"সব সম্পর্কে নাম হয়না
দিনে দিনে সেথা বাড়ছে দেনা
যে দেনা কখনও শোধ হবে না..."
আমি সবসময় ঘ্যানঘ্যান করি আমাকে কেউ ভালোবাসেনা, আমার কেউ নেই। আমার কোনও সম্পর্ক নেই। মা চলে যাওয়ার পর একটু হলেও একা হয়ে গেছি। তারপরেও কিছু মানুষ আছে যাদের দাবি আব্দার এড়াতে পারিনা আর তারাও আমার সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে শুক্রবার গা ম্যাজম্যাজ নিয়ে অফিস গেছিলাম প্যারাসিটামল খেয়ে। সকালে বেরোনোর ইচ্ছে ছিল না কিন্তু উইকেন্ডএ বন্ধু পার্থপ্রতিমের সাথে কাটানোর প্ল্যান ছিল এবং পরবর্তী কদিন ওর ওখান থেকেই অফিস যাতায়াতেরও পরিকল্পনা ছিল।
ট্রেন বন্ধ থাকায় মফস্বল শহর থেকে সল্টলেকে অফিস যাতায়াতে অসুবিধা এড়ানোয় এটাই সুবিধা। যদিও জরুরি পরিষেবার সাথে যুক্ত থাকায় অফিস এবার গাড়ির ব্যবস্হা করেছে আর সোমবার থেকে সেটা পাওয়া যাবে জানতে পেরেছিলাম।
অফিস গিয়ে দোটানায় পড়েছিলাম বন্ধুর ফ্ল্যাটে যাব নাকি বাড়ি। কারন সে তখন তার অসুস্থ মামার হাসপাতালে ভর্তির পর কোভিড ধরা পড়া ও সেটি কোভিড হাসপাতাল না হওয়ায় ওনাকে সিফট করতে পেরেছে আগের দিনই। সে কারণে সে বাড়ি গেছে। বন্ধু টিকে ফোন করলাম, সে জানাল না সে বাড়ি থেকে চলে আসছে আমিও যেন তার কাছেই আসি। অন্তত দুজনে একসাথে আড্ডা দিলে মন খুলে কথা বলতে পারলে তারও ভাল লাগবে। চলে তো এলাম কিন্তু রাত থেকে ধুম জ্বর। আমার অফিসের ডাক্তার সহকর্মীর থেকেও বেশি বন্ধু ডাঃ সুমন গাঙ্গুলির স্মরণ নিলাম। পরামর্শ মত শুধু প্যারাসিটামল খাওয়া বজায় রইল। আমার যে কোনও ভাইরাল ফিভার হলেই কাশি মাস্ট। গত নভেম্বরেও একবার বেশ ভুগেছি। ভয়ও পেয়েছিলাম। সেবার যদিও কোভিড ধরা পড়েনি।
যতই মনের জোর থাকুক ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তা আমাদের সকলেরই থাকে। আমার বন্ধুটির সেবা যত্ন পথ্য ওষুধে দুদিনেই জ্বর গায়েব। এদিকে তাঁর মামার অবস্থার অবনবতির খবর পাচ্ছি। আই সি ইউ থেকে এইচ ডি ইউ বেডে পাঠানো হয়েছে। রবিবার সকাল থেকে আমারও কোনও জ্বর নেই। শুধু একটু ক্লান্তি । তাই দুজনেই প্ল্যান করলাম দুজনের বাড়ি ব্যাক করার। ততক্ষণে অফিস গাড়িতে অফিস যাওয়ার কথাও পাকা করেছি। যদিও মনটা কু গাইছিল। তাই বাড়ির কাছের হাসপাতালে বন্ধুদের ফোন করে খোঁজ নিচ্ছিলাম কোভিড টেস্ট করানোর ব্যাপারে। এ প্যানডেমিকে বেশি পাকামি না করাই ভাল বলে বুঝেছি। এদিকে বিকালে বেরোনোর আগে আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু। বন্ধুটি জানাল এই ঝড়বৃষ্টিতে একা একা না ফিরে তার সাথেই যেন ফিরি। প্রয়োজনে পরদিন সে নিজে আমায় অফিস পৌঁছে দেবে। আর একান্ত অসুবিধা হলে আমায় আমার বাড়ি। সে মত ব্যাগ গোছানো হল। অভ্যেসমত এবার সে জানালা দরজা বন্ধ করে হাতে স্যানিটাইজার দিচ্ছে। অন্য সময় গন্ধ পাই। বুঝলাম গন্ধ পাচ্ছি না। নিজে তৈরী হতে গিয়ে বডি স্প্রে করতে গিয়ে গন্ধ পেলাম না। বুঝলাম ছড়িয়ে লাট করেছি। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুকে বললাম যে তার সঙ্গে যাওয়া একদম উচিত হবে না। আমি তার ফ্ল্যাটেই সেলফ আইসোলেশনে থেকে যাই। বাড়ি গিয়েও লাভ নেই। এদিকে ওকে বাড়ি যেতেই হবে। আবার ডাঃ গাঙ্গুলিকে ফোন। সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ চালু ও টেস্ট এর পরামর্শ। এদিকে আমার বন্ধুবর তো চিন্তায়। বাড়ির চিন্তা, নিজের চিন্তা, আমার চিন্তা। তাও তাতক্ষনিক ভাবে আমার টেস্টের বন্দোবস্ত, ওষুধ, সারা সপ্তাহের রসদ খাবার দাবার বুঝিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মনে বাড়ি গেলেন।
শুরু হল নিভৃতবাস। মাঝরাতে অসহ্য গায়ে ব্যাথা কাশি। টেম্পারেচার মাপতে গিয়ে দেখি থার্মোমিটারের পারা দুই এর ঘর ছুঁই ছু্ই। ওষুধ খেতেই নিমেষে জ্বর উধাও। কাফ শিরাপ গলায় পড়তে কাশিও কমল। কিন্তু গায়ের ব্যাথা কমল না। ভোরের দিকে ঘুম এল ভাঙল বেশ বেলায়। ঘুম থেকে উঠেই যোগাযোগ করলাম সোয়াব কালেকশনের জন্য। আসছি, আসব করে তিনি এলেন বেশ বেলায়। নিয়মমাফিক নাক গলা খোঁচাখুঁচি করে তিনি বিদায় নিলেন। আমিও গাড়গল করে স্টিম নিয়ে ওষুধ খেয়ে ঘুম। বিকালে শীত করছে পাখা অফ করতে গিয়ে দেখলাম আবার জ্বর বেড়েছে। ওষুধ পড়তেই তিনি গায়েব। ডাক্তার বন্ধুকে আবারও ফোন করে জ্বালাতন। তিনি যা যা বললেন শুনলাম। এদিকে জিভের স্বাদও প্রায় গন। শুধু ঝাল আর তেতো আছেন আমার সঙ্গে। চিনি ছাড়া কালো কফি চিরতার জল সমান। এদিকে বন্ধু দের ঠেলায় অক্সিমিটার সংগ্রহ করলাম। কিন্তু আমার মত বিশ্বট্যালা লোক অক্সিমিটারএর রিডিং নিতে গিয়ে হিমসিম। প্রথমে তো উল্টো আঙুল দিয়ে বসে আছি রিডিং আর ওঠেনা। নানানভাবে হলনা। বিকালে আর এক প্রস্থ ওষুধের জোগাড়ের জন্য বেরিয়ে জোড়া মাসক্ এঁটে পাশের ওষুধের দোকানদারএর শরণাপন্ন অক্সিমিটার কিভাবে ব্যবহার করব? যাই হোক তিনি দেখালেন আমিও দেখলাম বাড়ি এসে দেখি রিডিং ৭০ দিয়ে শুরু হয়েই থেমে যায়। ভেতরে ভয়ে শুকোয় ওদিকে জ্বর জারি শ্বাসকষ্ট কিছুই নেই। এমতাবস্থায় ফোন করলাম যার ফ্ল্যটে আছি তাকে। এসব মেশিনারি বিষয়ে ওর ওপর আবার আমার অগাধ আস্থা। সে তো বেচারা সব শুনে আর ভিডিওকলে মোটামুটি বোঝালেও ভেতরে শুকিয়ে কাঠ। তার একমাত্র চিন্তা রাতে বাড়াবাড়ি হলে আমায় কে দেখবে? সে নিজেও তো তার বাড়িতে। তারও ওদিকে জ্বর। সুতরাং সিম্পটম শুরু। কি হবে! এদিকে আমি সব শুনে বুঝে আবার অক্সিমিটার দিলাম। এবার দেখা গেল ৯৭। আবার একবার দেখলাম ৯৬। এবার রহস্য উদঘাটন করলাম নিজেই। আমার ডানহাতের তর্জনীতে কোনও কারনে প্রেশার পাচ্ছে না তাই শুরু হয়েই ফিংগার আউট দেখাচ্ছে। অন্য আঙুল বা বাঁ হাতের আঙুলে অসুবিধা নেই। রিডিং ঠিকঠাক। জ্বর না থেকেও ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এদিকে তখনও আমার রিপোর্ট আসেনি। আর আমার বন্ধুবর আমার অফিসের বন্ধু বান্ধব কে ফোন করে আগাম সতর্ক করতে চাইছে যদি রাত বিরেতে হাসপাতাল যেতে হয় তাই প্রস্তুতি নিতে। সকলে মিলে ফোন করছে। আর আমি বোঝাচ্ছি আমি ঠিক আছি।
পরের দিন সন্ধ্যেতে রিপোর্ট পেলাম কোভিড পজিটিভ। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারবাবুকে মেইল করলাম। রাতের বেলা তাঁর ফোন। তিনি আগের দিনের অক্সিমিটার বিভ্রাটের খবর ততক্ষণে অবহিত। সব নিয়ে কিছুটা কনফিউজড হয়ে জানতে চাইছেন কি করব! কোনও সেফ হোম বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিষেবার চেষ্টা করবেন কিনা। এসব নিয়ে আমি তো ভেতরে ভেতরে যাই ভাবিনা কেন মনের জোরে তাকে বলছি, না না আমি একলা বেশ আছি। তিনিও তা দেখে শুনে পরামর্শ দিলেন রক্তপরীক্ষা ও সিটি স্ক্যানের সে সব রিপোর্ট এলে তারপর না হয় বিবেচনা করা যাবে।
পরেরদিন ল্যাব থেকে বাড়ী এসে রক্তপরীক্ষার জন্য কালেকশন করে নিয়ে গেল। এদিকে সিটিস্ক্যান কোথায় করাব! ভাবলাম পরেরদিন নিজেই দুটো মাস্ক পড়ে বেরিয়ে খোঁজ নেব আর স্ক্যান করাব। এতো আর আমার চেনা জায়গা না। কি মনে হওয়াতে আবার জ্বালাতন শুরু করলাম কাছাকাছি বন্ধুদের। একজন খবর দিল আমার আস্তানার থেকে মিনিট পাঁচ সাতেক দূরে একটি ল্যাব আছে। তার সহায়তায় ল্যাবের ফোন নম্বরও যোগাড় হল। সেখানে ফোন করলাম। জানালাম কোভিড আক্রান্ত। তাঁরা জানালেন দুপুরের দিকে তাঁদের ল্যাবে ভিড় কম থাকে। আমি যেন বাড়তি মাস্ক,স্যানিটাইজার আর একটা পাজামা বা লুঙ্গি সাথে করে নিয়ে যাই। শুনে কেমন ভ্যাবচাকা খেলাম। লুঙ্গি পাজামা এখানে পাই কোথায়? দিমাগ কা বাত্তি জ্বলে উঠল হঠাৎই। মনে পড়ল আমি যার ফ্ল্যাটে আছি তিনি তো জিম ট্র্যাক পড়েন। তারই একটা বগল দাবা করে ঠাকুর ঠাকুর করে খাওয়াদাওয়া সেরে বের হলাম।
ল্যাবে তো পৌঁছে গেলাম। ভিতরে একটা অস্বস্তি। রিসেপশনে বাকীরা পাড়লে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অথচ বেশি ভিড় নেই। রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলাকে জানালাম, ফোনে বলা ছিল আমি কোভিড আক্রান্ত। তিনি সব ব্যবস্থা করলেন। বেশ খানিকক্ষণ একটা ফাঁকা ঘরে বসার পর আমার স্ক্যান হল। এবং আমার হয়ে যাওয়ার পর জায়গাটা স্যানিটাইজ করা হল, ডিসপোজেবল পেপার ব্যবহার করে আমায় মেশিনে বসানো হয়েছিল। মোটের ওপর পরিছন্ন। এই প্যানডেমিকে। বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে আসার সময় আর একটু রসদও যোগাড় করে আনলাম। ভাবলাম আমাকে আর হয়তো বেরোতে হবে না। যদিও পরের দিন রিপোর্টটা সংগ্রহের কথা মাথায় ছিলই। কেননা ওরা বাড়ি পৌঁছে দেবেন না আগেই জানিয়েছেন!
এদিকে খেয়াল হল এইচ আইভির জন্য আমাকে তো প্রতিদিন যে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ খেতে হয় তা বাড়ন্ত প্রায়।আমার বাড়ীতে যদিও তার স্টক আছে। কিন্তু আনব কি করে। আবার স্মরণাপন্ন বন্ধুদের। যে অন্তত আমার বাড়িতে যায়। সব কিছু খুঁজে পাবে। অগতির গতি আমাদের আদরের জস্সি, সুকান্ত ব্যানার্জী। ফোন করলাম, আমার বাড়ি তে যেতে। এবং সাবধান করলাম বাড়ীতে যেন কেউ কোনভাবেই না জানে। কেননা ফেব্রুয়ারিতে মা চলে যাওয়ার পর বাবা এমনিতেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমার কোভিড হয়েছে জানলে আরও বেশি দুশ্চিন্তা করবে। জসসি বাড়ি গিয়ে ওষুধ , আমার কিছু প্রয়োজনীয় নথি সব নিয়ে লকডাউনের কারণে বাড়ি থেকে অফিস যেতে অসুবিধার কারণ দর্শিয়ে সব এনে দিল সেদিন আমার জ্বর শুরুর সাতদিন আর রিপোর্ট পাওয়ার দু দিন। তখন যদিও আর জ্বর নেই। বাকি উপসর্গ গুলোও কমতির দিকে। ওদিকে আমার বন্ধুর রিপোর্ট পজিটিভ। সেও নিজের বাড়িতে নিভৃতবাসে। সঙ্গে আরও দুঃসংবাদ। ওর মামা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
এত কিছুর মধ্যেও ওদিকে আমার বন্ধুপ্রবর ভাবতে ভোলেনি আমি একা আছি। দরকার পড়লে কি হবে! আর তাই বাকী বন্ধুদের সাথে কথা চালিয়ে গেছে । তাদের কেউ কেউ তো এই আস্তানার লোকেশন ও ঠিকানা নিয়ে রাত-বিরেতে অসুবিধা হলে কি করা যায় তার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। এবং তাঁরা বাড়ি থেকে রান্না খাবার পাঠানোর বন্দোবস্তের উদ্যোগ নিচ্ছে।
যদিও সকলকে অনুরোধ করেছি খুব প্রয়োজনহলে সেসব তাদের বলব আপাততঃ নিজেরখাবার বানিয়ে নিতে পারছি। তারা ব্যাস্ত না হন।
এই পুরো পর্বটা ডিটেইলস এ লেখার কারণ এসময় অনুভব করতে পারছিলাম আমি কতটা প্রিভিলেজড, কতমানুষ আমায় ভালবাসেন, সকলের নাম আলাদা করে উল্লেখ করলামনা। এদের ঋণ আমি কোনওদিনই কোনওভাবে শোধ করতে পারবনা। এতগুলো মানুষের ভালোবাসায় মনের জোরটা একয়দিনে ক্রমশ বেড়েছে। আর তত সুস্থতার আলো দেখছি।
পরের দিন রাতে সব রিপোর্ট এলে দেখা গেল সিটিস্ক্যান বলছে নিউমোনিয়া তবে রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট মোটের ওপর ভাল। ডাক্তার বাবুর পরামর্শে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে ও ভবিষ্যতের সমস্যা এড়াতে স্টেরয়েড চালু হল। আজ বারদিন। এখন বোধকরি সুস্থতার পথে এগিয়ে চলেছি। যদিও ডাক্তার বাবুর বলা নিভৃতবাসের সময়সীমা এখনও পার হয়নি। একটাই আপ্তমন্ত্র জপে যাচ্ছি...
"আমি ভয় করবনা ভয় করব না/দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরবনা..."
আশা করছি ভালভাবেই এই কোভিডযাপনের নিভৃতবাসের বাকী কটা দিন কাটিয়ে উঠব। উঠবই...