২০০৬ এ যখন আমার এইচ আই ভির কথা জানাজানি হয়ে গেল এবং ঘরে বাইরে নানারকম ভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছিল দাঁতে দাঁত চেপে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাকে ভালো থাকতে হবে। লোকের মধ্যে ভুল ধারণাগুলো ভাঙতে হবে। ২০১১ সালে এই পোস্টারটা তৈরী করেছিলাম, আমার এখনকার অফিস থেকে। HIV নিয়েও সুস্থ সবল স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়, প্রচারের উদ্দেশ্যে। ... ...
এইচ আই ভি সংক্রণ হলে এন্টি রেট্রোভাইরাল চিকিৎসায় সুস্হ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়। একবার এন্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপির ওষুধ চালু হলে যত অসুবিধাই হোক নির্দিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা উচিত নয়। ... ...
আপাত কঠিন মানুষগুলোও একা একা পথ চলতে চলতে, স্বাবলম্বীতার আড়ালে কোনও কোনও ঘটনায় বড্ড ক্লান্তি অনুভব করে .. কোথাও যেন একটা স্নেহবহূল স্পর্শের চাহিদা সবসময়ই রয়ে যায় তাদের মনের গভীরে... ... ...
অনেক খারাপ লাগার মধ্যেও ভালো থাকা একটা আর্ট। ওটা রপ্ত করতে হয়। কি পাইনি ভুলে গিয়ে কি কি পেলাম সেটার উদযাপনে লোকের কথায় কান না দিয়ে নিজের ভালো লাগা বা ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দেওয়া বড্ডো জরুরি। ... ...
আমার নতুন কাজের জায়গায় এসে একসময় অনুভব করলাম আরও অনেক বেশি করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা দরকার। শুধু ক্যুইয়ার নয় সাধারণ মানুষেরও এইচ আই ভি নিয়ে ভুল ভাঙা দরকার। এইচ আই ভি নিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক থাকা যায় সেটা লোকে যত জানবে তত এইচ আই ভি পরীক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। এই ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম নতুন একটা পোস্টার ডিজাইনের।এই পোস্টারটা সমস্ত সরকারী হাসপাতালে এইচ আই ভি নির্ণয় কেন্দ্র বা আই সি টি সি বিভাগে আছে। যখন দেখি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ফোনে কেউ বলে "দাদা আপনি সত্যি সত্যি এইচ আই ভি পজিটিভ!এইচ আই ভি নিয়ে সত্যিই ভাল থাকা যায়? একটু আগেই জানতে পারলাম আমিও এইচ আই ভি পজিটিভ।" আর তখন আমাকেই কাউন্সেলিং করতে হয়। এইচ আই ভি নিয়েও সুস্থ স্বাভাবিক থাকা যায় অ্যন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপির মাধ্যমে। শুধু নিয়মিত ওষুধ আর চিকিৎসকের পরামর্শ মত চলতে হয়। তখন বুঝতে পারি পোস্টারে সেদিন আমার মুখ দেখানোর সিদ্ধান্তটা একদম সঠিক ছিল। ... ...
সমকামী পুরুষ ও লিঙ্গান্তরকামী পুরুষের মধ্যেকার এমন টানাপোড়েন আজও হয়ে চলে। অথচ পুরুষালি হওয়ার কারনে নিজের মধ্যে গুমরে মরা মানুষগুলো নিজের কথা প্রাণ খুলে বলতে পারেনা অনেকসময়ই। সামাজিক রাজনীতির চাপে তথাকথিত পুরুষালি-পুরুষের পৌরুষের আড়ালে জোর করে ঢাকা পড়ে যায় তাদের ভালো লাগা খারাপ লাগা যৌনতার উদযাপন। পারিবারিক, সামাজিক চাপ তো বটেই কখনো বা নিজের মধ্যেও চলা দ্বন্দ্ব উপেক্ষা করতে না পেরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে অনেকেই। উভকামী হলে না হয় এক রকম, কিন্তু আজন্মলালিত ফ্রেম অফ রেফারেন্স থেকে নারী পুরুষের বিয়ের সেলিব্রেশনের বাইরে যেতে পারেন না অনেক সমকামী পুরুষ। আবার অনেকেই নিজেদের বিবাহিত সম্পর্কে নিজেকে পুরুষ হয়েও নারী রূপে কল্পনা করে নিজেদের সম্পর্কটাকে লেসবিয়ান সম্পর্কের উদযাপনে খুশি হওয়ার চেষ্টাও করেন। আসলে এই পৃথিবীতে সাদা-কালো, আলো -অন্ধকার এর মতো কেমন যেন দুইয়ের প্রভাব বেশি। এই দুইয়ের পৃথিবী নারী-পুরুষের বাইনারিতে আটকে থাকতেই অভ্যস্ত। আর তাই অন্যরকম মানুষ যাদের মনটা একরকম আর দেহটা একরকম তাদের নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে। আজও তো লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরা বা পাবলিক বাসে মহিলা সিটের বিরোধিতা করে চলেন একদল মানুষ। আসলে আগুনের আঁচ তাদের গায়ে লাগেনা তাই তারা হয়তো বোঝেন না। আজও যেখানে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয় সেখানে এই লিঙ্গ রাজনীতির লড়াইয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকেরা খুব সহজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জায়গা ছেড়ে দেন না। আর তারপরেও তাঁরা রাস্তার মোড়ে বা ট্রাফিক সিগনালে ভিক্ষা করতে দেখলে নাক কুঁচকে তাকাতে একবারও দ্বিধা বোধ করেন না। অন্য যৌনতার অন্য যাপনের নানা দিক নিয়ে খোঁজ রাখার মতো সময় সমাজের বাকি অংশের নেই। শুধুই ব্যঙ্গ আর বিদ্রূপ দিয়ে বিচার করতে ব্যস্ত তারা। ... ...
যখন দেখলাম আমার এইচ আই ভির পুরো গোপন ব্যাপারটা হাট হয়ে গেল, তখন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এসব নিয়েই চলব। যত বেশি আমি আপসেট হব ততবেশি সমাজ আমার ঘাড়ে চেপে বসবে। যতই জানি একই সুঁচ- সিরিঞ্জের ব্যবহারে, সংক্রমিত রক্ত বা রক্তজাত দ্রব্যের সংবাহনে, এমনকি গর্ভবতী মা যদি এইচ আই ভি আক্রান্ত হন তাহলে তার ভবিষ্যৎ শিশুর এইচ আই ভি সংক্রমণ হয়। তবুও অসুরক্ষিত বা বিনা কন্ডোমে যৌনমিলনে এইচ আই ভি ছড়ানোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কেননা খিদে ঘুমের মত সেক্সটাও যে মানুষের জীবনে অপরিহার্য। আর সেক্স নিয়ে আমাদের অনেকরকম ট্যাবু, অনেকরকম ঢাকঢাক গুড়গুড়। আর তাছাড়া তথাকথিত যৌনতার বাইরের যৌনতা তো এই সেদিনও আইনস্বীকৃত ছিল না। এর ওপর ছিল আমার চূড়ান্ত নীতিবাগীশ দায়িত্ব। তাই যত বেশি আমাকে কোনও সম্পর্কে যেতে দেখলে লোকে আমার এইচ আই ভি নিয়ে বাকীদের সাবধান করত, তার থেকেও বেশি আগেভাগে কোনও ক্যাজুয়াল সম্পর্কে যেতে হলে আমার এইচ আই ভি নিয়ে আমিই সোচ্চার হয়ে বলতে শুরু করলাম। তাতে করে আমার যৌনজীবনটা অনেকটা কম্প্রোমাইজড হলেও মনে হত সুখের থেকে স্বস্তি ভাল। যদিও আজ আমার অনেক বন্ধুই সম্পর্কে আছেন যাদের একজন এইচ আই ভি আক্রান্ত আর অন্য জন এই আই ভি আক্রান্ত নন। ... ...
কাজ করতে গিয়ে বুঝেছিলাম কুয়্যার-কমিউনিটির মানুষজনের এই ঝুঁকিপুর্ণ আচরণের মুল জায়গা আত্মপ্রত্যয়ের অভাব। তার অনেক কারণ, নিজেকে দিয়ে যেটুকু জানতাম তা যথেষ্ট ছিল না। আসলে যৌনস্বাস্থ্য বা মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সামাজিক স্বাস্থ্য অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ। যে মানুষগুলো ছোট থেকে বড় হতে হতে পরিবার সমাজ সকলের কাছে অবাঞ্ছিত জানতে জানতে বড় হয়েছে তাদের হেলথ সিকিং বিহেভিয়ার তৈরী হওয়া অত সহজ না। তার ওপর সম্পর্কের টানাপোড়েন, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, সামাজিক স্বীকৃতির অভাব তখনও পর্যন্ত আইনি স্বীকৃতির অভাব এ সব গুলো ছিলই। আর একটা দিকের মুখোমুখি হলাম তা হল অর্থনৈতিক সমস্যা। আমার বড় হওয়া, পড়াশোনা, স্কুলিং, শহুরে প্রিভিলেজড জীবনের সঙ্গে এখানকার মানুষজনের বিস্তর ফারাক। এখানে এসে দেখলাম দিনের বেলা খেত খামারে কাজ করা তথাকথিত মেয়েলি পুরুষের অনেকেই বৌ বাচ্চা সংসার সামলাতে দুটো টাকার জন্য রাতের বেলা হিজড়া পেশার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ট্রেনে ট্রেনে ছল্লা মেঙ্গে (ভিক্ষা করা) বেড়ায়। রেলপুলিশের তাড়া খেয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নামার ঝুঁকি নিতে হয়। আবার কখনও কখনও শারিরীক ভাবে খুশি করতে হয় রেল পুলিশকে। কখনও রাতের বেলা গুড শেডের লরীর ড্রাইভার বা খালাসীর সাথে টাকার বিনিময়ে শারীরিক মেলামেশা তো আকছার ঘটে। এদের যৌনরোগ বা এইচ আই ভি নিয়ে বোঝানো বা কন্ডোমের ব্যবহার নিয়ে বলতে গেলে প্রয়ই শুনতে হত, "কি লাভ এভাবে বেঁচে থেকে। এমনিই তো মরে আছি, এর চেয়ে এডস হলে তো তাড়াতাড়ি মরে যাব।" তারপরেও কেউ যদিও বা এইচ এই ভি পরীক্ষা করতো, চিকিৎসার আওতায় আনা ছিল আরও কঠিন। ... ...
কাউন্সেলিং নিয়ে ভাবনা আমার ছিলই নিজের সেক্সুয়্যালিটি নিয়ে বুঝতে পারার সময় থেকেই, আমার প্রথম সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সেটা কতটা প্রয়োজন হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম, কেননা অন্য যৌনতা যাপন তখন আজকের মত সবাইকে বলা যেতনা , আজও অনেকেই বলতে পারেনা। এর সঙ্গে যোগ হল এইচ আই ভি যাপন। বুঝলাম আমাদের মত মানুষের পাশে পজিটিভ ভাবে থাকাটা আমার মত পজিটিভ লোকের ভীষণ জরুরি। আর তাই তো মনখারাপ, বিচিং বা কোনও নেগেটিভ ভাবনাকে পাত্তা না দিয়ে সবসময় ভাল থাকার অভিনয় করতে করতে কখন যেন ভালো থাকাটাই অভ্যেস হয়ে গেছে আমার । ভাল থাকা একটা আর্ট। ওটা রপ্ত করলেই হয়। আমি জানি জাতকের গল্পের মত একমুঠো সর্ষে কারও কাছে পাবনা যার খারাপ থাকা নেই। নিজেকে বোঝাই আমার মাথার ওপর বর্ষায় ছাদ আছে, দু'বেলা পেটপুরে খেতে পাই, শীতে গায়ে গরম পোষাক দিতে পারি, তাই বাকী দুঃখ নিয়ে ভাবনাটা বিলাসিতা! ... ...
এখন হয়তো কাউন্সেলিং ব্যবস্থা অনেক পাল্টেছে। আসলে এইচ আই ভি কাউন্সেলিং এর ভাবনা চিন্তা এখনকার মত তখন ছিল না। এইচ আই ভি প্রোগ্রামের খোলনলচে বদলেছে অনেক পরে। তখন অনেকেই মনে করত এইচ আই ভি আক্রান্তের যৌনজীবন থাকা উচিত না, আজও অনেকে করে। কাউন্সেলিং ব্যবস্থায় কন্ডোমের ব্যবহার করতে বলা হত নীতি পুলিশি দেখিয়ে, বলা হত, "কন্ডোম ব্যবহার না করলে, তোমার থেকে অন্যের এইচ আইভি ছড়াতে পারে" বিষয়টা যতটা সত্যি ততটাই এইচ আই ভি আক্রান্ত ব্যক্তির পুনঃসংক্রমণ বা অন্যান্য যৌনসংক্রমনের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা সব পরিসরে হত না। আজও অনেক কম হয়। দুজন এইচ আই ভি আক্রান্তেরও যে যৌনমিলনে কন্ডোম ব্যবহার প্রয়োজন তা নিয়েও কথা কমই হয়। আরও একটা অদ্ভুত বিষয় লোকজন মনে করে কারও এইচ আই ভি আছে তা বাকীদের জানালে বোধহয় বাকীরা সুরক্ষিত থাকবে। আসলে অনেকেই নিজের রক্তপরীক্ষা করায় না, নিজের অজান্তেই তারাও এইচ আই ভি-র বাহক হতে পারে তাদের থেকেও এইচ আই ভি ছড়াতে পারে এ সত্যটা মেনে নিতে মানুষজন কিছুতেই পারেনা। সকলেরই নিজেকে এইচ আই ভি বা যৌনরোগ থেকে সুরক্ষিত রাখতে কন্ডোমের ব্যবহার জরুরি এই সহজ তথ্যটা সকলের বোধগম্য আজও নয়।আসলে যৌনতা বিষয়টা নিয়েই তো খোলাখুলি আলোচনা আমাদের সমাজে আজও কম হয়। ... ...