এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  সমাজ

  • দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর - ৩

    এলেবেলে লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | সমাজ | ১০ অক্টোবর ২০২০ | ৪২৮১ বার পঠিত | রেটিং ৪.২ (৬ জন)
  • তৃতীয় অধ্যায়

     

    হেস্টিংস থেকে আমহার্স্টসংস্কৃতের আবাহন, সংস্কৃতির বিসর্জন

     

    ক্রমে ক্রমে দেখা গেল য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয়মণ্ডলে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্যে নয়, আগুন লাগাবার জন্যে।

      রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালান্তর

     

     

    তদানীন্তন বাংলার প্রচলিত রীতি অনুসারে, প্রতিটি নিজামত (ফৌজদারি) আদালতে অপরাধের মাত্রা অনুসারে শাস্তির বিষয়টা দেখভাল করতেন একজন কাজি, একজন মুফতি দুজন মৌলবি অন্যদিকে দেওয়ানি আদালতে, হিন্দু মুসলমান প্রজাদের উত্তরাধিকার, বিবাহ, জাতপাত এবং ধর্মসংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য, যথাক্রমে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত মৌলবিদের সাহায্য বা পরামর্শ নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে বিষয়ে কেবল আদালতের কাজিরাই চূড়ান্ত রায়দানের অধিকারী ছিলেন তখন রাজস্ব বিভাগের অল্প কিছু কর্মচারী আরবি-ফারসি জানতেন প্রথম দিকে ইংরেজরা বাণিজ্যের প্রয়োজনে বা দরবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে, এই কর্মচারীদের সাহায্য নিত পাশাপাশি মৌলবি পণ্ডিতদের সাহায্যে নিজেরাও শিখে নিত, কাজ চালানোর মতো ফারসি সংস্কৃত কিন্তু ১৭৬৫-তে দেওয়ানি ১৭৭২- নিজামতের অধিকার হস্তগত করার পরে, তাদের আরও ভালোভাবে আরবি, ফারসি সংস্কৃত জানার প্রয়োজন হল। তাই ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ বিচারব্যবস্থাকে শাসকস্বার্থে কার্যকর করার জন্য, শাসনকর্তা হেস্টিংস মনোযোগী হলেন আদালতে প্রচলিত ভাষাগুলি দ্রুত শিখে নেওয়ার কাজে।

    কিন্তু শুধু বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের কুক্ষিগত করলেই শাসকের চলে না, বাণিজ্যস্বার্থও তাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হয়। কারণ ক্রেতা তথা প্রজার ভাষা না বুঝতে পারলে সওদাও অসম্ভব, শাসনও সম্ভব নয় তাই একই সময়েধ্রুপদীআরবি-ফারসি-সংস্কৃত শেখার পাশাপাশি, শাসকরাভার্নাকুলারভাষাসমূহ শেখার তাগিদ অনুভব করল তবে শাসিতের ভাষার ওপর শাসকের দাপট যাতে অব্যাহত থাকে জ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে যাতে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়, সেই স্বার্থের প্রেরণা থেকে এক নতুন কার্যক্রম শুরু হল পুরোদমে। যুগপৎ শাসকের দাপট বজায় রাখা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার পরিকল্পনা শুরু হল মূলত দুদিক থেকেইতিহাস ভাষা। রবার্ট ওর্ম A History of the Military Transactions of the British Nation in Indostan from the year 1745 (১৭৪৫), চার্লস গ্র্যান্ট Observations on the State of Society among Asiatic Subjects of Great Britain (১৭৯২), জেমস মিল The History of British India (১৮১৭), জেমস টড Annals and Antiquities of Rajasthan or the Central and Western Rajpoot States of India (প্রথম খণ্ড ১৮২৯, দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৩২) প্রমুখ ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, শাসকের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় সভ্যতারকাঙ্ক্ষিতভাবাদর্শগত নির্মাণ   ব্রিটিশের বাঞ্ছিতসভ্যতার দূততত্ত্বটির বৈধতা দেওয়ার কাজে নামলেন কোমর বেঁধে।

    ইতিহাসনির্মাণ’-এর সঙ্গেই চলছিল সাহেবদের ভাষানির্মাণ’-এর চাতুরিও। ফলত শুরু হল ভাষাকে কাটাছেঁড়া করে নিজেদের পছন্দসই  ব্যাকরণ বানানোর কাজ, যাতে ভাষার আসল পকড়টা সর্বদা শাসকের হাতে থাকে। এরই অবশ্যম্ভাবী আনুষঙ্গিক হিসেবে এল ভাষার অভিধান, ভাষার জরিপ (Survey), ভাষার সীমানা নির্ধারণ ইত্যাদি একই সময় থেকে অর্থাৎ ১৭৭০ থেকে ১৭৮৫- মধ্যে, ভাষার ক্ষেত্রেও তারা শাসনযন্ত্র মসৃণ রাখার নানাযন্ত্রপাতি’ – ব্যাকরণ, অভিধান, পাঠ্যপুস্তক এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা থেকে অনুবাদ ইত্যাদিযোগান দিতে থাকল এই সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল আলেকজান্ডার ডাও-এর The History of Hindostan (১৭৭০), উইলিয়াম জোন্স-এর A Grammar of the Persian Language (১৭৭১), জর্জ হ্যাডলি- The Practical and Vulgar Dialect of the Indostan Language Commonly Called Moors (১৭৭২), ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন-এর English Persian Vocabulary (১৭৭৫), ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড-এর A Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮), জন রিচার্ডসন-এর A Dictionary of English, Persian and Arabic (১৭৮০), চার্লস উইলকিন্স-এর The Bhagvat-Geeta or Dialogues of Kreeshna and Arjoon (১৭৮৫), জন গিলক্রিস্ট-এর A Dictionary English and Hindustanee, Part I (১৭৮৭) ইত্যাদি।

    অবশ্য হেস্টিংসের অনেক আগে থেকেই পাশ্চাত্যের নানা স্থানে, ভাষার ইতিহাস-নির্মাণ শুরু হয়েছিল। ১৬৯০ সালে জন লক Essay concerning Human Understanding প্রবন্ধে জানান, আফ্রিকানদের বুদ্ধি জন্তুজানোয়ারদের মতো। ১৭৫৩-তে ডেভিড হিউম Of National Characters প্রবন্ধে পৃথিবীর তাবৎ মনুষ্যকুলের চূড়ান্ত বর্ণবাদী ব্যাখ্যা হাজির করে, শ্বেতাঙ্গদের (বর্তমানের পরিভাষায় ককেশিয়ান) অন্য সমস্ত বর্ণের মানুষের চেয়ে উন্নত বলে দাবি করেন। প্রকৃতপক্ষে ষোড়শ শতক থেকেই ইউরোপীয় দার্শনিকরা, মানুষেরআদিভাষার সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন তাঁদের ধারণা ছিল, পৃথিবীর সমস্ত ভাষাই সেই আদিভাষা থেকে উদ্ভূত। এই আদিভাষাকে তাঁরাপবিত্রঅভিজাতহিসেবে বিবেচনা করেছিলেন ফলে সমগ্র ইউরোপের জন্য, এই আদিভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল লাতিন, গ্রিক হিব্রু।

    এই ধারণা আরও জোরালো হয় ১৭৬৯ সালে হার্ডার-এর Essay on the Origin of Language প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পরে, যেখানে তিনি সমস্ত ভাষাকে একটিমাত্র ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে যুক্তি দেখান। সমস্ত বর্ণের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করে, প্রথম কেতাবি কিতাব প্রকাশিত হয় জার্মানির গোটিঙ্গন (Gottingen) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ব্রিটিশরা এই তত্ত্ব লুফে নেয় শ্বেতাঙ্গদের ভাষাকে শ্রেষ্ঠতম বিবেচনা করে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর নির্মাণ শুরু হয় এবং সেমেটিক (মূলত আরবি) হ্যামিটিক (উত্তর আফ্রিকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রচলিত) ভাষাসমূহকে, -শ্বেতাঙ্গদের (মূলত বাদামি বর্ণের মানুষজন) ভাষা হিসেবে চিহিত করা হয়। এই ভাষাশ্রেণির একদম শেষ স্তরে আশ্রয় নেয়, ‘কালা আদমি’-দের নিগ্রিটিক (জুলু) বা সুদানিক (ইথিওপিয়া থেকে সেনেগাল অবধি প্রচলিত) ভাষাগুলি এইভাবে তিনটি স্তরে থাকবন্দি হয় পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা।

    সংস্কৃতকে এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীতে স্থান দেওয়া হলেও, তাকে ইংরেজরা অতীত ভারতবর্ষের লুপ্ত গরিমা হিসেবে চিহ্নিত করে চিহ্নিতকরণের সময়ে সংস্কৃত সাহিত্যের অনেক আখ্যান-উপাখ্যানের নিদর্শন যে দেশীয় ভাষাতেও পুরোমাত্রায় বিদ্যমান, এই সহজ কথাটা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বিস্মৃত হতে বাধ্য হয় বরং তারা কথা প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে যে, সংস্কৃতমৃতভাষা এবং তার সঙ্গে বর্তমান উপমহাদেশের ভাষা সংস্কৃতির যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে দেশে চালু সমস্ত ভাষাই হয়তদ্ভব’ (dialects) নতুবা অপকৃষ্টদেশি’ (vernacular) ভাষা মাত্র। ফলে ভাষাকে তিনটি স্তরে থাকবন্দি করে ফেলার প্রক্রিয়া, এখানেও অব্যাহত থাকে। ভারতবর্ষে এই কাজটি প্রথমে এশিয়াটিক সোসাইটি পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে, বিদেশি সাহেবদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেশি পণ্ডিত-মৌলবিদের সক্রিয় সহযোগিতায় শুরু হয়

    সাহেবদের এই সংস্কৃত ভাষাচর্চার ব্যাপারে বুদ্ধদেব বসু জানাচ্ছেন,

    ...আধুনিক ভারতে সংস্কৃতচর্চা একটি বিলেতফেরৎ সামগ্রী, ভারতের তুলো বা পাট নিয়ে শ্বেতাঙ্গরা যেমন বিবিধ প্রস্তুত পণ্যের আকারে ভারতের হাটেই চালিয়েছে, তেমনি তাদের বুদ্ধির প্রক্রিয়ায় সংস্কৃত বিদ্যাও রূপান্তরিত লো নানা রকম ব্যবহারযোগ্য বিজ্ঞানে

    তিনি আরও বলছেন,

    ...সমগ্রভাবে -কথাই সত্য যে সংস্কৃত ভাষার রচনাবলির মধ্যে শ্বেতাঙ্গরা দেখেছেন গ্রীক বা লাতিনের মতো কোনো সাহিত্য নয়, রসসৃষ্টি নয়, সৃষ্টিকর্ম নয় দেখেছেন ইতিহাস ইত্যাদির উপাদান, আর ভারতীয় মনের পরিচয় পেয়ে ভারতবাসীকে বশীভূত রাখার খ্রীষ্টানীকৃত করার একটি সম্ভাব্য উপায় শেষের কথাটা, বলা বাহুল্য, ইংরেজ বিষয়ে বিশেষভাবে প্রযোজ্য

    তাঁর এই বক্তব্যের উৎকৃষ্ট প্রমাণ রেখে গেছেন কর্নেল বোডেন। তিনি তাঁর সঞ্চিত অর্থে, ১৮১১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপকপদ প্রতিষ্ঠা করেন একদা ওই পদে অধিষ্ঠিত স্যার মনিয়র উইলিয়ামস ১৮৯৯- রচিত সংস্কৃত থেকে ইংরেজি অভিধানের ভূমিকায় বলেছেন, বোডেন স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে এই পদ স্থাপনে তাঁর লক্ষ্য সংস্কৃত ভাষায় বাইবেল-অনুবাদের উন্নয়ন, যাতে তাঁর স্বদেশীয়রা ভারতবাসীকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারে

    অন্যদিকে হ্যালহেড A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থে কোনও রাখঢাক না রেখে স্পষ্ট জানান, Little indeed can be urged in favour of bulk of the modern Bengalees ভাষাটা কেমন হওয়াউচিততা সাহেব জানেন বলে, ‘ফিরিঙ্গিনামুপকরার্থভাষা শেখার বইটিতেপ্রভুহ্যালহেড-এর কণ্ঠস্বর ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠে। তাঁর কাছে বাংলা ভাষারforms of letters’, ‘modes of spelling এবং choice of wordsসবই equally erroneous and absurd বাঙালিরা  ‘can neither decline a word, nor construct a sentence’ ফলে তাদের লেখা গিজগিজ করেPersian, Arabic and Hindostanic terms মোদ্দা কথা, বাঙালি বলতে-লিখতে জানে না, তাই নিজের ভাষায় গুচ্ছের অন্য ভাষার শব্দ গুঁজে দিয়ে, ভাষাটাকে অকারণেunintelligibleএবং obscureকরে তোলে! তিনিপ্রকৃতবাংলা জানেন বলেভৃত্যদের ভুল ধরতে পারেন, দেখতে পান ভৃত্যের ভাষার improper structure’! তাই হ্যালহেড সাহেবপ্রভুদের কড়া নির্দেশ দেন, তারা যেন ভাষাটার চর্চা এমনভাবে করে, যাতে ভাষাটা তাদের কাছে হয়ে ওঠেa general medium of intercourse between the Government and its Subjects; between the Natives of Europe who are to rule, and the Inhabitants of India who are to obey

    আর তাঁর দেখানো পথ ধরেই বাংলা ভাষা থেকেঅদরকারিআরবি-ফারসি-হিন্দুস্তানিরখাদবিসর্জন দিয়ে শুরু হয়, বাংলারনিখাদসংস্কৃতায়ন প্রকল্প। পরবর্তীকালে যে প্রকল্পের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেবেনভৃত্যবিদ্যাসাগর, তিনি অবশ্যপ্রভুহ্যালহেডের কথায় কোনও ভুল দেখতে পান না। বরং তাঁর নির্ভেজাল প্রশংসা করে তিনি লিখবেন

    ১৭৭৮ খৃঃ অব্দে, বাঙ্গালা অক্ষরে সর্বপ্রথম এক পুস্তক মুদ্রিত হয় অসাধারণ- বুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন হালহেড সাহেব, সিবিল কর্মে নিযুক্ত হইয়া, ১৭৭০ খৃঃ অব্দে, এতদ্দেশে আসিয়া, ভাষাশিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন তিনি যেরূপ শিক্ষা করিয়াছিলেন, পূর্বে কোনও য়ুরোপীয় সেরূপ শিখিতে পারেন নাই

    প্রসঙ্গত, এই বিষয়টি লেখাটির তৃতীয় পর্বে বিশদে আলোচিত হবে।

    A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থে হ্যালহেড রীতিমতো গর্বভরে জানান, তিনিই প্রথম ইউরোপীয় যিনিআবিষ্কারকরেছেন the Bengal language merely as derived from its parent Shanscrit আর জোন্সকে তাঁর ভবিষ্যতেরআবিষ্কার’-এর পথ মসৃণ করে দেন এই ধরতাইটুকু দিয়ে যে, তিনিthe similitude of Shanscrit words with those of Persian and Arabic, and even of Latin and Greek দেখে চরম বিস্মিত হয়েছেন বাধ্য ছাত্রের মতোভারততত্ত্ববিদউইলিয়াম জোন্স, ‘মহাজনহ্যালহেডের দেখানো পথ অনুসরণ করে ১৭৮৬- ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটির তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনের বক্তৃতায়, ঘোষণা করেন শাসকের সেই বহুপ্রার্থিত তত্ত্বটি তিনি লেন,

    The Sanscrit language, whatever be its antiquity, is of a wonderful structure; more perfect than the Greek, more copious than the Latin, and more exquisitely refined than either, yet bearing to both of them a stronger affinity, both in the roots of verbs and in the forms of grammar, …there is a similar reason, though not quite so forcible, for supposing that both the Gothick and the Celtick, though blended with a very different idiom, had the same origin with the Sanscrit; and the old Persian might be added to the same family …. [নজরটান জোন্সের]

    এই বক্তৃতায় জোন্স হ্যালহেডের পথ ধরেই দেখান গ্রিক, লাতিন ইত্যাদি ভাষার শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে সংস্কৃতের মিল যথেষ্ট

    আসলে কোম্পানি এই ধারণাকে সামনে রেখে দেখাতে চেয়েছিল, ব্রিটিশদের ভারতবর্ষে উপনিবেশ স্থাপন অন্যায় তো নয়ই, বরং বহু শতাব্দী আগে আর্যদের আগমনের মতোই দেশের পক্ষে তা যুগান্তকারী মঙ্গলজনক একটি ঘটনা এর ফলে বিস্মৃতপ্রায় আর্য-ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রায় অভাবনীয় সেতুনির্মাণ সম্ভব করে তুলেছে ইংরেজরা; বলা বাহুল্য, সেজন্য দেশবাসীর ব্রিটিশদের প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ভারতবর্ষে বাণিজ্য প্রসার শাসন চালানোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে ব্রিটিশরা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিল যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু বৈদিক আর্যদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতে অভ্যস্ত ফলে এইরকম একটা তত্ত্বকে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে, প্রাচীন আর্যদের মতো ইউরোপীয় আর্য-বংশোদ্ভূত ইংরেজরাও তাদের চোখে বরণীয় হয়ে উঠবে উপনিবেশের প্রজাদের মন পেতে, এই অব্যর্থ দাওয়াই প্রথম দিকে বেশ কাজেও লেগে গিয়েছিল

    কিন্তু এই কৃত্রিমআর্যতত্ত্বচালু করতে গিয়ে, বিপদ এসেছিল অন্যদিক থেকে। কারণ একই সঙ্গে গ্রিক লাতিনের মতো সংস্কৃতকেধ্রুপদীভাষা হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি ইংরেজরা জানায়, কালের নিয়মে বদল হয়ে যে সমস্ত ভাষা তাদের থেকেজন্মেছে’, সেগুলো ওই ধ্রুপদী ভাষা থেকেবিচ্যুত শুধু তাই নয়, এই সাব্যস্ত করাধ্রুপদীভাষাসমূহের সঙ্গে যে সমস্ত ভাষার ধাঁচ মিলল না, তাদেরখারাপপ্রাচ্যভাষা বলতে অসুবিধা হল না এই সাহেবদের ততদিনে সংস্কৃতের চলন অনুযায়ী, বাংলা ভাষাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে কেবল কতগুলো অবাধ (arbitrary) চিহ্নের মিলজুলের ওপর নির্ভর করে এই যে সৃষ্টি করা হলভালোপ্রাচ্য সংস্কৃত আরখারাপপ্রাচ্য সেমেটিক গোষ্ঠীর কাজিয়া, তা ভারতবর্ষের বিভাজন হওয়ার আগে পর্যন্ত থামবে না।

    এই সুযোগে, এহেন উইলিয়াম জোন্সের সংস্কৃত চর্চার সামান্য হদিশ নেওয়া যাক। জোন্স লন্ডনে নানা ভাষা শিখলেও সংস্কৃত জানতেন না। কলকাতায় আসার আগে, অক্সফোর্ডে শিক্ষক রেখে আরবি শিখেছেন তিনিএমনটা অবশ্য জানা গেছে। ১৭৮৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হয়েছেন বটে, অথচ তখনও অবধি সংস্কৃতরজানেন না। মুনশিদের দিয়ে আরবি, ফারসি আর হিন্দুস্তানি দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন কোনও ক্রমে ১৭৮৩- ২৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় আসা ইস্তক সংস্কৃত নিয়ে তাঁর কোনও উৎসাহের কথা জানা তো যাচ্ছেই না, বরং উইলকিন্সকে ১৭৮৪- ২৪ এপ্রিল তিনি জানাচ্ছেনlife is too short and my necessary business too long for me to think at my age of acquiring a new language এদিকে আদালতে সংস্কৃত শাস্ত্রবিচার করে রায় দিতে হয়, জোন্সের যাকে বলে একেবারে বেইজ্জত অবস্থা! হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের খপ্পর থেকে নিজেকে বাঁচাতে এবং সে ভাষাটার পকড় নিজের হাতে তুলে নিতে, ১৭৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি তিনি উইলিয়াম পিট (জুনিয়র)-কে জানান তাঁর সংস্কৃত শেখার আসল মনোবাসনার কথা। ভাষা হিসেবে সংস্কৃত শেখা তাঁর উদ্দেশ্যে নয়, আসলে তিনি ভাষাটা শিখতে আগ্রহী যাতে তিনিmay be a check on the Pundits of the court১০

    এর আগে অর্থাৎ ভারতে পদার্পণ করার প্রায় বছরখানেকের মধ্যে, এই উদ্দেশ্যে তিনি হাজির হয়েছেন কাশী, যদিও সেখান থেকে তাঁকে ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে। এবারে ১৭৮৫- সেপ্টেম্বর মাসে, তিনি সংস্কৃত শিক্ষায় হাতে খড়ি নিতে পাড়ি জমান নবদ্বীপ সেপ্টেম্বর প্যাট্রিক রাসেলকে চিঠি লিখে তিনি জানাচ্ছেন, সেখানে তাঁর যাওয়ার একমাত্র কারণ হল এমন একজন উপযুক্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্ধান করা, যাঁর থেকে তিনিthe rudiments of that venerable and interesting language১১ আয়ত্ত করে স্মৃতিশাস্ত্র অনুবাদ করতে পারেন। কিন্তু দুর্গাপুজোর কারণে, নবদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা তখন নবদ্বীপ ছেড়ে দূরস্থ যজমানদের বাড়িতে চলে গেছেন। ফলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাউকে না পেয়ে, অগত্যা অক্টোবর মাসে তিনি কলকাতা ফেরেন অব্রাহ্মণ (বৈদ্য) রামলোচন পণ্ডিতকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণনগর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর উইলকিন্সকে চিঠিতে জানাচ্ছেন, তিনি এবারে রামলোচনের থেকে হিতোপদেশ পড়া শিখবেন।১২ মাত্র মাসখানেকের সংস্কৃত ভাষাশিক্ষার সঙ্গে ফারসি ভাষার জ্ঞান মিলিয়ে, আদালতে জজপণ্ডিতদের মত উলটে দিয়ে নিজের রায় দেওয়া শুরু করেন জোন্স শুধু তাই নয়, রামলোচনের যাদুগুণে মাত্র এক বছরের মধ্যে তিনি সংস্কৃততে এত পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে, ১৭৮৬ সালের ২৩ অক্টোবর হেস্টিংসকে জানাচ্ছেন, তিনি হিতোপদেশ -এর অনুবাদ করে ফেলেছেন এবং কিছুদিন পরেই ‘compiling a complete Digest of Indian laws’১৩-এর কাজে হাত দেবেন! লেখাটির দ্বিতীয় পর্বে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে, হ্যালহেড-জোন্সের শাস্ত্রগ্রন্থ অনুবাদের নমুনা তার বিষময় ফলাফল।

    সংস্কৃতর পাশাপাশি সাহেবদের ফারসি শেখার ধুম তখন তুঙ্গে, যা অবশ্য কিছুকাল পরে পুরো স্তব্ধ হবে গভর্নর জেনারেল হওয়ার পরেই, হেস্টিংস মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছেন কলকাতায়। বাংলার নব্যধনী আশরফ মুসলমান হিন্দু দেওয়ান-বেনিয়ানদের বিশ্বাস অর্জন করেআমি তোমাদেরই লোক’-এর বুজরুকির আড়ালে, আসলে নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করতে চেয়েছেন তিনি। ফলস্বরূপ ইংরেজদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপনিবেশিক শহরের শরীরে বহুমূল্য গয়না হিসেবে, উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে স্থাপিত হয়েছে প্রথমে কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১) সামান্য পরে এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪)

    ১৮০০ সালে ওয়েলসলির শাসনকালে যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই কলেজে আরবি ফারসিকে পাঠ্যক্রমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করে, তার অন্তর্ভুক্তির জন্য হেস্টিংস লিখছেন

    To the Persian language as being the medium of all Political intercourse the first place ought to be assigned in the studies of the Pupils; and as much of the Arabic as is necessary to shew the principles of its construction and the variations…. The Persian language ought to be studied to perfection, and is requisite to all the civil servants of the Company, as it may also prove of equal use to the Military Officers of all the Presidencies.১৪

    বাংলার এক মিলিটারি অফিসার উইলিয়াম ডেভি পইপই করে সাহেবদের সতর্ক করে দিচ্ছেন এই বলে যে, তাদের ফারসি ভাষাটা শুধু অনর্গল বলা শিখলেই চলবে না, এই ভাষায় লিখিত সমস্ত চিঠিও পড়তে হবে গড়গড়িয়ে এবং চিঠির গুরুত্ব বুঝে তার যথাযথ উত্তরও দিতে হবে নিজে হাতে লিখে। নাহলে ভয়ানক অনর্থ ঘটতে পারে, কারণ তাতেthe secret negotiations and correspondence of government are liable to be made public through the medium of the native Munchees, or writers, whom he will be obliged to employ and trust১৫ সাহেবদের এত এত আরবি-ফারসি-সংস্কৃতচর্চার জোয়ার নামছে একটাই কারণে হেস্টিংস দ্বিধাহীনভাবে জানাচ্ছেন, সাহেবরা তাদের শাসনের সুবিধার্থে শাসিতদের সমস্ত কিছুকে নিজেদের পছন্দসই মাপে কেটে-ছেঁটে এমনভাবে হাজির করবে, যাতেto graft Western notions and methods on to the main stem of Eastern Institutions১৬ আর এর পুরো রাশটা থাকবে কতিপয় ছোকরা সাহেব কর্মচারীর হাতে

    কর্নওয়ালিস মূলত রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন বেশি। কলকাতা মাদ্রাসার ১০ বছর পরে কোম্পানির বেনারসের রেসিডেন্ট (এই রেসিডেন্টরা ছিলেন কোম্পানি দেশীয় রাজন্যবর্গের সেতুস্বরূপ। কোম্পানি দেশীয় রাজরাজড়াদের সামরিক নিরাপত্তা দিত, বিনিময়ে সেখানে বকলমে চলত কোম্পানির শাসন) জনাথন ডানকানের অনুরোধে সাড়া দিয়ে, ১৭৯১ সালে বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ স্থাপনেই শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান সীমাবদ্ধ অবশ্য এর পেছনেও যে শাসকের যথেষ্ট স্বার্থবুদ্ধি ছিল, তা স্পষ্ট হয় ডানকানের বক্তব্যে এই কলেজ সম্পর্কে ১৭৯২-এর জানুয়ারি লর্ড কর্নওয়ালিসকে ডানকান লেখেন,

    সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হওয়ার দরুন প্রধান উপকার হবে ব্রিটিশদের, হিন্দুদের চোখে আরও উজ্জ্বল হবে ব্রিটিশের ভাবমূর্তি হিন্দুরা যখন দেখবে তাদের দর্শন শাস্ত্র সম্পর্কে অনীহা বা অবজ্ঞা দূরে থাক, সে সব বিষয়ে স্থানীয় রাজন্যবর্গের চেয়েও সরকারের আগ্রহ ঢের বেশি, তখন স্বভাবতই বিদেশি সরকারের প্রতি, হিন্দুদের মনে সম্ভ্রম সম্প্রীতির ভাব আরও জোরদার হবে১৭

    কলকাতায় মাদ্রাসা বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করে শিক্ষাক্ষেত্রে দেশীয় মানুষদের সামান্য সন্তোষবিধান করার পরে, লর্ড ওয়েলেসলি (কার্যকাল: মে ১৭৯৮-জুলাই ১৮০৫) নামেন, তাঁর দেশোয়ালি ভাইদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে।

    সওদাগরি ব্যবস্থা মসৃণভাবে চালাতে গেলে, সওদাগরদের সওদার ভাষা শিখে নেওয়া খুব জরুরি। শুধু তাই নয়, দেওয়ানি ফৌজদারি মামলার রায় যাতে শাসকস্বার্থকে অক্ষুন্ন রাখে, সেদিকে দৃষ্টি রেখে আদালতের ভাষার ওপর দখলদারিও প্রয়োজনীয় বটে। তাই ইংল্যান্ড থেকে আগত ছোকরা সাহেব কর্মচারীদের ভারতীয় ভাষাশিক্ষা শেখানোর উদ্দেশ্যে, ১৮০০ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। কলেজে মূলত শেখানো হত আরবি, ফারসি, হিন্দুস্তানি, সংস্কৃত, বাংলা অন্যান্য দেশীয় ভাষা। কলেজের প্রতিটি বিভাগের মূল দায়িত্বে ছিলেন একজন ইউরোপীয় অধ্যাপকযেমন আরবি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন বেইলি (John Baillie), ফারসির দায়িত্বে এডমনস্টোন (N.B. Edmonstone), হিন্দুস্তানির দায়িত্বে গিলক্রিস্ট (John Gilchrist), সংস্কৃতের দায়িত্বে কোলব্রুক (Henry Colebrooke) এবং বাংলা অন্যান্য দেশীয় ভাষাশিক্ষার দায়িত্ব ছিল কেরি (William Carey)- ওপর

    এই অধ্যাপকদের সহায়তা করার জন্য ছিলেন একজন প্রধান মুনশি, একজন দ্বিতীয় মুনশি এবং একদল অধস্তন মুনশি তবে অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রে এই সহায়কদের মুনশি বলা হলেও, বাংলা সংস্কৃত বিভাগের সহায়করা পণ্ডিত নামে পরিচিত ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, কেরির প্রধান পণ্ডিত ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, দ্বিতীয় পণ্ডিত রামনাথ বাচস্পতি এবং অধস্তন পণ্ডিতরা ছিলেন শ্রীপতি রায়, আনন্দচন্দ্র শর্মা, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, পদ্মলোচন চূড়ামণি রামরাম বসু খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্ষেত্রে অধ্যাপদের সঙ্গে, তাঁদের সহকারীদের বেতন বৈষম্য বহাল ছিল। ইউরোপীয় অধ্যাপকদের মাসিক বেতন ছিল ১৫০০ টাকা (তবে অধ্যাপক বেইলি ১৬০০ টাকা কেরি ৫০০ টাকা পেতেন); পাঁচটি বিভাগের প্রধান মুনশি মাসিক ২০০ টাকা, দ্বিতীয় মুনশি ১০০ টাকা এবং অন্যান্য অধস্তন মুনশি ৪০ টাকা পেতেন ভাষাশিক্ষার আসল কাজটাএই পণ্ডিত বা মুনশিরাই করতেন, যদিও তাঁদের নিয়ন্ত্রণের রাশটা ছিল তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ওপর শিশিরকুমার দাশ যথার্থই মন্তব্য করেছেন

    The European teachers controlled the policy and the Indian teacher obeyed the orders. The British teachers in the College were not only inferior to their European counterparts, they were also inferior to their Indian colleagues, in respect of their knowledge of Indian languages. And yet the Indian scholars were not treated at par with the European scholars. …The Indian scholar knew that he was superior to his European master in respect of the knowledge of the Indian language, but he also realised that he was not competent to teach that language directly to foreign students without the help of the European teacher. He was primarily an informant, a mere tool in the exercise of language teaching to be handled by others.১৮

    প্রসঙ্গত, ১৮১৩ সালের সনদের আগে মিশনারিদের কলকাতায় কার্যকলাপ চালানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও, কেরির ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটানো হয়েছিল।

     ওয়েলেসলি কলেজটিকে গড়তে চেয়েছিলেন অক্সফোর্ডের আদলে, ১৮০১- কলেজে পড়াশোনা শুরু হওয়ার মাত্র দু-বছরের মধ্যে, বাবদ খরচ হয়েছিল ,২৪,৫৫৫ পাউন্ড।১৯ বলা বাহুল্য, এহেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যয়বহুল প্রকল্প লন্ডনস্থ কোম্পানির পরিচালকবর্গের আদৌ মনঃপূত ছিল না। ১৮০৪- এই খরচে রাশ টানতে ইংল্যান্ডে একটি কলেজ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে সিদ্ধান্তের মূল মাথা ছিলেন চার্লস গ্র্যান্ট। এমব্রি জানাচ্ছেন:

    there was never any question in the minds of those familiar with the Company’s administration that Grant was the driving force behind the move to establish a college and was the author of the Report that outlined its constitution .২০

    ঠিক হয়, ইংল্যান্ডের প্রস্তাবিত কলেজটিতে ভাবী সিভিলিয়ানরা দু-বছর বাধ্যতামূলক পড়াশোনার সঙ্গে, প্রাথমিক স্তরে ভারতীয় ভাষাসমূহ শিখবেন এবং তার পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যে কোনও একটি ভারতীয় ভাষা শিখবেন অবশেষে ১৮০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হেইলিবারি ( Haileybury) কলেজ, যেখানে ভবিষ্যতের সিভিলিয়ানরা ইউরোপীয় বিষয়সমূহের সঙ্গে ভারতীয় ভাষা হিসেবে আরবি, ফারসি হিন্দুস্তানি শিখতে শুরু করে ১৮০৭ থেকেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজটি মাত্র তিনজন অধ্যাপক-শিক্ষকআরবি ফারসির জন্য বেইলি, হিন্দুস্তানির জন্য ক্যাপ্টেন মোয়াট এবং সংস্কৃত বাংলার জন্য কেরিনিয়ে ক্রমে মৃতপ্রায় হতে শুরু করে।   

    ১৮১-তে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নির্দেশে, কোম্পানিকে দেশের শিক্ষার দায়িত্ব খানিকটা স্বীকার করে নিতে ১৮১৩ সালে প্রবর্তিত নতুন সনদের ৪৩ সংখ্যক ধারা অনুযায়ী বলা হয়:

    সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন উন্নতি এবং বিদ্বান ভারতীয়দের উৎসাহদান বিজ্ঞানের প্রবর্তন প্রসারের উদ্দেশ্যে, বাৎসরিক অন্যূন এক লক্ষ টাকা ব্যয় করা হবে

    যেহেতু সনদের এই ধারাটিতে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে ভবিষ্যতে ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে তোলপাড় ঘটবে, সে কারণে সনদে ঠিক কী বলা হয়েছিল সেটা দেখে নেওয়াও জরুরি। সেখানে বলা হয়  

    a sum of not less than one lac of rupees in each year shall be set apart and applied to the revival and improvement of literature and the encouragement of the learned natives of India, and for the introduction and promotion of a knowledge of the sciences among the inhabitants of the British territories in India ....২১

    তবে সনদের ধারাটিতে শিক্ষার জন্য এক লক্ষ টাকা ব্যয় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচলনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা লেও, কোম্পানির এই প্রতিশ্রুতি পালনের বিষয়টি কোন ভাবে বাধ্যতামূলক ছিল না

    সনদের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রাচ্যবাদী প্রতীচ্যবাদীদের মধ্যে বিতর্কে ঝড় উঠলেও কোম্পানি বিজ্ঞান শিক্ষাদানের প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। তাদের তরফে অজুহাত হিসেবে যুক্তি দেখানো হয়, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের শিক্ষাদান জনসাধারণের যুক্তিসঙ্গত চাহিদার মধ্যে পড়ে না বং তা দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। ১৮১৪-তে কোম্পানির পরিচালকবর্গ লন্ডন থেকে কড়া নির্দেশ পাঠান, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অনুকরণে ভারতবর্ষে কোন কলেজ  প্রতিষ্ঠা করা যাবে না এই সময়ে গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ময়রা, মার্কুইস অফ হেস্টিংস (কার্যকাল: অক্টোবর ১৮১৩-জানুয়ারি ১৮২৩) ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান সম্ভবত শূন্য। তবু তাঁরই ভূয়সী প্রশংসা করে বিদ্যাসাগর লিখবেন,

    লার্ড হেষ্টিংস বাহাদুরের অধিকারের পূর্বে, প্রজাদিগকে বিদ্যাদান করিবার কোনও অনুষ্ঠান হয় নাই প্রজারা অজ্ঞানকূপে পতিত থাকিলে, কোনও কালে, রাজ্যভঙ্গের আশঙ্কা থাকে না; এই নিমিত্ত, তাহাদিগকে বিদ্যাদান করা রাজনীতির বিরুদ্ধ বলিয়াই পূর্বে বিবেচিত হইত। কিন্তু লার্ড হেষ্টিংস বাহাদুর, এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করিয়া, কহিলেন, ইঙ্গরেজরা, প্রজাদের মঙ্গলের নিমিত্তই, ভারতবর্ষে রাজ্যাধিকার স্থাপিত করিয়াছেন; অতএব, সর্বপ্রযত্নে, প্রজার সভ্যতা সম্পাদন ইঙ্গরেজ জাতির অবশ্যকর্তব্য অনন্তর, তদীয় আদেশ অনুসারে, স্থানে স্থানে বিদ্যালয় স্থাপিত হইতে লাগিল২২

    যাই হোক, অবশেষে বিস্তর টানাপোড়েনের পরে ১৮২৩-এর ১৭ জুলাই, কোম্পানির পরিচালকবর্গ বাংলায় শিক্ষাবিভাগ পরিচালনার জন্য দশ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা সংসদ (General Committe of Public Instruction) স্থাপন করেন

    সংসদের সদস্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, শিক্ষাখাতে বরাদ বাৎসরিক অন্যূন এক লক্ষ টাকা প্রাচ্যবিদ্যা ক্ষেত্রে ব্যয় করা হবে। শিক্ষার বিষয় হবে সংস্কৃত আরবি-ফারসি সাহিত্য-ব্যাকরণ এবং প্রাচ