এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ জুলাই ২০১৪ | ১১৫০ বার পঠিত

  • কাজ প্রায় শেষ।এর মধ্যে রায়পুর ও কোরবা থেকে সায়েবরা তিন দফায় এসে সরেজমিনে সব বুঝেসুঝে গিয়েছেন। আর দিন সাতেকের মধ্যে পাততাড়ি গোটাতে হবে। আগামী দিনের ডেরা? সম্ভবতঃ বাংগো নদীর পাড়ে সতরেঙ্গা অজগরবাহার প্রোজেক্ট এলাকায়।কাজটা নাকি বেশ বড়। তাই টিম বড় হবে, তবে আমি ও চ্যাটার্জি একসঙ্গেই থাকবো।তার আগে বাড়ি যাবো।
    কয়দিন হল রোজ রাত্তিরে বেড়াতে যাচ্ছি, চ্যাটার্জির কথামত পায়ে গামবুট, হাতে টর্চ। এ সময় নাকি সাপেদের ঘুম ভাঙে!চ্যাটার্জির হাতে আবার একটা বেঁটে লাঠি, অনেকটা এদেশের গয়লাদের মত।এতোল বেতোল হাওয়া। দূর গাঁয়ের গানবাজনা ঢোলকের আওয়াজ ঙেসে আসে।হাওয়ায় মহুয়া ঝরে টুপটাপ।আর মহুয়ার গন্ধে আসে হরিণের দল। দলে দলে নয়। হয় জোড়ায় জোড়ায়, নয় একা বিবাগী।
    মাটি থেকে ছয় বা সাত ফুট উঁচুতে জ্বলছে কারো সবুজ চোখ, বুঝে যাই সম্বর হরিণ গাছের ডাল থেকে কামড়ে খাচ্ছে মহুয়ার ফুল।আর হাঁটুর থেকে নীচে সবুজ চোখের মানে মাটিতে ঝরে পড়া মহুয়া একদম সাফাচট্! সকালে মহয়া কুড়োতে আসা মেয়েগুলোর কপাল খারাপ! আর ফুট তিনেক উঁচুতে পান্নার মত জ্বলা সবুজ চোখ?এগুলো কোটরি বা সাদা ছিট্ ছিট্ ছাগলের মত হরিণ।তবে রাত্তিরে ভয় করে গোরুর চোখ দেখলে, অন্ধকারে লালরঙা ভাঁটার মত জ্বলজ্বল করে।
    আর মাত্তর তিন দিন! আজকের রাতটা বাদ দিলে দুটো রাত্তির আর তিনটে দিন! তারপর বনবাস শেষ, ভাবা যায়? কাল থেকে বাঁধাছাঁদা শুরু করব, এখন তো ঘুমোই।
    কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর!কোন এক সামান্য ব্যাপারে আমার আর চ্যাটার্জির কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল।ব্যাপারটা এতই তুচ্ছ যে পরে চেষ্টা করেও মনে করা গেল না। কেশোদাদা হাতজোড় করে আমাদের থামতে বলল, কিন্তু চ্যাটার্জির সেই এক গোঁ!
    ঃ আমি শালা কারো খাই না পরি? কারো একপয়সার ধার ধারি নে! আমি কেন চুপ করব?
    কথাটা আমার গায়ে লেগে গেল।আমি তো বেশ কয়েকবার ধার নিয়েছি, তাও ওই চ্যাটার্জির কাছে; আমাকে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় যে! শেষকালে আমি আর কথা না বাড়িয়ে খাটিয়া টেনে নিয়ে কেশোদাদার কাছে লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম।

    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২১ যুনে ২০১৪ ০০ঃ৩৯ঃ৩৪ ঈট ২৪।৯৯।২২২।২৩২ (*) #
    পরের দিন সকালেও আমরা চা খেলাম চুপচাপ, নিজেদের মধ্যে একটা কথা না বলে। তবে আরেকজন তো ঠিক চুপ করে থাকতে পারে না। কেশোদাদাকে উঁচু গলায় নানা ফুট ফরমাস বা কাজের মেয়ে উম্মেদ কুঁয়েরকে আরেকবার চা বানাতে বলে আড় চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে আমার বাক্স-প্যাঁটরা গুছোতে থাকি।
    পরশু দিন এখান থেকে বেরিয়ে রায়পুরের ট্রেন ধরবো।
    মাঝখানে চ্যাটার্জি কোথায় বেরিয়ে গেছল, দুপুরের খাওয়ার আগে ঠিক ফিরে এল।
    ভাত বেড়ে দিতে দিতে কেশোদাদা শোনাল যে আবহাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাঁয়ের লোকজনের মেজাজও চড়ছে।
    গাঁয়ে এখন নাকি দুটো দল। একটা পুরনো মোড়লের আর একটা নতুন চ্যাংড়াদের। নতুনের দল চাষের জমির ক্ষতিপূরণের জন্যে আরো উঁচু দর দাবি করছে।
    কাল নাকি নগৈখারের দিকে লোকজন কয়লা কোম্পানির জমিকাটা ডোজার মেশিন আটকে দিয়েছে। পুলিশ এসে ফিরে গেছে। সোমবার সবাইকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক হবার কথা ছিল। কিন্তু কোথাও জমির ক্ষতিপূরনের ঝগড়ায় মারামারিতে টাঙি চলেছে। একজনের আঙুল কাটা পড়েছে।
    খেয়েদেয়ে খাটিয়ায় গড়িয়ে খানিকটা সময় কাটল। একটু উশখুশ করছি এমন সময় চ্যাটার্জির হুকুম-- কেশোদাদা ! বড়িয়া কড়ি মিঠঠি চায় বনাও, হম দোনো থোড়া গাঁও ঘুমনে জায়েঙ্গে।
    তারপর আমার দিকে চোখ মেরে বলল--- চল না রে মনবোধি! আবার কবে এ গাঁয়ে আসা হবে কি না হবে? অব গুস্‌সা থুক দে ইয়ার! দোষটা আমারই। ম্যাঁয় হী গলত থা।
    আমিও হেসে ফেলি। বেরোনোর সময় কেশোদাদা হেঁকে বলল আমরা যেন গাঁয়ের দোকান থেকে কেরোসিন নিয়ে আসি, প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। সকালে দোকান বন্ধ ছিল।
    মাত্র এক কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ। তারপর শিমূল গাছের পাশে একটা চায়-পান-বিড়ি-সিগ্রেট আর বিস্কুটের দোকান। কিছু চাল-ডাল-নুন-তেলও পাওয়া যায়।
    এই সময়টা দোকানের সামনে চার গাঁয়ের লোকজন জড়ো হয়। গুলতানি কেনাকাটা গপশপ সবই চলে।
    চ্যাটার্জির আশা এখানে ফোটানো দুধের চা খেতে খেতে গাঁয়ের আসলি খবর পাওয়া যাবে।
    কিন্তু সে গুড়ে বালি!
    মোড়ের মাথায় লোকের ভিড় নেই। হৈচৈ কেনাকাটা কিচ্ছু নেই।
    দোকানের সামনে মাত্র জনাচারেক লোক বসে চা খাচ্ছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন হল-- ক্যা চাহিয়ে?
    আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলি-- দো কাপ কড়িমিঠি চায় অউর--।
    আমাদের কথা কেটে দোকানদার -- নহী মিলেগা, দুধ নহী হ্যায়।
    আমরা অবাক। চ্যাটার্জি আঙুল দেখিয়ে বলে--নেই মানে? ওই তো কড়াইয়ে ফুটছে!
    দোকানদার জবাব দেবার আগেই উপস্থিত চারজনের একজন বলে ওঠে-- ও দুধ আপনাদের জন্যে নয়।
    আমরা এবার কোন কথা না বলে গাঁয়ের ভেতরে পা বাড়াই।
    কি আশ্চর্য! গাঁয়ের ভেতরের ছোটখাটো দোকানগুলো ও আজ বন্ধ দেখছি যে! রাস্তাঘাটে জনমনিষ্যি নেই, শুধু ছোট বাচ্চারা খেলছে। পাতকুয়োর সামনে বালতি নাবিয়ে জল তুলতে থাকা বৌ-ঝিয়ের দল অন্যদিন চোখে চোখ পড়লে সলজ্জ হাসি হাসত বা কেউ কেউ সাহস করে 'রাম-রাম সাহাবমন!' বলত।
    আজ আমাদের দেখে কলসী-দড়ি-বালতি সব ফেলে দুদ্দাড় করে ছুটে পালাল।
    কিছু না বুঝে আমরা গাঁয়ের মোড়ল বা সরপঞ্চের বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২২ যুনে ২০১৪ ০০ঃ২৬ঃ৪২ ঈট ২৪।৯৬।১০৯।৪৪ (*) #
    সদর দরজা ভেজানো, সামনে দু-চারটে ন্যাংটোপুঁটো বাচ্চা খেলছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াই, উস্‌খুশ্‌ করি।
    চ্যাটার্জি হাঁক পাড়ে--- কৈসে গা গোটিয়া, ঘর মা হবে কা?
    ( কি গো মোড়ল? ঘরে আছ নাকি?)
    কোন উত্তর নেই। বার দুয়েক হাঁক পেরে বিরক্ত হয়ে ওর দরজার কপাট থেকে ঝুলতে থাকা লোহার শেকল ধরে জোরে জোরে নাড়াই।
    হটাৎ দরজা খুলে যায়। দরজার ফ্রেমের মাঝে আধো ছায়ায় হেটো ধুতি আর পিরান পরা সমারুরাম গৌটিয়ার শুকনো কড়া চেহারা আমাদের চমকে দেয়।আরো চমকে দেয় ওর রস-কষহীন রুক্ষ কেজো প্রশ্নঃ
    --- কা বাত হ্যায়?
    আমি কি বলব ভেবে পাই না। এতদিন ওর দরজায় এলে এই গৌটিয়া আমাদের হাসিমুখে -- আওগা সাহাবমন! বৈঠো, বলে খাটিয়া টেনে এনে বসিয়েছে। কাঁসার বাটিতে কাঁসার ছোট গেলাস বসিয়ে চা দিয়েছে, তাতে এক চামচ ঘি! আর আজ?
    চ্যাটার্জি তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলে-- কা বাত হ্যায় গৌটিয়া? আজ খড়ে খড়ে বিদা করবে কা? চুঙ্গি-উঙ্গি পিলাইকে মন নাহি হাবয়?
    ( কী ব্যাপার মোড়ল? আজ দরজা থেকেই বিদেয় করবি নাকি ? বিড়ি- টিড়ি খাওয়াবি না?)
    সমারুরাম যেন ঘোরের থেকে জেগে ওঠে। একটু লজ্জা পায়। খাটিয়ার জন্যে বাড়ির ভেতর দিকে কাউকে হেঁকে বলে।
    তারপর বলে-- না, না! বিড়ি দেব না কেন? আসলে কি জান সাহেবরা? এতসব গন্ডগোলে মাথার ঠিক নেই আমার। এক ছেলে , এক মেয়ে। আমার

    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২২ যুনে ২০১৪ ০০ঃ২৬ঃ৪২ ঈট ২৪।৯৬।১০৯।৪৪ (*) #
    সদর দরজা ভেজানো, সামনে দু-চারটে ন্যাংটোপুঁটো বাচ্চা খেলছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াই, উস্‌খুশ্‌ করি।
    চ্যাটার্জি হাঁক পাড়ে--- কৈসে গা গোটিয়া, ঘর মা হবে কা?
    ( কি গো মোড়ল? ঘরে আছ নাকি?)
    কোন উত্তর নেই। বার দুয়েক হাঁক পেরে বিরক্ত হয়ে ওর দরজার কপাট থেকে ঝুলতে থাকা লোহার শেকল ধরে জোরে জোরে নাড়াই।
    হটাৎ দরজা খুলে যায়। দরজার ফ্রেমের মাঝে আধো ছায়ায় হেটো ধুতি আর পিরান পরা সমারুরাম গৌটিয়ার শুকনো কড়া চেহারা আমাদের চমকে দেয়।আরো চমকে দেয় ওর রস-কষহীন রুক্ষ কেজো প্রশ্নঃ
    --- কা বাত হ্যায়?
    আমি কি বলব ভেবে পাই না। এতদিন ওর দরজায় এলে এই গৌটিয়া আমাদের হাসিমুখে -- আওগা সাহাবমন! বৈঠো, বলে খাটিয়া টেনে এনে বসিয়েছে। কাঁসার বাটিতে কাঁসার ছোট গেলাস বসিয়ে চা দিয়েছে, তাতে এক চামচ ঘি! আর আজ?
    চ্যাটার্জি তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলে-- কা বাত হ্যায় গৌটিয়া? আজ খড়ে খড়ে বিদা করবে কা? চুঙ্গি-উঙ্গি পিলাইকে মন নাহি হাবয়?
    ( কী ব্যাপার মোড়ল? আজ দরজা থেকেই বিদেয় করবি নাকি ? বিড়ি- টিড়ি খাওয়াবি না?)
    সমারুরাম যেন ঘোরের থেকে জেগে ওঠে। একটু লজ্জা পায়। খাটিয়ার জন্যে বাড়ির ভেতর দিকে কাউকে হেঁকে বলে।
    তারপর বলে-- না, না! বিড়ি দেব না কেন? আসলে কি জান সাহেবরা? এতসব গন্ডগোলে মাথার ঠিক নেই আমার। এক ছেলে , এক মেয়ে। আমার

    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২২ যুনে ২০১৪ ০০ঃ২৮ঃ৪৫ ঈট ২৪।৯৬।১০৯।৪৪ (*) #
    ধেত্তেরি! মামুর কল দ্বৈতবাদী, কবে যে অদ্বৈতের মর্ম বুঝবে?
    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২২ যুনে ২০১৪ ০০ঃ৫৯ঃ০১ ঈট ২৪।৯৬।১০৯।৪৪ (*) #
    আমার যে জমির টুকরো সরকার কয়লাখনির জন্যে নিচ্ছে তাতে দেবে একটা চাকরি। তা আমার জামাই জিদ ধরেছে ওই চাকরি আমার ছেলেকে নয় ওকে দিতে হবে। নইলে আমার মেয়েকে সরকারি কাগজে দস্তখত করতে দেবে না।
    এই নিয়ে শালা-ভাটোর মধ্যে কথা কাটাকাটি, বচসা; শেষে আমার ছেলে রাগের মাথায় ভগ্নিপতির ওপর মারলো টাঙির কোপ! মেয়েটা বেওয়া হতে হতে বেঁচে গেল। কিন্তু জামাইয়ের বাঁ-হাতের তিনটে আঙুল চলে গেছে। তো আমার ঘরের একজন হাসপাতালে, আর একজন হাজতে। আমি বুড়ো দৌড়ুচ্ছি গাঁ থেকে শহর, শহর থেকে গাঁ।
    জামিন হয় নি। আগামী সোমবার কেস আদালতে তুলবে; উকিলবাবু দু'হাজার নিয়েছে। সেদিন বেশ কয়টা নম্বরি নোট নিয়ে যেতে হবে।
    এবার ও ঘটি থেকে ঢক্ঢক করে জল খায়।
    আমরা মিনিট খানেক চুপ করে থাকি।
    অস্বস্তি এড়াতে চ্যাটার্জি মুখ খোলে।
    ---- বহোত বুরি বাত। কিন্তু আমাদের কী দোষ? আমরা কী করেছি?
    ফুঁসে ওঠে গৌটিয়া সমারুরাম।
    --- কী বললে? তোমাদের কোন দোষ নেই? তবে কার দোষ? কে করেছে এসব?
    --- আমি? কী করলাম?
    --- তুমি নিজে না, তোমরা! আমরা জানতাম জমি হল মায়ের মতন; ও আমাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। জমি বেচতে নেই। তোমরা দেখালে লোভ,-- জমি দে, টাকা নে, চাকরি নে।
    আমরা ক্ষেতে চাকর রাখি, কামিয়া রাখি। নিজেরা গোমাতার সেবা করি, বাঢ়রাজা-বাররাণী-ঠাকুরদেব এর থানে মাথা ঠেকাই।
    আমরা কারো চাকর নই। এখন আমাদের ছেলেপুলেরা সরকারি অফিসে চৌকিদার হবে, পিয়ন হবে, চাপরাশি হবে!
    আমরা জানতাম সবাই মিলে একটা পরিবার। তোমরা সেখালে আপন আপন বাঁচ গে যাও। আমাদের হিসেবে বড় বা সিয়ান বা কর্তার কথাই শেষ কথা। তোমাদের প্রশ্রয়ে সেদিনের ছোঁড়াগুলো চোখ তুলে কথা বলে!
    জামাই ও ছেলে! কত ভাব-ভালবাসা! দুই ভাইয়ের মত। এখন সেই ছেলে জামাইয়ের ওপর টাঙি চালিয়ে দিল--- এর জন্যে তোমরা শহুরে বাবুরা দায়ী নও?
    শোন গো! আজকের চা তোলা রইল। আকাশের মতিগতি ভাল নয়। আঁধি আসছে মনে হয়। অব তুমন জলদি রেঙ্গ। লকর লকর লা ছোড়ব। উঠ, রেঙ্গ। নহী তো ফঁস জাও গে।
    ( এবার তোমরা গা তোল, পা চালাও। আমার বকবকানি শেষ। নইলে এখানেই আট্কা পড়ে যাবে।)
    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২৩ যুনে ২০১৪ ১৩ঃ৩২ঃ১৫ ঈট ২৪।৯৯।০।৮৬ (*) #

    আমরা চুপচাপ বেরিয়ে আসি। চ্যাটার্জি সিগ্রেট ধরায়, তারপর একদলা থুতু ফেলে বলে-- না এলেই ভাল হত।
    তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে--দূর্‌! মেঘ কোথায়? ওই যে এককোণে একটা ছোট্টমত? ওতে কিস্যু হবে না। মন খারাপ করিস নে মনবোধি! চল্‌, তোকে ওদের দেবতার থান দেখিয়ে নিয়ে যাই। ওখান থেকে আমাদের ক্যাম্পে ফেরার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে।
    আমি কোন কথা না বলে ওর পেছন পেছন চলতে থাকি।
    গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে একটা বাঁশঝাড় এড়িয়ে খানিকটা সাফসুতরো জায়গা। বিশাল বটগাছ, বয়সের গাছপাথর নেই, অসংখ্য ঝুরি নেমেছে, উইয়ের ঢিবি।
    এইখানে বটের ছায়ায় গোবরলেপা একটু বেদি মতন, তাতে তিনখন্ড এবড়ো খেবড়ো পাথর-- একটা খানিকটা বাড়ির মশলা পেষা শিলনোড়ার মত। ওটার গায়ে সিঁদূর লেপা। আর সামনে কিছু হলুদ চাল, লংকা ও আদার টুকরো মত ছড়িয়ে রয়েছে।
    কিন্তু ওদের ভগবান কই?
    চ্যাটার্জি আমার অজ্ঞতায় হাসে।--- বলে এই তো তিনজন দেবদেবী। শিলনোড়ার মত দেখতে পাথরটাই বাঢ়রাণী, বাকি দুটো বাঢ়রাজা ও ঠাকুরদেব।
    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২৩ যুনে ২০১৪ ১৭ঃ৪৫ঃ৩৬ ঈট ২৪।৯৬।১০১।২৫৪ (*) #
    হরি! হরি! এই তবে ওদের দেবস্থান, এমন সাদামাটা? একটার থেকে আর একটাকে আলাদা করে চেনাই মুশকিল।
    চ্যাটার্জি ধমকে ওঠে।
    --- ইয়ার্কি না। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি দেখে আলাদা করে চিনতে পার? ব্যাপারটা আসলে বিশ্বাসের।
    ধানকাটার পরে এদের গাঁয়ে আসলে দেখতে পেতে ।
    --কী?
    -- বারোদিন ধরে বাঢ় উৎসব। চারদিকের দশটা গাঁয়ের লোকজন মিলে রোজ রাত্তিরে নাচ আর গান। শেষরাত্রে ভক্তদের শরীরে এক এক করে বাঢ়রাজা, বাঢ়রাণী ও ঠাকুরদেবের ভর হওয়া; তারপর পাঁঠা ও মুরগি বলি দিয়ে শান্তিজল।
    আমি ঠোঁট উল্টে বলি -- শুনলাম।এবার সত্যিই পা চালাতে হবে মনে হয়।
    আমরা খেয়াল করিনি-- ঈশানকোণে একটু আগে দেখা ছোট্ট কালির ফোঁটা কখন যেন আকাশের সাদা টেবিল ক্লথে ছড়িয়ে গেছে। দূর থেকে একটা গোঁ-গোঁ-সোঁ-সোঁ আওয়াজ। পাক খেয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে শুকনো পাতা ও লাল ধূলো।
    ---- সেরেছে! বড় করে আঁধি আসছে। মনবোধি, দৌড়ো।
    আমরা দৌড়োতে থাকি। একটু পরেই চারদিক অন্ধকার করে সেই ধূলোর ঝড় আমাদের গায়ে মাথায় আছড়ে পড়ে। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি নে। চোখে মুখে বালি কিচকিচ করছে।
    ভাবছি কোথাও দাঁড়ালে হয়; তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। চ্যাটার্জি খিঁচিয়ে ওঠে-- থামিস না, সামনের দিকে দৌড়ো। আঁধি আমাদের পেছনে চলে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি আসছে, তার আগে ক্যাম্পে পৌঁছতে হবে। বেশি দূর নয়।
    আমরা অন্ধের মত সামনে দৌড়ে চলি।
    হ্যাঁ, ওই আঁধি বা ধূলোর ঘুর্ণি আমাদের টপকে গাঁয়ের দিকে চলে গেছে। এখন সামনে দেখতে পাচ্ছি। ওই তো আমাদের ক্যাম্প! আর পঞ্চাশ গজ।
    ওয়েল্ডিং এর তীব্র ফুলকির মত এক আলোর রেখা ইস্পাতনীল আকাশটাকে ওপর থেকে নীচ অবদি ফালাফালা করে দিল। আর কড় কড় শব্দে বাজ।
    শেষ ল্যাপে চ্যাটার্জিকে হারিয়ে সোজা ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে দম নিলাম। ততক্ষনে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২৩ যুনে ২০১৪ ২০ঃ৫৩ঃ৫১ ঈট ২৪।৯৬।১০১।২৫৪ (*) #
    হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে মাথা মুছে চায়ে চুমুক দিয়েছি কি বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বেশিক্ষণ থাকতে হল না, কেশোদাদা নিপুণ হাতে হ্যাজাক জ্বেলে দিয়েছে।
    বাইরে শুরু হয়েছে তান্ডব। কালো মেঘের চাঁদোয়ার নীচে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মত জলভরা সাদা মেঘ। মাটি ডাকছে আকাশকে। আকাশ সাড়া দিয়েছে সে ডাকে। বিজলির জিভ দিয়ে চেটে দিচ্ছে ধরতীর শরীর, লালায় ভরিয়ে দিচ্ছে। আর ধরতী মুঠো করে খামচে ধরছে গাছপালা, নুইয়ে দিচ্ছে মাথা।
    ক্যাম্পের টিনের চালে বৃষ্টির চড়বড় চড়বড় যেন মাদলের বোল। আস্তে আস্তে চাল আর টিনের দেওয়াল ঠান্ডা হয়ে এল। বাইরে ঝড়ের দাপট কমেছে, কিন্তু বৃষ্টির জোর সেই একরকম। এর ওপর শুরু হয়েছে 'ওলে' বা শিলাবৃষ্টি।
    জানলা বন্ধ করতেই হল, নানারকম পোকামাকড় ঢুকছে। কানে আসছে অসংখ্য সোনাব্যাঙ ও ঝিঁঝির ঐকতান।
    কিছু করার নেই। এই আবহাওয়ায় ট্রানজিস্টারেও শুধু খড়খড়ানি।
    খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। আর দুটো দিন। আর একটা রাত্তির।
    শীত শীত করছে। গায়ে চাদর টেনে চালের ওপর বৃষ্টিধারার তবলা লহরা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।
    আভতরঃ রন্জন রোয়
    Rেঃ ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    ওম্মেন্ত ফ্রোম রন্জন রোয় ওন ২৩ যুনে ২০১৪ ২১ঃ১৪ঃ১১ ঈট ২৪।৯৬।১০১।২৫৪ (*) #
    বাররাজা-বাররাণীর থানের সামনে অগ্নিকুন্ড। মাঠের চারপাশে গাছের গায়ে গায়ে মশাল বাঁধা। অগ্নিকুন্ডের সামনে একটা উঁচু ঢিবির ওপর বসে আছেন বাররাণী। তার সামনে আমি আর চ্যাটার্জি পিছমোড়া করে বাঁধা।
    আদিবাসীদের ছোট ছোট দল ঘুরে ঘুরে নাচছে আর গাইছে--" তোলা দয়া লাগে না, তোলা মায়া লাগে না, তোলা দয়া লাগে--এ-এ-এ!"
    ( তোর দয়া হয় না গো, তোর মায়া হয় না গো!)
    বৈগা পুরুত মন্ত্র পড়ে আমাদের দুজনের গায়ে হলুদ চাল ছিটিয়ে দিল। অমনই মোড়লের ছেলে দুহাতে রামদা' উঁচু করে তুলল। আগে আমি না চ্যাটার্জি? ভয়ে চোখ বুজতেই বাররাণী খিল খিল করে হেসে উঠল। চমকে তাকিয়ে দেখি ওর পরণে লাল লুগরা আর কালোকোলো বোঁচা মুখে গোটা কয় ব্রণ।
    ঘুম ভেঙে গেল। বালিশ ঘামে ভিজে গেছে। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। খাটিয়া থেকে নেমে কুঁজোটা তুলে গলায় উপুড় করে দিই।
    বাইরে ভোর হচ্ছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ জুলাই ২০১৪ | ১১৫০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন