এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের শিক্ষা দিবস

    Sumit Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ১৭৮৮ বার পঠিত
  • গত ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে ‘শিক্ষা দিবস’ ছিল। না, অফিশিয়ালি এই দিনটিকে শিক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি বটে, কিন্তু দিনটি শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। সেদিনই এটা নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ১৭ আর ১৯ তারিখ পরপর দুটো পরীক্ষার জন্য কিছু লেখা হয়নি...

    ১৯৬২ সালের এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলছিল শিক্ষা আন্দোলন, সেই আন্দোলনে শরিফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে পুলিসের গুলিতে মারা যান নবকুমার স্কুলের ছাত্র বাবুল, বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ও গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লা।

    ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যে শোষণ ও বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করা শুরু হয়, তার মধ্যে শিক্ষাও ছিল। ১৯৪৭-৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ২৯,৬৩৩টি। ১৯৫৪-৫৫ সালে দেখা গেল, ওই সংখ্যা নেমে এসেছে ২৬,০০০-এ। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে যখন শিক্ষার এই অবস্থা, পশ্চিম পাকিস্তানে তখন শিক্ষার হার বাড়ছিল, ড্রপ আউটের সংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কম। শিক্ষা খাতে পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি ব্যয়ও ছিল অনেক বেশি, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬%। এদিকে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হবার পর বংলাভাষার ‘মুসলমানীকরন’ বা 'উর্দুকরন' এর অপচেষ্টা চলতে থাকে।

    এই মুসলমানিকরন বা উর্দুকরনের ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। দুই একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘চল্ চল্ চল্’-এর ‘নব নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহাশ্মশান’ চরণের সংশোধন করে লেখা হয় ‘সজীব করিব গোরস্থান’। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জনপ্রিয় ছড়া "আমার পণ"-এর ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।’ - এটি পরিবর্তন করে করা হলো- ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, সারাদিন যেন আমি নেক হয়ে চলি।’ আশা করি এখান থেকেই ব্যাপারটা সম্পর্কে আইডিয়া পাবেন। এই প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সাল থেকে, হ্যাঁ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণারও ৩ বছর পর! অবশ্য ছাত্র বুদ্ধিজীবী মহল থেকে বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর একুশের সম্মিলিত অনুষ্ঠানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সভাপতির ভাষণে এসব বিকৃতি এবং রোমান হরফ প্রবর্তনের প্রস্তাবসহ অন্যান্য "সংস্কার" এর প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। ছাত্ররা সেসময় সম্মিলিতভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল যে, এসব তারা মেনে নেবেন না।

    পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ, দুই অঞ্চলের মধ্যকার বিশাল অর্থনৈতিক বৈষম্য তো আরও অনেক আগে থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু ঐ সেসময়ই বলতে গেলে এই শোষণের স্বরূপ এদিককার বুদ্ধিজীবী মহলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তখনই পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদরা এই দুই অঞ্চলের জন্য আলাদা আলাদা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের গুরুত্ব দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে শুরু করেন। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন, রেহমান সোবহান প্রমুখ সর্বপ্রথম পাকিস্তানের অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে পূর্ব পাকিস্তানের বেলার শুভঙ্করের ফাঁকিকে জনগণের কাছে তুলে ধরেছিলেন।

    ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী ছিল। স্বভাবতই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিদের কাছেও এই দিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু এই দিনটি পালনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ দীর্ঘদিন পর আবার উত্তপ্ত হয়। এই ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যাক। দেশে সামরিক শাসন জারি হলে কী হয় সেটা সকলেরই জানার কথা, প্রকাশ্য সাংগঠনিক রাজনৈতিক কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানেও তাই হয়েছিল। তাই রাজনৈতিক কার্যক্রম যখন এখানে একেবারেই নিষিদ্ধ তখন এই অঞ্চলের রাজনীতি আশ্রয় নিয়েছিল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তবে সামরিক শাসনের সরকার এদের উপর ভালভাবেই নজর রাখত। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালনকে সামরিক সরকার সরাসরি বিরোধিতা করতে পারেনি কারণ তা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। কিন্তু তাদের যা করার ক্ষমতা ছিল, তা তারা করেছিল। সাধারণত যা করা হয় আরকি, একশ্রেণীর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী সংগ্রহ করে তারা অপপ্রচারে ইন্ধন যোগানো শুরু করে। এই ঢাকা জেলা কাউন্সিল হলে রবীন্দ্র বর্জনের আলোচনায় অংশ নেন আবদুল মান্নান তালিব, দেওয়ান আব্দুল হামিদ, মাওলানা মহিউদ্দিন, অধ্যাপক গোলাম আজম প্রমুখ। (একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম তখন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলাম এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মাওলানা মহিউদ্দিন সেইসময় মাসিক মদিনা এর সম্পাদক ছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ইসলামি ঐক্যজোটের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন, আবদুল মান্নান তালিব সেসময় ছিলেন সাপ্তাহিক 'জাহানে নও' এর সহসম্পাদক, দেওয়ান আব্দুল হামিদ ছিলেন সাহিত্যিক। সেইসময় রক্ষণশীল মুসলিমদের মধ্যে এদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তাই অপপ্রচারের জন্য তাদেরকেই নিয়ে আসা হয়।)

    সেখানে তারা যেটা বলে তাও ভীষণ ইন্টারেস্টিং ছিল। তাদের গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের ইসলামভিত্তিক জাতীয়তা ও রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে অখণ্ড ভারতীয় সাম্রাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসাবে চালু করার জন্য একশ্রেণীর তথাকথিত সংস্কৃতিসেবী যে সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে, এই সভা তাহাদের কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করিতেছে’।

    আশা করছি সেসময়ের ব্যাকগ্রাউন্ডটা এতক্ষণে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এটা পরিষ্কার করাই এতক্ষণ ধরে লেখার উদ্দেশ্য ছিল। এই অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা, সংস্কৃতিসেবীরা ও অগ্রণী ছাত্রসমাজ যখন বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছিলেন, সামরিক শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে সময় ১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর তা আন্দোলনে রূপ নেয়।

    ১৯৫৮ সালে আইউব খান ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অবশ্য কোন সামরিক কর্মকর্তার জন্য এটা প্রথম হলেও পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। জিন্নার মৃত্যুর পর পাকিস্তানের গভর্নর হন খাজা নাজিমুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গুপ্তহত্যায় মারা গেলে তিনি প্রধানপন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন আর অর্থমন্ত্রী মালিক গোলাম মোহাম্মদকে গর্ভর্নর নিয়োগ করেন। এদিকে নাজিমুদ্দিনের সময় ভাষা আন্দোলন ও লাহোর দাঙ্গার কারণে রিজার্ভ পাওয়ারের ক্ষমতায় (গভার্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া এক্ট ১৯৩৫ অনুসারে) গভর্নর গোলাম মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভা বিলুপ্ত করে দেন ও বাঙ্গালি মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। সেই সাথে নিশ্চিত করেন যাতে গভর্নরের এই ক্ষমতা কখনও না কমানো যায়। এদিকে তিনি অসুস্থ হয়ে লন্ডনে গেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারপ্রাপ্ত গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা এসে তাকেই ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন, ইস্কান্দার মির্জাও বাঙ্গালি ছিলেন। তিনি এসে মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে সরিয়ে দিয়ে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী ও ফজলুল হককে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করেন।

    মির্জা ছিলেন খুব সন্দেহবাতিক, তার সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে চৌধুরি মোহাম্মদ আলীকে পদত্যাগ করতে হয়, ফজলুল হকও মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন, যদিও ফজলুল হক একটি সনদে "ইস্কান্দার মির্জা বাঙ্গালি, তার শরীরে রাজ রক্ত আছে..." এসব বলে পূর্ববঙ্গের গভর্নর পদ পেয়ে যান (ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন মীর জাফরের বংশধর)। এরপর পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হয়ে এলেন সোহরাওয়ার্দি, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন নেই এই অজুহাতে মির্জা তাকেও পদত্যাগে বাধ্য করে। তারপর ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দ্রিগড় প্রধানমন্ত্রী হয়ে এলে তারও একই পরিণতি হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী হন মালিক ফিরোজ খান নুন। সোহরাওয়ার্দি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফিরোজ খান নুনকে ধরে ফজলুল হককে পদত্যাগ করিয়েছিলেন। যাই হোক, এদিকে সংবিধান রচনা হয়ে গেলে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র হয়ে যায় আর গভর্নর পদ বিলুপ্তির ফলে ইসকান্দার মির্জা গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্টের পদ। কিন্তু এই সংবিধান অনুসারে ইলেক্টোরাল কলেজ দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার বিধান রয়েছে, তখন মুসলিম লীগের রিঅরগানাইজড হওয়া, আওয়ামি লীগের সাথে পাঞ্জাবি সিন্ধী গ্রুপের মৈত্রী স্থাপন এসব দেখে মির্জার হুমকি অনুভব করতে থাকে। আর তাই ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে তিনি জাতীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেন, সংবিধান স্থগিত করেন, সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেন আর সেনাপ্রধান জেনারেল আইউব খানকে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করে দেশে সামরিক আইন বা মার্শাল ল জারি করেন।

    রেডিওতে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, "পাকিস্তানে শিক্ষার হার মাত্র ১৫%, এই অবস্থায় এই রাষ্ট্র গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়।" আর রাজনীতিবিদদেরকে তিনি বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি তাদেরকে দেশত্যাগের আহ্বান জানান। সামরিক শাসকেরা বুঝি এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল। ক্ষমতা পেয়ে তারা "পাকিস্তান ও ইসলাম" রক্ষায় এগিয়ে আসে। সাধারণ মানুষও অনেক খুশি হয়েছিল। মন্ত্রিসভার বারবার রদবদল দেখে তারা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল, পূর্ববঙ্গের ব্যাপারটা আরও নাটকীয় ছিল, বিশেষ করে ফজলুল হকের গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগের পর। যাই হোক, তিন সপ্তাহ পর ইস্কান্দার মির্জা আইয়ুব খানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন, আর তিন দিন পর আইয়ুব খান প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়েই রাতের বেলায় ইস্কান্দার মির্জাকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করেন! ইস্কান্দার মির্জা ৩ সপ্তাহ আগেই রাজনীতিবিদদেরকে দেশত্যাগে আহ্বান করেছিলেন, কিন্তু এটা বুমেরাং হয়ে তাকেই আঘাত করে বসল। এরপর আইউব খান নিজে প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। এভাবেই শুরু হয় পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসন যার স্থায়িত্বকাল ছিল ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে ১৯৭১ সালের ৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত।

    আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হয়েই শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের সচিব ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তার সাবেক শিক্ষক এসএম শরিফকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। তার নামেই শিক্ষার উন্নয়নের জন্য শরিফ কমিশন গঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬ জন ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪ জন নিয়ে কমিশনটি গঠন করা হয়েছিল। ১৯৫৯ সালের ২৬শে আগস্টে কমিশনের সুপারিশসমূহ প্রতিবেদন আকারে প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করা হয়, আর ১৯৬২ সালে তা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এই ৬২ সালের আগস্ট মাসেই পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলনের একটি নতুন দিগন্ত শুরু হয়। ততদিনে শরিফ কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে, যা ছাত্রদের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু কী ছিল এই শরিফ কমিশনে? চলুন দেখা যাক...

    কমিশনের সুপারিশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বলা হয়, "আমাদের জাতীয় জীবনে ইংরেজির বিরাট প্রয়োজনীয়তা আছে এবং সেইজন্য ষষ্ঠ শ্রেণী হইতে ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক পড়া হিসাবে শিক্ষা দিতে হইবে। এবং উর্দুকে মুষ্টিমেয় লোকের পরিবর্তে জনগণের ভাষায় পরিণত করতে হইবে। অন্যত্র উর্দু ও বাংলা ভাষার সম্পর্কে আরও ঘনিষ্ঠতর করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে।"

    শরিফ কমিশন পাকিস্তানের একটি অভিন্ন বর্ণমালার জন্যেও সুপারিশ করেছিল। মনে রাখতে হবে, ৫৯ সালে যখন সুপারিশগুলো লেখা হয় তার মাত্র ৭ বছর আগেই তদকালীন পূর্ব বাংলায় সংগঠিত হয় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। জাতীয় ভাষা ও জাতীয়তার প্রশ্নে পূর্ব বাংলা তখন উত্তপ্ত ছিল। শরিফ কমিশন অত্যন্ত সুকৌশলে বিতর্ক টেনে বলে, "পাকিস্তানের জাতীয় ভাষার জন্য যদি একটি সাধারণ বর্ণমালা প্রবর্তন করিতেই হয় তাহা হইলে পবিত্র কোরান যাহাতে লেখা এবং যাহা সকল মুসলমানই পাঠ করে সেই আরবীয় (নাস্‌খ্‌) দাবি কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না।"

    এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, পূর্বে বাংলার উপর উর্দু চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানী শাসকচক্র অত্যন্ত সুকৌশলে ধর্মীয় আবেগকে হাতিয়ার করে আরবীকে বাংলার বিকল্প হিসেবে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু শরিফ কমিশন শেষপর্যন্ত এই বিতর্কের অবসানকল্পে সিদ্ধান্ত টানে অন্যরকম, যা মাতৃভাষা বাংলার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজের কাছে আরেকটি ষড়যন্ত্র হিসেবেই আবিষ্কৃত হয়: "আমরা মনে করি যে, একদিকে উর্দু ও বাংলা বর্ণমালাসমূহের সংস্কার ও উন্নয়ন করা উচিৎ এবং অপরদিকে রোমান বর্ণমালায় এমন একটি আকারের উদ্ভব ও মান নির্ধারণ করা উচিৎ যাহা পাকিস্তানী ভাষা সমূহকে অক্ষরান্তর করার উপযোগী হইবে।"

    কমিশন আরও সুপারিশ করে, "বিকল্পভাবে সরকারের পক্ষে তিনটি ভাষাবিদ কমিটি নিয়োগ করা উচিৎ যাহাদের একটি নির্দিষ্ট মানে উন্নয়নকৃত মুদ্রনযোগ্য একটি উর্দু বর্ণমালা নির্ধারণ করিবে, দ্বিতীয়টি বাংলা বর্ণমালা সংস্কার করিবে এবং তৃতীয়টি উর্দু ও বাংলার জন্য একটি রোমান বর্ণমালা গঠন ও মান নির্ধারণ করিবে।"

    শিক্ষা উন্নয়নের জন্য শরিফ কমিশন অর্থসংস্থান সম্পর্কিত যে সুপারিশ ও মন্তব্য করেছিল তাই সম্ভবত এই কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল। এখানে শিক্ষাকে বিনিয়োগ বা লাভ লোকসানের ব্যবসা হিসেবে দেখানো হয়। শরিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, "শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয়"। কমিশন অত্যন্ত খেদের সাথে আবিষ্কার করে: "সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অর্থনীতিবিদগণের রীতি ছিল শিক্ষাকে সম্পদ সৃষ্টির অন্যতম উপায় হিসাবে না দেখিয়ে একটি ব্যয়বহুল সমাজসেবামূলক কাজ হিসাবে দেখা।" আর তাই তারা নতুন তত্ত্ব এনে হাজির করে বলে, শিক্ষা হচ্ছে একধরণের মূলধন বিনিয়োগ, অর্থনীতির সাথে যার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে: "শিল্পে মূলধন বিনিয়োগকে আমরা যে নজরে দেখি অনেকটা সেই নজরে শিক্ষাবাবদ অর্থব্যয়কে দেখার যৌক্তিকতা প্রতীয়মান হয়।"

    শরিফ কমিশনে 'অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে অবাস্তব কল্পনা' বলে পরিহাস করা হয় এবং সর্বজনীন শিক্ষার গণদাবীকে নির্বিচারে ব্যঙ্গ করে বলা হয়, "শিক্ষার জন্য জনসাধারণের নিকট হইতে খুব সামান্যই অর্থসাহায্য পাওয়া গিয়াছে এবং আরও স্কুলের জন্য জনসাধারণ যতটা দাবী জানাইয়া থাকে ইহার অনুপাতে ব্যয় বহনের অভিপ্রায় তাহাদের কখনই দেখা যায় নাই। অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল ও নামমাত্র বেতনের মাধ্যমিক স্কুল স্থাপনের জন্য সরকারের উপর নির্ভর করাই জনসাধারণের রীতি। তাহাদিগকে উপলব্ধি করিতে হইবে যে অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা বস্তুত অবাস্তব কল্পনা মাত্র।"

    শরিফ কমিশনের আরেকটি সুপারিশ এখানে উল্লেখযোগ্য: "বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান উন্নত করিবার উদ্দেশ্যে আমরা অতীব জোরের সহিত সুপারিশ করিতেছি যে, স্নাতক ডিগ্রী কোর্সকে সম্প্রসারণ করিয়া তিন বছর মেয়াদী করা উচিৎ হইবে।" এই সুপারিশটি উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে এটাও বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনকে আরও তীব্রতর করে সাধারণ ছাত্রদের চেতনাকে নাড়া দেয়। ছাত্র-সমাজের মূল্যায়নে শরিফ কমিশনের প্রতিবেদনটি একটি প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি হিসেবে চিহ্নিত হয়। শিক্ষা সংকোচন নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে 'শিক্ষা বিনিয়োগ' শব্দগুচ্ছ দ্বারা যে সন্তানের পিতার টাকা আছে তার জন্যই শিক্ষার দ্বার খোলা রাখার প্রস্তাব করা হয়। এতে দরিদ্রের সন্তান মেধাবী হলেও শিক্ষার দ্বার তার জন্য বিলাসিতা হিসেবেই গণ্য হয়।

    আজকের পর্বে এতটুকুই। আগামী পর্বে ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে লেখা হবে।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ১৭৮৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন