এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • কাঠমিস্ত্রীর বাবা ও কাঠমিস্ত্রী

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৮ নভেম্বর ২০১৫ | ৮১৯ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • আমাদের পুরানো বাড়িতে কাঠের কাজ করেছিল রাজারাম, তা সে প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল। ঘোষ পাড়ার যৌথ বাড়ি থেকে আমরা স্থানান্তরিত হলাম পাল পাড়ায়, পুকুরের এপার আর ওপার। আমাদেরই বাগান বাড়িতে গড়ে উঠল আমাদের নতুন বাড়ি। গ্রামে আমাদের তখন কাঠের মিস্ত্রী বলতে ওই রাজারাম ও তার ভাই জয়রাম। আদপে হিন্দুস্থানী হলেও রাজারাম ও তার ভাইকে আমরা কোনদিন হিন্দী বলতে দেখি নি আমাদের সামনে। তবে ওদের দুজনের বউ কিন্তু খাঁটি বিহার থেকে আমদানী কৃত হবার জন্য ভালো বাংলা বলতে পারত না। ফলতঃ বাড়িতে ভালোই শান্তি বজায় ছিল – দুই ভাই মদ খেয়ে কাঁচা বাঙলায় বাওয়ালি করত বউদের উপরে, যারা সেই বাংলার মর্মোদ্ধার আজ বিবাহের চল্লিশ বছর পরেও করে ওঠার মত শিখে উঠতে পারে নি। এবং ভাইস ভার্সা – বউরা হিন্দী ভাষায় যে বাক্য বান থ্রো করত তা রাজা বা জয় কোন রামই কোনদিন উদ্ধার করে উঠতে পারে নি। বাড়িতে ইক্যুইলিব্রাম বজায় ছিল, অন্তত আমাদের বাড়িতে কাজ করতে করতে রাজারাম সেটাই দাবি করত।

    নতুন বাড়িতে জানালা দরজা বানাবার জন্য আমাদের কাঠ কিনতে হয় নি। যে বাগান কেটে বাড়ি তৈরী হয়, সেই বাগানেরই নিম কাঠ দিলে হয়েছিল ফ্রেম, আর সোনাঝুরি দিয়ে হয়েছিল জানালা দরজার পাল্লা। কাঠ চেরাই হয়েছিল অন্য এক বিহারীর কাঠ কলে যে আবার আমার বাবার ছাত্র ছিল – ফলতঃ আমাদের বাড়ির সাথে বিহারীদের সমন্ধ বেশ অঙ্গাঙ্গী বললে অত্যুক্তি হয় না। রাজারামের ফুল ফর্মে কাঠের কাজ করা আমার আজ সব মনে পড়ে না – তবে মনে পড়ে বাবার সাথে রাজারামের রোজকার আলোচনা, স্ক্রু (রাজারাম যাকে ইস্ক্রুপ বলত) কেমন ভাবে কাঠের কাজে ব্যবহার হওয়া উচিত এই নিয়ে। স্ক্রু –কে প্যাঁচ দিয়ে টাইট করা রাজারামের স্বভাবে ছিল না, দুম-দুম করে দিল হাতুরী দিয়ে দুই ঠোক্কর, স্ক্রু কাঠের মধ্যে সমাহিত। বাবা রাজারামকে বোঝানোর চেষ্টা করত যে পেরেকের মত ঠুকে কাজ সারা উচিত নয় স্ক্রু-র ক্ষেত্রে, কারণ তাহলে স্ক্রু উদ্ভাবনের দরকার হত না। কিন্তু কে শোনে কার কথা – বাবা যতক্ষণ আছে রাজারাম ততক্ষণ স্ক্রু টাইট দিচ্ছে, চোখের আড়াল হলেই দুম-দাম। আমার প্রথম গুপ্তচর বৃত্তিরও হাতেখড়ি তখনই – বাবা আমাকে রাজারামের ঠোকার উপর নজর রাখতে বলেছিল। গুপ্তচররা সাধারণত গুপ্ত থাকে, কিন্তু আমার কাজ ছিল রাজারামের আশেপাশে যতক্ষণ ঘুরঘুর করা যায়। আমার কাজ রাজারামের ভাষায় গুপ্তচর এবং আমাদের দিক থেকে নজরদারি – এই দুইয়ের মাঝে ঝুলে ছিল সেই সময়।

    সময় এগিয়ে গেছে – আমাদের নতুন বাড়ির মধ্যে আবার একটা বাড়ি হল উঠোনের অপর দিকে। ‘নতুন’ বাড়ি হয়ে গেল পুরানো। এখনকার নতুন বাড়ি গড়ে উঠল আমাদের এখনকার বাগানের কিছু গাছ সরিয়ে। দুটো আম গাছ কাটা গেল – মুড়ি ভাজার চালা উঠে গেল, ভাঁড়ার ঘর সরে গিয়ে ঠাঁই নিল এক কোণের দিকে। ঠাকুমার বয়স হয়ে যাবার পর আর অবশ্য আমাদের চালায় মুড়ি ভাজা হত না, মুড়ি ভাজা নামটাই থেকে গিয়েছিল। ভাঁড়ার ঘর তবে পুরোপুরি ব্যবহার হত চাষের সামগ্রী, সার, কাস্তে-কোদাল, বস্তা এবং আরো অসংখ্য জিনিসে। সবচেয়ে বেশী পরিবর্তন এসেছিল গরু নিয়ে – অনেক চোখে জল ফেলে প্রথমে চাষের হেলে-গরু দুটোকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। কারণ ছিল মূলত আর কেউ লাঙল ধরতে চাইত না – ততদিনে মাঠে ট্রাক্টর এবং হ্যান্ড ট্রাকটরে ভরে গেছে। নাগাড়ে কিষেণের অভাব আমাদের নতুন বাড়ির জায়গাকে এমনি অপ্রতক্ষ্য ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তারপর ক্রমে গেল গাই গরু গুলি – বাড়িতে রাখাল রাখার আর ছেলে পাওয়া যাচ্ছিল না – ঠাকুমার বয়স হয়ে গিয়ে মারা গেল – বাবা একা আর চারিদিক সামলাতে পারছিল না। নতুন বাড়িতে আমার এখনকার বেডরুমের ঠিক নীচেই ছিল এককালে আমাদের গোয়ালঘর। তবে বাড়ি হবার পরেও থেকে গিয়েছিল কিছু সুপারী গাছ, একটু লীচু, নারকেল এবং একটি আমগাছ।

    আমার নতুন বাড়ির দরজার ফ্রেম আর নিম গাছ দিয়ে হল না – হল সেগুন গাছ দিয়ে। বেলেডাঙা পড়ায় আমাদের পুকুর পাড়ে যে বড় সেগুন গাছ দুটি ছিল, সেই দুটি চেরাই করেই নতুন বাড়ির কাঠের সমস্যা মিটে গেল। তবে রাজারাম এখন আর বাড়ি বাড়ি কাজ করতে যায় না – তার ছেলে রবি এখন আমাদের গ্রামের একমাত্র কাঠমিস্ত্রী হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে। রবি আমার ভাইয়ের বয়সী – এবং নিমো গ্রামের ট্র্যাডিশন মেনে, অনেক দিন হল সে আমার বন্ধু স্থানীয় হয়ে গেছে। যতবার বাড়ি যেতাম রবির কাছে তার বাবা রাজারামের খোঁজ নিতাম। রবি বলত, ‘বুঝলে দাদা একেবারে জ্বালিয়ে মারছে। সন্ধ্যা হলেই মদ নিয়ে বসবে, আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার ধমকি দেবে। এদিকে নিজে সারাদিন কাজ কিছু করবে না, সংসার চলছে আমার জন্য’। রবি মুখে বাবাকে গাল দিলেও মনে মনে দারুন ভয় খেত – যার কারণ আমার জানা ছিল না। রাজারামের মদ খাওয়া আরো অনেকের মত আমাদের গাঁয়ে সুবিদিত। আরো একটা কারণে রাজারামের নাম ছিল, সেটা ছিল তার দিল দরিয়া মেজাজ। নিজে খাও এবং পরকেও খাওয়াও, এই নীতি নিয়ে রাজারাম চলত।

    এবার বাড়ি গিয়ে রবির সাথে কথা বলতে বলতে ওর বাড়ির কাছাকাছি চলে গেছি – দেখি রাজারাম রেজাক মাষ্টারের সাথে কথা বলছে। রেজাক কাকা আমার বাবার বন্ধু এবং খুবই শান্ত লোক। রাজারাম বলছে,

    -বুঝলে রেজাকদা, এই যে মদ খাওয়া খারাপ লোকে বলে, সেই নিয়ে হইচই করে – এগুলো সব ফালতু কথা
    -কেন রে? – রেজাক কা জিজ্ঞেস করল
    -কেন মানে? এই যে আমি তিরিশ বছর ধরে মদ খাচ্ছি, কিছু হয়েছে আমার? যত সব আল-বাল কথা, মদ খেলে নাকি শরীর খারাপ হবে!

    নির্বিবাদ রেজাককা খানিক ক্ষণ কিন্তু কিন্তু করে কোনক্রমে বিদায় নিল। এই করতে করতে রশিদ চাচার ছেলে গোলাপ এল ওর ওর্ডার দেওয়া তক্তার খোঁজ করতে।

    -কাকা, তক্তাটা ভালো করে বানিও কিন্তু
    -হ্যাঁরে বাঁড়া দেব, তবে মুরগী না খাওয়ালে, কাঠের প্যানা আর মারব না, শুধু গজাল দিয়েই সারব।
    -তোমার শুধু মুরগী খাব খাব
    -আগের বার তো খুব টুপী পরিয়ে তক্তায় প্যানা মারিয়ে নিয়ে গেলি মুরগী খাওয়াব বলে, কিন্তু এখনো তো মুরগী এল না
    -আসলে কি জানো তো কাকা, বউ মুরগী গুলো খুব ভালোবাসে – আগের বার তোমার জন্য ধরতে গেলাম, কিন্তু বউ কান্নাকাটি শুরু করে দিল
    -ঠিক আছে, মুরগী খাওয়াতে হয় না – তোর তক্তাও তেমন হবে
    -রাগ করো কেন কাকা – আচ্ছা, এবার আমি তোমাকে খাওয়াবোই মুরগী। একটার পা একটু খোঁড়া আছে, সেটাই না হয় তোমাকে দেব।

    আমি এই পর্যন্ত দেখে চলে এসেছিলাম। কিন্তুদিন পরে আমি রবিকে জিজ্ঞেস করলাম, কি রে মুরগী কেমন খেলি। রবি বলল

    -আর বলো না, গোলাপের মুরগীর জন্য আমার যা লস হলো
    -কেন রে, মুরগী তো পেলি ফ্রীতে, লসটা আবার কিসের?
    -তুমি তো সেদিন দেখে এলে খোঁড়া মুরগীটা গোলাপ বাপকে দেবে বলে এল। এখন হয়েছে কি, খোঁড়া মুরগীটা বেশ অনেকটাই বড়। গোলাপের বউ দিতে রাজী ন্য় – শেষে অনেক বলে কয়ে গোলাপ একটা ছোট মুরগী নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে হাজির।
    -তোর বাপ কি বলল?
    -বাপ তো মুরগীর সাইজ দেখে রেগে ফায়ার – বলল, সব কাঠের প্যানা টেনে খুলে দেব বোকাচোদা, আমাকে আবার মুরগী বানানো হচ্ছে! অনেক কষ্টে বাপকে শান্ত করলাম, গোলাপ মুরগী দিয়ে বিদায় নিল। বাপ সেই মুরগী একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখল পরের দিল মালের চাট করবে বলে।
    -তা এতে তোর লস কোথায়?
    -আরে শোনই না – পরের দিন সকালে বাপ ঝুড়ি তুলে গেছে মুরগী ধরতে। সেই শালা মুরগী হচ্ছে দেশী, ধরা দেবে কেন? গেছে পালিয়ে – আমার দুজন মিস্ত্রী এসেছিল কাজে, তাদের বলছে তোরা মুরগী ধর এবার।
    -মানে?
    -মানে আবার কি, ২০০ টাকা করে মজুরী দিই মিস্ত্রী গুলোকে আমার কারখানায় কাজ করার জন্য, তাদের দুজন নিয়ে বাপ বেলা দুটোর সময়েও মূর্গী ধরে বেড়াচ্ছে! বাচ্ছা একটা মুরগীর জন্য আমার দুটো মিস্ত্রীর মজুরী জলে গেল।
    -তুই কিছু বললি না?
    -বলতে গেলাম বলে আমার বউয়ের সামনেই আমাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করল, তুমি তো জানোই।

    তা জানি – আরো জানি যে রবি গালাগাল পারে না খুব একটা, তদোপরি বাপকে নিদারুন ভয় খায় বিয়ের পরেও। তবে রবি ভালো ছেলে, আমাদের গ্রামের অনেকেরি বলে। সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত কাজ করে রবি – তারপর রেষ্ট, এবং আমাদের সাথে বিকেলে নিমো স্টেশনে আড্ডা। রাত আটটার মধ্যে আবার রবি ঘরে ঢুকে পরে, বিয়ের আগে থেকেই। বিয়ের পরে তাই আমরা ওকে নিয়ে আর আগে ঘরে ঢোকার টান নিয়ে রসিকতাটা করতে পারি নি। ১২টা পর্যন্ত কাজের মধ্যে আবার গ্রামের কাউকে ব্যাঙ্কে নিয়ে যাওয়া, কাউকে বাইকে করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া, হাসপাতালে কাউকে খাবার পৌঁছে দেওয়া, মিউনিসিপ্যালিটির কাজ – এ সবই করত।

    কিছু বছর আগে থেকে রবির মনে রাজনীতির ঝোঁক লাগে। কেন লাগে বলতে পারব না – কারন ও নিজে ছিল ‘ওয়ার্কার’ শ্রেণির মেধা যুক্ত। জটিল বুদ্ধির কোন রূপ চিহ্ন ওর আপাত সরল মস্তিষ্কে ছিল না। তবে কিনা ওর অনেক বন্ধু ছিল খু রাজনীতি সচেতনে – তাদের চাপে পরেই মনে হয় ও গা ভাসাল রাজনীতিতে। গ্রাম পঞ্চায়েত ভোটে ওরা এক নির্দল মহিলা প্রার্থী খাড়া করে সামনে শিখন্ডী স্বরূপ – নেপ্তথ্যে থাকে ওরা। তা গ্রামের লোক বেইমান নয় – রবি এবং ওর বন্ধুদের গ্রামের সেবার কথা মনে করে সবাই ওদের ভোট দেয় – সি পি এম এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে হারিয়ে ওদের প্রার্থী বিপুল ভোটে জেতে।

    নিমো গ্রামে এই ভাবে এক কমপ্লেক্স পরিস্থিতির সৃষ্টী হয় – কিছু আসনে সি পি এম, কিছুতে তৃণমূল এবং একটায় রবিদের দল জয়লাভ করে। তৃণমূল তবু ঠিক আছে, কিন্তু নির্দল থেকে জেতায় রবিদের উপর চাপ বাড়ে। সন্ধ্যাবেলা রবি আর আমাদের সাথে আড্ডা মারতে আসে না – বরং যায় পার্টির অফিসে। গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী, যে পাড়া থেকে রবিরা জয়লাভ করেছে, সেই পাড়ার সকল ঝামেলার ফার্ষ্ট পয়েন্ট অব কন-ট্যাক্ট হচ্ছে ওদের দল। ফলে রোজ সন্ধ্যেতেই প্রায় বিচার সভা বসে। বিচার সঞ্চালনে রবিদের পার্টির ব্যাকবোন হচ্ছে নিতাই, পচা ও মজনু। আমি বহু দিন গ্রাম ছাড়া বলে এবং আমার সাথে সবার সম্পর্ক ভালো থাকার জন্য, এদের বিচার সভার অ্যাক্সেস ছিল আমার কাছে। কোন সন্ধ্যেবেলা সময় না কাটলে আমি রবির সাথে বিচার দেখতে যেতাম।

    তেমনি একদিন সন্ধ্যাবেলা বিচার সভা বসেছে ডাইনী অববাদ দিয়ে – বাউরি পাড়ার নীরজের বউ নাকি ডাইনী এবং সেই অপবাদ দিয়ে ওকে পাড়া থেকে একঘরে করে দেবার বন্দোব্যস্ত হয়েছে। নীরজের বউ বিচার চায়। সব কিছু শোনার পর পচা বলল –

    -তোমরা তো খুব এক জটিল সমস্যা এনেছো গো
    -এ পচা, এই মাগী ডাইনী আছে, ইতে আবার জটিল কি হলো?
    -না, মানে তোমরা ডাইনী বললেই তো আর ডাইনী হবে না – প্রমাণ করতে হবে।
    -কি প্রামন লিবি? উ যেদিন বাপের বাড়ি থেকে আসে, সি দিন আমার ষাঁড়া মোরগটা গাড়ির তলায় চাপা পড়ে!
    -আরে ধুর, এটা কোন প্রমাণ হল – একে বলে কো-ইনসিডেন্ট!
    -হ্যাঁ, আমার মনটাও ‘কু’ গাইছিল বটেক, তবে?
    -আরে ‘কু’ নয়, ‘কো’ – যাগগে ছাড়ান দাও। আর কি প্রমাণ আছে?
    -এ বছর জমিতে আলু পাতার আগে ওর বিয়ে হলোক, আর দ্যাখো, এবার আলুর দাম! চাষের দাম উঠে নাই –
    -ঠিক আছে মানছি, এবারে আলুর দাম নেই – কিন্তু তার জন্য তো ও দায়ী নয়!
    -তবে কে দায়ী বটে?
    -ওসব তোমরা বুঝবে না। বরং বলো, কি করলে তোমরা জানবে যে ও ডাইনী নয়?
    পচার এই প্রশ্ন খুব গুঞ্জন তুলল বিচার সভাতে – বাউরি পাড়ার লোকেরা নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনাতে ডুবে গেল। অনেক আলোচনার পরে
    -উ যদি শিমলাগড়ের কালী বাড়িতে গিয়ে ঠাকুরের থানে হাত দিয়ে বলে যে উ ডাইনী নয়, তাহলে আমরা মেনে নেব
    -এটা ভালো প্রস্তাব [নীরজের বউয়ের দিকে ফিরে] – কি গো তুমি রাজী তো বলতে?
    -[নীরজের বউ] আমি রাজী আছি, কিন্তু তুমাদের একজনকে যেতে হবে সাথে, সাক্ষী থাকতে
    পচা পরল সম্যাসায়, কাকে পাঠানো যায় দিনের বেলা ওদের সাথে! সবার কাজ থাকে। অনেক ভেবে –
    -তাহলে মজনু, তুমি কি করছ কাল সকালে?
    -না এই মানে একটু ভাবছি, হয়ত –
    -বুঝেছি তোমার কাজ নেই কাল, তাহলে তুমি কাল সকালে যাবে নীরজের বউয়ের সাথে।
    মজনু দেখল সে ফেঁসে গেছে, তা একটা ফাঁসে কেন, তাই বলল
    -তা, ষষ্টেরও তো কাজ নেই কাল সকালে, ও তো কালকেই মাছ নিয়ে এল ডায়মন্ডহারবার থেকে
    ষষ্টে কিছু বলার আগেই, পচা বলে উঠল
    -তাহলে ষষ্টে, তুমিও কাল মজনুর সাথে যাবে

    বিচার ফাইন্যাল হয়ে গেল প্রায়, ঠিক হল কাল সকালে ৮.৪৫ এর ট্রেনে দুই পক্ষ শিমলাগড় যাবে, আর সাক্ষী হিসাবে যাবে মজনু ও ষষ্টে। আমরা উঠতে যাচ্ছি পার্টি অফিস থেকে এমন সময় দেখলাম আমাদের গ্রামের গ্যাঁড়া সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হট্‌ করে দেখি নিতাই ডেকে উঠল, এই গ্যাঁড়া শোন এখানে। গ্যাঁড়া পার্টি অফিসে ঢুকল। নিতাই বলল –

    -গ্যাঁড়া, তুই কিন্তু কি করছিস, কোথায় যাচ্ছিস – সাব আমার রেডারে ধরা পড়ছে!

    গ্যাঁড়া গেল ঘাবড়ে – আমিও কিছু বুঝতে পারলাম না। গ্যাঁড়া মাথা চুলকাতে চুলকাতে রেডার কি জিনিস ভাবতে ভাবতে চলে গেল। আবার হতভম্ভ ভাব দেখে নিতাই আমাকে বলল –

    -বুঝলি না, গ্রামের ছোকরাদের এইভাবে আন্ডার কন্ট্রোল রাখতে হয়, থ্রেট দিয়ে।

    আমি বুঝলাম – সেই দিনের বিচারের এফিসিয়েন্সী দেখে আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। যাই হোক, পরের দিন বিকেলে নীরজের বউয়ের সাথে দেখা, জানতে চাইলাম সব মিটমাট হয়েছে কিনা। নীরজের বউ বলল –

    -সকালে স্টিশনে গিয়েছিলুম, কিন্তু তুমাদের পচা যাদের আস্তে বলে ছিল, তারা কেউ তো এলো নাই!
    আমি সেই দিন সন্ধ্যাবেলা ব্যাপারটা পার্টি অফিসে জানার জন্য ঢুঁ মারতে বাঁশতলার কাছে বাঁকটা নিয়েছি, দেখি পার্টি অফিস থেকে আরেক সদস্য দিবাকর হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে এসে কানের গোড়ায় ফিসফাস করে জিজ্ঞেস করল –

    -কাউকে দেখলি তুই?
    -কাকে দেখব? আর এই অন্ধকার শুনশান রাস্তায় এতো কানের গোড়ায় এসে ফিসফাস করে বলারি বা কি আছে?
    -তুই বুঝছিস না – সব স্পাই এ ছেয়ে গেছে, চারিদিকে শুঁকে বেড়াচ্ছে –
    আমি দিবাকরের কোড ওয়ার্ড কিছুই বুঝতে না পেরে ওর সাথে পার্টি অফিসের দিকে এগুলাম। কাছে গিয়ে শুনলাম, নিতাই হুঙ্কার দিচ্ছে –
    -সব শালার ভিতরে ঢুকিয়ে দেব, চারিদিকে আমার নজর – কোথায় যাবি?
    আমার জিজ্ঞাস্যু ভাব দেখে, চোখ টিপে নিতাই বলল,
    -কন্ট্রোলে রাখতে হয় বুঝলি? চাপে রাখতে হয়।
    আমি ঘাড় নাড়লাম, যদিও বুঝতে পারলাম না নিতাই কাকে কিভাবে চাপে রাখতে চাইছে। পচাকে আমি নীরজের বউয়ের ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করলাম, কেন কেউ যায়নি – পচা বলল

    -আরে ছাড় তো, কত যাবি? বিচার করে দিলাম, এটাই অনেক।

    খানিক গল্প হল সেদিন। আমাকে বলল, তোকে কালকে লাগতে পারে – মল্লিক পাড়া বনাম হাজরাদের একটা কেস আছে। দুই দলই দাবী করছে জমি তাদের। একটা পুরানো কোর্টের রায় আছে ইংরাজীতে, তুই একটু পড়ে দিবি, তার পর আমরা বিচার করব। আমি বললাম আমি পড়লে হবে কিনা। বলল, তুই তো নিরপেক্ষ, সবাই তো চেনে, প্রবলেম নেই। দরকার হলে ডেকো বলে চলে এলাম।

    রবিকে জিজ্ঞেস করলাম পরের দিন, আচ্ছা তোদের দল কি পয়সা মাড়ছে? আমি জানি রবি সৎ ছেলে, অন্তত এখনো। রবি জানালো যে, ইন্দিরা যোজনায় ঘর করতে গরীবদের টাকা দেওয়া হচ্ছে পঞ্চায়েত থেকে। আর সেই টাকা পাইয়ে দিতে ওদের দলের কে নাকি ৩০ হাজার করে দাবি করছিল। তাকে গুচ্ছ ক্যালানি দেওয়া হয়েছে এবং দল থেকে বিতারিত। ওরা সৎ ভাবেই কাজ করার চেষ্টা করছে। আমাকে জানালো যে ওদের অনেক ভালো পরিকল্পনা আছে – কিছু দিন পরে গরীবদের কম্বল বিতরণ করবএ, চাঁদা দিতে হবে। আমি দিলাম, মনে করিয়ে দিলাম যে মরে দিস না যেন টাকাটা। ক্ষমতায় আসার পর থেকে রবিদের দল কি কি ইন্টারেষ্টিং কাজ করেছে জানতে চাইলাম – নিম্নলিখিত টপিক গুলি উদ্ধৃত হলঃ

    -কাশী এবং কাশীর তৃতীয় পক্ষের বউয়ের মধ্যে চলা দীর্ঘমেয়াদী কলহের পরিসমাপ্তি। তৃতীয় পক্ষের বউয়ের গর্ভে জন্মানো মেয়েটি যে কাশীর নিজেরই ঔরসজাত, সেটা কাশির স্বীকার করে নেওয়া।

    -নিমোর রাস্তা চওড়া করতে গ্রাম্য অভিযান। সে সমস্ত লোকেরা রাস্তার জায়গায় বসার চেয়ার বা সদর দরজা বসিয়েছিল সেই সব ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া। [কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে, এর প্রধান কালপ্রিট হবে নিতাই নিজে, আমি সেটা পয়েন্ট আউট করলে, নিঃস্তব্ধতা নেমে এল]।

    -গ্রামের রাস্তা মোরাম থেকে পীচ এ উত্তীর্ণ হবার জন্য টাকা স্যাঙসন এবং অনেকটা অলরেডি হয়ে যাওয়া।

    -কিছুদিন আগে নিদারুণ বৃষ্টি জনিত বন্যার সৃষ্টি হলে কবলিত এলাকায় চিঁড়েমুড়ি ও ত্রিপল বিতরণ।

    আমি ব্যর্থতার কথা কথা জিজ্ঞেস করলাম – আমাকে বলা হল, “জানোই তো”। বুঝলাম অনেক! রবিকে মনে করিয়ে দিলাম যে পার্টি করতে গিয়ে আমার জানালা-দরজা পালিশ করে দেবার যে কথা ছিল সেটা যেন না ভোলে। বলল – কাল থেকেই পাঠাচ্ছি!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৮ নভেম্বর ২০১৫ | ৮১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 24.97.232.150 (*) | ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৩66741
  • অ্যাজ ইউজুয়াল দারুণ।

    ইয়ে, লিখে একবার যদি টাইপোগুলো একটউ দেখে নেন ...
  • Abhyu | 109.172.116.187 (*) | ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:৪২66742
  • খাসা
  • dd | 116.51.27.207 (*) | ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৫:০১66743
  • একেবারে অথেন্টিক ছবি। একশো লিং'এর থেকে দামী।

    আর খুব তড়তড়িয়ে ফ্লো।
  • Blank | 213.99.211.18 (*) | ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ০২:৪৭66745
  • ভাল্লাগলো বেশ
  • pipi | 117.77.85.93 (*) | ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ০৯:৫৯66746
  • বঢ়িয়া!
  • সুকি | 129.160.188.16 (*) | ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ১১:২২66744
  • 'দ'-দি,
    বানান ভুল থাকার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। পরের বার প্রুফ রিডিং করে নেব ভালো করে।

    আর লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন