এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  বিবিধ

  • লা জওয়াব দিল্লী - ৭

    শমীক মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ০১ মার্চ ২০০৯ | ৭৬১ বার পঠিত
  • আবার অন্যদিক থেকে দেখলে, দিল্লিতে বাঙালি, পুনরায়, দুই প্রকার। এক গ্যাঁড়ার মত লোকজন, যারা প্রায়শই বড়মেজ বিভিন্ন রকমের চাকরি পেয়ে বাংলার মাটি ছেড়ে দুর্জয় ঘাঁটি গেড়ে বসছে দিল্লি এনসিআরের বুকে, এবং এখানেই থেকে করেকম্মে খাচ্ছে, পয়দা করছে সেকেন্ড, থার্ড জেনারেশন প্রবাসী বাঙালি। চাকরি অথবা উচ্চশিক্ষা, সঙ্গে সাইড ডিশ হিসেবে উইকএন্ডে বাংলা কল্‌চর, এই এদের গল্প তো শুনেছেন আগের বারে।

    এরা ছাড়াও আরও এক ধরণের বাঙালিতে ছেয়ে আছে দিল্লি নয়ডা গুরগাঁওয়ের আনাচ-কানাচ। তারা প্রান্তবাসী। তারা রিক্‌শা চালায়, নয়ডা দিল্লি গুরগাঁওয়ের অজস্র সোসাইটি অ্যাপার্টমেন্টে ঠিকে কাজ করে, দলে দলে সকাল সন্ধ্যে কাজ করে বিভিন্ন কারখানা ফ্যাক্টরিতে। তাদের পেটে নাই বিদ্যে, দুবেলা দুমুঠো ভাত দিয়ে সেই শূন্যস্থান ভরার অছিলায় তারাও আসে, ভরিয়ে ফেলে নয়ডা দিল্লি গুরগাঁওয়ের বিভিন্ন গ্রাম। তারপর তারাও এখানকার বাসিন্দা হয়ে যায়। তাদের জন্য নেই নয়ডা কালিবাড়ি কি ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টার; নেই শ্রীকান্ত আচার্য বা বহুরূপী। তাদের বাড়ি ছিল বসিরহাটে, তাদের বাড়ি আছিল বনগাঁয়।

    তারা প্রান্তবাসী। রিক্সাওলার মুখনি:সৃত হিন্দী শুনেই আপনি চোখ বুজে বলে দিতে পারেন সে বাঙালি ছাড়া আর কেউ নয়। তাদের ঘরের বউ-ঝিরা, যারা সকাল না-হতেই বেরিয়ে পড়ে বিভিন্ন কাছাকাছির সোসাইটিতে সোসাইটিতে ঘর ঝাড়ু দেওয়া-বাসন মাজা-রুটি বানানোর কাজ করতে, তাদের কপালে জ্বলজ্বলে সিঁদুর, হাতে শাঁখা-পলা আর তাদের শাড়ি পরার ধরণ দেখেই আপনি বুঝে যাবেন এ বাঙালি কাজের লোক।

    সব বড় শহরেই যেমন হয়, দিল্লি নয়ডাতেও তেমনি, বড় বড় হাইরাইজ সোসাইটি অ্যাপার্টমেন্টের জঙ্গলের পাশেই এরা থাকে, ছোট ছোট ঘেটো বানিয়ে। ছোট ছোট গ্রাম। শহর দিয়ে ঘেরা গ্রাম। শহরেরই অংশ, তবু সেখানে নেই ন্যূনতম নাগরিক সাচ্ছন্দ্য, বা, বেসিক সিভিক অ্যামেনিটিজ, রাস্তাগুলো নর্দমার সাথেই বহন করে নোংরা জল ও বর্জ্য, খালের ধার তাদের শৌচক্রিয়ার জায়গা, যদিও ঘরগুলো সবই পাকা। কাঁচামাটির ঘর পারমিট করে না দিল্লির আবহাওয়া। ঘরে ঘরে টিভি ফ্রিজও দেখতে পাবেন, এবং এরকম কোনও কোনও বাঙালি পাড়ায় আপনি পেয়ে যেতে পারেন খাঁটি বাঙালি দশকর্মা ভান্ডার পর্যন্ত, মাদুলির লাল সুতো থেকে মাটির প্রদীপ, সবই যেখানে পাওয়া যায়। দৈনিক একবার কি দুবার ভিজিট দেওয়া দিল্লি জল বোর্ডের ট্যাঙ্কার তাদের জলের উৎস, চিৎকার চেঁচামেচি ঝগড়া আর প্রাত্যহিক খিস্তিখেউড়ের বিনিময়ে তারা রোজই ভরে নেয় তাদের সারাদিনের ব্যবহার্য জলের রসদ।

    সূক্ষ্মভাবে দেখতে গেলে, এদের সবাইই বাঙালি নয়। ঐ যে বললাম, এদের কারুর বাড়ি ছিল মালদায়, কারুর "বাসা' আছিল রাণাঘাটে। এদের অনেকেই বর্ডার পার করে আসা বাংলাদেশী। পেট্রাপোল কি মালদা সীমন্ত দিয়ে প্রায়শই অনেক বাংলাদেশী অবৈধভাবে কাঁটাতার পেরিয়ে চলে আসে, মিশে যায় ভারতের জনসংখ্যায়, এ কথা অনেকেরই জানা। তবে তারা বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গে না-থেকে হিন্দিভাষার দেশ দিল্লিতে আসে কেন?

    এ প্রশ্নের অনেক উত্তর হয়, তবে প্রথম এবং প্রধান উত্তর বোধ হয় গ্যাঁড়ার কাছে না-চেয়ে লাল সরকারের কাছে চাওয়া ভালো। মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপনের হাজারটা ফ্যাঁকড়া। মঙ্গলবাসীর কানে বাংলাদেশের ডায়লেক্ট চট করে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা। হিন্দি ভাষার দেশ দিল্লিতে পূব আর পশ্চিমবঙ্গের ভাষার তফাৎ ধরার লোক খুব কম, সেখানে লুকিয়ে থাকা সুবিধে। তা ছাড়া হিন্দি বলার ক্ষেত্রে তো সব বাঙালিই একরকম। কিন্তু মঙ্গলগ্রহে নিরাপদে নিশ্চিন্তে থাকতে হলে প্রথমেই ধরতে হয়, পূজো দিতে হয়, তুষ্ট করতে হয় মাঙ্গলিক ক্যাডারদের। শুধুই মাঙ্গলিক নয়, পূজো নেবার ব্যাপারে সব পার্টির ক্যাডাররাই সিদ্ধহস্ত। তামাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ডার এলাকা জুড়ে এই ক্যাডার দেবতারা অতিসক্রিয়। বেনিয়মে এসে পড়া অনুপ্রবেশকারীদের এদেশের বৈধ ভোটার বানিয়ে দেবার জন্য তাঁরা সদাসক্রিয়। প্রথম ও প্রাথমিক পরিচয়পত্র, র‌্যাশনকার্ডটা বানিয়ে দেন তাঁরাই। তো, তাঁদের তুষ্ট না-করলে চলে? একেকজনের একেক রকমের পূজো। কেউ শুধু ভোট পেলেই খুশি, কাউকে কলাটা মূলোটা দিয়ে যেতে হয় বছরভর, কেউ কেউ আবার পান থেকে চুন খসলেই রাতবিরেতে নতুন রেশন-কার্ড পাওয়া ভারতীয়ের ঘরের চালায় জ্বলন্ত বিড়ি-টিড়িও ছুঁড়ে ফেলেন।

    তো, তেমন ঝামেলা দিল্লিতে নেই। তুতিয়ে পাতিয়ে রেশনকার্ডটিকে একবার বগলদাবা করে দিল্লির ভিড়ে এসে মিশে যেতে পারলেই প্রচুর কাজ, প্রচুর খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ। খালি পেটে কারুর দয়ার ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে হয় না। পেটের খিদে মেটার পর পছন্দের মোবাইল হ্যন্ডসেট কেনারও পয়সা থাকে! তারপর ধীরে ধীরে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড টিভি সেট বা ফ্রিজ কিনে থিতু হয়ে বসাটা কেবল সময়ের অপেক্ষা। তেমন কর্মদক্ষ শ্রমিকেরা কেবল দিল্লির চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, আলাপ পরিচিতির পরিধি বাড়িয়ে তারা প্রায়শই কনট্র্যক্টে কাজ করে আসে লুধিয়ানা-পাটিয়ালা কানপুর নাগপুর মায় চেন্নাই কলপক্কম পর্যন্ত। হাতে আসে মোটা টাকা, তারা দ্যাখে আরও, আরও সুখের মুখ। টাকায় টাকা বানায় এখানকার জলহাওয়া। তাদের সাথেই একই রাতে বর্ডার পার হয়ে আসা দিনাজপুরের মাজিদ হয় তো এখনও কোনওমতে দিন গুজরান করে চলেছে সেখানেই। একবার সাহসে বুক বেঁধে বাংলা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে নি সে। দেশ ছেড়েছে পেটের টানে, ভাষার টান ছাড়তে পারে নি। এদিকের দল্লুপুরা, গাজিপুর, ভঙ্গেল, সালারপুর, হরোলা ইত্যাদি বিভিন্ন শহুরে গ্রামের পাকা বাসিন্দা হয়ে যাওয়া অন্যান্য প্রাক্তন বাঙালি ও বাংলাদেশীরা আস্তে আস্তে পর করে দেয় বাংলা ভাষাকে, ক্রমশ হিন্দিতে চোস্ত হয়ে ওঠে তারা।

    এই মেহনতী প্রান্তবাসী প্রবাসী বাঙালির সাথে সফল, স্যুটটাই পরা সংস্কৃতিবান মূলস্রোতের রাজধানীবাসী বাঙালিরা কেউ কাউকে চেনে না। থাকে পাশাপাশি পাড়াতেই, কিন্তু কেউ কারুর আনন্দ দূ:খের শরিক হয় না। স্টেটাসের অনেকখানি তফাৎ। সর্বত্রই। সে তফাৎ মেনটেইন করে চলার নামই সভ্যতা। সে দিল্লিই হোক, কি কলকাতা। এখানে সবাই ছুটছে, সাফল্যের পেছনে, টাকার পেছনে। অত আলাপচারিতার সময় কোথায়, অত ঔদার্যের খরচা ওঠায় কে?

    কারণ কী, জানা নেই। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর বাঙালিকে আপনি কখনোই দেখতে পাবেন না গাজিয়াবাদে। নতুন গড়ে ওঠা উপনিবেশ বলেই কিনা জানি না, প্রথম শ্রেণীর প্রচুর বাঙালি এখানে থাকলেও কাজের লোক, ফ্যাক্টরির বা স্বাধীন শ্রমিক কিংবা রিক্‌শাওলা বাঙালি কেবলমাত্র দেখা যায় নয়ডা, দিল্লি এবং গুরগাঁওতেই। গ্যাঁড়া ঠিক করে বলতে পারল না, সম্ভবত ফরিদাবাদেও এদের দেখা যায় না। উপনিবেশ স্থাপনের ব্যাপারে প্রথম শ্রেণীর বাঙালির কোনও চয়েস না-থাকলেও এই দ্বিতীয় শ্রেণীর বাঙালিরা বোধ হয় এ-ব্যাপারে খুবই চুজি!

    এইবার চা-ব্রেক। পরের কিস্তিতে গ্যাঁড়া শোনাবে দিল্লির দুগ্‌গাপুজো, খাওয়া-দাওয়া আর বেই-বেই করার গপ্‌পো। দুটো মিঠি আর একটা ফিকি এদিকে দেবেন, ভাইসাব!

    (চলেগা নেহি, দৌড়েগা)

    মার্চ ১, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০১ মার্চ ২০০৯ | ৭৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন