এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মরালমেসো, মরালমাসিমা এবং প্রাতঃকৃত্য

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ | ৪২২৬ বার পঠিত
  • অস্বীকার করবার প্রায় কোনও জায়গাই নেই যে ছোটবেলায় আমাদের অনেকেই প্রায় নিয়ার-পারফেক্ট শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে বড় হয়েছিলাম। হিন্দি গান শোনা ছিল মহাপাপ, গাওয়া তো উচ্ছন্নে যাওয়ার স্পষ্ট লক্ষণ ছিল। ছোটখাটো বিচ্যুতি, এই যেমন অনুপ জালোটা, মান্না দে এটুকু বাদ দিলে বাংলাময় ছিল আমাদের জীবন। পাড়া কালচারে বড় হয়েছি আমরা। গ্রাম নয়, আবার পুরোদস্তুর শহরও নয়, মফস্বল সংস্কৃতিতে কাজ করত পাড়া-কালচার। শুভানুধ্যায়ী কাকু-জেঠিমা-মোড়ের সিগারেটের দোকানের স্বপনদা, এঁদের স্নেহদৃষ্টির ছায়াতেই আমরা বড় হয়েছি। প্রায়শই খবর এসে যেত বাড়িতে, কবে যেন আমি খুউব স্পীডে সাইকেল চালিয়েছি, কবে যেন বিকেলের দিকে আমার পাশে পাশে একটা মেয়েও সাইকেল চালাচ্ছিল। কেউ কেউ ভালোবাসার চোটে আমায় এক দুবার সিগারেট খেতেও দেখে ফেলেছিলেন এবং বাড়িতে রিপোর্ট করেছিলেন - যদিও জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি বিড়ি-সিগারেট-গাঁজা কোনওটাই ছুঁই নি।

    তো, এবংবিধ মরালমেসো এবং মরালমাসিমাদের স্নেহচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে আমি যখন বাইরে পড়তে গেলাম, তখন বুঝলাম স্বাধীন জীবনের কী মানে। আঠেরো বছর বয়েস, কাউকে জবাবদিহি করতে পছন্দ করে না।

    সময় পাল্টেছে। যুগ পাল্টেছে। আমাদের আঠেরো বছর বয়েসে টিভিতে আসত কুল্লে দুটো চ্যানেল, ডিডি ওয়ান আর ডিডি মেট্রো। এখন দেড়শোটা আসে। সমাজ অনেকটা বিবর্তিত হয়েছে, সামনের দিকে না পেছনের দিকে - সে কথা অবশ্য ভবিষ্যতের ইতিহাস লিখবে, কিন্তু বাঙালিদের এই টিপিকাল শুদ্ধাচারী রক্ষণশীল বেম্মো সংস্কৃতি সেই অর্থে বিবর্তিত হয় নি। যেমন বদলায় নি আঠেরো বছরের স্পর্ধাও। প্রেসিডেন্সির মেয়েটির ধিঙ্গিপনা অত্যন্ত বিচলিত করেছিল শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর বাবা কমল গঙ্গোপাধ্যায় এবং মা-কে। "চোখে দেখা যায় না" - বলেছেন শৌভিকের মা। রাণিকুঠি এলাকা "আমাদের পাড়া" - সেখানে কেউ এমন বেলেল্লাপনা করবে, এমন জিনিস মরালমেসো আর মরালমাসিমা মেনে নেন কী করে? তাই পিতামাতাপুত্র মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ছাত্রীটির ওপর। মেয়েটির বোধ হয় আঠেরো কি উনিশ বছর বয়েসই হবে। তার অপরাধ ছিল একটা নয়, তিনটে। সন্ধ্যেবেলায়, হাফপ্যান্ট পরে মেয়েটি ধূমপান করছিল প্রকাশ্যে। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, আমরা সকলেই জানি, কিন্তু শারীরিক নিরাপত্তার পক্ষেও যে ক্ষতিকর, এটা সেইভাবে আমার জানা ছিল না। নৈতিক গার্জেনগিরি কী করে মেনে নেয় এতটা অসভ্যতা? তাই মার, চুলের মুঠি ধরে। "আমাদের এলাকা"।

    আমাদের এলাকা। তাই আমরা ঠিক করে দেব মেয়েটি হাফপ্যান্ট পরে সিগারেট খাবার দুঃসাহস দেখাতে পারবে কিনা, আমরা ঠিক করে দেব সুজেট জর্ডান একা একা নাইটক্লাবে গেলে তাঁকে "খানকি মাগি" বলা হবে কিনা, আমরা ঠিক করে দেব আমাদের প্রতিবেশির ফ্রিজে কোন প্রাণীর মাংস থাকবে, আমরা ঠিক করে দেব এ তল্লাটের বাসিন্দারা কোন চিহ্নে ভোট দেবে। আমরা ঠিক করে দেব ইনটলারেন্সের প্রতি তুমি টলারেন্ট থাকবে কিনা, নাকি আমার ডেফিনিশনে তুমি ইনটলারেন্সের অস্তিত্ব অস্বীকার করবে।

    মহানগরের বুকে কয়েক মাস আগে একটা সিনেমার শো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, কতিপয় মরালমেসোর হস্তক্ষেপে। জল তার পরে বেশ কিছুদূর গড়িয়েছিল, এবং কথায় বার্তায় দেখেছিলাম, কিছু বাঙালি এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছিলেন "আফটার অল, নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের কালচারালি প্রটেক্ট করার দায়িত্ব আমাদের, আমরা আমাদের শিশুমনকে বিষিয়ে যেতে দিতে পারি না"। কে যে তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেটা আর জানা হল না।

    রুচিবোধ, শালীনতাবোধ, সংস্কৃতিবোধ - এগুলো কিছুটা আপেক্ষিক বিষয়, এর কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয় না। আপনার চোখে যা নান্দনিক, আমার চোখে তা-ই নিদারুণ অশ্লীল হতেই পারে। যে ইলিশ খায় যে তার স্বাদগন্ধের জন্য খায়, আবার অনেকেই আছেন ইলিশের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কেউ হিন্দি গান ভালোবাসেন না, কেউ হাফপ্যান্ট ভালোবাসেন না, কেউ নন-ভেজ খাওয়াও ভালোবাসেন না। হতেই পারে। ভিন্নরুচির্হি লোকাঃ। এই পর্যন্ত সমস্যা নেই, সমস্যা তৈরি হয় যখন লোকে নিজের মত, নিজের পছন্দ, নিজের ধারণা নিয়ে অন্য লোকের ঘাড়ে চেপে বসে এবং জোর গলায় বলে, ব্যাটা, আমার মতটাই শ্রেষ্ঠ, তোকে এটাই মানতে হবে, না মানবি তো ...

    এই হোলিয়ার দ্যান দাউ অ্যাটিটিউডেই তৈরি হয় সমস্যা। আমার ধর্ম তোমার ধর্মের থেকে ভালো। আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারা তোমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর থেকে ভালো। আমার শালীনতার সংজ্ঞা, তোমার সংজ্ঞার থেকে ভালো। অতএব, তোমাকে আমার ধর্মটাই মেনে চলতে হবে, আমার চিন্তাধারাতেই সাবস্ক্রাইব করতে হবে, নইলে শালা তোমায় ক্যালাবো, প্রকাশ্যে হিউমিলিয়েট করব, তোমাকে খুন করব, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমার চোখদুটোকে কোটর থেকে বের করে আনব, তোমার বাড়িতে ছেলে ঢুকিয়ে মেয়েদের রেপ করে দেব।

    রেপ করে দেব। বিধবা বানিয়ে দেব। মাগীর রাতদুপুরে বেরনোর দরকার কী? মেয়েটার নির্জন রাস্তায় একা একা হাঁটবার কী দরকার পড়েছিল? মহিলাটি অচেনা লোকেদের কাছে কেন লিফট নিয়েছিল? মেয়েটা হাফপ্যান্ট পরবে কেন? - হাজারো প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায় বাতাসে, আমাদের চারপাশে। মেয়েদের আমরা একটি "বিশেষ" ক্যাটেগরি" মনে করি, খুব সহজেই তাদের অসম্মান করা যায়, বুকের খাঁজ দেখা গেলেই তাদের বুকের দিকে হাত বাড়ানো যায়, মেয়েদের "সম্মান" করা এমন একটা হট্‌কে ব্যাপার যে দিল্লির বেশির ভাগ অটো, ট্যাক্সির পেছনের কাঁচে স্টিকার সাঁটা থাকে - মেরা ইমান, নারী কা সম্মান। উচ্চকিতভাবে প্রদর্শন না করলে নারীর সম্মান না রাখাটাই এই শহরের, এই দেশের দস্তুর।

    এই সার্বিক মানসিকতা আমাদের ভাবায়। চিন্তায় ফেলে। আমরা কেউ লেখালিখি করি, কেউ মিছিলে দু-পা হাঁটি, কেউ মানিয়ে নিই।

    কেউ অন্য কিছু ভাবে। সেই ভাবনার নিদর্শন দেখতে হাজির হয়েছিলাম দিল্লির কামানি অডিটোরিয়ামে, একুশে এপ্রিল। ডান্স ড্রামা, কিন্তু ঠিক ডান্স ড্রামা নয় - নাম, প্রাতঃকৃত্য। কলকাতায় বেশ কয়েকটি সফল মঞ্চায়নের পরে তারা এসেছে দিল্লিতে একটিমাত্র শো করতে। টিকিটের কোনও মূল্য নেই, আপনি যা দেবেন, সেটাই টিকিটের মূল্য। এক টাকা, এক হাজার টাকা - যা ইচ্ছে। তমোঘ্ন আর শারদ্বতের আহ্বানে আমিও নামমাত্র মূল্যে টিকিট কেটে আমার সীট সিকিওর করে রাখলাম। একুশ তারিখে পৌঁছে গেলাম কামানি অডিটোরিয়ামে, সন্ধ্যে সওয়া সাতটার মধ্যে। যা দেখলাম, তা ভাষায় বর্ণনা করা খুব কঠিন, তবে যে হেতু খুব কম লোক দেখেছেন, এবং দিল্লিতে আর শো হবার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাই ভাবলাম যারা দেখেন নি, তাদের জন্য সামান্য হলেও চেষ্টা করি।

    প্রথম বেল পড়ার পরে হল-এ ঢুকতে পেলাম, এবং দেখলাম পাঁচটি মূর্তি স্টেজের ওপর দাঁড় করানো আছে, পাঁচটি স্পটলাইট এসে পড়েছে তাদের ওপর। খুব বেশি যে হেতু ভিড় ছিল না, তাই একেবারে সামনের রো-তে গিয়েই বসতে পেলাম, এবং দেখলাম, মূর্তি নয়, পাঁচটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কমবয়েসী, এবং বেশ কম জামাকাপড়ে। পরনে বাচ্চাদের টেপজামার মত একটা ছোট হাতকাটা পোশাক, যা উরুসন্ধির ঠিক নিচে এসে শেষ হচ্ছে। শান্ত, দুটি হাত দু পাশে রাখা, মুখে কোনও এক্সপ্রেশন নেই, কিংবা ছিল হয় তো, স্পটলাইট ওপর থেকে পড়ছে, মুখে পুরো আলো পড়ে নি, আর তা ছাড়া পাপী পুরুষের চোখ বারে বারে চলে যাচ্ছিল তাদের অনাবৃত পায়ের দিকে। সুন্দর পাঁচজোড়া পা, আর মাথার ওপরে খোলা একরাশ চুল - চোখ টানছিল খুব।

    অন্ধকারে চোখ সইতে দেখলাম, পেছনদিকটাতে অনেক বাদ্যযন্ত্র রাখা রয়েছে। ড্রাম, ঢাক, তবলা, ঢোলক, গীটার।

    মেয়েগুলি নড়েও না, চড়েও না। চোখের পাতাও পড়ে না। স্থানু মূর্তি পাঁচটি।

    ভেতরে ঢোকার সময়ে একটা করে লিফলেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেইটা পড়লাম। নামকরণের সার্থকতা টাইপের একটা কিছু লিখতে চেয়েছিলেন বোধ হয়, নির্দেশক, কিন্তু লেখাটুকু আমার সার্থক মনে হল না। উনি প্রাতঃকৃত্য শব্দটিকে প্রাত্যহিক কৃত্য বলে দাবি করেছেন, যদিও প্রাতঃকৃত্যের আসল মানে না নয়, ওটি প্রাতঃকাল, অর্থাৎ সকালবেলার কৃত্য, সেই অর্থে প্রাতঃকৃত্য। এইটুকু ভুল ছাড়া বাকি বক্তব্যের সাথে একমত হতে খুব একটা বাধা ছিল না।

    আবছা শুনতে পেলাম, সেকেন্ড বেল পড়ল। হল ভরে আসছে ধীরে ধীরে। চেনা মুখ একটিও দেখি না এ তল্লাটে। একমাত্র নাজেস আফরোজকে দেখলাম, তাঁর সঙ্গে সামান্যই আলাপ হয়েছে ইতিপূর্বে।

    মেয়েগুলি নড়ছে না। স্থানু। স্থির।

    ঘোষিকা উঠে এলেন স্টেজের কিনারায়। অল্প কথায় বললেন, মেয়েদের সম্মান রক্ষার নামে যে ঘটনা ঘটে চলেছে সারা দেশ জুড়ে, তার বৃহত্তর আবহে যে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ ছড়িয়ে পড়ছে, ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, তার প্রতিবাদ হিসেবেই এই ডান্স-ড্রামা, প্রাতঃকৃত্য। আজ সন্ধ্যের এই শো উৎসর্গ করা হচ্ছে জ্যোতি সিং এবং সোনি সোরিকে।

    ঠিক সাড়ে সাতটায় তৃতীয় বেল পড়ল। তবু মঞ্চের মেয়েগুলির মধ্যে কোনও চাঞ্চল্য নেই। ওরা কি সারা সন্ধ্যে এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে এসেছে নাকি?

    খুব ধীরে ধীরে একজন বয়স্ক ব্যক্তি প্রবেশ করলেন স্টেজে। পেছনে বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে অন্ধকারে বসে পড়লেন, তুলে নিলেন একটা কুঁজোর মত যন্ত্র - ঘট্টম বোধ হয়। হালকা চারমাত্রার ছন্দে মৃদু বোল তুললেন ঘট্টমের গায়ে। বাজাতে থাকলেন, বাজিয়েই চললেন।

    মেয়েগুলি স্থির। স্থানু। একচুলও নড়ছে না।

    আরও খানিক পরে একজন প্রবেশ করল, হাতে তুলে নিল একটা গীটার। অদ্ভূত কিছু শব্দ বেরোতে লাগল তার গীটার থেকে, তালের বাইরে যদিও নয়, কিন্তু ঠিক তালের মধ্যেও নয়। কেমন একটা আনক্যানি, ভয়াল আবহ তৈরি হচ্ছে বাজনার মধ্যে দিয়ে, ধীরে ধীরে।

    এক মুখ দাড়ি, হুড-লাগানো পুলওভার, জিনসের প্যান্ট আর হাইহিল স্নিকার্স পরা একটা লারেলাপ্পা টাইপের ছেলে এসে উদয় হল স্টেজের মাঝখানে। চোখে গগলস, মুখে সিগারেট, তার থেকে ধোঁয়া বেরিয়েই চলেছে। সে এসে মেয়েগুলোর মাঝে ইতিউতি ঘুরে বেড়াল খানিক, ওপর থেকে নিচ অবধি "মাপতে" লাগল মেয়েগুলোকে, আধা অন্ধকার গলিপথে লোলুপ চোখেরা যেমন মেপে নেয় নারীশরীর।

    আমরাও কি মাপছি না? আমরাও কি শরীর দেখছি না?

    ছেলেটি চলে গেল।, ইতিমধ্যে পেছনের সারিতে আরও কিছু যন্ত্রীর আগমন হয়েছে। আমার কি দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে? অনেকক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে থেকে কি অল্প আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে? মেয়েগুলো যেন ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, একটু বাঁ দিকে হেলে আছে না? ... নাঃ, সবাই নয়, সামনের দিকে দুই প্রান্তের দুটো মেয়ে সোজাই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বাকি তিনজন স্পষ্ট বাঁদিকে হেলে আছে। আবার খানিক বাদেই মনে হল, না না, বাঁদিকে তো নয়, ডানদিকে হেলে আছে বোধ হয়।

    এবার বোঝা গেল, মেয়েগুলি, সামনের দুজন বাদে খুব ধীরে ধীরে পেন্ডুলামের মত দুলছে। তাদের দোলা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে। পেছনের বাদ্যযন্ত্রীদের সারি এখন ভরে গেছে। এর পর সমবেত বাজনার সঙ্গে শুরু হল, ঠিক কখন যে শুরু হল তাদের নাচ, বুঝতে পারলাম না। প্রথমে মনে হল মেয়েগুলো স্টেজের মধ্যে এলোমেলো হেঁটে বেড়াচ্ছে, ব্রাউনিয়ার মোশন। ফলে মাঝেমধ্যেই একে অন্যের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে, আর ধাক্কা খেতেই দুজন বাঁই করে তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে আবার চলা শুরু করছে। আস্তে আস্তে চলায় প্যাটার্ন এল, স্টেজের সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে, তিনটে সারিতে। চলা, ধাক্কা, ঘুরে যাওয়া, আবার চলা, আবার ধাক্কা - চলতে থাকল যতক্ষণ না একজন ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল।

    না, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেব না এই ডান্স ড্রামার। তাতে পারফরমেন্সটির প্রতি জাস্টিস করা হবে না। মোদ্দা কথা, বিভিন্ন মুদ্রায় বিভিন্ন ভাবে তুলে ধরা হচ্ছিল মেয়েদের স্বাধীনতার চেষ্টা, নিজের মতন করে ভালো থাকার, ভালোবাসার চেষ্টা, এবং স্পষ্টভাবে সেই চেষ্টাকে বার বার প্রতিহত করছিল দুজন মেয়ে, যাদের উরুতে একটু আগেই সেই লারেলাপ্পা টাইপের দেখতে গগলস পরা ছেলেটা এসে, মার্কার পেন দিয়ে এঁকে দিয়ে গেছিল পদ্মফুল। সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।

    এর পর সবচেয়ে রোগা মেয়েটি এগিয়ে এল, পূজার ভঙ্গিতে বসল এবং অদ্ভূত ভঙ্গিতে হাত ঘোরাতে ঘোরাতে শুরু করল সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ।

    ওয়েট! প্রথমে সংস্কৃত স্তোত্র মনে হলেও আস্তে আস্তে বোঝা গেল এটি আসলে সংঘ দলের প্রতি একটি তীব্র খিল্লি, সংস্কৃতের ঢং মেশানো নিখাদ বাংলা ভাষায়। পুরো স্তোত্রটা তো মনে নেই, কোথাও পেলে লিখে দেব আবার এই লেখাতেই - শুরুটা এই রকমের ছিলঃ

    দলিতস্য প্রাণম গচ্ছম।
    সংঘপরিবার সেনা মণিপুরম।।
    সর্ব জনগণ উৎকৃষ্ট ভৃত্য।
    প্রাত্যহিকী করেব্য প্রাতঃকৃত্য।।
    না হোমে না যজ্ঞে লাগম্‌।
    নরেন্দ্র মোদীস্য পোঁদে লাগম্‌।।

    হাসি চেপে রাখা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।

    এর পরে আবার নাচ। বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন প্রেক্ষিত তুলে আনা। ওই স্তোত্রটুকু ছাড়া গোটা পারফরমেন্সে কোথাও কোনও কথা নেই। কীভাবে যে সোয়া এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল টের পাই নি। নাচ ধীরে ধীরে উদ্দাম থেকে উদ্দামতর হচ্ছে। সামনের সীটে বসে আমি তাদের শ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, এতটাই নিস্তব্ধ মন্ত্রমুগ্ধ ছিল পুরো অডিটোরিয়াম। কথা ছাড়াই তারা তুলে ধরছিল অসম প্রেমের বিরুদ্ধাচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মেয়েদের অবজেক্টিফাই করার মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মনুবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নব্য হিন্দুত্বের সংজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

    আস্তে আস্তে ঢাকী যিনি, তিনি ঢাক নিয়ে চলে এসে ঢাক বাজাতে শুরু করতেই একজন মেয়ে থামিয়ে দিল তাঁকে, ঢাকের গায়ে হাত রেখে। নাচের ভঙ্গিমায় ঢাকীর গা থেকে ছাড়িয়ে আনল তাঁর পৈতে। ধীরে ধীরে বাকি বাজনার তেজ কমে এল।

    হাতে পৈতে নিয়ে মেয়েটি এগিয়ে এল স্টেজের একদম সামনে। পৈতের একপ্রান্ত জড়ালো ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে, অন্যপ্রান্ত বাম হাতের তর্জনীতে।

    তার পর? তার পর কী হল?

    না, আমি আর বলব না। সব বলে দিলে আপনারা আর দেখবেন না। বাকিটুকু দেখার জন্য আপনাদের যোগাযোগ করতেই হবে টিম প্রাতঃকৃত্যের সঙ্গে। খুব সুন্দর, সুচিন্তিত, এবং একই সঙ্গে দুঃসাহসী উপস্থাপনা। এতটা ম্যাচিওরড একটা প্রেজেন্টেশনের আরও আরও বেশি পাবলিসিটি হওয়া উচিত, আরও বেশি করে শো হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

    দেখুন। ভাবুন। এটুকু বলতে পারি, না দেখলে পস্তাবেন।
































    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ | ৪২২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Tamoghno | 174.100.41.2 (*) | ০২ মে ২০১৬ ১০:৪০53007
  • Ranjanda
    আপনি ঠিক বলছেন। যারা ইতিহাস বিকৃত করেছে বা করে চলেছে তারা সবাই এক গোত্রের লোক।
  • Tamoghno | 174.100.41.2 (*) | ০২ মে ২০১৬ ১০:৪৩53008
  • এই মরেছে
    আমি বুদ্ধিজীবী নই। তবে তোমার ভাষার ব্যবহারে আহত হয়েছি। তোমাকে abuse করেছি তার জন্য অত্যন্ত লজ্জিত।ভালো থেক ভাই।
  • T | 165.69.174.101 (*) | ০২ মে ২০১৬ ১০:৪৪53009
  • যাহ্‌, ধুত। এই রঞ্জনদার সবেতে শান্তি শান্তি করার অব্যেসটা...ওফ
  • এই মরেছে! | 24.96.171.101 (*) | ০২ মে ২০১৬ ১০:৫০53010
  • রন্জন রায়,
    কাকা আমাকে বললো বাড়ীতে শিখেছি। ত কাকা আমার বাড়ীর কথা না বললে আমিও বাপ ঠাউদ্দার কথা তুলতাম না হয়ত।
    ভবিষ্যতে সালিশী করার আগে পুরোটা একবার দেখে নেবেন।
  • সত্যি! | 165.136.80.173 (*) | ০২ মে ২০১৬ ১০:৫৮53012
  • রঞ্জনদা কেমন যেন শান্তির জল টাইপের। রঞ্জনদাকে একটা ফ্যাকাশে হলুদ কার্ড দেখানো হোক।
  • ranjan roy | 24.96.27.27 (*) | ০২ মে ২০১৬ ১০:৫৮53011
  • T ও এই মরেছে!

    বুড়োরা এই রকমই হয়।ঃ)
    একটুতেই চাপ নিতে না পেরে বলে ওঠেঃ আহা! তুমিই না হয় ক্ষ্যামা দাও ভাই, এই আর কি!
  • ranjan roy | 24.96.27.27 (*) | ০২ মে ২০১৬ ১১:১১53013
  • ঃ)))
  • এই যে | 59.181.173.27 (*) | ০৫ জুন ২০১৬ ১০:২১53020
  • তুলে দিলাম।
  • শিহাব | 129.30.47.152 (*) | ০৮ জুন ২০১৭ ০৭:২৫53021
  • এটা কি আমই ভিডিও আকারে পেতে পারি।।।।।।?
  • সিকি | 132.177.218.85 (*) | ০৯ জুন ২০১৭ ০২:১৮53022
  • না। এর কোনও ভিডিও পাওয়া যায় না।
  • Du | 182.58.110.139 (*) | ০৯ জুন ২০১৭ ০৪:০৯53023
  • ডিলিটেদ পোস্ত ফিরে এলো নাকি একের বেশি ছিল
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন