এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অসভ্য চোখ (চলছে)

    Sayantani Putatunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২১ নভেম্বর ২০১৩ | ২৭৭৮ বার পঠিত
  • | |
    ৩.
    --‘হ্যালো’?
    --‘হ্যালো। পুঁটিরাম নার্সারী?’
    ওপ্রান্ত থেকে এমন একটা অদ্ভুত নাম শুনে ব্যায়ামবীর রাবন, তথা বাবন ঘাবড়ে গেল। পুঁটিরাম নার্সারী! এমন নামের কোনও নার্সারী আছে নাকি! সে আমতা আমতা করে বলে—‘না...এটা তো নার্সারী নয়। আপনার বোধহয় ভুল হচ্ছে’।
    --‘সে কি!’ ওপ্রান্ত থেকে ব্যথিত স্বর ভেসে আসে—‘এমন বলতে পারলেন আপনি? আমার ভুল হচ্ছে না! আপনারই ভুল হচ্ছে’।
    তার চোখ প্রায় চড়াৎ করে চাঁদিতে উঠে পড়েছে। অনেকটা চোখওয়ালা নারকোলগুলো যেমন হয়, তেমনই চাঁদি ছুঁয়ে পিট্‌পিট্‌ করে তাকিয়ে থেকে সে কিছুক্ষণ ভাবল। তার কি করে ভুল হয়? এটা তার নিজের বাড়ি। নিজের ফোন। নিজের নম্বর। এবং সে খুব ভালোভাবেই জানে যে এটা কখনই পুঁটিরাম নার্সারী নয়—হতেই পারে না!
    সেকথা বলতেই ওপ্রান্তের লোকটা কনফিডেন্টলি বলল—‘পুঁটিরাম নার্সারী আছে। আপনি জানেন না’।
    --‘আমার বাড়ি— আর আমি জানি না!’ বিরক্ত হয়ে বলল বাবন।
    --‘না জানেন না। আপনার বাড়ির সামনে একটা পুকুর আছে। তাই না? এখন বলুন সেটাও জানেন না!’
    --‘না, জানি। আছে’।
    --‘তবে? তাহলে পুঁটিরাম নার্সারীও আছে। আর তার প্রোপাইটার হরিকৃষ্ণ বাবুও আছেন। ফোনটা তাঁকে একটু দিন তো’।
    --‘হরিকৃষ্ণবাবু!’ সে ফের অবাক। এই হরিকৃষ্ণবাবুটা আবার কে? ঐ নামে এই তল্লাটে কেউ আছে বলে তো মনে হয় না!
    --‘আচ্ছা। হরিকৃষ্ণবাবু না থাকলে...’ লোকটা গলা মিহি করে বলল—‘... হীরালালবাবুকেই একটু দিন!’
    এতক্ষণে সব ব্যাপারটা একমুহূর্তে বুঝতে পারল বাবন। লোকটা আদৌ কোনও পুঁটিরাম নার্সারী বা হরিকৃষ্ণবাবুকে খুঁজছে না। ঐ হীরালালবাবুর খোঁজ করাই তার উদ্দেশ্য!
    সে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিতে শুরু করল—‘শুয়োরের বাচ্চা, হারামি, খান্‌কির ছেলে। হীরালালবাবুকে খোঁজা হচ্ছে! তোর গাঁড় না মেরে দিয়েছি শালা ...’।
    ও প্রান্তে খিক্‌খিক্‌ করে চাপা হাসির শব্দ। পরক্ষণেই লাইনটা কেটে গেল।
    রিসিভারটা দড়াম্‌ করে রেখে দিল বাবন। পাড়ার বিচ্ছুছেলেগুলোর উৎপাতে তার প্রাণ যাওয়ার উপক্রম! প্রথম প্রথম এত গালাগালি দিত না সে। ফোনে কেউ হীরালালবাবুকে খুঁজলে সপাটে বলে দিত—‘তিনি একটু আগেই দেহত্যাগ করেছেন। এইমাত্রই তাকে পুড়িয়ে আসছি’। কিন্তু ছেলেগুলো নাছোড়বান্দা। সকাল-সন্ধ্যা, দিন-রাত্তির খালি ফোন করেই চলেছে। কি? না, হীরালালবাবু আছেন? না, নেই। হীরালালের চোদ্দ পুরুষ জাহান্নামে গেছে! ধ্বক্‌ থাকলে সেখানে গিয়ে খোঁজ্‌ বাঞ্চোত!
    বাবন যে ‘হীরালালবাবু’ নামটা শুনলেই ক্ষেপে লাল হয়ে যায়, রীতিমত হাইপার হয়ে ওঠে এটা প্রথম আবিষ্কার করেছিল প্লেটোনিক ক্লাবের পিকুল। এক নম্বরের বজ্জাত ছেলে। প্রথম প্রথম সে একাই ফোন করে খিস্তি শুনত। এটা তার একরকমের মনোরঞ্জন! পরে তার গলা চিনতে পেরে গিয়েছিল বাবন। তখন হারামজাদা গলা পালটে মেয়েদের গলায় কথা বলতে শুরু করল। শুরুতেই ‘হীরালালবাবুর’ নাম বললে কেটে দেবে বলে প্রথমে একচোট ভুজুং ভাজুং দিয়ে নিত। তারপর সময়মত মোক্ষম পাঞ্চের মত মোক্ষম প্রশ্ন—‘হীরালালবাবু আছেন?’ বাবন রেগে গিয়ে রাজ্যের নোংরা নোংরা খিস্তির দোকান খুলে বসত। আর পিকুল ভারি মজা পেত।
    এখন পিকুলের কাছ থেকে তথ্যটা ক্রমশই ছড়িয়ে পড়েছে। সবসময়ই ফোনটা বাজে। কেউ অফিসের ফাঁকে, কেউ কলেজের টিফিনে, কেউ আবার ক্লাব, বা দোকান থেকে ফোন করে হীরালালবাবুকে খোঁজে! এমনকি এস টি ডি, আই এস ডি করেও পাব্লিক প্রশ্ন করে –‘হীরালালবাবু আছেন?’
    ওরা জানে, যে করেই হোক্‌ মাকড়াটাকে হীরালালবাবুর নামটা শোনাতেই হবে। তাহলেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত শিং উঁচিয়ে জগঝম্প করবে ব্যাটা! নোংরা নোংরা খিস্তি ঝাড়বে। আবার কেউ কেউ খিস্তির বন্যার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলে—‘ও দাদা, কাল এগুলো হয়ে গেছে। স্টকে নতুন কিছু নেই?’
    বোঝো! একটা লোক রেগে লাল হয়ে যাচ্ছে, রাগে দাপাদাপি করছে—আর কয়েকটা লোক তাতে মজা পাচ্ছে! বাবন ভেবে পায় না, মানুষেরা মানুষকে ব্যথা দিয়ে এত আনন্দ পায় কেন? এ যেন একটা বাঘকে খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে তাকে সড়কির খোঁচা মারা। বাঘটা আর্তনাদ করবে। গর্জন করবে। কিন্তু খাঁচার মধ্যেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে মরবে। আর বাইরে কতগুলো লোক তা দেখে অদ্ভুত পৈশাচিক আনন্দ লাভ করবে! কি আশ্চর্য এই দেশ! কি আশ্চর্য মানুষের এই বর্বর বিনোদন!
    সে আপনমনেই পানীয়ের গ্লাসটা তুলে নেয়। আজকাল একটু বেশিই মদ খাচ্ছে। মদ খেতে তার ভালো লাগে না। কিন্তু না খেয়েও থাকা মুস্কিল। রাতে কয়েক পেগ পেটে না পড়লে ঘুম আসে না। সবসময়ই অস্থিরতা তাকে তাড়া করে বেড়ায়...!
    ফের টেলিফোনটা বাজছে।
    বাবন জানে ফোন তুললেই কি হবে। তবু সে রিসিভারটা তুলল।
    --‘হ্যালো...আমার একটু জরুরী দরকার আছে’।
    বাবন ক্লান্ত গলায় বলে—‘বকুন’।
    --‘আমার একটা চাকরীর খুব দরকার। বাবা অসুস্থ। অ্যাক্সিডেন্টে দুটো পা কাটা গেছে...’।
    আরও কত কি বকবক করে বলে গেল লোকটা। বাবন হুঁ হুঁ করে শুনে যাচ্ছে। অবশেষে কাজের কথায় এল লোকটা—‘সরি স্যার, আপনার নামটা জানা হয়নি। আপনিই হীরালালবাবু তো?’
    একডজন বাছা বাছা কাঁচা খিস্তি দিয়ে বলল সে—‘ওরে হীরালালের রসিক নাগর, আমি হীরালালের পোষা রেন্ডির বাপ! বুঝেছিস শালা!’
    লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলল—‘ আরে বাঃ! দারুণ মজার ব্যাপার তো! কাল আবার ফোন করবো’।
    বলেই কুটুৎ করে লাইনটা কেটে দিল।
    বাবন রাগে চিড়বিড় করতে করতে মদের গ্লাসে উত্তেজিত কয়েকটা চুমুক দেয়। এই লোকগুলো তাকে কি ভাবে! সার্কাসের ক্লাউন! সামনাসামনি পড়লে সবক’টাকে দেখে নিত। ইয়ার্কি! দেখতে সে খারাপ হতে পারে। কিন্তু তার শরীরের ইস্পাতকঠিন মাস্‌ল্‌গুলো একদম সলিড! এই ‘ঢাই কিলো’র হাত একবার পিঠে পড়লে বুঝতে পারত কার সাথে পাঙ্গা নিয়েছে।
    দুঃখের বিষয় ফোনে কিলোনোর উপায় নেই। থাকলে এতদিনে সবক’টাকে ভীমকেলিয়ে কীচক বানিয়ে দিত।
    ভাবতে ভাবতেই তার মনটা টনটনিয়ে উঠল। থার্ড পার্সন প্লুরাল নাম্বারদের দোষ দিয়ে আর লাভ কি! সবচেয়ে কাছের মানুষটাই যে এমন দাগা দিয়ে যাবে, তা সে কখনও ভেবেছিল! অনিন্দিতা তাকে ছেড়ে চলে যাবে, তাও আবার ঐ বাপে খ্যাদানো, মায়ে তাড়ানো, ছয়টিক্কিবাবু হীরালালটার সঙ্গে পালিয়ে যাবে—এমন সম্ভাবনার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি বাবন।
    অনিন্দিতার কথা মনে পড়তেই বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। অনিন্দিতা তার বিয়ে করা ডবকা বৌ। বাবনের নিজস্ব তিনটে জিম আছে। গোল আলুরা, আর প্যাঁকাটি মার্কা তেজপাতারা সেখানে হুশহাশ করে ব্যায়াম করত। মেদ জিনিসটা ট্রান্সফারেব্‌ল্‌ হলে কত সুবিধাই না হত। সাম্যবাদের নিয়ম অনুযায়ী হোঁৎকা আর সিঁড়িঙ্গে লোকগুলোর মধ্যে চর্বি খানিকটা সমান ভাবে ভাগ করে দিলে বেশ কয়েকটা হৃষ্টপুষ্ট কেষ্ট পাওয়া যেত। কিন্তু তাতে একটা ইকোনমিক প্রবলেম আছে। জিম আর যোগা সেন্টারগুলো চলত কি করে?
    যাই হোকু, সেই জিমের টাকায় দিব্যি চলে যাচ্ছিল। সংসারে কোনও সমস্যা ছিল না। তবে অনেকদিন কেটে গেলেও কোনো ছানাপোনা হল না দুজনের। সমস্যা বাবনেরই ছিল। অনেক কিছু করেও যখন কিছু হল না, তখন অনিন্দিতার শখ হল থিয়েটার করার। চেহারাটা ভালো ছিল। অভিনয়টাও অল্পবিস্তর জানত। আর এই থিয়েটারই হল যত নষ্টের গোড়া। ঐ কালো কুচকুচে ভোঁদড়টার মধ্যে কি দেখল অনিন্দিতা কে জানে! ভিতরে ভিতরে আশনাই চলতে শুরু করল। তারপর অবশেষে একদিন পাখি ফুড়ুৎ! অনিন্দিতা চলে গেল। তার সাথে গায়ের গয়না-টাকাপয়সাও হাওয়া! রেখে গেল শুধু একটা চিরকুট। তাতে লেখা ছিল—‘আমি হীরালালের সাথে চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে থেকে থেকে আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেছে। একটা সন্তানের মুখ এতদিনেও দেখাতে পারলে না! আজ একটুকরো সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে বলছি, আমি রিক্ত, ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত! আমায় খোঁজার চেষ্টা কোরো না। করলেও পাবে না। আমি কি ডরাই সখী ভিখারী রাঘবে! প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া!’
    চিরকুটটা পড়ে বাবন হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায়নি। পরক্ষণেই ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শেষ চিঠিটায় অন্তত নিজের কথা লিখতে পারতে অনিন্দিতা! ঢ্যাম্‌না, হিজড়ে বলে গাল দিলেও কিছু মনে করতাম না। কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘প্রফুল্ল’, ‘রক্তকরবী’, ‘মেঘনাদবধ’ আর ‘মুঘল-এ-আজ্‌ম্‌’ থেকে ঝেঁপে ঝেঁপে কতগুলো লাইন লিখে দিয়ে গেলে! ঐ হতভাগা হীরালালের বাচ্চা তোমায় এমন নাটুকে বানিয়েছে যে একটা মৌলিক লাইনও মাথায় এলো না! ছ্যাঃ!
    ভাবতেই মাথা গরম হয়ে গেল তার। কতবার ভেবেছে ভুলে যাবে। হয়তো এতদিনে ভুলেও যেত। কিন্তু এই ফোনগুলো কিছুতেই ভুলতে দেয় না। অমোঘভাবে কিড়িং কিড়িং করে বাজে। আর ফোন ধরলেই অন্য প্রান্ত থেকে উদ্যত প্রশ্ন—‘হীরালালবাবু আছেন?’
    লোকগুলো মজা পায়। কিন্তু বোঝে না, প্রত্যেকবার এই নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ভিতরে তির্‌তির্‌ করে রক্তক্ষরণ হয়। একটা ভীষণ জ্বালা তিড়িক্‌ তিড়িক্‌ করে ওঠে। মরে যেতে ইচ্ছে করে বাবনের। কিন্তু কোনওদিনই মরা হয় না। আসলে মরার সাহসই নেই। বেঁচে থাকার সাহসও নেই। তাই বোতলকে আশ্রয় করে রোজ রাতে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে রোজ লাট খায় বাবন। ভরপেট মাল খেয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। এলোমেলো পায়ে হাঁটে। পাশ দিয়ে হুশহুশ করে চলে যায় লরি, ট্যাক্সি। মোটা মোটা টায়ারগুলো তাকে ছুঁই ছুঁই করেও ছোঁয় না। উদ্মা মাতাল হয়ে রোজ বাবন মৃত্যুর সাথে ছোঁওয়া-ছুঁয়ি খেলতে বেরোয়! কোনওদিন হয়তো টায়ারগুলো ছুঁয়ে ফেলবে তার দেহ। অনিন্দিতা কি জানতে পারবে? অনিন্দিতা কি কাঁদবে? বোধহয় না।
    আপনমনেই হেসে ওঠে বাবন। তারপর গ্লাসটা শেষ করে ঠক্‌ করে নামিয়ে রাখে টেবিলের উপরে। বেশ রাত হয়েছে। দশটা বাজে। এখন তাকে বাইরে বেরোতে হবে। দরকারি কাজ আছে।

    ৪.
    --‘একটা শাড়ির দাম পাঁচশো টাকা! শ্লা- ঢ্যাম্‌নামি হচ্ছে?’
    আপনমনেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবন দেখল এক ভদ্রলোক শাড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করছেন। তার চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে পারিষদবর্গ। পরণে একটা হাতাগোটানো পাঞ্জাবি। স্টাইলিশ জিন্স। পায়ে বুট জুতো। দাড়ি-গোঁফের বালাই নেই। কামিয়েছেন, না মাকুন্দ—ঠিক বোঝা গেল না! হাতে পাইপ! সেই পাইপে গোটা দুয়েক টান মেরে বললেন—‘ এক হাজার টাকায় দিবি কি না বল্‌’!
    সে কথাটা শুনে ঘাবড়ে গেছে। আড়চোখে দেখল দোকানিরও একই অবস্থা! ভদ্রলোকের ইয়ার-দোস্তদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে বলল—‘ইয়ে, মানে...ভাই, এক হাজার টাকাটা পাঁচশ টাকার চেয়ে বেশি’।
    ভাই! তার মানে ইয়ার-দোস্ত নয়! চ্যালা। মানে পন্টর্‌! আর চ্যালাদেরও কি চেহারা! বাবনকেও বলে ‘ওদিকে যা’! লোকটা কে? উঠতি কোনও ডন নাকি! এতদিন তো লাটু-মস্তানের চ্যালাদের দবদবাতেই টেঁকা যেত না! লাটু অবশ্য নিজে বিশেষ অপারেট করে না। তাকে মাঝেমধ্যে রাস্তায় দেখা যায়। রীতিমত সুন্দর দেখতে! বেশ কচি কচি মুখ! টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ! ছিপছিপে পাতলা চেহারা। একটা ষাঁড়ের মতন বাইকে চেপে হুশহাশ করে চলে যায়। কিন্তু তার শাগরেদদের উৎপাতেই প্রাণ যাওয়ার জো! তার উপর আবার একটা নতুন এসে জুটেছে!
    --‘বেশি?’ ভদ্রলোক একটু ভাবলেন—‘ঠিক আছে। তবে একশো টাকায় দে’।
    --‘একশো টাকা!’ দোকানি একেবারে নীলচাষীদের ভঙ্গিতে হাতজোড় করে ফেলেছে—‘হুজুর মা বাপ, আমরা শুয়োরের বাচ্চা। পাঁচশো টাকার জিনিস একশো টাকায় দিলে খাব কি?’
    ভদ্রলোক জুৎ করে পাইপে ফের টান মারলেন। প্রথমে মনে হল সন্তুষ্ট হয়েছেন। পরক্ষণেই ভ্রুকুটি করে বাজখাঁই গলায় বললেন—‘আবে ন্যাকাচোদা...কায়দা করে আমায় শুয়োর বলছিস্‌! হারামের পিল্লা! এই পচা, দে তো আমার চিক্‌নাটা...’!
    দোকানি পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে—‘হুজুর, আপনাকে শুয়োর বলিনি। নিজেকে শুয়োরের বাচ্চা বলেছি’।
    --‘তার আগে কি বলেছিস্‌ চিরকুট?’ পচা ততক্ষণে চিক্‌না তথা একখানা ভোজালি এগিয়ে দিয়েছে। সেটা দোকানির গলায় ছুঁইয়ে বললেন তিনি—‘আমি যদি তোর মা-বাপ হই, আর তুই যদি শুয়োরের বাচ্চা হয়ে থাকিস, তবে আমি কি হলাম! অ্যাঁ?...মাজাকি মারছিস্‌? শ্লা...আজ তোর আসল যন্তরটাই কেটে দেবো...! বাড়ি ফিরে মাগীর সামনে লুঙ্গি খুলে হাততালি দিয়ে নাচবি—হিজড়ে শ্লা!’
    --‘ভাই’। পিছন থেকে পচা এগিয়ে আসে—‘ছোটভাই বলেছে পাড়ায় ঝাড়পিট-লাফড়াবাজি নয়। আবে চিরকুট, শাড়িটা এক পাতায় দিবি? না ......’
    দোকানি হাঁউমাউ করে ওঠে—‘না...না...কিচ্ছু দিতে হবে না হুজুর। ওটা ফ্রি...।’
    এতক্ষণে ভদ্রলোক হাসলেন। হেসে বললেন—‘গুদ্‌!’
    বাবন স্তম্ভিত! বাপ্‌রে! এ কি ভাষা! ভাষা না ডাস্টবিন! সে নিজেও শব্দগুলো ব্যবহার করে। কিন্তু গালিগালাজ হিসাবে। যার নর্মাল ভাষাই এই, তার গালিগালাজ কোন্‌ স্তরের হবে!
    --‘আঃ ভাই—ফের লোচা!’ পিছন থেকে আরেকজন এগিয়ে এল—‘গুদ্‌ মানে...ইয়ে...ইয়ে...’। সে আঙুল দিয়ে কিছু একটা বোঝাল। তারপর বলল—‘ওটা গুড! গুড হবে’।
    --‘ওঃ!’ ভদ্রলোক শুধরে নিলেন—‘গুড, এবার একটা গামছা দে’।
    বলতে বলতেই পিছন ফিরে চোখে সানগ্লাস চাপালেন। এই রাত দশটায় চোখে সানগ্লাস চাপানোটা কেমন স্টাইল, সেটা ঠিক বোঝা গেল না। চ্যালা চামুন্ডাদের বললেন—‘ওকে চারটে নীলপাত্তি দে। এসব কেসে বেশি কঞ্জুসি ঠিক না’।
    বাবন ‘থ’ হয়ে গোটা ঘটনাটাই দেখছিল। হাতা গোটানো পাঞ্জাবি পরা, রাত্রে চোখে সানগ্লাস দেওয়া, পাইপ খাওয়া ডন এই প্রথম দেখছে। সাঙ্গোপাঙ্গ সহ ভদ্রলোক তথা ডন সাহেব চলে গেলে সে আস্তে আস্তে কাপড়ের দোকানির দিকে এগিয়ে গেল। সে বেচারি চারশো টাকা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তখনও ঠক্‌ঠক্‌ করে তার হাঁটু দুটো কাঁপছে!
    --‘উনি কে?’ বাবন কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করে—‘লাটু মস্তান নিজে বলে তো মনে হল না! না অন্য কেউ!’
    --‘লাটু না’। দোকানি কাঁপাকাঁপা গলায় বলে—‘উনি লাটুর গার্জেন’।
    --‘ও! লাটুর বাবা !’
    --‘সর্বনাশ!’ সে আধহাত জিভ কাটে—‘বাবা কেন হবেন? উনি লাটুর মা!’
    বাবন প্রায় এক পাউন্ডের হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর আপনমনেই বলে—‘মা এত ডেঞ্জারাস! সেইজন্যই ছেলের এত দম !’
    --‘ছেলে কে?’ দোকানিও এবার বিশ্বরূপদর্শন করাল—‘ছেলে কাকে বলছেন মশাই?’
    --‘কেন? লাটু? উনি তো লাটুর মা’। বাবন সবিস্ময়ে বলে—‘তাই না?’
    --‘হ্যাঁ। উনি লাটুর মা। কিন্তু লাটু ওনার ছেলে নয়! মেয়ে!’
    হায় আল্লা! এ কি কল্লা! কয় কি মিন্সে! লাটু মস্তান...নবগ্রামের ত্রাস...মূর্তিমান আতঙ্ক...যার নামে গোটা চত্বর কাঁপে...সে নাকি মেয়ে!
    --‘মেয়ে ভাই!’
    --‘কেন? মেয়েরা কি ভাই হতে পারে না? মা আর মেয়ে গুন্ডাগিরিতে ব্যাটাছেলেদেরও হার মানিয়েছে’। দোকানি টাকাগুলো গুনে গুনে ক্যাশবাক্সে রাখতে রাখতে বলল—‘দেখছেন না, কেমন কতগুলো ষন্ডাকে পোষা বেড়ালের মত সাথে নিয়ে ঘোরে!’
    --‘কিন্তু...লাটু...মেয়ে!’
    বাবনের চোখের সামনে যেন একটা কুমীর দাঁতে ক্লিপ আটকে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে। অথবা একটা বাঘ খুব মন দিয়ে লাল রঙের নখপালিশ লাগাচ্ছে। কিংবা একটা গন্ডার নাকে নথ লাগিয়ে...!
    --‘কোথায় থাকেন মশাই? জানেন না? লাটুর আসল নাম লতিকা! লাটু মস্তান হওয়ার আগে ঐ নামই ছিল।’ দোকানদার লাটুর ইতিহাস বিবৃত করে।
    লাটুর বাপ ছিল নামকরা মস্তান। কিন্তু লোকটা গ্যাং ওয়ারে খুন হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকে তাকে খুন করেছিল অন্য গ্যাঙের লোকেরা। লতিকার বয়েস তখন দশ। তাকে নিয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে বসেছিল তার মা। খাটের তলার অন্ধকারে বসে সে সজল চোখে দেখেছিল তার বাবাকে চপার দিয়ে কোপাচ্ছে অপোনেন্ট গ্যাঙের সর্দার নুটু মন্ডল। বাবার রক্তের ছিটে এসে লেগেছিল তার চোখেমুখে। কিন্তু মুখে টুঁ শব্দটিও করেনি। ভয়ে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে, মায়ের কোলে মুখ গুঁজে বোবাকান্না কাঁদছিল।
    নুটু মন্ডলকে চিনে রেখেছিল তার দু চোখ। নুটুর বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সঙ্গলাভের নেশা ছিল। একরকমের বিকৃত যৌনইচ্ছা বলা যেতে পারে। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই তার কাছে গেল লতিকা। তারপর নিভৃতে নুটুর নিজের ছুরি দিয়েই কোপের পর কোপ মেরে শেষ করল তাকে।
    সেই প্রথম তার হাতে “মেহেন্দি” লেগেছিল। মাত্র দশ বছর বয়েসেই। হিংসাই তাকে হিংসা শিখিয়েছিল। নাবালিকা হওয়ার দরুণ তেমন শাস্তি তাকে দিতে পারেনি আইন। আঠেরো বছর অবধি জুভেনাইল কাস্টডিতে থাকার পর মুক্তি পেয়েছিল লতিকা।
    এরপর লতিকা থেকে লাটু মস্তান হতে তার সময় লাগেনি। ফ্রক, চুড়িদার ছেড়ে সে শার্ট-প্যান্ট পরল। চুল ছোট করে কাটল। হাতে চুড়ির বদলে চেইন। কোমরের বেল্টে চাকু, পিস্তল দুটোই থাকে। ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট, শার্প শুটার! বাইরে থেকে ছিপছিপে চেহারা হলে কি হবে, চিতাবাঘের মত তার ডোলে-শোলে! আঙুলে জ্বলন্ত সিগ্রেট! বাবার শাগরেদদের জুটিয়ে নিয়ে সে আবার দল গড়ল। শক্তি আর সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়েই পুরুষদেরও টেক্কা দিয়েছে। জীবন তাকে শিখিয়েছিল বেঁচে থাকতে হলে দাঁত নখ থাকাটা জরুরী। নিরীহ প্রাণী হলে মাংসাশীদের শিকার হতেই হয়। শিকার হওয়ার চেয়ে শিকারী হওয়াই পছন্দ করল লতিকা। তাই নারীদের লালিত্য, কমনীয়তা সব ছুঁড়ে ফেলে লতিকা ওরফে লাটু মস্তান এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম!
    সব ঘটনা শুনে চুপ করে গেল বাবন। কিছু বলারও ছিল না। চুপচাপ এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে। আড়চোখে দেখল লাটুর মা তখন খই, আর হাঁড়ি কেনার দিকে মন দিয়েছেন!
    সে খুব মন দিয়ে মহিলাকে দেখছে। এতক্ষণ একটা বিতৃষ্ণা থেকে লক্ষ্য করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এখন কি মনে করে যেন কৌতুহলী চোখে দেখতে লাগল। ছোট করে ছাঁটা চুল। শ্যামলা রঙ হলেও মুখে একটা তর্‌তরে কমনীয়তা আছে। মাঝে মাঝেই হাতের পাইপটায় টান মারছেন। লাটুর মত হিলহিলে নয়। বরং বেশ ভারি চেহারা। আর কন্ঠস্বর! তার কথা না বলাই ভালো! ‘কন্ঠে যেন বজ্র লজ্জাহত’। খই ঠিক কিনলেন না। বলা যায়, বুক করলেন! দশকর্মা ভান্ডারের লোকটাকে শাসিয়ে বললেন—‘ সময়মত যদি না পাই, তবে তোর পুঙ্গি বাজবে, মনে রাখিস্‌’।
    বাবনের কৌতুহল ক্রমশই বাড়তে থাকে। কিসের মার্কেটিং করছেন ভদ্রমহিলা! শাড়ি, গামছা, হাঁড়ি, খই...! পুজো? বিয়ে? না অন্যকিছু!
    --‘খাটিয়া বুক হয়ে গেছে ভাই’। আরেকটা মুষকো এগিয়ে এসে বলল—‘ ধূপ, সেন্ট কিনে নিয়েছি, নার্সারিতে ফুলের অর্ডার দিয়েছি। গাড়ি কি বুক করবো? কোন্‌ গাড়ি নেবে? লরি? ম্যাটাডোর?’
    --‘ধু-উ-স পাগলাচোদা’। সস্নেহ ভঙ্গিতে বললেন তিনি—‘ওসব ফালতু চিজে যাবো না। ঐ যে কাঁচের গাড়িগুলো—একেবারে বিন্দাস রাপচিক মাল রে, কি নাম?’
    --‘স্বর্গরথ ভাই?’
    --‘হ্যাঁ। ওটাই একটা বায়না কর্‌। যেতে হলে রাজার মত যাবো শ্লা! তার সাথে তোদের জন্য একটা পেল্লায় বাস। কি যেন নাম?’
    --‘ভলভো। কিন্তু এত আগে কি ভলভো দেবে?’
    মহিলা ছিক্‌ করে থুতু ফেললেন—‘ দেবে না মানে! দরকার হলে দুগনা রোকড়া দিবি! পয়সা দেখলে নিজের নীচের ডান্ডাটাও দেবে, গাড়ি কি চিজ?’
    আশেপাশের লোকগুলো খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল। বাবন তখনও কনফিউশনে। কিসের মার্কেটিং হচ্ছে? ধূপ, ফুল, সেন্ট, খাটিয়া, গাড়ি—কি সর্বনাশ! কাউকে যমের দোরে পাঠানোর প্ল্যানিং হচ্ছে নাকি! তারই অন্তিমযাত্রার প্রস্তুতি! অ্যাঁ! এ তো ফুলটু জন্ডিস কেস! ডনরা মানুষ খুন করে সেটা জানা ছিল, কিন্তু তার অন্ত্যেষ্টির বন্দোবস্তও আগে থেকে করে রাখে, এমন তো কোথাও শোনেনি! এমনকি স্বর্গরথের পিছন পিছন যাওয়ার জন্য ভলভোও বুক করছে। কেসটা কি?
    মহিলার সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে একজনকে একটু নরমসরম মনে হচ্ছিল। সে তুলনায় একটু অল্পবয়স্ক। সদ্যই হয়তো দলে নাম লিখিয়েছে। সে ব্যাটা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সব দেখছিল। বাবন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করল—‘ভাই, একটু শুনবেন?’
    ছেলেটা তার দিকে ভাসাভাসা চোখে তাকাল—‘আমি ভাই নই। রাম-লক্ষণ দুই ভাই, আর সব চুদির ভাই’। মহিলার দিকে আঙুল তুলে দেখায় সে—‘ঐ যে ভাই!’
    লেঃ হালুয়া! ‘ভাই’ বলে ডাকাও বিপদ! কি বলে ওকে ডাকবে ভেবে পায় না বাবন। অনেক ভেবেচিন্তে বলল—‘তা দাদা, কিসের মার্কেটিং হচ্ছে?’
    বলতেই একেবারে হ্যাঁক করে কেঁদে ফেলল ছেলেটা! চোখের জলে, নাকের জলে একেবারে একাকার! গুন্ডাদের এরকম সেন্টু খেতে খুব কমই দেখেছে! এ তো টোট্টাল ইমোশনাল! ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে ‘ফোঁ-ও-চ’ করে সশব্দে নাক মুছে বলল সে—‘বডি ফেলবার পরের মার্কেটিং হচ্ছে’।
    তাহলে তো ঠিকই ধরেছিল বাবন! নির্ঘাৎ কারুর লাশ ফেলার মতলব! সে গলা খাটো করে জিজ্ঞাসা করে—‘কোনও মার্ডার কেস?’
    ছেলেটা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে—‘না। ন্যাচারাল ডেথ’।
    --‘কার হল?’
    --‘হয়নি এখনও’। সে আরেকচোট ফোঁচ ফোঁচ করে উত্তর দেয়—‘তবে হবে’।
    --‘কা-র?’
    ব্যাটা আঙুল তুলে মহিলার দিকে দেখায়—‘ভাইয়ের’।
    কিছুক্ষণের জন্য বাবনের মনে হল তার মাথায় একটা সাইবার ঝিঁ ঝিঁ বসে গ্যাঁ-ও গ্যাঁ-ও করে ঝিঁঝিঁট খাম্বাজ গাইছে। অথবা সে একটা কুয়োয় পড়ে গিয়েছে। অন্ধকার কুয়োর মধ্যে শ্যাওলা নয়, সর্ষেফুল ফুটে আছে আর তার মধ্যে কাজল নাচছে—‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়...’। কিম্বা একটা লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে ফঁৎ ফঁৎ করে মাঞ্চুরিয়ান ভাষায় কথা বলছে, যার বিন্দুবিসর্গও সে বুঝতে পারছে না!
    --‘হাঁ টা বন্ধ করুন দাদা’। ছেলেটির গলা শুনতে পেল সে—‘এত মশা মাছি, ধুলো বালির মধ্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলে ডাব্‌ল্‌ ওয়াট লাগবে। খচ্চা হয়ে যাবেন’।
    এতক্ষণে খেয়াল হল যে তার চোয়াল ‘বোরা গুহালু’র মতন ঝুলে পড়েছে! বোরা গুহালু কখনও দেখেনি বাবন। কিন্তু নাম শুনলেই মনে হয় এমন জায়গায় সব বোরিং পাব্লিকরাই যায়। আর আলুর শেপের গুহা দেখে এসে ফান্ডা মারে।
    যাই হোক্‌, কোনমতে হাঁ টা বন্ধ করে সে বলে—‘মানে?’
    ছেলেটি যা বলল তার মর্মার্থ অনেকটা এইরকম—
    লাটুর মা—তথা বড় ভাইয়ের বুকে কি যেন হয়েছে। একটা শিরা ক্রমশই ফুলতে শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে নাক দিয়ে খুব রক্তও পড়ে। বড় ভাইকে ছোট ভাই, মানে লাটু অনেকবার নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিয়েছে। কিন্তু হয় ভাই নিজেই পালিয়ে এসেছে, নয় নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ প্রায় হাতজোড় করে সাবমিশন ফি এর ডাব্‌ল্‌ টাকা দিয়ে পেশেন্টকে ফেরত পাঠিয়েছে। ভাই বেচারির দোষ কি! তার লাঞ্চে বিরিয়ানি আর মুর্গ মুসল্লম না হলে চলে না। রাতে মাত্র হাফ ডজন পরোটার সাথে, মাট্‌ন্‌ কষা, ঘুগনি আর রামের বোতল ছাড়া ভাই চোখে অন্ধকার দেখে! হাসপাতালের লাপসি তার পোষাবে কেন? তাই একদিন কিচেনে গিয়ে কুককে তারই হাতা খুন্তি শিলনোড়া দিয়ে অল্প করে পিট্টি দিয়েছিল। আরেকবার কোন্‌ এক হতভাগা ডাক্তার ভাইকে অজ্ঞান করে বুকে কাটাকুটি করার তাল করছিল। ভাই দুষ্টুমি করে অজ্ঞান করার মুখোশটা তার নাকেই দিয়ে দিয়েছিল। ওটা নেহাৎই ছেলেমানুষী। কিন্তু হতচ্ছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা তো বুঝলই না, উলটে ভাইকেই ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়ে বলল—‘যতদিনে ওঁর ট্রিটমেন্ট হবে, ততদিনে আমাদের একটা ডাক্তারও জ্যান্ত থাকবে না। ওঁকে বাড়িতেই রাখুন। প্লিজ হাসপাতালে পাঠাবেন না। পাঠালেই পুলিশে ফোন করবো’।
    ভাই নিজেও জানে সে ছ’মাসের বেশি বাঁচবে না। বুকের শিরাটা ফেটে গেলেই কেস খতম। কিন্তু মরার পর তাকে সস্তার জিনিসপত্র দিয়ে যা তা করে শ্মশানে পাঠানো হবে, তা তার বহুত না-পসন্দ! তাই সে এখন থেকেই নিজের মৃত্যুর শপিং করে রাখছে। এমনকি শ্রাদ্ধের কার্ডও পছন্দমত ছাপিয়ে ফেলেছে। শুধু ডেটটা বসানো বাকি।
    বাবন দেখল মহিলা দিব্যি হাসিমুখে শপিং করছেন। চ্যালাচামুন্ডাদের সাথে রীতিমত হাসি মশকরা করে প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র কিনছেন। কেউ বলবে যে এসব আসলে তার নিজের মৃত্যুরই শপিং!
    নেশা করলে বোধহয় মানুষ বেশি সাহসী হয়ে পড়ে। অনেক পাঁচুরাম তখন নিজেকে শের খাঁ ভাবতে শুরু করে। বাবনের ঘাড়ে বোধহয় চেঙ্গিস খাঁ এর প্রেতাত্মা ভর করেছিল। সে টলতে টলতে গিয়ে দাঁড়াল মহিলার সামনে—‘শুনুন’।
    চ্যালাবৃন্দ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে মাপতে শুরু করেছে। মহিলা অর্ধনিমীলিত দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। মুখে কিছু না বললেও তার দৃষ্টি যেন বলল—‘প্রসিড’।
    --‘আপনার মরতে ভয় করে না?’
    শোনামাত্রই চতুর্দিকে হাঁ হাঁ রব উঠল। অন্তত হাফ ডজন চাকু কিম্বা চপারের ঘা খেয়ে জুলিয়াস সিজার হয়ে যেত বাবন, বাঁচালেন বড়ভাই। হাত তুলে ধেয়ে আসা অস্ত্রকে থামালেন। একটু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেন প্রশ্নের কারণটা বোঝার চেষ্টা করছেন।
    বাবন তার পায়ের কাছে ততক্ষণে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়েছে। কি রোম্যান্টিক বসা! রোমিও বোধহয় জুলিয়েটের সামনে এমনভাবেই বসেছিলেন। চোখদুটো সামনের নারীটির চোখে রেখে বিড়বিড় করে বলল—‘আপনার মরতে ভয় করে না? আমার যে ভয় করে। আমার বাঁচতেও ভয় করে! আপনার বাঁচতে ভয় করে না?’
    অতবড় দোর্দন্ডপ্রতাপ ‘বড়ভাই’ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন মাতাল লোকটার দিকে।
    কেউ দেখল না, যে চোখে কখনও ভুলেও জল আসেনি, সেই চোখদুটোয় সামান্য রক্তিমাভা জমেছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তার পদানত মাতাল লোকটা বিড়বিড় করে বলেই যাচ্ছে—‘আপনার বাঁচতে ভয় করে না?...বাঁচতে ভয় করে না...বাঁচতে ভয় করে না...!’

    ৫.
    যখন বিশু বড়ি খেয়ে সাঁচীস্তূপ হয়ে বসে আছে, আর বাবন লাটু-মস্তানের মায়ের পায়ে মাতাল হয়ে ল্যাদ্‌ খাচ্ছে, ঠিক তখনই ক্লাবের ছেলেরা তাদের জরুরী মিটিং করছিল। বিষয়—অসভ্য চোখ!
    --‘বলো কি? ইন্টারন্যাশনাল দেবদাস বিশু! অথবা বৌ পালানো রাবণ!’ পিকুল সুব্রতদার কথা শুনে ঢোঁক গেলে—‘এই তোমার প্রিলিমিনারি সাসপেক্ট!’
    সিগ্রেটে আয়েশ করে টান মেরে সুব্রতদা বলল—‘ঠিক তাই’।
    --‘যাঃ!’ পিকুলের বিশ্বাস হয় না—‘আমার মনে হয় না!’
    --‘তোর মনে না হলে কি হবে!’ সুব্রতদা একদম থার্ড আম্পায়ারের মত কনফিডেন্ট—‘ওই দুটোরই একটা না হয়েই যায় না!’
    --‘কেন?’
    --‘আরে, সাইকোলজি...সাইকোলজি...’। বলতে বলতেই সুব্রতদা সোজা হয়ে বসে রকিং চেয়ারটাকে দোলাতে শুরু করেছেন। এখন তাকে শার্লক হোম্‌স্‌ কম, মিস্‌ মার্পল বলে বেশি মনে হচ্ছে! অমন মশাপ্রুফ গায়ের লোম আর বুলেটপ্রুফ গোঁফজোড়া না থাকলে দিব্যি মিস্‌ মার্পল বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সুব্রতদাকে ঐ দুটো ছাড়া ভাবা যায় না! ওকে মশারা কামড়াতেও ভয় পায়। স্কিন তো নয়, শালা আমাজনের জঙ্গল! মশারাও কনফিউজ্‌ড্‌ হয়ে যায়। কামড়ানো তো দূর, ওর গায়ে বসলেই এইসান লোমে জড়িয়ে মড়িয়ে একসা হয়ে যায় যে ফুলটু চিকুনগুনিয়া কেস! করুণ সুরে ভনভন করতে করতে বেচারারা ফেরার পথ খুঁজতে থাকে! কামড়ানো তখন মাথায় উঠেছে! আর গোঁফের কথা না বলাই ভালো! মশা তো তুচ্ছ প্রাণী, বুলেট, চাকু—এমনকি বোফর্সের গোলাও ও গোঁফ ভেদ করতে পারবে না!
    সেই দুর্ধর্ষ সুব্রতদা আস্তে আস্তে বললেন—‘দ্যাখ্‌, ওরা কেউ মুনি ঋষি নয়। আগেকার দিনের মুনি ঋষিদেরও সুবিধা ছিল। দিব্যি চোখটি বুঁজে বসে থাকতেন। অপ্সরারা যতই নাকের সামনে ধেই ধেই করে নাচুক মনে মনে ভাবতেন—‘তুই মাগী সব ঝুলিয়ে নেচে মর্‌, আমি শালা কিছুতেই চোখ খুলছি না!’ কিন্তু এখন সে সুবিধা নেই। টেলিভিশনের সামনে চোখ বোঁজার উপায় নেই! তুই যাবি কোথায়? চ্যানেল যতই বদলা, কোথাও মল্লিকা শেরাওয়াত, কোথাও রাখী সাবন্ত জিনিসপত্তর দুলিয়ে নাচছে। সেই সব দেখে ফ্রাস্টু খেতেই হবে। তার উপর বিশের অবস্থা ভাব’। তিনি সিগ্রেটে শেষ সুখটানটা মারলেন—‘ইন্টারন্যাশনাল দেবদাস। পারো আসে যায়, পারো বদলায়, কিন্তু কপাল বদলায় না! আর রাবণের একেই বৌ পালিয়েছে। তার উপর তোরা দিনরাত লোকটাকে ফোন করে হীরালালবাবুর নামকীর্তন শোনাচ্ছিস। এ পরিস্থিতিতে ফ্রাস্টুর চূড়ান্ত হয়ে কি করতে পারে?’
    --‘কি করতে পারে?’ ইয়ুথ ক্লাবের হাবু বলল—‘ বড়ি খেতে পারে, মদ খেতে পারে। বেশি হলে ব্লু ফিল্ম দেখতে পারে’।
    --‘ধুস্‌ গান্ডু! ব্লু ফিল্মেও এ ফ্রাস্টুর ইলাজ নেই। আরো গভীর ভাবে ভাব’। তিনি ভুরু দুটোকে প্রায় চাঁদির কাছাকাছি তুলে নাচাচ্ছেন—‘থিঙ্ক...থিঙ্ক...’।
    হুলোদা ফের ফস্‌ফস্‌ করে বিসর্গ ছুঁড়তে যাচ্ছিলেন। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়েছে পিকুল—‘এসব রদ্যাঁর টেকনিক ছাড়ো মামা! আমরা সারাদিনরাত এক করে পটিপোজে বসে থিঙ্ক করতে থাকি, আর তুমি বসে বসে থিঙ্কার বানাও! ওসব চলবে না গুরু। অত পাঁপড় বেলতে পারবো না। সরাসরি বলো, কি বক্তব্য! তুমি কি থিঙ্ক করেছ?’
    --‘খেলে যা! সব থিঙ্ক করা দেখছি আমারই কপালে!’ তিনি হেসে বললেন—‘বেশ, শোন্‌। সেক্ষেত্রে একটা রাস্তাই আছে। ব্লু ফিল্ম বা বই টই নয়, একেবারে লাইভ পানু দেখা। যেটা বেডরুম বা বাথরুমে বেশি দেখা যায়!’
    পাঁচু তিন চারটে হিক্কা তুলে বলল—‘ও এম জি!’
    --‘ও এম জি!’ সুব্রতদা বললেন—‘এম জি মানে তো মহাগুরু। মহাগুরুকে ডাকছিস না কি!’
    --‘না...না...’। পাঁচু এক্সপ্লেন করে দেয়—‘ও এম জি-হল ‘ওহ মাই গড!’—এর শর্টফর্ম!’
    --‘লেঃ হালুয়া!’ সুব্রতদার মুখ ঠিক ভাজা পাঁপড়ের মত হয়ে গেল—‘এই হল তোদের দোষ! সবকিছুতেই শর্টকার্ট খুঁজবি! এমনিতেই রোজ পাত্রপাত্রীর কলামে—পঃ বঃ,উঃ পঃ কঃ(উচ্চ পদস্থ কর্মচারী), কেঃ সঃ চাঃ(কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরি), হুঃ হাঃ, ফুঃ ফাঃ-এর ঠ্যালায় টিঁকতে পারি না, তার উপর তোদের এই যাচ্ছেতাই শর্টফর্ম! সব কটা শালা পি এস পি!’
    --‘পি এস পি!’
    --‘পরম সুবিধাবাদী পার্টি’। এবার তিনি মুখটাকে শালপাতার ঠোঙার মত করে বললেন—‘ এই জন্যই ভাল্লাগে না! হচ্ছিল একটা দরকারী কথা। তার মাঝখানে যত রাজ্যের শর্টহ্যান্ড নিয়ে টপকে পড়ল’।
    --‘পিলিজ কন্তিনিউ...’। শাঁকালুদা আধো আধো উচ্চারণে আলোচনা জারি রাখতে বললেন।
    --‘লক্ষ্য করে দ্যাখ্‌’। সুব্রতদা বলতে শুরু করেছেন—‘এখনও পর্যন্ত যে ক’টা কেস ঘটেছে, যেখানে যেখানে ঘটেছে—সবক’টাই রাবণ আর বিশে, দুজনেরই বাড়ির কাছাকাছি। মায়ার বাথরুম, শান্তিবৌদির বেডরুম, মজুমদার বাড়ির ছেলের বেডরুম- প্রত্যেকটা স্পট রাস্তার উপর। উঁকি মারতে কোনও অসুবিধে নেই। মজুমদার বাড়ির ছেলের বৌভাতে দুজনই নেমন্তন্ন খেতে এসেছিল। আর যতদূর আমার মনে পড়ে, দুজনেই বেশি রাতের দিকে এসে হাজির হয়েছিল’।
    --‘সে কি! তুমি জানলে কি করে!’
    --‘ক্যাটারিঙের দায়িত্ব তো আমাদের উপরই ছিল’। তিনি বলেন—‘বিশে এসেছিল রাত এগারোটা চল্লিশে, আর রাবন পৌনে বারোটায়। আমরা তখন খাবার দাবার, বাসন-পত্র সব গুছোচ্ছি। এমন সময় দুই মূর্তিমান এসে হাজির। রাবণ পুরো বেহেড মাতাল। বিশেটাও বড়ি খেয়ে টলছিল। খাবার খাবে কি, পুরো লাট খাচ্ছে! তবু নিমন্ত্রিত বলে কথা। ঘুগনিটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ডিমের ডেভিলটাও। তবু পোলাও-মাংস কিছু বাড়তি ছিল এই রক্ষে! মোদ্দা কথা, ওরা নেমন্তন্ন খেয়েছিল। আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার...’।
    সুব্রতদার কন্ঠস্বর এমন নাটুকে হয়ে গেল, যেন এখনই ভূতের গপ্পো বলতে শুরু করবেন!
    --‘ওরা দুজনে নেমন্তন্ন খেয়ে তখনই চলে যায় নি। অনেক রাত্তির অবধি দুটো ওখানেই ঘুরছিল। এমনকি চিৎকার চেঁচামেচির আগেও রাবণ আর বিশেকে ঐ জানলার সামনে ঘুরঘুর করতে দেখেছি। কিন্তু ঘটনার পর বেবাক হাওয়া! মানে, কখন যে পাতলা হয়ে গেছে টেরই পাইনি। তোরা যা বলিস্‌, আমার সন্দেহ হয়, ঐ দুটোর একটারই কীর্তি এসব!’
    নিজের বক্তব্য পেশ করে সুব্রতদা চুপ করে গেলেন। পিকুল অনেকক্ষণ ধরে উশখুশাচ্ছিল। এবার বলল—‘কিন্তু ওরা পাতলা হল কি করে? আর প্রত্যেকক্ষেত্রেই শুধু দুটো চোখ দেখা গেছে। মুখ কেন দেখা যায়নি? শুধু তাই নয়, চোখদুটোও অস্বাভাবিক! যারা দেখেছে, তাদের প্রত্যেকেরই প্রায় এক কথা। ভয়ঙ্কর চোখ!’
    --‘ওসব গপ্পো ছাড়’। সুব্রতদার চটপটে উত্তর—‘স্রেফ গাঁজা আর গুল! আমি তোর বাথরুমে গিয়ে হঠাৎ উঁকি মারলে তোরও পিলে চমকে যাবে, আর তুই ও বলবি—‘ভয়ঙ্কর চোখ’!’
    পিকুলের মনে হল সুব্রতদা স্রেফ অন্ধকারে ঢিল মারছে! কিন্তু মুশকিল হল ওর বাতেলা হজম করতেই হবে। মাঝেমধ্যে মালটা এমন রোয়াব দেখায় যে, মনে হয় ও নবগ্রামে জন্মেই ভুল করেছে। ইনফ্যাক্ট ভারতবর্ষে জন্মেই বিশাল ক্যাঁচাল করে ফেলেছে। আমেরিকায় জন্মালে এতদিনে প্রেসিডেন্টের অ্যাডভাইসর হয়ে যেত। ওবামার পাশাপাশি ‘ও মামা’... ‘ও মামা’ করে ঘুরত। আরও কি করত কে জানে!
    যাই হোকু! এখন কি করণীয়?
    সবাই মিলে ঠিক করা হল— চাঁদা তুলে এ তল্লাটে নাইটগার্ড রাখা হবে। গোটাকয়েক ‘সাব জি’ পঁ পঁ করে হুইস্‌ল্‌ বাজিয়ে ডান্ডা হাতে ঘোরাফেরা করলে বিশে কিম্বা রাবণের উঁকিঝুঁকি বন্ধ হবে।
    এ তো রাতের বেলার ব্যবস্থা হল। দিনের বেলায়?
    --‘হামরা আছিঃ কি কত্থেঃ!’ হুলোদা ফের খালি গ্যাসের পাইপের মত ফসফসাচ্ছেন—‘ঝান্‌ দিয়ে দেভঃ। রখ্‌থ ঘাম এখ খরে দেভঃ। হামরাই ফাহারা দেভঃ। ছোখে ছোখে রাখভোঃ! থবু মা-ভোনদের ইজ্জথ...’।
    ভোঃ মাভৈঃ ভৌঃভৌঃ! বিদেশি সংস্কৃত ফের শুরু হয়ে গেছে দেখে সুব্রতদা বললেন—‘ দিনের বেলায় আমাদেরই একটু অ্যালার্ট থাকতে হবে। বাড়িতে, আশেপাশে নজরদারি করলেই যথেষ্ট’।

    সমস্ত আলোচনা মাথায় করে বাড়ি ফিরল পিকুল। মাথায় গোটা আলোচনাটা বড় বেশি ফড়ফড়াচ্ছিল। তার উপর বাড়িতে দাদু আর ঠাকুর্দার ভয়াবহ ডিসকাশন! সে তো ডিসকাশন নয়, শব্দব্রহ্মের গুষ্টির পিন্ডি!
    ব্যাপারটা আর কিছুই নয়! পিকুলের দাদুর বয়েস সাতাশি পেরিয়েছে, আর ঠাকুর্দা নব্বই ছুঁইছুঁই! রোজ সকালে বিকেলে রাত্তিরে দুজনে পাশাপাশি বসে ঠেক মারেন। সে গজল্লার কথাবার্তা অনেকটা এইরকম—
    দাদু বলবেন—‘বেয়াই, নস্যে তেমন ঝাঁজ আর নাই’।
    ঠাকুর্দা বলবেন—‘আমাদের জমিতে শস্য আর হল কই! সব পঙ্গপালে খেয়েছে!’
    --‘হ! রঙ্গলালের দোকানের নস্যটায় ঝাঁজ ছিল বটে। তয় এখুন আর পাওয়া যায় না। সে নস্য লইয়া বড় হইলাম। এহন ঐহানে জোতার দোকান হৈছে!’
    দাদু জুতোকে ‘জোতা’ বলেন। প্রচুর খাবারদাবার রান্না হলে বলেন—‘আইজ দেহি খাওনের অ্যাক্কেরে জোতাবিষ্টি’।
    খাওয়ার সাথে জুতোবৃষ্টির কি সম্পর্ক তা পিকুল জানে না। ছোটবেলায় দু-একবার বদমায়েশির জন্য জুতোপেটা খেয়েছে বটে। কিন্তু বেসিক্যালি জুতো খেতে একটুও ভালো লাগে না।
    দাদুর ‘জোতা’কে ঠাকুর্দা ঠিক ‘তোতা’ শুনবেন। এবং প্রতিবাদ করবেন—‘না না...তোতা ফসল তেমন খায় না। তবে লঙ্কাগাছ হলে তখন অল্পবিস্তর খায়। বেশিরভাগটাই কাকে খায়’।
    ‘কাক’টাকে দাদু একেবারে জন্টি রোডসের মত ডাইভ মেরে ‘বাঘ’ হিসাবে ক্যাচ কট কট করেছেন। গম্ভীর মুখে বলবেন—‘যা কইছেন। বাঘছাপ নস্যই হইল নস্যের রাজা!’
    অর্থাৎ বেশিরভাগ সময়ই সিনটা এইরকম। একজন নস্য নিয়ে কথা বলবেন, একজন শষ্য নিয়ে। একজন দাড়ি কাটা নিয়ে কথা বলবেন তো অন্যজন রোদে চাঁদিফাটা নিয়ে আলোচনা করবেন। একজনের বিষয় সাইকেল, তো অন্যজনের মাইকেল মধুসূদন! আর অদ্ভুত ব্যাপার, দুজন দিব্যি পাশাপাশি বসে খোশমেজাজে কথা বলে যান দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় নিয়ে। কেউ কাউকে ইন্টারাপ্ট করেন না!
    পিকুলের ভালো নামও দুজন দুরকম জানেন। পিকুলের ভালো নাম আভোগ। বাবা আদর করে রেখেছিলেন। ঠাকুর্দা ও দাদু যখন নাতির নাম জানতে চেয়েছিলেন, তখন বাবা জানালেন, নাতির নাম—‘আভোগ’!
    দাদু বললেন—‘ ‘অবোধ’! খাসা নাম হৈছে!’
    ঠাকুর্দা ভ্রুকুটি করে বললেন—‘এটা কি নাম রেখেছিস! ছেলের নাম ‘আপদ’!’
    আপদই বটে! অবশেষে অনেক চেষ্টার পর তিনি বুঝলেন যে নাতির নাম ‘আবেশ’। ফলস্বরূপ আভোগকে একজন ‘অবোধ’ নামে চিনলেন, অন্যজন—‘আবেশ’ হিসাবে।
    কারণ? আর কি! দুজনেই বদ্ধ কালা! দুজনের একজনও কানে শুনতে পান না। পিকুলের মনে হয়, দুজনের একজনকে মুখ্যমন্ত্রী, এবং অন্যজনকে বিরোধী নেতা হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিলে চমৎকার হত। দুজনেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে যা খুশি বলে যেতেন। কেউ কারুর ভাষণ শুনতে পেতেন না। নো ঝগড়া-চেল্লামেল্লি-চাপানউতোর। দেশে শান্তি বজায় থাকত।
    আজ দুজনেই সিরিয়াস আলোচনা করছেন। দাদু আলোচনা করছেন সংবাদে সাহিত্য নিয়ে। আর ঠাকুর্দা সংসারে দায়িত্ব নিয়ে! দুজনেই দুজনের মুখভঙ্গী দেখে পরম আনন্দ লাভ করছেন। হাসি হাসি মুখে গল্প করে যাচ্ছেন। আহা কি ঠেক! এমন ঠেক এ দেশে বেঁচে থাক্‌!
    পিকুল বাড়িতে ঢোকার আগে সুব্রতদার কথামতো চতুর্দিকটা একবার দেখে নিল। বলা যায় না। মালটার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। হয়তো বিশে বা রাবণ অন্ধকারে ঘাপ্টি মেরে কোথাও বসে আছে। তাদের বাড়ির উল্টোদিকেই রাণাজীকাকুদের বাড়ি। আর ডানদিকে পিয়ালীদিরা থাকে। দুই বাড়িতেই অল্পবয়সী সোমত্ত মেয়ে আছে। দেখতে হলে হাইটেক মালই দেখা উচিৎ। এক্সপায়ারি ডেট ওভার হয়ে গেছে, এমন মডেল দেখে লাভ কি! অতএব বিশু বা রাবণের টার্গেট ঐ দুটো বাড়িই হতে পারে।
    পিকুল বাইরে দাঁড়িয়ে টিকটিকিগিরি করতেই ব্যস্ত। এমন শখের কাজ সে আগে কখনও পায়নি। ভাবতেই নাক শুলশুল করে উঠল। কানের ভিতরে ‘ট্যাং ট্যারাং’ করে জেমস্‌ বন্ডের মিউজিক বাজছে। ভাবছিল, বাবার কালো রঙের ব্লেজারটাকে আপন করে নিলে কেমন হয়। সাদা টুপিটাকে একটু জুতোর কালির পালিশ লাগালেই কালো হয়ে যাবে। আর কালো ট্রাউজার তো বাবার আছেই। সেটাকেও বেমালুম মায়া করে দিতে হবে।
    আরও অনেককিছুই ভাবতে যাচ্ছিল সে। তার আগেই ঠাকুর্দার ডাক শুনতে পেল—‘ রাতের বেলায় ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?’
    পিকুল মাথা চুলকিয়ে উত্তর দিল—‘এই, একটু নজর রাখছি’।
    কি কুক্ষণে যে উত্তরটা দিয়েছিল! এক বুড়ো বলল—‘কি? গজল গাইছিস? তা একা একা গাইছিস কেন? এখানে এসে গা, আমরাও শুনি’।
    আরেকজন বক্তব্য রাখল—‘ হজম করতাছস্‌! কি হজম করতাছস্‌?’
    পিকুল ক্ষেপে গিয়ে উত্তর দেয়—‘হাওয়া!’
    --‘দাওয়ায় দাঁড়িয়ে গাইবি? তা বেশ তো। গা না। বারণ করেছে কে?’
    --‘খাওয়া হজম করতাছিস্‌? কর্‌। চ্যাতস্‌ ক্যান্‌?’
    আর গজল! পিকুলের ইচ্ছে করছিল গজল নয়, গজাল নিয়ে এসে দুই বুড়োর কান সাফ করে! ভুল হয়েছে। বিধানসভায় নয়, এই দুই পাব্লিককে রাষ্ট্রদূত করে পাকিস্তানে পাঠানো উচিৎ! কাশ্মীর সমস্যা দুদিনে মিটে যাবে। উপরওয়ালা ভগা এই ভদ্রলোকদের কানহানি করে নিরীহ লোকদের প্রাণহানির বন্দোবস্ত প্রায় করেই দিয়েছেন!
    আপনমনেই গরগর করতে করতে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। এখন তার চাপের অন্ত নেই। কলেজের সেমিস্টার প্রায় চোখ পাকিয়ে ‘মারিকিরি পকাই দিব’ বলে তেড়ে আসছে। তার উপর সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে করতে প্রাণ গেল। অ্যাসাইনমেন্টের ভিড়ে জান কয়লা! এর চেয়ে আদিম মানব হয়ে যেতে পারলে ভালো হত। পড়াশোনার বালাই নেই। জামাকাপড়-আন্ডারওয়ার কাচাকুচি করার কোন চাপ নেই। বিন্দাস পাতা-টাতা পরে বসে থাকো। নিতান্তই গরু,ছাগল তেড়ে না আসলে পোশাক সলামত থাকবে। টারজান ঐ পাতার পোষাক পরে বলেই না লোকটাকে হ্যাবক সেক্সি লাগে! তার জায়গায় স্যান্ডোগেঞ্জি আর চাড্ডি পরলেও সে সেক্স অ্যাপিল আসে না!
    পিকুল অনেকবার গুহামানব হতে চেয়েছে। কিন্তু প্রবলেম একটাই। গুহায় হাগু করাটা বেশ চাপের। সেখানে কমোড নেই। জলের কল বা টয়লেট পেপার নেই। পাতা-টাতা দিয়ে মোছা যায় বটে, কিন্তু যদি কপালদোষে পাতাটা বিছুটির হয় তাহলে একেবারে ছড়িয়ে ছিয়াশি! এছাড়া গুহামানবেরা ডিওডোর্যাবন্টও মাখে না। গুহামানব আর পিকুলের মধ্যে স্নান না করাটা কমন ব্যাপার। কিন্তু পিকুল ডিওডোর্যা ন্ট লাগায়। নয়তো নিজেই নিজের গায়ের গন্ধে টিঁকতে পারে না। একেবারে যাকে বলে ভোমরাখাসির গন্ধ!
    সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে দোতলায় উঠতেই বাথরুমে ছপছপাত শব্দ শুনতে পেল সে। নির্ঘাৎ মা স্নান করছেন। এই এক মহিলা! শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—ভীম সাবানই ভরসা! অন্য সাবান তিনদিনও টিঁকবে না! কারণ মা দিনে তিন থেকে চারবার স্নান করেন। এবং বাথরুমে ঢুকে গণসঙ্গীত গাইতে গাইতে তালে তালে সাবান মাখেন। গণসঙ্গীতের বিটের সাথে সাথে সাবান ঘষা খায়। ফলস্বরূপ স্যান্টাক্লজের দাড়ির মত সাবানের ফেনা ছড়িয়ে টড়িয়ে একসা। ‘এই উজ্জ্বল দিন, ডাকে স্বপ্ন রঙিন...’ ঢিক্‌ চিক্‌ ঢিক্‌ চিক্‌ ঢিক্‌ চিক্‌। তার সাথে সাবান ঘষা খেয়ে আমসি হচ্ছে। বাবা অনেকবার বলেছেন—‘বাথরুমে ঢুকলেই তোমার গণসঙ্গীত মনে পড়ে কেন? রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারো না? বেশ স্লো, ঢিমে তালের টপ্পাঙ্গের গানও তো গাইতে পারো। এ-ই ক-রে-ছ ভা-লো নিঠুর হে-এ-এ-এ! আহা, কবিগুরুর গানে সাবানের ফুল সাশ্রয়!’
    কিন্তু গায়ে জল পড়লেই বোধহয় মায়ের ভিতরের প্রতিবাদী স্বত্বা হাঁই-মাঁই করতে করতে জেগে ওঠে। অগত্যা সাবান বেচারির হাল খাস্তা হয়ে যায়।
    আজও যথারীতি গণসঙ্গীত চলছে। মা চিৎকার করে গান গাইছেন—‘ওরা আমাদে-এ-র গান গাইতে দেয় না-আ-আ-আ! নিগ্রো ভাই আমার পল র-ব-স-ন...’
    কে তাকে গান গাইতে দেয় না কে জানে! আর এই পল রবসনটাই বা কে! মা ফেসবুকে কোনও বিদেশি বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছেন না কি! বলা যায় না। যা দিনকাল পড়েছে!
    ভাবতে ভাবতেই নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল পিকুল। কিন্তু যাওয়া হল না!
    এতক্ষণ মায়ের গান নির্বিঘ্নেই চলছিল। হঠাৎ থেমে গেল! পরক্ষণেই বিকট চিৎকার!
    এ আবার কি! গানের অন্তরা না কি! এমন প্রবল চাপের অন্তরা কস্মিনকালেও শোনেনি পিকুল। কিন্তু মা আজকাল ফেসবুকে বিদেশি বয়ফ্রেন্ডের সাথে চ্যাটাচ্ছেন। হতে পারে বিদেশী গানে এরকম চেল্লামেল্লিওয়ালা অন্তরা থাকে! যত ইউরোপীয় সঙ্গীত শুনেছে সে বেশির ভাগই ‘হা-হা-আ-আ-আ-আ’ অথবা ‘হু-উ-উ-উ-উ...’ করে নানান স্কেলে চিৎকার চেঁচামেচি! এই যদি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের নমুনা হয়, তবে রোজ বিকেলে যে ব্যাটা মিহিদানা বিক্রি করতে আসে, সেও পাশ্চাত্য সঙ্গীত গায়। লোকটার ব্যাডলাকই খারাপ! আজ যদি ও ব্রিটেনে মিহিদানা বিক্রি করত তবে এতদিনে সঙ্গীত-সম্রাট হয়ে যেত!
    এসব ভেবেই প্রথমে চিৎকারটাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি সে। কিন্তু তারপরই মায়ের আকুল আর্তি ভেসে এল—‘পি-কু-ল, পি-কু-উ-উ-ল!’
    নাঃ, এটা গান নয়। কিছু লোচা আছে!
    --‘কি ব্যাপার?’ সে বাইরে থেকে উত্তর দেয়—‘আরশোলা না টিকটিকি?’
    --‘কে যেন বাথরুমের জানলার কাছে......’
    কথাটা সবে মায়ের মুখ থেকে খসেছে। কিন্তু পুরোপুরি খসার আগেই পিকুল লাফ মেরে ছুটেছে ছাতের দিকে। শা-লা অসভ্য চোখ! এক ছেলের মায়ের বাথরুমেও ফিল্ডিং দিচ্ছে বাঞ্চোত! তাও পিকুলের বাড়িতে! দাঁড়া, একবার ছাতে উঠে নিই, তাপ্পর তোর একদিন কি আমার একদিন! কিলিয়ে কাঁঠাল না পাকিয়েছি...!
    প্রায় বিদ্যুৎগতিতে ছাতে উঠে গেল সে। মালটা পাতলা হওয়ার আগেই ক্যাঁক করে চেপে ধরতে হবে! সে রাবণই হোক্‌, কি বিশে! ঘুঁষি মেরে অন্তত দশটা উইকেট না উপড়েছে...!
    মায়ের বাথরুমটা দোতলায়। কাউকে জানলায় উঁকি মারতে হলে নিদেনপক্ষে বাথরুমের জানলার নীচের কার্ণিশে উঠতে হবে। সে যেই হোক্‌, সহজে ভোগা দিতে পারবে না। পিকুল ছাতে উঠে নীচের দিকে ঝুঁকে তাকায়। হ্যাঁ—যা ভেবেছে একেবারে মলিকিউলে মলিকিউলে ঠিক। হারামজাদা নীচের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে! কিন্তু উঠল কি করে! জলের পাইপ বেয়ে!
    সে কথা নেই বার্তা নেই, লোকটার মাথার চুল সবলে খামচে ধরে—‘আ-বে শালা! মাজাকি পেয়েছিস-অ্যাঁ? তোর বাপের নাম যদি খগেন না বানিয়েছি বাঞ্চোত! লাইভ পানু দেখা হচ্ছে...শুয়োরের বাচ্চা!’
    নীচের লোকটা কাঁউমাউ করে উঠেছে—‘মাথার চুল ছাড়্‌ পিকুল...লাগছে...!’
    --‘লাগছে? এখনও লাগেনি’। তার ক্রিকেট ব্যাটটা হাতের কাছেই পড়েছিল। সেটা দিয়ে দুমাদ্দুম কয়েক ঘা কষিয়ে দিয়ে বলল—‘তবে এইবার লাগবে। ডাব্‌ল্‌ ওয়াট! মাগীবাজ শালা!’
    --‘আঃ...আঃ...!’ লোকটা কাৎরে ওঠে—‘নাক ফেটে গেল’।
    --‘তোর বিচি ফাটিয়ে ছাড়বো...ওঠ শালা...উঠে আয়!’
    কার্নিশের উপরের লোকটা মার খেয়ে আঁক আঁক করছে। প্রবল ঠ্যাঙানির মধ্যেই সে কোনমতে হাঁকপাঁক করতে করতে ছাতে উঠে এল। পিকুল ব্যাটটাকে গদার মত করে বাগিয়ে ধরে। মালটার জিওগ্রাফি পালটে না দিয়েছে আজকে...! রাবণ হোক্‌ কি বিশে! কাউকে ছাড়বে না!
    এতক্ষণ লোকটাকে ঠিকমত দেখা যাচ্ছিল না। কার্নিশটা অন্ধকার ছিল। ছাতে একটা বড় আলো লাগিয়েছেন বাবা। এবার তার আলোয় দেখা যাবে কোন্‌ শালা ‘মুহ্‌ কালা’ করছে!
    কিন্তু লোকটাকে দেখা যেতেই নিজের বিচি মাথায় উঠে গেল পিকুলের! এ কে! এ তো কোনও শালা নয়! এ তো বাবা!
    বাবা কোনমতে কাতরাতে কাতরাতে বলেন—‘এসব কি হচ্ছে পিকুল। কথা নেই বার্তা নেই, ব্যাটপেটা করছিস্‌! আঃ, নাকটা গেল আমার...!’
    --‘কিন্তু...কিন্তু...!’ পিকুল ততক্ষণে ফুলটু হাকলা—‘তু...তুমি ওখানে কি করছিলে?’
    বাবা কুঁইকুঁই করতে করতে বললেন—‘কি আবার করবো! আমার একটা পায়রা কার্নিশে ঘাপ্টি মেরে বসেছিল। শত ডাকাডাকিতেও আসছে না। বাজপাখি অ্যাটাক করেছিল। ডানাটা জখম হয়েছে। তাই আমি নিজেই নেমে ধরে আনতে গিয়েছিলাম। তার মধ্যেই তোর ব্যাটের ঘা...!’ বলতে বলতেই থেমে গেছেন। নাকের ব্যথা ভুলে গিয়ে কড়া গলায় বললেন—‘আর ওসব কি ভাষায় কথা হচ্ছিল? অ্যাঁ...এসব নোংরা ভাষা কোথা থেকে শিখেছিস?...কোনও ভদ্রঘরের ছেলেপুলে এই ভাষায় কথা বলে...!’
    --‘না...মানে...ইয়ে...তোমাকে বলিনি...আসলে কি একটা যেন পড়ছিলুম...’। পিকুল কান চুলকুতে চুলকুতে সুড়ুৎ করে কেটে পড়ল। এখন বাবার সামনে থেকে পাতলা হয়ে পড়া বিশেষ প্রয়োজন! একেই বাবার পোষা পায়রা ইনজিওর্ড! দিন রাত ছাতে উঠে এইসব পায়রাদের ‘আয়...আয়...’ করে গলা ফাটিয়ে ডাকেন তিনি। একটা জখম হয়ে পড়লেই গুঁফো ‘লেডি উইদ দ্য ল্যাম্প’ হয়ে যান। সেই পায়রার দুঃখে নিশ্চয়ই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। তার উপর পেল্লায় ব্যাট দিয়ে তাকে ঠেঙিয়েছে পিকুল! উল্লাট খিস্তিও দিয়েছে! বাবা কি রিভেঞ্জ না নিয়ে ছাড়বেন!

    ৬.
    রাতের বেলায় নগ্ন হয়ে বিছানায় শুয়েছিল ইপ্সিতা। এ সি চলছে ঠিকই। তবু যেন গরম কমে না!
    সুইটজারল্যান্ডের ঠান্ডাটাই এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে আজন্ম পরিচিত পরিবেশটাকেও অচেনা লাগছে। আগে রাত্রে হাউসকোট বা নাইটি পরে শুতে যেত। এখন যেন তাও গায়ে চড়ানো যাচ্ছে না! সুইটজারল্যান্ডের ঠান্ডা থেকে আচমকা এই গরমে এসে পড়লে প্রাণ হাঁসফাঁস করতে থাকে! মনে হয়, গায়ের চামড়াটাও খুলে রাখতে পারলে ভালো হয়।
    অবনী আজ এ বাড়িতে আসবে না। সে এখন ক’টা দিন যাদবপুরে থাকবে। এমনিতেই দুদিন এখানে থেকেছে বলে শাশুড়ির মুখ তোলো হাঁড়ি। আরও কিছুদিন হলে বুড়ি ফেটে চৌচির হয়ে যেত। ইপ্সিতার বেশ মজাই লাগে। দ্যাখ্‌ কেমন লাগে! দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মত ফুলবি! ইশারা করে করে ঝগড়া করা! এবার কর্‌, কার সাথে ঝগড়া করবি!
    ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল ইপ্সিতার। ঝগড়া তো তারও আজকাল করা হয় না। অবনী যেন একেবারে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে—যে ঝগড়া করবেই না! মালটা কিছুতেই বোঝে না, ঝগড়া করাটা ইপ্সিতার হবি! ইপ্সিতা যা বলুক, অবনী সঙ্গে সঙ্গে তার সাথে একমত হয়ে যাবে। যদি বলে—‘সোনা, দেখো, সূর্যটা কি সুন্দর উত্তর দিক দিয়ে উঠছে’।
    অবনী সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে বলবে—‘তাই তো ডার্লিং! আমি তো একদমই লক্ষ্য করিনি!’
    ইপ্সিতা নাক কুঁচকে বলবে—‘তোমার মাথায় গোবর পোড়া! সূর্য কি কখনও উত্তর দিক থেকে ওঠে?’
    অবনীর চটজলদি জবাব—‘তাই তো! সত্যিই আমার মাথায় গোবর পোড়া। ইউ আর অলওয়েজ রাইট সুইটি’।
    এই করেই তাকে ঠান্ডা করে রেখেছে লোকটা। ইপ্সিতা ইজ অলওয়েজ রাইট। রঙ হওয়ার কোনও চান্সই নেই! কারণ রঙ হলেই ঝগড়া হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। এমন লোকের সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়াও করা যায় না! তাই অমন সাধের হবিটাকেই বিসর্জন দিয়েছে সে।
    ইপ্সিতা শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, সে কি আদৌ সুখে আছে! অবনী স্বামী হিসেবে ভালো, কোনও সন্দেহ নেই। টাকাপয়সার কোনও অসুবিধে নেই। তা সত্বেও দামি মদ, দামি সিগ্রেট কবে ধরল সে! শখের মাঝখানে কোথাও অসুখ লুকিয়ে নেই তো! আজ তার এক পুরনো বান্ধবী দেখা করতে এসেছিল। প্রথমেই ইপ্সিতাকে সে চিনতে পারেনি। তারপর প্রায় আকাশ থেকে পড়ে বলল—‘ তুই বাড়িতে গেঞ্জি আর শর্টস্‌ পরে থাকিস! কাকু জানেন?’
    লেঃ হালুয়া! যে লোকটা চোখে দেখতেই পায় না, সে বুঝবে কি করে যে ইপ্সিতা গেঞ্জি পরেছে না লঁজারে! আর শর্টস, গেঞ্জির মধ্যে খারাপ কি আছে! সে তো বিকিনি পরে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছে না! বাড়িতেই পড়ছে। বাবা চোখেই দেখেন না। আর দেখার মধ্যে আছে কুকুরটা। সে দেখলেই বা কি এলো গেলো! আজকাল মেয়েরা গেঞ্জি চাড্ডি পরে ম্যারাথন দৌড়চ্ছে, লেংটি পরে রেসলিং করছে, সুইমিং কস্টিউম পরে সাঁতার কাটছে, তলাকাটা মিনিস্কার্ট পরে টেনিস খেলে ফ্রাস্টু বাড়াচ্ছে—হাজার হাজার লোক দেখছে, সে বেলায় দোষ নেই। যত দোষ সব ইপ্সিতার বেলায়!
    এই যে ভোলা মুদি লোকাট লুজ লুঙ্গি পরে রাস্তায় পেট বের করে দাঁড়িয়ে থাকে, সেটা বুঝি দোষের নয়! আটমাসের পোয়াতির মত ভুঁড়ি গিঁটের উপরে লম্‌লম্‌ করে! নাভির নীচে বিপজ্জনক লুঙ্গির অবস্থান! যে কোনও মুহূর্তে খসে পড়ে কেলোর কীর্তি করতে পারে। কই, তাকে তো কেউ বলতে যায় না—‘কি কান্ড ভোলাদা! মল্লিকা শেরাওয়াতের ঘাগরার মত করে লুঙ্গি পরেছ! ঐটুকুই বা রক্ষা করার দরকার কি! নাগা সন্ন্যাসী হয়ে যাও না!’
    যত ডায়লগ সব ইপ্সিতার স্যান্ডোগেঞ্জি আর শর্টসের বেলায়! চমৎকার একটা ঝগড়ার স্কোপ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু অদ্ভুত কান্ড, কাজে লাগাতে ইচ্ছে করল না তার। বরং শান্ত গলায় বলে—‘বড্ড গরম রে। গায়ে সুতোও রাখতে পারছি না!’
    বান্ধবী কেমন বিটকেলে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তার দিকে। ফিস্‌ফিস্‌ করে বলেছিল—‘তুই মদ-সিগ্রেট খাস্‌ সেটা কাকু জানেন?’
    বোঝো! সবই কাকুকে জানাতে হবে! এখন বিয়ে হয়ে গেছে তার। তবু রক্ষে নেই। যতসব টিপিক্যাল মিড্‌ল্‌ক্লাস সেন্টিমেন্ট।
    আশ্চর্য! পরমাশ্চর্য! এবারও স্কোপ পেয়ে কাজিয়া করল না ইপ্সিতা। উলটে বোর হয়ে গিয়ে একটা আকাশপাতাল হাই তুলে বলল—‘আমি রোজ রাতে তোর অবনীদার পাশে ন্যাংটো হয়ে শুই। সেটাও কি কাকুকে জানাতে হবে? কি বলিস্‌?’
    বান্ধবী কি উত্তর দেবে ভেবে পায়নি। ঢোঁক গিলে বলল—‘তুই ভালো আছিস তো ইপ্সিতা?’
    এই প্রশ্নটা শুনলেই আজকাল মাথা গরম হয়ে যায় ইপ্সিতার। যত রাজ্যের ভ্যান্‌তারা! নেকু নেকু খানকি মাগী সব! ‘ভালো আছিস তো?’ আমি ভালো থাকলে তোর কি বে? আমি ভালো থাকলে কি তোকে নোবেল দেবে? আর যদি না থাকি তাতেই বা কি? তুই কি আমাকে ভালো থাকাবি! নেহাৎ ইপ্সিতার ঝাঁট নেই—নয়তো জ্বলে যেত! ড্যাম্‌ ইয়োর ভালো থাকা!
    কিন্তু ওসব বলতে পারল না ইপ্সিতা। বরং কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরও গোটা কয়েক হাই তুলে বলল—‘তুই আরও কিছু বলবি?’
    ইঙ্গিত স্পষ্ট। এবার তুমি ফোটো। বান্ধবী বুদ্ধিমতী। কেটে পড়ল।
    রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেসব কথাই ভাবছিল ইপ্সিতা। আজকাল ঘুমের ওষুধ না খেলে তার ঘুম হয় না। আগে একটা করে ট্যাবলেট খেত। এখন দুটো করে খেতে হয়। অথচ একটা ছোট্ট, নরম সরম, চুন্নুমুন্নু ছানা গোটা সিনটাই পালটে দিতে পারত! তার নিজের ছানা! মা হতে চায় সে। কিন্তু সে সম্ভাবনা দূর অস্ত! অবনীর ক্ষমতা নেই!
    চোখ বুঁজে ঘুমের প্রতীক্ষা করছিল সে। এমন সময়ই হঠাৎ একটা নরম কোমল রোমশ বস্তু তার পা বেয়ে উপরে উঠে এল! তারপরই একটা কুঁই কুঁই শব্দ। একটা ভেজা নাক তার গালে এসে পড়ল।
    --‘কে রে!’ ইপ্সিতা চোখ মেলে দেখে একটা পরিচিত মুখ জুলজুল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
    --‘ঘোঁতন! এতরাতে চড়ে বেড়াচ্ছিস যে!’ সে ঘোঁতনকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিল। ঘোঁতন তার নরম বুকের উপরে মাথা গড়িয়ে দিয়ে আরামসে চোখ বুঁজল!
    বুকের উপর একটা তুলোর বলের মত নরম তুলতুলে জিনিস! বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ইপ্সিতার। এমন একটা তুলতুলে জিনিসের আকাঙ্খাই তো ছিল তার। একটা ছোট্ট, ক্রিট্‌কি, কুঁচি কুঁচি পু—পুঁচকি পুতুল! লাল লাল ঠোঁট, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, দুদু খাওয়ার সময় বিসমিল্লা খাঁয়ের সানাইয়ের মত প্যাঁ সুর ধরত। আবার দুদুন খাওয়া হয়ে গেলেই নাক মুখ কুঁচকে একটা পুঁচকুরি হাই তুলে, গালে হাম খেত। অর্থাৎ পুঁটুলিটা এবার ঘুম যাবে! তখন শুরু হত দুর্বোধ্য গপ্প বলা—‘তারপরে তো কট্র শিশি সিঁটকি করেছে—তারপরে কি হয়েছে...! তারপরেতে নেংটি পিশি গক্ক করেছে—তারপরে কি হয়েছে...?’ মায়ের মুখের দুর্বোধ্য বিটকেল গপ্প শুনে সে কখনও চোখ গোল গোল করত। কখনও ফোঁকলা মাড়ি বের করে একচোট হেসে নিত। তারপর ছোট্ট ছোট্ট আঙুলে মায়ের চুলের গোছা জড়িয়ে ধরে ঘুম যেত।
    নাঃ—সে সুখ বোধহয় এ জীবনে কপালে নেই। জড়িয়ে ধরে ঘোঁতনের শরীরের উষ্ণতা নিতে নিতে হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল তার। একটা ছোট্ট মানুষের জন্য লোভ বড় মারাত্মক! এ ইচ্ছের কোনও শেষ নেই। একগাদা টাকা, মদ, সিগ্রেট, ঘুমের ওষুধও এই ইচ্ছের মুখে লাগাম পরাতে পারে না।
    এখন মনে হয়, অবনীকে বিয়ে না করে যদি ঐ ছেঁড়া জুতো পরা, ভ্যাবলাকান্ত বিশেটাকেই বিয়ে করত তাহলে হয়তো এমন দিন দেখতে হত না। বিশেটাকে ডিচ করে কি অন্যায় করেছিল সে? সহজ সরল ছেলেটাকে তো সে-ই নষ্ট করেছিল! কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। ভেবেছিল, ঐ পাগলাচোদাকে কে বিয়ে করবে! তার স্বপ্নের রাজকুমার থোড়াই অমন ল্যাদা-বোদা! সে আসবে ঝকঝকে গাড়িতে চড়ে। চকচকে চেহারা, তকতকে আচার-ব্যবহার! বিশু কে? সে তো স্রেফ একটা হাতের পুতুল! ছোট্ট একটা শখ মেটানোর জিনিস। পাব্লিক মাস্টারবেট করে। আর ইপ্সিতা তার যৌবনের গরম মেটানোর জন্য স্রেফ একটা পুরুষকে ব্যবহার করেছে। ব্যস্‌, এই পর্যন্তই!
    বিশুটা বড্ড সরল ছিল। গেমটাকেই প্রেম ঠাউরে বসল। ‘ইপ্সিতাদি...ইপ্সিতাদি...’ করতে করতে ন্যাকাচোদার মত চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াত। ভালোই লাগত ইপ্সিতার। বিশুকে নয়। বিশুর এই সদাব্যস্ত চাকর চাকর ভাব! তার মনোযোগ! বিশুর উপর উৎপাত করতে ভালো লাগত তার। যখন অনার্সের পরীক্ষা সামনে, তখন বিশু ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইপ্সিতার ইগোয় হেবি লেগেছিল! এমন ডব্‌কা মেয়েকে ছেড়ে কতগুলো নীরস বইয়ের পাতার মধ্যে নাক গুঁজেছে হতভাগা! চলো—দেখিয়ে দিচ্ছি, আমিও মেনকা, উর্বশীর জাত!
    দেখল বিশু! দেখিয়েই ছেড়েছিল ইপ্সিতা! ফলস্বরূপ পরীক্ষা মায়ের ভোগে! তার সাথে সাথে বিশুর ফুটুর ডুম!
    এখন মনে বড় পাপবোধ কাজ করে। বিশুকে না খেলালেই কি ভালো হত! ইপ্সিতার একটা ছোট্ট খেলার জন্যই ওর সর্বনাশ হয়ে গেল। বিশু তার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল বলেই সে আজকে ক্লার্ক! আর অবনী তাকে পাত্তা দেয় না বলেই অতবড় কোম্পানীর সি ই ও হয়ে বসেছে!
    ভাবতে ভাবতেই উঠে বসেছে সে। প্রেম কাকে বলে! প্রেম মানে কি অনেক টাকার রোয়াব! প্রেম মানে কি মোটা পার্স! প্রেম মানে কি একটা মেয়ের আনুগত্য স্বীকার করে পোষা কুত্তা হওয়া! প্রেমের চোটে নিজের জীবন বরবাদ করা! শরীরে শরীরে মাখামাখি, লদ্‌কালদ্‌কি কি প্রেম? তাই যদি হয় তবে কে ভালোবাসে তাকে? কে ভালোবেসেছিল? অবনী? না বিশু?
    মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তার। পরক্ষণেই ভাবল—ধুস শালা, প্রেমের ছেঁড়া গেছে! এই বেশ ভালো আছি! পাপবোধ কিসের? একটা ছেলেকে নিয়ে একটু ইন্টু-পিন্টু করেছিলাম। সে মালটা বুঝল না কেন? আমাকে এড়িয়ে কেরিয়ারে মন দিল না কেন? আমি তো ওর জন্য মরতে যাইনি। বরং নিজের আখের দিব্যি গুছিয়েছি। মালদার বর বাগিয়েছি। তবে? ওরে মাকড়া, পকেটে রেস্ত না থাকলে কালীঘাটের মালগুলো পর্যন্ত ঘরে ঢুকতে দেয় না, ইপ্সিতা তোকে পাত্তা দেবে! ইপ্সিতা তো দূর, খেঁদি-পেঁচিরাও ভাও দেবে না। তোকে ক্লার্ক হতে কি আমি বলেছিলাম? ফিজিক্সে ব্যাক পেতে আমি বলেছিলাম? তুই গোল্লায় যা, কি জাহান্নমে—তাতে আমার কি বে?
    ভাবতে ভাবতেই অস্থিরভঙ্গিতে পাশ ফিরল সে। আর সঙ্গে সঙ্গেই চোখ পড়ল জানলায়...!
    গরম লাগছিল বলে আজ দোতলার বেডরুমের জানলা খোলা রেখেছিল ইপ্সিতা। জানলার ঠিক সামনেই একটা আমগাছ। হঠাৎ সে দেখতে পেল সেই গাছের উপরেই কে যেন বসে আছে! তাকিয়ে আছে এদিকেই...একটা কালো কালো আবছায়া...!
    আর্তচিৎকার করে উঠল ইপ্সিতা। হাতের কাছেই টর্চটা ছিল। কিছু না ভেবেই আনতাবড়ি টর্চ জ্বেলে ফোকাস ফেলল ছায়ামূর্তিটার উপরে! লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখা গেল না! কিন্তু একজোড়া চোখ...একজোড়া বীভৎস চোখ...সে যে কি ভয়াবহ চোখ তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়! অসভ্যের মত, লোকলজ্জার মাথা খেয়ে তাকিয়ে আছে এদিকেই! দুচোখে লোলুপ বন্যতা! আরও কি যেন একটা অস্বাভাবিকতা ছিল সেই চোখে, যা দেখে তার রক্তহিম হয়ে গেল। মনে হল চোখদুটো মানুষের হতেই পারে না! একজোড়া অমানবীয় চোখ!
    পরিত্রাহি চিৎকারে সারা পাড়াকে জাগিয়ে তুলল সে। চিৎকার শুনে বাবা ঘুম থেকে উঠে—‘কি হল...কি হল...!’ বলতে বলতে উঠে এসেছেন। আচমকা উঠে আসার দরুণ স্টিকটার কথা ভুলে গিয়েছেন। ঘরে ঢুকতে গিয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে কোনমতে সামলে নিয়ে বললেন—‘কি হয়েছে মা? অমন চেঁচাচ্ছিস কেন?’
    ইতিমধ্যেই স্প্রিঙের মত ঘোঁতন ছুটে গেছে গাছটার দিকে। ‘ভৌ ভৌ, ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক’ করতে করতে সে প্রায় জানলা দিয়ে লাফিয়েই পড়তে চাইছে গাছ লক্ষ্য করে! কোনমতে তাকে একহাতে চেপে ধরে সামলাতে সামলাতে বলল ইপ্সিতা—‘বাবা, গাছে...ঐ গাছে... কে যেন জানলায়...’।
    --‘কে গাছে? অ্যাঁ?...’ বলতে বলতেই তিনি এগিয়ে গেছেন জানলার দিকে। ইপ্সিতা ততক্ষণে বেডকভারটা কোনওমতে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে বলল—‘জানলার কাছে যেও না বাবা! কি জানি...কে ওখানে...!’
    ঘোঁতন তখনও ছটফট করে ইপ্সিতার কোল থেকে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। কান দুটো খাড়া করে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। হিংস্র দাঁত বের করে বলল—‘গর্‌র্‌র্‌র্‌র্‌...’।
    ওদিকে চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের লোকজন ছুটে এসেছে। ছুটে এসেছে পাড়ার ছেলেরা। নাইটগার্ডের ব্যবস্থা না হওয়া অবধি তারাই এখন পালা করে পাহারা দিচ্ছে। হাতে মোটা মোটা গদার সাইজের টর্চ আর লাঠি! মধ্যরাত্রে মেয়েলি গলার চিৎকার শুনে বুঝতে অসুবিধে হয়নি কি হয়েছে। উত্তেজিত ইপ্সিতা ততক্ষণে বেডকভার পরেই উপর থেকে নীচে নেমে এসেছে। আমগাছটার দিকে হাত তুলে বলল—‘ঐ...ওখানে...ওখানে কেউ বসে আছে...জানলা দিয়ে উঁকি মারছে!’
    মুহূর্তের মধ্যে গাছটাকে ঘিরে ফেলল ছেলেরা! ছোটু-হাবু-পাঁচুরা একেবারে বনবিড়ালের মত গাছ বাইতে শুরু করেছে। নীচ থেকে সুব্রতদা, শাঁকালুদা, হুলোদারা টর্চের আলো ফেলছেন।
    --‘হাবু...সাবধানে’। সুব্রতদা নীচ থেকে চেঁচিয়ে বললেন—‘নির্ঘাৎ লোকটা ওখানেই আছে। পালাবার চেষ্টা করতে পারে। ডেসপারেট হয়ে যেতে পারে। লাঠিটা শক্ত করে ধরে রাখিস’।
    --‘ওকে সুব্রতদা’। হাবু উপর থেকে জবাব দিল—‘টর্চের আলোটা এইদিকে ফেলো’।
    --‘লোকটাকে ঠিক কোথায় দেখেছিলি ইপ্সিতা?’ সুব্রতদা ইপ্সিতার দিকে তাকালেন—‘এগজ্যাক্ট লোকেশনটা দেখাতে পারবি?’
    ইপ্সিতার তখনও বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করছিল। লোকটার চোখের মধ্যে কি যেন ছিল! সঠিক কি, তা মনে পড়ছে না। কিন্তু অদ্ভুত সে চোখ!
    সে কোনমতে ডালটা নির্দেশ করে—‘ঐ...ওখানে’।
    তার আঙুলের ডিরেকশনে সবকটা টর্চের মুখ ঘুরে গেল। কিন্তু ডালটা বেমালুম ফাঁকা! কেউ নেই! কিচ্ছু নেই!
    --‘হয় চেঁচামেচি শুনে পালিয়ে গেছে, নয়তো লুকিয়েছে’। সুব্রতদা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললেন—‘ভালো করে খোঁজ্‌! একটা ডাল, একটা পাতাও বাদ দিবি না! যাবে কোথায় হারামজাদা! চাপ্পা চাপ্পা ছান মার!’ বলতে বলতেই ফের ফিরলেন ইপ্সিতার দিকে—‘তুই ঠিক দেখেছিস্‌? ওখানে কেউ বসেছিল?’
    --‘একদম। পা ঝুলিয়ে বসেছিল। জানলা দিয়ে ভিতরের দিকে দেখছিল। আর...’। তার কি যেন মনে পড়ে যায়—‘যখন টর্চের আলো ফেলেছিলাম তখন গলায় কি যেন একটা চকচক করে উঠেছিল। চেইন টেইন গোছের’।
    --‘চেইন!’ সুব্রতদা চিন্তিত মুখে বললেন—‘মুখ দেখিসনি?’
    ইপ্সিতা মাথা নাড়ায়। চোখ দেখেই এমন ভির্মি খেয়েছিল যে মুখ দেখার সুযোগই পায়নি।
    অন্যদিকে তখন পুরো গাছটার প্রায় প্যাটাপিত্ত বের করে ফেলেছে ছেলেপুলেরা! তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলেছে। কিন্তু নেই! কেউ নেই! কোত্থাও নেই!
    হাবু বলল—‘দাদা, কেউ নেই এখানে!’
    --‘পালিয়েছে। নেমে আয়’। সুব্রতদার মুখে আফসোসের ভঙ্গি ফুটে ওঠে—‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি গেল কোথায়...?’
    ঘোঁতন এতক্ষণ রীতিমত লাফালাফি করছিল। হারাধন কোনমতে তাকে ধরে রেখেছিলেন। একটু আলগা পেতেই সে সুড়ুত করে নেমে পড়েছে। বিদ্যুতের মত ছুটে চলে গেল পিছনের দিকে! কয়েক সেকেন্ড পরেই শোনা গেল তার ভয়ঙ্কর গর্জন!
    --‘ঘোঁতন কিছু পেয়েছে। যাবে কোথায় বাছাধন! কুইক’। সুব্রতদা প্রাণপণে সেদিকেই দৌড়লেন। তার ল্যাংবোটরাও গেল পিছন পিছন। হারাধন ও ইপ্সিতাও ফলো করল তাদের।
    ঘোঁতন তখনও অবিশ্রান্ত স্বরে ডেকে চলেছে। তার সামনে একটা অন্ধকার ছায়ামূর্তি উপুড় হয়ে পড়েছিল। ঘোঁতনের চিৎকারে মুখ তুলে নেশাজড়ানো গলায় বলল—‘কেন রেকারিং ডেসিমাল বাজাচ্ছিস ব্রাদার? বলেছি তো আফটারশেভ কিনে দেব। একটু শান্তিতেও ঘুমোতে দিবি না!’
    সুব্রতদা টর্চের আলো ফেললেন লোকটার মুখে। চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। বিরক্ত হয়ে বলল—‘যাঃ শালা! তুই তো একদম টর্চ নিয়ে পার্টনার খুঁজতে লেগেছিস দেখছি! কিন্তু টর্চটা ধরেছিস কিসে? তোর তো চারটেই পা! মাস্টারবেট করতে পারিস্‌না তো টর্চ ধরবি কি করে? ন্যাজে পার্মানেন্টলি ফিক্স করেছিস নাকি!’
    ইপ্সিতা এগিয়ে এসে বিস্ময়াহত গলায় বলে—‘বি-শু! তু-ই!’
    --‘তোর গলার আওয়াজের কি হল মামা?’ কুকুরটার দিকে তাকিয়েই বলল বিশু—‘আবে, নাম ধরেই বা ডাকছিস কেন? আমি তোর কোন শালার ব্যাটা...?’
    ইপ্সিতা এবার তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলে—‘বিশু, আমি’।
    বিশু এবার তার দিকে তাকাল। কয়েকমুহূর্ত অপলকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলেছে। কোনমতে হামাগুড়ি দিয়ে ইপ্সিতার কাছে এগিয়ে এল। তার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পরে বলল—‘এই নাও...বুক পেতে শুয়ে পড়েছি! নেচে নেচে হাড়-পাঁজর সব ভেঙে দাও...কিন্তু তোমার চিলেকোঠার কসম্‌, তোমার পচে গলে যাওয়া রোম্যান্সের কসম্‌, তোমায় ম্যাগাস্থিনিসের দিব্যি...বসন পরো...বসন পরো...বসন পরো মা!’

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • ব্লগ | ২১ নভেম্বর ২০১৩ | ২৭৭৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    গরল - Sayantani Putatunda
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শ্রী সদা | 127.194.195.217 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:৩৯45613
  • জমেছে।
  • শঙ্খ | 169.53.174.143 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:৪৯45614
  • এইবারেরটা ভালো লাগল। ইনফ্যাক্ট এটা পড়ে আগেরটা পড়তে সুবিধে হল। তবে ঐ সিকি যা বলল, কমেডির জায়গাগুলো ঠিক জমছে না। চলুক।
  • pipi | 139.74.191.152 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:৫৭45615
  • আমার তো পুরোটাই পড়তে ভাল লাগল। ঝরঝরে লেখা। পড়তে পড়তে কয়েকবার ফিকফিকিয়ে হেসেও ফেললাম। চলুক, চলুক।
  • π | 172.129.44.87 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০৮:১২45616
  • সায়ন্তনী, পরের পর্বগুলো নতুন পোস্ট হিসেবে না দিয়ে এই লেখার সাথেই জুড়ে দিতে পারিস। তাহলে পুরোটা এক জায়গায় থাকবে।

    চলুক !
  • বিষ্ণু পালচৌধুরী | 126.202.198.90 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০৮:৪১45605
  • অসাধারন !
  • puspendu chatterjee | 213.202.242.50 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০৯:৪৭45606
  • টুপি খুলে দিদিভাই কে সম্মান জানালাম এই অসাধারণ লেখাটির জন্য ।।।।।
  • Prabir | 125.115.197.138 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ০৯:৫৮45607
  • আরিব্বাস !! কি ভাল ! এক নিশ্ব্বাসে শেষ হয়ে গেল !
  • b | 135.20.82.164 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ১০:০০45608
  • হেভি হচ্ছে। কিঞ্চিৎ অ্যাডাল্ট শীর্ষেন্দু। ল্যাখেন, গুছিয়ে ল্যাখেন।
  • a x | 86.31.217.192 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ১০:০৬45609
  • লেখার ফ্লো দারুণ লাগছে।
  • সিকি | 132.177.166.58 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ১০:৩৮45610
  • প্রথমটা তেমন জমে নি। খুব চেষ্টাকৃত কমেডি করা বলে মনে হচ্ছিল। এই দ্বিতীয় পর্বে এসে মনে হল হাত খুলে গেছে। বেশ লাগছে।
  • | 24.97.23.27 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ১০:৫০45611
  • বাঃ এইবার বেশ ভাল লাগছে।
  • I | 24.99.26.198 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ১১:২২45612
  • বেশ।
  • aka | 84.191.67.11 (*) | ২১ নভেম্বর ২০১৩ ১১:৫৪45617
  • বেশ ইনোভেটিভ আইডিয়া কিছু। ভালো লাগছে।
  • s | 182.0.249.87 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৩ ০৩:১৭45618
  • ভালো লেখা।
    কিন্তু ব্রতীনের সাথে একমত। অ্যাডাল্ট শীর্ষেন্দু।
  • Ramkrishna Bhattacharya | 125.187.60.225 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৩ ০৩:৩৪45619
  • সায়ন্তনী
    পড়ছি । আপাতত কিছু বলছি না । তবে, যারা পড়ছে তাদের বক্তব্যের সাথে আমি সহমত
  • de | 190.149.51.69 (*) | ২২ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:৪৬45620
  • ভালো লাগছে -- একদম অন্যরকম!
  • Biplob Rahman | 212.164.212.20 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৩ ১২:৪৩45621
  • সাড়ে সর্বনাশ! (Y)
  • subhadip das | 785612.185.123412.58 (*) | ২৪ জুলাই ২০১৮ ০৬:৩৯45622
  • puro a grade comedy asadharan.boi chere utha jai Na Sayantani.khub slang language ar kichu na
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন