এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা - ১৪ (পর্ব - মেমারী স্টেশনবাজার)

    Sukanta Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১২ নভেম্বর ২০১৩ | ১৭৬২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • বেশ কিছুদিন আগে খবরে কাগজে পড়লাম কলকাতার কোন এক প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন বিক্রেতা নাকি রসগোল্লা বানাবার মেশিন আমদানি করেছে বিদেশ থেকে! রসগোল্লা বানাবার মেশিন ! তায় আবার বিদেশ থেকে! খবরটা শুনে যথারীতি নিদারুণ দুঃখিত হলাম। এখানে দেশপ্রেম রিলেট করে একটা মাখো-মাখো বা ভারত এতোদিনে ইঞ্জিনিয়ারিংটাও শিখল না – এই নিয়ে তুল্যমূল্য আলোচনা একটা ফাঁদা যেতেই পারত। সেই দিকটায় এখন আর ঢুকছি না, কারণ এটা মূলত খাবার-দাবার নিয়ে আলোচনা। যদিও আমরা জানি খালি পেটে যেমন বিপ্লব হয় না, খালি পেটে তেমন দেশপ্রেমের আলোচনাও জমে না। সেই জন্যেই দেখবেন সব পার্টিতে “ভারতের কিছু হবে না” জাতীয় আলোচনাগুলো সাধারণত খাবারের প্লেট হাতে নিয়েই সম্পন্ন হয়ে থাকে।

    যদি জানতে চান আমার তাহলে দুঃখটা আসলে কিসের – আমি এর জবাব ঠিক দিতে পারব না। যদি আরো জানতে চান যে আগে থেকে না বলে দিলে শুধুমাত্র খেয়ে কোনটা মেশিনে আর কোনটা হাতে বানানো রসগোল্লা সেটা আমি বলতে পারব কিনা – তার প্রাইভেট উত্তর হবে বিলক্ষণ পারব না! তবে কি জানেন, ব্যাপারটা সাইকোলজিক্যাল। এবার পূজায় আদি ঢাকেশ্বরীতে জামদানী কিনতে গিয়ে আমার বউ যেমন বারবার বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করছিল সেটা হাতে বোনা কিনা! মেশিনে বোনা জামদানীতে নাকি সেই আমেজটা নেই! আমার বউ আর বাকি সবার মতই মেশিন বনাম হাতের তফাত সম্পর্কে ইল্যুউশনে ভুগত।

    তাই মিষ্টি বিক্রেতাদের আমার একান্ত অনুরোধ, মেশিনের মাল খাওয়াবেন খাওয়ান, কিন্তু প্লীজ খাবার আগে জানাবেন না। ইহা বাঙালী ঐতিহ্যের বুকে কশাঘাত। অবশ্য মৃদু চড়-চাপাটি আমাদের ঐতিহ্যে আগেও হয়েছে – যেমন রস নিঙড়ে রসগোল্লা খাওয়া, চামচে করে রসগোল্লকে ঠুকরানো, চকোলেট ফ্লেভার দিয়ে রসগোল্লা বানানো – ইত্যাদি। এ সবই পিকাসোর সেই শুধুমাত্র পায়ে মোজা পড়া নগ্ন নারীদেহের ছবির মতই অশ্লীল। তবে আমাদের বর্তমান রাজ্য সরকার বাঙালী ঐতিহ্যকে (কলকাতাকে লণ্ডন বানানো ছাড়া) ধরে রাখতে এতই সচেতন যে, আমার দৃঢ বিশ্বাস খুব শীঘ্রই রসগোল্লার সাইজ, রঙ (নীল আর সবুজ এই দুটি রঙ দৌড়ে এগিয়ে আছে), ক্যালোরিফিক ভ্যালু, বানানোর পদ্ধতি – সবই স্ট্যাণ্ডার্ডডাইজ করা হবে বিশেষ আদেশানুসারে।

