এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সচিন বাবু

    Binary লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩০ মার্চ ২০১৬ | ৯২৩ বার পঠিত
  • সচিন রায় কে পাড়ায় সবাই চিনত বিকট বাবু বলে। খিটকেল মেজাজের জন্য। তিনতলা পৈত্রিক বাড়ির দোতলা আর তিনতলা জুড়ে থাকতেন সচিন রায় , একতলায় প্রায় প্রতি চার/পাঁচ মাসে ভাড়াটে বদল হত ইলেকট্রিকলাইন , জলেরলাইন জনিত ঝগড়া ঝাঁটি-র সমস্যায় আর সচিন রায়-এর অষ্টপ্রহর বিকট গালাগালিতে।সচিন বাবুর বাড়ির গেটের বাইরে আলপটকা ট্যাক্সি দাঁড় করানো থেকে পাড়ার ছোটদের পিট্টু খেলার ছুটকো বল সচিন রায়-এর বারান্দায় গিয়ে পড়া-র মত তস্য গর্হিত ঘটনায় , সচিন বাবু'র কঙ্কর কন্ঠ পাড়াসুদ্ধু লোকের 'কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশিল রে' হত প্রায়-ই। দোতলা তিনতলায় সচিন বাবু একাই থাকতেন , অন্যপ্রাণী বলতে অশীতিপর মা। চৌরঙ্গী-র কোনো সদাগরী আপিসে বড়বাবু ছিলেন সচিন বাবু । আপিসের চাকরিটা কি করে টিকিয়ে রেখেছিলেন জানা নেই , কিন্তু লোকের কথায় , আপিসে এক পদে কাজ করছিলেন প্রায় তিরিশ বছর। এতদিনে কোনো উন্নতি হয়নি , অবনতি-ও অবশ্য হয়নি , আর সেভাবে দেখতে গেলে , ওনার মত কোপন মানুষের পক্ষে , সেটাও মনে হয় একটা বাহাদুরি।

    যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে , সেই সময় সচিন বাবুর বয়স পঞ্চাশে-র বাড়ন্ত পাশে। মেজাজের সাথে চেহারাটা-ও প্রায় মানানসই ছিল সচিন রায়-এর। বাঙালির তুলনায় দানবীয় উচ্চতা , চর্বিবহুল ধর , আর দেহের তুলনায় সামঁজস্যহীন , ছোট মাথা। এককথায় বিকর্ষনীয় চেহারা। তো , এহেন সচিন রায়ের বিয়ে হয়নি। প্রেম-ও না। এই না হওয়ার কারণ খোঁজার জন্য মনস্তত্ত্বিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। খালি এটাই বলার যে , আমাদের আর্থ-সমাজিক চেতনায় যেখানে ছেলেরা বিয়ে 'করে না' , সেখানে সচিন বাবুর বিয়ে 'হয় নি'। সে যাই হোক। সচিন বাবুর মা কিন্তু অমায়িক ভালমানুষ ছিলেন। খালি ওই অশীতিপর বৃদ্ধার জন্য-ই পাড়ার লোকেদের মর্মবেদনা পঞ্চম স্কেল ছেড়ে সপ্তম স্কেলে উঠতে পারেনি।

    তো, সচিন রায়ের মা-এর মুখে সচিন রায়ের বদ মেজাজের গল্প কম শোনা যায় নি। ছোট বেলায় ফুটবল খেলায় চোরাগোপতা ল্যাং খেয়ে , মাথা দিয়ে ঢুসো মেরে কোন ছেলের নাক ভেঙ্গে দেওয়ার গল্প। নিজেদের গ্রামের পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে আসা বেওয়ারিস ছোকরা মাছচোর-কে চ্যালা কাঠের বাড়ি মারতে মারতে তিন মেইল ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প। যৌবনে , একবার রেলের প্রথম শ্রেনীর কামরায় , নিজের শোবার বাংক-এ অন্য কারো বিছানা দেখে , সেই বিছানা বালিশ সুদ্ধু প্ল্যাটফর্মে ছুড়ে ফেলে দেওয়ায় গল্প। সচিন রায়ের বদমেজাজের গল্প অনন্ত।

    একদিন সন্ধ্যে বেলা , ব্লেজার-টাই পরা সচিন রায় , গড়িয়া হাটের ব্যস্ত রাস্তায় , বাঁশের কঞ্চির এক বড়সড় বোঝা মাথায় করে হেঁটে আসছিলেন। বাঁশের কঞ্চি কথা থেকে যোগার করলেন , সে রহস্য কারো জানা নেই , কিন্তু কঞ্চি দিয়ে বাড়ির সামনে বেড়া দেওয়া-ই উদ্দেশ্য ছিল। তো ব্লেজার-টাই পরা একজনকে এরকম একটা বোঝা কাঁধে নিয়ে যেতে দেখে আধাপরিচিত কেউ হয়তো জিগ্গেস করেছিল "দাদা এগুলো নিয়ে কোথায় যান ? কি হবে ? "

    - "কি হবে তাতে তোর্ বাপের কি ? শ্বশানে যাচ্ছি , মরা পোড়ানো হবে ... "

    তো এই সচিন রায় , বছরে দুইবার পুরী বেড়াতে যেতেন। একবার মা'কে সঙ্গে নিয়ে আরেকবার একা একা-ই। পুরীর কোনো ব্রেড-এন্ড-ব্রেকফাস্ট হোমের অংশীদারী ছিল সচিন রায়ের। তো বছরের দুই দুই চার সপ্তাহ , পাড়ার শান্তি বজায় থাকত।

    তো একবার , এক ডিসেম্বরের একা একা পুরী গিয়ে , ফেরার দিন , সঙ্গে একটি মেয়ে কে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামলেন সচিন রায়। মেয়েটা তিরিশের আসেপাসে , কালো , রোগাটে , অতি সাধারণ মুখশ্রী। খানিকটা লজ্জায় , আর অনেকটাই ভয়ে জরসর।পাড়ার লোকেদের অপরিসীম কৌতুহল , কিন্তু জিগ্গেস করবার সাহস তার একআনা-ও না। এই ভাবে কেটে গেল আরো তিন/চার সপ্তাহ। শেষে সচিন রায়ের মা'এর কাছ থেকে জানা গেল , কি-কেন ইত্যাদি ।

    মেয়েটি সচিন বাবুর পুরীর ব্রেড-এন্ড-ব্রেকফাস্ট-এর নতুন আসা কেয়ারটেকারের মেয়ে , পঞ্চাশভাগ উড়িয়া আর পঞ্চাশভাগ বাংলাভাষী , তিরিশ পেরিয়ে বয়স , অনূড়া। সামান্য লেখাপড়া জানে। ব্রেড-এন্ড-ব্রেকফাস্ট -এই বাবার সাথে খাতা লেখা থেকে রান্না করা সব কাজ-ই করত। আর বিয়ে হবে কি হবে না নিত্য সেই অশান্তি আর পারিবারিক কলহতে দিন কাটাচ্ছিল। সচিন রায় আচমকা তিন দিনের নোটিশে মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলেন। কেন এবং কিজন্য তার হিসাব আপাতত থাক , কারণ-টা , সচিন রায়ের নিজের একাকিত্ত্ব-ও হতে পারে বা নিতান্ত-ই জৈবিক তাড়না-ও হতে পারে।

    এরপরে , সচিন রায়ের বাড়ি আর ব্যবহারে কিছু রং লাগে। অনেকদিন না রং করা তিনতলা বাড়িতে রঙের পোঁচ পরে। সচিন রায় , যিনি বাজারের মাছওয়ালা সবজিওয়ালা সাথে নিত্যদিন অকথ্য-কুকথ্য ঝগড়ায় বাজারের সময় কাটাতেন , তিনি এখন নিজের হাঁটুর বয়সী বউ কে নিয়ে 'কোনদিন না হাসা' মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে মাছ-সবজি কেনেন , রণংদেহি বডিল্যাঙ্গুয়েজে পরে ঘোরেন না ত্যামন।

    ***
    এই পর্যন্ত লিখে আর প্রেমের গল্প বলে গৌরচন্দ্রিকা করার আমার ইচ্ছে নয়। বছর দু-এক পরে , সচিন বাবুর বউ ঘর ছাড়ে। পুরীতে বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আর ফেরেনি। কেন ফেরেনি , তার রহস্য-ও কারো জানা নেই। সচিন রায় আবার পুনর্মূষিক। সেই বদমেজাজি , পাড়ার লোকেদের সেই তিরিক্ষে প্রতিবেশী।

    কেবল , সচিন বাবুর বৌএর পাড়াপাতানো এক সই বলেছিল , একবার নাকি দুপুরে সচিন বাবুর বাসায় গেছিল , তার অনুপস্তিতিতে , বউ-এর সাথে গল্প করতে। তো , কথায় কথায় , সেই ভিতু ভিতু চোখের জরসর চেহারার মেয়েটা হয়তঃ ভালো করে বোঝাতে পারেনি তার বৈবাহিক জীবনটা কিসে ভালো আর কিসে খারাপ। খালি , হয়ত ভুল করে-ই , টেলিফোনের রিপ্লে বোতাম টিপে শুনিয়েছিল একটা রেকর্ড করে রাখা বার্তা। শচিন রায়ের গলা , বউ-এর উদ্দেশ্যে ,

    "মাগী , শালী , ঢ্যামনামি না করে , ফোনটা এবার ধর , তোর্ জন্য একটা শাড়ি কিনলাম শুনবি না ? এরপর যদি ফোন না ধরিস, বাড়ি ফিরে দেখিস তোর্ কি অবস্থা করি। ..."

    মেয়েটা হয়ত , তখন ফোন ধরার মত অবস্থায় ছিল না , কোনো কাজে ব্যস্ত ছিল তাই।

    বিকট বাবু জানতেন না , বিয়ে করলে শুধু উপহার কিনলেই চলে না , দূষণীয় প্রবৃত্তি -কেও আয়ত্তে আনতে হয় , একান্তেও .....
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩০ মার্চ ২০১৬ | ৯২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sosen | 177.96.3.193 (*) | ৩০ মার্চ ২০১৬ ১০:১২57083
  • ঃ(
  • d | 144.159.168.72 (*) | ৩১ মার্চ ২০১৬ ০৫:০২57084
  • ইশশ
    ভাগ্যিস মেয়েটা ঘর ছেড়েছে। আশা করি নতুন ঘরে ভালই আছে, অন্তত আত্মসম্মান নিয়ে আছে।
  • আচ্ছা | 233.176.188.30 (*) | ৩১ মার্চ ২০১৬ ০৬:২৪57085
  • উনি কি আনন্দবাজার পড়ার পরেই নিজেকে শচীন না বলে সচিন বলে ডাকতেন?
  • ! | 47.130.227.133 (*) | ৩১ মার্চ ২০১৬ ০৬:২৭57086
  • ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন