এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • চার রঙের উপপাদ্য - শরৎ-২

    ইন্দ্রাণী
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৫০৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি - ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক


    শরৎ-২


    অফিস যাওয়ার আগে পঙ্কজ কলকাতার খবর পড়ছিল ল্যাপটপে। প্রথমে হেডলাইন, তারপর এডিটোরিয়াল দেখে নিয়ে অন্যান্য খবরে চোখ বোলাচ্ছিল – জাস্ট আর একবার স্ক্রোল করেই বেরিয়ে যাবে; একটা খবর – তাড়াহুড়োয় চোখে না পড়ারই কথা – যাদুকর শব্দই চোখ টানল সম্ভবত – ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করতে গিয়েও পঙ্কজ পড়ে ফেলল – ‘যাদুকরের মৃত্যু’; পড়ল ‘সংবাদসংস্থার খবর অনুযায়ী, মাঝগঙ্গায় হুডিনি ট্রিক দেখাতে গিয়ে, গত রবিবার সন্ধ্যায় এক যাদুকরের মৃত্যু হয়েছে। একটি সংস্থার পক্ষ থেকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মৃত ব্যক্তি ঐ বিপদজনক খেলা দেখাতে যান। সুরক্ষাব্যবস্থায় গাফিলতির অভিযোগে ঐ কোম্পানির তিন কর্মচারী ও মালিককে পুলিশ আটক করেছে। সংবাদসংস্থার সূত্রে প্রকাশ, মৃত ব্যক্তির নাম বি. পালিত। পুলিশের তরফে মৃত যাদুকরের সম্বন্ধে আর কোনো তথ্য জানা যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া বিবরণে প্রকাশ, ...”। তারপর হুডিনি, জলের তলার স্টান্ট নিয়ে কয়েক লাইন আরও। পঙ্কজ ঘামতে শুরু করল, বিন বিন করে ঘাম জমছিল কপালে, পিঠ ভিজে উঠছে টের পাচ্ছিল নিজেই; সে শার্টের গলার বোতাম খুলল, আস্তিন গোটাল, তারপর কপাল মুছে অন্য নিউজ সাইটে গেল তৎক্ষণাৎ, তারপরে আরো এক সাইটে – ইংরিজি, বাংলা, আবার ইংরিজি – একের পর এক উইন্ডো খুলে যাচ্ছিল ওর ল্যাপটপের স্ক্রিনে – পঙ্কজ জানতে চাইছিল যাদুকরের পরিচয় – সম্পূর্ণ নাম, বয়স, অতীত – অথচ কোথাও বিশদ কিছু নেই। নেট সার্চ করেই চলছিল পঙ্কজ, অফিসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, সে বোধ আর ছিল না – ল্যাপটপের স্ক্রিনটুকু ছাড়া বাকি জগৎ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে এই মুহূর্তে। বেশ কিছুক্ষণ লাগল একটা ছবি পেতে – সম্ভবত ব্লগ সাইট – গঙ্গার জলের ওপর খাঁচা, মৃত যাদুকরের দণ্ডায়মান অবয়ব, ব্যাকগ্রাউন্ডে হাওড়া ব্রিজ আর আকাশে বুড়ো মানুষের পাঁজরের মত শরতের মেঘ। ছবির তলায় সেদিনের ঘটনার বিবরণ। পঙ্কজের হাতের মাউস থমকে গেল। মৃত ব্যক্তির দাঁড়ানোর ভঙ্গি, পোষাক – তার চেনা মনে হয়েছিল, অথচ যাদুকরের পরিচয় সম্পর্কে নিঃসংশয় হতে তার দ্বিধা হচ্ছিল। তার নিজস্ব অনুমান নিশ্চিত বলে জানলে, এই মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়। পঙ্কজ এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে জুম করে যাদুকরের মুখ আরো কাছ থেকে দেখতে চাইছিল। পিক্সেল রেজোলিউশন সে পথে বাধা হওয়ায় পঙ্কজ একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন হচ্ছিল ও স্বস্তি বোধ করছিল। এক সময় স্বস্তি হেরে গিয়েছিল তার আশঙ্কার কাছে। শুধু মৃত ব্যক্তির দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে, যে অতীতকে পঙ্কজ গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে এতদিন এবং একসময় ভেবেছে যে সে মরে গেছে, সেই অতীত আজ এক মুহূর্তে বেঁচে উঠেই মারা গেল পঙ্কজের চোখের সামনে, নিতান্ত অফিসবেলায়। এই এক মুহূর্তের বেঁচে ওঠায় পঙ্কজের মাঝবয়সী হৃদয়ের সব থেকে নরম জায়গায় একটা হাতুড়ির ঘা পড়ল প্রথমে – ভোঁতা অস্ত্র, অথচ ব্যথা বিষম, বুক কেঁপে উঠে থরথর করতে লাগল সমস্ত শরীর। ঐ একই জায়গায় যেন পেরেক মারল কেউ তারপর, রক্ত বেরিয়ে এল। প্রথমে বিন্দু বিন্দু রক্ত, তারপর রক্তের ধারা, তারপর যেন আগল খুলে গিয়ে রক্তের স্রোত – সেই স্রোতে ভেসে এল ওর পনেরো বছর বয়সের স্মৃতি – যাদের ও গলা টিপে মেরে রেখেছিল এতদিন। সেইসব স্মৃতি প্রথমে ঢিপি হল, তারপর স্তূপাকৃতি – কপালের রগ টিপে বসে রইল পঙ্কজ, মাথা ঝাঁকাল; সমস্ত শরীর উথালপাথাল করছিল - মাথা, বুক, পেট, হাত, পা। দু’বার বাথরুমে গেল, চোখেমুখে জল থাবড়াল, তারপর এই সব রক্তপাত সমেত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এইখানে বসে থাকলে স্মৃতিরা ওকে চেপে ধরে ডুবিয়ে দেবে নির্ঘাৎ। গলগল করে স্মৃতিরা বেরিয়ে আসছিল – বেবাক ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল মন এবং মাথা। অথচ এই শূন্যতায় যে হৃদয়ের ভার উজাড় করে দেওয়ার অনুভূতি মিশে থাকছিল, পঙ্কজ নিজে তা বুঝতে পারছিল না। ঝাপসা চোখ, ঝাপসা মন নিয়ে গাড়ি ছোটাচ্ছিল শুধু।
    অফিসের কাছাকাছি একটা ট্রাফিক সিগনালে রোজ দাঁড়াতে হয়। অভ্যাসের বশে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে, অথচ আজ সিগনালের রঙ সবুজ। একশ’ কিলোমিটার স্পিডের রাস্তায় সবুজ আলোয় দাঁড়িয়ে পড়েই বুঝল – ভুল করেছে, তবু, শোধরানোর চেষ্টা করল না, দাঁড়িয়েই রইল, দাঁড়িয়ে রইল ঠায় – যেন সে চলচ্ছক্তিহীন; চোখ যতদূর যায়, ঢালা পিচরাস্তায় খণ্ড খণ্ড জলতল, বাষ্প উঠছে সেখান থেকে। পঙ্কজ তার ভাগ্যের কাছে নিজের হৃৎপিণ্ড বন্ধক দিয়ে বসে রইল – যা কিছু ঘটে যেতে পারে এই মুহূর্তে – হয়তো একটা কলিশন, হয়তো চুরচুর হয়ে যাবে গাড়ি, তালগোল পাকিয়ে যাবে পঙ্কজ নিজে – শেষ হয়ে যাবে সব। অথচ তা ঘটছিল না। ওর পিছনের গাড়ি হর্ন দিয়ে পাশ কাটাল, আশপাশের সমস্ত গাড়ি ওকে পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে হর্ন বাজাচ্ছিল, জানলার কাচ নামিয়ে মধ্যমা দেখাচ্ছিল অথবা অশ্রাব্য গালি দিয়ে স্পিড তুলছিল। নদীর বুকে একটা ঢ্যাঁটা পাথরখণ্ডের মত লাগছিল পঙ্কজ আর তার গাড়িকে; লাল আলো জ্বলে উঠতে পঙ্কজের খেয়াল হল, রক্তপাতের সঙ্গে ওর হৃদয়ের খোলস গলে যাচ্ছে। খোলস ছাড়ানো দগদগে হৃৎপিণ্ড ধুকপুক করছিল। এবার সবুজ আলোয় সে স্পিড তুলেছিল, পেরিয়ে যাচ্ছিল জল আর বাষ্পের মরীচিকা –






    তিন্নি নতুন বাড়ির ছবি আঁকছিল একের পর এক। রাঘবকে, শান্তাকে দেখাচ্ছিল। ড্রয়িং খাতার পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে উপহার দিচ্ছিল সব নিমন্ত্রিতদের। রান্নাঘর থেকে সুবাস আসছিল – সুবিমল যথারীতি বিরিয়ানিতে ফাইনাল টাচ দিচ্ছে। ট্রে-তে পকোড়া আর কফি নিয়ে এ’ঘর ও’ঘর করছিল লিপি। কেউ একজন প্লে-লিস্ট ঘেঁটে গান চালাল – প্যারা এক বাংলা হো, বাংলে মে গাড়ি হো; ‘কবেকার গান’ – কে যেন বলে উঠল; ‘রেখা ছিল না?’ উত্তর নয়। তবু উত্তরের মত শোনাল। কেউ জোক শেয়ার করল, প্রথমে একটা তারপর দুটো, তিনটে, চারটে – হাসির ছররা ঘরের দরজা ফুঁড়ে বাইরে এল।
    সুবিমলদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করে উত্তরের আকাশে তাকাল পঙ্কজ। স্কাইলাইনে শহরের আলো জ্বলে উঠছে – বিশাল ক্রেন আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। এখনও ওর মনে পড়ছিল না – এই রকম একটা ক্রেন আগে কোথায় দেখেছে। আজ উত্তর খুঁজতে পকেট হাতড়াল না পঙ্কজ – সুবিমলরা নতুন বাড়িতে গেলে আর আসা হবে না এই রাস্তায় – এই ক্রেনটাকে আর দেখবে না; কত রকম আত্মীয়তা যে জন্মায় –
    - এত দেরি করলেন পঙ্কজদা?
    - পঙ্কজ, আজকাল খুব বাগান করছিস শুনলাম
    - এই, এই গানটা কোন সিনেমার বলো তো
    - পকোড়া নিন, একদম গরম-
    - বৌদি কবে আসছেন পঙ্কজদা?
    লিপি-সুবিমলের অ্যাপার্টমেন্ট সিগারেট, কফি, ভাজা পোড়া খাবার আর অ্যালকোহলের গন্ধে ভরে আছে, ধোঁয়া, হাসি আর হুল্লোড়ে সবাইকে একরকম দেখাচ্ছে – লাল, নীল, সবুজ, সাদা অবয়ব ঘুরে ঘুরে কথা বলে, নাচে, এক কলি গেয়ে ওঠে, অকারণ প্রশ্ন করে, উত্তর জানার আগেই হেসে ওঠে হো হো করে। আজ পঙ্কজ বর্ম পরবে না ঠিক করেছে। লোকে বড়জোর পাশ কাটাবে, মধ্যমা দেখিয়ে গালি দেবে; সিগনালের রং বদলাবেই – এইটুকু সময় শুধু ঠোঁট টিপে থাকা। হাসল পঙ্কজ।
    “এর পর তাহলে হাউজ ওয়ার্মিং পার্টি – দু’বাড়িতেই” রাঘব বলল –
    - দু’ বাড়িতেই?
    - তিন্নির নতুন বাড়ি – এক নম্বর। আর পঙ্কজদার বাড়ি – দুই নম্বর। তাড়া নেই। বৌদি এলেই –
    হাসছিল সবাই। বিবিধ টপিক উঠে আসছে আসরে – একের ওপর এক – যেন অন্ত্যাক্ষরী চলেছে – এক টপিকের ল্যাজা থেকে অন্য বিষয়ের মুড়ো শুরু হচ্ছে অটোম্যাটিক। সমস্ত ঘরে আনন্দের হিল্লোল বইছে – যাকে ছুঁয়ে দিচ্ছিল, সে তৎক্ষণাৎ এই আনন্দের অংশীদার হয়ে যাচ্ছিল। এই সন্ধ্যায় ডুবে যাওয়া যাদুকরের কথা কেউ বলবে না – জানা কথাই। পঙ্কজের অতীতও যেন ডুবে গেল এইখানে – লোকের ভিড়ে, হাসির শব্দে আজ তার আড়ষ্ট লাগছিল না। দগদগে হৃৎপিণ্ডকে আড়াল করে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল পঙ্কজ, জোরে জোরে হাসল, পকোড়া গালে ফেলে তিন্নিকে কোলে তুলে নিল।
    - তুমি পাপি আনতে গেলে, আমাকে নিয়ে যেও।
    - তুমিও পাপি নেবে? বনময়ূর টু?

    রাত অনেক। তিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরদোর পরিষ্কার করে সোফায় বসেছিল সুবিমল, লিপি। এবার শুতে যাবে।
    - আজ পঙ্কজদা দারুণ ফর্মে ছিল।
    - হয়তো বৌদি ফিরছেন।
    - কিছু তো বলল না।
    - কতদিন একা রইলেন, বৌদিও তো ওখানে একাই-
    - আমি এতদিন থাকতেই পারতাম না তোমাকে ছাড়া
    - প্র্যাকটিস করে রাখা ভাল কিন্তু
    - কী?
    - আমাকে ছেড়ে থাকার –
    - মরেই যাব তাহলে, ফিরে এসে আর আমাকে দেখতে পাবে না – আজ এত ভাল কাটল, এরপর শিফটিং-এর ঝামেলা, এখন আর হাবিজাবি কথা বলতে হবে না
    - তাহলে এদেশে সেটল করে গেলাম আমরা? ফিরব না কোনোদিন? কোনোদিন নয়?
    - তোমাকে নিয়ে ভয় হয় আমার লিপি – কখন কী কর – এই চাকরি ছেড়ে দিলে, কোনদিন আমাকে ছেড়ে – কী হল? কী ভাবছ?
    - একটু আগে আমিই বললাম, হয়তো স্মিতাবৌদি ফিরে আসছেন। ফিরে আসছেন। আবার এই আমিই বলছি, ফিরে যাওয়ার কথা। কী অদ্ভুত না? ফিরে আসাও হয়, ফিরে যাওয়াও হয়।
    সুবিমল চুমু খেল লিপিকে – “পাগলিটা”।
    স্বপ্নে আজ আবার ট্রেনে চড়েছিল লিপি। জানলার বাইরে সরে সরে যাচ্ছিল গাছ, নদী, পাহাড়, জনপদ। লিপি জানলার দিকে ফিরে বসে আছে। টিটি এসে টিকিট চাইতেই ব্যাগ হাতড়াতে লাগল। তার ব্যাগ যেন তলহীন। অতল গভীর সে ব্যাগে টিফিন বক্স, জলের বোতল, বাড়ির চাবি, রুমাল, মোবাইল, ঘাস, পাতা, নুড়ি পাথর, একটা টেডি বেয়ার। টিকিট নেই। লিপি আবার ব্যাগ হাতড়াল – পার্স নেই, টিকিট নেই। টিটির সামনে গোটা ব্যাগ উপুড় করল লিপি – কামরার মেঝে ভরে গেল লিপির ব্যাগের জিনিসে, কিন্তু পার্স নেই; লিপি আবার ব্যাগ ঝাড়ল, মোবাইল আছড়ে পড়েই বেজে উঠল রী- রী- করে। ধড়মড় করে উঠে লিপি দেখল – ফোন বাজছে।
    - বাবা, কী হয়েছে?
    “কী হল লিপি” সুবিমল উঠে বসে বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালাল।
    - বাবার ফোন। সত্যি বাড়ি কাঁপছে। ছাদের চাঙড় খসে মাথা ফেটে গেছে মা’র। আমি বাড়ি যাব। আমি বাড়ি যাব।






    টেবিলে দুধ আর কর্নফ্লেক্স; একটা ভেজা তোয়ালে হাতে খিড়কির দরজা খুলছিল পঙ্কজ – বাইরের তারে মেলে দেবে। স্নান সারা। ব্রেকফাস্ট খাবে। এ’বাড়িতে আসার পর ভেজা তোয়ালে বাইরের দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া একরকম নিয়ম করে দিয়েছিল স্মিতা। ব্যাপারটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। গত সাতদিন তুমুল বৃষ্টি – অভ্যাসের কাজে বাধা পড়েছে; আজ রোদ উঠতে দেখেই ভেজা তোয়ালে তুলে নিয়ে পিছনের দরজা খুলল। থ হয়ে গেল পঙ্কজ। ইদানিং খিড়কির দরজা পঙ্কজের অবসেশনে দাঁড়িয়েছিল। রাতের দিকে প্রায়ই মনে হয়, এই বুঝি কেউ বলবে – দরজা খোল, আমি এসেছি। বিশেষত ঝড়জলের রাতে শুয়ে শুয়ে পঙ্কজের মনে হয়েছে, দরজায় ধাক্কা দিল কেউ; এরপর আধোঘুমে ভাবতে চেয়েছে, দরজা খুলে কাকে ও দেখতে চায় – ওর মন এইখানে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে – এক অংশ চেয়েছে বাস্তবকে, অন্য অংশ ম্যাজিকের দিকে টার্ন নিয়েছে – যে পথে বনময়ূর বা সাহেবগলির গতায়াত সম্ভব। সকালে তোয়ালে মেলতে গিয়ে কতদিন ভেবেছে দরজা খুলে দেখবে বনময়ূর এসে বসে আছে -
    গত ক’দিন এই দিকটায় আসেইনি পঙ্কজ, আজ রোদের তেজ এক্সপেক্ট করে চোখ কুঁচকে গেছিল দরজা খোলার আগেই। অথচ দরজা খুলতেই দেখল বাড়ির পিছনের ঐ ছোট্ট অংশে যেন অন্য এক সকাল – আলোর রঙ সবুজ। অবাক হয়ে সে দেখল, ক্লথ লাইনে লতিয়ে উঠেছে ঘন সবুজ লতা, সরু সরু আকর্ষ আঁকড়ে আছে ওর তোয়ালে মেলে দেওয়ার দড়ি, সবুজ চাঁদোয়া চুইঁয়ে সূর্যের আলো ঘন ছায়া হয়ে মাটিতে পড়ছে। সবুজের মধ্যে একটি দু’টি বেগুনি-সাদা বিন্দু – ফুল ধরে আছে। পঙ্কজ সবুজ পাতায় হাত দিল। বহুদিন পরে কোনো জীবন্ত কিছু স্পর্শ করছে সে। ওর ঘরদোরে রোদ ঢুকছিল – দেওয়ালের ছবিতে পঙ্কজ, স্মিতা, বুলটি, ছোটো বনময়ূর – ব্যাকড্রপে সমুদ্র, বালি, রৌদ্রময় আকাশ – রোদ আর ছায়ার দড়ি টানাটানি খেলা শুরু হয়ে গেল – কখনও আলো জিতছিল, কখনও ছায়া। পঙ্কজের খোলসবিহীন দগদগে হৃদয় একটুখানি ছায়া চেয়ে কেঁদে উঠল অকস্মাৎ – নিজেই লুফে নিল এই মুহূর্ত – মাটিতে পড়ে চৌচির হতে দিল না; ও মোবাইল তুলে নিল, স্মিতার কলকাতার নম্বরে গেল –






    তিন্নিকে নিয়ে লিপি গাড়ি থেকে নামছিল – এয়ারপোর্টের সামনে। এয়ার ইন্ডিয়ার চেক ইন শুরু হবে একটু পরেই। ওদের নামিয়ে সুবিমল অফিস দৌড়োবে – লেটস কনেক্ট বাই লাফটারের ইভেন্ট আজ দুপুর থেকে।
    - লিপি, পৌঁছে ফোন কোরো। আমি সামলে নেব শিফটিং। পঙ্কজদা, রাঘবদের ডেকে নেব। তুমি ফিরে ঘরদোর গুছিও। তাড়াতাড়ি ফিরবে তো লিপি?
    তিন্নি হাত নাড়ছিল বাবাকে। “সাবধানে থেকো” – লিপি চোখের জল আড়াল করল। ট্রলি ঠেলে ঢুকে গেল ভেতরে।

    সুবিমলদের অফিসের লেটস কনেক্ট বাই লাফটার থিমের অনুষ্ঠান চলছিল – কোট, টাই, পয়েন্টেড শু, স্কার্ট, হিল পরা মানুষজন – কখনও দু’হাত তুলে হাসতে হচ্ছিল হা হা করে, কখনও দুলে দুলে, কখনও দু’পাশে দু’হাত ছড়িয়ে। নতুন খেলা শুরু হয়েছিল তারপর – সহকর্মীর দিকে ফিরে চোখে চোখ রেখে নিচু হয়ে গ্রিট করতে হচ্ছিল, তারপর চোখ না সরিয়ে হা হা করে হেসে উঠতে হচ্ছিল সব কর্মীদের। সুবিমল ঘুরে ঘুরে মাথা ঝোঁকাচ্ছিল, হাসছিল, হাসছিল আর হাসছিল।



    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৫০৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিদিশা দাশ | 182.66.163.17 | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:১৬503699
  • কথা কও কথা কও
    অনাদি অতীত
    অনন্ত রাতে
    কেঁ বসে চেয়ে রও
  • সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য | 43.251.179.219 | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৯:৪৪503708
  • কত ঘটনার সমাহার! বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন মানুষের..... 
  • মীনাক্ষী রায় | 87.200.123.89 | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:১৭503728
  • যত শেষ হবার দিকে গল্প এগোচ্ছে...তত মায়া বাড়ছে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন