আমাদের মেল বাক্সে প্রায়ই আসে নানাপ্রকার চিঠি পত্র। সেগুলি ঠিক লেখা নয়। তাই উপযুক্ত বিভাগের অভাবে তারা কখনও প্রকাশিত হয়না। এবার থেকে চিঠিপত্রের জন্য তৈরি করার হবে স্বতন্ত্র একটি বিভাগ, যাতে এই লেখাগুলিকে স্থান দেওয়া যায়। আপাততঃ বিভাগটি এখনও তৈরি না হওয়ায় এই চিঠিটি রইল খবরের বিভাগেই।
মাননীয় সম্পাদক
আমরা, দুর্গাপুর ই এস আই হাসপাতালের চিকিৎসকবৃন্দ, চিকিৎসাক্ষেত্রে বহিরাগত এবং দুর্বৃত্তদের নিরন্তর এবং অসহনীয় উৎপীড়নের বিষয়ে সাধারণ জন সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সাধারণভাবে প্রায় সমস্ত সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রকেই প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল পরিকাঠামো নিয়ে চিকিৎসা করতে যেয়ে জনরোষের মুখে পড়তে হচ্ছে। ই এস আই-এর ক্ষেত্রে এই অত্যাচার অমানবিক পর্যায়ে পোঁছে যাবার দুটো নির্দিষ্ট কারণ আছে। এক, শ্রমিক এবং কর্মচারীর দেওয়া মাসিক চাঁদার পরিবর্তে ই এস আই সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। দুই, এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করার জন্য ই এস আই বিভিন্ন বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছে যার মাধ্যমে বিমাকারিরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সব রকম চিকিৎসা পেতে পারেন। এই ব্যবস্থার ফলে শ্রমিকদের বিনামূল্যে সমস্ত ধরণের কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি, নিউরো সার্জারি, ইউরো সার্জারি নিয়মিত ভাবে করানো সম্ভব হচ্ছে। অথচ, একশ্রেণীর বিকৃতবুদ্ধি স্বার্থান্বেষী দালালের প্ররোচনায় বীমাকারিদের ক্ষোভ ও অসন্তোষও বেড়ে চলেছে। স্বাস্থ্যবীমার চাঁদা ভবিষ্যতের বিপদ আপদে সুরক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য, যার প্রয়োজন একজন বিমাকারির সারা জীবনে নাও হতে পারে – এই মূল বার্তাটা গুলিয়ে দিয়ে চিকিৎসা পরিষেবাকে দেখানো হচ্ছে বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের মতো। আমার চাঁদার পয়সা উশুল হচ্ছে কিনা – এই ভাবে শ্রমিকরাও ভাবতে শুরু করেছেন। আর পয়সা উশুল হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে তখনই যখন তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারছেন।
এই প্রবণতা বেসরকারি হাসপাতালের পক্ষে সুসংবাদ হলেও, আমাদের পক্ষে প্রায় জীবন সংশয়ের জোগাড়। যে অসুখের চিকিৎসা করার যোগ্যতা এবং পরিকাঠামো আমাদের আছে তার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করা আমরা চিকিৎসকরা অবমাননাকর বলে মনে করি। পাঁচতারা হাসপাতালের কাঁচের ঘরে ঢুকলেই সর্বরোগ থেকে মুক্তিলাভ ঘটবে এমন কুসংস্কারেও আমাদের বিশ্বাস নেই। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর বয়ানে, রাজ্য সরকারেরও ঘোষিত এবং যুক্তিসম্মত নীতি হল যথেষ্ট কারণ না থাকলে রুগীকে রেফার না করা। অথচ আমাদের হাসপাতালে রুগী আসার সময় থেকে পরিজন এবং অন্যান্য বহিরাগতরা দাবী করতে শুরু করেন বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করাতে হবে। নয়তো আমাদের গ্যারান্টি দিতে হবে রুগী ভালো হয়ে যাবে। আর নিরন্তর চলতে থাকা এই টানাপোড়েনের মধ্যে হাসপাতালে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই হাসপাতালে শুরু হয়ে যাবে জান্তব, অকথ্য গালিগালাজ, মারধোর। কেন চিকিৎসা করি নি সেই কারণে নয়, কেন আমরা (বেসরকারি হাসপাতালে না পাঠিয়ে) নিজেরা চিকিৎসা করেছি এই অপরাধে তৃতীয় শ্রেণীর অপরাধীর মতো জনসমক্ষে আমাদের লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে।
আমরা খোলাখুলি ভাবে বলতে চাই, বিশ্বের কোথাও এভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা চলতে পারে না। জৈব প্রক্রিয়া মানুষের প্রচেষ্টার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনাধীন নয়, তাই চিকিৎসায় অনিশ্চয়তা থাকবে, ঝুঁকি থাকবে। প্রতিনিয়ত চিকিৎসকদের যদি রক্তচক্ষু লেঠেলদের ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হয়, কোন চিকিৎসকের পক্ষেই চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়।
আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, এক শ্রেণীর মানুষ ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে হাসপাতালের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় সাংবাদিকের ছদ্ম পরিচয়ে। বিকৃত উত্তেজনা বিক্রি করাই এদের পেশা। জীব বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠটুকুও এদের নেই। বিশ্বসংসারের যে কোন বিষয়কে এরা ব্রেকিং নিউজের একটি মাত্র বাক্যে পুরে ফেলে। অথচ প্রায় প্রতিদিনই ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে এরা বিচারকের ভঙ্গিতে আমাদের জেরা করে সাধারণ জনসমাজে চূড়ান্ত অবমাননার জন্য।
এ কথা স্পষ্টভাবে সাধারণ সমাজের সামনে বলা ছাড়া আমাদের উপায় নেই যে এই অসহনীয় অবস্থার মধ্যে আমরা চিকিৎসা করতে পারছি না। এ কথা বলারও সময় এসেছে যে যারা এসবের পেছনে পেশিশক্তি এবং ক্ষমতার যোগান দিচ্ছেন তাঁরা সচেতন বা অচেতনভাবে সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোটাকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আর কেই বা না জানে যে, সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থাকে অযোগ্য, অপরাধী প্রতিপন্ন করতে পারলে মুনাফার জন্য পরিচালিত হাসপাতালগুলোর সামনে খুলে যাবে আরো বিনিয়োগ এবং আরো মুনাফার আদিগন্ত ক্ষেত্র।
স্বাক্ষরঃ
ডঃ অজিত কুমার মন্ডল, ডঃ অশোকতরু মন্ডল, ডঃ শোভন পান্ডা সহ সর্বমোট ২৫ জন চিকিৎসক।