    আমাদের সৌভাগ্য যে মেমারী স্টেশন বাজারে এখনও ক্লাসিক রসগোল্লা পাওয়া যাচ্ছে। এবার পূজার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে গোপালভোগ নামক মিষ্টিটির সাথে আবার ক্ল্যাশ করলাম। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, এই মিষ্টি-টির জন্মাবার কি দরকার ছিল এখনও আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। এ যেন সেই ধাতু বা অধাতুর মধ্যবর্তী মালগুলির মত – রসালো ও রসহীনতার মাঝেই গোপালভোগের অবস্থান। আমার বাবা ছাড়া এখনও পর্যন্ত আমি গোপালভোগের কোন ডাই-হার্ড ফ্যান পাই নি। বোনের বিয়েতে আমি চাইলাম চিরাচরিত ধবধবে (ঈষৎ ফাটাফাটা হলে তো কথাই নেই!) রসগোল্লা হোক শেষ পাতে – হল তার বদলে কমলাভোগ ও গোপালভোগ। প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে কি মিষ্টি নিয়ে যাব সেই চিন্তায় যখন আমি মগ্ন, বাবা নিয়ে হাজির করল গোপালভোগ বেয়াইয়ের জন্য।

    কমলাভোগের প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোন বিদ্বেষ নেই – বরং মাঝে মাঝে বেশ তারিয়ে তারিয়েই খাই। মিষ্টি আমার খুব প্রিয় জিনিস হলেও এবং সেটা নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেও আমার কাছে দুটি ব্যাপার এখনও ধোঁয়াটে থেকে গেছে – প্রথমতঃ “দুধের কাজ” বলতে মিষ্টির দোকানে কি বোঝায় এবং দ্বিতীয়ত আমার বাবা যে মিষ্টিগুলিকে “লর্ডের মাল” বলে সেই প্রজাতির মিষ্টির উদ্ভব কোথায়। ভেবেছিলাম গেল বার দেশে গিয়ে ব্যাপারটা ক্লীয়ার করব – কিন্তু সেটা আর হল না। তবে তাতে করে একদিকে ভালোই হয়েছে। কিছু কিছু ব্যাপার ধোঁয়াটে থাকাই ভালো – জানলে আকর্ষণ কমে যায়। আমার স্পেকুলেশন হচ্ছে যে ‘লর্ডের মাল’ আদপে ‘দুধের কাজ’ হতেই পয়দা হয়। মিষ্টির দোকানে খুব কমন জিনিস হল ছানার কাজ – বেশীর ভাহ মিষ্টিই তা থাকে সৃষ্ট। তাই ‘দুধের কাজ’ একটু বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। গ্রামে পুকুরপাড়ে বসে বন্ধুদের সাথে মিষ্টি বিষয়ক কথা হচ্ছিল – মুকুল ছাগল চড়াতে যাবার সময় খানিক ক্ষণ দাঁড়ালো, একটু আলোচনা শুনে ফাইন্যাল ভারডিক্ট দিয়ে আবার ছাগল নিয়ে চলে গেল। ভারডিক্ট ছিল – মিষ্টির কারিগর চেনা যায় তার ‘দুধের কাজ’ দেখে। যে দুধে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে সে ছানার কাজ স্বাভাবিক ভাবেই ভালো করে শিখে যাবে। মোটকথা, মিষ্টির কারিগরদের মোক্ষলাভ ওই দুধ ঘাঁটা ঘাঁটি করেই।

    মেমারী স্টেশনবাজারে মিষ্টির দোকানগুলি হতে বেশ কিছুদিন হল ‘চমচম’ নামক মিষ্টিটি অব্ লুপ্ত হয়েছে। কেন জানি না – ঈষৎ শুকনো হবার জন্য চমচম কুটুম্ববাড়িতে ক্যারি করার সুবিধা ছিল। কিন্তু সেই চমচম তার কৌলিন্য হারিয়েছে – চ্যাপ্টা চমচম আজকালকার বাচ্ছাদের হাতে দিলে তারা সেটা বিজাতীয় বস্তু বলেই ঠাওর করবে মনে হয়। যাই হোক চমচম মিষ্টি বিলুপ্তির পথে গেলেও চমচম নামটি চালু আছে, যেমন ‘লর্ড চমচম’। ইহা ওই আগে বর্নিত লর্ডের মালেরই এক টাইপ। লর্ড চমচম অবশ্য চ্যাপ্টা হত না – হত রডাকৃতি আর তারা ঈষৎ থকথকে তরলে অর্ধনিমজ্জিত থাকত। রসমালাই যদিও দুধের কাজ ক্যাটাগরি ভুক্ত কিন্তু তাকে লর্ডের মাল বলা হত না। মেমারীর কিছু দোকানে নানাবিধ লর্ডের মাল পাওয়া যেত, তার মধ্যে একটা খুব সুন্দর প্রোডাক্ট ছিল যার নামকরণ ঠিক করে ঊঠতে পারে নি কোন ময়রা। সেটিকে বলা হত ‘ওমলেট’ মিষ্টি। লর্ডের মাল লুচির মত বানিয়ে তাকে ওমলেটের মত ভাঁজ দেওয়া হত আর তার ভিতরে থাকত দুগ্ধজাত কিছু পুর (ক্ষীর টাইপের)। অতীব সুস্বাদু খেতে হত যদি না মালটি ‘টকে’ যাওয়া হত। দুধের কাজের প্রধান ডাউন্সাইড ছিল এই যে ওই মাল বেশীদিন রাখা যেত না। মনে রাখবেন আমি ক্লাসিক্যাল মিষ্টির দোকানের কথা বলছি যেখানে মিষ্টি কোন শীতল কাঁচের চেম্বারে থাকে না। ফলে প্রবল গরমে খুব সহজেই দুধের মাল/লর্ডের মাল খারাপ হয়ে যেত – আমরা তাকে বলতাম ‘টকে’ যাওয়া।

    এখন প্রশ্ন হল আপনি কি ভাবে জানবেন যে লর্ডের মালটি খারাপ কিনা? খুব সহজ উত্তর – খেয়ে দেখে। কিন্তু সব সময় তা এত সহজ হত না – যেমন ধরুণ ‘ওমলেট’ মিষ্টিটার দাম ১৪ টাকা। আমাদের গ্রামের দিকে এটা যথেষ্টই দামী মিষ্টি বলে বিবেচিত হত। ফলে আঙ্গুর টক না মিষ্টি সেই টেস্টিংয়ের মত ওমলেট মিষ্টি কেউ ফ্রী তে টেষ্ট করতে দিত না। কিনে টেষ্ট করার আগে তাই ক্রেতাকে মনে মনে হালকা রিক্স অ্যানালিসিস করে দিতে হত। মিষ্টি ভালো থাকলে আপনি অযথাই ১৪ টাকা নষ্ট করলেন টেষ্ট করে। আবার সঙ্গত কারণেই আপনি মিষ্টির দোকানদারকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না – সে এক ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন। মিষ্টির দোকানের সামনে এমনই কিছু ইনডিসাইসিভ পাবলিক দেখা যায় যারা পুরো ওই ক্রিটিক্যাল স্যিচুয়েশনের মাঝখানে রয়েছে। এদের দেখলেই চেনা যায় কন্যাদায় গ্রস্ত পিতাদের মত – উভয়েই বিভ্রান্ত প্রজাতি!

    যে সকল মিষ্টির দোকান মেমারী বাজারে নাম করেছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নীরেন মইয়ড়া, আশীর্বাদ, মৌচাক, রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, খালের দোকান ইত্যাদি। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত নীরেন ময়রার ফিলসফি ছিল – সাপ্লাই থাকবে ডিমাণ্ডের থেকে কম। তার ফলে টাটকা মিষ্টি ওই দোকানে গ্যারাণ্টেড ছিল। আরও বৈশিষ্ট ছিল যে নীরেন ময়রা মিষ্টি নিয়ে বেশী এক্সপেরিমেন্টে যায় নি। সে সাদা মিষ্টি ভালো করত, তাতে তার নাম হয়েছিল – এবং সেটাই সে বহুদিন ধরে বজায় রেখেছিল। অন্য দোকান যখন সাড়ে বত্রিশ ধরণের মিষ্টি সাজিয়ে ব্যস্ত, তখন নীরেন ময়রা সাকুল্যে ছয় থেকে আট রকমের মিষ্টি তৈরী করত।

    মৌচাকের অবস্থান মেমারী বাসস্ট্যাণ্ডে – এদের ফিলসফি আবার অন্য। কাষ্টমার আকর্ষণের জন্য ক্লাসিক মিষ্টির বাইরে নানা প্রকার মিষ্টি মেমারী বাজারে এরাই প্রথমে আমদানী করে। অগুণতি রকমের মিষ্টি – এর নেগেটিভ দিক হল এই দোকানে বাসি মিষ্টি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিল। অনেক সময় মিষ্টি খারাপও হয়ে যেত। এত প্রকার মিষ্টি প্রতিদিন বিক্রী করা প্রায় অসম্ভব ছিল আমাদের সেই ছোট মফস্বলে। পাবলিককে গন্ধ হয়ে যাওয়া মিষ্টি খাইয়ে মৌচাক তার নাম একটু খারাপ করে ফেলেছিল – সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। নতুন ধরণের মিষ্টি আগমণ হেতু প্রথম দিকে তার স্বাদ সম্পর্কে পাবলিক একটু ধ্বন্দে ছিল। খারাপ হয়ে যাওয়া মিষ্টি খেয়েও ভাবছে সেটা অমনই খেতে! বেসলাইন ডাটা না থাকলে যা হয় আর কি!

    আশীর্বাদ আমার বাবা ফেবারিট দোকান। এই দোকান থেকেই গোপাল্ভোগ আমার বাড়িতে সাপ্লাই যায়। আগে এরা ‘খাজা’ নামে মিষ্টিটাও ভালো তৈরী করত। কিন্তু এবার গিয়ে দেখলাম যে আশীর্বাদ সহ সব মিষ্টির দোকানেই খাজার রূপান্তর, বিবর্তন এবং পরোক্ষে অবনমন হয়েছে। আগে খাজা হত ফুলে কুঁড়ির মতন লম্বাকৃতি। চিনির প্রচণ্ড আধিক্য থাকত – যাকে বলে একেবারে সুপার স্যাচুরেটেড অবস্থা, গা দিয়ে চিনির রসের গুঁড়ো খসে পড়ত। আর গলা দিয়ে নামার সময় মিষ্টির প্রাবাল্য হেতু মনে হত যেন গলা জ্বলে যাচ্ছে। এত পরিমাণ চিনি থাকার জন্য খাজা খুবই ভঙ্গুর হত – পাপড়ির মত খাজার খোসা খুলে আসত। ইহাই ছিল দশকের পর দশক খাজার বৈশিষ্ট – বিয়ে পরবর্তি তত্ত্ব তালাশের সময় এই খাজা অপরিহার্য ছিল। এবার বাড়ি গিয়ে প্রতিবেশীদের বিয়ের তত্ত্বের খাজা খেয়ে আমি কালচারালি শকড্‌। যেমন শকড্‌ হয় সর্বভারতীয় দীপাবলি ফাংশানে অবাঙালীরা বাঙালী মেয়েদের রবীন্দ্রসংগীত শুনে। খাজা হয়ে গেছে গোলাকৃতি – চিনি প্রায় বেশি নেই, শুধু গায়ে ছিটানো যেটুকু মিশটির রস লেগে আছে আর কি! আর মাল প্রবল শক্ত হয়ে গেছে – যেন আপনি খাজা নয় বরং চিনির রসে ফেলেই তুলে নেওয়া ময়দা ভাজা খাচ্ছেন! এই জিনিসকে আমি আর যাই হোক খাজা বলতে নারাজ – খাজার এহেন বিবর্তনের পিছনে মূল কারণ দুই প্রকার – চিনির দাম বেড়ে যাওয়া এবং বাঙালীর স্বাস্থ্যসচেতনতা। এই স্বাস্থ্যসচেতনতা নামক সোনার পাথরবাটি জিনিসটি নিয়ে যত কম নাড়াচাড়া করা যায় ততই ভালো। আমাদের পশ্চাতদেশ দিয়ে হাতি গলে যায়, কিন্তু সামনে দিয়ে ছুঁচো আমরা গলতে দেব না!

    যাই হোক আমি আদি খাজা সংগ্রহের জন্য একটু হালকা চেষ্টা দিয়েছিলাম, কিন্তু বেবাক মার্কেট আজ মডিফায়েড খাজায় ছেয়ে গেছে। আমার মনে হয় অরিজিন্যাল থেলে সরে এলে হয় মিষ্টির নতুন নামকরণ হোক, নতুবা সফটওয়ার প্রোডাক্টের মত ভার্সান ১, ভার্সান ১।১, ভার্সান ২ এই সব চালু হোক। আকৃতির তারতম্য মানে ভার্সান ২, মিষ্টিত্বের তারতম্যে ভার্সান ১।১। সেই অনুযায়ী আজকালকার খাজার নাম আদপে হওয়া উচিত “খাজা – ভার্সান ২।১”।

    গোপালভোগ ছাড়া আশীর্বাদ দোকানে নাকি রসগোল্লাও ভালো পাওয়া যায়। তবে আমার মতে সেটা যত না রসগোল্লার স্বাদের জন্য, তার থেকেও বেশী বড় সাইজের রসগোল্লা তৈরীর জন্য। মনে রাখতে হবে মিষ্টির দোকানদারের কেউ জোকা, ব্যাঙ্গালোর, আমেদাবাদ ম্যানেজমেণ্টের ছাত্র না হলেও, বাজারের মূল ট্রেণ্ড ধরার চেষ্টা করে গেছে নিজেদের মত করে। যে মধ্যবিত্ত ফিফথ পে কমিশনের পর বেশী মাইনে পেয়ে এখন সফিসটিকেটেড হবার জন্য উঠে পরে লেগেছে, তারা এখন বড় সাইজের রসগোল্লা খাচ্ছে না বা কম খাচ্ছে। খেতে প্রাণ আইঢাই করলেও সম্বরণ করছে – সবার সামনে খাবার জন্য কিনছে না – কেমন এক ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েছে যে বড় সাইজের রসগোল্লা খাওয়া নাকি সফিসটিকেশনের সাথে ঠিক ম্যাচ করে না। ওরা বড় রসগোল্লা কেনে শুধু দেখনদারির জন্য – জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকি ইত্যাদি। অন্যদিকে যারা ব্যাবসা করছে এবং সেই ফাকেঁ টিফিন সারতে আগে আশীর্বাদে তারা বাজেট অনুযায়ী দেদার বড় রসগোল্লা গলধগরণ করে। তরকারী ও মাছের বাজারের মধ্যবর্তী হবার দরূন আশীর্বাদ তাই বড় রসগোল্লা বিক্রী করতে পারছে যার পিক টাইম সকাল ৯ টা থেকে ১১টার মধ্যে। অন্যদিকে নীরেন ময়রার ক্রেতারা মূলত বাঁধা চাকুরীজীবি – ফলে তারা সফিসটিকেশন বজায় রাখতে চার টাকা দামের বেশী রসগোল্লা আর খাচ্ছে না।

    আগে বর্ণিত মৌচাক মিষ্টির দোকানের অবস্থান মেমারী বাসস্ট্যাণ্ডে হবার জন্য লোকাল কাষ্টমার ছাড়াও ওদের ফ্লাইং কাষ্টমারের সংখ্যাও অনেক বেশী। ফ্লাইং খদ্দেরদের সাথে ব্যবসার এক সুবিধা আছে – পচা ও রদ্দি মাল এদের দিয়ে চালানো যায়। সে সব মিষ্টি গন্ধ হয়ে যায় সেইগুলি মৌচাক ফ্লাইং ক্রেতাদের সরাবরাহ করতে থাকে। তবে ওরা হিসাবে একটু গরমিল করে ফেলেছিল – মেমারী বাসস্ট্যাণ্ড তো আর বর্ধমানের তিনকোনিয়া বা কলকাতার এসপ্ল্যানেড নয়! এখানকার ফ্লায়িং কাষ্টমারদের উড়ান বেশীদূর নয়। এসপ্ল্যানেডের ফ্লাইং কাষ্টমার যদি পায়রা সদৃশ উড়ান দিতে পারে, তবে মেমারী বাসস্ট্যাণ্ডের খরিদ্দারের ফ্লাইং মুরগীর মত বড়জোড়। ফলে কাষ্টমার ঘুরেফিরে এসে গাল দিতে থাকল – এমত ফিডব্যাক হেতু মৌচাকের মার্কেট একটু ডাউন হয়েছিল মাজে। এখন ওরা নাকি আবার ম্যানেজমেণ্ট চেঞ্জ করে (আগে মেজ ভাই ক্যাশে বসত, এখন বসে ছোট ভাই) ব্রাণ্ড ভ্যালু রিভাইভ্যালের তালে আছে।

    খালের দোকানের সাথে আমার পরিচয় একেবারে বাল্যকাল থেকে। মেমারী শহরের ভিতরে ঢোকার রাস্তার পাশেই এই দোকান। আগে রাস্তা উঁচু ছিল আর দোকান ছিল পাশের নীচু জলা জায়গায়। সেই থেকেই নাম ‘খালের দোকান’। এখন অবশ্য রাস্তার পাশগুলি মাটি ফেলে উঁচু করা হয়েছে, ফলতঃ খালের দোকান আর খালে নেই, রাস্তার সাথে একই এলিভেশনে এসেছে। তবু বাঙালী কালচারের সাথে খাপ খাইয়ে নামটি রয়ে গেছে। পদা প্রেসিডেণ্ট হলেও পদাই থাকবে গ্রামের লোকেদের কাছে। ইনফ্যাক্ট আমি মনে করতে পারছি না এই দোকানের সামনে কোনদিন নামের সাইনবোর্ড দেখেছি কিনা! প্রথমদিকে মেমারী শহরের বাইরের দিকে অবস্থান হেতু এদের টার্গেট কাষ্টমার ছিল অন্যরকম। এরা কোনদিনই ফ্যান্সি মিষ্টি তৈরী করে নি – রসগোল্লা, সন্দেশ, ল্যাংচা, দানাদার, বোঁদে, নিমকি, গজা, সিঙাড়া – এই সবই করে এসেছে। দুই একটা আইটেম যেটা ওদের আইকনিক হয়ে দাঁড়ায়, সেগুলি পরে যোগ করে ওরা ওদের প্রোডাক্ট লাইনে। প্রথমতঃ ছানার কেক – অ্যালুমিনিয়ামের কানা উঁচু ট্রে থেকে ওজন অনুযায়ী কেটে দেওয়া। আর দ্বিতয়তঃ পোড়া কেক। ছানার কেক সাদা, যেখানে পোড়া কেক গাড় বাদামী রঙের। পোড়া কেকের মিষ্টিত্ব ছানার কেকের থেকে অনেক বেশী। মেমারীর সেরা ছানার কেক তৈরী হয় ওই খালের দোকানেই। আর তা ছাড়া আরো একটি জিনিস খালের দোকান ভালোই বানাত – তা হল মিষ্টি দই। মৌচাকের মিষ্টি দই সরাবরাহে ভালো নাম করেছিল।

    খালের দোকানের আরেক বৈশিষ্ট এককালে (মানে আমাদের বাল্যকালে) ছিল ‘পেটা সন্দেশ’। ইহা চ্যাপ্টাকৃতি, ক্রীম বিস্কুটের মত দুই গোলাকার ভাগ মুখোমুখি জোড়া থাকত (অবশ্যি ক্রীম ছাড়া!)। আমার খুবই প্রিয় ছিল এই পেটা সন্দেশ। বলাই বাহুল্য বাড়ির লোকেরা আমার এই পেটা সন্দেশ প্রীতি খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। তার মূল কারণ ছিল পেটা সন্দেশ তৈরীর উপাদান। কথিত আছে যে সব ছানা মিষ্টি গন্ধ/টকে যেত, সেইগুলি চটকে এবং তাতে চিনি মিশিয়ে তৈরী হত এই সন্দেশ। সেই চটকানো ছানা তারপর ঘুঁটে দেবার মত চটের গায়ে থেবড়ানো/ বা পেটানো হত। সেখান থেকেই নাম এসেছিল ‘পেটা সন্দেশ’। ব্যাপারটা সাইকোলজিক্যাল কিনা বলতে পারব না, তবে আমার ছোটবেলায় এটা ভালোলাগার একটা কারণই ছিল সন্দেশে সেই টক টক ভাবটা। আমার মত পাবলিক ছাড়া পেটা সন্দেশ খাবার জন্য কেউ কিনত না – মূলত কেনা হত পূজা দেবার জন্য। যাতে ওই মাল বেশী না খেয়ে পেট খারাপ না হয় সেই জন্যই ওই ব্যাবস্থা চালু করেছিলেন মনে হয় কোন দূরদ্রষ্টা। আফটার অল পূজার প্রসাদ আবার বেশী কেউ খায় নাকি! তখন দোকানে পূজার মানসিকের সন্দেশ বললেই কাগজের ঠোঙায় দুটো করে পেটা সন্দেশ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত।

    তবে খাজার মত পেটা সন্দেশও তার কৌলিন্য হারিয়েছে। আজকালকার মানসিকের পূজায় পেটা সন্দেশ পড়লেও তাতে ছানার ভাগ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে এসেছে। চিনির ঢেলা সদৃশ মনে হয় পেটা সন্দেশকে মুখে দেবার পর। আসলে এখন মাখা সন্দেশ দিয়ে পূজা দেবার একটা ট্রেণ্ড এসে গেছে। দোকানে দোকানে ন্যানো সাইজের ছোট্ট চৌকো ঠোঙার উদ্ভব হয়েছে ৫০ গ্রাম পর্যন্ত সন্দেশ দেবার জন্য। সন্দেশ দিলে বামুন মারফত ঠাকুরের আশীর্বাদ আরো বেশী ডাইরেক্ট হবে এই হল এখনকার মধ্যবিত্তের মতামত। আফটার অল ভালো জিনিস ঠাকুর বা মানুষ সবার জিহ্বাই পছন্দ করে। মেমারী স্টেশনবাজারের আরো খাবারের গল্প পরেরবার।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১২ নভেম্বর ২০১৩ | ১৭৬২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | 132.167.47.9 (*) | ১২ নভেম্বর ২০১৩ ০১:৪৫46058
  • খাসা লাগলো। পড়ে টরে বেশ একটা পেটে হাত বুলিয়ে হেউ করতে ইচ্ছে করে।

    দু একটা গ্রাফ বা ইকুএশন থাকলে আরো ভাল্লাগতো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন