১৯৫৬ সালের কথা। বাংলা-বিহারকে জুড়ে দিয়ে পূর্বপ্রদেশ নামক একটি রাজ্য তৈরি করার প্রস্তাব আনল তৎকালীন রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিধান চন্দ্র রায়। বাংলা ভাগের সর্বনাশ করার পর, পশ্চিমবঙ্গকে হিন্দি বলয়ের অংশ বানিয়ে ফেলার চেষ্টার সেই শুরু। সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন, ২৩শে জানুয়ারি, ১৯৫৬, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিংহ, এক যৌথ বিবৃতিতে এই সংযুক্তির প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন। সর্বশক্তিমান কংগ্রেস হাইকম্যান্ড প্রস্তাবে শিলমোহর দিল।
এ প্রস্তাব কার্যকরী হলে বাঙালিজাতির বিপর্যয়ের ষোলকলা পূর্ণ হত, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তখনও বিহার টুকরো হয়নি, চার কোটি বিহারবাসীর সঙ্গে, আড়াই কোটি বাঙালিকে যোগ করলে নতুন রাজ্যে বাঙালিরা সংখ্যালঘু হতেন। বাঙালিরা সব দখল করে নেবে, বিহারবাসীদের এই আতঙ্কের কথা তখনই শোনা যাচ্ছিল, বছর-বছর নিশ্চয়ই বাড়ত। তার উপর পূর্ব বাংলা থেকে আসছিলেন অসংখ্য উদ্বাস্তু। দেশভাগের দায় তাঁদের নয়, কিন্তু দায়িত্ব পুরোটাই নিতে হচ্ছিল। হিন্দুদের পরিত্রাতারা তখন কাঁথাকম্বল জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। এই অবস্থায় আরেকটা আসাম তৈরির ছক একদম পাকা ছিল, যেখানে ভূমিপুত্রদের আতঙ্কের দোহাই দিয়ে দশকের পর দশক ধরে বাঙালি খেদানো চলবে এবং বছর পঞ্চাশ-ষাট পরে খানিক গণহত্যা, আর তারপর সর্বদলসম্মত এন-আর-সি করে পাকাপোক্তভাবেই খেদিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু বলাবাহুল্য, এরকমটা হয়নি। কারণ ঘোষণার পরেই ঘটে গিয়েছিল, যা ছিল অকল্পনীয়। সেই দোর্দন্ডপ্রতাপ কংগ্রেসের যুগেও বাঙালি রাস্তায় নেমে পড়ল। রাস্তায় রাস্তায় মিটিং মিছিল তো হলই, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সংযুক্তকরণের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নিল। তৈরি হল 'পশ্চিমবঙ্গ ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি'। তারা বঙ্গভাষাভাষী সম্মেলনের আয়োজন করল, উদ্বোধন করলেন মেঘনাদ সাহা স্বয়ং। জানুয়ারি মাসে ডাকা হল হরতাল। ফেব্রুয়ারির দু তারিখ দুলক্ষ ছাত্র ধর্মঘট করল। চরমপত্র দেওয়া হল সরকারকে। ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে হিসেবে ঘোষণা করা হল। প্রস্তাব বিধানসভায় সেদিনই পেশ করার কথা ছিল।
সরকার সাময়িক ভাবে পিছু হটল। কারণ, অবস্থা সরকারের পক্ষে কঠিন জায়গায় পৌঁছেছিল। সরকার পড়ে যেত এমন একেবারেই না, কিন্তু বিধানসভায় বিল হয়তো পাশ হতনা। বিধান রায় পরে নেহরুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, তিনি মেরেকেটে বড়জোর ১৫০ জন বিধায়কের সমর্থন জোগাড় করতে পারতেন। বিলটা পাশ করবেনা, এমনও হতে পারত। অর্থাৎ, কংগ্রেসি বিধায়করাও বিভীষণ আখ্যা পেতে ভয় পাচ্ছিলেন।
তখনও অবশ্য পুরো পিছু হটা বাকি। সেটা ঘটল কয়েকমাস পরে। ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ মারা গেলেন মেঘনাদ সাহা। তিনি তখন বিধানসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে ফাঁকা হয়ে গেল কলকাতা উত্তর-পূর্ব কেন্দ্র। ঘোষিত হল উপনির্বাচন। মার্চ মাসে ময়দানের এক জনসভায় বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু ঘোষণা করলেন ভাষা পুনর্গঠন কমিটির সম্পাদক মোহিত মিত্রই হবেন নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী। এবং এই একটি নির্বাচনেই প্রতিফলিত হবে রাজ্য পুনর্গঠন নিয়ে মানুষের আশা আকাঙ্খা। ছিল কেবলমাত্র একটা উপনির্বাচন। হিসেব অনুযায়ী ড্রেন-পরিষ্কার আর রাস্তা সংস্কার ছাড়া আর কিছু তার ইস্যু হবার কথাই নয়। কিন্তু হয়ে গেল গোটা বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গণভোট।
দেশভাগ নিয়ে কোনো গণভোট হয়নি। সুভাষের দাদা শরৎ বসু শেষ পর্যন্ত চেয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু এই ভোট হয়েছিল। মোহিত মিত্র জিতেছিলেন। একই সঙ্গে খেজুরি বিধানসভায় বিপুল ভোটে জিতেছিলেন বিরোধী প্রার্থী। বিধান রায়ের এই জনরায় মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা।
ভারতবর্ষের সংবিধানে গণভোটের সুযোগ নেই। কিন্তু কোনো কোনো ভোটকে গণভোটে পরিণত করা যায়। দেশভাগকে করা যায়নি, কেউ ঝুঁকি নেননি। হলে হয়তো এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতনা। অন্তত শরৎ বসুর শেষ দিন পর্যন্ত তেমনই বিশ্বাস ছিল। বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণ নিয়ে জ্যোতি বসু ঝুঁকি নিয়েছিলেন। সেই বিপর্যয় আটকানো গেছে। এন-আর-সি নিয়ে বিপুল জনবিক্ষোভের পরে, আসামের অভিজ্ঞতার পরে, কোনো নেতা কি ঝুঁকি নিয়ে বলবেন, এবারের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন আসলে স্রেফ ড্রেন পরিষ্কার আর প্রশাসন চালানোর ইস্যুতে নয়, এন-আর-সির বিরুদ্ধে, বিজেপির বিরুদ্ধে গণভোট? বাঙালি জাতিকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে গণভোট? কেউ কি সোচ্চারে বলবেন, তৃণমূলকে হঠাতে চাইলে বামকে ভোট দিন, বামকে না চাইলে তৃণমূলকে? কিন্তু বর্গিদের একটিও ভোট নয়? বিভীষণদের বয়কট করুন, যেন তারা রাজনীতি থেকে চিরতরে নির্বাসনের ভয় পায়? কেউ বলতে পারবেন, যে, মুসলমান, নমঃশূদ্র, বর্ণহিন্দু, যে বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন, সবাই ভারতীয় নাগরিক? এদের আবার নাগরিকত্বের পরীক্ষা দেওয়ানোর কোনো প্রশ্নই নেই? সেটা করতে দেওয়া হবেনা?
স্রেফ জনতা চাইলেই গণভোট হয়না। ভোটকে নেতাদেরই গণভোটে পরিণত করতে হয়। তাতে ঝুঁকি আছে। কিন্তু ঝুঁকি না নিয়ে স্রেফ নিরাপদে খেলে গেলে সেরকম নেতা হওয়াও যায়না। ১৯৫৬ সালের বিরোধী নেতা জ্যোতি বসু ঝুঁকি নিয়েছিলেন। "এটা তো একটা উপনির্বাচন মাত্র, রাজ্যের সঙ্গে এর কী" বা "ভারতীয় সংবিধানে গণভোট বলে কিছু হয়না" বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই যেত। যাননি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও তিনিই হয়েছিলেন, অনেক দিন পরে, সে তো আমরা সবাই জানিই।
নোটা-ও কি একটা অপশন - বামকে না চাইলে, তৃণমূলকেও না চাইলে নোটা ?
ওরম হয়।