এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • আকর্ষ

    ইন্দ্রাণী লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | ২১৭০ বার পঠিত


  • বিকেলের হাওয়া বইছিল রেলব্রিজের ওপর - দু হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে আঁচল সামলাতে নাজেহাল হচ্ছি। স্কুল ছুটির পরে বাজার হয়ে বাড়ি ফেরা এখন নিয়মের মত। ভারি বাজার তো নয়-টুকটাক -একটু আলু, পেঁয়াজ, ধনে পাতা, দুটো ডিম হয়ত। সকালে মাছটা এনে দেয় বাবুলাল; চাল ডাল মাসকাবারি বাড়িতে দিয়ে যায় গোপীর দোকান থেকে। দু'দিন হ'ল বাবুলাল এখানে নেই। কবে আসবে জানি না। তবু ক'টা ডিম নিলাম আজ - রাতের দিকে যদি আসে ; তারপর ফুলকপি কিনতে গিয়ে দুহাতে ব্যাগ হয়ে গেল। বাড়ি দূরে নয়, কাছেই। এই তো রেলব্রিজ পেরোলেই বাজার, শনিমন্দির, তার পাশেই রিক্সা স্ট্যান্ড। রিক্সা নিলে হয়। রিক্সা স্ট্যান্ড পেরিয়ে নেতাজীর স্ট্যাচুর বাঁ হাতে জয়গুরু মিষ্টান্ন ভান্ডারের পাশের গলিতেই আমার বাড়ি। এই টুকু হাঁটা। কপালের ঘামের ওপর হাওয়াটুকু ভালো লাগছিল। রিক্সার ঘেরাটোপে তো হাওয়া ঢোকে না। হেঁটেই এলাম। গেটের সামনে এসে ব্যাগ নামালাম। ঘাড় টনটন করছিল। কাঁধের কাছটা শক্তমতো -ছাড়িয়ে নিতে মাথা ঘুরিয়েছিলাম দুপাশে, নিচে, তারপরে ওপরে। অনেকদিন পরে বিকেলের আকাশে চোখ গেল। হাল্কা সাদা মেঘের ওপর একখন্ড কালো মেঘ, তার ফাঁক দিয়ে বিকেলের রোদ-হাওয়ায় হাওয়ায় কালো মেঘে মুখ তৈরি হল, তারপর নাক, কোঁকড়া চুল- যেন মোমের আলোয় উত্তমকুমার ওথেলো হ'ল, তারপর হাত দিয়ে আড়াল করে চুমু খেলো সুচিত্রা সেনকে। তারপর আবার বাতাস বইল। উত্তমকুমার কুঁজোমত বুড়ো মানুষ হয়ে গেল তারপর উট। তালা খুলে ঢুকতেই দেখি কালীচরণ বারান্দায় ল্যাজ নাড়ছে - সামনের থাবায় ভর দিয়ে গ্রিলে মুখ রেখে আমাকে দেখছে। একবার মুখ উঁচু করল- হয়ত গন্ধ শুঁকল আমার না কি ও ও আকাশ দেখল - যেন বুঝতে চাইল তালা খুলতে কেন পাঁচ মিনিট দেরি হল আমার।

    কালীচরণকে এনেছিল সুপ্রকাশ। সুপ্রকাশ আমার দ্বিতীয় বর। আমার প্রথম বরের কথা আমার স্কুলে শ্যামলীদি ছাড়া কেউ জানে না। পঞ্চাশ বছরের ভূগোল দিদিমণির বিয়ের ইতিহাসে কারই বা কৌতূহল থাকবে? সুন্দরী টুন্দরী হলেও কথা ছিল। আগ বাড়িয়ে এসব বলার মত আমার তো কেউ ছিলও না। একবার শ্যামলীদিকে বলেছিলাম প্রথম বিয়ের কথা। বলে ফেলেছিলাম আর কি। শ্যামলীদি আমার স্কুলেই অঙ্কের দিদিমণি। স্কুলের মেয়েদের নিয়ে শান্তিনিকেতন গিয়েছি একবার - সুপ্রকাশের সঙ্গে বিয়ে বেশিদিন হয় নি তখন। আশ্রম, শ্রীনিকেতন, কোপাই, কঙ্কালীতলা- দু দিনের ট্রিপ। আমি আর শ্যামলীদি এক ঘরে। রাতে খুব জ্বর এলো আমার, মাথা ব্যথা-শ্যামলীদি ওষুধ দিলো, মাথা টিপে দিল, উঠে উঠে জ্বর দেখছিল সারা রাত। জ্বরের ঘোরে আমার মনে হল-এমন সেবা আর তো কেউ আমাকে করে নি কোনদিন। বেড়াতে গেলে , একসঙ্গে পাশাপাশি দুদিন থাকলে, একটু আধটু গোপন কথা হয়েই যায়। একবার তো কি হয়েছিল - কলেজে পড়ি - দীঘায় গিয়ে শান্তশ্রী , দেবীকা আর আমি এক ঘরে- সারা রাত ধরে গল্প-শেষ রাতে শান্তশ্রীর হাউ হাউ করে কান্না- পিসতুতো দাদার কথা , তার বিদেশ চলে যাওয়া, যাওয়ার আগে মেরি স্টোপস না কোথায় গিয়ে অ্যাবরশন - ভোর হতে চোখ টোখ মুছে আবার সবার সঙ্গে হই হই-সমুদ্র, বালি, ঝিনুকের মালা টালা। কলকাতায় ফিরে আর কোনদিন কথা হয় নি এই নিয়ে। শান্তিনিকেতনে ঐ জ্বরের রাতটাও সেরকম ছিল। শ্যামলীদি কপালে হাত দিয়ে তাত মাপছে, আমার কি মনে হ'ল, হাত ধরে বললাম,
    -' শ্যামলীদি, আমার আগেও একটা বিয়ে ছিল'।
    শ্যামলীদি চোখ কুঁচকে থার্মোমিটার দেখতে দেখতে বলেছিল, 'ওমা, কী কথা! ভুল বকছিস না কি!
    -'না গো, সত্যি আগে একবার বিয়ে করেছিলাম। পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম, জানো? মন্দিরে মালা বদল, সিঁদুর পরা এইসব-কাগজপত্রে সই সাবুদ , সাক্ষী টাক্ষী হয় নি কিছু-কানপুরের দিকে কোথাও বাড়ি ছিল ছেলেটার। ওরা কপূর। ভিকি কপূর। আমাদের পাড়ায় ভাড়া থাকত, খুব সুন্দর দেখতে। বাইকে ঘুরত কলেজের সামনে। কানপুর চলে যাই ভিকির সঙ্গে। আসল চেহারাটা তখন দেখলাম। আগে কিছুই বুঝি নি। সাঙ্ঘাতিক অত্যাচার করত। রেপই একরকম। মাস দুয়েক ছিলাম। তারপর পালাই।'

    কথাগুলো সে'রাতে খুব সহজে বলেছিলাম। গলা বুজে আসে নি। চোখ টোখও শুকনো ছিল। শ্যামলীদি জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়েছিল-'সুপ্রকাশের সঙ্গে বিয়ে কি তারপরেই? সম্বন্ধ করে?'
    আমি তখন চুপ করে গিয়েছিলাম। নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল- কেন বলতে গেলাম!
    শ্যামলীদি বুঝেছিল । কপালে হাত রেখে বলেছিল, 'আর কথা বলতে হবে না, ঘুমো।'
    পর্দার ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো বিছানায় পড়েছিল, শ্যামলীদির হাল্কা নাক ডাকা শুনতে পাচ্ছিলাম।

    আসলে কানপুর থেকে পালিয়ে আসার পর মা বিয়ের চেষ্টা শুরু করে। মা ছিল সরকারী হাসপাতালের নার্স-সুপ্রকাশের সঙ্গে মা'র আলাপ ঐ হাসপাতালেই। কি সব ব্যব্সা করত সুপ্রকাশ -মা বলেছিল, 'ছোটো ব্যবসা-ওষুধ বিষুধের, অল্প বয়স, আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে যাবে। কলকাতায় নিজের বাড়িঘর নেই, এই বাড়িতেই থাকবে সুপ্রকাশ। কথা হয়ে গেছে।' আমিও জানতে চাই নি। ততদিনে আমার চাকরি হয়ে গেছে গার্ল্স স্কুলে আর ভিকি কাপুরের কাছে টানা দু'মাস রেপড হতে হতে ভোঁতা হয়ে গিয়েছে শরীর আর মন। তবু জানতাম, আবার বিয়ে করতেই হবে , মা তো থাকবে না চিরকাল। একা থাকবার সাহস আমার ছিল না। বিয়ের আগে সুপ্রকাশ একদিনই এসেছিল বাড়িতে-লম্বা চুল ঘাড় অবধি, হাসি মুখ। শ্রীখোল কোলে নিয়ে কন্ঠী গলায় যেন এখনই গেয়ে উঠবে, 'মাআধব' -এইরকম মনে হয়েছিল প্রথমদিন। ওরও আগে বিয়ে হয়েছিল একবার। এক বছরের মধ্যে বৌ পালিয়েছিল তার পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে। সুপ্রকাশ তাই বলেছিল মা কে।

    সুপ্রকাশের দাদা বৌদি এসেছিল আশীর্বাদে, বিয়ের দিন। ওদের আত্মীয় বন্ধু খুব বেশি ছিল না , সামান্য ক'জন বরযাত্রী, তারপর ছোটো করে বৌভাত সুপ্রকাশের দাদার বাড়ির ছাদে, প্যান্ডেল করে। বৌভাতের রাতে ফুলশয্যার আগে , সকলের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল মা। হঠাৎই পিছন ঘুরে আলাদা করে ডাকল আমাকে-
    'ছেলেটা বড় দুঃখী। ওকে ভালোবাসিস।'

    এরকমই কথা বলে মা। এরকমই ভাবে - নিজের মা বাবা ভাই বোন, স্বামী, রবীন্দ্রনাথ, আর নিজের দেশকে যেন ভালোবাসতেই হয়, নইলে সবাই খারাপ বলে। একবার কি হয়েছিল- রাঙাদাদুর বাড়ি থেকে ফিরছি-বৃষ্টির জমা জলে রাস্তায় ইঁট পাতা-শাড়ি একটু উঁচু করে পা টিপে টিপে হাঁটছে মা- মার ফরসা গোড়ালি, নীল পাড় শাড়ি। মার সঙ্গে ফ্রকপরা আমি-কত আর- ছ সাত বছর বয়স হয়ত। হঠাৎই মা বলল, ' ও বাড়িতে সবাই যখন জিগ্যেস করল, তুই কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসিস, বড়পিসিমা বললি যে!'
    জল পেরোতে পেরোতে আমি বললাম,'কেন, ভালোবাসিই তো।'
    মা ইঁট মিস করে জমা জলে পা দিল। ঝাঁঝিয়ে বলল, ' মা কে সব থেকে ভালোবাসতে হয়, জানো না? অসভ্য মেয়ে কোথাকার!'

    সেদিন, সুপ্রকাশের সঙ্গে ফুলশয্যার ঠিক আগে সানাই, রজনীগন্ধা, লোকজন পান মুখে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে, ডেকরেটরের লোক বালতি গামলা গোছাচ্ছে- তখন যে মা বলল, 'ভালোবাসিস'-আমি স্পষ্ট দেখলাম জমা জল, মার ফরসা পা, মা ঝাঁঝিয়ে বলছে, 'অসভ্য মেয়ে, বিয়ে করা বরকে ভালোবাসতে হয়, জানো না?'

    রাতে ফুল সাজানো খাটে সুপ্রকাশ হাসিমুখে বলেছিল-'ইতালিতে সবাই পাস্তা খায়। তুমি খেয়েছ? কি ভাবে বানায়, বলতো?'
    ফুলশয্যায় নতুন বরের মুখে পাস্তা বৃত্তান্ত শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম।
    বলেছিল-' আর ফরাসীরা কি খায়? হুঁ? ফ্রেঞ্চ কিস কাকে বলে জানো?'
    সে রাতে শরীর অবশ্যম্ভাবী ছিল। অথচ দুজনেই চুমু খেয়েছিলাম চোখ খুলে।

    দু'দিন পরেই মায়ের কাছে চলে আসি। সেরকমই কথা ছিল। ওর দাদা বৌদিও আর থাকতে বলে নি আমাদের। বিয়ের সাতদিনের মাথায় সুপ্রকাশ মা'র কাছে গিয়ে বলেছিল, -' অনেকদিন ছুটি নেওয়া হয়ে গেছে, এবারে ফিরে যেতে হবে।'
    -'ছুটি নেওয়া মানে? তোমার নিজের ব্যবসা না? '
    -' ঐ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। এখন অন্য কাজ করি।'
    -'কোথায়?'
    -'সার্কাসে।'
    -'সার্কাসে? সেখানে কি কাজ তোমার? কি কর?'
    সুপ্রকাশ হেসে বলেছিল, ' না, না , খেলা দেখাই না। অফিসে হিসেব টিসেব দেখি।'
    মা চেঁচিয়ে বলেছিল, ' এসব আগেই বলা উচিত ছিল তোমার। ও কাজ ছেড়ে দাও। এদিকে কিছু একটা পেয়েই যাবে।'
    -'সার্কাসের সঙ্গে থাকতে আমার ভালো লাগে।'
    চলে গিয়েছিল সুটকেস নিয়ে।



    অনেকদিন আগে মা'র প্রাণের বন্ধু রমামাসি একটা চীনামাটির বাটি দিয়েছিল মা কে-কোন এক বড় শিল্পীর নিজের বানানো, নকশা আঁকা, মা'র নাম লেখা। রমা মাসি বাটিটা পুরোনো ধুতি দিয়ে মুড়ে মা' র ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল-অনেকটা পথ বাসে ফিরবে-যাতে না ভাঙে। মা তো বাড়ি ফিরে ঘরে ব্যাগ রেখে দিয়েছে তারপর দুদিন বাদে রাতের দিকে ব্যাগ খুলে-'এটা কি রে ব্যাগে, পুরোনো ধুতি টুতি' বলে মোড়কটা টেনে বার করে ঝাড়া দিতেই সব চুরচুর। মার তখনকার সেই মুখটা- নিজের ওপর রাগ, হতাশা, কান্না- নিজের দোষে খুব দামী একটা জিনিস নষ্ট হ'লে মানুষের যা হয় -
    এতদিন পরে মা ঠিক ঐরকম হয়ে গেল। বরাবরের মত। সার্কাসের লোক যে আমার বর হবে, মা তো ভাবেই নি কোনদিন। আমরা আর পাঁচকান করি নি সার্কাসের কথা। স্কুলে, পাড়ায়, আত্মীয়দের বলেছি, ব্যবসার কাজে এদিক ওদিক ঘুরতে হয়, এই সব।

    এক বছর কোনো খবর ছিল না সুপ্রকাশের। না চিঠি, না ফোন। একটা মোবাইল নম্বর দিয়ে গিয়েছিল, যাওয়ার আগে । আর সার্কাসের নাম, মাদ্রাজের একটা ঠিকানা।
    বলেছিল, 'আমাদের ঘুরে ঘুরে কাজ, কখন কোথায় থাকি। কত দেশ, কত শহর। তুমি তো ভূগোল পড়াও, তুমি তো জানো। ফোন না পেলে ভেবো না।'
    যতবার ফোন করেছি, হয় বেজে গেছে, নয় যান্ত্রিক স্বর বলেছে, 'মোবাইলটি এই মুহূর্তে পরিষেবার বাইরে আছে।' ওর দাদা বৌদির কাছে গিয়েছিলাম আমি আর মা। রসগোল্লা আর চা দিয়ে হেসে বলেছিল, 'ও এরকমই। আমাদের সঙ্গে কোনই যোগাযোগ নেই।'
    আমি আর মা কেমন ধরেই নিয়েছিলাম, সুপ্রকাশ আর ফিরবে না।
    দেবীকা বলেছিল, 'হয়ত আগের পক্ষের কাছে গেছে, সে কোথায় থাকে? খোঁজ নিয়েছিলি তো ভালো ক'রে?'
    শান্তশ্রী বলেছিল,' এরপর এলে খুব সাবধান, কত রকম রোগ হতে পারে- কে জানে কোথায় কী করে বেড়ায়। তা হ্যাঁরে ভালো ঠালো বেসে ফেলিস নি তো?'

    ভালোবাসা বড় অদ্ভূত ব্যাপার। ভালোবাসা বলতে আগে বুঝতাম ভিকি, ওর বাইক, দুপুরের শোয়ে সিনেমা, লুকিয়ে চুমু। সুপ্রকাশ যখন সাত দিনের জন্য আমার বর হয়েছিল, আমি যেন তখন অন্য কেউ, যেন আমার বাপের বাড়ির বাগানের কেটে ফেলা কমলা হলুদ ফুলের লতা। নাম টাম জানতাম না লতাটার-আমার ছোটোবেলায় বাড়ির বাগানে মাচায় লতানো ছিল কমলা হলুদ ফুলের লতা-মাচা ভরা ফুল, পাতা। সরু সরু আকর্ষ দিয়ে মাচার বুনোট আঁকড়ে মাকড়ে থাকত। একবার ঐ মাচা সারানো হচ্ছিল- দুপুরে বাগানে বসে নতুন করে মাচা বাঁধছে পাঁচুদা আর রোদে ধুলোয় পড়ে আছে ছেঁড়া ফুল, ছেঁড়া পাতা, কমলা হলুদ ফুলের সেই লতা - সমস্ত আকর্ষ দা দিয়ে কাটা। আমার কান্না দেখে পাঁচুদা বলেছিল-' এ মরবে না , আমি তুলে দেব মাচায়, আবার লতাবে, দেখো তখন, অ খুকী।'

    বিয়ের পরের ঐ সাতদিনে আমার কোনো আকর্ষ জন্মায় নি। তবু শরীর ছিল। চোখ খুলে চুমু খেতাম দুজনেই। যেন পরস্পরের চোখে কে আছে দেখতে চাইতাম। সুপ্রকাশ চলে গেলে চিন্তা হয়েছিল প্রথমটায়। তারপরে সেটুকুও নয়। শুধু সাতদিনের বরের হাসিটুকু মনে পড়ত মাঝে মাঝে। সিঁদুর পরেছি, লোহা- স্কুল করছিলাম নিয়ম করে। মা র ক্যান্সার ধরা পড়েছিল।

    সুপ্রকাশ এলো আমাদের বিয়ের তারিখের বিকেলে। হাসপাতাল থেকে মা কে দেখে ফিরে এসেছি। দেখি বারান্দায় বসে সুপ্রকাশ। বুক কেঁপে ওঠা উচিত ছিল, অবাক হতে পারতাম অথচ খুব স্বাভাবিকভাবে তালা খুলে ওকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিলাম, ভাত বসিয়েছিলাম দুজনের মত। সুপ্রকাশও খুব স্বাভাবিক ছিল, যেন রোজই দেখা হয়েছে আমাদের, যেন এতদিন একসঙ্গেই ছিলাম। হাসিমুখে বলেছিল- 'মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা কমে যাচ্ছে, জানো?' এমনভাবে বলেছিল, যেন ও গিয়েছিল হিমালয়ে, উচ্চতা মাপতে, যেন ঠিক একারণেই আসে নি এতদিন।

    রান্না সেরে খেতে ডাকতে গিয়ে দেখলাম, বারান্দায় টবে একটা গাছ পুঁতছে । বলল, 'তোমাকে দিলাম আজকের দিনে। একটা নাম দিও না হয়। নাম না দিলে ঠিক যেন নিজের হয় না।'

    ভাত খেয়ে আর বসে নি । ডালিমের গাছ ছিল। আমি নাম দিয়েছিলাম-'রাঙাদাদু'। একটা কঞ্চির গায়ে ছোটো কার্ডে নাম লিখে টবের এক কোণে পুঁতে দিয়েছিলাম।

    সুপ্রকাশ আবার এসেছিল আমার জন্মদিনে- মা ততদিনে চলে গেছে- ডালিমগাছে লেখা নাম দেখেছিল। তারপর নতুন একটা চারা পুঁতল বারান্দার টবে। তেজপাতা গাছ দেখলাম সেই প্রথম-নাম দিলাম 'বড় পিসিমা।'

    ব্যাপারটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল এর পর। নিয়ম বা একটা খেলার মত। ও আসত জন্মদিনে আর বিয়ের তারিখে। গাছ আনত, নাম দিতে বলত। আমিও টবে জল দিতাম রোজ। নাম দিতাম। সুপ্রকাশ এলে নতুন নাম দেখত কেমন আকুল হয়ে। একদিন মনে হ'ল জিগ্যেস করি, 'কাকে খুঁজছ? '

    আমাদের পাঁচ নম্বর বিয়ের তারিখে সুপ্রকাশ এলো খুব ভোরে, কোলে ছোট্টো কুকুরছানা, গায়ে পোকা, একটা চোখ আধ বোজা। বলল-' তুমি তো চিপসের কথা জানো। যুদ্ধে গিয়েছিল? আফ্রিকা, ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি- খুব লড়েছিল যুদ্ধে। ও চিপসের নাতি-কালীচরণ। রাস্তায় গাড়ি ধাক্কা দিয়েছিল, নিয়ে এলাম। যত্ন কোরো। আর শোনো, ও না গান খুব ভালোবাসে। তুমি যে গানগুলো গুনগুন করো, একটু গলা ছেড়ে গেও, ও বুঝবে-দেখো'।

    বুঝলাম না কি বলতে চাইল-বুঝলাম না কালীচরণ দেশী না বিদেশী। শুধু ভাবছিলাম, আমি যে গুনগুন করি স্নানের ঘরে-সুপ্রকাশ কি করে জানল। গায়ে আঁচল জড়িয়ে নিলাম। শীত করছিল কেমন। শান্তশ্রী পরে বলেছিল, 'এ হল সুপ্রকাশের স্পাই। তুই কি করিস না করিস, কে আসে বাড়িতে সব নজর রাখবে। খুব সাবধান।'

    বেঁচে গেল কালীচরণ। নিয়ম করে খাওয়া, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, কৃমির ওষুধ, ইনজেকশন। প্রথম প্রথম ভয়ে ভয়ে থাকত; রাতের দিকে, আলো নিভিয়ে দিলে হু হু ক'রে কাঁদত। আমার খাটের পাশে একটা বাক্সে শুয়ে থাকত ছোট্টো কালীচরণ, কেঁদে উঠলে, ওর গায়ে চাপড় দিয়ে দিয়ে গাইতাম-মম চিত্তে, আগুনের পরশমণি- তখন থামত। তারপর বড় হল, গা ময় নরম লালচে লোম - গোলগাল চেহারা। আমাদের স্কুল আপিসের ক্লার্ক হরেনবাবু আসেন মাঝে মাঝে -মেয়ের জন্য বই টই নিতে -বললেন, 'ঠিক জানেন , কুকুর? হরিণ নয় তো? না কি অন্য কিছু, একটু ডোরা মত দেখলাম যেন পিঠের ওপর। একটু খেয়াল রাখবেন, দিদি' । আর ক' মাস পরে কালীচরণকে কুকুর বলেই চেনা গেল-নিতান্ত দেশী কুকুর। পায়ে পায়ে ঘুরত সারাদিন, আমি বেরোলে বারান্দায় থাকত। স্কুল থেকে আসতে একটু দেরি হ'লে পরিত্রাহি চিৎকার। ক্লাসে জলবায়ু বোঝাতে গিয়ে ওর কথা আমারও মনে হত। ভাবতাম-বারান্দায় কি করছে একা একা। একটা খেলনা কিনে আনলাম বাজার থেকে-শস্তা সফ্ট টয়-সাদা কুকুরছানা, গলায় সোনালী ফিতে-সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় কালীচরণের বাটিতে জল আর খাবার দিয়ে , পাশে খেলনাটাও রেখে গেলাম। বিকেলে গেট খুলে বারান্দায় উঠেছি, দেখি- কালীচরণ পাগলের মত সঙ্গম করছে খেলনাটার সঙ্গে। কান মাথা ঝাঁঝাঁ করে উঠল আমার। খেলনাটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললাম এক কোণে। কালীচরণ দৌড়ে কুড়িয়ে আনল। আমার সামনে ধড় আর মুন্ডু আলাদা করল এক কামড়ে, তারপর কবন্ধ মুখে করে বসে রইল বারান্দায়।

    পরদিন পাড়ার ক্লাবে কথা বললাম, ওরা রাস্তার কুকুরদের অপারেশন টন করায়। খোঁজ খবর নিয়ে কালীচরণের অপারেশন করিয়ে নিলাম। তারপর থেকে কালীচরণ যেন আরো নেওটা হ'ল- একটু হিংসুটেও। রাস্তায় কারোর সঙ্গে কথা বলতে দেখলে, বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়ায়, দু পা মাটিতে, দুপা গ্রিলে, তারপর বিকট চেঁচায়। হরেনবাবু বাড়িতে এলে তেড়ে যায় আজকাল। রাতের দিকে খাওয়ার পরে টিভি দেখি ওকে নিয়ে । হাবিজাবি সব সিরিয়াল। ঢুল আসে বসে বসে। গান গাই তখন নিজের মনে। মম চিত্তে আর আগুনের পরশমণির সঙ্গে এখনও ল্যাজ নাড়ে খুব। তারপর চেটে দেয় হাত, গাল।

    বিজয়া দশমী পড়েছিল আমার জন্মদিনে। সকালে সুপ্রকাশ এসেছে এলাচ চারা নিয়ে, বিকেলে চলে যাবে। হরেনবাবু এলেন বিজয়া করতে। নাড়ু, নিমকি দিলাম। সুপ্রকাশ পাশের ঘরে। পাড়ার ঠাকুর ভাসান হয় নি সেদিন, প্যান্ডেলে বক্স লাগিয়ে গান হচ্ছিল 'কানে কানে শুধু একবার বলো'। হরেনবাবু জলের গ্লাস নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, 'দিদি, এই গানগুলো শুনলে বুকের মধ্যে কেমন করে না? কী সব গান ছিল বলুন। কী সব মানুষ, কী সব গান, কত ভালোবাসা-উত্তম সুচিত্রা, রাজকাপুর নার্গিস, দিলীপকুমার সায়রাবানু-এখন আর সে সব কই?'
    হঠাৎ কেমন রাগ হয়ে গেল। হরেনবাবুর সামনে থেকে কাপ ডিস তুলে নিয়ে সকালেই কাগজে পড়া এক অভিনেতার বক্তব্য জোরে জোরে আউড়ে দিলাম-'ভালোবাসা বলে কিছু হয় না,হরেনবাবু। পারস্পরিক প্রয়োজনকেই আমরা ভালোবাসা বলি।' বারান্দায় কাপ ডিস নামাতে গিয়ে দেখি, দরজার বাইরে সুপ্রকাশ, সমস্ত মুখে বেগুণী কালশিটে যেন। আমাকে দেখে হাসার চেষ্টা করল। মুখ নামিয়ে বলল-'এই বেরোচ্ছিলাম। আসি।'

    পরের জন্মদিনে আস্ত মানুষ আনল সুপ্রকাশ-বছর বারোর বাবুলাল। কোন শহরের স্টেশনে বসে বসে না কি কাঁদছিল। তাই তো বলেছিল সুপ্রকাশ। বাবুলালের মাথায় উকুন, গা ময় খড়ি, চাপটি বাঁধা ময়লা, জট পড়া তামাটে চুল। কথায় কেমন হিন্দি টান। কোন এক অনাথ আশ্রমে থাকত, ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছে, তারপর আশ্রম থেকে পালায়। চায়ের দোকানে কাজ করেছে, ভিক্ষাও করত - নিজেই বলল। সুপ্রকাশকে 'বাবুজী' বলেছিল বাবুলাল।

    রয়ে গেল সেও। পাড়ার স্কুলে ভর্তি করে দিলাম-ফর্মে বাবার নাম লিখলাম সুপ্রকাশ। শান্তশ্রী বলল, 'দ্যাখ গে, আগের পক্ষের ছেলে, তোকে গছিয়ে গেল। তুই বা কী? বলতে পারলি না-রাখতে পারব না? '

    বাবুলালকে চলে যেতে বলার কথা আমার মনেও হয় নি। কানপুরের দুমাস আমার প্রতিক্রিয়ার বোধ ভোঁতা করে দিয়েছে বহুদিন। শুধু ভেবেছিলাম- একটা প্রাণই তো। বারান্দায় গাছ আছে, কালীচরণ আছে, বাবুলালও রইল। আলাদা ঘর তো একটা ছিলই। চুপচাপ শান্ত ছেলে-স্কুল, পড়াশোনা, বিকেলে একটু আধটু ক্রিকেট ফুটবল।

    আমার কেমন নিজের সংসার তৈরি হয়ে গেল -একা থাকতে হ'ল না। গাছেরা, কালীচরণ, বাবুলাল।
    বাবুলালের পড়াশুনো হ'ল না তেমন। বাড়িতে আমিই পড়িয়েছি, শ্যামলীদিও আসত অঙ্ক দেখাতে। বয়স অনুপাতে নিচের ক্লাসে ভর্তি করিয়েছিলাম। ক্লাস এইটে পড়ছে যখন, নিজেই একদিন বলল, 'আর পড়ব না।'
    -কি করবি তবে?'
    -মোড়ের মাথায় একটা ফুলের দোকান আছে না? সেখানে ফুল সাজানোর কাজ করব। একবার শিখে নিতে পারলে তারপর দেখো। নিজেই ব্যবসা করব।'
    -'পড়বি না আর?'
    -'পড়াশোনা ভালো লাগে না ।'
    -'মাধ্যমিকটা পাশ কর অন্ততঃ; আর তো মোটে দু বছর।'

    কথা শুনল বাবুলাল। মাধ্যমিক পাশ করল। তবে আর কলেজ গেল না। ফটিকের ফুলের দোকানে কাজ নিল। ফুলের গয়না টয়্না তৈরি করত, বিয়ের মরশুমে বরের গাড়ি, বিয়েবাড়ির গেট , ফুলশয্যার খাট সাজাতো। খুব খাটতো। ফটিক না কি জি টিভির কোন প্রোগ্রামের সেট সাজানোর বরাত পেয়েছে, সেই সব নিয়েই ব্যস্ত থাকে, ফুলের দোকানের ভার তাই বাবুলালেরই ওপর -অর্ডার নেওয়া, হিসেবপত্তর শিখে নিচ্ছিল। স্কুলে যাওয়া আসার পথে ওকে দোকানে দেখতাম। খারাপ লাগত। নিজের ছেলে হ'লে কি জানি কি করতাম-মারতাম , বকতাম, জোর করে কলেজে পাঠাতাম?
    বাবুলালের বয়স এখন কুড়ি একুশ হবে। এই এতগুলো বছরে সে আমাকে সরাসরি সম্বোধন করে কথা বলে নি। আমিও তাকে কোনদিন বলি নি-' মা না হোক, পিসি, মাসি বা দিদি, কিছু একটা বলে ডাক, বাবুলাল।'

    আমাদের বিয়ের তারিখে সুপ্রকাশ এসেছিল। একগাল পাকা দাড়ি, সেই লম্বা চুল, হাসিমুখ।

    -' ক্যানারি আইল্যান্ড কোথায় জানো? আছে না ভূগোল বইতে? পরেরবার একটা গাছ আনব ওখান থেকে। হাজার বছর বাঁচে। জানো? তোমার বারান্দার টবে হবে না। বাইরে মাটি ফেলে লাগাবো, দাঁড়াও। ভাবো তো, তুমি থাকবে না, আমি থাকব না, কালীচরণ , বাবুলাল -কেউ থাকবে না, অথচ গাছটা থাকবে। কী নাম দেবে?'



    স্কুলেই শুনেছিলাম একটু আধটু। সেদিন হরেনবাবু সরাসরি বলে গেলেন, 'দিদি, বাবুলালের সঙ্গে কথা বলুন একটু। ফটিকের বোনের সঙ্গে খুব ঘুরছে।'

    রাতে খেতে বসে কথাটা তুললাম। বাবুলাল বলল, 'আমি সুমিকে বিয়ে করব শিগ্গিরি।'
    -'ওরা রাজি হবে? ফটিক? ওদের বাড়ি মেনে নেবে?'
    -'তুমি বললে ঠিক রাজি হবে। বলবে, তোমার কাছে থাকবে।'
    -'তোকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবে ফটিক। কী করবি তখন?'
    -'আরেকটা কাজ ঠিক খুঁজে নেব। এখানে না হোক, অন্য কোথাও।'
    -'তুই এখান থেকে চলে গেলে, সুমি কোথায় থাকবে?'
    -'এখানে। তোমার কাছে। আমি মাঝে মাঝে আসব।''

    হাসল বাবুলাল। হাসিটা যেন কার মত-আগে কোনদিন মনে হয় নি। বয়স হচ্ছে, চোখের ভুলই হবে। ডালে রুটি ডুবিয়ে মুখে দিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গদাম করে জানলায় ইঁট ছুঁড়ল কেউ। বিকট ডেকে উঠল কালীচরণ। অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ পাচ্ছিলাম বাইরে। কেউ চিৎকার করে বলছিল-'শালা বেজন্মা, বাইরে আয় শালা।' বলছিল,'বাবুলাল, বেরিয়ে আয় বাঞ্চোৎ, তোকে কালীচরণ বানিয়ে দি।'

    বারান্দার দিকের জানলা খুলে মুখ বাড়ালাম-'কে? কে তোমরা? কি হয়েছে?'
    -' কি হয়েছে , জানেন না? বাবুলালকে সাবধান করুন, সুমিকে না ছাড়লে জানে মেরে দেব। '
    অশ্লীল গালি দিতে দিতে চলে গেল ছেলেগুলো।
    পাড়ার মধ্যে আছি। সামনে পেছনে বাড়ি। একজনও বেরোলো না এত আওয়াজেও। বারান্দার আলো জ্বেলে অনেকক্ষণ জেগে রইলাম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি-

    পরদিন সকালে বাবুলালকে দেখলাম না। ফোন করলাম কতবার। অনেকদিন পরে আবার শুনলাম, 'এই মুহূর্তে মোবাইলটি পরিষেবার বাইরে রয়েছে।' স্কুলে গেলাম যথারীতি। কানাঘুষো শুনলাম, সুমিও নিখোঁজ। হরেনবাবু বললেন, 'একবার থানায় যান দিদি। কিংবা, এক কাজ করবেন? কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলুন। আমি সঙ্গে যাব?'
    আমি বললাম,'দেখি আরো দু'দিন। যদি ফোন করে বাবুলাল। কোথায় আছে, কেমন আছে জেনে নিই।'

    পরদিনও স্কুলে গেলাম। ফেরার পথে বাজার। আজ কোনো খবর না পেলে কাল একবার থানায় যাব ভাবছিলাম।

    বিকেলে ব্রিজের ওপর হাওয়া উঠেছিল আজ, আকাশে উত্তম সুচিত্রা। ব্যাগ নামিয়ে গেট খুলতেই কালীচরণ দৌড়ে এল। বারান্দায় উঠেছি আর সঙ্গে সঙ্গেই বিকট আওয়াজে বোমা ফাটলো গেটের সামনে। বারুদের গন্ধে যেন ভরে গেল আমাদের গলি। কালীচরণ খুব জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। তালা খুলতে গিয়ে বাজারের ব্যাগদুটো বাইরে রেখেছিলাম- ফুলকপি, আলু ক'টা গড়িয়ে যাচ্ছে দেখলাম। মুহূর্তের জন্য মনে হ'ল-ডিমগুলো ভেঙে গেল। দেখলাম, ধোঁয়ায় ভরে গেছে বাইরেটা। বারান্দার গ্রিলের দরজা তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে গেলাম, কাঁধে একটা ধাক্কা দিয়ে যেন ফেলে দিল কেউ - জ্বলন্ত কিছু একটা পিঠ ফুঁড়ে বেরোলো আমার। মেঝেতে পড়তে পড়তে দেখি হাতে পিস্তল নিয়ে একটা ছেলে-ফটিক না ? গুলি করল আমাকে?

    সেকেন্ডের ভগ্নাংশে আরেকটা কান ফাটানো আওয়াজ আর কালীচরণের গর্জন। দেখি, কালীচরণ লাফ দিয়ে কামড়ে ধরেছে পিস্তল ধরা হাত, ছেলেটা চিৎকার করছে তারস্বরে, কালীচরণের কান দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। ছেলেটাকে পালিয়ে যেতে দেখলাম তারপর। আর কালীচরণ ধপ করে শুয়ে পড়ল পাশে। সব কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। আরো বোমা ফাটছে? আমার চোখ বুজে আসছে।কালীচরণ কি ভয় পাচ্ছে, ছোটোবেলার মত? ওর গায়ে হাত রেখে যেন গাইলাম-'মম চিত্তে নিতি নৃত্যে, কালীচরণ, তাতা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ। ভয় পাস না কালীচরণ, ভয় পাস না, তা তা থৈ থৈ।'

    দরজার বাইরে পায়ের শব্দ। কে এলো? কে ? পুলিশ? অ্যাম্বুল্যান্সের লোক? হরেনবাবুকে কেউ খবর দিল? ফিরলি, বাবুলাল তুই ফিরলি ? সুপ্রকাশ এলো বুঝি সেই গাছ নিয়ে? আজ কি আমার বিয়ের তারিখ?

    কালীচরণ আর আমি পাশাপাশি শুয়ে রইলাম। মাথার কাছে রাঙাদাদু, বড়পিসিমা, রমামাসি। দরজা খোলা রইল। যে আসে, আসুক।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | ২১৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | 59.205.218.52 (*) | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৪:৩৮64230
  • উফ মানে উফ ? এটাতো মারাত্মক হয়েছে।

    আরো হোক।
  • b | 24.139.196.6 (*) | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৫:২৩64231
  • দুর্ধর্ষ।
  • শঙ্খ | 126.206.220.114 (*) | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৫:৩৫64232
  • এইটা জবরদস্ত হয়েছে। বেশ আলাদা ফ্লেভার।
  • kumu | 192.68.21.182 (*) | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১১:৫৪64227
  • কী অসাধারণ!!!

    কালীচরণ আর আমি পাশাপাশি শুয়ে রইলাম। মাথার কাছে রাঙাদাদু, বড়পিসিমা, রমামাসি। দরজা খোলা রইল। যে আসে, আসুক।
  • de | 69.185.236.56 (*) | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:৪১64228
  • অপূর্ব লাগলো -

    ছোটাইয়ের লেখাগুলো প্রত্যেকটা আগেরটার চাইতে অন্যরকম ভালো হয় - আর আগেরটার পার্ফেকশনের সীমা ক্রস করে -
  • | 144.159.168.72 (*) | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:৪৬64229
  • উফ!
  • de | 69.185.236.56 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৩৩64235
  • আজকেও পড়তে এসেছিলাম এটা - অ্যাকচুয়ালি রমামাসিকে খুঁজতে এসেছিলাম - পড়ে দেখলাম এলাচচারার নাম বোধ্হয় -

    এই গল্পটা এতো ভালো হয়েচে - ছোটাই আর টেখা বোলো না !
  • h | 213.99.211.135 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৩৯64236
  • খুব সুন্দর লেগেছে। কি সুন্দর লেখা গল্প। থ্যাংক ইউ ইন্দ্রাণী দি।
  • ফরিদা | 132.161.170.62 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৫১64237
  • ভীষণ ভালো লাগল লেখাটা।

    ছোটাই এরএর এই সব লেখাগুলো এক জায়গায় কবে পাওয়া যাবে?
    অপেক্ষায় থাকব বাকি জন্মদিনগুলোয়।
  • পৃথা | 132.161.15.12 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৪:০৪64238
  • ভালো লাগল
  • lcm | 109.0.80.158 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৪:২৩64233
  • দুরন্ত !
  • গবু | 57.15.138.14 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৪:৪১64239
  • ভালো, অন্যরকম লেখা
  • Blank | 233.191.50.254 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:৫১64240
  • অসাধারন ছোটাই দি
  • Paramita | 118.217.227.153 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৯:০৫64241
  • বহু বহু পাঠকের মতো ইন্দ্রাণীর লেখার আমি খুব ভক্ত। সরলরৈখিক ভাবে চলতে চলতে কখন যে ইন্দ্রানীর লেখাগুলো জটিলতা ছেঁচে আনা বহুমাত্রিক কাহিনী হয়ে ওঠে, অথচ গল্প কথনের সহজ ভঙ্গিটি থাকে অপরিবর্তিত, পাঠককে হেল্প করে জটিল অলিগলিকে নিজ নিজ বুদ্ধি ও অনুভূতি দিয়ে খুঁজে নিতে - সেটা বুঝতেই পারি না । আরও একটা ব্যাপার, চতুর্দিকে প্রবন্ধ ও memoir -এর পাতা উড়ছে । গপ্পো লিখতে লোকে বুঝি ভুলেই গেলো। সেখানে এটা রিফ্রেশিং চেঞ্জ। ফিকশনের জয় হোক !
  • Titir | 138.210.107.26 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৯:১৪64242
  • ইন্দ্রানী,
    এই লেখার বিশ্লেষন করার সাধ্য আমার নেই। জানি বা কতটুকু।
    মুগ্ধতাটুকু জানিয়ে গেলাম।
    আর সমগ্র লেখাগুলোর একটা সংকলন দেখতে চাই।
  • Mahua | 132.163.20.139 (*) | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৯:২৩64234
  • দারুন হয়েছে। দারুন।
  • i | 134.170.241.153 (*) | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৮:৪৪64243
  • সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।

    রোব্বারের পরদিন লেখার সময় একটা সিরিজের কথা ভেবেছিলাম। লিখেওছি। সবই প্রায় পড়েছেন আপনারা। কুকুর, বাঘ, ঘোড়া,হরিণ, হাতি-আবার সারমেয়তেই ফেরৎ এলাম। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হ'ল সম্ভবতঃ। এই সিরিজে এক্ষুণি আর কিছু লিখব না। পরে আবার দেখা যাবে।

    আপনারা অনেকেই গল্প সংকলনের কথা লিখেছেন। গুরুচন্ডালি বহুদিন যাবৎই এই কথাটি বলে এসেছে আমাকে। গুরুকেও যা বলেছি, আজও তাই বলছি-আমার লেখা এখনও সেই পর্যায়ে ওঠে নি-গল্পগুলি সংগ্রহ করে রেখে দেওয়ার মত নয় এই মুহূর্তে। আরো লিখতে হবে। দুই মলাটে বাঁধা না পড়ে গল্পরা ভুলে যাওয়া স্রোতের 'পরেই না হয় টলোমল করুক আপাততঃ।

    দে র কথা শিরোধার্য করে টেখা শব্দটি ব্যবহার করলাম না। বহুব্যবহৃত হয়ে জীর্ণও হয়েছে শব্দটি।

    ইতি ছোটাই।
  • aranya | 172.118.16.5 (*) | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:৩৯64244
  • ভাল লাগল
  • Munia | 172.229.184.102 (*) | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:২৪64246
  • ইন্দ্রাণীর লেখা বুকে থম ধরায়!
  • ঝর্না | 24.97.243.251 (*) | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:৫০64245
  • ভীষণ ভালোলাগল পড়ে ...
  • রিভু | 117.0.228.218 (*) | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৮:৫০64247
  • উফফ সবাই এতো ভালো লিখলে কি করে হবে! পড়াশুনো মাথায় উঠবে দেখছি। কেঁদেই ফেললাম প্রায়।

    আচ্ছা গল্প সংকলন যদিবা নাও হয়, লেখিকার বাকি লেখা গুলো একসঙ্গে পাওয়া যাবে কোথাও? মানে গুচর প্রোফাইলে ক্লিক করলে যেগুলি দেখাচ্ছে তার বাইরেও আছে নিশ্চই। আস্তে আস্তে পড়বো।
  • রিভু | 117.0.228.218 (*) | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৪:১৪64249
  • ধন্যবাদ ছোটাই।
  • i | 134.170.241.153 (*) | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৮:২০64248
  • আচ্ছা আবারও ধন্যবাদ সকলকে।

    ঋভু,
    http://dattaindrani.blogspot.com.au/ মোটামুটি সবই তুলে রেখেছি।

    ছোটাই
  • pi | 24.139.221.129 (*) | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৫:৫৯64250
  • গল্পটা সাঙ্ঘাতিক হয়েছে। সাঙ্ঘাতিকই বলব।
    একের পর এক প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া জানানোর মত ঘটনা একটা অদ্ভুত নির্বিকার ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতি নিয়ে আপাত নিরাসক্ত ন্যারেশনের এই পরিণতি সাঙ্ঘাতিকই বটে। হ্যাঁ, আপাত টাও ইচ্ছে করেই বললাম। মনে হল।

    নামকরণটা মারাত্মক হয়েছে !
  • i | 213.158.52.141 (*) | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:১৮64251
  • থ্যান্ক্স পাই।
    প্রতিটা গল্পেই মনে মনে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করি-এই গল্পতেও ছিল। আপাত ভোঁতা অনুভূতি নিয়ে একটা মানুষ নিজের কথা কি ভাবে বলবে-বলার মধ্যে কি ভাবে 'আপাত' ব্যাপারটা বোঝা যাবে-কি সেই শব্দ-কি সেই ছবি.. এই সব।
    চেষ্টা করেছিলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন