এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • সত্যজিৎ রায় সমীপেষু (১ ) --পটলকুমার

    Binary লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৫ মে ২০২১ | ২৩৯৩ বার পঠিত
  • কাকুড়গাছি গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলের ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হওয়ার আগেই পটল একথেকে একশো লিখতে পারতো। পটলের মা পটলকে সক্কাল সক্কাল সরষের তেলটেল মাখিয়ে চানটান করিয়ে রুটি আলুচ্চচড়ি খাইয়ে সিমেন্টের দাওয়াতে বসিয়ে দিত ঠাকুমার কাছে। ধপধপে থান পরা ঠাকুমা খেতেন স্বপাকে। উঠোনের পাশে বসে রান্না করতেন গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি। তার সুবাস ম ম করতো উঠোনময়। দাওয়ার সিমেন্টের মেঝেতে আঁক কষত পটল। ঠাকুমা সুরকরে বলতেন '১কে চন্দ্র, ২যে পক্ষ, ৩নে নেত্র, ৪তুর্বেদ, ৫ঞ্চ বান, ৬যে ঋতু, ৭সমুদ্র, ৮ষ্ট বসু, ৯বা গ্রহ, ১০সে দিক। ১ থেকে ১০। পটল রিনরিনে গলায় মুখস্ত বলত আর লিখত। কাঁকুড়গাছি প্রাইমারি ইস্কুলের ক্লাস ফোরে উঠল , ততদিনে ভূগোলের মাস্টারমশাই বঙ্কিমবাবু রিটায়ার করে গিয়েছেন। ক্লাসফোরে একটি নতুন ছাত্র ভর্তি হল পটলের ক্লাসে, তার নাম অনঙ্গ। ফর্সাপানা , লিকপিকে, কাঠির ডগায় আলুদ্দম। তবে চোখ দুটো খুব বড়। প্রায় মুখের সিকিভাগ জুড়ে। সে চোখ খুব লাজুক, তবে হাসিখুশি। লাজুক বলে তার বিশেষ বন্ধু নেই , একমাত্র পটল। পটল আর অনঙ্গ টিফিন টাইমে আর ইস্কুল ছুটির পরে একটু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। পটল অবশ্য একটু দুবলা ছোটবেলা থেকেই। দৌড়ঝাঁপে ত্যামোন দড় নয়. এদিকে অনঙ্গ তার লিকপিকে হাতপা নিয়ে সরসর করে নারকেল, খেজুর গাছ বাইতে পারত ইচ্ছেমত, জলের নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারত পাক্কা ৫ মিনিট, একটিপে গুলতি ছুঁড়ে পঞ্চাশ গজ দূরের মিত্তিরদের বাড়ির দোতালা বারান্দয় শুকোতে দেওয়া মসলার কৌটো উল্টে দিতে পারত। তবে নেহাত প্রয়োজন নাহলে এসব ডানপিটে গিরি বেশি করত না অনঙ্গ। আরেকটা বিশেষত্ব ছিল ওর. ঝালমুড়ি, ফুচকা, হজমি বা বিশুকাকার চায়ের দোকানের নানখাটাই কিছুতেই ওর লোভ ছিল না। ১০-১২ বছরের এরকম হজমি নির্লোভ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব , কিন্তু অনঙ্গ সেরকম-ই ছিল। সত্যি বলতে কি জল ছাড়া ওকে কোনোদিন কিছু খেতে দ্যাখেনি পটল। দুষ্টু ছেলেপিলে বলে বেড়াত , অনঙ্গ-কে নাকি ফড়িং আর আরশোলা ধরে চিবিয়ে খেতে দেখেছিলো। সে পটলের বিশ্বাস হয় নি।
    .তবে দুটি আশ্চর্যি ঘটনা পটলের জানা।  
    একবার, সেদিন ইস্কুলে আসেনি অনঙ্গ , ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার জন্য সাইকেলে উঠে বাঁইবাঁই চালাচ্ছিল পটল শ্যামাপুকুরের মোড়ে হটাৎ এক ইঁট বোঝাই লরির সামনে পরে যায়। লরির ধাক্কায় নির্ঘাত পটল তুলত পটল, চোখ বুঁজে ফেলেছিল , হঠাৎ কে যেন শূন্যে চ্যাংদোলা করে রাস্তার পাশে মিত্তিরদের রোযাকে তুলে বসায়। পটল চোখ খুলে দ্যাখে অনঙ্গ। বললো রাস্তা দিয়ে সেই সময় যাচ্ছিলো পেন্সিল কিনতে , আচমকা পটলকে লরির সামনে পড়তে দেখে রিফ্লেক্স অ্যাকশনে ঝাঁপিয়েছে। কেজানে কেন, পটলের সেটা অবিশ্বাস্য মনে হল। শুনশান দুপুরে রাস্তায় এমনিতে কোনো লোক ছিল না, খালি ইস্কুলের আলুকাবলিওয়ালে রতনদা গাছতলায় বসে ঘুমাচ্ছিল। পটল আর অনঙ্গকে মিত্তিরদের রোযাকে ক্যাওম্যাও করতে শুনে ঘুম ভেঙে যায় তার। পরে একদিন একলা পেয়ে রতনদা পটলকে বলেছিল , ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রতনদা সেদিন নাকি একটা ছেলেকে বিদ্যুতের মত মাটির তিনফুট উঁচু দিয়ে উড়ে যেতে দেখেছিল। তা, সে স্বপ্নে গরুও গাছে চড়ে।
    আরেকবার ক্লাস ফাইবের অ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে পটল অনঙ্গকে ঠাকুমার শেখানো একে চন্দ্র , দুয়ে পক্ষ শোনাচ্ছিল। এক চন্দ্র শুনেই অনঙ্গ বললো
    -- চন্দ্র চাইলে একটা কেন , পাঁচটাও হতে পারে , সুজ্জিও দুটো হতে পারে।
    শুনে পটলের রাগ হয়ে গেল.
    -- চাঁদ কোথায় পাঁচটা রে পাগল ? সূয্য দুটো ? তোর কি মাথা গুলিয়ে গেছে ?
    -- হয় রে , আকাশ কি আর একটা ?
    -- আবার পাগলামি ? আকাশ আবার কটা হবে ?
    -- আচ্ছা, বিশ্বাস না হয় তোকে একদিন দেখাবো , আরেকটা আকাশ
    আরেকটা আকাশ আর দেখা হয়নি পটলের। ফাল্গুন মাসে জলবসন্ত হয়েছিল পটলের। তিন হপ্তা পরে ইস্কুলে এসে শোনে অনঙ্গ-কে ওর বাবা এসে ইস্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। ওরা নাকি অন্যশহরে চলে যাচ্ছে তাই। সেকেন্ড বেঞ্চে বসা বখা ছেলে সুবল বললো অনঙ্গর বাবাকে নাকি দেখেছে। কঞ্চির মত নাকি চেহারা , চোখে রোদচশমা।
     
    ***
     
    বড়হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ার সময় পটল জানতে পারে বাইনারি ষ্টার সিস্টেমের কথা। বাইনারি ষ্টার সিস্টেমের গ্রহদের কথা। সেই গ্রহতেই মহাজাগতিক সভ্যতার অস্তিত্বের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকার কথা। আর সেই বসবাস যোগ্য গ্রহের, এক কেন, একাধিক চাঁদ থাকা কিছুই আশ্চর্য্যের না।  
     
    আর সে আকাশ পৃথিবীর আকাশ নয় , আরেকটা আকাশ তো বটেই।
     
    ===
    বঙ্কুবাবু এপিসোডের পরে ক্রোনিয়াস গ্রহের অ্যাং-টি দ্বিতীয়বার আবার যে সেই কাঁকুড়গাছি গ্রামে এসেছিল, সে কথা সকলের জানা নেই। রায়বাবু তো তারপরে আরো পঁচানব্বুই খানা গল্প, গোটাকুড়ি ফেলুদা কাহিনী, খান পঁচিশ প্রফেসর শঙ্কু ইত্যাদি লিখে ইহধাম ত্যাগ করলেন। মহাজাগতিক ব্যাপারনিয়ে তিনি আর লেখেন্নি তা নয়। এমনকি টেরাটোম বলে আস্ত একটা ক্ষুদ্র গ্রহকে প্রফেসর শঙ্কুর ল্যাবটারিতে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেই অ্যাং-র কথা তার মনেও পড়েনি।
     
    অ্যাংবাবু আবার এসেছিলেন। ছেলেকে রেখেগেছিলেন দুমাসের পৃথিবীর সভ্যতা শিক্ষার জন্য।
     
    ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি , ক্রনিয়াস দুই মাস সমান দুই পৃথিবী বছর।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৫ মে ২০২১ | ২৩৯৩ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:89b2:39ce:9b11:f5e3 | ২৫ মে ২০২১ ০৯:৫২106410
  • বাঃ 

  • Ranjan Roy | ২৫ মে ২০২১ ১৩:০২106414
  • কতদিন পরে বাইনারির সিগনেচার ছোট লেখা, তাতে হীরকদ্যুতি। 


    ওঁর লেখাগুলো নিয়ে একটা চটি বই হতে পারে।

  • anandaB | 50.125.252.150 | ২৭ মে ২০২১ ০৭:২৬106465
  • খুব ভালো হয়েছে

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন