এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • বোতল ভর্তি চন্ডাল পরী

    মোহাম্মদ কাজী মামুন লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৪ মার্চ ২০২৩ | ৭৩৯ বার পঠিত
  • ‘লাইজুর মার আজ পোলা হইব।’ সালামের কথাটা কানে যাওয়ার পর থেকেই মোরসালিনের মুখটা কেমন ছদ্মবেশ ধারণ করে চোখ যেন হয় বহু আলোকবর্ষ দূরের ফিট করা কোন টেলিস্কোপ।
    মনের ভাব লুকোতে অচিরেই সেখানে অশরীরী রেখারা দুর্বোধ্য সব ছন্দে নৃত্য করতে থাকে!

    - ‘তুই কি করে জানলি?’

    - ‘পেডের দিকে চা বলদা, ফুইলা ঢোল হইয়া রইছে।’

    মোরসালিন আচমকা দৌড়ে যায় দড়ি থেকে শুকনো কাপড় নামানোয় ব্যস্ত লাইজুর মায়ের দিকে, ‘মামি, মামি, জানেন, আপনার না আজ একটা ছেলে হবে!’ রোদের তাপে কাপড়গুলো আগেই ঝলসে গিয়েছিল প্রায়, এখন সেই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে মামির অপুষ্ট বাহু বেয়ে শরীরের অলিগলিতে।

    সন্ধ্যে রাত থেকে লাইজুদের বাড়ির দরজা বন্ধ, বাইরে স্বজন, পড়শী ও উৎসুকদের ভীড়। সকালে নবজাতককে যখন দুহাতের বিছানায় রেখে ‘থুতনিডা অবিকল মিয়া ভাইয়ের’ ইত্যকার তূল্যমূল্য বিচারে ব্যস্ত রওশান আরা, তখন লাইজুর মা’র নিঃশেষিত-প্রায় কন্ঠ শোনা যায়, ‘বুজি, জানেন, মোরসালিন কাইল দুপুরে কইতেসিল…..!’ শুনে মোরসালিনের মায়ের মুখ এতটা বদলে যায় যে আঁতুড় ঘরে সারি বেঁধে দাঁড়ানো লাইজুদের তিন বোন তার পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সদ্যজাত ভাইকে ভুলে গিয়ে।

    মোরসালিনের জগতজোড়া বন্ধু ছিল। কিন্তু সে-ই তো যখন অবসরের ঘন্টাগুলো কাটাতো গান গেয়ে কোন এক বিদেশী ভাষায়, তখন পৃথিবীটা একাই সময় দিত তাকে। পাকা সড়কের উপর দাঁড়িয়ে থাকা যে বিরাট বটগাছটা নানাবাড়ি ঢোকার মুখে তাদের অভ্যর্থনা জানাতো, তাই নাকি মধ্যরাতে একটি দুর্ধর্ষ ভূতের কবলে পড়ত! নিশুতি রাতে লেলিহান শিখার বেশ ধরে শাখা-প্রশাখাগুলোকে সে প্রবল রোষে জাপটে ধরতো, আর লাল টুকটুকে ভোরে পাতাগুলোকে আগের দিনের থেকেও সজীব দেখাত। দিনের বেলায় মোরসালিন সেই গাছটায় বসে আপন মনে পাতার আংটি বানিয়ে যেতো কেবল!

    মামা উড়নচন্ডি স্বভাবের জন্য শৈশবে তাকে ‘ঘোড়া’ উপাধি দিয়েছিল, সে খুব ক্ষেপে যেত দুষ্টুমির ছলে কেউ এই নামে ডাকলে…. অথচ সে প্রায়ই দাঁড়িয়ে ঘুমোত এবং তা কেউই জানতো না। ছোট থেকেই সে খুব সোজা হাঁটে, একই রকম করে কদম ফেলে; তার চোখ দেখে, সবই তো সরল পথ, যেখানে পথ বেঁকেছে বলে মনে হয়, সেখানেই তো নতুন পথের খোঁজ পেয়ে যায় সে। বেতার তরঙ্গের মত সে সোজা ছুটে, মাঝে মাঝে মহাকাশের কাছে পৌঁছে যায়, বায়ুমন্ডলের সর্বোচ্চ সীমায় বাঁধা খেয়ে আবার ফিরে আসে পৃথিবীতে। একদিন সে-ই নানাজানের হাতের বাঁধনে পিষ্ট হতে হতে এক গনজমায়েতের মুখে দাঁড়িয়ে জানলো, ‘এক রত্তি মাংস নাই শরিলে…সাধারন বৃত্তি না…ট্যালেন্টপুল…সবই তাঁর কেরামতি!’ তীর্যক চোখে তাকিয়েছিল তারা সবাই, সম্মিলিত একটি ফিসফিসানি ঢেউয়ের মত আবর্তিত হয়ে প্রায় পিষে ধরছিল তাকে।

    অথচ মোরসালিনই ছিল ক্লাসের সব থেকে অমনোযোগী ছাত্র। সবাই দেখতো, সে জ্যামিতি বইয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পড়া মুখস্ত করছে, আসলে সে তো তখন অনিমেষ তাকিয়ে ছিল গাছ, মানুষ, পাখি, দালান, নক্ষত্র বা কোন গল্পের পাতায়, কোন এক ব্যাখ্যাতীত অলৌকিক রসায়নে সেই দৃশ্যগুলো বইয়ের প্রতিটি শব্দের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছিল। পরীক্ষার হলে সেই দৃশ্যগুলো দেখেই বইকে হুবুহু লিখে দিতো, এদিকে কাউকে একটি ঠিকানাও ঠিক ঠাক বলে দেয়া তার জন্য ছিল পৃথিবীর কঠিনতম পরীক্ষা, কোন বস্তু সোজাসুজি এঁকে দিতে পারলেও তাদের আয়তন বা আকৃতির জটিল অংকের মধ্যে সে বেশীক্ষন স্থায়ী হত না।

    যখন পাখির মত সাঁতরে বেড়াতো খালে-বিলে বা ভেসে বেড়াত সাইকেলে দিগন্তের চিকন রেখা দিয়ে, তখন এই জগতের সাথে তার কোন যোগ থাকতো না নিশ্চিত, উধাও হয়ে যেত কোন সুদূর রাজ্যপাটে! অথচ ছেলেদের দল যখন ঝাঁপিয়ে পড়ত পুকুরে বা হল্লা করত সাইকেল নিয়ে, সে এক কোনে নিমগ্ন দাঁড়িয়ে থাকত যেন হারিয়ে ফেলেছে পাখা! একটা বিষয় খেয়াল করেছিল তার মা, মোরসালিনকে যতটুকু খাবার দেয়া হয় প্লেটে, ঠিক ততটুকুই সে দ্রুত শেষ করে, যেন এটুকুই তার ক্ষুধা ছিল, অথবা, সে যেন খায় না, একটি পর্ব শেষ করে।

    একদিন একজন অচেনা মানুষের কথা ও কাজের উপর সে পাঠ করল, তারপর কি মনে করে তার একখানি পোট্রেট এঁকে ফেলল। একটি ছেলে ও মেয়ে একসাথে হেঁটে যাচ্ছিল, তারা কিছুটা মুহূর্ত একে অপরের দিকে আবেগঘন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, এদিকে একটি শিশুর ভ্রুন মূর্ত হয়ে উঠতে লাগলো মোরসালিনের পর্দায়, মুহুর্তের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কি করে একটু একটু করে অবয়ব দিত লাগলো, চিন্তাটুকু অযুত নিযুত কনায় ভেঙ্গে যেয়ে গড়ে দিতে লাগলো শিশুটির চরিত্র। সে যেন লিখতো এক অভেদ্য মহাকাব্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পৃথিবীর নিরিবিলি এক কক্ষের কোণে বসে। তখন তার চোখ-মুখ থেকে ধোঁয়া বেরুতো, সে রূপান্তরিত হত অশরীরী কোন আত্মায়!

    ভাল ছাত্রের আওয়াজ মোরসালিনের এই রাশি রাশি ভুতুড়ে কায়দাকানুন ভুলিয়ে রাখলেও বাবা-মায়ের উৎকন্ঠা ক্রমেই দৈর্ঘ্য বিস্তার করতে থাকে - মজিবর সাহেব কোথা থেকে শুনে এসেছেন, এক পীর বাস করেন শোল্লার চরে, হেন কোন অসুখ নেই, যার চিকিৎসা করেন না। একদিন সূর্য ভাল করে ফোঁটার আগেই ছেলেকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন। মোরসালিনের মাঝে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করলো না কেউ, যদিও কয়দিন ধরেই কানের পর্দায় বিরমাহীন বেজে যাচ্ছিল, ‘পিঠের ছাল উঠাইবো, বদ জ্বীনের আছর ছুডান কি মুহের কথা !’

    শোল্লার চর সাত সকালেই জন অরণ্য! অসুখী মানুষের স্রোত প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে নতুন জেগে উঠা এই নরম মাটিতে আর তৈরী করছে বিচিত্র সব কারুকাজ! তার মধ্যেই লাইন ধরে ধরে গোলাপি আলখাল্লা পরিহিত হুজুরের কাছে এক সময় পৌঁছুনো গেল - ব্যক্তিগত সহকারী আগেই ব্রিফ করেছে মোরসালিনের সমস্যাটা। হুজুর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নাম কি তোমার, বাবা?’ মাথা নীচু করে থাকা মোরসালিন চোখ তুললেও সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নিল, পরে বহু দূর থেকে ভেসে আসা একটি জড়ানো কন্ঠ তার নামটি বলে দিল। এরপর ‘কোন ক্লাসে পড়ে’ প্রশ্নটিও উত্থাপিত হয়েছিল, ততক্ষনে অশালিন-অসংলগ্ন কথা বলতে থাকা এক অদূরবর্তী মহিলা দর্শনার্থীর দিকে তার মনোযোগ পুরো নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। হুজুর মজিবর সাহেবের দিকে ফিরে এক গাল হেসে বললেন, ‘মাশাল্লা, খুব ব্রেইনি ছেলে আপনার, অনেক বড় হবে ইনশল্লাহ্‌।’

    সেদিন বাড়ি ফিরে মজিবর সাহেব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কবরস্থানের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা আম গাছটার গোড়ায় একটি তেলের শিশিকে সমাধিস্থ করতে। ঐ বোতলে মোরসালিনকে প্রায় দখলে নেয়া এক অশরীরীকে বন্দী করা হয়েছে। এমনকি সেই প্রেতেনির নামটিও বলে দেয়া হয়েছে। সমবয়সী ভাইবোনেরা তাকে ক্ষ্যাপাতে চেয়ে অবশ্য পরাস্ত হয়, সে আটখানা ছিল এমন প্রেত তার মাঝে বাস করে জানতে পেরে, ‘জানো, আমার আছে এক চন্ডালপরী’ - যাকে সামনে পাচ্ছিল, তাকেই ঘটা করে দিচ্ছিল খবরটা।

    এরপর থেকে নিজের খোলস তাকে আগ্রহী করে তুললো, হালকা পাতলা কাঠামোটা তাকে বিষ্মিয়ে অভিভূত করতে শুরু করল। সেই সময়টাতেই, ঘরের মধ্যে হঠাৎ ছুটে আসা তেলাপোকাকে যেমন, নিজেকেও তেমনি ভীষন অচেনা মনে হত। অবাক হয়ে ভাবতো, এ ছেলেটি কে? সবচেয়ে বিভৎস ব্যাপার হত, আয়নার সামনে যখন থাকতো… রীতিমত কাঁপতে শুরু করতো; অনেক চেষ্টা করতো, আয়নার মানুষটির সাথে নিজেকে মেলাতে, তৈরী করতে কোন সংযোগ, কিন্তু সে যে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ! তাহলে এই যে সে ভাবছে, সে কে? আয়নার মানুষটি কি তার ছদ্মবেশ? সে কি তবে অশরীরি এক জীব? অস্তিত্ব? বা, আদৌ তার অস্তিত্ব আছে?

    মোরসালিন বড় হতে লাগলো, ওদিকে চন্ডাল পরী বোতলের গায়ে তীব্র কশাঘাত করে যেত লাগলো, সেই ঘা টেস্ট পরীক্ষা অবধি চলে এল। অংক পরীক্ষার আগের রাত থেকেই সে বুঝতে পারছিল পরীক্ষাটা এ সময়ে হওয়া একান্তই উচিৎ নয়। পরীক্ষার হলে সে পুরো তিন ঘন্টা ধরে অংক কষল, কিন্তু খাতাটা জমা দেয়ার সময় থেকেই সে জানতো, তেত্রিশ পেরুনো হবে না, সার্টিফিকেট পরীক্ষা দেয়া হবে না। রেজাল্টের দুদিন আগে অন্য সবার মত, অংক স্যার সবার হাতে খাতা তুলে দিয়ে নাম্বার চেক করতে বললেন, সে দেখতে পেল টপশিটে তার নাম্বার লেখা রয়েছে ৪৫, সে পুরো খাতা উলটে পালটে দেখলো, দুটো ভুল অংকে স্যার তাকে ফুল নাম্বার দিয়ে রেখেছেন! সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো স্যারের কাছে, চোখে-মুখে তার আবিষ্কারের এক নির্দোষ আনন্দ, কিন্তু মুছে গেল কড়া ধমক খেয়ে - স্যারের হুঁশিয়ার তখন ঘাত প্রতিঘাত হচ্ছে শ্রেণীকক্ষে, ‘শুধু যোগে ভুল হইলে আসবি, আর কিছু….’

    দিন গড়াতে থাকে, চন্ডাল পরীও ক্রমাগত মাথা ঠুকে যেতে থাকে কাঁচের দেয়ালে, ভীষন দুলে উঠতে থাকে বোতলটা, এক অচেনা কম্পাঙ্ক ছুঁয়ে যেতে থাকে তার কর্মস্থলকেও। তাকে চৌকিদারের দায়িত্ব দেয়া হয় দৃশ্যপট বদলে দেয়া এক নির্মাণশিল্পের। কর্মের ছটা খইয়ের মত ফুটছে যতদূর চোখ যায়, কর্মোদ্যোগী মানুষের জ্ঞানের দৈর্ঘ্য তার চোখ ঝলসে দেয়, তারা জানে কিভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠকে সেঁচে বাড়ি-ঘর-রাস্তা-ঘাট-বাঁধ এর মুক্তো বের আনতে হয়! মোরসালিন হতবিহবল হয়ে পড়ে, এত সহজ ভুল করে, আর নিজেই তা রাষ্ট্র করে। তার মত অমনোযোগী চাকুরে আর দ্বিতীয়টি নেই এই সাম্রাজ্যে, তার উপরোওয়ালার কাছে পোস্ট হতে শুরু করে অভিযোগনামা। কবে আপিস করেনি, কোথায় ঢিলেমি, নির্বুদ্ধি, অদক্ষতা …. পৌঁছুয় এসবের নিখুঁত নির্ঘন্ট। শেষ বিচারের দিন তার বস অবশ্য খুদ খুঁটে খুঁটে হয়রান হয়ে শেষমেষ রিপোর্টটা ছুঁড়ে ফেলে গা এলিয়ে দেন ঘূর্ণিকেদারায়।

    এদিকে চন্ডাল পরীর রোষ আর যায় না, একদিন সেই আমগাছটা প্রবল ঝড়ে দিগ্বিদিক তড়পাতে থাকে, আর সেদিনই মোরসালিনকে ধরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় পাত্রী দেখাতে - কিন্তু তার বেশভূষা সবার মাঝে পরম বিষ্ময়ের জন্ম দেয় - চুল স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও এলোমেলো, প্যান্টের পাড় স্যান্ডেল ছাড়িয়ে রাস্তার ধুলো ভরে নিয়ে এসেছে তার কোটরে, ঢোলা শার্টের হাত ঝুলে আছে হাত ছাড়িয়ে, মুখ ফুঁড়ে গজিয়ে উঠা দাড়ির বে-আদব ঝোঁপ… একটি জন্তু মানুষের ছল ধরে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো একটি মেয়েটিকে… মামা এক পর্যায়ে মাথায় চাটি দেয়, ‘কি দেখছিছ হাবলার মত?’ সে এতকটু সতর্ক হয় না - সবাইকে বিব্রত করে ঘটনাটি, এদিকে মেয়েটি লজ্জায় কুকড়ে কুকড়ে একসময় মাদাম তুসোর মিউজিয়াম হয়!

    অংকে সবসময়ই খারাপ মোরসালিন। সে তো শুধু কিছু একটা করে যায়, মুহুর্তেরা ডুবে গেলে কি ভেসে উঠে, সে খবর সে কখনো করে না। ঐদিনই সে শৈশবের স্কুলটি পেরুচ্ছিল আর ভাবছিল, কত আগের হবে? সে ঐ ছেলেটিকে ধরতে চাইছিল যে কিনা হাঁটছিল ঐ স্কুলের চত্বরেই … কাঁধে স্কুল ব্যগ ও হাতে ফ্লাস্ক ঝুলিয়ে নিবিষ্ট মনে পার হচ্ছিল বাসা ও স্কুলকে গেঁথে দেয়া সিকি মাইলের গলিটি, পকেটে গোঁজা সদ্য তোলা একটি শিশির ভেজা টগর, ম্যাডামের চোখ নিবদ্ধ রোলকল খাতায়… নরম গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে আর্তি ঝুরে পড়ে, “গুড মর্নিং, ম্যাডাম’’, এরপর বেঞ্চের উপর হাতের ঘর করে মাথাটা তার মধ্যে গলিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে টপ টপ জল নিঃসরণ।

    ঐ একবারই একটি ঐকিক নিয়ম কষেছিল সে, জীবনে মাত্র একবার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছিল, পাঁচ বছর পর কি ঘটতে যাচ্ছে, দশ বছর পর .. বিশ বছর…...সেও এক সময় পড়াশুনোর পাট চুকোবে, এরপর বড় একটা চাকুরি নেবে, এরপর মামার মত তারও একখানি সংসার হবে… ঐ তো দেখা যাচ্ছে তার পায়ের নিখুঁত-নির্ভুল ছাপ! এইতো মাত্র কিছুক্ষন আগেই সে হেঁটে গেছে! বড়জোর কয়েকটা মিনিট!.... হঠাৎ মোবাইল ফোনের তীব্র আর্তনাদ, ওপার থেকে মায়ের উত্তেজিত কন্ঠ … ঐ পক্ষ জানতে চেয়েছে, তাদের মেয়েকে ছেলের পছন্দ হয়েছে কিনা। সন্ধ্যেয় বাড়ি ফেরার পর কানে এল একটি ভেতরের খবর যা বাতাস ফুঁড়ে বের করে এনেছে তার মামা, মেয়েটিও নাকি কেমন ভুতুড়ে আচরণ করছে গতকাল থেকেই।

    এর মাঝে অনেক বার মৃত্যু হয়েছে মোরসালিনের, কিন্তু আজকের মত এতটা ঝাঁকুনি দিয়ে যায়নি আর কোনটি! মৃত্যু হলেও সে চুপি চুপি বেঁচে উঠে, আর তা কেউই জানতে পারে না… মৃত্যুগুলির পর সে তো নতুন এক জগতে এসে পড়ে, রিলে রেসের মত আগের জগতের যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু করে… টেস্ট ফেলের পরেও সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সগৌরবে আবির্ভূত হয়, চাকুরিচ্যুত হয়েও চৌকিদারি করে যায় নতুন এক রিলে ধরে… যে নতুন জগৎটাতে এই রাতে সে এসে পড়েছিল সেখানেও একজনের মৃত্যু হয়েছে নিশ্চিত, কিন্তু তা অজানা থেকে গিয়েছিল গ্যালারির, যার চোখে পুরো রেসটা তো একটাই ঢেউয়ের মত ছুটে চলে!

    এদিকে স্মৃতিতে যদিও নতুন জগতটাই ছিল, মোরসালিনের খালি মনে হত লাগলো, আজ রাতের ঘটনাটা আগে ঘটেছিল … স্মৃতির দরজাটা তখন ঘূর্নি হাওয়ার তোড়ে ঘরের ভেতর ও বাইরের দেয়ালে বিপুল শব্দে বাড়ি খাচ্ছিল… এক পর্যায়ে সে নিশ্চিত হয় যে ঘটনাটা সে আগে থেকেই জানতো। সে দ্রুত দৌড়ে যায় জানালাটার দিকে… নানাবাড়ির সেই বটগাছটার উপর দেখতে পায় এক অদ্ভুত রশ্মি, পাতাগুলোকে গ্রাস করে নিচ্ছে এক লেলিহান দানব! … মোরসালিন ভূতই থেকে যায় সারা জীবন, মানুষ হওয়া আর হয় না তার।

    সেদিনের সেই ঝড়ে আমগাছটার সাথে মাটি চাপা দেয়া বোতলটাও ভেঙ্গে খান খান হয়। কবরস্থানটা উন্মাতাল রাতের পর এখন শান্ত সমুদ্র। পাতালপুরী থেকে কদাচিৎ ভেসে আসে নানাজানের ক্ষীণ কন্ঠ, ‘সবই তাঁর কেরামতি!’
    .....
    (সমাপ্ত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৪ মার্চ ২০২৩ | ৭৩৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীপাঞ্জন | 223.191.53.115 | ২৫ মার্চ ২০২৩ ১৬:২৬517833
  • মোরসালিনকে নিয়ে গল্পের সিরিজ লিখছেন ? yes​​
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২৫ মার্চ ২০২৩ ২৩:৫৫517839
  • @দীপাঞ্জন দাদা 
    না,সেরকম কিছু নয়। আসলে প্রতি গল্পে একটি করে নতুন নাম বাছাই করা আমার মত অলস মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য বলেই চালিয়ে দিচ্ছি আর কি! ভাল থাকবেন দাদা! 
  • হীরেন সিংহরায় | ২৬ মার্চ ২০২৩ ০০:৪৪517841
  • মামুন 
    আপনার গদ্যের গতি অসামান্য শব্দ চয়ন আমার ঈর্ষা  উদ্রেক করে 
  • Ranjan Roy | ২৬ মার্চ ২০২৩ ০৮:১৯517856
  • "স্মৃতির দরজাটা তখন ঘূর্নি হাওয়ার তোড়ে ঘরের ভেতর ও বাইরের দেয়ালে বিপুল শব্দে বাড়ি খাচ্ছিল… "
     
    --এরকম একটি চিত্রকল্প নির্মাণের জন্যে লেখককে সালাম।
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ২৬ মার্চ ২০২৩ ০৮:৪৫517859
  • অসামান্য শব্দ-মায়া।
     
    (কোন এক টইয়ে লামা তাঁর বন্ধুদের গল্প লিখেছিলেন। মনে পড়ে গেল।)
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২৭ মার্চ ২০২৩ ১৯:২৩517935
  • @হীরেন সিংহরায় 
    অশেষ ধন্যবাদ দাদা । অশেষ শক্তি যোগাল।
    @রঞ্জন রায় 
    অশেষ ধন্যবাদ দাদা। খুব অণুপ্রাণিত হলাম।
    @অমিতাভ চক্রবর্তী
    টইয়ের সেই বন্ধুদের গল্পটি পড়ার বিশেষ আগ্রহ অনুভব করছি। অশেষ ধন্যবাদ দাদা। 
     
  • এস এস অরুন্ধতী | ২১ এপ্রিল ২০২৩ ০০:৫১518868
  • এই ধরণের আখ্যান আসলে গল্প পড়ার বিনোদনের অভ্যন্তরে গিয়ে একটা গহীন বোধে ধাক্কা মারে। দীর্ঘ সময় রেশ রেখে যাবার মত একটি কাহিনী। জাস্ট অসাম। 
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২১ এপ্রিল ২০২৩ ০১:৩৭518871
  • @এস এস অরুন্ধতীদি,
    আপনার এই মন্তব্য অনেকখানি শক্তি যোগাল দিদি। আমি খুব কৃতজ্ঞ আপনার কাছে, দিদি। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন