এক রাজা। বোম্বাগড়ের। যিনি একাই ছাপ্পান্ন। সর্বত্র বিরাজমান, কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছবির ফ্রেমে আমসত্ত্বভাজা হয়ে নিজেই ঝুলে থাকেন। বলিউডে তাঁর ছবি দেখা যায়, উত্তরাখণ্ডের গুহাতেও। মোনাকো থেকে রোমানিয়া, ইন্টারনেট থেকে টিভিতে সর্বত্র তাঁর ছবি আছে, কিন্তু সামনাসামনি কোনো সাংবাদিক তাঁকে চোখে দেখেননি। তিনি এমন স্টেশনে চা বেচেছেন, যা আর খুঁজে পাওয়া যায়না, এমন ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি পেয়েছেন, যার খোঁজ করতে গেলে আদালত জরিমানা করে। তাঁকে নিয়ে কটু কথা বললে বিবিসিকেও ঠুসে দেওয়া হয়, তাঁর বিরুদ্ধে পোস্টার মারলে পুলিশ ধরে। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই দেশদ্রোহ। কারণ তিনিই দেশ। তিনিই পরমাত্মা। তিনিই পরমেশ্বর। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়েই লিখেছিলেন, "আমরা বেগুনভাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে"। আজ রাজা আছেন, নিরবধিকাল থাকবেন, রোজ সকালে উঠে নমন করবেন। ... ...
বেশি ভ্যান্তারা করে লাভ নেই। মহারাষ্ট্র থেকে দিল্লি, বিহার থেকে বাংলা, উহাদের ছক একটাই, এবং সেটা খুব পরিষ্কার। সিবিআই-ইডি-গ্রেপ্তার দিয়ে আঞ্চলিক বিরোধী সরকারগুলোকে নড়বড়ে করে দাও। চাপে রাখো। সত্যিই দুর্নীতি থাকলে তো সোনায় সোহাগা, নইলে বানিয়ে নাও। তারপর, চাপে থাকতে-থাকতেই খেলে দাও দাঙ্গার তাস। একে হিটলারি মতে বলা হত ব্লিৎসক্রিগ। ঝটিকা আক্রমণ। নানা জায়গায় ঝড়ের গতিতে শত্রুর সামনের লাইনে ফুটো করে দাও। তারপর সামনে চলো। দেখবে শত্রু নালে-ঝোলে হয়ে পিছনে পড়ে আছে। ... ...
সব মিলিয়ে এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। শাসকের বিরুদ্ধে লিখলে, শাসক ক্ষেপে যায়, কখনও উপেক্ষা করে, এ দেখা জিনিস। অনেকবার দেখেছি। শাসক প্রতিবাদের প্রকরণও নির্ধারণ করে দিতে চায়, সেও দেখেছি। কিন্তু বিরোধী, প্রতিবাদ যাদের পক্ষে যাবার কথা, আঙুল উঁচিয়ে, "এইভাবে লিখুন বলছি, চোপ!" বলে চোখ রাঙাচ্ছে, এ জিনিস দেখা একেবারে নতুন। হয় কায়েমী কোনো স্বার্থ, কিংবা নিছক নির্বুদ্ধিতা, কিংবা দুটোই না থাকলে, এ জিনিস হওয়া কঠিন। এর মধ্যে কোনটা ছিল, বলতে পারবনা। কিন্তু এইসবের চক্করে ফাঁকতালে যেটা হল, সেটা হল, বগটুই কান্ডটাই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। বছর খানেক পরে, সে নিয়ে আর কোনো আলোচনা নেই। সিবিআই 'মূল অভিযুক্ত'কে গ্রেপ্তার করেছিল, তিনি হেফাজতেই রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। সে নিয়েও বিশেষ কথাবার্তা দেখিনা। শাসক-বিরোধী কোনো দিকেই। ... ...
সত্যিকারের যুদ্ধই ধরুন। এই এখন একটা যুদ্ধ চলছে। রাশিয়া বনাম ইউক্রেন। সেখানে সৈন্যের অভাব বলে, উভয় পক্ষই প্রাপ্তবয়স্কদের ধরে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে নামিয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক মানে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। মহিলা নয়। কারণ, যুদ্ধ হল সিরিয়াস বিজনেস, সত্যিকারের 'খুনে-মানসিকতা' চাই। সেখানে মেয়েদের জায়গা নেই। আমেরিকায় এই বাধ্যতামূলক যুদ্ধে নামানোর পদ্ধতিটাকে বলে ড্রাফট। যেই আঠারো বছর হল, সমস্ত ছেলেকে সেনাবাহিনীর কাছে নাম লেখাতে হবে, যাতে দরকার হলেই তারা ডেকে নিতে পারে। মেয়েদের এটা করতে হয়না। বিশ্বের যে কটি দেশে এই বাধ্যতামূলক ড্রাফট আছে, তার মধ্যে হাতে-গোণা এক-আধটিই মেয়েদের ডাকে। বাদবাকি পুরোটাই ব্যাটাছেলেদের রাজত্ব। সত্যিই যদি যুদ্ধ বাধে, যেমন বেধেছিল ভিয়েতনামে, আমার ছেলে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হবে, ওমুকের মেয়ে হবেনা। ... ...
আমি শিক্ষাবিশেষজ্ঞ নই। এবং আমার দৌড় কলকাতা থেকে সিঙ্গুর অবধি। সেটাও নেহাৎই মধ্যবিত্ত বৃত্তে। সেই বৃত্তে আমি কী দেখছি? আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা প্রায় কেউ তাঁদের ছেলেমেয়েদের রাজ্য বোর্ডের ইশকুলে পড়াননা। যাঁরা রাজ্য বোর্ডের শিক্ষক, তাঁরাও না। তার নিশ্চয়ই অনেক কারণ আছে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, কলকাতা থেকে সিঙ্গুর অবধি, এই যে তিরিশ কিলোমিটার এলাকা, স্যাম্পল সার্ভে না করেই বলতে পারি, যে, রাজ্য বোর্ডের ইশকুল গুলো মধ্যবিত্তের প্রথম পছন্দ তো নয়ই, বরং অগতির-গতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। আমরা যে ইশকুলগুলোয় পড়েছি, যেগুলো নামী ইশকুল বলে জেনেছি, সেগুলো সমেত। দুর্নীতি, ইশকুল-বন্ধ করে দেওয়া, এই ব্যাপারগুলো দিয়ে এই দুচ্ছাইকরণ প্রক্রিয়াটাকে ক্রমশ ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। ... ...
এইটুকু খালি জানা আছে, যে, শুদ্ধস্বরের সঙ্গে এবার লাগছিল কোমল ধা এবং নি। বেহালা এবং সেতার বাজছিল পরপর। বোঝা যাচ্ছিল, শুরুর স্বর স্রেফ চোখে-ধুলো-দেওয়া উদ্যোগপর্ব ছিল। আসলে সেই শুদ্ধস্বর ছিল প্রস্তুতি, আসলে যা হয়ে উঠবে চারুকেশী। বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যায়ন। অনির্বাণ মাঝে-মাঝেই একটু-একটু সুজন হয়ে যাচ্ছিলেন, আর সুজন একটু-আধটু অনির্বাণ। আর নাটকের ঠিক মাঝখানে এসে, দেখা গেল, দুজন শারীরিক ভাবে জুড়ে গেলেন। পিছনে, যদ্দূর মনে করতে পারছি, সেই মুহূর্তেই বেহালা সিম্ফনী হয়ে গেল। সেও ভেঙে দেওয়া চারুকেশীতেই। পাশ্চাত্যে এই স্কেলটার নাম মেলডিক মাইনর। ঝপাঝপ মিলে গেল তারাও। ... ...
এই ফুটবলের বাজারে আমি লোভে পড়ে একটা সিনেমা দেখে ফেললাম। কলকাতার সিনেমাজগতের পুরাযুগ নিয়ে সিনেমা, জিনিসটায় আমার আগ্রহ আছে, সেই লোভে। সিনেমার নাম কলা। ইংরিজিতে QALA। তাই থেকেই বোঝা উচিত ছিল কেসটা। কিন্তু আমি আবার ঠেকে শিখি। খুলে দেখি একেবারে কাঁচQALA । যেমন মিস্টিসিজম, তেমনই ডার্ক, কিন্তু সিনেমাটা কীসের প্রেক্ষাপটে, সুইজারল্যান্ড না কলকাতা, বোঝার উপায় নেই (ভাষা হিন্দি, তাতে অসুবিধে নেই, কারণ,হিন্দি সিনেমার প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রায়ই সুইজারল্যান্ডে দেখা যায়।) কলকাতার সিনেমা নিয়ে ছবি, কিন্তু সারাক্ষণ দেখে গেলাম সিমলারও উত্তরে কোন এক জায়গায় ধাঁইধপাধপ বরফ পড়ছে। কেদার-বদ্রীতেও সারাবছর বরফ পড়েনা, আলাস্কাতেও না, কিন্তু এখানে পড়ে, হয়তো উত্তরমেরুর কাছাকাছি, কে জানে। সেখানে এক সঙ্গীতশিল্পী মহিলা তাঁর মেয়ের উপর হেবি অত্যাচার করেন, আর বেপাড়ার একটা পাঞ্জাবি ছেলেকে ধরে এনে গান শেখান। সেই জাল ভেদ করে মেয়ে একদিন কলকাতায় গানের জগতে সুপারস্টার হয়, এই হল গপ্পের একটা অংশ। শুরুর পাঁচ মিনিটেই এটা বুঝতে পারবেন, কাজেই স্পয়লার নয়। ... ...
এ বছরের গোড়ার দিকে মোদী এবং সুভাষ বসুকে নিয়ে আনন্দ পট্টবর্ধন যা লিখেছিলেন, বঙ্গানুবাদে তা এরকমঃ "মোদী এবং আরএসএস কেন সুভাষ বসুকে ভালোবাসে, ভালো করে বুঝে নিন! সুভাষ যখন হিটলারের সঙ্গে নীতিগত বোঝাপড়ায়, তখন আরএসএস আর হিন্দু মহাসভা তার সঙ্গে আদর্শগত বোঝাপড়া করে ফেলেছে। হিটলারের আশীর্বাদ নিয়ে সুভাষ আজাদ-হিন্দ-ফৌজে যাদের নিয়োগ করেন, তাদের বেশিরভাগটাই সেইসমস্ত ভারতীয় সেনাদের থেকে, যারা জার্মান, ইতালিয়ান, এবং জাপানিদের হাতে ধরা পড়েছিল। হ্যাঁ, তাদের অনেকেই নাৎসিদের পক্ষে যুদ্ধ করে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আরও, আরও অনেক বেশি ভারতীয় সৈন্য মারা যায় নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।" এতে তথ্য এবং বোঝাপড়াগত কিছু ভুল আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, এই লাইনে বললে, তার ফলাফল কী হবে। আজাদ-হিন্দ-ফৌজ নাৎসিদের জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছিল, সুভাষ-আরেসেসের একরকম করে বোঝাপড়া ছিল, এ কথা বললে, বঙ্গে ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা নিঃসন্দেহে লাটে উঠবে। ... ...
এটা, ওই এলাকায় চালু পদ্ধতি। অর্থাৎ টাকা ধার নিয়ে শোধ দিতে না পারলে সেক্ষেত্রে মেয়েদের নিলামে চড়ানো হয়। তাতে যা দাম উঠবে উঠবে। অন্তত আধডজন জেলায়, এএনআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জিনিসটা চালু। রীতিমতো স্ট্যাম্প পেপার দিয়ে সইসাবুদ করে কর্মটা সমাধা করা হয়, স্থানীয় পঞ্চায়েতের সহযোগিতায়। এটাই একমাত্র পদ্ধতি তা নয়। ঋণ পরিশোধের যেমন নানা উপায় থাকে, এক্ষেত্রেও তাই। কেউ যদি নিজের মেয়েকে বেচতে রাজি না হন, সেক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের নির্দেশে মেয়ের মাকে ধর্ষণ করা হয়। কতজন করে, সেটা খবরের কাগজের প্রতিবেদনে লেখা নেই। কন্যাসন্তান না থাকলে কি কিস্তি পরিশোধের একমাত্র উপায় ধর্ষণ? সেটাও লেখা নেই। তবে, আন্দাজ করা যায়, তাইই হবে। ... ...
নতুন কেন্দ্রীয় সরকার আসার পর আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বিষয়টা। এখন শিল্প মুনাফা তো নয়ই, বরং ওইটাই দেশপ্রেম। আর কোনো প্রতিযোগিতার লেশমাত্রই নেই। ঠেকনা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে। ব্যবসার নতুন মডেল হল, শিল্পপতি ব্যাংক থেকে ধার নেবেন। সেই টাকায় শিল্প বানাবেন। তারপর সেই ধারের টাকা ব্যাংক মকুব করে দেব। অর্থাৎ দেশবাসীর টাকায় শিল্প হবে, মুনাফা করবেন শিল্পপতি। কিন্তু সে তো মুনাফা নয়, সেটাই হল দেশপ্রেম। এই নতুন মতাদর্শ এখন বছর দশেক চলছে। ওইটাই এখন ইনথিং। এখন চুপচাপ আস্ত বন্দর আদানির হাতে চলে যায়। কোথাও একটিও বিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা যায়না। এখন টাটাকে কে তাড়িয়ে মহা অপরাধ করেছিল, এই নিয়ে তর্জা হয়। কারণ, শিল্পপতিরা মুনাফা নয়, তৈরি করেন কর্মসংস্থান, সমাজসেবার ঠিকাদারি তাঁদের। তাঁরা আমাদের স্বজন। তাই আমাদের কোনো মুক্ত অর্থনীতি নেই, আছে স্বজনপোষিত অর্থনীতি। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। পোষিত পুঁজিবাদ। ঠেকনা দেওয়া পুঁজিবাদ। স্বাধীন, স্বাবলম্বী মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে কিছু নেই। স্বাধীন ভারতের উৎপত্তির আগে থেকেই। ভারতবর্ষের পুঁজির ইতিহাস মূলত স্বজনপোষণের ইতিহাস। ... ...