তুত নয়। অথচ আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার ডাক্তারদের সংগঠন মৃত্যুদণ্ড থেকে বন্দীদের ওপর অত্যাচার নিয়ে খুব নির্দিষ্টভাবে নিজেদের ভিন্ন অবস্থান ব্যক্ত করে সরকারি সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে কিংবা বিরোধিতা করে।

    আগে উল্লেখিত সুবিখ্যাত জনস্বাস্থ্য গবেষক মাইকেল মার্মট (যিনি social determinants of health-এর ধারণার অন্যতম প্রবক্তাও বটে) তাঁর দ্য হেলথ গ্যাপ পুস্তকে ডাক্তারদের স্মরণ করান – As doctors we are trained to treat the sick. Of course; but if behaviour, and health, are linked to people’s social conditions, I asked myself whose job it should be improve social social conditions. Should not be the doctor, or at least this doctor, be involved? (চিকিৎসক হিসেবে আমাদের প্রশিক্ষণ হয়েছে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা করার জন্য। অবশ্যই, কিন্তু যদি আচরণ এবং স্বাস্থ্য যদি সাধারণ মানুষের সামাজিক অবস্থার সাথে সংযুক্ত থাকে তাহলে? আমি নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলাম সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো কার দায়িত্ব। এতে কি ডাক্তারদের কিংবা অন্ততপক্ষে একজন ব্যক্তি চিকিৎসকের ভূমিকা থাকবে না?)

    ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন (NEJM)-এ একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল “The Violece of Uncertainty – Undermining Immigrant and Refugee Health” শিরোনামে। এখানে দু’ধরনের হিংসা বা ভায়োলেন্সের কথা বলা হয়েছে – প্রথম, পল ফার্মার তাঁর সাড়া জাগানো গ্রন্থ Pathologies of Power যেমনটা বলেছেন স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স বা গঠনগত হিংসা; দ্বিতীয়, ভায়োলেন্স অফ আনসেরটেইন্টি বা অনিশ্চয়তার হিংসা। কেমন এদের চেহারা? যখন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তিসমূহ রোগের জন্ম দেয় বা রোগের রিস্ক ফ্যাক্টর বেড়ে যায় তাকে বলা হচ্ছে স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স। এরকম বিশেষ ধরনের হিংসার ফলে সমগ্র দেশ একটি জীবন্ত ল্যাবরেটরি হয়ে ওঠে। অমর্ত্য সেন এ বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বিষয়টি আরেকটু বিশদে ব্যাখ্যা করেন। সে ব্যাখ্যা অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি এই যে না-নাগরিক/না-ভোটার মানুষেরা নিজের আত্মপরিচয় সহ সবকিছু খুইয়ে ডিটেনশন সেন্টারে ঢুকতে বাধ্য হচ্ছে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রকট এবং শক্তিশালী চালক হিসেবে থাকে সামাজিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে অসাম্য এবং অবিচার। এখানে যে যে শক্তিগুলো একসাথে কাজ করছে – দানবীয় রাষ্ট্রশক্তি, অনুভূতিহীন আমলাতন্ত্র, সমাজে শ্রেণিবিন্যাসের অতলান্ত তারতম্য। একেই বলা হচ্ছে স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স। পরিণতি?

    এখানে আসে দ্বিতীয় সমস্যা - ভায়োলেন্স অফ আনসেরটেইন্টি বা অনিশ্চয়তার হিংসা। The Violece of Uncertainty – Undermining Immigrant and Refugee Health-এর লেখকেরা জানাচ্ছেন যে এখন আমরা আরেকটি নতুন চরিত্রের এবং গঠনের হিংসা দেখছি - form of violence inflicted on these groups, enacted through systematic personal, social, and institutional instability that exacerbates inequality and injects fear into the most basic of daily interactions. We refer to such violence as “the violence of uncertainty.” রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এ হিংসা চিরস্থায়ী চেহারা নেয়। ওঁদের পর্যবেক্ষণে, “Even naturalized citizens fear that their status is no longer secure. These are not unfounded fears.” যারা জন্ম থেকেই স্বাভাবিকভাবে এদেশের নাগরিক তাদের মাঝেও অনিশ্চয়তার ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এ এমন এক পরিস্থিতি যখন পাশের বাড়ির প্রতিবেশী কিংবা ঘনিষ্ঠতম বন্ধুও কোন সাহায্য করতে পারেনা, পারবেনা। তাহলে এমন এক অন্তহীন দুশ্চিন্তার পরিস্থিতি হল যা “affecting all social determinants of health and injects more uncertainty into communities that are already precarious.” এ অবস্থায় যে রোগটি সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে তাকে আমরা ডাক্তারি পরিভাষায় বলি posttraumatic stress disorder বা PTSD। একবার ভাবার চেষ্টা করি সেই পরিস্থিতির কথা যেখানে সন্তানকে ডিটেনশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মা বাবা বাড়িতে। কিংবা এর উল্টোটা। যে নীতি-নির্ধারণের মধ্য দিয়ে এই সামাজিক ভীতি ও অনিশ্চয়তার জন্ম হল এর ফলে লেখকদের মতো আমাদেরও মনে হয় “these challenges will outlive the policies that created them." প্রসঙ্গত বলার যে একইরকম PTSD-তে বছরের পর বছর ধরে ভুগছে কাশ্মীর, সিরিয়া, লেবানন এবং অন্য অনেক জায়গার শিশু এবং মানুষ।

    এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের অবস্থান কি হবে? পল ফার্মার অন্য একটি প্রবন্ধে বলছেন – Careful assessment of severity is important, at least to physicians, who must practice triage and referral daily. আমাদের ভারতবর্ষের বিশেষ পরিস্থিতিতে ডাক্তাররা যাবেন তো? তাদেরকে রোগী দেখার প্রবেশিধিকার দেওয়া হবে তো? দেবে রাষ্ট্র এবং প্রশাসন?

    Rebecca Chopp তাঁর The Praxis of Suffering গ্রন্থে লিখছেন – “ইতিহাস কেঁপে কেঁপে ওঠে, অতিবৃহৎ সব ঘটনা দিয়ে বিদ্ধ হয় জনতার suffering বা ক্লিষ্টতা, স্মৃতিকে তাড়া করে ফেরে ইতিহাসের বলির পশুদের চুপিসার পদক্ষেপ ... বুভুক্ষু মানুষের আর্তনাদ, রাজনৈতিক বন্দীদের সুতীক্ষ্ণ চিৎকার এবং নিপীড়িতের নিঃশব্দ স্বর আমাদের প্রাত্যহিক যাপনে ধীর গতিতে, যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়ে প্রতিধ্বনিত হয়।”

    সত্যিই কি আমাদের দিন যাপনে, এমনকি চিকিৎসকদের দিন যাপনেও, মূক পশুর মতো অস্তিত্বে পর্যবসিত হওয়া মানুষের suffering বা PTSD কোনভাবে তাড়িত করে? আমি নিশ্চিত নই। ২৯ জুন, ২০১৯-এ ল্যান্সেট জার্নালের সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল “Refugee health is a crisis of our own making”। এ সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়েছিল – “Health is a right, not a privilege granted by circumstance of birthplace.” স্বাস্থ্য মানুষের একটি মৌলিক অধিকার, সৌভাগ্যক্রমে জন্মস্থানের সূত্রে পাওয়া কোন সুবিধে নয়।

    আজকের ভারতে মেডিসিনের পেশার সাথে যুক্ত চিকিৎসক এবং সমস্ত স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীর বোধহয় অনুভব করার সময় এসেছে ডিটেনশন সেন্টারের চরিত্র কি এবং ওখানকার মানুষদের জন্য আমাদের কি ভূমিকা হওয়া কাম্য।

    রামচন্দ্র গুহ তাঁর সুবৃহৎ India after Gandhi পুস্তকে মির্জা গালিবের একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছেন। আমাদের জন্য বর্তমান মুহূর্তে বড়ো প্রাসঙ্গিক সে কবিতা –

    Sir, you well perceive,
    Fidelity and love
    Have all departed from this sorry land.
    ....
    Why does not the Last Trumpet sound?
    Who holds the reins of the Final Catastrophe?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১২ জানুয়ারি ২০২০ | ১৬৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • জয়ন্ত ভট্টাচার্য | 117.201.123.46 | ১৩ জানুয়ারি ২০২০ ০৯:৩৯45382
  • লেখাটি অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে।
  • গুরুচণ্ডা৯ | 162.158.167.143 | ১৭ জানুয়ারি ২০২০ ১৭:১৬45402
  • সম্পূর্ণ লেখা ফিরে এসেছে। এই অনিচ্ছাকৃত অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন