এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  বিবিধ

  • লা জওয়াব দিল্লী - ৪

    শমীক মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ৩০ নভেম্বর ২০০৮ | ৭৭৮ বার পঠিত
  • মোটরসাইকেল ডায়েরিজ

    ভুবনেশ্বর থেকে পাকাপাকি পাট তুলে দিল্লিতে আসার সময়ে নিজের হোল্ডঅল আর সুটকেস ছাড়াও গ্যাঁড়া আর দুটো জিনিস নিয়ে আসতে পেরেছিল। এক, টিভি, আর দুই, মোটরসাইকেল। সেই ওড়িয়া মোটরসাইকেল গ্যাঁড়ার বেশ প্রিয় ছিল।

    দিল্লিতে চোর-ছ্যঁচোর প্রচুর, গাজিয়াবাদে আরও প্রচুর। বেশির ভাগই ছিঁচকে। কেন জানা যায় নি, তারা গ্যাঁড়ার মোটরসাইকেলকে টার্গেট করেছিল বেশ কয়েকবার। একদিন গ্যাঁড়া দেখল লক খুলে তার হেলমেট হাওয়া। আরেকদিন দেখল স্পার্ক প্লাগের তারটা কে খুলে রেখে দিয়েছে। আরেকদিন দেখল একপিস আয়না হাওয়া। এই রকম।

    এমনিই একদিন,গাজিয়াবাদে দু বছর কাটিয়ে ফেলার পর, ওয়ান ফাইন মর্নিং অফিস যাবার জন্য নিচে নেমে গ্যাঁড়া দ্যাখে তার মোটরসাইকেলটাই হাওয়া পার্কিং থেকে। এর আগেও সোসাইটির ভেতরে পার্কিং থেকে দু একটা মোটরসাইকেল হাওয়া হয়েছে, কিন্তু সে সব ঘটেছে গ্যাঁড়া আসার আগে। নিজের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটায় গ্যাঁড়া পুরো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। উত্তরপ্রদেশ রামভক্তদের দেশ, সব কিছুই এখানে রাম-ভরোসে চলে বলে গ্যাঁড়াদের সোসাইটিতে কয়েকটা সিকিওরিটি গার্ড আছে বটে, তাদের ইউনিফর্মও আছে, কিন্তু সিকিওরিটি বলে কিছু নেই। তো, তাদেরও জিজ্ঞেস করে কিছুই জানা গেল না।

    এর পর বাকি থাকে একটাই কাজ, সবচেয়ে কঠিন কাজ। পুলিশের কাছে গিয়ে এফআইআর করা।
    ধূ ধূ প্রান্তরের মধ্যে বসুন্ধরা সেক্টর সেভেনে একটা থানা। একপাশে বাজেয়াপ্ত করা জংধরা কিছু লরি-বাস-অটো-গাড়ি। গিয়ে বলা হল ঘটনা। কর্মরত পুলিশ পান চিবোতে চিবোতে বলল, লিখকে দেও। কাগজ? থানা কাগজ দেবে না। লেকে আও।

    গেঁড়ি বুদ্ধি করে কিছু কাগজ এনেছিল। সেইটা কাজে লাগল। গ্যাঁড়ার ধারণা ছিল পুলিশ বয়ান শুনে নিজেদের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে সই করিয়ে নেয়। সেটা যে বয়ানকারীকে কাগজে লিখে দিতে হয়, কে জানত?

    বয়ান লেখা হলে পরে জমা দিতে যেতেই পানখেকো পুলিশ সেটা দেখে মুখ বেঁকিয়ে বলল, আংরেজি মে কিঁউ? হিন্দি মে লিখকে লাও। গ্যাঁড়া সবিনয়ে জানাল, সে হিন্দি লিখতে পারে না। পুলিশ তা শুনবে কেন? কিসি সে ভি লিখোয়াকে লাও। হমারে য়ঁহা হিন্দি কে বিনা অন্য কোই ভাষা স্বীকার নহি কিয়ে জাতে হ্যাঁয়। গ্যাঁড়া শেষ চেষ্টা করল, আমি মুখে বলে দিচ্ছি, কাগজ দিচ্ছি, আপনিই হিন্দিতে লিখে নিন না। পাগল! এ সব কাজের জন্য কি মুলায়ম সিং যাদব পুলিশকে মাইনে দেয়? পানখেকো পুলিশ অতএব অম্লানবদনে বলল, হম লিখ নহি সকতে। বাহার চায়েওয়ালা বৈঠে হ্যাঁয়, উস্‌ সে লিখওয়া লো।

    চাওয়ালা পর্যন্ত যেতে হল না। বাইরে বসে গ্যাঁড়া আর গেঁড়ি অল্পস্বল্প চেষ্টাচরিত্তির করে হিন্দিতে লিখে ফেলতে পারল বয়ানটা। কী আর করা। রোমে গেলে রোমান হতেই হয়। আর পুলিশের কাছে গেলে যে কত কী হতে হয় ... হ্যারাসমেন্টের এই তো সবে শুরু।

    বয়ান নিয়ে পানখেকো পুলিশ বলল, ঠিক হ্যায়, জাও। -- যাও মানে? এফআইআরের তো একটা কপি পাবার কথা! সেটা দেবে না? পুলিশ বলল, সামনের বুধবার আসবে, কপি পাবে। আমাদের এখানে বুধবার বুধবার এফআইআর লেখা হয়।

    যাশ্‌শালা, হাটবারের ফান্ডা নাকি? এমন হয় বলে তো কখনও শোনে নি গ্যাঁড়া। প্রসঙ্গত, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। বুধবার মানে, পুরো এক সপ্তাহ। পানখেকো পুলিশ তবু দয়া করে বয়ানের দু'নম্বর কপিতে (সেটাও গেঁড়ির নিজেরই হাতে লেখা, থানার ত্রিসীমানায় শুধুই ফাঁকা মাঠ, কোনও জেরক্স সেন্টারও নেই) একটা অস্পষ্ট স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছিল। সেটা নিয়েই ফিরতে হল গ্যাঁড়া গেঁড়িকে।

    বোঝা গেল সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। উত্তরপ্রদেশ করাপশনের জায়গা, সেটা জানা ছিল, কিন্তু পুলিশটা ঠিক পয়সাও তো চাইল না! কিছু আভাস ইঙ্গিত দিলেও বোঝা যেত। তা হলে একটাই কারণ হতে পারে, সরাসরি এফআইআর না নেওয়ার। না নিলেই তো দেখানো যাবে ইউপিতে ক্রাইম বেশি হয় না, অমিতাভ বচ্চন সাদা দাড়ি নেড়ে টিভিতে বলতে পারবেন, ইউপি মে দম্‌ হ্যায়, কিঁউকি জুল্‌ম য়ঁহা কম হ্যায়।

    সৌভাগ্যক্রমে গেঁড়ি যেখানে কাজ করে, সেটা ভারত সরকারের একটা মন্ত্রক। চেষ্টা করলে মন্ত্রী সান্ত্রী লেভেল অবধি পৌঁছনো যায়। আর চাকরির প্রথম দিকে ট্রেনিংয়ে গেঁড়ির সাথে আলাপ হয়েছিল আরও বেশ কিছু সতীর্থর, যারা তারই মত বিভিন্ন মিনিস্ট্রিতে পোস্টেড হয়েছে। এ রকমই একজন বন্ধুকে পাওয়া গেল হোম মিনিস্ট্রিতে। ঘটনাচক্রে সে মন্ত্রীর ঘরের খুব কাছেই বসে, মন্ত্রীর সাথে তার অল্পস্বল্প মুখচেনাও আছে।
    তার কাছে ফোনে দরবার করা হল। সে শুনে বলল, ঠিক আছে, তুমি ঐ বয়ানের কপিটা আমাকে ফ্যাক্স করে দাও, আর থানার ঠিকানাটা দাও, আমি দেখছি।

    গ্যাঁড়ার বড় লজ্জা লাগছিল, এ রকম একটা ব্যাপারে লোকের সাহায্য নেওয়া ... তা, আপৎকালে কী আর করা। গ্যাঁড়া তৎক্ষণাৎ ফ্যাক্স করে দিল। বিকেলের মধ্যে সেই বন্ধুর ফোন এল, দ্যাখো, এটা তো দিল্লির থানা নয়, ওটা তো গাজিয়াবাদ, আলাদা স্টেট, আলাদা জুরিসডিকশন, তবুও আমাদের মিনিস্টারের পিএ আজ কথা বলেছেন, তিনি বললেন যাতে তোমাকে তাড়াতাড়ি এফআইআর দিয়ে দেওয়া হয়। ঐ থানার SHO একজন মহিলা, তিনি অফিসে নেই, কোথাও সাইটে গেছেন, তিনি এলে তাঁকে এই হল মোবাইল নাম্বার, একটা ফোন করে বোলো হোম মিনিস্ট্রি থেকে তাঁকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

    লে হালুয়া! এ তো পুরো রূপমকে একটা চাকরি দিন-এর কেস হয়ে গেল! কাকা বললেন মামাকে, মামা বললেন জ্যাঠাকে, জ্যাঠা বললেন বাতাসকে। গ্যাঁড়া বেজায় হতাশ হয়ে ফোন্নং টুকে নিল।

    কিন্তু না! পরদিন সকাল হল অপূর্ব বিস্ময় নিয়ে। অফিসে পৌঁছে চেয়ারে সবে পশ্চাদ্দেশটা গ্যাঁড়া ঠেকিয়েছে কি ঠেকায় নি, একটি ফোন এল। নাম, বাবার নাম আর বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে এক পুলিশ অতি সহৃদয় কণ্ঠে জানালেন, তিনি ইন্দিরাপুরম থানা থেকে কথা বলছেন (গ্যাঁড়ার বাড়ি যে থানায় পড়ে), গ্যাঁড়ার এফআইআর রেডি হয়ে গেছে, গ্যাঁড়া যেন অবশ্যই আজ সন্ধ্যেয় এসে কপি নিয়ে যায়।

    গ্যাঁড়া পুউরো অভিভূত, দ্রবীভূত। মন্ত্রীকে ধরলে যে সত্যি সত্যি এই রকম কাজ হয়, সেটা গ্যাঁড়া সিনেমায় দেখেছিল বটে, কিন্তু নিজের চোখে এই প্রথম দেখল। দুরুদুরু বক্ষে গ্যাঁড়া সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় প্রবেশ করল থানায়। সন্ধ্যেবেলায় থানার চেহারাই পুরো আলাদা হয়ে যায়। জীবনে কোনওদিন থানাপুলিশের সম্মুখীন না-হওয়া লোককে সন্ধ্যেবেলায় থানায় যেতে বলার থেকে মাঝরাতে শ্মশানে যেতে বলা অনেক সোজা।

    গ্যঁড়া সোজা ঢুকল নির্ধারিত ঘরে, সেখানে তখন ওয়্যারলেসের চেঁচামেচি, কেউ একজন মীরাট থেকে শুদ্ধ হিন্দিতে কোনও ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে, এখানে বসে একটা কনস্টেবল সেটা টুকছে। পাশে একটা কনস্টেবল বসে পান চিবোচ্ছে, আর তার চেয়ারের পাশেই রাখা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে পিক ফেলছে মাঝে মাঝে। সে-ও উৎকর্ণ ধারাবিবরণীর দিকে।

    গ্যাঁড়া সসম্ভ্রমে পান-চর্বণকারীকে বলল এফআইআরের কথা। পান চর্বণকারী শুনতেই পেল না জাস্ট। গ্যাঁড়া খানিকক্ষণ ওয়েট করে আবার নিবেদন করল। পান-চিবনো কনস্টেবল আবারও অপরিসীম অবজ্ঞায় গ্যাঁড়ার কথা শুনতে পেল না।

    ঘরের অন্যপ্রান্তে একটা প্লেন ড্রেসের লোক চেয়ারের ওপর উবু হয়ে বসে একমনে কান খোঁচাচ্ছিল। সে হঠাৎ গ্যাঁড়ার ওপর নজর দিল; "অ্যায় লেড়কা, ইধার আ। ক্যা হুয়া?'
    গ্যাঁড়া বাধ্য ছেলের মত লোকটার কাছে গিয়ে আবার ঘটনার বিবরণ দিয়ে জানাল, এফআইআর নিতে এসেছে।
    --কিসনে ফোন কিয়া থা?
    -- সে তো আমি জানি না। কেউ একজন ফোন করে এই-এই বললেন, এই যে এই নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। ... গ্যাঁড়া মোবাইল বের করে নম্বর দেখায়।
    নম্বরটা দেখেই লোকটা পুরো অ্যালার্ট হয়ে গেল, আরে এসএচও ম্যাম নে ফোন কিয়া থা। হাঁ, কেয়া পতা বতায়া থা? হাঁ হাঁ, আরে এ পর্‌সাদ সিং, এসএচও ম্যামকে কামরে মে জাকে উও চোরিবালী এফআইআর কি ফাইল লে কে আও। উসি মে রাখকে গয়ি থি ম্যাম। বতাকে ভি গয়ি থি। তুম ইয়ার উধার জাকে ব্যায়ঠো, হম নিকালকে দেতে হ্যায়।

    শেষ কথাটা গ্যাঁড়াকে উদ্দেশ্য করে বলা। গ্যাঁড়া প্রচন্ড অবাক হয়ে দেখল, কীভাবে একটা ফোন নম্বর দেখিয়ে সে "অ্যায় ল্যাড়কা' থেকে "তুম ইয়ার' হয়ে গেল। বাইরের দিকে একটা চেয়ারে বসে গ্যাঁড়া নম্বরটা সন্তর্পণে সেভ করে রাখল SHO নাম দিয়ে।

    দু মিনিটের মধ্যে জ্যালজেলে একটা কাগজে দুর্বোধ্য হস্তাক্ষরে হিন্দিতে লেখা একটা এফআইআরের কপি এসে গেল গ্যাঁড়ার হাতে। কান-খোঁচানো পুলিশ যেচে এসে গ্যাঁড়াকে বলে গেল, অ্যায়সে কিসিকা এফআইআর ইতনি জলদি নহি নিকালতা। তুম ইয়ার কঁহা কাম করতে হো?

    গ্যাঁড়া দেখল, কাজ হয়ে গেছে, এখানে আর খাপ না খুললেও চলবে। কেবল গম্ভীর মুখে বলল, আইবিএম। কান-খোঁচানো পুলিশ এসব নাম শোনেও নি কখনও, বলল, হাঁ? আইপিএম? বঁহাপে পঢ়তে হো ক্যা? গ্যাঁড়া গম্ভীরমুখে "হুঁ' বলে বেরিয়ে এল। থানার কাজ আপাতত শেষ। আর ওমুখো হতে হবে না।

    অত:পর ইনসিওরেন্স অফিস। সে তত ভয়ঙ্কর জায়গা নয়। কিন্তু ফাইলের পাহাড় আর এই টেবিল থেকে ঐ টেবিলে রেফারেন্স ট্র্যান্সফার দেখে ক্লেইমারের কনফিডেন্স কমে যেতে বাধ্য। তো, সেখানে ফাইলপত্তর ঘেঁটে ফর্ম ইত্যাদি ভরার পরে জানা গেল ইনসিওরেন্সের তরফ থেকে ইনভেস্টিগেটর আসবে ঘটনার তদন্ত করতে। তারপর আবার ঘটনার গতিপ্রকৃতি এগোবে।

    এক শুভদিনে খবর টবর দিয়েই সুদূর রোহিণী থেকে এলেন এক ইনভেস্টিগেটর। সত্তর পঁচাত্তর বছর বয়েস, পক্ককেশ পক্কদাড়ি শুভ্রবেশ এক সর্দারজি। নিশ্চয়ই বেশ ধর্মপ্রাণ, কারণ তাঁর কৃপাণটা সাধারণ সর্দারদের তুলনায় বেশ লম্বা, এবং সেটা পোষাকের ভেতরে নয়, ওপরে পরা।
    তিনি এলেন, দেখলেন, নোট নিলেন, প্রতিবেশীর থেকেও বয়ান নথিবদ্ধ করলেন, ফটো তুললেন গ্যাঁড়ার বাইক যেখানে থাকত সেখানকার, চাবির ফটোও তুললেন, অপরিসীম বিস্ময় প্রকাশ করলেন যখন জানলেন পুলিশ এফআইআর করানোর সময়ে এক পয়সাও নেয় নি। আসল গল্প গ্যাঁড়া ভেঙে বলল না তাঁকে, তিনি দাড়ি নেড়ে অভিশাপ দিয়ে গেলেন, দেখো, বাদ মে পুলিশ জরুর মাঙ্গেগি আপসে।

    তারপর লম্বা লিস্টি দিয়ে গেলেন, এই এই জিনিসগুলো দু সপ্তাহের মধ্যে আমার রোহিণীর বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসবে। জিনিসগুলো তখন উপস্থিত ছিল না, যেমন শেষ গাড়ি সার্ভিসিংয়ের বিল ইত্যাদি।

    সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে পরের শনিবারই গ্যাঁড়া পাড়ি দিল রোহিণীর উদ্দেশ্যে। রোহিণী কি এখানে? সে দিল্লির অন্য প্রান্তে। গাড়ি করে গ্যাঁড়া যাচ্ছে যাচ্ছে, লালকেল্লা ছাড়িয়ে অনেকদূর পৌঁছে যখন মনে হল এইবার কাউকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিৎ, তখন রাস্তার পাশে দেখা গেল একটা পুলিশ কিওস্ক। বাইরে ঝিনচ্যাক দিল্লি পুলিশের লোগো আর ভাটের আশ্বাসনবাণী, ভেতরে কেউ নেই, বুথের বাইরে একটা পুলিশ চেয়ারে বসে মন দিয়ে ট্র্যানজিস্টর রেডিওতে কিছু একটা শুনছে। খেলার রিলে বোধ হয়। গ্যাঁড়া গাড়িটা বুথের ঠিক পাশে দাঁড় করিয়ে পুলিশটাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।

    গ্যাঁড়া তখনও বুঝতে পারে নি কী মারাত্মক অপরাধ সে করে ফেলেছে। পুলিশটা ছিল মাত্র পাঁচ ফিট দূরে। সেখান থেকে রক্তচক্ষু মেলে গ্যাঁড়াকে আদেশ করল : আরসি আউর লাইসিন লেকে আ।

    আর সি আর লাইসিন গ্যাঁড়ার পকেটেই থাকে। পুলিশের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পুলিশের সে কী চোটপাট। হাঁ, বতা, কাঁহা কাম করতা হ্যায় তু? মেরেকো হাত দিখাকে বুলাতা হ্যায়? জরুরত কিসকো হ্যায়? তেরি ইয়া মেরি? গ্যাঁড়া অতি করুণ মুখ করে জানাল, সে ভুল করে ফেলেছে, সে আসলে রোহিণী যাবার রাস্তা জিজ্ঞেস করতে চাইছিল।

    এতে পুলিশ খানিক নরম হয়ে বলল, এই রাস্তা সিধা রোহিণী নিয়ে যাবে, সোজা চলে যাও। গ্যাঁড়া শুক্রিয়া বলে পেছন ফিরতেই পুলিশ অবিকল ক্লোরমিন্টের "দুবারা মত্‌ পুছনা'-র স্টাইলে শেষ হুমকি দিল, আউর হাঁ, আইন্দা কভি কিসি পুলিশওয়ালে কো অ্যায়সে হাত হিলাকে মৎ বুলানা।
    এরপর আর গ্যাঁড়ার রোহিণী পৌঁছতে কোনও অসুবিধে হয় নি।

    এরপর আরও বার তিনেক ইনসিওরেন্স অফিসে চক্কর কাটার পর জানা গেল, FIR এর একটা ক্লোজিং রিপোর্ট বা অন্তিম রিপোর্টও হয়। সেটা এফআইআর করার তিন মাসের মাথায় পাওয়া যায়। সেটা আবার থানায় গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। ... আবার থানা? গ্যাঁড়ার রীতিমতো আতঙ্ক হচ্ছিল আবার খাকি পোষাক পরা কোনও পুলিশের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু গরজ বড় বালাই। সব ঝামেলা চুকে গেলে বড় টাকা পাওয়া যাবে ইনসিওরেন্স থেকে। অতএব গ্যাঁড়া আবার ছুটল সেই ধূ ধূ মাঠের মাঝে ইন্দিরাপুরম থানায়।

    ততদিনে যমুনা দিয়ে অনেক কেমিক্যাল্‌স বয়ে গেছে। উত্তরপ্রদেশে ভোট হয়ে গেছে, মূলায়মকে ল্যাং মেরে হঠিয়ে দিয়ে গদিতে বসেছেন "ব্যাহেনজী' কুঁয়ারী মায়াবতী। ব্যাহেনজি গদিতে বসেই বহু বহু পুলিশ অফসরের গুছিয়ে পিন্ডি চটকেছেন। তবাদলা হয়েছে। মানে বদলি। ট্র্যান্সফার। থানা জানাল সেই অফিসার এখন বদলি হয়ে গেছেন সিহানি গেটে। সেটা গাজিয়াবাদের ভেতরে একটা জায়গা। সেখানে গিয়ে খোঁজ নেবার পরে সেই অফিসারকে পাওয়া গেল, তিনি পান খেতে খেতে জানালেন সেই অন্তিম রিপোর্ট গ্যাঁড়াকে উদ্ধার করে আনতে হবে "ক্যাচ্‌হরি' থেকে।

    ক্যাচ্‌হরি অর্থাৎ কাছারি, মানে, কোর্ট। গাজিয়াবাদ কোর্ট। উরিম্মা! পুলিশে রক্ষা নেই, বাইকের টাকা পাবার জন্যে কোর্টেও যেতে হবে? গ্যাঁড়ার তখন রোখ চেপে গেছে, শেষ দেখে ছাড়বে। কে সেরা সেরা ইত্যাদি।

    অন্তিম বা ক্লোজার রিপোর্ট হল পুলিশের তরফে একটা ফাইনাল ডিক্লারেশন, যাতে লেখা থাকে, বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরেও উক্ত চুরি যাওয়া জিনিস পাওয়া যাইল না। অতএব, জিনিসটিকে আর পাওয়া যাবে না ধরে নিয়ে খোঁজাখুঁজি এখানেই সমাপ্ত করা হল।.

    নিরীহ নিষ্পাপ দৃষ্টিতে দেখলে এই রিপোর্টে তেমন খেলার কিছু নেই। পুলিশের কাছে রোজ কতো কতো কমপ্লেন আসছে, একটা বাইকের পেছনে পুলিশ সত্যিই কতদিন আর হেদিয়ে মরবে? ক্লোজার রিপোর্ট বানিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। সরকারি মান্যগন্য পুলিশসাহেবদের শ্রমের অযথা অপচয় আর হয় না।

    এইবারে মনে করুন আপনি একজন ঘুষখোর পুলিশ। মাইনের পয়সায় দিন চলে না, ঘুষের পয়সায় মেয়ের স্কুলের ফীজ মেটান। বউয়ের শাড়ি কেনেন, এমনকি আপনার হাতমাটি করার সাবান কেনার জন্যেও ঘুষের পয়সার ওপরেই আপনাকে নির্ভর করতে হয়। তো, সেইরকম পুলিশি মস্তিষ্ক নিয়ে যদি আপনি ক্লোজার রিপোর্ট বানাতে বসেন, তা হলে আপনার মাথায় ফার্স্টেই কী আসবে? ... ব্যাটা ক্লোজার রিপোর্ট নিয়ে ইনসিওরেন্সের অফিসে জমা করে দিলেই তো আরামসে কুড়ি তিরিশ হাজার টাকা পেয়ে যাবে। আমি শালা কী পাবো? কয়েক হাজার টাকা এর কাছ থেকে না গেঁড়িয়ে একে ক্লোজার রিপোর্ট দিই কী করে?
    গ্যাঁড়ার ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছিল।

    কোর্টে গিয়ে প্রথমে তো বোঝাই গেল না কাকে গিয়ে কী বলতে হয়। সর্বত্র শুদ্ধ হিন্দিতে সবকিছু লেখা, এর মধ্যে কীভাবে যে SDJM ফাইভকে খুঁজে পাওয়া যাবে, কে জানে! একটা পুলিশ গলায় গামছা ঝুলিয়ে ঘুরছিল। সে গ্যাঁড়াকে একটা বড় দরজা দিয়ে উঁকি মারতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, যথারীতি কর্কশ ভাবেই, কেয়া কাম হ্যায়? গ্যাঁড়া জানাল, ক্লোজার রিপোর্ট নিতে এসেছে, SDJM ফাইভের সাথে তাকে দেখা করতে হবে। পুলিশ তো প্রথমে ক্লোজার রিপোর্ট কী তাই বুঝল না, শেষে অন্তিম রপোট বলাতে খানিকটা বুঝল, তারপর জিজ্ঞেস করল, কঁহা কাম করতে হো? এই সময়েই গ্যাঁড়ার মাথার পেছনদিকে দিব্যজ্যোতি খেলা করে গেল। গ্যাঁড়া খুব কনফিডেন্টলি জানাল, সে আজতকে কাজ করে।

    এই একটা জিনিসকে পুলিশ হেব্বি ভয় খায়। মিডিয়া। এইবার গলা একটু নরম করে শুধোল, পত্রকার হো? গ্যাঁড়া আবারও জানাল, সে পত্রকার নয় বটে, তবে অনেক পত্রকারকে সে চেনে।
    গামছা গলায় পুলিশ আর কথা না বাড়িয়ে বলে দিল, তিনতলায় উঠে ডানদিকে এত নম্বর ঘরের দিকে চলে যাও।

    গ্যাঁড়া তিনতলায় উঠল, ডানদিকে এসে ঘর গুনতে গিয়ে দ্যাখে, নির্দিষ্ট জায়গায় একটা ইউরিনাল, দরজা ভাঙা, ভেতর থেকে নোংরা জল গড়িয়ে এসেছে বাইরের করিডরে। তার পাশেই সাবডিভিশনাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টর পাঁচ নম্বরির অফিস। ঘর ফাঁকা। কেউ নেই।

    এ দরজা সে দরজা ঘোরার পরে গ্যাঁড়াকে উদ্ধার করল এক দালাল। কোর্টে গেলে দালালের খপ্পরে পড়তেই হয়, গ্যাঁড়াও দেখল উপায় নেই, কারণ, দালাল জানাল কী সব ডকুমেন্ট আদি লাগে, এফিডেবিট করতে হয়, হলফনামা দিতে হয়, তবে নাকি পাওয়া যাবে, মেলা হ্যাপা, একমাত্র সে-ই পারবে সমস্ত হ্যাপা থেকে গ্যাঁড়াকে বাঁচাতে।

    সেই থেকে শুরু হল কোর্টের চক্কর কাটা, ন-দশবার চক্কর কাটার পর, এবং প্রচুর শাপশাপান্ত করার পর অবশেষে আড়াই মাসের মাথায় গ্যাঁড়ার হাতে এল সেই অন্তিম রিপোর্ট। মাঝে পুলিশ খেয়েছে দেড় হাজার টাকা, ফাইল ক্লোজ করার জন্য, পয়সা না পেলে সে আবার রি-ইনভেস্টিগেশনের জন্য ফাইল খুলে দিত।

    কোর্টের কাজ মিটলে পরে গ্যাঁড়া আবার গেল ইনশিওরেন্স অফিসে, আশা করল, পুলিশের সাথে ইন্টার‌্যাকশন বোধ হয় শেষ হল। কিন্তু হায়, গ্যাঁড়া প্রোপোজেস, ইনশিওরেন্স কোম্পানি ডিসপোজেস। ক্লোজার রিপোর্ট দেখে ইনশি অফিসার মধুর হেসে আবার সেই আদি ও অকৃত্রিম এফআইআরটি বের করলেন। করে বললেন, ইসকি ফোটোকপি করাকে লাও। করে আনা হলে জানালেন, এইবার এর ফোটোকপিতে সেই SHO র একটা স্টেটমেন্ট লিখিয়ে আনো যে গাড়ি শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তাতে তার সই আর স্ট্যাম্প থাকবে।
    গ্যাঁড়া পুরো হতভম্ব। সবিনয়ে জিজ্ঞেস করল, আর এর পর কতোবার পুলিশের কাছে যাবার আছে? ইনশি অফিসার অভয় দিয়ে বললেন, না না, আর তো পুলিশের সাথে কিছু করারই নেই। এর পর তো আরটিও থেকে তোমাকে লিখিয়ে আনতে হবে গাড়ি চুরির কথা, এফআইআর আর ক্লোজার রিপোর্ট দেখিয়ে।

    খেয়েছে। একেবারে পুঁদিচ্চেরি কেস। পুলিশের কাছে যাবার কথা হলেই গ্যাঁড়ার কেমন যেন পা কাঁপতে থাকে, পায়খানার বেগ অনুভূত হয়, কিন্তু উপায় নেই, ক্লেমটা পাওয়া গেলে অনেকগুলো টাকা একসাথে পাওয়া যাবে।

    এইবারে থানায় গিয়ে নতুন SHO সাহেবের দর্শন পাওয়া গেল। তাঁর ঘরে ঢোকার সৌভাগ্যও হল। দুটি আনপালিশ্‌ড যুবক, কথায় বার্তায় মনে হল স্থানীয় কোনও হিন্দি পত্রিকার "পত্রকার'। কোনও ঘটনার বিবরণ নিতে এসেছে। এসএইচও সাহেবের চেহারাটি বেশ জাঁদরেল, ভুঁড়িটিও দশাসই, সাথে মানানসই মোটা গোঁফ, আর মুখে রাজ্যের বিরক্তি। সেই রকম মুখ করেই তিনি পত্রকারদের বলছিলেন, এসএসপি সাব ব্যায়ঠতে হ্যায় গাজিয়াবাদ সিটি মে, আপলোগ উনহি কে পাস চলে জাইয়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাতে এক পত্রকার ভেরিফাই করার জন্য জিজ্ঞেস করেছিল, বো জো কোতোয়ালি গেট পে ব্যায়ঠতা হ্যায়, এসএসপি, বো হি হ্যায় না?

    ইন্দিরাপুরম থানার এসএইচওর চোখমুখ পুরো বেদনায় কুঁচকে গেল, আপ ইয়ার রপোর্টারলোগ, কিসিকো ইজ্জত নহী দেতে হো। রপোর্টার ততোধিক হতভম্ব, কিসকো ইজ্জত নহী দিয়া? কেয়া বোলা ম্যায়নে?
    এসএইচও তার কুটিল মুখটাকে যথাসম্ভব বেদনাবিধুর করে বলল, হম হোতে তো বোলতে এসএসপি "সাব', ব্যায়ঠতা হ্যায় নহী, "ব্যায়ঠতে হ্যায়', লেকিন, খ্যয়ের আপলোগ তো পত্রকার হো, পত্রকার এই ফাঁকে আপার হ্যান্ড নিয়ে নিল, সাব হোঙ্গে আপকে লিয়ে, হমারে তো সাব নহী হ্যায়, হম আম আদমিয়োঁ কে লিয়ে বো তো এসএসপি হি হ্যায়।

    গ্যাঁড়া, পেছন দিকে একটা চেয়ারে বসে এইসব কথোপকথন শুনছিল, আর পরিষ্কার বুঝতে পারছিল, পত্রকার না হয়ে যদি সত্যিকারের কোনও আম আদমি এই রকমের বেয়াদপি করত, এসএইচও "সাব' নিশ্চয়ই সাথে সাথে চাবকে তার ছালচামড়া তুলে নিতেন, স্রেফ পত্রকারদের চটানো যায় না বলে তিনি জাস্ট মুখ বুজে ছোকরা পত্রকারের উক্তিগুলো হজম করে নিলেন। আর ফিরে কিছু বলতে পারলেন না।

    গ্যাঁড়া তাক কষছিল, পত্রকাররা গেলেই গিয়ে গ্যাঁড়া তার নিবেদন পেশ করবে, ঘরে আর কোনও ভিজিটর নেই, কিন্তু বিধি বাম, কোথা থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে এক দম্পতি এলেন, তাঁরা রিকশায় করে আসছিলেন, হঠাৎ করে এক বাইকওলা হাত বাড়িয়ে মহিলার গলা থেকে বহুমূল্য সোনার হার চুরি করে ভেগেছে, থানা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। সাথে সাথে এসএইচও টেনশন খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন, কিধর সে আ রহা থা, কিস তরফ গয়া, আপলোগ আইয়ে মেরে সাথ, এই হাজারি সিং, গাড়ি নিকালো, বলে এমন তড়বড় করে বেরিয়ে গেলেন যে তাঁর কাঁধ থেকে লাল নীল পাট্টা লাগানো তিনটে তারা খসে পড়ল। কনস্টেবল ঝটিতি সেটা তুলে আবার সাবের হাতে তুলে দিল, গ্যাঁড়া দেখল কেস গুবলেট, ইনি যদি এখন এই ধূ ধূ মাঠের মধ্যে গাড়ি করে বাইক চালানো ছিনতাইবাজ খুঁজতে বেরোন, তিনি আজ আর ফিরবেন কিনা সন্দেহ আছে। মরিয়া হয়ে গ্যাঁড়া একেবারে সেই ভয়ঙ্করদর্শন এসএইচও সাবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, হাতে এফআইআরের কপি।

    গ্যাঁড়া সবিনয়ে, যথাসম্ভব সংক্ষেপে তার নিবেদন পেশ করতেই গাঁক গাঁক করে চেঁচালেন এসএইচও সাব, লে জাও ইয়ে সব, মু মাঙ্গে কঁহি পে ভি দস্তখত করুঙ্গা ক্যা ম্যাঁয়? ম্যাঁয় কেয়া তেরা বাপ কা নোকর হুঁ? জাকে বতা দে ইনশিওরেন্সওয়ালে কো, ম্যাঁয় দস্তখত নহী করুঙ্গা। ... বলে গাড়িতে চেপে বসলেন এবং গাড়ী ভোঁ করে বেরিয়ে গেল থানা ছেড়ে।

    আর কোনও উপায় না পেয়ে অবশেষে সেই অগতির গতি গৃহমন্ত্রকের বন্ধুর শরণাপন্ন হতে হল। লজ্জার মাথা খেয়ে জানাতে হল সব, অপমানের কথাও।ছেলেটি অতি পরোপকারী। পরের দিনই ফোন করে বলল, দ্যাখো, আগের বারে তো মুলায়মের সরকার ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের বন্ধু ছিল, চ্যানেল ধরে কাজ হয়ে যেত, কিন্তু এখন তো মায়াবতীর সরকার, কেন্দ্রের সাথে তাঁর ঘোর শত্রুতা, কতটা কাজ হবে আমিও বলতে পারছি না, তবে আমি মিনিস্টারের পিএকে দিয়ে কথা বলিয়েছিলাম, তুমি কালই কাগজপত্র নিয়ে গাজিয়াবাদের এসএসপি বিজয় ভূষণের কাছে চলে যাও। জিজ্ঞেস করলে বলবে হোম মিনিস্ট্রি থেকে তোমাকে পাঠিয়েছে। তারপরে তোমার কথা জানাবে।

    বন্ধুকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে গ্যাঁড়া পরের দিনই ছুটল এসএসপির অফিসে। ঠিক সময়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া গেল। নাম ঠিকানা লেখা স্লিপ ভরে পাঠাতে হল, ডাক এল, তিনি তখন বেরোবার জন্য রেডি হচ্ছিলেন। ইনি ততটা বদমেজাজি নন, তবে ভিজিটরদের কথা শোনার বিশেষ অভ্যেস নেই এঁর, যাই হোক, অর্ধেক কথা শুনেই তিনি বলে দিলেন, আপনি সিহানী গেটে যে থানা আছে সেখান গিয়ে সামথিং অফিসারের সাথে দেখা করুন, আমি চিটে লিখে দিচ্ছি। বলে সত্যিই একটা চিটে লিখে দিলেন ইনকা মদত কিজিয়ে, লিখে নিচে সই করে দিয়ে এক কনস্টেবলকে বলে দিলেন, ইনকো সিহানী গেট জানে কা রাস্তা বতা দিজিয়ে। বলে বেরিয়ে গেলেন।

    গ্যাঁড়া পুউউউরো অভিভূত। অতখানি অপমানের পর পুলিশের কাছ থেকে এতখানি সাহায্য ... তবু শেষ পর্যন্ত না আঁচালে বিশ্বাস নেই। তবে গ্যাঁড়ার অভিভূত হবার তখনও বাকি ছিল। আধঘন্টার মধ্যে গ্যাঁড়া পৌঁছল সিহানি গেটে, গাজিয়াবাদ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা GDA অফিসের পাশেই। সেখানে একে তাকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে গ্যাঁড়া প্রতীক্ষিত অফিসে পৌঁছল। সেখানে কিছু পুলিশ, বোধ হয় কেরানী পুলিশ হবে, তুমুল ফাইলের গাদার নিচে চাপা পড়ে কাজ করছিল। তাদের একজনকে গিয়ে প্রথমে অফিসারের সঙ্গে দেখা করার অভিপ্রায় জানাতেই সে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে জানাল, আভি সাব নহী মিলেঙ্গে। বো বিজি চল রহে হ্যাঁয়।

    গ্যাঁড়া এইবার পকেট থেকে চিরকূটটা বের করল। এসএসপির নাম সই দেখেই পুলিশটা তড়াক করে সজাগ হয়ে বসল। সাথে সাথে কী ব্যাপার, কী বৃত্তান্ত জেনে নিয়ে লোকটা অফিসারের ঘরে ঢুকে গেল। অন্য একটা বয়স্ক পুলিশ খুব কিন্তু কিন্তু করে গ্যাঁড়াকে জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে আসছো? গ্যাঁড়া বেশ ঘ্যাম নিয়ে বলল, ফিলহাল তো এসএসপি "সাব'কে অফিস সে আ রহা হুঁ, দরঅসল মেরি ওয়াইফ গৃহ মন্ত্রালয় মে কাম করতি হ্যায়। ইয়ে ইন্দিরাপুরম চৌকি কা যো এসএইচও হ্যায় না, উনকে পাস ম্যায় গয়া থা ইসপে দস্তখত করানে কে লিয়ে। তো তিনি বাপ তুলে গাল দিলেন আর খবর গেল গৃহমন্ত্রীর অফিসে, গৃহমন্ত্রীর পিএ ফোন করেছেন আপনাদের এসএসপি সাবকে, তিনি আমাকে ডেকে বললেন আপনাদের সাবের কাছ থেকে দস্তখত করিয়ে নিয়ে যেতে। পুলিশটার গৃহ মন্ত্রালয় পর্যন্ত শুনেই মোটামুটি হয়ে গেছিল, সেই মন্ত্রালয়টাকে ভারতের যে কোনও ডিপার্টমেন্ট নর্মালি ভয় খায়, আর দিল্লির যত কাছে যে থাকে সে তত বেশি ভয় খায়। সেই পর্যন্ত গ্যাঁড়ার পঁহুছ আছে দেখে লোকটা প্রায় কথা হারিয়ে ফেলেছিল। এই সময়ে একটা ছেলে এল টেবিলে টেবিলে চা সরবরাহ করতে। পুলিশ গ্যাঁড়াকে অনুরোধের পর উপরোধ করে এক কাপ চা খেতে বাধ্য করল। প্রায় স্বাদবিহীন এককাপ চা খেতে খেতে গ্যাঁড়া শুনে গেল, কেয়া পতা হ্যায়, হর ইনসান তো কে জ্যায়সে নহী হোতে, কুছ লোগ অ্যায়সে বাত করতে, পুলিশকি বদনামী হো জাতি হ্যায়। গ্যাঁড়া শুনে গেল, মনে মনে বলল, গৃহ মন্ত্রালয় না শুনলে তুমিও ঐ রকম কথাই হয় তো বলতে, চা-ও খাওয়াতে না। মুখে বলল, হান্‌জী হান্‌জী, বো তো ঠীকহি কহা আপনে। হাথ কে পাঁচ উঙ্গলিয়াঁ ভি তো এক জ্যায়সে তো নহী হোতে ... অত:পর পুনরায় স্বগত:, ভালোয় ভালোয় সইসাবুদটা হয়ে গেলে বঁচি। পুলিশের সামনে টেবিলে বসে পুলিশের দেওয়া চা খাওয়াও যে কত অস্বস্তিকর হতে পারে, গ্যাঁড়া ছাড়া আর কে বুঝবে। বাপ রে, শুধু গৃহ মন্ত্রালয় শুনেই এত খাতির, আই কার্ড বের করে দেখাতে পারলে না-জানি কী করত!
    ততক্ষণে প্রথম পুলিশ ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, খুব ভদ্রভাবে গ্যাঁড়াকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় সাইন করতে হবে, আর কিছু লিখতে হবে কিনা। অত:পর ঠিক দেড় মিনিটের মাথায় সেই বহু প্রতীক্ষিত সিগনেচার নিয়ে গ্যাঁড়ার এফআইআরের কপি বেরিয়ে এল। পুলিশ যথোপযুক্ত ভদ্রতার সঙ্গে গ্যাঁড়াকে বিদায় জানাল এবং কোনও অসুবিধা হলে আবার আসতে বলল।

    একবুক অক্সিজেন নিয়ে গ্যাঁড়া ফিরে এল বাড়িতে। এর পর অবশ্য আর বেশি চক্কর কাটার ছিল না, দু এক জায়গায় এফআইআরের কপি পাঠানোর ছিল আর ট্রান্সপোর্ট অফিসে গিয়ে আরসি, মানে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট সারেন্ডার করার ছিল। তা, যে হেতু সে-সবই দিল্লিতে, তাই আর লেখার মত কিছু ঘটে নি।

    তাই জ্ঞানীগুণী সুধী পাঠকগণ, আপনাদের কারুর যদি কখনও মোটরসাইকেল বা চারচাকার গাড়ি চুরি হয়, আর জায়গাটা যদি উত্তর প্রদেশ বিহার টাইপের রাজ্য হয়; তা হলে পুলিশের কাছে যাবার আগে বার দুয়েক ভাববেন। দূরতম কোনও আত্মীয়ের যদি কোনও মিনিস্ট্রির সাথে যোগাযোগ থাকে, তার সাথে বেশ দহরম মহরম জমাতে শুরু করবেন। বাকিটা আপনার ভাগ্য।
    ইউপি মে দম্‌ হ্যায়, কিঁউকি জুলমি য়ঁহা কম্‌ হ্যায়।

    চলেগা নেহী, দৌড়েগা

    নভেম্বর ৩০, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ৩০ নভেম্বর ২০০৮ | ৭৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন