এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • কোথায় তোমার দেশ গো বন্ধু? পর্ব ১২

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৯ জানুয়ারি ২০২২ | ১৩১০ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • “তোমার শরীর নেই, তোমার আত্মাও আজ ঢেকে গেছে ঘাসে”

    সম্ভবতঃ আরও দু’মাস কেটে গেছে। এখানে সময়ের হিসেব রাখা কঠিন, আগেই বলেছিলাম। আর নভেলের কায়দায় দেয়ালের গায়ে আঁচড় কেটে রাখব, ওটা কেমন ছেলেমানুষি মনে হল। আমি তো এখানে সারাজীবন থাকব না। আমার শিক্ষানবিশী চলছে, প্রোবেশন বলতে পারেন। কথা ছিল একবছরের। আমি নিশ্চিত, এখনও তার ধারে কাছে নেই। এসেছিলাম এক ডিসেম্বরের শীতের রাতে। এখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চারদিকে ঘন গাছপালা, বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। আনমনা হয়ে যাই। এই সময় সবিতার কথা খুব মনে হয়।

    কবে যে এই যাত্রাপালা শেষ হবে? আমাকে দিতে হবে স্লীপার সেলের সুলুক-সন্ধান। নইলে আমিই নাকি সেই স্লীপার সেল। কেন ? প্রথম জীবনে বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম বলে? সেতো তখন বাঙলার আদ্দেক ছাত্রই ছিল , কোন-না-কোন ভাবে। অবশ্য মাঝবয়সে চাকরি করার সময় শিক্ষকজীবনে কিছু রাজনীতির ক্লাস নিয়েছি, স্কুলের বাইরে। সেসব তো কবে চুকে বুকে গেছে।

    আসলে আমার মনে হয়েছিল আমাদের প্রজন্মের কাছে মার্ক্সবাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল এক নৈতিক অবস্থান। একেবারে সেইঃ

    ‘কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে।
    চোখ ফেটে এল জল,
    এমনি করে কি জগত জুড়িয়া মার খাবে দূর্বল‘?

    কিন্তু চাকরি করতে করতে সেই আকর্ষণ কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল। আর অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের পার্টি শিক্ষামালা মেনে ‘মজুরি-দাম-মুনাফা’ থেকে বাঁধা গতে কিছু ভারি ভারি শব্দ শেখানো -- সারপ্লাস ভ্যালু , ইউজ ভ্যালু, এক্সচেঞ্জ ভ্যালু, রেট অফ এক্সপ্লয়টেশন, নেসাসারি টাইম – বড্ড একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর লাগছিল। শেষে স্বাস্থ্যের অজুহাতে ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দিলাম। হ্যাঁ, বছরে কয়েকবার কোন মিছিলে বা সম্মেলনে মুখ দেখিয়েছি।

    সিরাজুল মিঞাও কিছু শান্ত হয়েছে মনে হয়। তবে সপ্তাহে দু’বার করে ওর আলাদা সেশন নিচ্ছে এখানকার কর্তাব্যক্তিরা। বেশিক্ষণ নয়—এক আধ ঘন্টা করে। তার চোটেই ও ফেরে ক্লান্ত হয়ে; কথা বলতে চায় না। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়। ব্যাপারটা কী? যাকগে, যথাসময়ে জানা যাবে।

    এদিকে আমারও একটা ব্যাপার হয়েছে। দু’মাস আগে সেই যে প্রিয়ংবদাকে নিয়ে নালিশ করার সময় বারান্দায় একজন তালঢ্যাঙা লোক বলেছিল –দুপুরে খাওয়ার সময় সবার শেষে থালা ধোবার কথা। সেটা আমি মনে রেখেছিলাম। রান্নাঘরের বাইরে পেছনের বারান্দায় কলতলা, উঁচু মত প্ল্যাটফর্মে পর পর পাঁচটা কল, পাশে বাসন ধোবার জন্য একটা সোপকেসে গুঁড়ো সাবান, ধুঁধুলের খোসা এবং স্পঞ্জ। সেখানে সিরাজুল ও দু’একজন স্টাফের বাসন ধুয়ে চলে যাবার পর আমিও নিজের এঁটো থালাবাটি নিয়ে রোজের মত হাজির হলাম। ধীরে ধীরে আলতো হাতে মাজা শুরু করলাম। কেউ কোথাও নেই। শুধু রান্নাঘরের ইনচার্জ ভরত মণ্ডল একবার বলে গেল—কী ব্যাপার মাস্টার? আজ যে একটু ঢিলেঢালা ভাব? শরীর ঠিক আছে তো? শোন, খারাপ লাগলে আগে থেকে বলবে, ডাক্তারবাবুকে খবর দেব।

    আমি মাথা নেড়ে হেসে বলি—একটু আলসেমি, ব্যস্‌ চিন্তা করার মত কিছু নয়।

    থালা শেষ করে ধুয়ে বাটি ও চামচে হাত লাগিয়েছি কি কানের কাছে প্রায় ফিসফিস আওয়াজে শুনলাম—এই জায়গাটায় কোন সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। সেই জন্য এখানে আসতে বলেছিলাম।

    তোমাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে সেটা লম্বা করে টেনে যাও, উলের গোলার মত।

    --কেন ?

    -- মাস্টার তুমি নির্বোধ। ওদের গেমটা বুঝতে সময় লাগবে। যা লিখবে সেটা যেন শেষ না হয়।

    --মিথ্যে কথা বললে প্রিয়ংবদা ধরে ফেলে।

    --ধূর! সবচেয়ে ভাল মিথ্যে সেটাই যেটা সত্যের কাছাকাছি, অর্থাৎ ৯৫ প্রতিশত সত্যি, কিন্তু এসেনশিয়াল ৫% বানানো। যা হলেও হতে পারত, কিন্তু বাস্তবে ঘটেনি। প্রিয়ংবদা কয়েকটা প্যাটার্নের মিথ্যে ধরতে পারে, সব নয়। ওর দৌড় তুমি একটু একটু করে বুঝতে পারবে। ওদের আশা জাগিয়ে রাখ। এবার কেটে পড়।

    বিজয় স্যার

    উনি ছিলেন আমার নাকতলা স্কুলের মাস্টারমশায়, পড়াতেন ইকনমিক্স। স্কুলে পরে আসতেন সাদা শার্ট, সাদা ধুতি—হাতে কাচা এবং নীল দেওয়া। ওনার বাচনভঙ্গি, শান্তভাবে বিরুদ্ধ মতের বক্তব্য শোনা এবং বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করেছিল। হালতুতে ওনার বাড়ি গেছলাম এক রোববারে। সেই দরমার বেড়া ও টিন এবং টালির চাল-- নেতাজিনগর, বাপুজিনগর, বিদ্যাসাগর ও রামগড় কলোনীতে উদ্বাস্তুদের সব ঘর যেমনটি হয়। রোদ্দূর বেশ চড়া, পাশের কোন ঘরে কোন মাস্টারমশাই গান শেখাচ্ছেনঃ

    ‘নিত্যকালের উৎসব তব বিশ্বের দীপালিকা,

    আমি তারি সেই মাটির প্রদীপ জ্বালাও তাহার শিখা’।

    আমার মন কেমন করে উঠল। আমি কি স্যারের মাটির প্রদীপ? উনি আজ আমাকে দীক্ষা দেবেন! শিখা জ্বলবে!

    স্যার বাজারে গিয়েছিলেন। আমি একটা কাঠের টুলে বসে মন দিয়ে পাশের বাড়ির গান শুনছিলাম, তবলা বাজছে, তেহাই দিয়ে শেষ হোল। স্যার থলিহাতে ঢুকলেন। আমাকে দেখে খুব খুশি। ঘামে ভেজা পাঞ্জাবিটা খুলে একটা দড়ির উপর টাঙিয়ে দিলেন। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন- কিছু মনে কর না। গেঞ্জিটা খুলছি।

    আমার মনে পড়ল পাঠ সংকলনে পড়া উত্তেজিত রামমোহনের উক্তিঃ যদি কিছু মনে না কর, তবে গায়ের পিরান খুলি!

    স্যারের বাড়িতে পাখা নেই, স্যারও গরীব। আমাদের বাড়িতে অন্ততঃ সিলিং ফ্যান আছে। ঠিক; গরীবের দলের কর্মীদের জীবনযাপন তো অমনিই হয়, হওয়া উচিৎ।

    আমি দেখলাম, স্যার বড্ড রোগা পেটের একদিকে একটা অপারেশনের দাগ। স্যার খেয়াল করে বললেন-অ্যাপেন্ডিসাইটিস।

    আমি কিছুই বুঝলাম না। একটা চায়ের প্লেটে করে আমাদের দুজনের জন্যে সেঁকা পাউঁরুটি আর ঝোলাগুড় এল। দুজনেই খেলাম খুব তৃপ্তি করে। এরপর ছোট্ট কাপে এল গুড়ের চা। আগে কখনও খাইনি।

    তারপর কথা শুরু হল-অনেক কথা। ফেরার সময় স্যার দিলেন দুটো বই—এমিল বার্নসের ‘মার্ক্সবাদ’ এবং সৌরী ঘটকের উপন্যাস ‘কমরেড’।

    কিন্তু বছর দুই পরে যখন ‘তোমার বাড়ি ,আমার বাড়ি –নকশালবাড়ি খড়িবাড়ি’! শ্লোগানে কাঁপছে ইউনিভার্সিটির দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং আর আমরা খানিকটা বিভ্রান্ত, তখন বিজয় স্যারকে কেউ চুকলি করল যে আপনার তারিণী ছোঁড়া বখে গেছে। প্রেসিডেন্সির বড়োলোক বাড়ির বখা ছেলেগুলোর সাগরেদি করছে। ওকে রোজ কফিহাউসে দেখা যাচ্ছে। কফি খাওয়ার পয়সা কে জোগাচ্ছে কে জানে!

    স্যার খবর পাঠালেন। আমি এড়িয়ে গেলাম, সাহস পাইনি।

    শেষে একদিন মনুমেন্ট ময়দানে বৃষ্টিভেজা দিনে আচমকা স্যারের সামনে পড়ে গেলাম। বোধহয় ভিয়েতনাম দিবস ছিল । একটা বই সাজানো টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পাতা ওল্টাচ্ছি পিঠে কেউ হাত রাখল। চমকে তাকাতেই দেখি স্যারের হাসিমুখ। --কী হে তারিণী, কী রাজনীতি করছ আজকাল? নরম না গরম? নাকি ঠিক ঠিক?

    কেন যেন পিত্তি জ্বলে গেল।

    -স্যার, কোনটা যে ঠিক ঠিক, সেটাই বা কে ঠিক করবে? এগুলো তো আপনার আমার পারসেপশন, মানে সাবজেক্টিভ। একটা সময় ধরে প্রয়োগের পর বলা যাবে।

    স্যার, আমাকে অবাক চোখে দেখলেন। তারপর সঙ্গের যুবকটির সংগে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন।

    খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬৬।


    তিন বছরের মধ্যে দু-দুটো যুদ্ধ। প্রথমে চীন, পরে পাকিস্তান। আমেরিকার দেওয়া প্যাটন ট্যাঙ্ক ও স্যাবর জেট ফাইটার প্লেন পেয়ে পাকিস্তান অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। ওদুটোর টেস্ট কেস হোল কাশ্মীরের মাটিতে। ভারতের সম্বল বৈজয়ন্ত ট্যাংক ও মিরাজ বিমান।

    ভারত জিতল বটে, কিন্তু ইকনমির হাল হোল খাস্তা। খাদ্যসংকট চরমে।

    তখন রেশনে জুটছে মোটা কাঁকরমণি লাল চাল আর গাঁয়ের দিকে মাইলো, আমেরিকার পি এল ৪৮০ খয়রাতি প্রোগ্রামের থেকে পাওয়া। শস্তায় ভাল চাল পাওয়া যাচ্ছে কোলকাতার বাইরে। কিন্তু জেলায় জেলায় কর্ডন। এক জেলার থেকে অন্য জেলায় বা কোলকাতায় চাল নিয়ে আসা বে-আইনি। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। একবার বাঁশদ্রোনীর উষা পুল পেরিয়ে সেজকার সংগে ভাল চাল কিনে ফিরছি।কাকার ব্যাগে দশ কিলো, আমার পাঁচ। গঙ্গার খালের ওপারে চব্বিশ পরগণা, এপারে কোলকাতা।

    রায়পুর চব্বিশ পরগণা, বাঁশদ্রোণী কোলকাতা। তখনো পিনকোড শুরু হয়নি। পুলের উপর হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ আটকালো। কী নিয়ে যাচ্ছেন? চাল। কত ? পনের কিলো। আরে মশাই, আমরা কি চ্যালাকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব?

    তখনও ভারত রক্ষা আইন তুলে নেওয়া হয়নি। একবছর আগে ভারত-পাকিস্তান দ্বিতীয় যুদ্ধের জের। বামপন্থী নেতারা সব জেলে। কিন্তু গাঁয়ের দিকে চালের সংগে কেরোসিনেরও আকাল। একেবারে হাতে হ্যারিকেন কেস। ছাত্ররা পড়বে কী করে?

    লোক পথে নামল। মিছিল বের করল। বাদুড়িয়া ও স্বরূপনগরে কেরোসিনের দাবিতে মিছিল করা ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি চলল। নুরুল ইসলাম ও আরেকটি ক্লাস ফাইভের ছাত্র মারা গেল।

    লোক খেপে গেল, মিছিলের সংখ্যা বেড়ে গেল। রেল অবরোধ, হরতাল। মিলিটারির রুট মার্চ। অজিত পান্ডে গান গাইলেন—ও নুরুলের মা, সারাদিন চোখের জলে বান ডাকাইয়া জমিন ভিজাস না!

    স্বদেশ স্যার


    বাঘাযতীন স্কুলে ফুড কনভেনশনে গণনাট্য সংঘের নাটক দেখার লোভে গেলাম। গিয়ে দেখি আমাদের স্বদেশ স্যার স্টেজে উঠে খোলা গলায় নিজের লেখা গান গাইছেন –

    “ নম নম নম নম স্বদেশী স্বরাজ,
    যার রাজত্বে জনগণের মাথায় পড়ল বাজ”।

    স্বদেশ স্যার পড়াতেন ইতিহাস আর দায়িত্ব নিতেন স্কুলের ফুটবল টিম গড়ার। স্কাউটিং করতেন কাছাকাছি কোন স্কুলে কোন উঠতি প্লেয়ার ভাল খেলছে। তাদের পরের বছর নাকতলা স্কুলে নিয়ে আসতেন। এভাবে বাপুজি নগর উদ্বাস্তু বিদ্যালয় থেকে এল সেন্টার ফরওয়ার্ড স্বরাজ ও সেন্টার হাফ কেশব। কারণ স্যারের হিসেবে এই দুটো পজিশনে স্কুলের সেট প্লেয়ারেরা পাশ করে একবছর আগে বেরিয়ে গেছে। বদলে যারা খেলছে তারা বেশ নড়বড়ে।

    দক্ষিণ কোলকাতা লীগের খেলায় লেকের মাঠে চেতলা বয়েজ স্কুলের হয়ে খেলতে নামা একজন হাট্টাকাট্টা চেহারার সুভাষ ভৌমিক বলে উঠতি প্লেয়ার আমাদের গুণে গুণে সাতটা গোল দিল। আমরা অতিকষ্টে একটা শোধ দিতে পেরে ছিলাম। আসলে ওই ভৌমিক একাই একশ’। নিজেদের ডিফেন্স থেকে বল ধরে আমাদের সাতজনকে ড্রিবল করে কাটিয়ে গোলে বল ঠেলে দিল!

    যাইহোক , কেশব আর স্বরাজ আমার ক্লাসে ইলেভেন আর্টসে ভর্তি হোল। স্যার আমাকে ডেকে চুপিচুপি বললেন—ওরা খেটে খাওয়া গরীব ঘরের ছেলে। লেখাপড়ার ভিতটা দুর্বল। তুই ওদের একটু ইংরেজি আর ইকনমিক্স দেখিয়ে দিবি? সপ্তাহে দু’দিন একঘন্টা করে? স্কুলের ছুটির পর? তোরও রিভিশন হয়ে যাবে।

    আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। জনতা রেলস্টেশনে আগুন লাগাচ্ছে। রেশনের দোকান, চালের গুদাম লুঠ হচ্ছে। তখন অকৃতদার প্রবীণ গান্ধীবাদী কংগ্রেসি নেতা প্রফুল্ল সেন একাধারে খাদ্য ও মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু আমরা স্কুলের ছাত্ররা গান্ধীবাদী নেতার নতুন অবতার দেখে হতভম্ব।

    কৃষ্ণনগর ও কোন্নগরে কারফিউ এবং মিলিটারি গুলি চালাচ্ছে। খবরের কাগজ লিখল—উনি নাকি রাইটার্সে ব্যঙ্গ করে দু’কলি গুনগুন করেছেন, ‘কৃষ্ণনগর ডুবুডুবু, কোন্ননগর ভেসে যায় রে’!

    রাস্তায় লোকের মিছিলে শ্লোগান বদলে গেল। আগে ছিল –এই বর্বর পুলিশি হামলার জবাব চাই!

    এখন নতুন শ্লোগান উঠল—‘পুলিশ যদি আঘাত হানে, পাল্টা আঘাত হানতে হবে।

    আমি নিশ্চিত হলাম যে গান্ধীবাদী-টাদি সব ভেকধারী, আমার ভরসা সুভাষ মুখুজ্জের কবিতাঃ

    “কুয়াশা -কঠিন বাসর যে সম্মুখে, লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা,
    দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশংকুকে,কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না”!

    ইতিহাস ক্লাসের সময় আমার অফ পিরিয়ড। আমি স্বদেশ স্যারের ক্লাসে গিয়ে নিয়মিত বসি। মুগ্ধ হয়ে শুনি উনি কেমন হাসিমুখে অনাটকীয় ভাবে পড়িয়ে যাচ্ছেন ফরাসী বিপ্লব। বুঝিয়ে দিচ্ছেন জ্যাকোবিন ও জিরন্ডিস্টদের তফাৎ।

    একসময় আন্দোলন থেমে গেল। জরুরী অবস্থা উঠে গেল। ভারত রক্ষা আইন তুলে নেওয়া হোল। আমি একদিন স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে মিছিল করে বিডিও অফিসে গিয়ে স্মারক পত্র দিলাম। কিন্তু জানলা দিয়ে উড়ে আসা একটা টোম্যাটো বিডিও’র টেবিলে পড়ে ছেতরে গিয়ে আমার জমা দেওয়া স্মারক পত্রে লাল স্বাক্ষর রাখল।ভদ্রলোক খেপে গিয়ে আমাকে বললেন—এসব কী! খাদ্য সংকটে খাবার নষ্ট! যাও স্কুলে ফিরে গিয়ে ভাল করে পড়াশুনো কর। রাজনীতি বড়দের কাজ, তোমাদের কাজ লেখাপড়া করা।

    ফেরার পথে আনন্দ আশ্রম গার্লস স্কুলে গিয়ে মেয়েদের ছুটি দিতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু স্কুলের দিদিমণিরা আমাদের গেটের ওপারে যেতে দিলেন না। আদ্দেক দরজা খুলে ওখান থেকেই বকুনি লাগালেন। আমি বোঝালাম—কোন জবরদস্তি করছি না। আমাকে ভেতরে গিয়ে মেয়েদের সামনে বক্তব্য রাখতে দিন, তারপরে ওরা যদি বেরিয়ে আসতে রাজি হয়!

    -হ্যাঁ, হ্যাঁ, দাদারা ডাকলে বোনেরা বেরোবে না? পদ্মশ্রী সিনেমা হলে নতুন বই শুরু হয়েছে যে!

    এরপর এল সারা বাংলা জুড়ে শহীদ দিবস। আমি একটা আবেদন পত্র লিখে স্টাফ রুমে গিয়ে সব স্যারের থেকে সাহায্য চাইলাম—শহীদ বেদী বানাব। অল্প কিছু ইঁট সিমেন্ট বালি রঙ কিনতে হবে। রাজমিস্ত্রিকে ঘন্টা দুয়েকের মজুরি দেব আর বাঁশদ্রোণী বাজার থেকে কিছু সাদা ফুল কিনব।

    সবাই কিছু কিছু দিলেন—আট আনা থেকে একটাকা পর্য্যন্ত। একটা দিন তখনও বাকি। স্বদেশ স্যারের জ্বর হয়েছে, স্কুলে আসেন নি। বিকেলে ফুটবলার কেশবের সংগে খাল পেরিয়ে বিধানপল্লীতে স্যারের বাড়িতে হাজির হলাম। টিনের চাল ও চাটাইয়ের বেড়ার সাধারণ বাড়ি। স্যারের স্ত্রী বেরিয়ে এসে বললেন—অ্যানাসিন খেয়ে শুয়ে আছে।

    আমরা ফিরে আসব কিনা ভাবছি, স্যার বেড়িয়ে এলেন লুঙ্গিপরা অবস্থায়। সব শুনে গিন্নিকে বললেন—একটা টাকা দিয়ে দাও।

    টাকা পেলাম, কিন্তু বৌদির মুখে অপ্রসন্ন ভাব।

    শহীদ বেদী হোল, কালো রঙে লেপে দেওয়া। আমরা সবাই সাদাফুলের মালায় তাকে ঢেকে দিলাম। অনেকে বক্তব্য রাখলেন। যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন দেখি রোদ্দূরের মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে স্যার হাজির। ডেকে নিলেন নাইনের সন্দীপকে, ও স্যারের কাছে গান শিখত।

    তারপর দরাজ গলায় শুরু করলেনঃ

    ‘ঝঞ্ঝা-ঝড়-মৃত্যু-দুর্বিপাক।
    ভয় যারা পায় তাদের ছায়া দূর মিলাক, তাদের ছায়া দূর মিলাক’।
    একটু পরে জ্বরক্লান্ত গলা কাঁপতে লাগল। ততক্ষণে গানটা ধরে নিয়েছে সন্দীপ।

    কলেজ পেরিয়ে নাকতলা স্কুলে চাকরি করতে গিয়ে দেখি সেই শহীদ বেদী এখনও দাঁড়িয়ে আছে, হয়ত বর্তমান ছাত্ররা জানেনা কিসের শহীদ বেদী, বা শোনেনি নুরুল ইসলাম বলে স্বরূপনগরের ক্লাস ফাইভের ছেলেটার নাম। কিন্তু তার চারদিকে লোহার শিকের বেড়া। যাতে ছেলের দলের পা না লেগে যায়, বল লেগে ভেঙে না যায়।

    কে করেছে? কে আবার, আমাদের সবুজ সাথী ফুটবল ক্লাবের ভবানীদা। এখন মাঠের উলটো দিকে ভারতী বালিকা বিদ্যালয় থুড়ি ১২৭৬ নম্বর ডিটেনশন সেন্টারের চাপরাশি, এখনও ঘন্টা বাজায়।

    আজ বোধহয় ১০ ইউনিটের বেশি কাজ করেছি। পিঠ ধরে গেছে। প্রিয়ংবদার দিকে তাকাতেই ও কব্জাওলা স্কেলিটন- হাতের ঝটকায় নিয়মমাফিক একটা সেন্সর রে প্রিন্টারের উপর ফেলল। ঘড়ঘড়িয়ে প্রিন্টার চালু হয়ে গেল।

    ‘ভাসন্ত শবের মুখে বসেছিল দক্ষিণের পাখি’


    আবার ডাক পড়েছে, আর ভাল লাগেনা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই কথা। স্লীপার সেলের বুড়ো ঘাঘুমালটি কে? তুমি নও? হয়ত তুমি তাকে চেন। বলে দাও, বলে ফেল। নইলে স্মৃতির অতল খুঁড়ে তুলে আন এমন রতন যার থেকে আমরা সন্ধান পাব। বুঝে যাব।

    কিন্তু আজকে মাত্র দু’জন। আগন্তুক ব্যক্তিটি রোগা লম্বা, বয়েস আমার চেয়ে সামান্য কম, তোবড়ানো গাল, মাথাভর্তি সাদা চুল, চিরুনি পড়ে না। তাই ঝুলঝাড়ার ডান্ডার মত দেখাচ্ছে। যত্ন করে দাড়ি কামিয়েছে, তবে পরণের সাদা হাফ হাতা শার্ট ও পায়জামার কাপড় খুব সাধারণ।

    পুরনো জন নতুন ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দিলেন। উনি হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং আমি ইতস্ততঃ করছি দেখে সিগ্রেট খাওয়া দাঁতে হেসে উঠলেন ।

    -ইনি আপনার জাতভাই, মাস্টারমশায়।

    বাঙালি? দেখে তো মনে হচ্ছে না। উনি বাড়িয়ে দেয়া হাত টেনে নেননি। আমি আলতো করে ছুঁয়ে দিলাম। কিন্তু কমলি দেখছি নাছোড়োবান্দা! শক্ত করে ধরে দু’বার ঝাঁকিয়ে বললেন—আমি সতীশ দীঘে। আমাকে সবাই ভাঊ বলে ডাকে।

    আমার চোখে প্রশ্নঃ জাতভাই!

    --আরে উনি আপনারই মত এক্স-কমরেড, নাগপুরের কলেজে ইকনমিক্স পড়াতেন, লালঝাণ্ডার দল ছেড়ে এখন আমাদের কাজ করছেন। আপনাদের জমবে ভাল। দেখবেন, আলাপ করে আপনার ভাল লাগবে। আমি এখন চলি।

    আমরা দু’জনে বসলাম দুটো কাঁচের ছোট গেলাসে লাল চা নিয়ে। আমাদের হাতে জ্বলছে পানামা সিগ্রেট। কেমন যেন দেজা ভু হচ্ছে।

    রামগড়ের চায়ের দোকান। দু’দিকে দুটো খুঁটির উপর বাঁশের চাটাই পেতে পেরেক ঠুকে বসার জায়গা আর তিনদিকে চাটাইয়ের বেড়া। জুকভদা আর বিল্টুদা আমাকে বোঝাচ্ছে। আমি ভুল পথে যাচ্ছি, কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় ইডেন হোস্টেল ও কফি হাউসের আড্ডা আমার বিশ্বাসের কাঠামোয় ঘুণ ধরিয়েছে।

    নকশালরা ভুলভাল বকে। ভারত একটি স্বাধীন রিপাবলিক, কখনই আমেরিকা-ইংল্যান্ডের নিও -কলোনি নয়। ভারতের ক্ষমতায় যারা এসেছে তারা এদেশের পুঁজিপতি, ন্যাশনালিস্ট বুর্জোয়া। ওদের বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সংগে আর্থিক ও টেকনোলজিক্যাল সাহায্য নিয়ে দরাদরি করার ক্ষমতা রয়েছে। দরকার মত এরা সাম্রাজ্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক—দুই শিবিরের সঙ্গেই গলাগলি করে। সাপের গালেও চুমু খায়, ব্যাঙের গালেও খায়।

    আর বুঝে দ্যাখ, তিরিশের দশকের চীন আর ষাটের দশকের ভারত—দুটো এক নয়। ওদের রাষ্ট্র ছিল ডিসেন্ট্রালাইজড—একগাদা সামন্তপ্রভু ও যুদ্ধবাজ ভাড়াটে সৈন্যসামন্তের জোরে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করছিল। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্র ও সৈন্যবাহিনী ভীষণ ভাবে সেন্ট্রালাইজড। সৈন্যরা মাইনে পায়, দেশপ্রেম বলে একটা ইমোশন আছে। এখানে ও’রকম ভাবে মুক্তাঞ্চল বা লিবারেটেড জোন টিঁকে থাকতে পারেনা।

    আরও আছে,--জুকভদা থামলে বিল্টুদা শুরু হয়ে যায়—ওদের একটাই জাতি হান, একটাই ভাষা মান্দারিন, মূলতঃ একটাই ধর্ম—কনফুশিয়ান ও বৌদ্ধ। আমাদের মত তিরিশটা ভাষা , পাঁচরকমের ধর্ম—এতসব জগাখিচুড়ি নেই। ওদের নকল করতে গেলে মরবি। হাতে থাকবে পেনসিল।

    আমি সতীশভাউকে বলি—শিং ভেঙে বাছুরের দলে? নাকি সাতশো চুহা খেয়ে বিল্লি গেল হজ করতে?

    সতীশভাউ হো হো করে হেসে ওঠেন। বলেছেন ভাল, ধরে নিন দুটোই খানিকটা করে সত্যি।

    তারপর নিভন্ত পানামায় জোরে দুটো টান মেরে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতে দিতে বলেনঃ আসলে কী জানেন? কমিউনিস্ট থেকে হিন্দু রাষ্ট্রবাদী হওয়া বেশ সহজ। তাই আমার বিশেষ অসুবিধে হয়নি। আপনারও হবে না।

    আমি চমকে উঠি। কীরকম? একটু ঝেড়ে কাশলে বুঝতে সুবিধে হয়।

    --দেখুন, দুটো দলের তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক ভাবনা চিন্তায় বেশ মিল রয়েছে। অবশ্য জার্গনগুলো আলাদা।

    যেমন, দুটো দলই ক্যাডার বেসড, মাস পার্টি নয়। দুটো দলই মনে করে ইতিহাসের সাক্ষ্য ওদের পক্ষে। তোমরা মনে কর দুনিয়া জুড়ে সাম্যবাদ ইতিহাসের ভবিতব্য, আজ নয় কাল হবেই। আমরা মনে করি ভারতের ভবিতব্য হিন্দুরাষ্ট্র, আজ নয় তো কাল। অনেকটা হয়ে এসেছে।

    তোমাদের স্বপ্নের রাষ্ট্রে হবে সর্বহারার একনায়কত্ব, যা আসলে একটা গোষ্ঠীর একনায়কত্ব দিয়ে শুরু হয়ে একজন মার্শাল একজন মহানায়ক বা কান্ডারীর শাসনে দাঁড়ায়। স্তালিন -মাও হয়ে কিম ইল সুং থেকে শি পিং -পুতিন সবার মডেল দেখ।

    আমি উত্তেজিত হয়ে বাধা দিই। বাজে কথা! অন্ততঃ স্তালিন মাও সম্বন্ধে এগুলো খাটে না।

    ভাউ মুচকি হাসে। আমি সত্তরের দশকে পিকিং রেডিওর বুলেটিন শুনতাম –হিন্দি ও ইংরেজিতে। এছাড়া তখনকার রেড ফ্ল্যাগ, পিপলস ডেইলি সবই পড়া আছে। তুমিও পড়েছ ধরে নিচ্ছি। তাতে চেয়ারম্যান মাওকে কথায় কথায় রহনুমা (ত্রাণকর্তা) এবং গ্রেট হেল্মসম্যান বলা হত না? এবং জোসেফ স্তালিন আর কয়েক বছর বাঁচলে যে জেনারেলিসিমো বা মার্শাল হতেন, এসব তথ্য এখন হাতে পাওয়া যায়।

    আমি শুনতে থাকি; এ’ শ্যালক তো দেখি একলহমায় আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। জাতভাই বটেক!

    --তাই বুঝি সংবিধান সংশোধন করে আমাদের আমাদের মহান নেতাকে একাধারে প্রধানমন্ত্রী ও সর্বাধিনায়ক বানানো হয়েছে?

    হাসিতে ফেটে পড়েন ভাউ। ঠিক ধরেছ, সব মহাজনের একই পন্থা।

    --তোমার কথা বুঝতে পারছি, কিন্তু মেনে নিচ্ছি না। তোমাদের আর আমাদের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। আমরা নাস্তিক; মার্ক্সবাদ একটি আদ্যন্ত নিরীশ্বরবাদী দর্শন। আর তোমরা?

    আমিও তুমিতে নেমে আসি। হাজার হোক, লোকটি আমার চেয়ে বয়সে বড় হবে না।

    উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে সতীশ ভাউ।

    -ভো ভো রাজন! শৃণ্বন্তু মম বাক্যম্‌ !

    কে বলেছে নিরীশ্বরবাদী ধর্ম হয় না? ভারতে বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনে কোন সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর নেই। তথাগত বা মহাবীর কেউই দীনদুনিয়ার সৃষ্টিকর্তা নন। এছাড়া আস্তিক ষড়দর্শনে সাংখ্য ও পূর্ব মীমাংসা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।

    আর কমিউনিজমও ধর্ম। ধর্মের সামান্য লক্ষণ –যেমন হোলি বুক, প্রফেট এবং আজকের পঙ্কিল জীবন থেকে উদ্ধারের উপায় সবই কমিউনিজমে রয়েছে। এবং প্রফেট মার্ক্স কোন ভুল করতে পারেন না। বিজ্ঞানের সত্য কন্টিঞ্জেন্ট ট্রুথ, ভুলের সম্ভাবনা স্বীকার করে এগোয়। কিন্তু মার্ক্সবাদ ও অন্যান্য ধর্ম?

    শোন , তুমি তো আমার মতই ইকনমিক্সের ছাত্র। এই গল্পটা শোন। জোয়ান রবিনসন একবার রাশিয়ায় গিয়ে ওখানকার তাবড় তাবড় প্রফেসরদের সংগে বৈঠকে বসে বললেন—মার্ক্স তো মানুষ, দেবতা নন। তাহলে কিছু ভুল করতেই পারেন। সবাই সায় দিলেন।

    তখন রবিনসন বললেন—মার্ক্সের দু’একটা ভুলের কথা বলুন না!

    সবাই নিশ্চুপ, এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।[1]

    শোন, এত কিন্তু কিন্তু করার কী আছে? ধর্মকে বাদ দিয়ে মানুষের চলে না। “ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন সমাজে হৃদয়ের ধুকধুকি, আত্মাহীন পরিবেশের আত্মা”। [2] আমার কথা নয়, খোদ তোমাদের প্রফেট মার্ক্স বলেছেন প্রায় দু’শ বছর আগে।

    --বাঃ , এত সব মুখস্থ করে রেখেছ আর আসল কথাটাই গিলে ফেলেছ? “ধর্ম হচ্ছে জনতার আফিম”। এটাই তো কেকের উপরের চেরি! এটা বাদ দিলে পুরো কোটেশনটার কোন মানে হয় না।

    ভাউ মিটিমিটি হাসে। বলে-চেরি পিকিং তোমরা করেছ। স্থান-কাল বাদ দিয়ে প্রেক্ষিত বাদ দিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছ—ধর্ম হচ্ছে জনতার আফিম! এইজন্যেই তোমাদের আজ এমন হাল। কখনও ভেবে দেখেছ, মার্ক্স পয়জন না বলে ওপিয়াম কেন বললেন? আজ থেকে দুই শতাব্দী আগে এত রকম সেডেটিভ পেইনকিলার ছিল না। তখন মানুষের ব্যথা প্রশমনের জন্য চিকিৎসায় ওপিয়াম ব্যবহার করা হত। ধর্ম সমাধান নয়, কিন্তু সেডেটিভের কাজ করে। সিস্টেমের মার খাওয়া অসহায় একলা মানুষকে ব্যথা সহ্য করে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়। আজও কি ডাক্তাররা মরফিন ইঞ্জেকশন দেন না? ক্যান্সারের রোগীকে?

    মার্ক্স তোমার আমার মত রসকষহীন, অনুভূতি বা আবেগহীন, খিটখিটে অধ্যাপক ছিলেন না। ওঁর প্রাথমিক প্রেরণা ছিল মানুষের দুঃখ দূর করা। আরে বাবা শোষিত মানুষ আগে বাঁচবে তবে তো লড়াই করবে? দুর্ভিক্ষের কংকালের সারি নিয়ে সৈন্যদল গড়া যায় না।

    --আর ধর্মের নামে যত অত্যাচার, নিপীড়ন হয়েছে? মেয়েদের ও দলিতদের সংগে অমানবিক ব্যবহার হয়েছে? এই ভারতেই ত্রিবাংকুর রাজ্যে ইজাভা নাদার আদি দলিত সম্প্রদায়ের মেয়েদের জন্য প্রচলিত ছিল স্তন -শুল্ক। ওরা বুক ঢাকতে পারবে না। বুক ঢাকলে ট্যাক্স দিতে হবে। এই ‘মুলক্করম’ বা ব্রেস্ট ট্যাক্স বন্ধ হয় ১৯২৪ সালে, মাত্র একশ’ বছর আগে। [3]

    আমাদের তর্কের ঝোঁকে খেয়াল ছিল না যে আওয়াজ কখন উদারা মুদারা ছাড়িয়ে তারার নিষাদ ছুঁয়েছে। এবং দরজাটা খালি ভেজানো ছিল, বন্ধ করা কেউ দরকার মনে করি নি। কিন্তু এখন দরজাটা হাট করে খুলে গেছে। শুধু তাই নয়, ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে প্রিয়ংবদা। স্টিম ইঞ্জিনের মত গরম গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে তালে তালে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমি একলাফে কোণের আলমারিটার পেছনে সেঁধিয়ে যাই। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে সাবধানে একটা টেবিলের নীচে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। বিপদের সময় ব্রেন সক্রিয় হয়ে ওঠে। মনে হোল ওর যা গঠন ও টেবিলের নীচে ঢুকতে পারবে না, হাত বাড়ালেও না।

    আতংকিত ভাউয়ের চিৎকার কানে আসে—ভরত, এ ভরত! জলদি আও। এ ক্যা হো রহা হ্যায়?

    তারপর কথা বন্ধ হয়ে শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ । প্রিয়ংবদা ভাউয়ের কোঁকড়ানো সাদাচুল খামচে ধরে টানছে।

    অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ। ভরতের গলার স্বর। -দরজা লক করেননি কেন ? এত ক্যালানে হলে চলে?

    ভরত মাটিতে পড়েথাকা সতীশভাউয়ের চোখে মুখে জলের ছিটে দিচ্ছে। আমি প্রিয়ংবদাকে দেখতে থাকি। ও এককোণে ফসিলের মত স্থির। চোখে বা বুকে কোন চঞ্চল ছটফটে লাইট জ্বলছে না। ভরত আগে কন্ট্রোল প্যানেলের মেইন সুইচ অফ করে তারপর এখানে এসেছে।

    (চলবে)

    [1] জোয়ান রবিন্সন, কেরালার ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ থেকে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলনে রাশিয়ান মার্ক্সবাদ নিয়ে প্রবন্ধ।
    [2] কার্ল মার্ক্স, ‘ক্রিটিক অফ হেগেল’স ফিলজফি অফ রাইটস’ এর ভূমিকা, ১৮৪৪।
    [3] উইকিপিডিয়া।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৯ জানুয়ারি ২০২২ | ১৩১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন