ফাঁকা রাস্তার মাথার ওপরে ঘন নীল মেঘ উঠছে, উল্টোদিকের বাড়ির দোতলায় আলো জ্বলল, আর যে পাখি তিনটে এতক্ষণ টেলিফোনের তারে বসেছিল, তারা উড়ে গেল এইমাত্র ; দূর থেকে কিছু শব্দ এগিয়ে আসছিল যেন পথচারীদের সেই সব কথারা মাঝখানের এই ফাঁকা রাস্তাটুকু পেরিয়ে ডানদিকে যাবে কিম্বা উল্টোটা- ফলে এই জনহীন পথের দু’ দিকেই কিছু দৃশ্য ক্রমাগত ভেঙে যাচ্ছিল অথবা তৈরি হচ্ছিল। এখান থেকে যে রাস্তাটুকু দেখা যায় তা এমনই চৌকো আর ফাঁকা যেন এখনই নাটক শুরু পারে সেখানে - ছোটো, একাঙ্ক কোনো নাটক। ... ...
একজিট নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম শুনশান গলিতে। এফ এম বন্ধ করে দিলে এখন শুধু মেটাল বডি আর জলের ঠোকাঠুকি, ওয়াইপারের সুইশ সোয়াশ, সুইশ সোয়াশ আর রেনওয়াটার পাইপ থেকে গবগব করে জল বেরোনোর ননস্টপ আওয়াজ। লাল, হলুদ, নীল, সবুজ একতলা, দোতলা, তিনতলা বাড়ির দেওয়াল বেয়ে জল নামছিল নিঃশব্দে, গড়ানো ঢালের গলি বেয়ে বড় রাস্তায় পড়ছিল। ওদিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা শেড, তার পাশে আগাগোড়া প্লাস্টিক ঢাকা ঠ্যালাগাড়ি- ট্রেনে কাটা পড়া ডেডবডি যেন। শিউলিদের গলির কথা মনে হ'ল। ... ...
একটা অসমাপ্ত নকশা তৈরি হত, বদলেও যেত প্রতিদিন- এই সব হিসেব না মেলা সংখ্যাদের জ্যান্ত দেখাতো- আলাদা রং, আলাদা শেপ- যেন একটা বোর্ড গেমের ঘুঁটি সব- খেলার নিয়ম তৈরি হওয়ার অপেক্ষা করছে; মনে হত, আমাকেই এই গেমের রুল ঠিক করতে হবে- তার আগে নকশাটা চিনে নেওয়া খুব জরুরী । নকশা বা একটা গল্প -স্পাই বলেছিল। ... ...
শীতের বিকেলে অবিশ্রান্ত পাতা ঝরছিল - ছাউনির ফাঁক গলে হলুদ পাতা প্রাচীন কূপের অভ্যন্তরে খসে খসে পড়ছে। মাথার ওপরে ঝকঝকে আকাশ আর রোদ , দিন শেষ হতে যেন অনেক বাকি- হাতে যেন অগাধ সময়; এই সব সময়ে ঝরা পাতার সম্পূর্ণ গতিপথ নিরীক্ষণ করার কৌতূহল জাগে। ইঁদারার দেওয়ালে কালচে সবুজ শ্যাওলা- ভেলভেটের মত ; চটে যাওয়া পলেস্তারা, এবড়োখেবড়ো ইঁট কারুকার্য ফর্ম করেছে -যাকে ব্যাকড্রপে রাখলে খসে পড়া পাতাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না; বিভ্রম ঘটে কখনও - পড়ন্ত পাতাকে স্থবির মনে হয়, পরক্ষণেই শ্যাওলাকে পাতার মত লাগে, তারপর নিম্নগতি পাতাকে আবার ঠাহর করতে গেলে, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, সে' পাতা কুয়োর তলদেশ স্পর্শ করে গেছে ততক্ষণে। পাতা পড়তে থাকে, আরও পাতা, অজস্র পাতা, তাদের গতিপথ সম্পূর্ণ গোচরের আগেই আবার যাবতীয় বিভ্রম পুনরায় ঘটে যেতে থাকে। ... ...
আমার মনে হচ্ছিল, অনীক আর আমার সমস্যাটা যেন কিছুটা বুঝতে পারছি- আবছা আবছা- যেন একটা মাকড়শার জালের মতো, গাছের দুটো ডালের মাঝখানে আঠালো সুতোর একটা নকশা হচ্ছিল আস্তে আস্তে । আরো মনে হচ্ছিল, স্বপ্নার নদী পেরোনোর ঐ মোমেন্টটার মত আমরাও একটা মুহূর্তর সন্ধানে আছি- দ্য স্বপ্না মোমেন্ট- আমি আর অনীক, দুজনেই। মুহূর্তটা এসে গেলেই আমরা আর একসঙ্গে থাকতেই পারব না। ... ...
এই মুহূর্তে, রাতের আকাশের তলায় প্রমীলা হাত তুলছে মাথার ওপর, আবার নামিয়ে নিচ্ছে, যেন তার কাঁধের ওপর ডানা আর সে তা ঝাপটে চলেছে ; জলের তলায় ওর পা স্থান বদলাচ্ছিল ঘন ঘন, যেন সে তার ব্যালে ক্লাসের প্রথম দিনে ফার্স্ট পোজিশন থেকে ফিফথ পোজিশন করে চলেছে - ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর , ফাইভ, ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর , ফাইভ; দ্রুত, প্রাণবন্ত মুভমেন্ট ; লয় বাড়ছিল, প্রমীলার পা ক্রমান্বয়ে গতি বাড়াচ্ছিল- যেন ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে গিয়ে চাইকোভোস্কি বাজছে ওর মাথার মধ্যে। চাঁদ আর ছেঁড়া মেঘ লাইটিং ডিজাইন করেছে- নীলচে শাদা আলোয় ভরে যাচ্ছিল চরাচর। ... ...
সার্কাসে তুলসীদা খেলা দেখিয়েছে কী দেখায় নি, এই নিয়ে পাড়ায় বিবিধ মত ছিল। আমার বন্ধুরা জোর দিয়ে না বলেছিল, অথচ শিবুদা, কেষ্ট কাকা হলফ করে বলেছিল, তুলসীদাকে এক চাকা সাইকেল চালাতে দেখেছে, কাঁধের ওপর সাদা কাকাতুয়া; তুলসীদার বুকের ওপর টান টান করে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। ... ...
আসলে এই সব কথা ওদের মনে বুড়বুড় করে সর্বক্ষণ - ঢাকা দেওয়া হাঁড়িতে ভাত ফোটার মত অনেকটা - তারপর একসময় কথা ফোটা বন্ধ হয়; সব কথারা ঠান্ডা হয়ে গিয়ে সর ফ্যালে আলটিমেটলি ; সেই জমাটবাঁধা থকথকে শাদা ফ্যান দিনের শেষে ড্রেনের মুখে নিজেরাই ঢেলে দেয় ওরা; জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলে, শলার ঝাঁটা দিয়ে বাড়তি জল কাচায়, তারপর শুতে যায় সেদিনের মত। ... ...
গাড়ির আলোয় যতটা দেখা যাচ্ছিল, তার বাইরে কুয়াশা। প্রদীপ আর বিজন টর্চ জ্বেলে আশে পাশে দেখছিল। এদিক ওদিক কুয়াশা ফুঁড়ে ঝোপঝাড় বেরিয়েছে। ফণিমনসার মত কাঁটা গাছ। সেইখানে অন্ধকারের একটা স্তূপ পড়ে আছে যেন। বিজনের বুক কেঁপে উঠল। ... ...
সে রাতে বহু লোকেরই ভৌগোলিক অবস্থান গুলিয়ে যেতে থাকে। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ এ ওর ঘাড়ে চড়ে এক রাতে মফস্সলে মহাপৃথিবীর জন্ম হয়। ... ...