এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বোকা মানুষের গল্প

    Sayantani Putatunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ | ২৩২৩ বার পঠিত
  • ১.
    রাজধানী এক্সপ্রেস তুমুল গতিতে ছুটে চলেছিল।
    তখন অনেক রাত। যাত্রীরা নিজেদের বার্থে শুয়ে ঘুমে মগ্ন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনের কামরার জানলাগুলো শক্ত করে আঁটা। তার ঝাপ্সা কাঁচে কালো মসৃণ রাতের ছায়া পিছলে পিছলে যাচ্ছে। কখনও কখনও শোনা যাচ্ছে দু একটা পায়ের শব্দ। কখনও বা বেসিনের জলের কলের কলকল।
    একটা সুন্দর দুলুনি অনুভব করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তিনি মানে যে কেউ হতে পারেন। আমি, আপনি, বা অন্য কেউ। ধরে নেওয়া যাক, তাঁর নাম অমুক চন্দ্র অমুক। সংক্ষেপে অমুকবাবু। টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত মার্কা চেহারা। হাতের আঙুলে বেশ কয়েকটা রূপোর আংটি শোভা পাচ্ছে। মুক্তো, পলা, ক্যাটস আই—আরও কিছু পরিচিত অপরিচিত পাথর। ডান হাতের বাহুতে একটা মাদুলি। কব্জিতে বাঁধা মা বিপত্তারিণীর লাল রঙের তাগা। হাতে রিস্টওয়াচের সাদা দাগ। তবে রিস্টওয়াচটা নেই। সম্ভবত চোরের ভয়ে ওটা তালাবন্ধ ব্যাগের কোনও খুপরিতে রয়েছে। একই সাথে রয়েছে অ্যান্টাসিডের বোতল, ইসবগুল, ব্লাড-প্রেশার,সুগারের ট্যাবলেট, দাঁতের মাজন, সাবান—এইরকমই আরও কিছু টুকিটাকি। বহুমূল্য কিছু আছে কি না বোঝা মুস্কিল। তবে তালা চাবি-চেইন সহযোগে বাঁধাছাঁদার বহর দেখলে মনে হয় ব্যাগের মধ্যে কোহ-ই-নূর থাকাও অসম্ভব নয়!
    সাপের মত গাড়িটা দুর্বার গতিতে ছুটে চললেও তার পেটের ভিতরটা কিন্তু খুব বেশি লাফঝাঁপ মারছে না। জীবনে এই প্রথমবার রাজধানী এক্সপ্রেসে চড়েছেন অমুক বাবু। সচরাচর দূরপাল্লার ট্রেনের অভিজ্ঞতা তাঁর খুব খারাপ। এমনিতে সবই ঠিকঠাক, কিন্তু বিহার এলেই অবস্থা প্রাণান্তকর হয়ে ওঠে। রিজার্ভেশন ছাড়া শুধু মানুষ উঠলে তবু কথা ছিল। কিন্তু তার সাথে আরও যে কত উপদ্রব ওঠে তার ঠিক নেই। জগদ্দল ট্রাঙ্ক গুলো তো ট্রাঙ্ক নয়—গোবর্ধন পাহাড়! তার সাথে কত রকমের বাক্স-প্যাঁটরা! যত্রতত্র পানের পিক ফেলার অভ্যেস, এবং তার সাথে উপরি পাওনা বেশ বাছা বাছা কিছু গালাগালি! মাঝেমধ্যে ভয় হয় হয়তো এরপর কোনওদিন ‘ভইসাঁ’ নিয়েও উঠে পড়বে লোকগুলো।
    রাজধানী এক্সপ্রেসে সেসব ঝামেলা নেই। বলা বাহুল্য অমুকবাবু মহানন্দেই ঘুমোচ্ছিলেন। কোথাও কোনও সমস্যা ছিল না। রাতের মসৃণ অন্ধকারের মতই মসৃণ গতিবেগে এগিয়ে চলেছিল ইস্পাতের সরীসৃপ!...
    আচমকা একটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি!
    তারপরই হঠাৎ কি হল কে জানে! অমুকবাবু বার্থ থেকে ছিটকে পড়লেন মেঝেতে...! মনে হল গোটা পৃথিবীটা যেন লাট খাচ্ছে...! মড়মড় করে ট্রেনের ছাতটা দুমড়ে মুচড়ে নীচের দিকে নেমে আসছে—ঠিক যেন দেশলাইয়ের বাক্স! ঝন্‌ঝন্‌ করে ভাঙছে জানলার কাঁচ! চতুর্দিকে যাত্রীদের ভয়ার্ত পরিত্রাহি চিৎকার!... রক্তাক্ত শবের মিছিল... কালো ঘন ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ঢুকছে...নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না...দমবন্ধ হয়ে আসছে... তিনি উঠে বসার চেষ্টা করছেন...কিন্তু...কিন্তু...
    --‘টিকিট ...প্লিজ’।
    ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। কিন্তু তার মধ্যেও স্পষ্ট শব্দ দুটো শুনতে পেলেন। রাগে পিত্তি জ্বলে গেল! ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে! লোকগুলো মরতে বসেছে!...কি হবে ঠিক নেই...—এর মধ্যে টিকিট চেকার! এ কি টাইটানিকের ভায়োলিন বাদক নাকি? মরার আগেও ডিউটি করে যাচ্ছে!
    হাঁফাতে হাঁফাতে কোনমতে বললেন—‘বাঁ-চা-ও...বাঁ-চা-ও...!’
    উপর থেকে একটা গুরুগম্ভীর শব্দ ভেসে এল—‘কে কাকে বাঁচায় মশাই! আপনার নাক ডাকার চোটে যে আমাদের সবার হার্টফেল হওয়ার উপক্রম! আমাদের কে বাঁচায় তার ঠিক নেই! আর আপনি মধ্যরাত্রে ভুতুড়েপানা দেয়ালা জুড়েছেন। উঠুন উঠুন...!’
    মধ্যপ্রদেশে একখানা জব্বর খোঁচা খেয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ মেললেন অমুকবাবু! যাচ্চলে!—কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট, আর কোথায় কি! ট্রেন দিব্যি ট্রেনের মনে ছুটে চলেছে। আশেপাশের বার্থের লোকজন তাঁর দিকে প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে! তার উপরের বার্থের মিচকে ভদ্রলোক একখানা কলম দিয়ে তাঁর পেটে খোঁচা মারছিলেন। আরও কিছুক্ষণ হয়তো মারতেন, কিন্তু অমুকবাবু কটমটিয়ে তাকাতেই নিরস্ত হলেন। একদম নাকের সামনেই কালোকোটধারী চোখে চশমা আঁটা পেঁচকাবতার টি.টি বাবু। তাঁকে নড়েচড়ে উঠতে দেখেই ফের সবিনয়ে আবেদন জানালেন—‘টিকিটটা...?’
    টিকিট দেখিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। যাক্‌, তাহলে অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি। নেহাতই দুঃস্বপ্ন! ভাবতে ভাবতেই ফের রাগ হল তাঁর। সমস্ত দোষ ঐ উপরের বার্থের তমুকবাবুর! এক নম্বরের অনামুখো লোক! এমন সব কথাবার্তা বলেন...!
    এই তো, একটু আগেই ডিনার করে মহা খোশমেজাজে ছিলেন অমুকবাবু। স্বাভাবিকভাবেই পেটে একটু ভালোমন্দ পড়লে মানুষ দার্শনিক হয়ে যায়। হয়তো সেই দার্শনিক আমেজেই তমুকবাবুকে বলে ফেলেছিলেন—‘ভেবে দেখুন, এই যে কত লোক একসঙ্গে সফর করছে—কয়েকঘন্টা সময় একসাথে কাটাবে, একে অন্যের সঙ্গে গল্প করবে—তারপর যেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যাবে তখন কি অবলীলায় সব কথা ভুলে মেরে দেবে! মনেও থাকবে না যে ট্রেনে কয়েকটি মানুষের সাথে আলাপ হয়েছিল! একে আপনি কি বলবেন? টাইম আর স্পেসের খেলা!’
    তমুকবাবু খুব গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন—‘তা বলতে পারি না মশাই। উল্টোটাও হতে পারে। হয়তো এই জার্নি কেউ কোনদিন ভুলতেই পারল না!’
    --‘তা কিভাবে সম্ভব’?
    তমুকবাবু একখানা জব্বর হাই তুলে বলেছিলেন—‘ধরুন একটা ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল! ট্রেনের গ্যারান্টি কি? হয়তো কেউ ট্র্যাকের উপর একখানা মাইন রেখে গেল, অথবা ফিশপ্লেট সরিয়ে দিল...অথবা ব্রিজ ভেঙে পড়ল...!’
    অমুকবাবু সঙ্গে সঙ্গেই জোয়ানের আরকের বোতলটা এগিয়ে দিয়েছিলেন—‘আসুন, আপনার নির্ঘাৎ বদহজম হয়েছে’।
    তিনি হেসে বলেছিলেন—‘আপনি মানবেন না! কিন্তু এটা কঠিন বাস্তব। এই ট্রেনের সমস্ত যাত্রীর মধ্যে একটাই যোগসূত্র হতে পারে—মৃত্যু! ওনলি ডেথ!’
    ‘ওনলি ডেথ’ শব্দটা শুনে অমুকবাবুর গা শিরশির করে উঠেছিল। অজান্তেই কখন যেন মাদুলিটা চেপে ধরেছিলেন। আর তারপর থেকেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন গুড়গুড় করছে। এমনিতেই তিনি একটু ভীতু মানুষ! ট্রেনে যে পরিমাণ লাগাতার অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা ঘটছে তাতে ট্রেনে উঠতেই ভয় ভয় করে। তার উপর সহযাত্রীর এমন মন্তব্য!
    ফলস্বরূপ রাত্রে মর্মান্তিক দুঃস্বপ্ন! তিনি অপ্রস্তুত মুখে চতুর্দিকে দেখছিলেন। তমুকবাবু একটা বিরাট হাই তুলে ফের শুয়ে পড়লেন। তবে ফোড়ন কাটতে ছাড়লেন না—‘এতদিন বোফর্স কামানের ছবিই শুধু দেখেছি। এবার আওয়াজটাও শুনে গেলাম! কিসের স্বপ্ন দেখছিলেন মশাই? কার্গিল ওয়ারের?’
    অমুকবাবু এবার ক্ষেপে গেলেন—‘আপনি কি ভালো কিছু বলতে পারেন না? শুরুটা করেছেন কি—অ্যাঁ? হয় অ্যাক্সিডেন্ট, নয় মাইন, বোফর্স কামান—যত সব অলুক্ষুণে কথা বলেই চলেছেন...!’
    --‘স—রি!’ শব্দটা ছুঁড়ে দিয়েই সুড়ুৎ করে কম্বলের তলায় সেঁধিয়ে গেলেন তমুকবাবু। কিছুক্ষণ সেদিকে কটমট করে তাকিয়ে থেকে তিনিও অসম্পূর্ণ ঘুমটুকু সেরে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হঠাৎই চোখ পড়ল তার দিকে। সে অপলকে তাকিয়ে আছে এদিকেই!
    বছর ত্রিশের এক সুদর্শন যুবক! গোঁফ দাড়ি কামানো পরিপাটী মুখ। গলায় একটা কালো কার ঝুলছে! তার সাথে একটা সোনার চেইনে স্বস্তিক চিহ্ন ও ক্রস লকেট হিসাবে সহাবস্থানে বিরাজ করছে। হাতের কব্জিতে রুদ্রাক্ষ! নিপাট বাঙালী। সবমিলিয়ে আধুনিক কেতাদুরস্ত এক যুবক!
    তা সত্ত্বেও ছেলেটাকে দেখলেই একধরণের অস্বস্তি বোধ করেন অমুকবাবু। আপাত নিরীহ ছেলেটার চোখে কেমন যেন একটা দৃঢ়তা মাঝেমধ্যেই চকচক করে ওঠে। চৌকো চোয়াল দেখলেই মনে হয়—মানুষটা খুব সহজ নয়! এমন চেহারা প্রায়ই পেপারে দেখা যায়! অতি ভদ্র, নম্র ও শিক্ষিত চেহারা—অথচ ক্রূর প্রকৃতির নৃশংস মানুষ! ঠিক তেমনই একটা সাধারণ অথচ অস্বস্তিকর চেহারার মালিক সে!
    --‘মেসোমশাই...’। পাশের বার্থ থেকে সহানুভূতিপূর্ণ স্বরে বলল সে—‘ঠিক আছেন?’
    তাঁর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। ঢোঁক গিলে বললেন--‘একটু জল...’।
    সে বিনাবাক্যব্যয়ে জলের বোতল এগিয়ে দিল—‘নিন্‌’।
    বুকটা তখনও ধুকপুক করছিল! বোতলের জলে গলা ভিজিয়ে একটু শান্তি পেলেন অমুকবাবু। জলটা খেতেও ভালো লাগল। সচরাচর ট্রেনের জলের প্যাকেট বা মিনারেল ওয়াটারের বোতলের জল একেবারেই বিস্বাদ হয়! সেই তুলনায় এই জলটা খেতে ভালো। সে হেসে বলল—‘ডোন্ট ওরি। বাড়ির জল’।
    আশ্বাস পেয়ে চোঁ চোঁ করে প্রায় আধবোতল জল খেয়ে নিলেন তিনি। তারপর বোতলটা ফেরৎ দিয়ে বললেন –‘থ্যাঙ্কস্‌’।

    ২.
    যখন ঘুম ভাঙল তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। অমুকবাবু সচরাচর এতক্ষণ ঘুমোন না। কিন্তু কাল রাতে ঘুমটা বেশ গাঢ় হয়েছিল। আর কোনও দুঃস্বপ্নও দেখেননি। বার্থে গা এলিয়ে দিতে না দিতেই চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছিল। যথারীতি একঘুমে রাত কাবার।
    কিন্তু ভালো করে চোখ মেলতেই চক্ষু চড়কগাছ! এ কি ট্রেনটা এমন ফাঁকা কেন! স্টেশন এসে গেছে নাকি! সে কি! কেউ তো ডাকেনি তাকে! প্রায় ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা করছেন। অদ্ভুত! বাইরে কোনও স্টেশন নেই! বরং চতুর্দিকটা অন্ধকার! এমন সময় বাইরে অন্ধকার কেন? ক’টা বাজে?
    মনে পড়ল, ব্যাগে হাতঘড়িটা আছে। তিনি সিটের তলায় হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগ খুঁজছিলেন! কি কেলেঙ্কারি! ব্যাগ তো সিটের তলায় নেই! অমুকবাবু উন্মাদের মত খুঁজতে শুরু করলেন...এই তো! এখানেই...! এখানেই চেইন দিয়ে বেঁধেছিলেন! গেল কোথায়! ওর মধ্যে তাঁর প্যান কার্ড, এ টি এম কার্ড ছিল। সঙ্গে হাজার দশেক টাকাও...! সব গেছে...কিচ্ছু নেই...!
    বিদ্যুৎচমকের মত একটা সম্ভাবনা মাথায় চিড়িক করে খেলে গেল! সে! সেই ছেলেটা! তার দেওয়া বোতল থেকে জল খেয়েছিলেন! জলে কিছু ছিল—কিছু মেশানো ছিল! এমনভাবেই ওরা নিরীহ মানুষদের লুটে নেয়!...এমনভাবেই...!
    অসহায়ের মত তবু কিছুক্ষণ আঁতিপাতি করে ব্যাগটা খুঁজলেন! অন্ধ আশা সহজে পিছন ছাড়ে না! যদি তাঁরই ভুল হয়! যদি অন্য কোথাও রেখে থাকেন...! যদি ট্রেনের সিটের নীচে কোনও ঘুপচিতে ঢুকে গিয়ে থাকে! যদি...!
    কিন্তু একসময় নিজেই বুঝলেন—খোঁজাখুঁজি বৃথা। ব্যাগটা গেছে! তার সঙ্গে গেছে যাবতীয় দরকারি জিনিসপত্রও! এখন তিনি নিঃস্ব! কপর্দকহীন! কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলেন ট্রেনের দরজার দিকে! এখানে নেমে পড়ে পুলিশে রিপোর্ট করতে হবে। বলতে হবে বদমায়েশটা তাঁর কি দশা করেছে! দ্যাট ব্লাডি বাস্টার্ড...!
    দরজার বাইরে বেরোতেই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! এ কি! তিনি কোথায়! এ তো কোনও স্টেশন নয়! চতুর্দিকে সারসার ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে! কোনওটা আস্ত! কোনওটা ভাঙা। কোথাও শুধু ইঞ্জিন! কোথাও বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকটা বগির ধ্বংসস্তূপ! বেওয়ারিশ বগির ভাঙা জানলাগুলোর শূন্যতা অসহায় মানুষটাকে দেখে হা হা করে অট্টহাস্য করে উঠল!
    তিনি একটা কারশেডে! হে ঈশ্বর...!
    ......এই রোক্‌কে...রোক্‌কে...! গল্পের ট্রেনে এবার চেন টানা দরকার। ইয়ে...মানে...একটি অসহায়, নিঃস্ব মানুষের ট্র্যাজেডিকে আর দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই! কারণ আদৌ এই ঘটনাটা ঘটেনি!
    এটা অমুকবাবু ভাবছেন! এক মুহূর্তের মধ্যে গোটা ঘটনাটাই তাঁর মাথার মধ্যে ঘটে গেল! সে তখনও জলের বোতলটা ধরে আছে ভদ্রলোকের নাকের সামনে।
    --‘কি হল মেসোমশাই?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল সে—‘জল খাবেন না!’
    অমুকবাবু প্রায় খিঁচিয়ে উঠলেন—‘না, খাবো না। আর আমি তোমার কোথাকার মেসোমশাই হে! এমন গায়ে পড়ে সম্বন্ধ পাতানো আমি একেবারেই পছন্দ করি না!’
    সে একটু ক্ষুণ্ণ হল বোধহয়। জলের বোতলটা ফিরিয়ে নিয়ে কম্বলটা গায়ে টেনে ফের শুয়ে পড়ল! অমুকবাবু বিড়বিড় করে বললেন—‘যতসব চোর-বদমায়েশের দল!’
    উপর থেকে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য ভেসে এল—‘কথায় কথায় এত সন্দেহ করেন কেন মশাই! পোলদারোগা ছিলেন না কি!’
    অমুকবাবু ফোঁৎ ফোঁৎ করে একটা তাচ্ছিল্যসূচক শব্দ করে পিছন ফিরে শুয়ে পড়লেন। তাঁর সহযাত্রী আর কি করে বুঝবেন যে এই জার্নির একসপ্তাহ আগে থেকেই অমুকবাবুর স্ত্রী পই পই করে তাঁকে সাবধান করেছেন। দিল্লীতে বৌমার কাছে এই প্রথম তিনি একা যাচ্ছেন। গিন্নীরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছোট মেয়ের পরীক্ষার দরুণ যেতে পারেননি। তাই আলাভোলা স্বামীটিকে যতরকম ভাবে সতর্ক করে দেওয়া যায়, করে দিয়েছেন! এক কথায় বলা যেতে পারে গিন্নীর কথার মর্মার্থ ছিল—‘পাগলা, নাও ডোবাস্‌নি যেন!’ আর সেকথা শোনামাত্রই অমুকবাবু মাস্তুলে চড়ে এমন লম্ফঝম্প শুরু করেছেন যে তাঁর সহযাত্রীদের মান-সম্মান সব ডুবতে বসেছে!
    যাই হোক্‌, সে রাতটা নিরাপদেই কাটল। অমুকবাবু সতর্ক ছিলেন। কিন্তু কোনও চোর-ডাকাতের উপদ্রব হয়নি।

    ৩.
    --‘গুড মর্নিং!’ পরদিন সকালে একগাল চিমটি কাটা হাসি হেসে বললেন তমুকবাবু—‘ব্যাগ পত্তর সব চেক করেছেন? ঠিকঠাক আছে তো?’
    অমুকবাবু একখানা ভিসুভিয়াস চাউনি দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলেন। স্বেচ্ছায় নয়! যোগগুরুর ডিভিডি দেখার পর থেকে নিয়মিত কপালভাতি করছেন তিনি। বয়েসের সাথে সাথে ভুঁড়িও সমানুপাতে বেড়েছে! তাই নিয়ম করে যোগাসন করতে হয়!
    আজও যোগাসন করছিলেন বটে, কিন্তু মনটা বিক্ষিপ্ত! তাঁর একমাত্র ছেলে শুভ তিনবছর আগে আগামীকালের তারিখেই চলে গিয়েছিল! তরতাজা জোয়ান ছেলেটা বেপরোয়া ভাবে বাইক চালাত! অনেকবার বারণ করেছিলেন। কিন্তু শোনেনি। দিল্লীর রাস্তায় ট্রাক এসে ঠুকে দিয়েছিল! রাস্তায় শুয়ে শুয়ে তাঁর জখম, মৃত্যুপথযাত্রী ছেলেটা সাহায্যের অপেক্ষা করছিল! নাঃ, কেউ এগিয়ে আসেনি! কোনও সাহায্যের হাত তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়নি। দিল্লীর জনবহুল রাস্তা মূঢ়ের মত দেখেছিল যে এক রক্তাপ্লুত যুবক তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেলল ধুলো-ধোঁয়াভরা রাস্তায়! মৃত্যুর আগে সে একটা বিছানা পায়নি, নিজের ঘরের পরিচিত দেওয়ালগুলো দেখতে পায়নি,... স্ত্রী—ছোট্ট মেয়ের সজল দৃষ্টি দেখে যাওয়াও তার ভাগ্যে জোটেনি!
    তাই অ্যাক্সিডেন্টকে বড় ভয় পান অমুকবাবু। এমন বেওয়ারিশ মৃত্যু নিজের সবচেয়ে বড় শত্রুর জন্যও কামনা করেন না! দিনকাল বড় খারাপ! কার কখন শখ হবে তাঁকে পিষে দেওয়ার, কিম্বা বোমায় উড়িয়ে দেওয়ার—কে জানে! অন্যের ইচ্ছেয় মরতে চান না তিনি! কিছুতেই না...!
    --‘চিন্তা কোর না তুমি!...সব ঠিকঠাক আছে! এবার আর কোনও ভুল হবে না...!’
    কপালভাতি করতে করতেই কানে এল ফিসফিস করে বলা একটা কন্ঠস্বর! সে মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে! তাঁর কানে এল চাপা কন্ঠস্বর—‘টাইমার ফিক্স করা আছে। একদম ঠিক সময়েই...!’
    তার পরের কথাগুলো আর কানে এল না! কানে আসার মত অবস্থাও ছিল না। ‘টাইমার’ শব্দটা শুনেই তিনি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করলেন। না, এবার কপালভাতির জন্য নয়! উত্তেজনায়! ‘টাইমার’ মানে! ‘টাইমার’ তো বোমায় থাকে! ওর ব্যাগের দিকে আড়চোখে তাকালেন। কোনও সন্দেহ নেই, ওর ভিতরে নির্ঘাৎ একটা বোমা আছে! ছিঁচকে চোর বা ডাকাত নয়, এ নির্ঘাৎ কোনও বাদী-টাদী হবে! রাজধানী এক্সপ্রেসকে উড়িয়ে দেওয়ার তালে আছে! আজকাল চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু...কিন্তু...এবার কি হবে! ট্রেন তো এখন কোথাও থামবে না...নেমেও যাওয়া যাবে না...কি হবে...কি হবে...! ট্রেনের গার্ডকে বলবেন?... চেইন টানবেন...? ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়বেন?...
    শুধু এইটুকু ভাবার সময়ই পেয়েছিলেন তিনি। আচমকা পিঁপ পিঁপ করে একটা আওয়াজ! পরক্ষণেই কি হল ঠিক বুঝতে পারলেন না! একটা উজ্জ্বল আলো চোখের রেটিনাকে যেন পুড়িয়ে ছাই করে দিল। বিধ্বংসী বিস্ফোরণের শব্দে কানের পর্দা ফেটে গেল! ট্রেনটা থর্‌থর্‌ করে কেঁপে উঠেছে! পরক্ষণেই সব ওলোট পালোট! অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে টের পেলেন ট্রেনটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে...তাঁর সারা শরীর গ্রাস করে নিচ্ছে আগুন...ডানহাতটা তুলতে গিয়ে দেখলেন—হাত নেই! নেই ডান পা-টাও! যন্ত্রণায় কাঁপছেন! চতুর্দিকে ছিন্নভিন্ন মানবশরীর...! বেওয়ারিশ লাশের ছড়াছড়ি! আগুন ক্রমাগত হিংস্র হয়ে উঠছে...! রক্ষা নেই... আর রক্ষা নেই...! লেলিহান বিক্রমে এগিয়ে আসছে বেওয়ারিশ মৃত্যু! তাঁর দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া, পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া লাশটা কেউ চিনতে পারবে না...কেউ শনাক্ত করতে পারবে না তাঁকে...!
    কি?...হ্যাঁ...হ্যাঁ—একদম ঠিক ধরেছেন! এটাও কিন্তু বাস্তবে ঘটেনি! মুহূর্তের ভগ্নাংশে গোটা দৃশ্যটা ভেসে উঠল তাঁর চোখের সামনে! ভাবতেই রক্ত হিম হয়ে গেল অমুকবাবুর। কি ভয়াবহ!
    --‘কি ভাবছেন মশাই?’ তমুকবাবুর ফোড়ন কানে এল—‘দিবাস্বপ্ন দেখছেন নাকি?’
    এই লোকটাকে দেখলেও বিরক্ত লাগছে! কিন্তু উপায় নেই। সহযাত্রী। সহ্য করতেই হবে। কোনমতে ধরা গলায় বললেন—‘টা-ই-মা-র!’
    --‘টাইমার! কিসের টাইমার!’
    তিনি আরও ফিসফিস করে বললেন—‘জানি না!...’ ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন—‘ও লাগিয়েছে!’
    তমুকবাবুর বুদ্ধিও বটে। কথা নেই বার্তা নেই, হেঁকে বললেন—‘এই যো, কিসের টাইমার লাগিয়েছ?’
    ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি! তমুকবাবু সোজা বাঘের খাঁচায় মাথা ঢুকিয়ে ফেলেছেন। সে পিছন ফিরে ব্যাগের মধ্যে খুটখাট করে কি যেন করছিল! তমুকবাবুর কথায় এদিকেই ফিরল! তার হাতে একটা ছুরি! অমুকবাবুর মনে হল, ছুরিটার শানানো ফলা যেন হিংস্র ভাবে জিভ বের করে আছে রক্তের স্বাদ নেওয়ার জন্য! তার গোপনকথা দুই বৃদ্ধ জেনে ফেলেছেন! এত সহজে কি সে ছেড়ে দেবে তাঁদের!
    তাঁর মনে হল—এক্ষুনি ছুরিটা এসে আমূল বিঁধে যাবে বুকে! একটা নৃশংস খুনী তাঁকে...!
    সে ছুরিটা নিয়ে অমুকবাবুর দিকেই এগিয়ে এল। ডানহাতে উদ্যত ছুরি! আর বাঁহাতে... বাঁ হাতে...!
    একটি লাল টুকটুকে আপেল! ছুরি দিয়ে আপেলটাকে কেটে একটুকরো এগিয়ে দিল সে অমুকবাবুর দিকে—‘খাবেন মেসোমশাই?’
    অমুকবাবু ছুরিটা দেখে এতক্ষণ প্রায় সিঁটিয়ে ছিলেন। এবার খেঁকিয়ে উঠলেন—‘বলেছি না, একদম মেসোমশাই বলবে না আমাকে! এসব খেজুরে আত্মীয়তা ভালো লাগে না! আর তোমার আপেল আমি খাবই বা কেন? কি মিশিয়েছ ওর মধ্যে ঠিক নেই!’
    ছেলেটার মুখ ম্লান হয়ে আসে। সে একটু অপ্রতিভ হেসে ফিরে যাচ্ছিল, তমুকবাবু তাঁকে ডাকলেন—‘ওহে, আমায় এক টুকরো দিয়ে যাও’।
    তার মুখ আবার হাসিতে ঝলমল করে ওঠে। সে নির্বিবাদে তমুকবাবুর পাশে বসে আপেল খেতে খেতে জমিয়ে গল্প করতে থাকে।
    --‘কিসের টাইমার লাগিয়ে রেখেছ হে?’ তিনি হেসে বললেন—‘টাইম বম্ব-টম্ব নিয়ে ঘুরছ না তো?’
    --‘টাইমার?’ সে হেসে ফেলল—‘মোবাইলে টাইমার সেট করে রেখেছি। আমার দাদার জন্মদিন। কিন্তু সে আবার থাকে লন্ডনে! সময়ের অনেক ফারাক! তাই লন্ডনের টাইম অনুযায়ী ওর বার্থ ডেট টাইমারে সেট করে রেখেছি যাতে সময়মতো বার্থ ডে উইশ করতে পারি’।
    বলতে বলতেই সে হাসছে—‘দাদা বড্ড অভিমানী। লন্ডনে একা একা থাকে তো। সবাইকে মিস করে। বার্থ ডে উইশ না করলে দুঃখও পায়। তাই...!’
    এবার বোঝা গেল টাইমারের রহস্য! সন্দেহ তবু পুরোপুরি গেল না।

    ৪.
    অবশেষে নিউ দিল্লী!
    অমুকবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। নাঃ, কোনও সমস্যা হয়নি! জার্নিতে একটু ক্লান্ত হলেও আস্ত দেহে যে পৌঁছতে পেরেছেন এটাই অনেক। রাস্তায় কোনও দুর্ঘটনা হয়নি, কেউ লুটপাটের চেষ্টা করেনি, বোমাবাজি হয়নি! রাজধানী এক্সপ্রেস একেবারে নিরুপদ্রবে এসে দাঁড়াল নিউ দিল্লী স্টেশনে।
    স্টেশনের চতুর্দিকে তখন থিকথিকে ভিড়! কুলি আর ট্রলির ধাক্কায় লন্ডভন্ড হতে হতে কোনমতে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা ট্রলি তাঁর পায়ের উপর দিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত করছিল। তিনি হাঁই-হুঁই করে, বিজাতীয় হিন্দিতে ট্রলিচালকের গুষ্টির পিন্ডি উদ্ধার করে কোনমতে পা বাঁচিয়েছেন!
    স্টেশনের বাইরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন অমুকবাবু। যাক্‌, অবশেষে পৌঁছনো গেল। তিনি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। যদিও হাওয়ার চেয়ে একরাশ ধুলো আর পেট্রোলপোড়া গন্ধই নাকে ঢুকল বেশি! তবু বেঁচে থাকার অনুভব যে কি সুখের তা অস্থিতে অস্থিতে অনুভব করলেন তিনি।
    --‘ট্যাক্সি লাগবে না কি?’
    তাঁর অজান্তেই কখন যেন তমুকবাবু পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। লটবহর সামলাতে সামলাতে বললেন—‘যাবেন কোথায়?’
    তিনি গন্তব্যস্থলের নাম বললেন।
    --‘আমিও তো ওদিকেই যাবো। চলুন একসাথেই যাওয়া যাক। ভাড়াটাও ভাগাভাগি হয়ে যাবে’।
    ‘হ্যাঁ’, ‘না’ এর তোয়াক্কা না করেই তমুকবাবু তড়িঘড়ি এগিয়ে গেলেন ট্যাক্সি ঠিক করতে।
    অমুকবাবু নির্লিপ্ত চোখে নিউ দিল্লীর রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলেন। এখনও কি রাস্তায় লেগে আছে শুভ’র রক্ত? প্রত্যেকবার দিল্লীর রাজপথকে এই প্রশ্নটাই করেন। আর প্রত্যেকবার একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যস্ত রাজপথে হুশ হুশ করে চলে যায় একরাশ গাড়ি! কোনও উত্তর দেয় না!
    তিনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ একটা চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সজাগ হলেন। স্টেশনের বাইরে ডানদিকে একটা কোল্ডড্রিঙ্কের দোকানের সামনে কিছু একটা ঘটেছে। বীভৎস চেঁচামেচি চলছে! পুরোটা বুঝতে না পারলেও হিন্দিতে গোটাকয়েক গালাগালি শুনতে পেলেন।
    ওদিক থেকেই একজন ছুটে আসছিল ওঁর দিকে। কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলেন—‘কি হয়েছে দাদা? ক্যায়া হুয়া?’
    লোকটি বাঙালী। আফসোসসূচক শব্দ করে বলল—‘আর বলবেন না। দুটো লোক্যাল বস্তির ছেলে একটি মেয়েকে ইভটিজিং করছিল। একটি ছেলে যেই প্রতিবাদ করেছে অমনি তার পেটে ছোরা মেরে দিয়েছে! বিচ্ছিরি কান্ড! একদম নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গেছে ছেলেটির! বাঁচবে না বোধহয়!’
    কি যেন হয়ে গেল অমুকবাবুর! এক অপ্রতিরোধ্য টানে গিয়ে উপস্থিত হলেন ঘটনাস্থলে! যুবকটি তখনও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে! তার চতুর্দিকে কতগুলো কৌতুহলী চোখ! কিন্তু যথারীতি সেই মূঢ় ভিড়! কোনও সাহায্যের হাত নেই! নেই সেই ইভটিজিং—এর শিকারটিও। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ প্রবাদটিকে সার্থক করে সেই মেয়েটিও চম্পট দিয়েছে!
    অমুকবাবু ভালো করে দেখলেন! রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ! তবুও চিনতে কোনও কষ্ট হল না। সে! ট্রেনের সেই ছেলেটা!
    তিনি হাঁটুগেড়ে বসে পড়লেন। বুকে তুলে নিলেন তাকে। মরিয়া হয়ে বললেন—‘ভয় পেও না। কিচ্ছু হবে না তোমার! আমি এক্ষুনি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো...!’
    সে অতিকষ্টে হাসল—‘মে-সো-ম-শা-ই...!’
    তিনি ওকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরলেন—‘ডোন্ট ওরি...! আমি আছি...ভয় পেও না!’ বলতে বলতেই উন্মত্তের মত চিৎকার করে উঠলেন—‘আপনারা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন? কল্‌ এ ট্যাক্সি...প্লিজ্‌...!’
    --‘আরে মশাই, আপনি এখানে!...আমি তো ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে...’ তমুকবাবু তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে চলে এসেছেন। অবস্থা দেখে আঁৎকে উঠলেন—‘ এ কি! আপনি এসবের মধ্যে ফেঁসে গেলেন কি করে? চলে আসুন...এক্ষুনি চলে আসুন...!’
    --‘ওকে ফেলে আমি যাবো না’। দৃঢ় উত্তর এল।
    --‘আপনি কি পাগল হয়েছেন?’ তমুকবাবু উত্তেজিত—‘আরে, চেনেন না—জানেন না, অজ্ঞাতকুলশীল একটা ছেলে!...বাঁচবে কি না ঠিক নেই—এরপর যে আপনিই বিপদে পড়বেন!’
    --‘অজ্ঞাতকুলশীল!’ প্রায় তেড়ে গেলেন তিনি—‘আপেল খাওয়ার সময়, ওর মায়ের হাতের টিফিন খাওয়ার সময় মনে ছিল না যে ও অজ্ঞাতকুলশীল? এখন হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে ছেলেটাকে আপনি চেনেন না! চমৎকার!’
    ভদ্রলোক প্রথমে কি বলবেন ভেবে পেলেন না! তারপর চোয়াল শক্ত করে বললেন—‘তাহলে মরুন...! জানা নেই, শোনা নেই তবু...!’
    তাঁর কথাগুলো পুরো শোনা গেল না। কারণ কথাগুলো বলতে বলতেই তিনি সরে পড়েছেন! অমুকবাবু ছেলেটার মাথা কোলে টেনে নিলেন...তাঁর পাঞ্জাবীতে রক্তের দাগ লাগল! কিন্তু কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি প্রাণপণে হাত নেড়ে, গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছেন—‘ট্যাক্সি-ই-ই-ই-ই! ট্যা-ক্সি-ই-ই-ই-ই-ই!’
    ...হ্যাঁ...কিছুক্ষণ আগেও তুই অজ্ঞাতকুলশীল ছিলি!...কিন্তু এখন তোকে চিনতে পেরেছি! তুই একটা বোকা মানুষ! আমার মত, কিম্বা শুভ’র মত! তোকে সন্দেহ করলেও তুই ভালোবাসতে আসিস! প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াস! মেরে ফেললেও বোকার মত প্রতিবাদ করতে যাস! তোর মত একটা বোকা মানুষ থাকলে আজ আমার শুভ বেঁচে থাকত! আজ যদি তোকে ছেড়ে যাই তবে শুভ’র বিধবা বৌটার দিকে তাকাতে পারব না...! নাতনির চোখে কোনও দিন চোখ রাখতে পারবো না! তা হবে না... তুই বাঁচবি! বাঁচতেই হবে তোকে! এই,...ট্যাক্সি-ই-ই-ই-ই!... ট্যা—ক্সি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই!

    (আনন্দবাজার--এবেলার, রবিবেলায় প্রকাশিত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ | ২৩২৩ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    গরল - Sayantani Putatunda
    আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kaushik | 127.211.91.74 (*) | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ ১০:২৬46083
  • এই প্রথম আপনার লেখা পড়লাম।

    বেশ ভালো লাগলো। আরো লিখুন।
  • Ekak | 24.99.84.234 (*) | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩ ১২:৫৭46084
  • ভালো লাগলো শেষ প্যারা টা বাদদিয়ে । ওটা ছাত্রবন্ধু মনে হয়েছে ।বাদবাকি গপ্প সাবলীল ।
  • de | 69.185.236.52 (*) | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৩ ০১:৪৯46086
  • খুব ভালো লাগলো!
  • Rivu Roy | 140.203.189.5 (*) | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৩ ১২:৫০46085
  • লেখাটা বেশ ঝরঝরে। আমার সায়ন্তনীর আগের লেখা গুলোর চেয়েও এটার ভাষাটা বেশি সাবলীল মনে হয়েছে।
  • আশীষ বসু | 212.142.81.3 (*) | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ০২:০১46087
  • দরুন লাগল তাই শেয়ার করলাম
  • Aloka | 24.99.189.207 (*) | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৩:৪৪46089
  • আগেও আপনার লেখা পড়েছি তবে এটাই সবচেয়ে ভালো লাগলো। আরো লিখুন
  • m chateerjee | 123.21.77.235 (*) | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৬:২৮46088
  • ei protham bar apnar lekha porlam besh valo legeche ama, aro porbo, oro onek likhun
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন