এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বাঙলার বাউল

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৬ মার্চ ২০১৪ | ৩৭০৮ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • বাউল নিয়ে আমাদের সবারই কিছু না কিছু ভাবনা আছে – আর সেই ভাবনার শুরু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের গান দিয়ে। এমনকি এটাও বলা যেতে পারে বাউল দর্শন, বাউল ধর্ম এই সব কিছুর থেকে আগে আমাদের মনের কাছা কাছি থেকে যায় বাউল গান। বাউল দীর্ঘদিন ধরেই আমার প্রিয় বিষয়, তাই অনেক দিন যাবতই ভাবছি এই নিয়ে কিছু লিখলে কেমন হয়! কিন্তু প্রশ্ন হল কিভাবে শুরু করা যায়? একটা প্রবন্ধে তো আর সম্ভব নয় বাউলদের গান থেকে শুরু করে তাদের জীবন ধারা সব কিছু নিয়ে আলোচনা করা! তাই আমি চেষ্টা করব যতটা পারা যায় বাউল সম্পর্কীয় নানা দিকগুলো ছুঁয়ে যেতে।

    আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনেকসময়ই ভাবতে বসি, বাউল সম্পর্কে আমরা ঠিক কতটা জানি? বাউল গান শুনি, বাউল মেলাতেও গিয়ে থাকি আমরা – আমরা শান্তিনিকেতন, জয়দেবপুর, কেন্দুলী সহ বর্ধমান বা বীরভূমের কিছু আখড়ায় যাই – ছবি তুলে, অনেক সময় বেশী অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে তাদের ধূম্র প্রসাদ চেখে উইকএণ্ড কাটিয়ে নিজেদের চেনা গন্ডিতে ফিরে আসি। সেই দিক দিয়ে ভাবলে আমরা সবাই জানি সামাজিক ভাবে, বা জীবনধারণ পদ্ধতিতে আমরা তাদের থেকে অনেকটাই দূরে বা ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমরা তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছি। একটু গভীর ভাবে ভাবতে বসলে আমরা দেখব যে আমাদের বাউল সম্পর্কিত জ্ঞান অনেকটাই প্রাথমিক স্তরের। দুচারটে গানের কলি জানি, আলখাল্লা পরা বাউল জানি, তাদের কি সব গোপন সাধন পদ্ধতির কথাও শোনা আছে আবছা ভাবে। কিন্তু তারপর? যাঁরা বাউল নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন, তাঁদের জ্ঞান স্বাভাবিক ভাবেই আর একটু বেশী বাউল সাধন প্রণালী – বাউল গান সম্পর্কে। যে সমস্ত বই সহজ লভ্য বাউলদের বিষয়ে তার অনেকটাই বাউল দর্শন নিয়ে, বাউলদের উদ্ভব, বাউলদের সামাজিক অবস্থান বা বাউলগান নিয়ে। বাউলদের সাধন প্রণালীও অনেকে অগভীর ভাবে আলোচনা করেছেন। কারণ, বাউল ধর্মে দীক্ষিত না হলে তথাকথিত ‘সাধন-প্রণালী’ নিয়ে আলোচনা করা যায় না, হয়তবা বেশী জানাও যায় না। বাউল সম্পর্কিত কোন গবেষণা ধর্মী প্রবন্ধ লেখার বাসনা নিয়ে আমি এই লেখা লিখতে বসি নি। যাঁরা সত্যিকারের গবেষণা মূলক লেখা পড়তে চান, তাদের অনুরোধ করব হাতের কাছে কেনার জন্য সহজলভ্য শক্তিনাথ ঝা র ‘বস্তুবাদী বাউল’ বইটি পড়তে। তা ছাড়া রয়েছে সুধীর চক্রবর্তীর ‘বাঙলার বাউল’, লীনা চাকির লেখা ‘বাউলের গানের ভেলা’, ওয়াকিল আহমেদের লেখা ‘বাউল গান’, ‘বাউল-ফকির পদাবলী’ শক্তিনাথ ঝা সম্পাদিত এমন কিছু বই। এই মুহুর্তে আমার হাতের কাছে এই বই গুলি রয়েছে, আর রয়েছে কিছু প্রবন্ধ, ইন্টারনেট। আমি নিজে যে বইগুলি পড়েছি তার মধ্যে বাউল সাধন প্রণালী নিয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘বস্তুবাদী বাউল’ বইটিতে। সুধীর চক্রবর্তী মহাশয় দু দশকেরও বেশী সময় ধরে বাউল সঙ্গ করেছেন। তাঁর বইটিতে প্রভূত পরিশ্রমের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। তিনি অনেক বাউলের সাক্ষাতকার নিয়েছেন এবং জেলাভিত্তিক বাউলদের একটা তালিকাও তৈরী করেছেন। অপরদিকে ‘বাউল গান’ বইটি মূলত একটি গান সংকলন। প্রায় ৩০০টি বাউল গান এখানে সংগ্রহীত হয়েছে। তবে এটাও বলতে হবে এই বই টির বেশীর ভাগ জুড়েই ‘উদ্ধৃতির’ মেলা! লেখকের স্বাধীন চিন্তার ছাপ কম। যাই হোক, এবার আমি মূল বিষয়ে ফেরার চেষ্টা করি।

    বাঙলা সাহিত্যে অনেক উপন্যাস, গল্প বা কবিতায় বাউলের উল্লেখ হয়েই এসেছে পরম্পরায়। তবে সম্ভবত সমরেশ বসুর মত এত মরমী হাতে উপন্যাসেতে বাউলদের উপস্থাপনা আর কেউই করেন নি। তাঁর ‘কালকূট’ ছদ্মনামে লেখা অনেক অনেক উপন্যাসেই ছড়িয়ে আছে বাউলদের নিতে, বাউলদের সাথে মিশে যাবার কথা। এত কথা বলছি এই জন্য যে এই কালকূটের উপন্যাস ‘কোথায় পাবো তারে’ পড়েই বাউলদের বিষয়ে অনুসন্ধিতসা আরো বেড়ে ওঠে আমার। এই উপন্যাসের গাজী নামক চরিত্রটি আজো আমার মনে গেঁথে আছে। এমনিতে আমার বাড়ি বর্ধমানের দিকে হওয়াতে, ছোটবেলা থেকেই বাউল দেখে আসছি। পাশের জেলা বীরভূমে ও বিভিন্ন মেলায় (যার মধ্যে পৌষমেলাও পড়ে) বাউলদের আনাগোনা লেগেই থাকত। মনে পড়ে ছোটবেলায় রাত জেগে বাউল গানের আসর শোনা। এখনো সময় পেলে বাউল গানের আসরে যাই। তবে ছোটবেলাতে যা এখনও অনেকটাই তাই – মুখ্যত সুরের টান, পরিবেশনার টান। গানের কথার গূঢ় অর্থ তখন বুঝতে পারতাম না, এখনও বা কতটাই পারি! সে জানার জন্য গুরু ধরতে হয়, মুরশিদ চাই।

    যখন এই লেখা শুরু করব ভাবছি, তখনই ই-মেলে একটা লেখা পেলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে, নাম ‘Interview with God’। লেখাটা পড়ে কিছু কিছু জায়গায় এমন জিজ্ঞাসা পেলাম যে গুলোর উত্তর খুঁজতেই যেন বাউলরা বের হয়েছে। কথা গুলি ইংরাজী তেই লিখছি কারণ বঙ্গানুবাদে মাধুর্য হয়ত কিছুটা হারিয়ে যাবে।
    When asked, “What surprises you most about humankind?”, God answered
    “ .. That by thinking anxiously about the future, they forget the present, such that they live in neither the present nor the future. That they live as if they will never die, and die as they had never lived.
    When asked, “What lessons you want your children to learn,” God replied,
    “To learn that it is not good to compare themselves to others. To learn that a rich person is not one who has the most, but it is one who needs the least. To learn to forgive by practicing forgiveness. To learn that two people can look at the same thing and see it differently..”

    কি অদ্ভূত মিল – এ যেন বাউলদেরই কথা! পার্থক্য এই যে বাউলরা কোন তথাকথিত ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। তাদের কাছে মানুষই সব। তারা খুঁজে ফেরে ‘মনের মানুষ’।

    তাই তো মনে হয় বাউল লিখেছে,

    “এমন মানব জনম আর কি হবে
    মন যা করো, ত্বরায় করো এই ভবে”।

    বাউল ও বাউল গান আমাদের আজকের সাংস্কৃতিক জীবনে বহুল উচ্চারিত নাম। আদতে বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, এই মতের একজন প্রবর্তক থাকাই তাই স্বাভাবিক। কিন্তু কে তিনি? এর উত্তর আমাদের অজানা। ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি নির্ণয় করতে গিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। কেউ মনে করেন সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। অনেকে বলেন ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই বাউল এসেছে। অনেকে বাউল সাধকদের ‘ক্ষ্যাপা বাউল’ বলে সম্বোধন করেন। ভাবের উন্মাদ অর্থেই পাগলা বা ক্ষ্যাপা শব্দের ব্যবহার হয়েছে। বাতুল শব্দের অর্থ উন্মাদ, পাগল ইত্যাদি। অন্য একটি অভিমতে বলা হয়, ‘বায়ু’ শব্দের সাথে ল-প্রত্যয় যোগ করে বায়ুল > বাউল শব্দের উৎপত্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যোগ সাধনায় শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বায়ুর অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে। তাই তো লালন শাহ বলেন,

    “হাওয়া রূপে এই দেহে আল্লা আসে আল্লা যায়”।

    তবে অনেকে মনে করেন, এই যে ‘বায়ু প্রকোপিত’ ভাবে বাউলদের চিহ্নিত করার পিছনে সাধারণের একটা অশ্রদ্ধা ও বাউলদের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। এর পিছনে অবশ্য রয়েছে বাউলদের গাঁজা সেবনের ইতিহাস। এ যেন সেই ছিলিমের ধোঁয়া (বায়ু) খেয়ে উন্মাদ হয়ে যাওয়া আর কি! তবে এই যে ‘হাওয়া’ বা ‘বায়ু’ একে লালন শাহ আরো অন্য সব গানেও ব্যবহার করেছেন। তাঁর ব্যবহৃত ‘হাওয়াদম’ শব্দটা এইভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে যেন তা পরমের সাথে, ‘দম’ (গাঁজা) এবং ‘হাওয়া’ যা ছিলিম দিয়ে মানুষ শরীরে প্রবেশ করে এই দুই এর মিলনের মাধ্যমে।

    “হাওয়া দমে দেখো তারে, তার আসল বায়না”।

    অপর মতে আরবি ‘আউল’ শব্দের সাথে সাথেই বাউল শব্দের উৎপত্তি। ইসলামের সুফিধারার একটি সাধক সম্প্রদায় ‘আউলিয়া’ নামে পরিচিত। অনেকে বলেন বৌদ্ধ সহজিয়ামতে ব্যবহৃত ‘ব্রজকুল’ থেকে ‘বাজুল’ এবং তা থেকেই ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি।

    বাউলমতের উদ্ভব সমন্ধেও নির্দিষ্ট কোন সাল-পঞ্জী বা কাল সীমানাও নির্ণয় করা যায় না। বাউল গানের কোন লিখিত রূপ না থাকার কারণে (কারণ বাউল গান গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মৌখিক ভাবে চলে এসেছে), তার ভাষা থেকেও কাল সীমানা নির্ণয় করা দুরূহ। বাউল মতের সাথে মিলন ঘটেছে বৌদ্ধ সহজিয়া, সুফি মত, বৈষ্ণব মত, নাথ পন্থা ইত্যাদির এবং সময়ের সাথে সাথে মিশ্রণও হয়েছে অনেক। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাঙলার বাউল ও বাউল গান’ বইতে বাঙলার বাউল ধর্মের উদ্ভব-বিকাশ-পরিণতি সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “আনুমানিক ১৬২৫ খ্রীষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া ১৬৭৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বাংলায় বাউল ধর্ম এক পূর্ণ রূপ লইয়া আবির্ভূত হয়”। বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব সম্পর্কে একটি প্রচলিত মত হল এই যে – শ্রীচৈতন্য পার্ষদ নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র নিম্ন শ্রেণীভুক্ত নেড়ানেড়িকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেন, এরাই পরবর্তীকালে বাউল মতবাদের ও সম্প্রদায়েড় জন্ম দেয়।

    আসলে এই বাউলদের উদ্ভব নিয়ে আলোচনা করতে হলে, সেই সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপ্টের কথাও মনে রাখতে হবে। খ্রীষ্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে রাজা গোপালদেব যখন পাল বংশ স্থাপন করেন, তখন বাঙলায় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রভাব তুঙ্গে এবং তা মূলত দুই শাখায় বিভক্ত ছিল – ব্রজজান ও সহজান। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচারে ও বঞ্চনায় অনেক নীচু ও অনঅগ্রসর শ্রেণীর মানুষ তখন সহজীয়া বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পরে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। ইসলামে ধর্মান্তরিত হলেও তাঁরা তাঁদের পুরানো ধর্মীয় ভাবনা ও অভ্যাস কিছুটা বজায় রাখেন। অর্থাৎ সহজীয়া বৌদ্ধধর্মের অনেক ছাপ এঁদের মধ্যে থেকে যায়। এরাই পরে পরিচিত হন ‘ফকির’ বা ‘নেড়া’র ফকির’ বলে। কারণ বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের মত এঁরাও মস্তক মুণ্ডন করতেন। সুফি মতবাদ দ্বারাও এঁরা অনেকটা প্রভাবিত ছিলেন এবং খানিকটা চৈতন্যদেব প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্ম দ্বারাও। অপরদিকে বঞ্চনা ও শোষণ সত্ত্বেও নীচু শ্রেণীর বা দরিদ্র লোকেরা যাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন না, তাঁরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিলেন এবং তাঁদের মধ্যেও থেকে গেল ব্যবহৃত তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের অভ্যাসগুলি। বৌদ্ধ থেকে বৈষ্ণব ধর্মে রূপান্তর চিহ্নিত করার জন্য তাঁদের ডাকা হত নেড়া-নেড়ি। বাউলরা মনে করেন যে, বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যই তাদের ধর্মের পরম পিতা এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’ পুস্তকে তাদের ধর্মের মূল বিষয় বস্তুর গোপন ইঙ্গিত আছে। বাউলদের পুরুষ-প্রকৃতি মিলনের রাধা-কৃষ্ণ তত্ত্বের সাথে বৈষ্ণবীয় রাধা-কৃষ্ণের অনেকটাই মিল আছে। মোটের উপর নেড়ানেড়ি ও বাউলদের মাঝখানে আছে বৈষ্ণব সহজিয়ামতের সাধক শ্রেণী। সাধন-সঙ্গিনী গ্রহন বৈষ্ণব সহজিয়া মতের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাউল ধর্ম সাধনার সাধন-সঙ্গিনীর স্থান আছে। গৃহীর মত যৌনতৃপ্তির জন্য নর-নারীর মিলন নয়, মিথুনাত্মক যোগ-সাধনায় অঙ্গ হিসাবে পুরুষ প্রকৃতির মিলন বিবেচিত হয়। উদার পন্থী ও যোগসাধক বৈষ্ণব সহজিয়ার সাথে ভ্রাম্যমান গোপনচারী এক শ্রেণীর মুসলমান ফকির সম্প্রদায়ের মিলন-মিশ্রণে বাউল নামধারী একটি স্বতন্ত্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এদের মূলমন্ত্র হল সহজ পথে আরাধ্যকে পাওয়ার সাধনা করা এবং এর জন্য তারা বেদ-কোরান, মন্দির-মসজিদ, নামাজ-উপাসনা ইত্যাদি শাস্ত্রীয় ধর্মের রীতি-নীতি বিরোধিতা করে। তাদের লিখিত শাস্ত্র নেই, মৌখিক গানের ভাষায় তাদের ধর্মের কথা প্রকাশিত হয়।

    ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বলেন, “বাউলের জন্ম ১৪শ শতাব্দীর শেষভাগে কি পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। বাউল জন্মগ্রহণ করেছে সিদ্ধা ও মুসলমান ফকির হতে। ১৬শ, ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে বাউল যথেষ্ট প্রবল ছিল”।

    বাউল ধর্মের উদ্ভব কোন একদিন বা কোন এক ব্যক্তির দ্বারা হয় নি। সমাজের উপরতলার মানুষের কাছে বঞ্চনা, শোষণ, লাঞ্ছনা পেয়ে সহজিয়ামতের বৈষ্ণব বৈরাগী এবং সুফিমতের মুসলমান ফকির সমাজ সমস্বার্থে ও সমসূত্রে একত্র হয়ে বাউল সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছে। তাই তো বাউল কবি বলেন,

    “তাহতে বাউল হইনু ভাই,
    এখন বেদের ভেদ বিভেদের
    আর তো দাবী দাওয়া নাই”।

    বাউল ধর্মের উৎস সম্পর্কে গবেষকেরা ভিন্নমত পোষণ করলেও একথা প্রকারান্তরে সবাই স্বীকার করেছেন যে, বাউল মতবাদ একটি নিরক্ষর সম্প্রদায় সৃষ্ট ও অনুসৃত সম্পূর্ণ লৌকিক ধর্মমত।

    মধ্যবিত্ত বাঙালী সম্প্রদায় দীর্ঘদিন বাউলদের প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করে এসেছে। বাউলদের প্রতি এই সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অনৈস্বীকার্য। এই কাজে তাঁর যোগ্য সহচর ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন যিনি নিজে দীর্ঘদিন বাউলদের নিয়ে চর্চা করেছেন। মূলত এই দুজনের নিরলস চেষ্টায় বাউলরা সেই প্রথম সমাজের নেকনজরে আসে এবং হয়তবা সম্প্রদায় হিসাবে তাদের আভিজাত্য কিছুটা বাড়ে। বাউলরা গান গেয়ে ‘মনের মানুষের’ সন্ধান করে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

    “দেখেছি একতার হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে
    মনের মানুষের সন্ধান করবার
    গভীর নির্জন পথে”।

    বাউলগান হিন্দু-বৈষ্ণব-বৌদ্ধ-নাথ-সুফি ভাবধারার মিশ্রণে এক স্বতন্ত্র মতবাদের অনুসারী, তবে ‘হিন্দু বাউল’, ‘মুসলমান বাউল’ কথাটিও চালু আছে। কিন্তু সবার উপরে বাউলদের কাছে সত্য মানুষ। এই ধর্ম সম্পৃক্ত হয়েছে উদারতায় ও মানবতায়। রবীন্দ্রনাথ একে ‘মানবধর্ম’ বলে ভূষিত করেছেন। তিনি লিখেছেন,

    “আমাদের দেশের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতম গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি। ---- এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করে নি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয় নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্য সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কন্ঠ মিলিছে, কোরান-পুরানে ঝগড়া বাধেনি”।

    রবীন্দ্রনাথ নিজের উৎসাহে প্নেক বাউল গান সংগ্রহ করেছিলেন এবং তাঁর লিখিত অনেকগানের মধ্যেও বাউল ভাবধারা ও সুরের ছাপ দেখা যায়। তিনি মনে হয় নিজেকে বাউল হিসাবে কল্পনা করতেন – তাইতো লিখেছিলেন,

    “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
    তাই হেরি তাই সকল খানে
    আছে সে নয়ন তারায়, আলোক ধারায়
    তাই না হারায়
    ওগো তাই হেরি তায় যেথায় সেথায় তাকাই আমি যেদিক পানে”।

    তা হলে এবার প্রশ্ন উঠতে পারে বাউলদের তত্ত্ব বা দর্শনটা আসলে কি? ওয়াকিল আহমেদ তাঁর বইতে ‘বাউল আন্দোলন’ বলে একটা অধ্যায় রেখেছেন। কিন্তু এই ভাবে কি সত্যই কোন আন্দোলন গড়ে উঠেছিল? মনে হয় না! কারণ যে কোন আন্দোলনের যা মূল দরকার সেই সংগঠন বলে কোন বস্তুই বাউলদের মধ্যে ছিল না। অনেকের মতে তারা জীবন যুদ্ধ থেকে পালানো এক সম্প্রদায়। তারা ভিক্ষা করে জীবন কাটায়, আত্মভোলা, উদাসীন, মরমি সাধক এবং অল্পেই সন্তুষ্ট। সমাজের নিম্ন বর্ণের ও পেশার তাঁতি, জোলা, যুগী নিজেদের সমাজের বন্ধন ত্যাগ করে বাউল হয়েছে। তারা অশিক্ষিত, গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েই তাঁর নির্দেশমত আধ্যাত্মিক সাধনা করে। বাউল ধর্মের মূল বৈশিষ্টই হল তাদের চিন্তা ভাবনার সরলতা ও ভাবপ্রকাশের আকুলতা। বাউলদের ভগবান ও সৃষ্ট রহস্য সমন্ধীয় বিশ্বাস কতকটা তান্ত্রিক ভাব দর্শনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এই বাউল ও তান্ত্রিক বিশ্বাস সবটা না হলেও অনেকটা বৈদিক দর্শন থেকে আলাদা। তন্ত্রের সাথে বাউলদের মূল পার্থক্য হল উভয়ের প্রেম বা ভালোবাসা বিষয়ক চিন্তাভাবনা। বাউলদের কাছে ভালোবাসা ও ঈশ্বর প্রায় সমগোত্রীয়। বাউলরা বৈদিক দর্শনের মত মেনে নিয়েছে যে ঈশ্বর এক ও নিরাকার। কিন্তু তার সাথে সাথেই নিজেদের মত করে নতুন দর্শনও গড়ে তুলেছে, যাকে বলে ‘মনের মানুষ’। শ্রী চৈতন্যের প্রেম বিষয়ক চিন্তাভাবনার অনেকটা ছাপ দেখা যায় বাউলদের মধ্যে। অবশ্য বাউলরা এর সাথেও নিজেদের মত করে দেহ সাধনাও জুড়ে দিয়েছে প্রেমের সাথে যেটা শ্রী চৈতন্য প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মে নেই। বাউলদের সাধনা মূলতঃ দেহ কেন্দ্রীক।

    বাউলদের গানে জন্ম ও মৃত্যু এই দুটি বিষয়েই বারবার ফিরে এসেছে। তারা ‘মনের মানুষ’ খুঁজে ফেরে জন্ম থেকে মৃত্যুতে, আর তাই তো তারা জন্ম ও মৃত্যুকে পৃথক করতে পারে না। এই যেন সেই নিরবিচ্ছিন্ন, প্রবাহমান অনুসন্ধান। আসলে বাউলরা কোন বুদ্ধিজীবি ব্যক্তি নয়, তবে তাদের ভিতর একটা প্রতিবাদী মন আছে যার প্রধান প্রতিবাদ শাস্ত্রাচারের বিরুদ্ধে। তারা শাস্ত্রাচার, লোকাচার উভয়কে অস্বীকার করে মানবিক আচারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। তারা দেহতত্ত্বের আধ্যাত্মিক সাধনা করে বলে মানবদেহ, মানব জমীন, মানব গুরু, মানব ধর্ম, মনুষ্যত্ব ইত্যাদির প্রতি অসীন মর্যাদা দিয়ে থাকে। জাতি-বর্ণ-বিত্ত-ভেদ মুক্ত মানবজীবন ও মানব সমাজই বাউলদের কাম্য। নিজেকে শুদ্ধভাবে গড়ে তোলাও বাউল সাধনার অঙ্গ, সেই অর্ন্তজীবন হবে লোভ-মোহ-ঈর্ষা-পাপমুক্ত। তাদের সাধনার মূল লক্ষ্য নিজের মধ্যেকার ‘অহং’কে ধ্বংস করা। কারণ এই ‘অহং’-ই ঈশ্বর বা ‘অটল’ প্রাপ্তির পথে প্রধান বাধা। বাউলের ঈশ্বর কোন কল্পিত স্বর্গলোকে বাস করেন না, তিনি বাস করেন মানুষের অর্ন্তলোকে। প্রেম-ভক্তির পথে দেহ সাধনার মাধ্যমে তাঁকে পাওয়া যায়। “যাহা আছে ভাণ্ডে তাহাই আছে ব্রহ্মান্ডে” এরূপ ধর্মদর্শন সামনে রেখে তারা কায়াসাধনা করে। এমন মৌলিক ধারণা পোষণ করার জন্য বাউলরা অবলীলায় শাস্ত্রাচার-বেদাচার-লোকাচারের বিরোধিতা করে। বেদ-কোরাণ ধর্মগ্রন্থ, মন্দির-মসজিদ ধর্ম প্রতিষ্ঠান, মক্কা-পুরী তীর্থস্থান, রোজা-নামাজ-যাগ যজ্ঞ ধর্মকর্ম সবই উপেক্ষা করে তারা। লালন তাই বাউলদের বেদের ভেদ বিভেদের দাবী থেকে বাইরে বলে অভিহিত করেছেন।

    লালন শাহ ‘সোনার মানুষ’ গড়ার প্রচেষ্টা করেন। “এমন মানব জীবন রইল পতিত চাষ করলে ফলত সোনা”। বাউলদের আরাধ্য ‘সোনার মানুষ’ মানব দেহে বাস করেন। বাউলদের মানব প্রেমে ঈশ্বরের কোন আড়াল নেই। নিজেকে জানলে তবেই পরমকে জানা যাবে। মানুষের মধ্যে ‘মানুষ রতন’ আছেন, তাই মানুষের মধ্যেই তাঁকে অনুসন্ধান করতে হবে। এক প্রেমিকের মতই ঈশ্বর বাউলের চিরসঙ্গী – বাড়ি থেকে মরুভূমিতে, অনুভব বা আকাঙ্কায়, জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত। তাইতো বাউলের গান খুঁজে ফেরে এর হাড় ও চামড়ার খাঁচায় বন্দী থেকেও মুক্তির উপায়। বাউল গোপীনাথের কথায়,

    “আগেতে মনে বুঝে দেখ না খুঁজে
    মানুষ আছে এই মানুষে।
    মানুষকে কে চিনতে পারে ও সে বেদের পারে
    প্রেম – নগরে বসত করে...”

    বাউলদের সম্পর্কে যে কোন আলোচনাই অসম্পূর্ণ থেকে যায় লালন ফকিরের (১৭৭৪-১৮৯০) আলোচনা ছাড়া। বাউলদের প্রধান সম্পদই হল গান। আর এ কথা মোটামুটি প্রমাণিত যে লালনের আগে বাউল গান রচিত হয় নি। লালন তরুন বয়স থেকেই গান রচনা শুরু করলে উনিশ শতকের প্রারম্ভ বাউল গানের উদ্ভব কাল বলে নির্ধারণ করা যায়। বাণীর ও সুরের বিবেচনায় তাঁর সমকক্ষ দ্বিতীয় বাউল ছিল না। তিনি প্রায় দু থেকে আড়াই হাজাত বাউল গান রচনা করেন। লালন-ই সর্বপ্রথম বাউলদের মুখে ভাষা দিয়েছিলেন গান স্বরূপ যা দিয়েই তাদের প্রতিবাদ, তাদের অন্বেষণ, তাদের সাধনার আশ্রয়। লালনকে কেউ বলেন ‘লালন ফকির’, কেউ বা ‘লালন শাহ’, কখনও বা তাঁকে ডাকা হয় ‘ফকির লালন শাহ’। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই ফকির উপাধির উৎপত্তি আরবী ‘ফিক্‌’ শব্দ থেকে যা ব্যবহৃত হয় কোন ব্যক্তিকে বোঝাতে যে দর্শনের গভীর জ্ঞান লাভ করেছেন অভ্যাস, ধৈর্য্য, অনুসন্ধান ও ত্যাগের মাধ্যমে।

    প্রত্যেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের মত লালনকে নিয়েও উপকথা গড়ে উঠেছে। তাঁর সমন্ধে অনেক কথাই অজানা, যেমন জানা যায় না তিনি হিন্দু ছিলেন নাকি মুসলমান। অবশ্য তিনি মারা যাবার পর তাঁকে যাথারীতি হিন্দু ও মুসলমান বানানোর পৃথক পৃথক প্রচেষ্টা বহুবার হয়েছে। যাই হোক উপকথা অনুযায়ী লালন কুষ্টিয়ার ভাঁড়ার গ্রামে এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি যৌবন বেলায় আত্মীয় ও বন্ধুদের সাথে একবার তীর্থযাত্রায় বের হয়েছিলেন। তীর্থ যাত্রা থেকে ফিরবার সময় তাঁকে গুটি বসন্ত আক্রমণ করে। তখন কার দিনে যার কোন চিকিৎসা ছিল না। রোগে কাবু হয়ে লালন অচৈতন্য হয়ে পড়লে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে মৃত ভেবে পথে ফেলে রেখেই চলে যায়। তখন এক অপুত্রক মুসলমান দম্পতি তাঁকে পড়ে থাকতে দেখেন। সেই মুসলমান রমণীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ও শুশ্রুষায় লালন ভালো হয়ে ওঠেন। অনেকে বলেন সেই গ্রামের পীরবাবার অলৌকিক ক্ষমতা বলেই লালনের জ্ঞান ফিরে আসে। রোগের ফলে লালন তাঁর সব পূর্বস্মৃতি ভুলে যান। যেহেতু গ্রামবাসী তাঁর ধর্ম সমন্ধে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে নি তাই তাঁকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করা হয় এবং তাঁকে সেই মুসলমান দম্পতি দত্তক গ্রহণ করেন। অনেক দিন ধরে এরপর লালন পীরবাবার কাছে ইসলাম ও সুফি ধর্ম সমন্ধে শিক্ষালাভ করেন। এরপর হঠাৎ তাঁর পূর্বস্মৃতি ফিরে এলে লালন তাঁর গ্রামে বাবা-মা ও স্ত্রীর কাছে ফিরে যান। কিন্তু তাঁর বাবা-মা তাঁকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেন, এমন কি তাঁর স্ত্রীও তাঁর নতুন ধর্ম বা নতুন জীবন অস্বীকার করে তাঁর সাথে আসতে রাজী হন না। তখন লালন পুনরায় তাঁর পালক মাতার কাছে ফিরে যান। পীরবাবাকে গুরু মেনে তাঁর দীক্ষা নিয়ে ধর্মসাধনা করেন। প্রায় শতাধিক বছরের আয়ূ নিয়ে তিনি স্থানীয় ভাবে বাউল সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেন। তাঁর প্রায় দু হাজার শিষ্য এবং প্রায় দশ লক্ষ ভক্ত অনুসারী ছিল। তিনি বাউল ধর্ম ও সাধনা আয়িত গান রচনা করে এবং গেয়ে বাউল মতবাদের প্রথম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি প্রদান করেন।

    বাউলদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল গান। বাউল ও বাউল গান প্রায় অভিন্ন সত্ত্বা। ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে বাউলরা গান গেয়ে ধর্মপালন করে। তারা তাদের ধর্ম চিন্তা, সাধনা ও জীবনের কথা গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে। কারও কারও মতে, গান রচয়িতা বাউলের সংখ্যা তিন শতের অধিক। যেহেতু বাউলরা গান গেয়েই ধর্মপালন করে, তাই বাউল গান তত্ত্বভিত্তিক। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে নানা ধর্মের স্রোতধারা বাউল ধর্মমতে এসে মিলেছে; মূলত সেই কারণে নানা তত্তের সমাহার ঘটেছে বাউল গানে। বাউল গানের ভাব ধারা বিশ্লেষণ করে ওয়াকিল আহমেদ প্রধান সাতটি তত্ত্বের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেনঃ

    ১। আত্ম তত্ত্ব
    ২। দেহ তত্ত্ব
    ৩। গুরু তত্ত্ব
    ৪। পরম তত্ত্ব
    ৫। প্রেম তত্ত্ব
    ৬। সাধন তত্ত্ব
    ৭। সৃষ্ট তত্ত্ব

    বাউলরা মানব জন্মকে অসীম গুরুত্ব দেয়। তাদের বিশ্বাস, “কত ভাগ্যের ফলে না জানি, মনরে পেয়েছে এই মানব তরণী”। এই মানব জন্মকে বৃথা যেতে দেওয়া যায় না। লালনের ভাষায় দেহ হল খাঁচা, এই খাঁচার ভিতর ‘অচিন পাখি’ যাতাযাত করে। সে সহজে ধরা দেয় না। ‘মনো-বেড়ি’ দিয়ে ‘অচিন-পাখিকে’ বাঁধার বাসনা লালন পোষণ করেছেন।

    “আপনারে আপনি চেনা যদি যায়
    তবে তারে চিনতে পারি সেই পরিচয়
    উপরওয়ালা সদর বাড়ি,
    আত্মারূপে অবতারি
    মনের ঘোরে চিনতে নারি
    কি সে কি হয়...”

    বাউলদের অন্বেষণ শুরু হয় নিজেকে দিয়ে। তারা আপনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকা ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে চায়।

    “ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়
    আপন ঘর না বুঝে বাহির খুঁজে পড়বি ধাঁধায়
    আমি সত্য না হইলে
    হয় গুরু সত্য কোন কালে;
    আমি যেরুপ দেখ না সেরূপ দীন দয়াময় ...”

    বাউলদের সাধনার দুটি মুখ্য রীতি - জ্ঞানমার্গীয় যোগসাধনা আর মিথুনাত্মক যোগসাধনা। বাউলরা অনেকটা সহজিয়ামতের অনুসারী, কিন্তু বাউল তত্ত্ব সহজে বোঝা যায় না। বাউলরা দেহবাদী আধাত্মসাধনা করে। এপারের দেহতরীকে ওপারে নিয়ে যাওয়ার কান্ডারী হলেন গুরুই। সাধন-সঙ্গিনী হিসাবে নারী সংসর্গ এবং যোগ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নারী সম্ভোহ বাউলধর্মে স্বীকৃতি পায়। তন্ত্র ও সহজীয়া উভয় মতেই নর-নারীর দেহ মিলনকে ধর্মসাধনার সোপান রূপে গণ্য করা হয়। বাউলরা আধ্যাত্ম প্রেমাস্বাদের জন্য দেহজ প্রেমকে গ্রহণ করে যৌনাচরণে স্বাধীনতা নিয়ে আসে। এই খানেই বাউলরা প্রচলিত ধর্মের থেকে পৃথক মত নিয়ে আসে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা পাপ হিসাবে দেখে। সেখানে অনেকক্ষেত্রেই নারীকে তার যোগ্য না প্রাপ্য মর্যাদাটুকু না দিয়ে কেবলমাত্র যৌনতার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হত। বিধবরা জীবনের অনেক অধিকারের সাথে যৌন অধিকারো হারাত। এই সময়ে বাউলরা দেহ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নর-নারীর মিলন ও সঙ্গমকে ধর্মীয়ভাবে বৈধ করে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় ও নৈতিক চেতনার বিরোধিতা করে। আধ্যাত্ম প্রেমের জন্যই দেহ-প্রেম; স্বয়ং গুরু এ-প্রেমের নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে গুরুর উপস্থিতিতে মিলন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

    “আমার দেহ-জমি আবাদ হইল না
    গুরুর বীজ বুনতে পারলাম না।
    ও বীজ বুনতে পারলে হত কামরাঙ্গা ফল
    পুষ্ট হত দানা...”

    বাউলের দেহ মিলন সামজিক মানুষের দেহমিলনের মত নয়। বিশেষ সময়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুরুষ-প্রকৃতির মিলনকে বাউলের ধর্মাবিধিতে বৈধ করা আছে। বিশ শতকের গোড়ায় যে ‘বাউল ধ্বংস আন্দোলন’ হয় তাতে অন্যতম অভিযোগ ছিল বাউলরা ধর্মের নামে অবাধ যৌনলীলা ও নানা বিধ অশ্লীল আচার আচরম করে। বাউলরা বলে তাদের সকাম প্রেম সাধনার লক্ষ্য নিষ্কাম প্রেমসাধনায় উত্তীর্ণ হওয়া। যৌন ব্যাপারে বাউলদের কোন পাপবোধ ছিল না। তবে একথাও ঠিক যে এই যৌন স্বাধীনতার কারণেই অনেক তরুণ ও যুবক বাউল মতে আকৃষ্ট হয়। দেহবাদী যোগ সাধনা অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী। বাউল্রা আপ্তনাশের মাধ্যমে ‘দশম দশা’ অর্থাৎ ‘জ্যান্তে-মরা’ পর্যায়ে উন্নীত হয়, আর তখনই চিদানন্দ বা পরমাত্মার আস্বাদন সম্ভব হয়।

    বাউল মতে তান্ত্রিক যোগ সাধনার প্রভাব আছে অনেকটাই। তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই গানে পাওয়া যাবেঃ

    “আউয়ালে হয় দুই দল শুনি।
    দুই দলে দুই জনে মিলে,
    তাইতে উদয় দিনমণি।
    ষোলদল দুই দলের পরে,
    অষ্ট দল মন সরোবরে,
    তার উপর সাঁই বিরাজ করে
    শতদল পদ্মেতে সুরধনী
    অধঃ ঊর্দ্ধ মেঘের পোড়া,
    তিন শত ষাইট সে পদ্মের জোড়া;
    ধরে আছে পদ্মের গোড়া
    ও তার সম্মুখ ঘাটে বৈতরণী”।

    এই গানের তাত্ত্বিক ভিত্তি তান্ত্রিক ষট্‌চক্র; ‘চক্র’ বিভিন্ন দল বিশিষ্ট পদ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। সুষুন্না কে কেন্দ্র করে ইড়া ও পিঙ্গল নাড়িদ্বয় মেরুদণ্ড সংলগ্ন অবস্থায় জড়াজড়ি করে আছে। পদ্ম চক্র এই নাড়ি ত্রয়কে কেন্দ্র করে শরীরে এক এক স্থানে অবস্থান করছে। মানব দেহের চক্রগুলোর অবস্থান এরূপঃ মূলধার – লিঙ্গমূল, স্বাধিষ্ঠান – তলপেট, মনিপুর – নাভিমূল, অনাহত – হৃদয়, আজ্ঞা – ভ্রূ-মধ্য, ওঁ – মস্তক। অরবিন্দ ঘোষের অনুসরণে চক্রের ক্রিয়াগুলো হলঃ

    1.The Muladhara governs the physical down the subconscient
    2.Swadhistan governs the lower vital
    3.Manipura governs the larger vital
    4.Anahat governs the emotional being
    5.Visuddha governs expressive and externilising mind.
    6.Ajna chakra governs the mind, will, vision, mental formation

    অনেক বাউল গান আছে যেখানে সাধন তত্ত্ব ও সাধন রীতির কথা সরাসরি বলা হয়েছে। আবার কতক গানে সাধনার রীতি পদ্ধতির গুহ্য কথা, সেই পথের জটিলতা, অনিশ্চয়তা, রহস্যময়তা ইত্যাদি বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। লালনের ভু গানে দেহবাদী, গুরুবাদী যোগ প্রণালীর গুপ্ত-ব্যক্ত তত্ত্ব কথা বলা হয়েছে। তবে বাউলরা বিশ্বাস করে যে, “আপন সাধন কথা, না কহিবে যথা তথা”। যারা সেই সাধনার একটু আভাস পেতে চান তাঁরা শক্তিনাথ ঝা র ‘বস্তুবাদী বাউল’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। বাউলদের যে গোপন সাধনাটি নিয়ে বারবার নানা জায়গায় আলোচনা দেখা যায় তা হল ‘চারিচন্দ্র ভেদ’ প্রক্রিয়া। অনেক বাউল গানে এর উল্লেখ আছে, যেমন,

    “চারটি চন্দ্র ভাবের ভুবনে।
    ও তার দুটি চন্দ্র প্রকাশ্য হয়,
    তাই জানে অনেক জনে।
    যে জানে সে চন্দ্র-ভেদ কথা,
    বলবো কি তার ভক্তির ক্ষমতা,
    সে চাঁদ ধরে পার চাঁদ অন্বেষণ
    সে চাঁদ না কেউ পায় গুণে”।

    এখানে উল্লিখিত চারটি চন্দ্র হল – শুক্র, রজঃ, বিষ্ঠা ও মূত্র। দেহ নিঃসৃত এই চার পদাত্থকে প্রতীকের ভাষায় ‘চারি চন্দ্র’ বলে। দেহ তত্ত্ব সাধনায় ‘চারি চন্দ্রভেদ’ পদ্ধতির বিশেষ গুরুত্ব আছে। অনেকে মনে করেন যে, এই চারি চন্দ্র ভেদ তত্ত্ব দ্বারাই বাউল গণ অন্যান্য উপাসক সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন। আর একটি গানের উল্লেখ করে দেহ তত্ত্বের প্রসঙ্গ শেষ করব।

    “কোন রসে কোন রতির খেলা
    জানতে হয় এই বেলা
    সাড়ে তিন রতি বটে
    লেখা যায় শাস্ত্র পাঠে
    সাধ্যের মূল তিন রস ঘটে
    তিনশ ‘ষাট রসের বালা।
    ............
    রস রতির নাই বিচক্ষণ
    আন্দাজে করি সাধন
    কিসে হয় প্রাপ্ত কি ধন
    ঘোচে না মনের ঘোলা
    আমি উজাই কি ভেটেল পড়ি
    ত্রিপিণীর তীর নালা।
    শুদ্ধ প্রেম রসিক হইলে
    রসরতির উজান চলে
    ভিয়ানে সদ্য ফলে অমৃত মিছরি ওলা।
    লালন বলে, আমার কেবল
    শুধুই জল তোলা ফেলা”।

    এখানে ‘ভেটেল’ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বাউলদের দেহতত্ত্বে জোয়ার-ভাটার রূপক আছে। জোয়ার- ভাটা আঞ্চলিক ভাষায় উজান-ভেটেল। এর যোগ তান্ত্রিক নিহিতার্থ সম্পর্কে সিরাজুদ্দিন কাসিম পুরী বলছেন, “উজান শব্দের অর্থ –রতিক্রিয়ার সময় বীর্যেস ঊর্দ্ধগমন ক্রিয়ার অভ্যাস গঠন। এই অভ্যাস বদ্ধমূল হইলে অর্থাৎ বীর্যের ঊর্দ্ধগমন অভ্যস্ত ও স্থিতি হইলে সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়ে থাকে। ইহাতে শারিরীক ও মানসিক শক্তি খুব বৃদ্ধি পাইয়া মানুষ্কে দান করে পূর্ণ মানুষ হওয়ার শক্তি সামর্থ্য। ‘ভেটেল’ – এই পথে বা ক্রিয়ায় বীর্যপাত হয়, সন্তান জন্মে, - সিদ্ধি হয় না, অর্থাৎ ঊর্দ্ধরেতা হওয়া যায় না। সিদ্ধ গুরুর নিকট এই ‘উজান-ভেটেল’ সাধন প্রক্রিয়া শিক্ষা করতে হয়”।

    লেখে বেশ বড় হয়ে গেল। প্রবন্ধ শেষ করব বাউলদের কাছে গুরুর অবস্থান সমন্ধে কিছু আলোচনা করে। বাউল সাধকদের কাছে গুরুর স্থান খুব উঁচুতে। কারণ বাউল মতবাদ গুরুবাদী, গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ ও গুরুর নির্দেশ মত সাধন-ভজন ব্যতীত বাউল হওয়া যায় না। গুরু সিদ্ধ পুরুষ – তিনি ঈশ্বরকে জানেন। সুতরাং গুরুর কাছে শর্তহীন আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। গুরু সম্পর্কে বাউলদের ধারণা হলঃ

    ১। গুরু সিদ্ধ পুরুষ
    ২। গুরু ধরে তাঁর কাছে দীক্ষা নিতে হয় ও তাঁর নির্দেশ অনুসারে সাধনা করতে হয়
    ৩। গুরুর চরণাশ্রয় বাউলের একান্ত কাম্য, কারণ তিনিই মুক্তিদাতা
    ৪। গুরু পূজ্য, তিনি পরমাত্মার সন্ধান পেয়েছেন, তিনিই শিষ্যলে পরমাত্মার সন্ধান দেবেন
    ৫। বাউলেরা মানব-গুরু আর দেব-গুরু অভিন্ন ভাবে দেখে।

    তাইতো বাউলরা বলে,

    “মন, তুমি গুরুর চরণ ভুল না।
    গুরু বিনে এ ভুবনে পারে যাওয়া ঘটবে না”।

    কিংবা,

    “মুরশিদের চরণ সুধা
    পান করিলে হরে ক্ষুধা
    কোরো না দেলে দ্বিধা
    যেহি মুরশিদ সেহি খোদা”।

    কিংবা,

    “মন মাঝি তুই গুরু নামে কষে ধর হাল
    ওরে ভবসাগর পারি দিতে গুরুর মতো নাই দয়াল”।

    বাউলদের জানার প্রধান উপায় হল বাউল সঙ্গ করা। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও বীরভূমেই বাউল বেশী দেখা যায় – এটাই মূলত বাউলদের চারণভূমি। একথা ঠিক যে বাউলের প্রসার আর আগের মত নেই, তবুও তারা মৃতপ্রায় নয়। বাউলরা বৈরাগ্যপন্থী তাই বাউল গানের প্রধান সুরও করুণ। উদাসী বাউল তার সর্বস্ব ত্যাগ করে একাকী ‘মনের মানুষের’ সন্ধান করে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। এই প্রবন্ধে আমি যেটা নিয়ে আলোচনা করি নি সেটা হল তথাকথিত বাণিজ্যিক বাউলদের কথা। বাউলগান এখন পণ্যপ্রায় – সামাজিক সমস্যা, প্রতিবাদের অস্ত্র হিসাবে এখন বাউল গান রচিত হচ্ছে! বলাই বাহুল্য এর সাথে প্রকৃত বাউলের সম্পর্ক খুবই কম। তাই হয়ত পরের বার আপনি গেরুয়াধারী, একতারা হাতে বাউলটাকে দেখে চিন্তা করবেন যে সে আসল না নকল! আমি বলি কি অত না ভেবে তার গান শুনুন, হয়ত সে তখন গাইছে,

    “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,
    লালন ভাবে জেতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে
    কেউ মালা কেউ তসবি গলায়
    তাইতেরে জাত ভিন্ন বলায়
    যাওয়া কিংবা আসার বেলায় জেতের চিহ্ন রয় কারে”।

    তথ্যসূত্র

    ১। বাউল গান – ওয়াকিল আহমেদ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা
    ২। বস্তুবাদী বাউল – শক্তিনাথ ঝা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ
    ৩। বাউল ফকির কথা – সুধীর চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ
    ৪। বাউল- ফকির পদাবলী, শক্তিনাথ ঝা সম্পাদিত, মনফকিরা
    ৫। বাউলের গানের ভেলা – লীনা চাকি, পুনশ্চ
    ৬। The mirror of the sky – songs of the Bauls from Bengal, by Deben Bhattacharya
    ৭। Article named, “Bouls of Bengal” by Gautam Sengupta
    ৮। Article named, “Bauliana: The Quest for Universal Agnostic Monotheism,” by Mausoodul Haque
    ৯। Article named, “The Bauls of Bengal”, by Robert Menger.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৬ মার্চ ২০১৪ | ৩৭০৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    এসো - Rashmita Das
    আরও পড়ুন
    এসো - Rashmita Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • udvranto | 127.194.88.151 (*) | ১৬ মার্চ ২০১৪ ০২:৪৮73673
  • http://www.baularchive.com/

    কাজে লাগা উচিত। অদিতি সরকারের কাজ।
  • সুকান্ত ঘোষ | 212.160.18.142 (*) | ১৬ মার্চ ২০১৪ ০৮:৫১73672
  • অনেক কিছু লেখার ছিল - অনেক কিছুই লেখা হল না। বেশ কিছুদিন আগের লেখা। তবুও লেখাটা বড় হয়ে গেল, জানিনা পড়তে গেলে কারো ধৈর্য থাকবে কিনা!
  • sosen | 111.63.192.46 (*) | ২৩ মার্চ ২০১৪ ০৫:২৬73674
  • আরো বড় হলেও ক্ষতি নেই তো। বরং আরো বিশদে লিখুন।
  • পলাশ চন্দ্র সূত্র ধর | 138.199.136.5 (*) | ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০৪:১১73675
  • নমস্কার ঔ জয় গুরু ও দয়াল গুরু কৃপায় কেবলম্।আমার খুভ ভাল লেগেছে গুরু দেব।যদি দয়া করে আরো গভীর জগতের কিছু কথা লিখেন তা হলে আরো খুশি হোতাম আদ্বাতিক দেহ তত্ত্ব ও গুরু তত্ত্ব, জ্ঞেয়ান তত্ত্ব,, গরর্ভের তত্ত্ব, আমি কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম আবার জানি কোথায় যাই গুরু আমার দেশের খবর জান্তে চাই।।
  • ন্যাড়া | 172.233.205.42 (*) | ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০৫:২৯73676
  • কেয়াবাত। ঘোষবাবু তো ফাটায়ে দিসেন!
  • san | 113.240.239.216 (*) | ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০৬:২২73677
  • ভাল লাগল , আরো পর্ব লিখুন না !
  • Tim | 188.91.253.22 (*) | ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০৭:৩৬73678
  • বেশ প্রাঞ্জল লেখা। সুধীর চক্রবর্তীর গভীর নির্জন পথে পড়েছিলাম, আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া গেল। আরো লিখুন
  • Atoz | 161.141.84.175 (*) | ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০৮:৫৮73680
  • ব্রাহ্ম কিনা!
  • b | 135.20.82.164 (*) | ২২ এপ্রিল ২০১৫ ০৯:৪০73679
  • সুধীরবাবুর লেখায় এ-ও পড়েছিলাম যে, বাউল সাধনায় ঐ মনের মানুষ, প্রাণের মানুষ ইত্যাদি শব্দ সবই কোন না কোন যৌন সাধনার নির্দেশিত করে। রবীন্দ্রনাথ সেটাকে ব্রহ্মের সাথে এক করে দেখেছেন।
  • Somnath Roy | 125.118.72.238 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ১১:৪৫73681
  • সুন্দর লেখা।
    কটি সংযোজনা-
    বজ্রযান > বাজিল> বাউল এইরকম একটা রুটের কথা অনেকে বলেন।
    বৌদ্ধ তন্ত্রের সঙ্গে বাউলতত্ত্বের মিল নেহাৎ আপতিক তো নয়ই, জাস্ট প্রভাবিতও হয়তো নয়। তিব্বতি মহাযোগী মিলেরোপা (সম্ভবতঃ) কিছু পদ পড়েছিলাম, সেগুলি প্রায় বাউল গান মনে হয়।
    আমি চর্যাপদের কিছু আজকের বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম, তার একটা এখানে দিচ্ছি
    যারে যায় না বোঝা যায় না পাওয়া রে
    কি আক্কেলে মানবি রে তারে?
    দেখ না চেয়ে তোর ঐ বিজ্ঞান
    দেয় শ্লেষ্মা-বায়ু-পিত্তে কি জানান?
    যার চিহ্ন-রূপ ও বর্ণ জানা নেই
    বল ভেদ-জ্ঞানে কি পড়বে ধরা সেই?
    প্রশ্ন আমার কোনটা কী তাই বল
    জলেতে চান্দেরই ছায়া, সত্য না কি ছল-
    তাই বলে যে লুই ভাবব কাকে আর!
    যা নিয়ে মেতেছি আমি নেই রে হদিশ তার-

    -------------
    - ভাব ন হৈ অভাব ণ জাই।
    অইস সংবোহেঁ কো পতিআই ।।
    লুই ভণই বঢ় দুলকুখ বিণাণা।
    তিঅ ধাএ বিলসই উহ লাগে ণা ।।
    জাহের বাঞ্চিহ্ন রূব ণ জাণী।
    সো কইসে আগম বীঁ বখাণী।।
    কাহেরে কিস ভণী মই দিবি পিরিচ্ছা।
    উদক চান্দ জিম সাচন মিচ্ছা।।
    লুই ভণই মই ভাবই কীস।
    জো লই অচ্ছম তাহের উহ ণ দিস।।

    আরেকটা অন্য কথা-- সুফি, তুর্কি মরমিয়া ও দেহবাদী সাধনারও বিশেষ ভূমিকা আছে বাউল-চর্যায় সম্ভবতঃ
  • Somnath Roy | 125.118.72.238 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ১২:০৮73682
  • সুধীরবাবু, শক্তিনাথ ঝা দুজনই বেশ ক্যাটেগরিকালি বারণ করেছেন দাদুর পথে হেঁটে বাউল-এর মানুষতত্ত্বকে মানবতাবাদী প্রকল্প হিসেবে ভাবতে।
    চন্ডীদাসের নামে চলে আসা সবার উপরে মানুষ সত্য-র পুরো পদটাও যদি পড়েন, দেখবেন সেও আদতে কায়াসাধনের কথা।
  • সুকান্ত ঘোষ | 129.160.188.156 (*) | ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ১২:৩৫73683
  • সকলকে ধন্যবাদ পড়ার আর আরো বেশী তত্থ্য যোগানোর জন্য।

    ন্যাড়াদা, কোথায় আবার ফাটতে দেখলেন!

    সোমনাথবাবু,
    আপনি ঠিকই বলেছেন - বাউল শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কিত অমন একটা রুট আছে বটে। খোঁজ নিয়ে পেলাম যে, ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে রমেশ বসু এক প্রবন্ধে বাজুল, বাজিল শব্দ থেকে বাউল শব্দের উদ্ভব নির্দেশ করেছেন। এর পরে আহাম্মদ শরীফ, এস এম লুৎফর রহমান প্রমুখ অনেকে ব্জ্রী, ব্জ্রস্তত্ব, ব্রজধর অথবা ব্রজকুল থেকে বাউল শব্দের উদ্ভব ব্যাখ্যা করেছেন।
  • Lama | 160.129.64.123 (*) | ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৫:৫৭73684
  • মোটেই বেশি বড় হয়নি। আরো বড় হলেও অসুবিধা ছিল না। বরং সীমিত জায়গার মধ্যে অনেক তথ্য বোধগম্যভাবে দিয়েছিস। আরো লেখ এ বিষয়ে। যত তাড়াতাড়ি পারিস।
  • তাশরীফ | 69.152.98.162 (*) | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩১73685
  • আদমতত্ত্ব নিয়ে কিছু তথ্য দরকার
  • Ratam | 212.134.11.146 (*) | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:৩৮73687
  • Ki r likhi- chari chondraer ajob bekhkha....
    Boi pori kom kintu net dekhi..... apni ato boi pore kisu kotha likhlen..... tate ki holo??? Bauler ejjot gelo....ai r ki.
    Amon manob jonom r ki hobe...... gan ti 'ved rup'
    Ja likhlen.... Allah malum. Jinuk chinen??? Jinuke mukta hole ....mukh na ki bondho rakhe.... Janen???
  • Ratam | 212.134.11.146 (*) | ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:৩৮73686
  • Ki r likhi- chari chondraer ajob bekhkha....
    Boi pori kom kintu net dekhi..... apni ato boi pore kisu kotha likhlen..... tate ki holo??? Bauler ejjot gelo....ai r ki.
    Amon manob jonom r ki hobe...... gan ti 'ved rup'
    Ja likhlen.... Allah malum. Jinuk chinen??? Jinuke mukta hole ....mukh na ki bondho rakhe.... Janen???
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন