এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ।। ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদ: কিছু কথা।। চার

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ মে ২০১৭ | ২৫৮৮ বার পঠিত
  • [মধ্য প্রদেশের এক দলিত অধ্যুষিত গ্রামে মেয়ের বিয়েতে ঢোল না বাজিয়ে ব্যান্ড বাজানোর অপরাধে গ্রামের একমাত্র কুয়োর জলে কেরসিন ঢেলে দিয়েছে গ্রামের উচ্চবর্ণের মাতব্বররা। আইসিস সন্ত্রাসীদের মতো এক কোপে গলা না কেটে সঙ্ঘু সন্ত্রাসীরা এই ভাবে সহনশীল পদ্ধতিতে গলা শুকিয়ে তিলে তিলে পরলোকে প্রেরণের আয়োজন করছে। ঠিক সেই দিন যেদিন দক্ষিণ এশিয়ার নামে ভারত সরকার একটি কৃত্রিম উপগ্রহ আকাশে তুলবে বলে ঘোষণা হল। মন্দ না! এই ভাবেই হিন্দু রাজ চায় ১৬ শতাংশের জন্য আধুনিক সুখী রাজ্য গড়ে তুলতে, আর ৮৪ শতাংশকে নিয়ে যেতে চায় ২৭২ খ্রিষ্টাব্দের বর্ণাশ্রমিক ঘোর অন্ধকার কালো যুগে। আজ আর শুধু মুসলমান বিরোধী নয়, আপামর দলিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও ঘৃণা ও হিংসার জারক রসে সিঞ্চিত এক অসম যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই স্বঘোষিত বর্ণ-হিন্দু সেনানী। এই পরিস্থিতির একটা সামগ্রিক মূল্যায়ন বোধ করি আজ প্রয়োজন হয়ে উঠেছে! সুচিন্তিত যুক্তি, প্রামাণ্য তথ্য ও ভারত ইতিহাসের প্রশস্ত ক্যানভাসে। সেই প্রয়াসের আজ চতুর্থ ও শেষ পর্ব!]

    [১০] ধর্মীয় মৌলবাদ বনাম নারীর স্বাধীনতা

    এই শেষের কথাটা বোধ হয় একটু ভাব সম্প্রসারণ দাবি করে। উপরে হিন্দু-মুসলমানের খাদ্যাখাদ্য বিচারের প্রসঙ্গে আমি এটা বোঝানোর পক্ষে একটা খুব সহজবোধ্য সূত্র উত্থাপন ও আলোচনা করেছি। এবার নারীর স্বাধীন অস্তিত্ব ও সামাজিক অধিকার সম্পর্কে আরও একটা সহজ অভিপাদ্য তুলে আনতে চাই।

    সকলেই জানেন, সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ধনতান্ত্রিক সমাজের অভ্যুদয়ের কালে একটা বড় অগ্রগতি এসেছিল নারীর জীবনে। প্রথমে ইউরোপে। তারপর একে একে অন্য অনেক দেশে। সামন্তযুগ পর্যন্ত মানুষের সংজ্ঞায় নারীকে ধরা হত না। কী ভারতীয় কী গ্রিক কী চৈনিক—সমস্ত দেশের প্রাচীন কালের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা মানুষ বলতে বুঝতেন শুধু পুরুষকে। নারী ছিল শুধুমাত্র পুরুষ উৎপাদনের যন্ত্র। নারীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শুভকামনা বা আশীর্বাদ ছিল: “শত পুত্রের জননী হও।” সন্তান নয়, পুত্র। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। মানুষ তো মানুষই চাইবে। তাই সে পুত্র চাইত। বিশ্বের কোনো ধর্মই এই ধারণার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। পারেনি তার কারণ এটা নয় যে তারা চায়নি বা কোনো পরিকল্পনা করে এবং চক্রান্ত করে করেনি। না পারার কারণ হল, তদানীন্তন সমাজ বাস্তবতায় কোনো ধর্ম প্রবর্তক বা আদিগুরুর মাথাতেই এই চিন্তার উদয় হয়নি যে নারীও মানুষ।

    কথা সাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যের একটা বড় নিবন্ধ আছে—“নারীর মূল্য”। যুক্তিবাদীদের, গণ আন্দোলনের কর্মীদের, নারীমুক্তি আন্দোলনের কর্মীদের পক্ষে এটি একটি অবশ্য পাঠ্য। তাঁদের হাতে হাতে এই অণুবইটি ঘোরা উচিত। এমনকি মার্ক্সবাদীদেরও। আমাদের এই প্রবন্ধের আলোচ্য ধর্মীয় মৌলবাদের ক্ষেত্রেও এই নিবন্ধটির বক্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যদিও, শরৎ চন্দ্র হিন্দু ও খ্রিস্টান ঐতিহ্য নিয়ে যতটা বিস্তৃতভাবে এবং সোচ্চারে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন, ইসলাম ধর্মের আওতায় নারীর অবস্থান নিয়ে সেই তুলনায় প্রায় কিছুই সেখানে বলেননি।

    প্রবন্ধটির শিরোনাম লক্ষ করুন: নারীর মূল্য। অবশ্যই তিনি এই মূল্যের অনুসন্ধান করেছেন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মধ্যে। এবং যথার্থই লক্ষ করেছেন, সামন্তী সমাজে নারী যে পরিমাণে এবং যতক্ষণ সন্তান উৎপাদন করতে পারে সেই অনুপাতে এবং ততক্ষণই পুরুষতন্ত্রের কাছে তার মূল্য। বিত্তবান পরিবারের পুত্র সন্তান চাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার রক্ষার স্বার্থে, বিত্তহীনেরও পুত্র সন্তান চাই মাঠেঘাটে কাজ করার হাত বাড়ানোর প্রয়োজনে। অন্য উৎপাদন যন্ত্রের মতো তাই এই যন্ত্রটিকেও ঘরে-পরিবারে সুরক্ষিত রাখতে হবে। যাবতীয় ধর্মীয় অনুশাসন এবং বিধিনিষেধ তারই জন্য। ধর্ম পালন তারও কর্তব্য, কিন্তু ধর্মানুষ্ঠানে তার প্রকাশ্য অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। ধর্মানুষ্ঠানের (আসলে সাংসারিক যে কোনো অনুষ্ঠানের) সমস্ত কঠিন গায়ে-গতরে কাজের দায়ভার তার উপর; কিন্তু ফল বর্তায় শুধু পুরুষদের উপরে। সন্তানের কল্যাণের কামনায়, স্বামীর কল্যাণ কামনায় কত ব্রত, কত তার উপাখ্যান। কিন্তু স্ত্রীর কল্যাণ কামনায় কোনো আচার অনুষ্ঠান নেই।

    বৈবাহিক সম্পর্কের যাবতীয় কঠোরতা নারীর জন্য। খ্রিস্ট ধর্মে শুরু থেকেই একগামিতা (monogamy)-র প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও বিত্তবান পুরুষের বিবাহোর্ধ্ব একাধিক নারীসঙ্গ অনুমোদিত না হলেও নিন্দিত ছিল না। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মে পুরুষের বহুগামিতা (polygamy) ধর্মমতেই সিদ্ধ। অতএব এই সব আদি বিশুদ্ধ অবিকৃত ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রহণ করলে তাকেও বৈধতা দিতে হবে। পর্দা ঘোমটা বোরখা ইত্যাদি যা কিছু নারীকে তার শরীর ও মুখ ঢেকে রাখতে বাধ্য করে, এবং আসলে তাকে সমাজে এক নিম্নতর অবস্থানে এইভাবে নামিয়ে দেয় তারও পেছনে আছে নারীকে পুরুষের সম্পত্তি-কল্পনার সমাজমনস্তত্ত্ব। নারীকে সেই নিম্নস্থান-সূচক পরিধান আজীবন অঙ্গে ধারণ করতে বাধ্য করা হয়েছে তাকে অস্তিত্বের প্রতি পলে মনে করিয়ে দেবার জন্য, সে নিচে, সে অধীন, সে পরনির্ভর, সে গুপ্ত সম্পত্তি হিসাবে পুরুষের ঘরে বন্দিনী।

    আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে, নারী-পুরুষ সমানাধিকারের ধারণার সাথে, নারীস্বাধীনতার বাস্তব প্রক্রিয়ার সাথে এই সমস্ত বিধিব্যবস্থাগুলির বিরোধ দেখা দিতে বাধ্য। ধর্মকে বাঁচিয়ে রেখে, সৎ ভাবে পালন করে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে এই আধুনিক বোধ ও আচরণকে গ্রহণ ও লালন করার কোনো উপায়ই নেই। ফলে যাঁরা ধর্মকে কিছুতেই ছাড়তে চান না, তাঁরা শেষ পর্যন্ত হয় এই প্রাচীন প্রথাগুলির বৈজ্ঞানিক ও উপকারী ভাষ্য খুঁজতে থাকেন; অথবা, ইতিহাস এবং বাস্তব তথ্য না জেনে, ধর্মের পরবর্তীকালীন বিকৃতিকে এই সব অন্যায় প্রথাগুলির প্রচলনের জন্য দায়ী করেন।

    কিন্তু, লক্ষ করুন, ধর্মীয় মৌলবাদ সেই দুদিক থেকেই লাভবান হতে থাকে। বহুবিবাহ বোরখা বা ঘোমটার বৈজ্ঞানিক সমর্থন পেলেও তার লাভ। ধর্ম কত ভাবনাচিন্তা করে কাজ করত দেখ! আবার পরবর্তী বিকৃতির তত্ত্ব গৃহীত হলেও তার সুবিধা। দেখ দেখ, আদিতে ধর্ম কত ভালো ছিল। চল, আমরা সেই আদি যুগের আদর্শকেই তুলে ধরি।

    বুর্জোয়া মানবতাবাদীরাই প্রথম নারীমুক্তির কথা ইতিহাসে উত্থাপন করেন। ব্যক্তি স্বাধীনতার যে ধারণা তাঁরা তুলে ধরেন, তাতে নারীকেও যুক্ত করতে হবে—এই বোধটা তাঁরাই প্রথম বলেছেন। এইভাবে তাঁরাই প্রথম সমাজ মননে সামাজিক মতাদর্শে নারীকেও মানুষ বলে গণ্য করার চিন্তা নিয়ে আসেন। কিন্তু ধনতন্ত্রেও নারীর যথার্থ মুক্তি আসেনি। কিছু আনুষ্ঠানিক অধিকার সে পেয়েছে মাত্র। মাত্র কয়েক পা সে এগোতে পেরেছে। তবুও যতটুকু অধিকার সে পেয়েছে তার সমস্তটাই এসেছে ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করেই। তার ঘেরাটোপে থেকে নয়। নারী শিক্ষায় সমস্ত ধর্ম, সমস্ত ধর্মীয় শক্তি সাধ্যমতো বাধা দিয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে, বহুবিবাহ রোধে সমস্ত ধর্ম সমস্ত ধর্মীয় শক্তি আজ অবধি বাধা দিয়ে যাচ্ছে।

    হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা নিবর্তন কিংবা বিধবা বিবাহ প্রবর্তন—কোনোটাই ধর্মের শুভবুদ্ধিতে সম্ভব হয়নি। ধর্মীয় বিশ্বাস আচার ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। যাঁরা আদিতে ধর্মের খুব ভালো ভূমিকার দাবি তোলেন, তাঁদের ভুলে গেলে চলবে না, সমাজ সংস্কার ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে কোনো আদি-ভালো-ধর্ম পন্থী ব্যক্তি বা শক্তি ভালো চোখে দেখেননি বা সমর্থন করেননি। শুরু করা তো দূরের কথা। আজও প্রাচীনপন্থী ধর্মীয় লোকেরা সতীপ্রথার মতো একটা বীভৎস নিষ্ঠুর কাজকে খুব উচ্চ মূল্য দিয়ে থাকে। অর্থাৎ, আরও এগোতে হলে নারীদের ধর্মীয় গণ্ডি থেকে আরও বেশ অনেক পা হেঁটে যেতে হবে।

    নারীর পোশাকের প্রশ্ন।

    ধর্মীয় মৌলবাদকে চিনতে হলে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে আত্মিক ঐক্যকে দেখতে হলে এই জায়গায় এসে আমাদের শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতেই হবে।

    ধনতন্ত্র নারীকে সামন্তী নাগপাশ থেকে যতটা মুক্ত করেছে, তার চেয়ে বেশি সে চেয়েছে নারী শরীরের মুক্তি। পর্দা বোরখা ঘোমটার সে বিরোধিতা করেছে প্রথম যুগে নারীশ্রমশক্তিকেও উৎপাদনে নিযুক্ত করার অভিপ্রায়ে; আর এখন সে উন্মুক্ত পোশাকের ওকালতি করছে নারী শরীরের পণ্যায়নের জন্য। নারী দেহ যত অনাবৃত তত বেশি করে এবং ভালো করে পণ্য হবে। তত শক্তিশালী মুনাফাকর্ষী পণ্য। শরীর পণ্য বিপণন, আবার শরীর দিয়েও অন্য পণ্য বিপণন। নারী পাচার, নারী বেচাকেনা, গণিকাবৃত্তি, বার-পাবে নারীর নগ্ন বা প্রায়-নগ্ন শরীরী উপস্থিতি—এইখানে নারীদেহ নিজেই পণ্য। আর চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, মডেলিং—ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীশরীর অন্য পণ্যের বিক্রির আকর্ষক-পণ্য! এই সব কিছুর মধ্যেই নারী শরীরের পণ্যায়নের আয়োজন। পুঁজির এতে বিপুল মুনাফা হলেও সমাজ জীবনে এর থেকে যে বিপুল কুফল বর্তাচ্ছে তা নিয়ে এখানে সবিস্তার চর্চার সুযোগ নেই, বোধ হয় দরকারও নেই।

    কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে। এই সবের মধ্য দিয়ে সমাজের এক বিস্তীর্ণ মণ্ডলে এই ধারণা নিরুচ্চারে প্রসারিত করে দেওয়া হয়েছে যে নারীর শরীর নিতান্তই সহজলভ্য এক দ্রব্য। যা ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যায়। আর এই নিঃশব্দ ধারণাই সামন্তী সমাজ থেকে চলে আসা ঘরোয়া নারী নির্যাতনের বহুপ্রচলিত সিলেবাসে যুক্ত করল আর একটি ধারাপাত: বহির্নিযাতন। কটূক্তি, বিরক্তি উৎপাদন, অশ্লীল ভঙ্গিমা, শারীরিক আক্রমণ, ধর্ষণ। [এই বিষয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি: মুখোপাধ্যায় ২০১৪, ৪৩-৬২] সাম্প্রতিক অতীতে নারী ধর্ষণ এক সাংঘাতিক বিপজ্জনক প্রবণতা হিসাবে ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানে দেখা দিয়েছে। ছয় বছর বয়সের শিশু থেকে শুরু করে সত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধা নারী পর্যন্ত কেউই এই আনুক্রমিক আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।

    আরও দেখুন, যখনই কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে, এক শক্তিশালী সম্প্রদায় আর এক দুর্বল প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের প্রথম লক্ষ্য হয় নারী। নারীদেরকেই সে মনে করে সবচেয়ে সহজ শিকার। ধর্মীয় বিশ্বাস, আদিকালের ভালো ধর্মের ধারণা—কোনো কিছুই তখন এর বিরুদ্ধে সামান্যতমও বাধা হয়ে উঠতে পারে না। গুজরাতের ক্ষেত্রে এই ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আবার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, বিশেষ করে, আল বদর, রাজাকার, প্রমুখ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনগুলিই পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে বাঙালি মেয়েদের যোগান দেবার প্রধান আড়কাঠি হয়ে ওঠে। জানা গেছে, এইভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনারা কমপক্ষে ৩ লক্ষ বাঙালি নারীর ইজ্জত লুট করে, ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতন করে এবং অবশেষে তাদের বড় অংশকেই তারা হত্যা করে ফেলে। এই সব তথ্য এখন এত সুবিদিত যে একে আর চাইলেও অস্বীকার করা যাবে না।

    সেই সঙ্গে এও বলে রাখি, আমার জানায় আজ অবধি কোনো মুসলিম ধর্মীয় সংগঠন—কি বাংলাদেশে, কি এপারে—পাক বাহিনীর সেই অত্যাচার বা জামাত শিবিরের সেই নারীদেহ যোগানদারিকে নিন্দা করেনি। করতে পারেনি। নিশ্চয়ই কিছু আরবি ধর্মীয় বয়েত এই নিন্দাকার্যের পক্ষে বাধা হয়ে আছে।

    স্বভাবতই আজকের সমাজে এই সব ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনায়ও সাধারণ মানুষ গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। তাঁরা এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বুঝতে পারেন, কোনো ধর্মমতেই এর কোনো সমাধান নেই। অথচ তাঁরা এর থেকে সমাধানের রাস্তা খুঁজে বেড়াছেন। আর ঠিক তখন—হ্যাঁ, এই সব জটিল মুহূর্তেই তো বিভিন্ন শক্তির আসল চেহারাটা বাইরে নগ্ন ভাবে বেরিয়ে আসে—ভারতে বিজেপি এবং তার সহযোগী শক্তিগুলির প্রতিনিধিরা, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সমচিন্তক ব্যক্তিরা কী বলছেন? তাঁরা নারীর পোশাককে দায়ী করছেন এই সব ঘটনার জন্য। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নারীকে মধ্যযুগীয় ঘরবন্দি জীবনচর্যায় ফিরে যেতে বলছেন। কেন? কারণ, সমস্ত ধর্মীয় চিন্তার মূল কথাই হল, নারীর স্থান ঘরের মধ্যে, সন্তান উৎপাদন ও তাদের লালন-পালনের কাজে। সমস্ত ধর্মই নারীকে পুরুষের অধীনস্থ জীব হিসাবে দেখেছে, পুরুষের শাসনাধীনে রাখার কথা বলেছে। নারী স্বাধীনতা, নারীর ঘরের বাইরে পুরুষের সাথে সমানভাবে সামাজিক দায়দায়িত্ব পালনে তার আপত্তি একেবারে মৌল ভিত্তিগত। এই সব আধুনিক জীবনবোধ আপন জীবনে পেতে হলে, আয়ত্ত করতে হলে, একে সমর্থন করতে গেলে ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে আসতেই হবে।

    অথচ কী অদ্ভুত দেখুন! কি বিজেপি কি জামাতি—কেউই কিন্তু পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে, বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে, টুঁ শব্দটিও করছে না। একবারও বলছে না, সাবান শ্যাম্পু তেল ক্রিম ইত্যাদির বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে, বা এই সব পণ্যের বিজ্ঞাপনে নগ্ন নারীদেহ প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে, কিংবা এই জাতীয় সমস্ত বিজ্ঞাপন পুরুষদের দিয়ে করাতে হবে। কেন? কারণ, ধর্মীয় মৌলবাদী পাঁকে হাবুডুবু খেলেও তারা বোঝে, কোথায় খাপ খুলে লাভ নেই। আর আমাদের এখান থেকেও বুঝে নিতে হবে, এরা কাদের পক্ষের লোক! এদের শালীনতার দৌড় কতদূর! বুঝে নিতে হবে, নারীর পোশাক নিয়ে এদের মাথাব্যথার আসল জায়গাটা কী!!

    ভারতে তথাকথিত লাভ-জেহাদিদের কথা শুনলেও এটা আরও সুন্দর করে বোঝা যাবে। যখন বলা হচ্ছে, মুসলিম যুবক হিন্দু নারীকে বিয়ে করলে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি হবে (কথাটা যদিও ভুল), তখনও সে নারীকে শুধু সন্তান উৎপাদনের কারখানা হিসাবেই দেখছে (কথাটা ভুল, কেন না, সেই যুবক একজন মুসলিম নারীকে বিয়ে করলেও একই সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিতে পারে। বরং বলা যায়, এতে হিন্দু সন্তান উৎপাদনের সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে)। আর এইভাবে হিন্দু-মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক প্রেম ভালোবাসা বিবাহ—সব কিছুরই বিরোধিতা করছে। ধর্ম এখানেও আধুনিক জীবন ধারণার বিরোধী।

    কেউ কেউ এরকম একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন, কোরানে বোরখার কথা নেই, আদি ইসলামি শাস্ত্রে নারীর মুখ-চোখ ঢাকার কথা নেই, ইত্যাদি। তাঁরা বুঝতেই পারেন না, আজকের দিনে এই সব কথার কোনো মানে নেই। যদি আদি ইসলামি শাস্ত্রে নারীর হিযাব পরিধানের কথা থেকে থাকে, সেটাই মৌলবাদীদের জন্য যথেষ্ট। তার ইঞ্চিফুট নিয়ে আমি আপনি বিবাদ করতে পারি, কিন্তু মৌলবাদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে: সমস্ত ঢাকো। তাই এখানে আমাকে আপনাকে যুক্তি তর্ক করতে হবে, কোরানে বলেছে বলেই কি আজকের দিনে তা মেনে চলা সম্ভব, না উচিত? কোরানে একজন মুসলিম পুরুষকে পরপর চারটে বিয়ে করার অধিকার দিয়েছে বলে কি আজকের দিনে তা আমরা অনুমোদন করতে পারি? সেখানে কোন কথাটা কেন বলা হয়েছিল, তা নিয়ে আমরা চর্চা করতে পারি, তর্ক করতে পারি, বুঝবার চেষ্টা করতেও পারি। কিন্তু সেই সব বিধান আজ আর আমরা পালন করতে পারি না। এই সরল কথাটা সহজ করে স্পষ্ট করে বলার সাহস আমাদের অর্জন করতে হবে।

    ভয়ের কিছু নেই। প্রথমে বোঝাতে না পারলেও ধীরে ধীরে পারব। যেমন করে একদিন রামমোহন পেরেছিলেন, বিদ্যাসাগর পেরেছিলেন। আমরা দেখাতে পারব, দেখ, কোরানে সর্বাধিক চার জন স্ত্রী রাখার কথা বলা হলেও হজরত মহম্মদের নিজেরই ছিল বারো (বা মতান্তরে তেরোটি) স্ত্রী। তাহলে তুমি কোনটা মানবে? প্রিয় নবীর কথা না আচরণ? তখন এই কথাও উঠবে, কোরান হজরত মহম্মদের জীবদ্দশায় লিখিতই হয়নি। হয়েছে তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পরে। সেও ঠিক। তাহলে হজরতের ব্যক্তি জীবনের আচরণ জানা থাকা সত্ত্বেও যাঁরা সঙ্কলন করলেন, তাঁরা কোরানে কেন সংখ্যাটাকে চার-এ সীমাবদ্ধ করলেন? নিশ্চয়ই তাঁরা বুঝেছিলেন, উদাহরণ যাই থাকুক, যত উঁচু আসন থেকেই এসে থাকুক, সমাজে তাকেই নিয়ম হিসাবে চালু করা যাবে না। আর, বিশ পঞ্চাশ বছর বাদেই যদি এই অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি হয়ে থাকে, তাহলে এটা বুঝতে বা বোঝাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, সেই সময় থেকে দেড় হাজার বছর পরে সেদিনকার নির্দেশ বা উদাহরণ আজ তো আমরা আর চাইলেও মেনে চলতে পারি না।

    আরও দেখুন, কোরানে দাস বা গোলামদের প্রতি সদয় ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। যার মানে হল, দাসপ্রথাকে সেখানে মেনেই নেওয়া হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই সেই সব কথা বলা হয়েছে। আজ কোনো সভ্য দেশের সংবিধানে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী দাসপ্রথা মেনে নিয়ে দাসদের প্রতি কী আচরণ করা হবে তা লেখা যাবে? যাবে না। পক্ষান্তরে, এই যে বোকো হারাম, আইসিস, ইত্যাদি কিছু ইসলামি মৌলবাদী সংগঠন বিধর্মীদের দাস করার পক্ষে ফতোয়া দিচ্ছে, লক্ষ করলেই দেখা যাবে, তারা কিন্তু কোরান বা হাদিশের বিধান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েই সেই কথা বলছে। ফলে কোরানের অন্য বাণী দিয়ে অথবা এই সব বিধানের অন্যতর ব্যাখ্যা উপস্থিত করে আমি আপনি এদেরকে পরাস্ত বা নিরস্ত করতে পারব না।

    শুধু তথ্যের দিকে খোলা চোখে তাকালেও ধর্মীয় মৌলবাদের আগ্রাসী প্রসারণের সাথে সাথে ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানে যেভাবে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা বেড়ে চলেছে, নারী নিগ্রহ ধর্ষণ ও আরও নানা রকম নিপীড়নের ঘটনার সংখ্যা এবং ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, বিশেষ করে ভারতে যেভাবে ক্রমবর্ধমান হারে দলিত সম্প্রদায়ের উপরে ব্রাহ্মণ্যবাদী অত্যাচারের ঘটনা ঘটে চলেছে—তাতেও এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিশুদ্ধ বা আদি ধর্মের আওয়াজ দিয়ে হিন্দু এবং/কিংবা মুসলিম মৌলবাদীরা দেশ জাতি ও মানব সমাজকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চায়!

    আবার আমি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই: মৌলবাদ মানুষকে ইতিহাসে মানুষেরই অতীতের বর্জিত জীবন-ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। অন্তত তার পক্ষে দাবি করে। আর যেহেতু অনেকেই না জেনে বিশ্বাস করেন, আদিতে ধর্ম অনেক ভালো ছিল, পরে স্বার্থান্বেষীরা এসে তাকে বিকৃত ও খারাপ করেছে, তাই তাদের বক্তব্য একটা বিরাট অংশের ধর্মবিশ্বাসীকে আকৃষ্ট করতে পারে।

    [১১] মতাদর্শগত সংগ্রাম: সামনেই দুই-পা

    কিন্তু একথা তো ঠিক, রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর দুজনেই তাঁদের সংস্কার কার্যক্রমের সমর্থনে আদি হিন্দু শাস্ত্রের দোহাই দিয়েছিলেন। অনুকূল নজির তুলে এনেছিলেন। সুতরাং আজ আমরাও যদি সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াইতে বেদ পুরাণ বা কোরানের থেকে প্রাসঙ্গিক ভালো ভালো কথা তুলে ধরতে পারি, তাতে ক্ষতি কী? এই প্রশ্নটাও অনেককে ভাবাচ্ছে। অনেকে এইভাবেই লড়াই করার কথা ভাবছেন। লড়াইটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবছেন।

    রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরের রণকৌশলের কথাটাই আগে বিচার করি। তাঁরা যথাক্রমে ঊনবিংশ শতাব্দের গোড়ায় এবং মাঝামাঝি পর্বে তাঁদের সংগ্রামগুলি করেছিলেন। তখন সাধারণ মানুষের জীবনে ধর্মের বিপুল প্রভাব ছিল। অবস্থাটা আজকের মতো ছিল না। শাস্ত্রটাস্ত্রে কী লেখা আছে কেউ জানত না পড়ত না, কিন্তু টিকিধারী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দেওয়া ব্যাখ্যা তারা মেনে চলত। ফলে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহনকে, বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগরকে শাস্ত্রীয় সমর্থন দেখাতে হয়েছিল। সেই পরিস্থিতি আজ আর নেই। ধর্মের দাপট আগের তুলনায় অনেকখানি কমে গেছে। ধোপা-নাপিত বন্ধ করে রাস্তায় হাঁটার পথ বন্ধ করে বা খাওয়ার জল নিতে না দিয়ে বেকায়দায় ফেলার ক্ষমতা তার আজ আর প্রায় নেই বললেই চলে। এই ক্ষমতা চলে গেছে রাজনৈতিক দলগুলির হাতে। তারা অবশ্য সরকারে থেকে এই একই ধরনের কাজ করতে পারে, আজকাল করেও থাকে বিরোধী দল বা ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে। বা আবার সেই জাতিবাদী প্রথা ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু শাসক দলের মদত না পেলে ধর্মের নামে এরকম কাজ করার ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই আজ আর ধর্মগুরু সাধুবাবা উচ্চ বর্ণ কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেই।

    দ্বিতীয়ত, সেই সময়ে রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর—দুজনের ক্ষেত্রেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আশ্বস্ত করার একটা মস্ত ব্যাপার ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের আগে পর্যন্ত কোম্পানির লোকদের মনোভাব ছিল, উপনিবেশের দেশি লোকদের ধর্ম চর্চায় বাধা না দিয়ে বা হস্তক্ষেপ না করে যতদূর পারা যায় নির্বিঘ্নে বাণিজ্য ও লুণ্ঠন চালিয়ে যাওয়া। তখন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার কথা তাদের মাথাতে আসেনি। তাই তারা সাবধান হয়ে এগোতে চাইছিল। ভারতীয় মনীষীরা যদি সতীপ্রথার বিরুদ্ধে বা বিধবা বিবাহের সমর্থনে কোনো প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রীয় প্রমাণ দাখিল করতে না পারতেন, তারা আইন করে একটার নিবর্তন ও অন্যটার প্রবর্তনের দিকে যেত না। এটা রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর—দুজনেই বেশ ভালোরকম জানতেন। এই ব্যাপারটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমাদের সামনে এখন এই সমস্যাটাও নেই। আমরা যদি আজকের দিনে সমাজের কোনো কুপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করি (যেমন, ডাইনি প্রথা), তার জন্য শাস্ত্রীয় সমর্থন খুঁজে বের করার খুব একটা দরকার নেই।

    রামমোহনের না থাকলেও বিদ্যাসাগরের অবশ্য আরও একটা গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে তিনি ছিলেন নাস্তিক, ধর্ম ঈশ্বর ব্রহ্ম—কোনো কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করতেন না। ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রগুলির সম্পর্কে এবং বড় বড় শাস্ত্রকারদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। ধর্ম লোকাচার দেশাচার —কোনো কিছুর প্রতি তার কোনো পিছুটান ছিল না। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ, তাই তাঁর এই মনোভাব তিনি বড় একটা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করতেন না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলে অফ-লাইন আলোচনায় এই সব ব্যাপারে কিছু কিছু যা বলে গেছেন তা থেকে (মানে, তাঁদের স্মৃতিচারণ থেকে) আমরা এটা জানি। তিনি চেয়েছিলেন, বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্র গ্রন্থে এই সব (বিধবার পুনর্বিবাহ, বাল্যবিবাহ, গর্ভনিষেক, ইত্যাদি) সামাজিক সমস্যার ব্যাপারে যে অনেক রকম বিচিত্র ও পরস্পর বিরোধী, এমনকি হাস্যকর সব বিধান দেওয়া আছে—সেই দিকে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। তাঁর শাস্ত্রোল্লেখ, শাস্ত্র চর্চার ধরন এবং বিতর্কের রীতি অনুসরণ করলেই এই সত্য ধরা পড়বে।

    হ্যাঁ, অনেকেই বলবেন, এই কথাগুলো হয়ত হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রে সত্য। তারা নানা কারণে শিক্ষাদীক্ষা চাকরিবাকরি ইত্যাদি নানা দিক থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। অন্তত পশ্চিম বাংলায় এই সব প্রসঙ্গ এখন খোলামেলা আলোচনা করা যায়। কিন্তু মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রে এই ভাবে কথা বলা চলে না। তারা সব ব্যাপারেই আজও অনেকটাই পশ্চাদপদ। এইভাবে বললে তারা নেবে না। নিতে পারবে না। হয়ত লাঠি নিয়ে তাড়া করবে। এরকম যুক্তিও অনেকে করে থাকেন। ফলে বোরখাই হোক, বিবাহ বিচ্ছেদই হোক, আর বহুবিবাহই হোক, কোরান হাদিশ ইত্যাদির সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। অন্তত নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তার বিরুদ্ধে কিছু বলা উচিত হবে না।

    কেউ কেউ এর সমর্থনে আবার মার্ক্সের সেই বিখ্যাত উক্তির “পুরোটা” তুলে ধরে বোঝাতে চান, তিনি ধর্মকে শুধু আফিমের তুলনা করেননি। বলেছেন, ধর্ম হচ্ছে সাধারণ নিপীড়িত মানুষের আত্মিক সান্ত্বনার জায়গা। গরিব মানুষের দীর্ঘশ্বাস। পার্থিব শোষণ জুলুমের বিরুদ্ধে স্বর্গীয় প্রতিবাদ। [Marx 1976, 39] তাই ধর্মীয় আবেগে আঘাত করে কোনো সামাজিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। মাঝখান থেকে মানুষ আরও আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

    এর উত্তরে আমি আপাতত দুটো কথা বলব। প্রথমত, এরকম চেষ্টা আমরা বহু দিন ধরে করে এসেছি। কোনো লাভই হয়নি। মাঝখান থেকে, বামপন্থী মার্ক্সবাদী বা যুক্তিবাদীদের তরফ থেকে এরকম যুক্তি উত্থাপন করার দ্বারা আমরা তাদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি, প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থের প্রতি ভক্তিভাব ও মান্যতা বাড়াতেই সাহায্য করেছি। সেইগুলিকে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিতে দেখবার সামান্য আগ্রহটুকুও তৈরি করতে পারিনি। অতএব এখন থেকে অন্তত এই চেষ্টা আমাদের পরিত্যাগ করা উচিত। বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে মুসলিম (বা অন্য যে কোনো) ধর্মশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। আমার বক্তব্য হল, আমাদের তরফে আমরা প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলির প্রশংসা বা সমালোচনা কোনোটাই নিজের থেকে আম জনতার কাছে নিয়ে যাব না। প্রশ্ন উঠলেও আমরা তার মধ্যে আজকে নেওয়ার মতো কী কী ভালো জিনিস আছে, তার ব্যাখ্যায় ঢুকব না। আমাদের কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র এইটা দেখানো যে তার মধ্যেকার ভালোটাও শুধুমাত্র সেই সময়ের পক্ষেই হয়ত ভালো ছিল, তার খারাপটাও তাই। বর্তমানে আমরা যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন, তার সমাধান সেখানে নেই বা থাকার প্রশ্নও নেই।

    দ্বিতীয়ত, ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসাবে মুসলিম সমাজের ভেতরে মানসিকভাবে এমনিতেই একটা ভয়-ভয় ভাব কাজ করে। এই বুঝি তাদের ধর্ম ধর্মীয় সংস্কৃতি বা তাদের স্বসত্তা (identity) বিপন্ন হয়ে পড়ল। ফলে তাদের আচারে বিচারে আহার বিহারে এর একটা প্রতিফলন সব সময়ই ঘটতে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তা ক্রমশ একপেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, উচ্ছেদ, নারী-ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যাকাণ্ডের দিকে গড়িয়েছে (পাকিস্তান বা বাংলাদেশেও অবশ্য তাই)। তাই তারা তাদের শাস্ত্র, আচার-প্রথা, পোশাক, ইত্যাদিকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে নিজেরাও বাঁচতে চায়, তাদের আপাত-স্বসত্তাকেও ধরে রাখতে চায়। এই অবস্থায় আমরাও যদি সেই দিক থেকেই তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগাতে যাই, আমরা এই পশ্চাদ-আকর্ষণকেই আরও শক্তিশালী করে বসব।

    অন্যদিকে আমরা যদি তাদের ব্যক্তিগতভাবে ধর্মচর্চার বিরোধিতা না করার পাশাপাশি সমাজ জীবনে তাদের শ্রেণি ও পেশাগত অবস্থানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি, সেখানে সহজেই দেখানে যাবে, তারা আর সংখ্যালঘু নয়। শ্রমিক চাষি অসংগঠিত শ্রমিক শিক্ষক অধ্যাপক কেরানি দোকানদার অটোচালক রিকশাচালক—কোনো হিসাবেই সে আর সংখ্যালঘু নয়। সে তখন সংখ্যাগুরুর অন্তর্ভুক্ত। ৯৯% বিশাল শোষিত সমাজের একজন। তখন এমনিতেই কোরানে বা হাদিশে কী বলা আছে, তা নিয়ে আমাদের আর মাথা ঘামাতে হবে না।

    বরং খুব সত্যি কথা বলতে গেলে, মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা ক্ষুদ্র অংশের মধ্যেও এই বোধটা ধীরে ধীরে জাগছে। বিজেপি-র লোকেরা যখন বলছে, আমরা বামপন্থীরা মার্ক্সবাদীরা নাকি ভোটের জন্য মুসলিম তোষণ করছি, তখন তারা আসলে আমাদের আদর্শগত আপসের কথাই ইঙ্গিত করছে, আর বাস্তবে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সামাজিক অবস্থান ক্রমশ নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে। সাচার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর এই সত্য আরও বেশি করে সকলের চোখ খুলে দিয়েছে। অর্থাৎ, আমরা যতই টুপিদাড়ির তোষামোদ করছি, ততই তারা শিক্ষায় চাকরিবাকরিতে ক্রমাগতই পিছিয়ে পড়ছে। এই তোষণ তাদের মধ্যেও আর বেশিদিন সাড়া জাগাতে পারবে না। তারাও আর বেশি দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভোটব্যাঙ্ক হয়ে থাকতে চাইবে না।

    আজকে পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূল সরকার এই পরিচিত রাস্তাই বেছে নিয়েছে। তারও চাই মুসলমান ভোট। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো পন্থায়। ইমামভাতা, ইত্যাদি আদালতের রায়ে আটকে গেলেও তার লক্ষ্যও একই। এখন সে ঘুরিয়ে ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে সেই টাকা বরাদ্দ ও খয়রাত করে যাচ্ছে। এমনকি পশ্চিম বঙ্গ নজরুল অ্যাকাডেমি গঠনকেও তারা তাদের সংখ্যালঘু উন্নয়নের কর্মসূচির একটি পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করেছে। ভাবা যায়? নজরুলের কাব্য সঙ্গীত চর্চা মানে মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা? শুধুমাত্র মুসলিমদের মধ্যে এই চর্চা হবে? আধর্ম বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সঙ্গীতের সাথে নজরুলের সম্পর্ক নেই? আসলে এই ছোট বৃত্তের মধ্যে তারা নিজেরাও আটকে পড়েছে, মুসলিম জনসাধারণকেও আটকে রাখতে চাইছে।

    এটাও তো সত্যি কথাই যে কিছুকাল আগে এই মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক অটুট ধরে রাখার জন্যই সি পি আই (এম) সরকারে থাকার সময় তসলিমা নাসরিনের একটা বই “দ্বিখণ্ডিত” নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। আদালতে সেই সিদ্ধান্ত বিশ্রীভাবে খারিজ হয়ে যাওয়ার পর তারা কলকাতার রাস্তায় কিছু মুসলমান যুবককে জড়ো হয়ে একটা প্রক্সি-গোলমাল পাকাতে দিয়ে এবং তারপর (এক অলিখিত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী) তা অচিরেই সামলে নিয়ে এরকম একটা বাতাবরণ তৈরি করে যে তসলিমা কলকাতায় থাকলে রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম অশান্তি বাড়বে। এমনকি, সত্যিই তা ঘটে কিনা তা দেখার জন্য একদিনও অপেক্ষা না করে সেই রাতেই তারা তসলিমাকে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে জবরদস্তি কলকাতা থেকে এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

    এতে মুসলিম সমাজের কার কী উপকার হয়েছে? বরং এর মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সেই ভ্রান্ত লাইন: মুসলিম সমাজকে আকর্ষণ করতে তাদের মধ্যেকার সবচাইতে পিছিয়ে থাকা চূড়ান্ত রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতাগুলিকে লালনপালন কর। উৎসাহ দাও। আধুনিক শিক্ষা, আধুনিক জীবনরীতি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে তাদের টেনে আনার চেষ্টাও কোরো না। এর ফলে মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকে যাঁরা রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, তাঁরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন, ঘরে-বাইরে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন। আর প্রতিক্রিয়ার শক্তি, মৌলবাদী শক্তি, উজ্জীবিত হয়ে উঠছে। আবার এই জাতীয় ঘটনা দেখিয়েই সঙ্ঘ পরিবার তথাকথিত মুসলিম তোষণের অভিযোগ এনে সাধারণ হিন্দু জনসাধারণের মন বিষিয়ে তোলার সুযোগ পায়।

    হ্যাঁ, একথা ঠিক যে তসলিমা নাসরিনের বেশ কিছু রচনায় ধর্মের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে অনেক কড়া কড়া কথা আছে। তাতে হয়ত কিছু ধর্মভিরু মুসলিম আহত বোধ করতে পারে। কিন্তু ইসলামপন্থীদেরও হাত পা তো কেউ বেঁধে রাখেনি। তাঁরা তার জবাব দিন না। তসলিমার লেখায় যদি ভুল তথ্য থাকে, ইতিহাসের বিকৃতি থাকে, হজরত মহম্মদ সম্পর্কে ভুল তথ্য ও সমালোচনা থেকে থাকে, তাঁরা সেটা পালটা উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দিয়ে ধরিয়ে দিন। প্রচার করুন, বক্তৃতা দিন, লিখুন। আমরাও পড়ি শুনি। ভয়ের কী আছে? তাঁকে মেরে ফেলতে হবে কেন? তাড়িয়ে দিতে হবে কেন? তর্ক এড়িয়ে আঘাত করতে চাইছ, মুখ বন্ধ করে দিতে চাইছ মানে হল: তুমিও সম্ভবত মনে মনে মেনে নিচ্ছ, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে কিছু না কিছু সত্য আছে। যা নিয়ে আলোচনা হোক, তুমি একেবারেই চাও না। কেন না, তুমি জান সেই সব কথাকে কাটতে পারবে না।

    এই কথাটা যদি সেদিন বামফ্রন্টের নেতারা বলতে পারতেন, সি পি আই (এম) নেতারা জোর দিয়ে বলতে পারতেন (সেই সাংগঠনিক তাকত তখন তাঁদের ছিল), শুধু ইসলামি নয় হিন্দু মৌলবাদেরও হাত থেকে একটা বড় অস্ত্র চলে যেত। তারপর তাঁরা তসলিমার লেখায় কোথায় কতটা উগ্রতা আছে অহেতুক আঘাত আছে, তা নিয়ে তাঁরও সমালোচনা করতে পারতেন। কিন্তু সরকারপক্ষ যুক্তিতর্কের স্বাভাবিক পথটি এড়িয়ে গিয়ে ধর্মান্ধ মোল্লাতন্ত্রের কাছেই আত্মসমর্পণ করলেন। সেই সহজ রাস্তাটা তাঁরা বেছে নিলেন, যার দ্বারা দুই মৌলবাদী শক্তিরই উপকার হল। গান্ধীর সেই পথ প্রদর্শনের কী সুদূর প্রসারী প্রভাব!

    অথচ সাম্প্রতিক কালে ফ্রান্স একটা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। ফরাসি সরকার ঘোষণা করেছে: পাব্লিক স্কুলে পড়তে হলে মুসলিম মেয়েদেরও স্কুল পোশাক ছাড়া অন্য বাড়তি কিছু (যথা বোরখা/ওড়না ইত্যাদি) পরে মাথা মুখ ঢেকে ক্লাশে আসা চলবে না। কিছুদিন সেখানকার পশ্চাদপদ মুসলিম জনসাধারণের একটা অংশকে উত্তেজিত করে মৌলবাদীরা কিছু কিছু জায়গায় ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেছিল, কিচ্ছু লাভ হয়নি। সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। মুসলিমদের কোনো একটা গোষ্ঠী ইউরো আদালতে মামলা করেছিল এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। সেই আদালতও রায় দিয়েছে ফরাসি সরকারর সিদ্ধান্তের পক্ষেই।

    কিছু দিন আগে চিন সারা দেশেই যে কোনো বয়সের মুসলিম মহিলাদের বোরখা হিজাব পরার উপর কড়া নিষেধ আরোপ করেছে শুধু নয়, আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে পুরুষদের বড় দাড়ি রাখার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কই, কেউ কোনো ট্যাঁ-ফো করছে না তো! আরব দুনিয়ার কোনো মাতব্বর এখন অবধি চিনা পণ্য বয়কটের ফতোয়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ভারত বাংলাদেশ বা পাকিস্তানেও কাউকে এ নিয়ে গাঁইগুঁই করতে শুনিনি। ধর্ম গেল, ইসলাম বিপন্ন, ঈমান রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে—না, কেউ কোথাও এই রকম আওয়াজ তুলছে না। যারা তুলবে, তারাও জানে, কোনো লাভ নেই! আমি মনে করি, পৃথিবীর সমস্ত দেশেই যদি যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি এইভাবে কড়া হাতে রক্ষণশীল ও মৌলবাদীদের মোকাবিলা করে, মৌলবাদীদের পায়ের তলা থেকে মাটি অনেকটাই সরে যেতে থাকবে। প্রগতিশীল শক্তি আর একটু দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলার ভরসা পাবে।

    এখনকার তুলনায় দু চারশ বছর আগে সাধারণ মানুষের উপর ধর্মের অনেক বেশি প্রভাব থাকা সত্ত্বেও যদি মধ্যযুগের ধর্মতান্ত্রিক সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর এতগুলো দেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন সম্ভব হয়ে থাকে, আজ তো তাকে ভয় পাওয়ার কারণ আরও কম, যদি অবশ্য তাকেই ব্যবহার করার বদিচ্ছা না থাকে!

    পরিশেষে, মার্ক্সের মন্তব্য সম্পর্কেও কিছু কথা বলা দরকার।

    এক নম্বর কথা হল, অনেকেই ভুলে যান যে মার্ক্স যখন (১৮৪৪) এই কথাগুলো বলেছেন তখনও তিনি পুরোপুরি মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠেননি, হওয়ার পথে। তখন তিনি হেগেলের প্রভাব কাটিয়ে উঠে মূলত ফয়ারবাখের মানবকেন্দ্রিক বস্তুবাদের ভাবশিষ্য। ধর্মের আধ্যাত্মিকতা, ঐশ্বরিকতার বিরুদ্ধে পার্থিব চিন্তাকে, ঐহিক চিন্তাধারাকে জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। স্বর্গের মোহ থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য এই পৃথিবীতেই স্বর্গ স্থাপনার কথা ভাবছেন।

    দ্বিতীয়ত, তখন জার্মানিতে খ্রিস্টীয় ভাবধারার বিরুদ্ধে নানা রকম দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের সমালোচনা চলছিল। ব্যক্তি যিশু খ্রিস্টর ঐতিহাসিক বাস্তবতা নিয়েও তখন তুমুল চর্চা বিতর্ক ও গবেষণা চলছিল। কিছু কাল পরে এঙ্গেল্‌সও সেই বিতর্কে যোগ দিয়ে খুব মূল্যবান কিছু কথা বলেছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে মার্ক্স এই কথাটা বলে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ধর্ম একটি মোহময় ভাবধারা হলেও এই মোহ থেকে মুক্ত করতে হলে, যে সমাজ ব্যবস্থা সেই মোহর জন্ম দেয়, তাকেই পাল্টাতে হবে। তাহলে কি সেই সমাজ পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত মার্ক্সবাদীরা ধর্মের সমালোচনা মুলতুবি রাখবে? এরকম ভাবনা যে অন্তত মার্ক্সের তরফে হাস্যকর তার প্রথম এবং প্রধান প্রমাণ এই যে মার্ক্স নিজেই তা স্থগিত করে দেননি। একটা বেশ বড় আকারের প্রবন্ধ লিখেছিলেন এই বিষয়ে।

    সুতরাং মোহ সৃষ্টিকারী বর্তমান শোষণমূলক ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং তৎসৃষ্ট ধর্ম-মোহাঞ্জন—এই দুইয়েরই বিরুদ্ধে চলবে আমাদের যুগপৎ সংগ্রাম। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক শ্রেণি সংগ্রামের মধ্যেই অঙ্গীভূত করে নিতে হবে এই মোহমুক্তির সংগ্রাম প্রয়াসকেও। কাজটা কঠিন। ঠিক। কিন্তু মার্ক্সবাদীদের কেউ তো দিব্যি দেয়নি কাজটাকে সহজ করে তোলার জন্য বা কঠিন কাজকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের যে সমস্ত মতাদর্শগত লড়াই, তার মধ্যেই একটা অধ্যায়ে থাকবে এই ধর্মীয় মোহমুক্তির যুক্তি তর্ক ও প্রেরণা। একজন বুর্জোয়া মানবতাবাদী কবি হয়ে রবীন্দ্রনাথ যদি “ধর্মমোহ”-র মতো কবিতা লিখতে পেরে থাকেন, “যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে” তাকে ভাঙবার সোচ্চার আহ্বান জানিয়ে থাকতে পারেন, মার্ক্সবাদীদের এই প্রশ্নে এত দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকবে কেন?

    [১২] আমাদের কাজ

    তবে, পাশাপাশি এটাও আমাদের অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের এই কাজটা মূলত সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের প্রধান কাজের একটা অঙ্গ, এটাই আমাদের সকলের প্রধান কাজ নয়। সেই সমাজ পরিবর্তন মানে হল, বর্তমান শ্রেণিবিভক্ত সমাজের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিবর্তন, শুধু হাত আর পায়ের নয়। শুধু মাথারও নয়। এই সমাজ পরিবর্তন সম্ভব হবে সমগ্র শোষিত শ্রেণির সুদৃঢ় ঐক্যের ভিত্তিতে। আর এই ঐক্য গড়ে উঠবে একমাত্র সমমতের সহমতের ভিত্তিতে, ধর্ম বর্ণ জাতি লিঙ্গ ভাষা ইত্যাদি সমস্ত বিভাজনরেখাকে অতিক্রম করে। মুছে দিয়ে নয়; এর মধ্যেকার সামাজিক ভেদচিহ্নগুলি সমাজে আরও বহু দিনই থেকে যাবে। নারীপুরুষের ভেদ তো আরও মৌলিক ও জৈব চরিত্রের। তার তো অবলুপ্তির প্রশ্নই ওঠে না। কিন্ত ভেদ মানেই বিভাজন নয়, বিভাজন মানেই বৈষম্য নয়। মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক কিছু ভেদ সহই শ্রেণিগত ঐক্য গড়ে উঠবে, অন্তত সেইভাবেই গড়ে তুলতে হবে। আর তার জন্যই এই সব প্রশ্নের স্পষ্ট সদুত্তর দিয়ে দিয়ে আমাদের মধ্যে মতাদর্শগত নৈকট্য স্থাপন করতে হবে। শুধু আন্দোলন করব, কিন্তু আন্দোলনের মধ্যেকার মতাদর্শগত প্রশ্নগুলির সুষ্ঠ মীমাংসা করব না—এই ফাঁকি দিয়ে আর বামপন্থী মার্ক্সবাদী বা যুক্তিবাদীদের কাজ চলবে না। সঙ্ঘ পরিবার (অন্যান্য দেশে তাদের অন্যান্য জাতভাইরা) এবার এমন জায়গায় আমাদের ঠেলে দিয়েছে যে পুরনো ফেলে রাখা কাজগুলো আমরা চাই বা না চাই এখন সম্পন্ন করতেই হবে।

    শাসক শ্রেণির এখন ধর্মকে দুই কাজে প্রয়োজন। একটা হল, তার নিজের অপকর্মের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মানুষকে অন্য দিকে অন্য বোগাস কাজেকম্মে ব্যস্ত রাখা। আর একটা হল, শোষিত মানুষের সার্বিক ঐক্যে ফাটল ধরানো। তার দ্বারা ক্রম অগ্রসরমান সমাজ বিপ্লবকে কিছু দিনের জন্য হলেও ঠেকিয়ে রাখা। অথবা কোথাও সমাজ পরিবর্তন ঘটে থাকলে তাকে ভেঙে দেবার আয়োজন করা। ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ—কোনো দেশই এই পরিকল্পনার বাইরে নেই। ফলে সংশ্লিষ্ট সকলেরই সাবধান হওয়ার সময় এসেছে।

    ভারতবর্ষের বুকে আমরা বিজেপি-আরএসএস ইত্যাদির মাধ্যমে এই পরিকল্পনারই এক রুদ্রমূর্তি দেখতে পাচ্ছি। এবারে ওরা একটা সাঁড়াশি আক্রমণ হানতে চাইছে। একটা হল চিন্তার জগতে আক্রমণ। গণেশ, কর্ণ, গান্ধারী ইত্যাদি-সম্পৃক্ত প্রশ্ন। প্রাচীন ভারতের মুনিঋষিদের ঘাড়ে অসম্ভব সমস্ত আবিষ্কারের কৃতিত্ব চাপানোর গল্প। গীতা কিংবা সংস্কৃত ভাষা চাপিয়ে দেবার অপপ্রয়াস! আর সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিদ্বেষবাষ্প ছড়ানোর আয়োজন। আর একটা হল, সরকারি শাসন ক্ষমতায় বসে জনসাধারণের উপর একটার পর একটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আক্রমণ।

    দ্বিতীয়টাই আসল।

    মনমোহন সিং সরকার একচেটিয়া পুঁজিপতিদের আদেশ পালনে যথেষ্ট তৎপরতা দেখাতে পারেনি বলেই ওদের সরিয়ে এদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে ওরা। মোদীর সঙ্গে আদানী আম্বানীদের প্রতিদিনকার ওঠাবসা এখন বুর্জোয়া গণমাধ্যমগুলির চোখেও খুবই বিসদৃশ ঠেকছে। তারাও মাঝে মাঝে তীর্যক মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীকে সচেতন করে দিতে চাইছে: তুমি কাদের কুলের জামাই সেটা এত প্রকাশ্যে রোজ রোজ দেখিয়ে দিও না বাপু। জাতীয় সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, আর্থিক সম্পদ—সমস্ত কিছু দেশি বিদেশি করপোরেটদের হাতে বিনি পয়সায় অথবা নামমাত্র মূল্যে তুলে দিচ্ছে মোদী সরকার। জনসাধারণের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সমস্ত ভর্তুকি ছাঁটাই করে লক্ষ কোটি টাকার ভর্তুকি দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বিরাট অঙ্কের ঋণ খেলাপি করা বৃহৎ ব্যবসায়ীদের। দেশের অর্থনীতিকে বিদেশি পুঁজির যথেচ্ছ লীলাভূমি করে ফেলতে চাইছে তারা।

    আর ওদের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির এই দ্বিমুখী আক্রমণের চরিত্র এমন যে আমরা হয়ত অসতর্কভাবেই যে কোনো একটার দিকে নজর দেব, অপরটা দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। কেউ বেশি শ্রেণি সচেতন হতে গিয়ে সাংস্কৃতিক আক্রমণগুলিকে অবহেলা করবেন; কেউ আবার হয়ত সাংস্কৃতিক আক্রমণগুলিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আর্থরাজনৈতিক আক্রমণগুলিকে খাটো করে ফেলবেন। আর যেটাই নজরের বাইরে থাকবে, সেখান দিয়েই এক মারাত্মক বিপদ এসে উপস্থিত হবে। তাতে ওদের লাভ। ওরাও এটাই চাইছে। অতএব আমাদেরও সাবধান হতে হবে। শিখতে হবে, কীভাবে ওদের দ্বিমুখী আক্রমণকে এক যোগে মোকাবিলা করা যায়, তার জন্য কীভাবে উভয় ফ্রন্টে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

    সামনে এক কঠিন পরীক্ষা।

    সেই পরীক্ষায় আমাদের সার্থকভাবে উত্তীর্ণ হতে হবে।

    //তথ্যসূত্র//

    স্বামী অপূর্বানন্দ (১৯৭৮), আচার্য শঙ্কর; উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৭৮।

    স্বামী বিবেকানন্দ (১৯৮৬), স্বামীজীর বাণী ও রচনা; খণ্ড ৫, ৬, ৯, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।

    অশোক মুখোপাধ্যায় (২০০৪), মন্দির-মসজিদ বিসম্বাদ; বোধোদয় মঞ্চ, কলকাতা।

    অশোক মুখোপাধ্যায় (২০১৪), “মেঘে ঢাকা যে অর্ধেক আকাশ”; অস্তিত্বের সংলাপ: সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি উপকথা; সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সায়েন্স অ্যান্ড সোশাইটি [সেস্টাস], কলকাতা।

    অশোক মুখোপাধ্যায় (২০১৫), “প্রাচীন ভারতে “আধুনিক”(?) বিজ্ঞান”; অনীক, বর্ষ ৫২ সংখ্যা ৩-৪, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ২০১৫ বিশেষ সংখ্যা। আরও দ্রষ্টব্য: “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: প্রাচীন ভারত”; মুক্তমনা বাংলা ব্লগ;
    https://blog.mukto-mona.com/2015/02/21/44470/

    অশোক মুখোপাধ্যায় (২০১৬), “ভারতীয় রাজনীতিতে গোবলয় সম্প্রসারণ”; একুশ শতকের যুক্তিবাদী, সেপ্টেম্বর ২০১৬। আরও দ্রষ্টব্য: “সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতি ও গরু-মোষের দ্বন্দ্ব”; মুক্তমনা বাংলা ব্লগ;
    https://blog.mukto-mona.com/2016/03/23/48652/

    হেমেন্দ্র কুমার রায় (১৯৮৯), বর্গি এল দেশে; রচনাবলি, ১১শ খণ্ড; এশিয়া পাবলিশিং কোং, কলকাতা।

    ক্ষিতি মোহন সেন (১৯৯০), ভারতে হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা; বিশ্বভারতী, কলকাতা।

    দীনেশ চন্দ্র সেন (১৯৩৫), বৃহৎ বঙ্গ (দুই খণ্ড); ১ম খণ্ড, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা।

    D. P. Bhattacharya (2014), “BJP gains in polls after every riot, says Yale study”; Economic Times (e-version); 5 December 2014. http://m.economictimes.com/news/politics-and-nation/bjp-gains-in-polls-after-every-riot-says-yale-study/articleshow/45378840.cms

    J. S. Grewal (1970), Muslim Rule in India: The Assessment of British Historians; Oxford University Press, Oxford.

    H. S. Hodiwala (1939), Studies in Indo-Muslim History; Bombay.

    B. B. Lal (1954-55), “Report on the excavation at Hastinapur”; Ancient India, Nos. 10-11.

    Karl Marx (1976), “Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Law: Introduction”; Karl Marx and Frederick Engels (1976), On Religion; Progressive Publishers, Moscow.

    A Mirsab (2014), “Burdwan Blast: Loopholes in NIA’s investigation, lead NGO to call for independent probe by SC judge”; Two Circles: mainstream news of the marginalized (e-magazine), 3 December 2014. http://twocircles.net/2014dec03/1417616083.html#.VJgXscRDb4

    Rajendra Lal Mitra (১৯৬৭), Beef in Ancient India (edited and annotated by
    Swami Bhumananda, 1926); Manisha Granthalay, Kolkata;

    B. N. Pandey (1984), Islam and Indian Culture; Khuda Boksh Memorial Trust, Patna.

    Ajit Sahi (2014), “ That House in Burdwan”; Outlook (e-version), 8 December 2014. http://www.outlookindia.com/magazine/story/that-house-in-burdwan/292735

    H. D. Sankalia (1967), “The Cow in History”: Seminar, No. 93 (May 1967)

    M. C. Setalvad (1967), Secularism (Patel Memorial Radio Lecture 1965); Publication Division, Government of India; New Dellhi.

    Ram Saran Sharma (1990), Communal History and Rama’s Ayodhya; People’s Publishing House, Delhi.

    Pattabhi Sitaramayya (1946), The Feathers and the Stones; Padma Publications, Bombay.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ মে ২০১৭ | ২৫৮৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন