দশম অধ্যায়
বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ – দশচক্রে ভগবান ভূত
…আমরা বিচারের চেয়ে প্রচারের অত্যন্ত বশীভূত, ফলে কোনোমতে একটা দাগ এঁটে বা মেরে দিলে বা কিছুদিন রটালে সাদা মিথ্যাও আমাদের কাছে জোর পেয়ে যায়, এর পেছনে উপরন্তু সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ও অন্তঃশীল প্রচার থাকলে তার ভিত এত পাকা হয় যে, খুব খাঁটি সত্যকেও অনেক সময় মাথা কুটতে হয় অসহায়ভাবে।
— কার্তিক লাহিড়ী, কলকাতার গ্রাম্যতা ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী
বিদ্যাসাগর সহসা সংস্কৃত কলেজ থেকে কেন পদত্যাগ করেছিলেন, তার কারণ হিসেবে একাধিক বিদ্যাসাগর জীবনীকার ও গবেষক জনশিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ংকে দায়ী করে থাকেন। তাঁদের মুল বক্তব্য – সংস্কৃত কলেজে ও বাংলায় শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে সব নিয়ে ইয়ঙের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ চরমে ওঠায় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। যেমন বিনয় ঘোষ এ বিষয়ে ইয়ংকে অভিযুক্ত করে সরাসরি লিখেছেন —
১৮৫৭ সালে সিপাহীবিদ্রোহের সময় থেকে দেখা যায়, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সরকারী শিক্ষাবিভাগের মতবিরোধের আবার সূত্রপাত হতে থাকে। এবারে বিরোধ ডি.পি.আই গর্ডন ইয়ঙের সঙ্গে। বিরোধ দিন-দিন বাড়তে থাকে এবং ক্রমে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে বিদ্যাসাগর শেষ পর্যন্ত তাঁর অধ্যক্ষতার সরকারী চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।১
তাঁর অনেক আগে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের আসল কারণটি বলার পরেও, বিনয় ঘোষ একাধিক ছেঁদো অজুহাত দেখিয়ে তাঁর মতটিতেই অটল থাকার চেষ্টা করেছেন। আমরা এই অধ্যায়ে গোটা বিষয়টিকে নানা তথ্যের সাহায্যে সম্যক পর্যালোচনার চেষ্টা করে দেখব, ঠিক কী কারণে বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেছিলেন।
১৮৫৪-র নভেম্বরে গর্ডন ইয়ঙের আমলে, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে মুগ্ধবোধ-এর বদলে সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা এবং ঋজুপাঠ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ চালু করেন। পরে তার সঙ্গে যোগ হয় আরও একটি গ্রন্থ ব্যাকরণ কৌমুদী। পরের বছরে যথাক্রমে তত্ত্বাবধায়ক, সহকারী পরিদর্শক ও বিশেষ পরিদর্শক হিসেবে তিনি মডেল স্কুল ও নর্মাল স্কুল স্থাপন করলেও অধিকর্তা ইয়ং তাঁকে বাধা দেননি। বরং ১৮৫৫-র ২ জুলাই বিদ্যাসাগর নর্মাল স্কুল স্থাপনের ব্যাপারে ইয়ংকে চিঠি লিখলে, তিনি মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। ১৮৫৬-এ তাঁরই অনুরোধে বিদ্যাসাগর প্রকাশ করেন চরিতাবলী। বিদ্যাসাগর-জীবনীকার বিহারীলাল সরকার কিংবা সুবল চন্দ্র মিত্র কোনও তথ্যসূত্রের উল্লেখ না করে ধারণা করেছেন, ইয়ংকে উপেক্ষা করে স্বয়ং ছোটলাটের ভরসায় বিদ্যাসাগর যে একাধিক বালিকা বিদ্যালয় খোলেন, সেখান থেকেই তাঁর সঙ্গে ইয়ঙের বিরোধের সূত্রপাত – যার ফলে বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বলা বাহুল্য, এই ধারণার কোনও প্রামাণ্য ভিত্তি নেই। কারণ এই অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব, ১৮৫৮ সালে বালিকা বিদ্যালয়গুলির শিক্ষকদের বকেয়া বেতন পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে বিদ্যাসাগর যখন সরকারের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করবেন, তখনও বিদ্যাসাগরের পক্ষেই কথা বলবেন জনশিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ং।
আমরা আগের অধ্যায়েই দেখেছি, ১৮৫৮-র ৭ মে ভারত সরকার বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে অনুমোদন না দেওয়ার কারণে, বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারীরা বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। ওই বছরের জুন পর্যন্ত সরকারের কাছে তাঁদের মোট বকেয়া বেতন পাওনা হয় ৩৪৩৯ টাকা ৩ আনা ৩ পয়সা। এই শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়োগ করেছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। এই পরিস্থিতিতে ২৪ জুন বিদ্যাসাগর ইয়ংকে জানান –
The establishments, having been appointed by me, naturally look up to me for payment, and it will certainly be a great hardship if I am made responsible for it ….২
ইয়ং এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আদৌ অসহযোগিতা করেননি, বরং বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন এবং তাঁর চিঠির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের চিঠিটিও বাংলা সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে লেখেন:
I would venture to recommend to the generous consideration of Government the Pandit’s petition to be shielded from personal and pecuniary liability on account of the female schools which, in anticipation of the sanction and approbation of Government, he was the means of establishing.৩ [নজরটান সংযোজিত]
২২ জুলাই ছোটলাট সরকারের ৭ মে জারি করা আদেশনামা পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়ে সম্পূর্ণ বিষয়টি ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেন।
কিন্তু নতুন করে সরকারি আদেশনামা জারি করার আগে, কোন পরিস্থিতিতে আর্থিক অনুমোদনের প্রত্যাশা করে বালিকা বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিদ্যাসাগর এত অর্থ ব্যয় করেছেন; বিদ্যাসাগরের দাবি অনুযায়ী কোন ব্যক্তি তাঁকে এই কাজে উৎসাহিত করেছেন; বিশেষত ১৮৫৮ সালের ১৩ই এপ্রিল বাংলা সরকার লিখিত চিঠির আগেই প্রায় অর্ধেক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা ছোটলাটের জানা ছিল কি না এবং থাকলে সে কথা চিঠিতে কেন উল্লেখ করা হয়নি — এই সমস্ত ব্যাপারে ভারত সরকার হ্যালিডের কাছে পূর্ণ ব্যাখ্যা দাবি করেন।৪ ভারত সরকারের প্রশ্নের উত্তরে ৩০ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগর অধিকর্তাকে লেখেন –
...যেহেতু সরকারি অনুমোদনের ভিত্তিতে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, তার ফলে আমার ধারণা হয়েছিল যে এ বিষয়ে সরকারের সার্বিক অনুমোদন আছে। প্রত্যেক নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরের মাসেই আপনাকে তা জানিয়েছি। কোনও আদেশনামা প্রকাশিত না হলেও আপনি সর্বদা বিদ্যালয়গুলির ব্যয়সংক্রান্ত আমার সমস্ত আবেদনপত্র গ্রহণ করেছেন। এতদিন এই কাজে আমাকে নিরুৎসাহিত না করার কারণে স্বভাবতই আমার ধারণা হয়েছিল যে, এ বিষয়ে সরকারের সম্মতি আছে।৫
বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে এ কথা স্পষ্ট, ইয়ং কোনও সময়েই তাঁকে এ কাজে নিরুৎসাহিত করেননি, বরং তাঁর আবেদনপত্র গ্রহণ করে সরকারের বিবেচনার জন্য যথাসময়ে পাঠান।
এই কথার সমর্থন মেলে স্বয়ং ইয়ঙের লেখা চিঠিতেও। ৪ অক্টোবর তিনি বাংলা সরকারের কাছে বিদ্যাসাগরের চিঠিটি পাঠিয়ে মন্তব্য করেন —
আমি জানি, আমার অবর্তমানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ছোটলাটের সঙ্গে পণ্ডিতের ব্যক্তিগত মত বিনিময় হয়েছে। সরকার তাঁর প্রচেষ্টায় সর্বাত্মক সাহায্য করতে প্রস্তুত, সেটা আপনার ২১ অক্টোবরের চিঠি (No. 503) থেকে অনুমান করে আমি বিনা দ্বিধায় পণ্ডিতের প্রতিবেদনগুলি কোনও নিরুৎসাহ প্রদর্শন বা মন্তব্য ছাড়া সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে পাঠিয়েছি। আমার অনুপস্থিতিতে মি. উড্রোও তাই করেছেন।৬
অবশেষে ২৭ নভেম্বর ছোটলাট নিজের ত্রুটি স্বীকার করে ভারত সরকারকে লেখেন,
ছোটলাটের ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, তিনি তাঁর ক্ষমতাবলে বিদ্যালয়গুলির আর্থিক অনুমোদন দিতে পারেন। ...কিন্তু এক্ষেত্রে যে ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের মতো ছোটলাট নিজেও সমান দায়ী।৭
কাজেই যে ভুলের জন্য স্বয়ং ছোটলাট নিজে দায়স্বীকার করছেন, সেখানে ইয়ঙের মতো নেহাতই এক সরকারি আমলাকে এ বিষয়ে জড়ানোর কোনও অর্থই থাকতে পারে না।
এই ক্ষেত্রেও যখন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে জনশিক্ষা অধিকর্তার কোনও বিরোধিতা হয়নি, তাহলে তিনি আকস্মিকভাবে ১৮৫৭ সালের ২৯ অগস্ট পদত্যাগপত্র পেশ করলেন কেন? এই বিষয়ে বিনয় ঘোষ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন! বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ গ্রন্থের ‘শিক্ষাচিন্তা’ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন –
সরকারী শিক্ষাবিভাগের সঙ্গে এই ধরনের নানাবিষয় নিয়ে বিদ্যাসাগরের যখন বিরোধ চলছিল, তখন সিপাহীবিদ্রোহের আগুন দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্রিটিশ শাসকরা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। কলকাতা শহরের বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের অট্টালিকা তাঁরা তখন সৈন্যসামন্ত মজুত করার জন্য দখল করছেন। সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজের বৃহৎ অট্টালিকাও তাঁরা দখল করার সিদ্ধান্ত করেন। এই সিদ্ধান্তও বিদ্যাসাগর সহজে মেনে নেননি।৮ [নজরটান সংযোজিত]
এখানেই না থেমে তিনি দৃঢ় সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে জানিয়েছেন,
বরং ঘটনাগতি ও এই সময়কার চিঠিপত্রের বিষয়বস্তু থেকে মনে হয় যে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজ সরকারী সেনাবিভাগের কুক্ষিগত করার বিরোধী ছিলেন।৯
বিনয় ঘোষের ভাষাপ্রয়োগ দেখে এ কথা মনে করা অসঙ্গত নয় যে, বিদ্যাসাগর সিপাহি বিদ্রোহের চরম সমর্থক ছিলেন বলেই তাঁর কলেজটিকে সেনাবিভাগের কুক্ষিগত করার বিরোধিতা করেছিলেন। এ বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে, সিপাহি বিদ্রোহের প্রকৃতি ও বিদ্রোহ সম্পর্কে সমকালীন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মনোভাব সংক্ষেপে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
বিদ্রোহের যথাযথ কারণ হিসেবে ‘destruction, through free trade, [of] the domestic handicraft industry in India’-কে চিহ্নিত করে, ১৮৫৭ সালের ৩০ জুন নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে মার্ক্স যে বিদ্রোহকে ‘national revolt’ এবং ‘the only social revolution ever heard of in Asia’১০ বলে আখ্যায়িত করেন, সেই বিদ্রোহকে তৎকালীন তাবৎ অগ্রগণ্য হিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবী ‘সামন্ত বিদ্রোহ’ বলতে দ্বিধা করেননি। যদিও সিপাহি বিদ্রোহকে সামন্ত বিদ্রোহ বলার কোনও কারণই থাকতে পারে না। কারণ এই বিদ্রোহে সামন্তব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ রাজন্যবর্গের একজনও যোগ দেননি। শুধু তাই নয়, অযোধ্যা বাদে জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রিটিশের পক্ষে। বরং উত্তর ভারতের অযোধ্যা, রোহিলখণ্ড, বুন্দেলখণ্ড ও নর্মদা – চারটি অঞ্চলের জনসাধারণ এই বিদ্রোহে যোগ দেন।
বিদ্রোহের প্রাথমিক সাফল্যের পর পরই সংগ্রাম পরিচালনার জন্য, বিভিন্ন সামরিক বিভাগের নির্বাচিত সিপাহি প্রতিনিধি নিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় সভা (Court of Administration) গঠিত হয়। এই সভা ১৮৫৭-র ১১ মে বাহাদুর শাহকে ভারত সম্রাট ঘোষণা করে ঠিকই, কিন্তু এর অব্যবহিত পরেই ‘আজমগড় ইস্তাহার’-এর ভিত্তিতে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয় এই রাষ্ট্রীয় সভা। ২৫ অগস্ট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের নামে ঘোষিত আজমগড় ইস্তাহারে কোম্পানির অপশাসনের প্রকৃত ছবি তুলে ধরা হয়। সেখানে মূল অভিযোগগুলি ছিল — জমিদারদের অবর্ণনীয় শোষণ; নীল, কাপড় ও রপ্তানিযোগ্য পণ্যের একচেটিয়া কারবারের ফলে দেশীয় কারিগরদের নাভিশ্বাস; ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর চাপানো করের গুরুহার এবং কোম্পানির সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সেনাদের পদোন্নতির সুযোগের অভাব ও দুর্ব্যব্যহার।১১ ইস্তাহারে সিপাহিদের অভাব-অভিযোগ ছাড়াও চাষি, কারিগর ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করার কারণে বিহারের পশ্চিমভাগে, পাটনা বিভাগের বহু জেলায়, আগ্রা এবং মিরাটে সিপাহিদের সঙ্গে একই সময়ে অভ্যুত্থানে যোগ দেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ, সাধারণ চাষি ও মুসলমান কারিগররা। এই ব্যাপক অভ্যুত্থানের ফলে শুধু অযোধ্যাতে মারা যান দেড় লাখ মানুষ, যার মধ্যে সিপাহি ছিলেন মাত্র ৩৫ হাজার জন। লখনউ ও কানপুরের মধ্যবর্তী মিয়াগঞ্জে যে যুদ্ধ হয়, সেখানে আট হাজার বিদ্রোহীর মধ্যে সিপাহি ছিলেন মাত্র এক হাজার জন। একই সময়ে সুলতানপুরের বিদ্রোহে পঁচিশ হাজার বিদ্রোহীর মধ্যে ছিলেন মাত্র পাঁচ হাজার জন সিপাহি।
আসলে এই বিদ্রোহকে ‘সামন্ত বিদ্রোহ’ বলার অন্য কারণ বর্তমান। তৎকালীন ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ইংরেজি-শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তদের জমিদারি এবং ‘ঘটিরাম ডেপুটি’গিরির পুরোটাই ছিল ইংরেজ শাসকদের কৃপার ওপর নির্ভরশীল। ফলে একাধিক ছোট-বড় আঞ্চলিক কৃষক বিদ্রোহের পরে দেশ জুড়ে যখন বৃহত্তম বিদ্রোহটি সংগঠিত ও সশস্ত্র রূপ ধারণ করে, তখন ব্রিটিশ শোষণের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করেও তাঁদের কাছে তা অসহ্য মনে হয়নি। একাধিক সমকালীন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও সমসাময়িক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া, এ কথাকে সমর্থন করে। ১২৭৮ বঙ্গাব্দের এডুকেশন গেজেট-এ ছাপা হয় এই মন্তব্য –
ইংলণ্ডের কোন সুপ্রসিদ্ধ সংবাদপত্রে লিখিত হইয়াছে যে, ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেন্ট উচ্চ ইংরাজী শিক্ষার প্রতিকূলতাচরণ করিয়া অবিবেচনার কার্য করিতেছেন। কোন ইংরাজী ভাষাভিজ্ঞ ভারতবর্ষীয় লোক সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দেন নাই। ইহাতেই সপ্রমাণ হয় যে ইংরাজী শিখিলে ইংরাজ গবর্ণমেন্টের প্রতি দৃঢ়ভক্ত জন্মিয়া থাকে।১২
বিদ্রোহ চলাকালীন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লেখা হয় —
...বঙ্গদেশস্থ সমস্ত বাঙ্গালি প্রজা নিতান্ত প্রভুভক্ত, ইহারা নিরন্তর কেবল শ্রীশ্রীমতী রাজ্যেশ্বরীর প্রতুল প্রত্যাশা করে, যাহাতে রাজপুরুষদিগের রাজলক্ষ্মী ভারতবর্ষে চিরস্থায়িনী হয়েন, একাগ্র চিত্তে তাহারি অভিলাষ করে, স্বপ্নেও কখনো অমঙ্গল চিন্তা করে না, কারণ ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের অধীনতায় অধুনা দুর্বল ভীরু বাঙ্গালি ব্যূহ যেরূপ সুখ সচ্ছন্দতা সম্ভোগ পূর্বক সানন্দে বাস করিতেছে, কস্মিন্কালে তদ্রূপ হয় নাই, রামরাজ্য আর কাহাকে বলে? এই রাজ্যইতো রাম রাজ্যের ন্যায় সুখের রাজ্য হইয়াছে, আমরা যথার্থরূপ স্বাধীনতা সহযোগে পদ, মান, বিদ্যা, এবং ধর্ম, কর্মাদি সকল প্রকার সাংসারিক সুখে সুখি হইয়াছি; কোন বিষয়েই ক্লেশের লেশমাত্র জানিতে পারি না, জননীর নিকট পুত্রেরা লালিত ও পালিত হইয়া যদ্রূপ উৎসাহে ও সাহসে অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া অন্তঃকরণকে কৃতার্থ করেন, আমরাও অবিকল সেইরূপে পৃথিবীশ্বরী ইংলণ্ডেশ্বরী জননীর নিকটে পুত্রের ন্যায় প্রতিপালিত হইয়া সর্বমতে চরিতার্থ হইতেছি।১৩
অন্যদিকে নীল বিদ্রোহের আগুনখেকো সম্পাদক হরিশ মুখোপাধ্যায়ের ভূয়সী প্রশংসা করে শিবনাথ শাস্ত্রী পরোক্ষে বুঝিয়ে দেন, অন্তত এই বিষয়ে ঈশ্বর গুপ্ত এবং হরিশ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে কোনও ফারাক নেই! তিনি লেখেন:
বিদ্রোহজনিত উত্তেজনাকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হিন্দু পেট্রিয়ট নামক সাপ্তাহিক ইংরাজী কাগজ এক মহোপকার সাধন করিল। পেট্রিয়ট সারগর্ভ সুযুক্তিপূর্ণ তেজস্বিনী ভাষাতে কর্তৃপক্ষের মনে এই সংস্কার দৃঢ়রূপে মুদ্রিত করিবার প্রয়াস পাইলেন যে, সিপাহী-বিদ্রোহ কেবল কুসংস্কারাপন্ন সিপাহিগণের কার্য মাত্র, দেশের প্রজাবর্গের তাহার সহিত যোগ নাই। প্রজাকুল ইংরাজ গবর্ণমেণ্টের প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুরক্ত এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে। পেট্রিয়টের চেষ্টাতে লর্ড ক্যানিং-এর মনেও এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল; সেজন্য এদেশীয়দিগের প্রতি কঠিন শাসন বিস্তার করিবার জন্য ইংরাজগণ যে কিছু পরামর্শ দিতে লাগিলেন ক্যানিং তাহার প্রতি কর্ণপাত করিলেন না। পূর্বেই বলিয়াছি সেই কারণে তাঁহার স্বদেশীয়গণ তাঁহার Clemency Canning বা ‘দয়াময়ী ক্যানিং’ নাম দিল। এমনকি তাঁহাকে ফিরাইয়া লইবার জন্য ইংলণ্ডের প্রভুদিগকে অনেকে পরামর্শ দিতে লাগিলেন। পার্লিয়ামেন্টেও সে কথা উঠিয়াছিল; কিন্তু ক্যানিং-এর বন্ধুগণ পেট্রিয়টের উক্তিসকল উদ্ধৃত করিয়া দেখাইলেন যে এদেশবাসিগণ ক্যানিং-এর প্রতি কিরূপ অনুরক্ত এবং ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টের প্রতি কিরূপ কৃতজ্ঞ।১৪
সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়গুলিতে বিদ্রোহের প্রতি এহেন মনোভাবে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে যায়।
একই কারণে ১৮৫৭-র ভারত কাঁপানো মহাবিদ্রোহের পরে, ব্রিটেনের রানি স্বহস্তে এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করায় উচ্ছ্বসিত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ-এর ভূমিকায় লেখেন –
প্রজাবৃন্দের সুখ-সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে। দাসীদ্বারা সন্তানকে স্তনদুগ্ধ দেওয়া অবৈধ বিবেচনায় দয়াশীলা প্রজা-জননী মহারাণী ভিক্টোরিয়া প্রজাদিগকে স্বক্রোড়ে লইয়া স্তন পান করাইতেছেন। সুধীর সুবিজ্ঞ সাহসী উদারচরিত্র ক্যানিং মহোদয় গভরনর্ জেনরল্ হইয়াছেন।১৫
ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর মহানুভবতার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি লিখতে পারেন:
প্রজার দুঃখে দুঃখী, প্রজার সুখে সুখী, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, ন্যায়পর গ্র্যান্ট মহামতি লেফ্টেনেন্ট গভরনর্ হইয়াছেন এবং ক্রমশ সত্যপরায়ণ, বিচক্ষণ, নিরপেক্ষ ইডেন, হার্সেল্ প্রভৃতি রাজকার্য-পরিচালকগণ শতদলস্বরূপে সিবিল্ সর্ভিস সরোবরে বিকশিত হইতেছেন। অতএব ইহাদ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে নীলকর দুষ্টরাহুগ্রস্ত প্রজাবৃন্দের অসহ্য কষ্ট নিবারণার্থ উক্ত মহানুভবগণ যে অচিরাৎ সদ্বিচাররূপ সুদর্শনচক্র হস্তে গ্রহণ করিবেন, তাহার সূচনা হইয়াছে।১৬
আরেক ‘ঈশ্বর’ বিদ্যাসাগর ১৮৭১ সালে বহুবিবাহ নিবারণ বিষয়ক প্রথম পুস্তকের বিজ্ঞাপনে অক্লেশে লিখতে পারেন –
ব্যবস্থাপক সমাজ বহুবিবাহনিবারণী ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করিবেন, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ আশ্বাস জন্মিয়াছিল। কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশের দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই সময়ে রাজবিদ্রোহ উপস্থিত হইল। রাজপুরুষেরা বিদ্রোহনিবারণবিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যাপৃত হইলেন; বহুবিবাহনিবারণবিষয়ে আর তাঁহাদের মনোযোগ দিবার অবকাশ রহিল না।১৯
অর্থাৎ অঙ্গুলিমেয় কুলীন ব্রাহ্মণের বহুবিবাহ তাঁর প্রধান মাথাব্যথার বিষয়। তাই তাঁর কাছে ‘রাজবিদ্রোহ’ ঘোরতর অন্যায়, নেহাত দেশে ‘দুর্ভাগ্য’ উপস্থিত না হলে এমনটা হতেই পারে না! হাজার হাজার সাধারণ মানুষের প্রাণবিসর্জনে তিনি বিচলিত হন না, বরং ‘রাজপুরুষেরা’ যে সেই বিষয়ে ভিন দেশ থেকে সেনা এনে বিদ্রোহ সামাল দিতে ‘সম্পূর্ণ ব্যাপৃত’ হয়ে পড়ে, এতে তাঁর আফশোসের সীমা-পরিসীমা থাকে না!! আর এ বিষয়ে তাঁর হয়ে সাফাই দিতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েন মাননীয় বিদ্যাসাগর-গবেষক বিনয় ঘোষ!!!
অথচ তদানীন্তন সরকারি নথিপত্রে দেখা যায়, ১৮৫৭ সালে বিদ্যাসাগর শুধু সিপাহি বিদ্রোহ উপলক্ষেই সংস্কৃত কলেজটি ছাড়েননি, বরং ওই বছরেই প্রথমে ‘বকরি ইদ’ ও পরে ‘মহরম’-এর জন্য তিনি কলেজ ভবনটি ছেড়ে দেন। ১ অগস্ট তিনি গর্ডন ইয়ংকে জানান:
I have the honour to report that, in compliance with the request contained in the accompanying copy of a letter to my address from the Principal of the Presidency College of yesterday’s date, I have closed the Sanscrit College for five days commencing from today.
It will be seen from Mr. Sutcliffe‘s letter that the Colleges and Schools have been closed at the desire of Colonel Strachey, Commandant of the Volunteer Corps, a body of whom are to be located in the College premises during the festival of the Buckreed.২০
এর পরে ইয়ঙের অনুমোদন পাওয়ার আগেই ২৪ অগস্ট মহরম উপলক্ষে ৮ দিন কলেজ বন্ধ রেখে তাঁকে লেখেন —
Two squads of the Volunteer Corps having occupied the Sanscrit College premises from Saturday evening when it is understood that they will be on duty for the day and night during the Mohurrum, I have the honour to report for your information that in anticipation of your sanction I have this day closed the Institution for 8 Days.২১
এই চিঠিগুলি থেকে এই সামান্য কথাটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না – বিদ্যাসাগর যেমন সিপাহি বিদ্রোহের আগেও তাঁর কলেজটিকে সেনা ও পুলিশের সাময়িক আস্তানা হিসেবে ছেড়ে দেন, তেমনই তার জন্য সর্বদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও নেননি। বিনয় ঘোষের মতো খ্যাতিমান বিদ্যাসাগর-গবেষকের এ চিঠিপত্রগুলি না দেখার কথা নয়, তবুও তিনি এ বিষয়ে তাঁকে আড়াল করার হাস্যকর চেষ্টা করেছেন।
মহরমের ছুটি শেষে কলেজ ফের খোলে ১ সেপ্টেম্বর। ওই দিন দুপুর দুটো নাগাদ বিদ্যাসাগর প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ সাটক্লিফ (J. Sutcliffe)-এর পাঠানো চিঠিতে জানতে পারেন যে, গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার সংস্কৃত কলেজটি অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। ২ সেপ্টেম্বর তিনি সে কথা জানিয়ে ইয়ংকে লেখেন:
Measures have accordingly been taken to remove the College furniture to the Normal School premises, one of the houses which I had reported upon as available, having since been let out by its proprietor to another party without intimation being given to me.
As no other houses can immediately be had for transferring the College and as there are only 12 days to the Dusserah vacation, I have in anticipation of your sanction closed the College for that period from this day. In the mean time I hope to be able to engage suitable houses for the accomodation of the College after the Dusserah vacation.২২ [নজরটান সংযোজিত]
গোটা ঘটনার গতিপথ বুঝতে এই চিঠিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিঠি থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার, ব্রিটিশ সরকারের আদেশ অনুযায়ী বিদ্যাসাগর জেনেবুঝে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতিরেকে, কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংস্কৃত কলেজকে সেনাবাহিনীর ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করতে দেন। সরকারি বেতনভুক কর্মচারী বিদ্যাসাগরের সরকারি নির্দেশ অমান্য করার উপায়ও ছিল না।
কিন্তু খটকা লাগে চিঠিটির ‘one of the houses which I had reported upon as available’ জায়গাটিতে। বোঝা যায়, এই আদেশ পাওয়ার আগেই বিদ্যাসাগর অস্থায়ীভাবে বাড়ি ভাড়া করে কলেজ চালানোর প্রস্তুতি নেন এবং সেই বাড়িতে কলেজের আসবাবপত্র সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করেন। যদিও কবে তিনি এই আগাম ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, তা এই চিঠি থেকে জানা সম্ভব নয়। তবে জনশিক্ষা অধিকর্তার অনুমোদন পাওয়ার আগেই তিনি যে নিজের উদ্যোগে কলেজ সংলগ্ন দুটি বাড়ি যথাক্রমে মাসিক ৩০ টাকা ও ৫০ টাকায় ভাড়া নেওয়ার সুলুকসন্ধানের কাজ সম্পন্ন করেন, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয় বিদ্যাসাগরের অন্য একটি চিঠি থেকে। এখানে উল্লেখ্য, কলেজটিকে সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া এবং বাড়ি ভাড়ার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া – কোনও ক্ষেত্রেই তিনি গর্ডন ইয়ঙের অনুমোদনের তোয়াক্কা করেননি।
নিজের মতো করে সমস্ত বিষয়টি সেরে ফেলার পরে, এ বিষয়ে সরকারের আর্থিক অনুমতির জন্য মহরম উপলক্ষে কলেজ বন্ধ করার দিনে অর্থাৎ ২৪ অগস্ট বিদ্যাসাগর ইয়ংকে জানান –
As other houses are not available in that suitable quarter and as the rent appears to me to be cheap, I would beg your permission to enter into written agreements at once with the proprietors of the houses in question, otherwise I am told they would dispose them to other parties.২৩
ইয়ং তাঁর প্রস্তাবে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি। চিঠি পাওয়ার পরের দিনই তিনি বাংলা সরকারের সচিব বাকল্যান্ড (C.T. Buckland)-কে গোটা বিষয়টি অবহিত করে লেখেন:
In anticipation of the approval of Government, I have permitted the Principal to rent the two houses in question, should he find it absolutely necessary to do so.২৪
ইতিমধ্যে একটি বাড়ি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার জন্য, বিদ্যাসাগর অন্য একটি বাড়ি মাসিক ৭৫ টাকা ভাড়ায় জোগাড় করেন এবং দুটি বাড়ির জন্য মোট মাসিক ১০৫ টাকা ভাড়ার আর্থিক অনুমোদন