এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  সমাজ

  • দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর - ৭

    এলেবেলে লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | সমাজ | ০৭ নভেম্বর ২০২০ | ৩০৪০ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • সপ্তম অধ্যায়

     

    সংস্কৃত কলেজে শিক্ষাসংস্কার  বিলিতি তলোয়ারের খাপে দিশি খাঁড়া ভরবার কসরত

     

    সংস্কারকথাটির মূল অর্থ মনের ওপর ছাপ বা দাগ ছাপহীন বা দাগহীন মন অসম্ভব এবং অবাঞ্ছনীয় এই ভাবে বুঝলে সংস্কারহীন মানুষ জড়বুদ্ধি বা মুক্তপুরুষ হতে পারে, সভ্য হতে পারে না ধর্ম সংস্কারক বা সমাজসংস্কারক তাই শুধু পুরাতন, জড়ীভূত কালের অনুপযোগী সংস্কারগুলিকে ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হন না, বিচার বিবেকের দ্বারা পরীক্ষিত, যুগের বৈপরীত্যগুলির মধ্যে সমন্বয়কারী একগুচ্ছ নতুন ভাবনা আচরণের অভ্যাস বা সংস্কার তিনি প্রবর্তনও করেন

    অরিন্দম চক্রবর্তী, মননের মধু

     

     

    কর্মজীবনে তিন-তিনবার চাকরি বদলের পরে, সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের পদে থিতু হন বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রথমে প্রায় সাড়ে চার বছর পরে প্রায় পৌনে দু-বছর সময়কালে, তাঁর শিক্ষাসংস্কারের কোনও সংবাদ পাওয়া যায় না অবশ্য সে সুযোগও তাঁর ছিল না। মধ্যবর্তী সময়ে তিনি সংস্কৃত কলেজের জন্য শিক্ষা পরিকল্পনা পেশ করলেও, তা গৃহীত হয়নি। সম্পাদক সহকারী সম্পাদকের পদ রাতারাতি বিলোপের ফলে অধ্যক্ষরূপে অবাধ দাপট, অসীম কর্তৃত্ব একক ক্ষমতা লাভ করে, তিনি মনোযোগী হন কলেজটিকে ঢেলে সাজানোর কাজে। বস্তুতপক্ষে সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরেরশিক্ষাসংস্কার’-এর বিষয়টি নিয়ে ভক্ত গবেষকরা এতটাই গদগদ যে, তাঁদের সমবেত ভক্তির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। হয় সেই অপ্রিয় বিষয়গুলো তাঁরা আড়াল করতে চেয়েছেন, নতুবা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন।

    বিষয়ে সর্বপ্রথম পরিশ্রমী গবেষণা করেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ (১৩৩৮) গ্রন্থে তিনি সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের শিক্ষাসংস্কারের যে বিষয়গুলিকে তুলে ধরেন, সেগুলি যথাক্রমে এই ) কলেজে ব্রাহ্মণ বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থদের ভর্তি হওয়া, ) প্রচলিত অষ্টমী প্রতিপদের পরিবর্তে কলেজ কেবল রবিবার বন্ধ রাখা, ) ব্রাহ্মণ, বৈদ্য কায়স্থদের পাশাপাশি সমস্ত সম্ভ্রান্ত হিন্দুসন্তানের কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া, ) হিন্দু কলেজ কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্রদের মতো সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্যও ডেপুটিগিরির সুযোগ করে দেওয়া, ) ছাত্রদের জন্য বেতন চালু করা, ) ব্যাকরণ শ্রেণিতে মুগ্ধবোধ পড়ানোর বিলুপ্তি, ) পাঠ্যক্রমে ইংরেজি আবশ্যিক করা এবং ) দর্শনের পাঠ্যসূচী নিয়ে ব্যালান্টাইনের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক ব্রজেন্দ্রনাথের গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার ৮৯ বছর পরেও, বিষয়ে আপামর বাঙালির ভক্তির প্রাবল্য এতটুকু কমেনি! আমরা বিদ্যাসাগরের এই আটটি শিক্ষাসংস্কার মূল্যায়ন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব, যদিও আলোচনার সাযুজ্যের কারণে ব্রজেন্দ্রনাথের ক্রমটি লঙ্ঘিত হবে।

    ১৮৩৫- দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলনের পর থেকেই, সংস্কৃত কলেজের আর্থিক হাল ক্রমে খারাপ হতে থাকে ১৮৩২-৩৪ সালে কলেজে বার্ষিক ব্যয়বরাদ্দ ছিল গড়ে ২৪ হাজার টাকা, ১৮৩৫ থেকে ১৮৫১ পর্যন্ত তা কমে হয় বার্ষিক গড়ে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা ১৮৩৫- কলেজে ছাত্রপিছু সরকারের ব্যয় ছিল প্রায় ১৬২ টাকা, ১৮৫১-তে তা কমে হয় মাত্র ৬২ টাকা। মেকলে তাঁর বিখ্যাত প্রস্তাবে বলেন, কলকাতার মাদ্রাসা আর সংস্কৃত কলেজদুটোই তুলে দেওয়া হোক। প্রাচ্যভাষা চর্চার জন্য দিল্লির মাদ্রাসা আর কাশীর সংস্কৃত কলেজ রাখাই যথেষ্ট। এমনকি সেখানেও ছাত্রদের বৃত্তি হিসেবে নগদ টাকা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। ওসব ভাষাচর্চা করার ইচ্ছে থাকলে, ছাত্রদের পকেটের কড়ি খসিয়ে শেখাই বরং ভালো। বৃত্তির প্রলোভন দেখিয়ে দেশীয় ভাষাচর্চার প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্রদের ভর্তি করার প্রথাকে মেকলেbribe বলতেও দ্বিধা করেননি।

    ইংরেজি শিক্ষার প্রতি চাহিদা বৃদ্ধির প্রমাণ পেশ করে মেকলের দোসর ট্রেভেলিয়ান বলেন, ১৮৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের থেকে বেতন বাবদ সরকারের আয় হয়েছে ১৩২৫ টাকা, অথচ সংস্কৃত কলেজে ৩০ জন ছাত্রকে মাসে টাকা ৭০ জনকে মাসে টাকা করে বৃত্তি দেওয়া বাবদ সরকারের খরচ হচ্ছে মাসিক ৫৯০ টাকা ১৮৩৫-এর মার্চে দেশে ফিরে যাওয়ার আগে, বেন্টিঙ্ক অবশ্য এই ধরণের প্রাচ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর এতটা নির্দয় হতে পারেননি। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, যাবৎ প্রতিষ্ঠিত কোনও সরকারি প্রাচ্যবিদ্যার প্রতিষ্ঠানকে বিলুপ্ত করা হবে না, তবে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের জন্য বৃত্তিপ্রথা তুলে দেওয়া হবে। এই প্রথা ফিরিয়ে আনতে চেয়ে ১৮৩৬-এর অগস্ট সংস্কৃত কলেজের ৭০ জন ছাত্র একটি লিখিত আবেদন পেশ করেন, যদিও তাতে লাভ হয়নি। ১৮৩৮-৩৯ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে যে ঈশ্বর নগদ ৮০ টাকা পুরস্কার পান, সংস্কৃত কলেজের অস্থায়ী সম্পাদকের পদে আসীন হওয়ার পরে, তিনিই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ১৮৫১-এর ১৩ জানুয়ারি শিক্ষা সংদের কার্যকারী সম্পাদককে চিঠিতে জানান‘…Book prizes are to be substituted instead of Money prizes heretofore given to the best students of the Grammar Department 

    বলা বাহুল্য, এই উদ্দেশ্যেই তিনি সংস্কৃত কলেজে বেতন প্রথা চালু করেছিলেন। কলেজের জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্ররা বিনা বেতনে কলেজে পড়ত, ভর্তি হতেও কোনও টাকাপয়সা লাগত না। এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সময়ে প্রাচ্যবিদ্যার চর্চাকে উৎসাহদান নয়, বরং সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল আদালতের কাজে সহায়তা করার জন্য কিছু সস্তা পণ্ডিতের যোগান অব্যাহত রাখা। ফলে তাদের স্বার্থেই এই ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা পুরোদমে চালু হওয়ার পরে, এই প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের বোঝাস্বরূপ হয়ে ওঠে ফলে তখন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে, যে কোনও উপায়ে প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস করা।

    সরকারের এই মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, ১৮৫২ সালের ১৯ অগস্ট বিদ্যাসাগর সম্পাদক মোয়াটকে যে চিঠি লেখেন, তাতে তিনি কলেজে বেতন প্রথা চালু করার দুটি বাহ্যিক কারণ দেখান। প্রথমত, ছাত্ররা বিনা পয়সায় এই কলেজে ভর্তি হয়ে নিয়মিত হাজিরা দেয় না তাদের কোনও ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে থাকে, ফলে সেই সুযোগ পেলে তারা কলেজ ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, ভর্তি হয়ে চলে যাওয়ার জন্য হাজিরা খাতায় নাম কাটা যাওয়ার পরে, কোনও কারণে আবার কলেজে ফিরে এসে ভর্তি হয়। কলেজে শৃঙ্খলা বজায় রাখার খাতিরে তিনি প্রস্তাব রাখেন, সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হতে টাকা লাগবে হাজিরা খাতা থেকে একবার নাম কাটা গেলে, আবার ভর্তি হতে ফের টাকা দিতে হবে অথচ এই প্রস্তাব তড়িঘড়ি মঞ্জুর হওয়ার পরে, বিদ্যাসাগরের ১৮৫৩- ১২ এপ্রিলের চিঠি থেকে জানা যায়, সব মিলিয়ে বাবদ আদায় হয়েছিল মাত্র ৪০ টাকা! আর কলেজের জন্মলগ্ন থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত বিদ্যাসাগর যে ছাত্রতালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেন, তাতে দেখা যায় দীর্ঘ ২৮ বছরে ভর্তি হওয়া একটি ছাত্রও পড়া ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যায়নি!!

    যে চিঠিতে তিনি ভর্তি ফি বাবদ টাকা নেওয়ার প্রস্তাব জানান, সেই চিঠির একদম শেষ বাক্যে তিনি লেখেন:

    This measure, if adopted, will, it may be hoped, pave the way for the introduction of the pay system.১০

    কলেজের বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে কথা স্পষ্টকলেজে বেতন প্রথা চালু করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, সরকারি ব্যয়সংকোচ নীতির সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রাখা ১৮৫৪- জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ছাত্রপিছু মাসিক এক টাকা বেতন নেওয়া শুরু হলে, কলেজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি যে বিশুদ্ধ বাহানা ছিল, তা আরও স্পষ্ট হয়। কারণ, ওই বছরের ২৪ জুন শিক্ষা সংসদের নতুন সম্পাদক উড্রো (H.Woodrow) সাহেবকে তিনি জানান

    …as the pay-system has been introduced the admission and re-admission fees produced under the order of the Council No. IV, dated the 28 August 1852, be discontinued.১১

    এই তথ্যগুলি নতুনও নয়, গবেষকদের অজানাও নয়। তবুও তাঁরা বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করেন, কারণ তাতেঈশ্বর’-এর ভাবমূর্তি নির্মাণের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়!

    অনুরূপভাবে সরকারি ব্যয়সংকোচ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার কারণে, তাঁর আমলে ছাত্রদের ডেপুটিগিরি সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই কলেজ যে অন্য আর পাঁচটা কলেজের মতো ছাত্রদের ভবিষ্যতের পেশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ভূমিকা পালন করতে পারে, এই আশা দেখিয়ে অধিক সংখ্যক ছাত্র ভর্তি করাই ছিল এই তথাকথিতসংস্কার’-এর মূল উদ্দেশ্য। হিন্দু কলেজ কলকাতা মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রথমাবধি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ পেত। প্রাচ্যবিদ্যার প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসার ছাত্ররা সুযোগ পেলেও, সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্য তা ছিল না। তাঁর কলেজের ছাত্রদের জন্যও এই পদ দেওয়ার অনুরোধ করে, বিদ্যাসাগর ১৮৫২ সালের ১৩ জানুয়ারি মোয়াটকে চিঠি লেখেন তাঁর অনুরোধ মঞ্জুর করে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের ডেপুটিগিরির পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া শুরু হয় যদিও এই সিদ্ধান্তের ফলে সংস্কৃত কলেজের কতজন ছাত্র শেষ পর্যন্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পেয়েছিল, সে কথা জানা যায় না কাজেই কলেজের ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি নতুন পদে আবেদন করার সুযোগ করে দেওয়ার বেশি, এইসংস্কার’-এর অতিরিক্ত কোনও মূল্যই নেই।

    তবে ছুটি বিষয়টি আরও মজাদার! সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হওয়ার পর থেকে, অষ্টমী প্রতিপদ তিথিতে কলেজ বন্ধ থাকত এই ব্যবস্থার পরিবর্তে শুধু রবিবারে কলেজ বন্ধ রাখার জন্য, ১৮৫১ সালের ২৫ জুলাই বিদ্যাসাগর সংসদ সম্পাদক  মোয়াটকে চিঠি লেখেন এবং তাঁর প্রস্তাব অনুমোদিত হয় যদিও ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘the number of working days remaining the same as before১২; আসলে কিন্তু কলেজ বন্ধ হয় ৪৮ দিনের বদলে ৫২ দিন! এহ বাহ্য, কলেজের পরীক্ষা অক্টোবর থেকে পিছিয়ে এপ্রিলে নেওয়ার জন্য, পরের বছরে ১৬ মার্চ তিনি মোয়াটের কাছে আবেদন করেন। সেই চিঠিতে তিনি দু-মাস গ্রীষ্মাবকাশের প্রস্তাব দেন। তাঁর দুটি আবেদনই সরকারিভাবে মঞ্জুর হয় যদিও তাতে কলেজে মোট বিধিবদ্ধ ছুটির পরিমাণ ৬২ দিন থেকে বেড়ে হয় ৮৫ দিন প্রসঙ্গত, অষ্টমী-প্রতিপদে কলেজ বন্ধ রাখার দীর্ঘ দিনের প্রচলিত রীতি বন্ধ হলেও, ‘Her Majesty’s Birthday১৩- জন্য বরাদ্দ ছুটির প্রচলিত রীতি কিন্তু বন্ধ হয়নি! হয়তো এই কারণেই কলেজে সব মিলিয়ে কর্মদিবস প্রায় এক মাস কমছে বুঝতে পেরেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি!!

    সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি বিভাগ খোলার জন্য, বিদ্যাসাগর ১৮৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মোয়াটকে প্রথম চিঠিটি লেখেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান: The utility of the Sanscrit College depends greatly on the efficient state of the English Department, and for this the present establishment of two teachers is inadequate .১৪ [নজরটান সংযোজিত]

    তাঁর উল্লিখিতutilityশব্দটির মূল তাৎপর্য ছিল, নতুন যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সংস্কৃত কলেজে আকৃষ্ট করা নতুবা তদানীন্তন বাংলায় একাধিক ইংরেজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও, সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত পাঠ্যক্রমের সঙ্গে নতুন করে একটি ইংরেজি বিভাগ খোলার অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে না খেয়াল করলে দেখা যাবে, কলেজের ছাত্রদের ডেপুটিগিরির আবেদন করার অনুরোধ জানিয়ে লেখা তাঁর চিঠিটির মাত্র এক মাস ব্যবধানে, তিনি এই চিঠিটি লেখেন। সরকারি ব্যয়সংকোচ নীতির সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রাখার জন্য তিনি যেমন কলেজে বেতন প্রথা চালু করেন, তেমনই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাচ্যবিদ্যার প্রতিষ্ঠানেও চালু করার জন্য, তিনি ডেপুটিগিরির প্রলোভন দেখিয়ে কলেজে ইংরেজি বিভাগ চালু করেন।  

    চিঠির উত্তরে মার্চ মোয়াট বিদ্যাসাগরকে জানানyour proposal has been favourably considered১৫ এর পরে প্রথমে ১৮৫৩-এর ১৬ জুলাই তিনি ইংরেজি বিভাগের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক, তাঁদের বেতনক্রম প্রয়োজনীয় ক্লাসরুমের আবেদন জানিয়ে শিক্ষা সংসদে চিঠি লেখেন এবং ওই বছরের ২৭ অক্টোবর তিনি পাঁচ জন শিক্ষক নির্বাচন করে সংসদকে জানান। এঁদের মধ্যে ইংরেজি বিভাগের চার জন হলেনঅধ্যাপক প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী (বেতন মাসিক ১০০ টাকা) এবং প্রথম, দ্বিতীয় তৃতীয় জুনিয়র শিক্ষক কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রসন্নকুমার রায় (বেতন যথাক্রমে মাসিক ৮০, ৫০ ৩০ টাকা) আগে কলেজে অঙ্ক শেখানো হত সংস্কৃতে, পড়ানো হত ভাস্করাচার্যের লীলাবতী বীজগণিত বিদ্যাসাগর তার পরিবর্তে ইংরেজিতে অঙ্ক শেখানো শুরু করেন, ১০০ টাকা মাসিক বেতনে নিযুক্ত করেন গণিতের অধ্যাপক শ্রীনাথ দাসকে।১৬ কলেজে মোট ক্লাসের এক-তৃতীয়াংশ ইংরেজি বিভাগের জন্য বরাদ্দ করে, নভেম্বর মাস থেকে তিনি কলেজে পুরোদস্তুর ইংরেজি পড়ানো শুরু করে দেন বিদ্যাসাগরের এই পরিকল্পনায় শিক্ষা সংসদের কর্তাব্যক্তিরা খুশি হয়ে মাত্র তিন বছরে মাথায়, ১৮৫৪- জানুয়ারি থেকে তাঁর মাইনে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দেন।

    তবে নিজের বেতনের এহেন বৃদ্ধিতে বিদ্যাসাগর সম্ভবতলজ্জিতবোধ করেছিলেন। হয়তো সে কারণেই তিনি ওই বছরের এপ্রিল, সংসদ সম্পাদকের কাছে কলেজের শিক্ষকদের বেতনবৃদ্ধির জন্য আবেদন করেন। তাঁর চিঠি থেকে জানা যায়, গত বারো বছরে সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক পণ্ডিতদের বেতন এক পয়সাও বাড়েনি।মানবতাবাদীবিদ্যাসাগর নিতান্তদয়াপরবশহয়ে সংস্কৃত বিভাগের আপামর শিক্ষকের জন্য, মাসে দশ টাকা বেতনবৃদ্ধির প্রস্তাব করেন; আর মাত্র পাঁচ মাস আগে নিযুক্ত ইংরেজি বিভাগের দুজন অধ্যাপককে মাসিক ৫০ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন!১৭ শুধু তাই নয়, ১৮৫৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর নবগঠিত জনশিক্ষা অধিকর্তা (Director of Public Instruction) গর্ডন ইয়ং (W. Gordon Young) সাহেবকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে জানা যায়সংস্কৃত বিভাগের দর্শন, ন্যায়, অলঙ্কার, সাহিত্য ব্যাকরণ বিভাগের সমস্ত শিক্ষকের বেতন দিতে বছরে খরচ হয় ,৮৬০ টাকা; অথচ ইংরেজি বিভাগের মাত্র পাঁচ জন শিক্ষকের জন্য বেতন বাবদ ব্যয় হয় বার্ষিক ,৩২০ টাকা।১৮ যদিও তাঁর আমলে সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষকদের বেতন এক পয়সাও বাড়েনি। ইংরেজ আমলে ইংরেজি জানা শিক্ষকদের বেতন যে অন্যদের থেকে বেশি হবে, আর কী এমন নতুন কথা! সমস্ত ঘটনা থেকে স্পষ্ট, বেন্টিঙ্ক যেমন মেকলেকে চিনে নিতে ভুল করেননি; ঠিক তেমনই মার্শাল, মোয়াট বেথুনের জহুরির চোখ জহর চিনতে ভুল করেনি!!

    কিন্তু এই বিশাল সময় বিপুল অর্থ ব্যয় করার পরে কলেজের ছাত্ররা কতটুকু ইংরেজি শিখেছিল? ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম গ্র্যাজুয়েট হন বঙ্কিমচন্দ্র যদুনাথ বসু এবং পরের বছরে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৬০- যে চার জন গ্র্যাজুয়েট হন, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি বিদ্যাসাগরের অধ্যক্ষতার সময়ে সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেন বিদ্যাসাগরের প্রিয় ছাত্র এহেন কৃষ্ণকমল বিষয়ে খোলাখুলি জানিয়েছেন

    তবে বিদ্যাসাগর মহাশয় যেন কতকটা ভিতরের ব্যাপার বুঝিয়া রাখিয়া ছিলেন, কারণ তিনি একদিন আমাকে স্পষ্ট বলিলেন, তোরা দুইয়ের বার হয়ে রইলি, না ইংরাজিও তেমন লিখতে পারিস, না সংস্কৃততেও পণ্ডিত হলি। তিনি তখনবিধবা বিবাহবাদানুবাদে মগ্নপ্রায় হইয়াছিলেন। তাহার অভিলাষ ছিল যে তাঁহার যুক্তিবিন্যাসগুলি ইংরাজিতে উত্তমরূপে প্রতিপাদিত হয়। কিন্তু সংস্কৃতও ভাল বুঝে, ইংরাজিও ভাল লিখিতে পারে এরূপ লোক না পাওয়ায় নিরস্ত হইয়াছিলেন।১৯

    বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে এসে পড়ে কৃষ্ণকমলের দাদা রামকমল ভট্টাচার্যের কথা। কৃষ্ণকমল তাঁর সম্পর্কে জানিয়েছেন

    ...সংস্কৃতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা বলিতে গেলে আমার জ্যেষ্ঠ হোদর রামকমলের প্রকৃতপক্ষে ছিল। আমার তাহা কিছুই নাই। তিনি সংস্কৃত কলেজে যে ০।১১ বৎসর অধ্যয়ন করিয়াছিলেন, সেই কয় বৎসরের মধ্যে সংস্কৃতশাস্ত্রের এমন কোনও অংশই নাই যাহা তিনি প্রগাঢ়রূপে এবং সুগভীর আলোচনার সহিত অনুশীলন করেন নাই, কি সাহিত্য, কি অলঙ্কার কি দর্শন যখন যাহা পড়িয়াছিলেন, তাহাতেই এরূপ পারিপাট্য পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন যে তাহার ধ্যাপকগণ উত্তরকালে ছাত্রদিগের নিকট তাহাকে দৃষ্টান্তের স্বরূপ উপন্যাসিত করিতেন। আমার বেশ মনে আছে আমি যখন প্রেমচাঁ তর্কবাগীশ মহাশয়ের শ্রেণীতে অলঙ্কার পাঠ করি তখন আমাদের পাঠশৈথিল্যের প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া তিনি বলিতেন, যথার্থ শিখিবার দ্যম কেবল রামকলের দেখিয়াছি২০

    রামকমল ১৮৬০ সালের ১১ জুলাই আত্মহত্যা করেন। হায়, রামকমলকে দিয়েও বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ সম্পর্কে তাঁরযুক্তিবিন্যাসগুলি ইংরাজিতে উত্তমরূপে প্রতিপাদিতকরতে পারেননি!

    তবে ইংরেজির বিষয়টিকেও ছাড়িয়ে গেছে, বিদ্যাসাগরের আমলে কলেজে মুগ্ধবোধ-এর বিলোপ।মুগ্ধবোধ নিয়ে প্রায় সব গবেষকই দুটি উপকারিতার কথা বলেছেন) এর ফলে ছাত্রদের দুরূহ সংস্কৃত ব্যাকরণ পাঠের সময়, আগের তুলনায় অনেক কমেছিল এবং ) ছাত্রদের ব্যাকরণে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল। অথচ খুঁটিয়ে বিবেচনা করলে, দুটি উপকারিতাকেই নেহাতই আচাভুয়া দাবি হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। প্রথমে আমরা দেখে নিই, বিদ্যাসাগর ঠিক কী কারণে সংস্কৃত কলেজে মুগ্ধবোধ-এর পাঠ উঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১৮৫১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা একই বছরে প্রকাশিত হয়েছিল ঋজুপাঠ প্রথম তৃতীয় ভাগ (অগ্রহায়ণ পৌষ, ১৯০৮ সংবৎ) আর দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল পরের বছরে (ফাল্গুন, ১৯০৮ সংবৎ) ১৮৫৪-তে শিক্ষা সংসদের সম্মতিক্রমে, তিনি কলেজ থেকে মুগ্ধবোধ-এর বদলে চালু করেন উপরোক্ত চার-চারটি বই। পরে তার সঙ্গে যোগ হয় আরও একটি গ্রন্থব্যাকরণ কৌমুদী একজন কলেজের অধ্যক্ষ তাঁর নিজের লেখা পাঁচটি বই তাঁরই কলেজের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করছেন, তৎকালীন সময়ে এমন ঘটনা সারা ভারতবর্ষে ঘটেছিল কি না সন্দেহ। অথচ একই বিদ্যাসাগর, তাঁর কলেজে ব্যালান্টাইনের বই চালু করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন!

    সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা-বিজ্ঞাপন’- বিদ্যাসাগর লিখেছেন

    প্রথমেই সংস্কৃত ভাষায় লিখিত সংস্কৃত ব্যাকরণ, এবং ব্যাকরণ সমাপ্ত করিয়াই একবারে রঘুবংশ প্রভৃতি উৎকৃষ্ট কাব্য পড়িতে আরম্ভ করা কোনও ক্রমেই শ্রেয়স্কর বো না হওয়াতে, শিক্ষাসমাজের সম্মতিক্রমে এই নিয়ম নির্ধারিত হইয়াছে; ছাত্রেরা, প্রথমতঃ অতি সরল বাঙ্গালা ভাষায় সঙ্কলিত সংস্কৃত ব্যাকরণ, অতি সহজ সংস্কৃত গ্রন্থ, পাঠ করিবেক; তৎপরে সংস্কৃত ভাষায় কিঞ্চিৎ বোধাধিকার জন্মিলে, সিদ্ধান্তকৌমুদী রঘুবংশাদি পাঠ করিতে আরম্ভ করিবেক। তদনুসারে সরল বাঙ্গালা ভাষায় ব্যাকরণসঙ্কলন দুই তিনখানি সহজ সংস্কৃত পুস্তক প্রস্তুত করা অত্যাবশ্যক বো হওয়াতে, প্রথ পাঠার্থে সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা নামে এই পুস্তক প্রস্তুত প্রচারিত হইল২১ [নজরটান সংযোজিত]

    তার অর্থশিক্ষাসমাজশুধু এই চারটি বই পাঠ্য করার সম্মতি দেননি, তাঁরা কী উপায়ে সংস্কৃত ব্যাকরণকে আয়ত্ত করতে হবে, তার নিয়মও নির্ধারণ করে দিয়েছেন! বটেই তো, হ্যালহেড যেমন বাঙালির চেয়েও বেশি বাংলা জানতেন; কেমন করে শুদ্ধ বাংলা লিখতে হয়, তার নিয়ম নির্ধারণ করেছিলেন; মার্শাল-মোয়াট জুটিও তেমনই সংস্কৃত ব্যাকরণের পাণিনি-পতঞ্জলি! আর সংস্কৃতজ্ঞ বিদ্যাসাগর তাঁদের হুকুমবরদার মাত্র!

    তিনি জানিয়েছেন,

    এই গ্রন্থে অল্প বয়স্ক বালকদিগের প্রথমশিক্ষোপযোগী স্থূ স্থূ বিষয় সকল সঙ্কলিত হইয়াছে। ইহা পাঠ করিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণে ব্যুৎপত্তি জন্মিবেক না যথার্থ বটে; কিন্তু উপদেশসাক্ষ হইয়া সহজ সহজ সংস্কৃত গ্রন্থ সকল সহজে অধ্যয়ন করিবার ক্ষমতা জন্মিবেক, সন্দেহ নাই; এবং ইহাই এই পুস্তক প্রস্তুত করিবার মুখ্য তাৎপর্য।...আর হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ, ভট্টিকাব্য, তুসংহার, বেণীসংহার এই কয়েক গ্রন্থ হইতে বালকদিগের পাঠোপযোগী অংশ সকল সঙ্কলন করিয়া ঋজুপাঠ নামে তিনখানি পুস্তক প্রস্তুত হইয়ছে। এতদ্বতিরিক্ত মুগ্ধবো অথবা লঘুকৌমুদীতে ব্যাকরণের যত বিষয় লিখিত আছে, সেই সমুদয় বাঙ্গালা ভাষায় সঙ্কলন করিয়া অতি ত্বরায় ব্যাকরণকৌমুদী নামে আর একখানি পুস্তক প্রস্তুত করা যাইবেক২২ [নজরটান সংযোজিত]

    অর্থাৎ, ) এই বই পড়ে ব্যাকরণে বুৎপত্তি জন্মাবে না, ) এর সঙ্গে আরও তিনটি বই ছাত্রদের পড়তে হবে এবং ) অতি শিগগির পঞ্চম বইটিও আসবে! তখন ছাত্রদের বোপদেবের একটি বইয়ের বদলে পড়তে হবে, বিদ্যাসাগরের পাঁচ-পাঁচটা বই!!

         অথচ তার পরেও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন

    ১৮৫১ সালের নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজে এক উন্নত প্রণালীর শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হইল ব্যাকরণ-বিভাগ সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত হইল। পূর্বে বোপদেবেরমুগ্ধবোধছিল ব্যাকরণের একমাত্র পাঠ্যপুস্তক। সংস্কৃত শিক্ষার গোড়াতেই সংস্কৃতে লেখা এই দুরূহ ব্যাকরণখানি ছেলেদের পড়িতে হইত। এখানি আয়ত্ত করিতে লাগিত চার-পাঁচ বৎসর; তাও ছেলেরা অর্থ না বুঝিয়াই মুখস্থ করিত। কাজেই সংস্কৃত-সাহিত্য পড়িবার সময় এই মুখস্থ বিদ্যা বিশেষ কাজে লাগিত না; দেখা যাইত, ভাষায় তাহারা আশানুরূপ অধিকার লাভ করে নাই। বিদ্যাসাগর ছেলেদের বাধাটুকু বুঝিতে পারিলেন। তিনি দেখিলেন, বাঙালী ছাত্রকে সংস্কৃত শিখাইতে হইলে বাংলায় ব্যাকরণ পড়াইতে হইবে। তিনিমুগ্ধবোধপড়ানো বন্ধ করিলেন এবং তাহার পরিবর্তে বাংলায় লেখা স্বরচিতসংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকাব্যাকরণ কৌমুদীধরাইলেন। এই সঙ্গেঋজুপাঠ পড়ানো হইতে লাগিল। সংস্কৃত গদ্য কাব্য হইতে কতকগুলি নির্বাচিত অংশ ঋজুপাঠে সন্নিবেশিত হইয়াছে। এই নব ব্যবস্থার ফল ভালই হইল। সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে এই ব্যবস্থায় সংস্কৃতে মোটামুটিরূপে ব্যুৎপত্তি লাভ করিতে তিন বৎসরের বেশী সময় লাগে না।২৩

    সারা গ্রন্থে এই একটিমাত্র বিষয়ে ব্রজেন্দ্রনাথ কোনও তথ্যসূত্র না দেওয়ায় মনে হওয়া স্বাভাবিক, এটি বুঝি তাঁরই উপলব্ধি। কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ তো বিদ্যাসাগরের ছাত্র নন। তিনি এত কথা লিখলেন কোন যাদুমন্ত্রে?

    অবশেষে আবিষ্কৃত হয় ব্রজেন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাসের উৎস আসলে তিনি জনশিক্ষা দফতরের সরকারি প্রতিবেদনটির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন মাত্র! এই সেই রিপোর্ট:

    The introduction of a re-modelled system of study in the Grammar Department was noticed in the Annual Report of the Institution for the session 1852-53. Previous to November 1854, the Mugdhabodha, a Sanscrit Grammar in Sanscrit was the text-book of the Grammar Department. Pupils had to begin their study of Sanscrit with this most difficult book, and they had to spend four or five years. Young lads, on account of the extreme difficulty of this Grammar, only learnt by rote what their instructors said, without being able in almost every instance, to understand the contents of the work they read. In consequence of this, the knowledge they acquired of Grammar was very imperfect, and they had to experience great difficulty in being made, all at once, to begin with the standard works in the Sahitya or Literature Class, to which they were promoted after they have finished their course in the Grammar Department. By the adoption of the new system, a totally different course has been pursued. The study of the Mugdhabodha has been discontinued, and in its stead outlines of Sanscrit grammar compiled in Bengali, and three Sanscrit Readers, consisting of easy selections in Prose and Verse, have been introduced. To complete this course, a student of ordinary ability, and ordinary application, does not require more than three years. After finishing this course, a student is well grounded in the elements of Sanscrit Grammar and is thoroughly prepared to be introduced to the study of standard works in the Sahitya or Literature Class.২৪ [নজরটান সংযোজিত]

    আগেই দেখেছি, মার্শাল-মোয়াট জুটি সংস্কৃতেও ধনুর্ধর! তাই তাঁরা কলেজের ছাত্র না হয়েও দিব্যি লিখতে পেরেছেন, কলেজের ছাত্রদের আগে যেmost difficult bookটি আয়ত্ত করতে লাগত চার থেকে পাঁচ বছর, এখন লাগছে তিন বছরেরও কম সময়!!

    বিদ্যাসাগর নিজে কতদিনে মুগ্ধবোধ আয়ত্ত করেছিলেন? মাত্র তিন বছরে। তিনি নিজেই লিখেছেন,

    প্রথম তিন বৎসরে মুগ্ধবোধপাঠ সমাপ্ত করিয়া, শেষ ছয় মাসে অমরকোষের মনুষ্যবর্গ ভট্টিকাব্যের পঞ্চম সর্গ পর্যন্ত পাঠ করিয়াছিলাম২৫

    একই কথা বলেছেন শম্ভুচন্দ্রও

    [বিদ্যাসাগর] ব্যাকরণশ্রেণীতে তিন বৎসর ছয় মাস ছিলেন; কিন্তু তিন বৎসরের মধ্যেই ব্যাকরণ সমাপ্ত করেন শেষ ছয় মাস কাল অমরকোষের মনুষ্যবর্গ ভট্টিকাব্যের পঞ্চম সর্গ পর্যন্ত পাঠ করিয়াছিলেন২৬

    আর যিনি বিদ্যাসাগরের আমলে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র ছিলেন, সেই কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য স্মৃতিচারণায় বলেছেন

    তখন আমার বয়স আন্দাজ ৬।৭ বৎসর; বোধ হয় ইংরাজি ১৮৪৭ সাল [আসলে আট বৎসর, ১৮৪৮ সাল; কৃষ্ণকমলের স্মৃতিবিভ্রম] হইবে আমি আমার দাদার সঙ্গে সংস্কৃত কলেজে যাইতাম। তিনি আমাকে একটা বেঞ্চে বসাইয়া রাখিতেন। এই রকম ২।৫ দিন যাইতে যাইতে একদিন বিদ্যাসাগর মহাশয় আমাকে বলিলেন, ‘আয় তোকে ইস্কুলে ভর্তি করে দি তখন কোনও ছাত্রের বেতন দিবার পদ্ধতি ছিল না; কাজেই ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রতিবন্ধক হইল না। ...ইস্কুলে ভর্তি হইয়াই আমারমুগ্ধবোধপড়া আরম্ভ হইল। প্রথম দুই বৎসর ৺প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে অধ্যয়ন করিলাম। ... তৃতীয় বৎসর ৺গোবিন্দ শিরোমণি [আসলে রামগোবিন্দ গোস্বামী (তর্করত্ন); কৃষ্ণকমলের স্মৃতিবিভ্রম] মহাশয়ের ক্লাসে চতুর্থ বৎসর ৺দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের কাছেমুগ্ধবোধঅধ্যয়ন করিলাম। ... এই চারি বৎসরেমুগ্ধবোধপড়া শেষ হইল২৭

    অর্থাৎ বিদ্যাসাগর মুগ্ধবোধ শেষ করেছেন তিন বছরে, আর তাঁর ছাত্র কৃষ্ণকমলেরচারি বৎসরেমুগ্ধবোধ পড়া শেষ হয়েছে। তার পরেও কৃষ্ণকমলের সংস্কৃতজ্ঞান নিয়ে বিদ্যাসাগর যে সন্তুষ্ট ছিলেন না, সে বিষয়ে তিনি নিজেই উক্তি করেছেন যা আগেই আলোচিত হয়েছে তার মানে মুগ্ধবোধের পাঁচ-পাঁচটাসহায়িকা’- না কমেছিল সময়, না বেড়েছিল সংস্কৃততে ছাত্রদের দক্ষতা তবুও মুগ্ধবোধ নিয়ে বাঙালির মুগ্ধতার রেশ একটুও কমেনি। সত্যিই ভক্তি অতি বিষম বস্তু!

    অবশ্য মুগ্ধবোধ-এর থেকেও বাঙালি বেশি আপ্লুত তাঁর বেদান্ত বিরোধিতা প্রসঙ্গে। শিক্ষা সংসদের আমন্ত্রণে, ১৮৫৩- ২১ মে কলকাতা সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শনে আসেন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালান্টাইন (J.R. Ballantyne) কলেজ পরিদর্শন শেষে ব্যালান্টাইন তাঁর রিপোর্ট দাখিল করলে, সংসদ বিদ্যাসাগরের কাছে সেই রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয় ২৯ অগস্ট বিদ্যাসাগর ব্যালান্টাইনের তের সমালোচনা করে সেপ্টেম্বর সংসদের সম্পাদক মোয়াটকে এক দীর্ঘ চিঠিতে জানান:

    কিছু বিশেষ কারণে, যদিও এখানে সেই কারণগুলির উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই, সংস্কৃত কলেজে আমাদের বেদান্ত সাংখ্য পড়াতেই হয় কিন্তু বেদান্ত সাংখ্য যে ভ্রান্তদর্শন, বিষয়ে এখন আর কোনও বিতর্ক নেই তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে সংস্কৃত পাঠক্রমে এগুলি যখন পড়াতে হবে, তখন [এগুলি পড়ানোর সময়ে] এদের প্রভাব দূর করার ন্য ইংরেজি পাঠক্রমে খাঁটি (sound) দর্শন দিয়ে এগুলির বিরোধিতা করা উচিত।২৮

    আজ অবধি সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর-প্রবর্তিত পাশ্চাত্য দর্শনের পাঠ্যসূচীতে কোন কোন বই পড়ানো