ঈদুল আযহা বা ঈদুল ফিতর আমরা বুঝতাম না, আমরা চিনতাম না। আমরা চিনতাম বড় ঈদ আর ছোট ঈদ। এখনো আমরা প্রায় সময়ই বড় ঈদ বলে থাকি। আর বলা হয় কুরবানির ঈদ আর রোজার ঈদ। বড় ঈদ আর ছোট ঈদ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে।
বড় ঈদে নতুন কাপড় নাই। কাপড় কিনে হবে ছোট ঈদে। দুই ঈদে মানুষ নতুন পোশাক কিনছে এই জিনিস খুব বেশি দিন হয় চালু হয়নি। এখনো অনেকেই এবং আমরাও বড় ঈদে খুব একটা নতুন কাপড় কিনি না। তবে আগের তুলনায় বড় ঈদেও এখন অনেক কেনাকাটা হয়। শপং মল থেকে শুরু করে ছোটখাটো দোকান পাট সবই এখন এই ঈদে ভাল বেচা বিক্রি করে। সম্ভবত অর্থনৈতিক অবস্থার যে উন্নতি হয়েছে তা এর মূল কারণ।
বড় ঈদে নতুন জামা কাপড় দেওয়া হত না কারণ বড় একটা খরচ করতে হত কুরবানির জন্য। গোরু কেনার জন্য বেশ অনেক টাকাই লাগে। যার কোপ পড়ত কাপড়ের উপরে। তবে ছোট ঈদে যেমন শপিং সেন্টারে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করতে মজা, বড় ঈদের মজা হচ্ছে গোরুর হাটে গোরু দেখে কেনার মজা। যদিও আমি এই মজা থেকে শত হস্ত দূরে সব সময়। বহু কাল আগে শখ করে গোরুর হাটে একবার যাওয়ার পরেই বুঝতে পারলাম এই জিনিস আমার জন্য না। এবং আমি এখনো বুঝি না এখনে মজাটা ঠিক কোথায়? গোবর দিয়ে মাখামাখি? প্রচণ্ড গরমে গোরুর লাথি না কী? আমি জানি না। যেবার শখ করে গেছিলাম ওইবারও গোরু কিনে আমি ফিরতে পারিনি। অবস্থা বুঝে আস্তে করে কেটে পড়েছিলাম। এর দায় একটু রনিরও ছিল। রনি আর কাওসার মোটর সাইকেল নিয়ে হাজির। আমি স্যাত করে নাই। পরে বাড়ি ফিরে বললাম আরে তোমরা আমারে রেখে কই গেলাগা? আমি হারায় গেছিলাম হাটে, পরে কাওকে না পেয়ে চলে আসছি একা একাই! বলা বাহুল্য কেউ পাঁচ পাই দিয়াও বিশ্বাস করে নাই আমার কথা। তবে কাজের কাজ একটা হইছে, এরপর কেউ আর কোনদিন গোরুর হাটে আমাকে নিয়া যায় নাই। তবে আরেকবার যাওয়া হইছিল, সেইবারও একই বুদ্ধি করে আমি হাওয়া। আবার আবেগে চলে গেছিলাম। গোরুর হাটে পা দেওয়া মাত্র বুঝলাম, আমি ভুল কইরালচি! অতএব...
আমি অবশ্য ঈদের দিন গড়িমসি করি না। একবার গিয়ে বসলে শেষ করে দিয়া উঠি। যতক্ষণ কুলায় চলে কাটাকাটি। আবার জবাইয়ের সময়ও আমার জরুরি দরকার পরে। দুর্বল চিত্তের মানুষের কাম না জবাই সামাল দেওয়া। নিজেকে যেহেতু সবল চিত্তের মনে করি তাই ধর গিয়ে গোরু! যদিও ইদানীং ওই প্রচণ্ড রক্তপাত নিতে পারি না আর। কিন্তু যেহেতু মাংস খাওয়া বন্ধ করতে পারি নাই। তাই বলতে পারছি না এই রক্তপাত বন্ধ হোক। গোরুর মাংসর নাম শুনলে আমার ডায়েট ফায়েট সব উড়ে চলে যেতে চায়। এখন পর্যন্ত এই জিহ্বায় যত আমিষের স্বাদ নিয়েছে তার মধ্যে গোরুর সাথে তুলনা চলে এমন কিছুই ছিল না।
স্বাদের কথা যখন বললাম তখন আরেকটু বলি। বড় ঈদ মূলত খাওয়ার ঈদ। কোন পরিসংখ্যান আছে কিনা জানা নাই আমার। আমার ধারনা এই ঈদের পরে মানুষ বেশি অসুস্থ হয়। কারণ সবার ঘরে ঘরে গোরুর মাংস। সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাত চলছে গোরু খাওয়া। এখন অনেক ধরনের রান্না হয় মাংস। আগে তা হত না। আম্মাকে দেখতাম বড় এক পাতিলে অনেক মাংস একবারে রান্না করত। ওই এক জিনিসই। চলত জ্বাল দেওয়া আর খাওয়া। একদিন পর থেকে স্বাদ পরিবর্তন হয়ে যেত। যতই দিন যেত ততই নতুন স্বাদ পাওয়া যেত। দুইদিন তিনদিনের মাংসের যে স্বাদ তা রীতিমত স্বর্গীয় লাগত আমাদের। জ্বালে জ্বালে মাংস আর মাংস থাকত না, সব মিশে অন্য কিছু একটা হয়ে যেত, যার কোন তুলনা নাই। ঈদের পর দিন আমাদের বাড়িতে খাওয়া হত গোরুর মাংস আর পরোটা। কেউ কেউ চালের গুড়ার রুটি খেত, আমাদের এখানেও হত। লা জবাব স্বাদ! এখন নানান ধরনের রান্না হয় মাংস। কাবাব হয়, কোরমা হয়, টিকিয়া হয়, সাদা মাংস রান্না হয়, এবং আরও নানান ধরনের রান্নায় এখন ঈদ জমে যায়।
এর বাইরে যার কথা বলতে হয় তা হচ্ছে গোরুর পা, নেহারি করে খাওয়া। আগে আম্মাকে মাটির চুলায় বেশ কয়েকদিন জ্বাল দিয়ে তৈরি করত নেহারি। নেহারি দিয়ে চালের আটার রুটি! ওহ! বেঁচে থাকা সার্থক মনে হয় আমার। এখন অনেক আধুনিক পদ্ধতি এসে গেছে। প্রেশার কুকারে সিটি মেরেই কাজ হাছিল। তবে সেরা নেহারি কিন্তু আমি খেয়েছিলাম আমার এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে। খাসির নেহারি! বন্ধুর মা প্রেশার কুকারে এমন ভাবে রান্না করেছিল যে খাসির পায়ের হাড্ডি আঙুল দিতেই ভেঙে যাচ্ছিল! আহ! কী যে খেয়েছিলাম! অতুলনীয়।
অন্য আরেকটা খাবারের কথা না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে কুরবানির ঈদের খাবারের কথায়। তা হচ্ছে গোরুর ভুরি। এই জিনিস আমি কোথা থেকে খাওয়া শিখেছি আল্লাই জানে। আমাদের বাড়িতে মেজপা আর আমি ছাড়া আর কেউ খায় না। আম্মা আমাদের জন্যই রান্না করে দিত। নিজে খায় না কিন্তু ওই জিনিস আমাদের জন্য তৈরি করত এত চমৎকার করে, এখন ভাবলে অবাক হয়ে যাই। আম্মা বলত উনারা ছোট বেলায় দেখেছেন গোরুর ভুরি কেউ খেত না, দূরে বিলের ধারে ফেলে দিয়ে আসত। আর এখন ধনী গরিব নাই, সকলে হামলে পরে খায়। উনি উনার ছোটবেলার ওই স্মৃতি থেকে বের হতে পারেন নাই। আমার অন্য ভাই বোনেরাও কেউ খায় না। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে আমি খাওয়া শিখে গেছি। আর এমনই শিখলাম যে এখন সবার আগে মনে পরে ভুরির কথা। ঢাকায় যাওয়ার পর একদিন শুনলাম কিছু হোটেলে ভুরি বিক্রি করে, এখানে অন্য নাম, বট! এই বট খাওয়ার জন্য কতদিন রাস্তা হাঁটছি, বহুদূরে গিয়ে খেয়ে আসতাম।
এখন আম্মা নাই, আম্মা ভুরি খাওয়াই মেনে নিতে পারেন নাই, এখন যে আরও কত উদ্ভট খাবার চালু হইছে তা কীভাবে মেনে নিতো আলাই জানে। এবার কয়েক জায়গায় দেখলাম গোরুর চামড়া রান্নার তরিকা শেয়ার করছে লোকজন! ঢাকায় গোরুর ল্যাজ খেতে দেখছি, কাবাব করে খায়। যারা খায় তারা অস্থির হয়ে যায় খাওয়ার জন্য। আমার অত অধঃপতন হয়নি, আমি ভুরি পর্যন্তই আছি, আজকে আম্মা থাকলে হয়ত আরও কিছু বানী দিত মানুষের অধতে পতন নিয়ে।
এসব কারনে মানে খাওয়ার এই বিপুল আয়োজন এখনো আমি অস্বীকার করতে পারি নাই, তাই রক্তপাতের কথা বলে কুরবারনি বন্ধ করতে বলতে পারি না। এছাড়াও আমি বরাবরই বলি যে এক একদিনে কত মানুষ যে মুখে একটু মাংসের স্বাদ পায় তার কোন হিসাব নাই। আমাদের দেশের আমিষের চাহিদা পূরণ করে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ফার্মের মুরগি আর তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ মাছ। গোরু অনেক পরিবারেরই হাতের বাইরের খাদ্য। খাসি তো রীতিমত বিলাসী খাদ্য! তাই যখন ঈদের সুবাদে এই মানুষ গুলো তৃপ্তি করে মাংস খেতে পারে আমি আপত্তি করব কোন যুক্তিতে?
কিন্তু রক্ত নিয়ে কাজ করার আছে তা পরিষ্কার করেই বলতে চাই। যে ভাবে আমাদের দেশে কুরবানি হয় তা রীতিমত বীভৎস। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমরা খুব কুৎসিত ভাবেই অন্য ধর্মের মানুষদের কথা ভাবি না। সকাল থেকে যে রক্তের একটা মাইর লাগে তা সারা দিন চলে, কয়েকদিন পর্যন্ত এর রেশ থেকে যায়। রক্তের তীব্র গন্ধ সকলের জন্যই সমস্যা, যাদের কাছে এটা ধর্মীয় ট্যাবু তাদের কেমন লাগে? আমরা এগুলা ভাবি না। কিন্তু এগুলা ভাবা উচিত। রাস্তার উপরে কুরবানি দিয়ে মানুষের চলাচল বন্ধ করে দিয়ে উৎসব হয় কীভাবে? রাজপথে কুরবানি হয় অনেক। এতে যে অন্যদের সমস্যা হতে পারে তা আমরা ভাবি না। হয়ত ভাবার প্রয়োজনই মনে করি না। আমরা তো এই দেশে সুপ্রিম পাওয়ার! বরং এমন অনেকেই আছে যারা এগুলাকে আরও বেশি করে উপস্থাপন করে, দেখানোর জন্য যে সে এই দেশে সংখ্যাগুরু, তারা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, বাকিরা তাদের অধিনস্ত। এই বর্বরতম মানসিকতা কোথাও নেই এই কথা যদি বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম তাহলে স্বস্তি পেতাম, কিন্তু আমি জানি তার কোন উপায় নাই।
ধর্ম যার যার উৎসব যদি সবার হয় তাহলে সবার জন্যই সহনীয় উৎসব হতে হবে। গোরুর রক্ত দিয়ে রাস্তা ভিজিয়ে সবার জন্য উৎসব বলতে পারি না। আর যদি ভাবেন আমরা সংখ্যায় বেশি, আমরা যা ইচ্ছা তাই করব, তাহলে করতে তা করতে পারেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার শুধু পূজায় খাওয়ার জন্য বলবেন, নিজে কত সেকুলার তা প্রমাণের জন্য বলবেন আর নিজেদের যখন সময় আসবে তখন ধুর... বলে ফুর্তিতে মজে যাবেন, তাহলে তা করতে পারেন। শুধু নিজেদের সভ্য বলে দাবী করা বাদ দিয়েন। এই দুইটা এক সাথে যায় না।
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, বড় ঈদের শুভেচ্ছা সকলকে। ঈদ মোবারক।