এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রাজেন্দ্রলাল মিত্র: উনিশ শতকের ভারতবিদ্যা পথিক

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ জুলাই ২০১৬ | ১৭৯৯ বার পঠিত
  • প্রথম পর্ব
    সত্যিই খুব অদ্ভুত ব্যাপার। একশ পঁচিশ বছর আগেকার কথা। ঠিক তিন দিনের ব্যবধানে দুজন প্রখ্যাত মনীষী বাংলার বৌদ্ধিক মঞ্চ থেকে চিরবিদায় নিলেন। একজন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৯ জুলাই ১৮৯১)—যাঁকে আমরা মোটামুটি মনে রেখেছি; যাঁর জন্ম বা মৃত্যু দিবস কম বেশি অনেকেই নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্‌যাপন করেছেন; দ্বিতীয় জন রাজেন্দ্রলাল মিত্র (২৬ জুলাই ১৮৯১)—যাঁকে আমাদের অর্ধশতকও লাগেনি পুরোপুরি ভুলে যেতে। মৃত্যুর দু এক বছর পর থেকেই তাঁকে নিয়ে কেউ কোথাও স্মরণ সভার আয়োজন করেনি। সুতরাং কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ মহলকে বাদ দিলে, রাজেন্দ্রলালকে নিয়ে আম জনতার দরবারে কোথাও কোনো অনুষ্ঠান করার আজ আর প্রশ্নই ওঠে না। দুই মনীষীরই এবছর মৃত্যুর একশ পঁচিশ তম বছর এসে গেলেও আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনে কোনো পার্থক্য হবে বলে মনে হয় না। বিদ্যাসাগরকে হয়ত আবারও আমরা—নমো নমো করে ঔপচারিক রূপে হলেও—নিশ্চয়ই স্মরণ করব। পক্ষান্তরে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র এবারও আমাদের কাছে কোনো ফুল মালা বা ধুপের ধোঁয়া পাবেন না।
    তবে কিন্তু যদি—
    হ্যাঁ, যদি কেউ মনে করিয়ে দেয়—তাঁকেও মনে রাখার, স্মরণ করার সপক্ষে যুক্তি আছে; তাঁর থেকে আমাদের একালেও নেবার মতো অনেক মাল-মশলা আছে; আমাদের জীবনচর্যার বেশ কিছু অন্তঃস্থলে তাঁরও হাতের কাজের ছাপ খুঁজলে পাওয়া যাবে, তখন কী হবে বলা যায় না। হাজার হোক, আমরা তো হুজুগে জাতি, তাই না?
    প্রকৃতপক্ষে, ১৮০০-১৯৫০—এই সার্ধশতকের বিস্তীর্ণ সময়কালে বাংলার বুকে এত অসংখ্য মনীষীর আগমন হয়েছিল, এবং তাঁরা নানা বিচিত্র ক্ষেত্রে স্বকীয় সৃজনশীল ভূমিকার দ্বারা এদেশের জীবন-মনন সংস্কৃতি ও সভ্যতার জগদ্দলকে এক মধ্যযুগীয় বর্বরতার অচলায়তন থেকে বের করে এনে যেভাবে আধুনিক পরিশীলিত পর্যায়ে অতি দ্রুত গতিময় করে তুলেছিলেন, এটা আজ ভাবলেও বিস্ময় জাগে। আরও বিস্ময়ের—এই উজ্জ্বল চরিত্রমণ্ডলি এবং তাঁদের সুনিবিড় কর্মধারাকে আমরা মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই নিখুঁতভাবে স্মৃতি থেকে মুছে দিতে পেরেছি। সুতরাং তাঁদের মধ্যেকার কোনো একজন বিশেষ মনীষীকে ভুলে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করা বোধ হয় নিতান্তই অর্থহীন!

    ।। ১।।

    তথাপি, রাজেন্দ্রলালকে স্মরণ করার প্রাসঙ্গিকতা দ্বিবিধ। প্রথমত, তাঁর কর্ম বহুল জীবনের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাঁকে আমাদের কাছে স্মরণযোগ্য করে রেখে গেছে। ভারতবিদ্যাচর্চায়, অর্থাৎ, সাহিত্য ও অন্যান্য বস্তুগত উপকরণ থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, সমাজগঠন, সংস্কৃতি, ধর্ম, মননশীলতা, ইত্যাদি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ভুবন মণ্ডলে না হলেও ভারতীয়দের মধ্যে তিনি পথিকৃৎ। বহুমুখী পাণ্ডিত্যে ও সৃজনশীলতায় তিনি ইউরোপীয় অনেক ভারতবিদের সঙ্গেই তুলনীয়, বা এমনকি, অপেক্ষাকৃত শ্রেয়তর। দ্বিতীয়ত, বিদ্যাসাগর চর্চার সঙ্গে যুক্ত করেও তাঁকে আমরা একজন সহসৈনিক হিসাবে বুঝতে পারি, যখন আমরা তাঁর সামাজিক-ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করি, যে বিশেষ দেশ-কাল তাঁর কর্মজীবনের সীমানা নির্দেশ করেছিল তাকেও দেখবার চেষ্টা করি।
    রাজেন্দ্রলালের শিক্ষাজীবন কিছুটা খাপছাড়া। তাঁর পরবর্তী বিদ্যাচর্চার সঙ্গে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মেধাবী ছাত্র হিসাবে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভালো ফল করে বৃত্তি পেয়ে তিনি কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন। মনে মনে একজন সুচিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। ভেষজ উদ্ভিদের এক বৃহৎ তালিকা তৈরি করে সৃজনশীল কৃতিত্বের স্বাক্ষর দিতে শুরুও করলেন। কিন্তু ডাক্তারী পড়া আর হল না। কিছু ছাত্রের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বিরোধে কলেজ থেকে তাঁকে সেই ছাত্রদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়েছিল। তিনি রাজি হলেন না। ফলে অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও মেডিক্যাল কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। তারপর তিনি আইন নিয়ে পড়ে উকিল হওয়ার কথা ভাবলেন। আর ঠিক সেবারেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়ে পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেল। এইভাবেই ইতি হল তাঁর পেশাগত শিক্ষালাভের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার।
    অন্য দিকে, এই সময় থেকেই পরবর্তীকালের রাজেন্দ্রলাল মিত্রের বিকাশ পর্ব শুরু হল। বাংলা ফারসি এবং ইংরেজি তিনি আগেই শিখেছিলেন। এখন থেকে শুরু করলেন সংস্কৃত, গ্রিক, লাতিন ও ফরাসি ভাষা শিক্ষা। অবশ্যই সবচেয়ে জোর দিয়ে সংস্কৃত ভাষা। এর মাধ্যমে যত তিনি প্রাচীন কাব্য-সাহিত্য পুরাণ শাস্ত্র পড়বার সুযোগ পেলেন, ততই তাঁর সামনে জ্ঞানচর্চার একটা নতুন দিক বা রাস্তা উদ্ভাসিত হতে লাগল। প্রাচীন ইতিহাস তথা প্রাচ্যবিদ্যা ও ভারতবিদ্যা চর্চার প্রতি আগ্রহ এই সময়ে তাঁর মধ্যে প্রবলভাবে দেখা দেয়। সমস্ত সামাজিক-দার্শনিক-নৈতিক সমস্যা সমাধানের সর্বরোগহর ধন্বন্তরি হিসাবে নয়, সংস্কৃত গ্রন্থ ভাণ্ডারের মধ্যে প্রাচীন ভারতের আচার বিচার, রীতি নীতি, সমাজ সভ্যতার ধরন বুঝবার বেশ কিছু জরুরি উপকরণ তিনি পেয়ে গেলেন।
    ১৮৪৬ সালে বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদকের পদে যোগ দিলেন, তার কিছুদিনের মধ্যেই রাজেন্দ্রলাল কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সহকারী সম্পাদক ও গ্রন্থাগারিক হিসাবে একশ টাকা বেতনের একটি চাকরি পেলেন। এ-ও তাঁর জীবনের গতিমুখ নির্ণায়ক আর একটি ঘটনা। কারণ, এখানে তিনি সংস্কৃত সাহিত্য পাঠে জাগ্রত প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে কৌতুহল মেটানোর প্রচুর উপকরণ খুঁজে পেলেন—দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদেশি কর্মচারি, সংগ্রাহক ও পণ্ডিতদের সংগৃহীত পুঁথি, মুদ্রা, মূর্তি ও অনুশাসন। এরই ভিত্তিতে তিনি কিছু কিছু মৌলিক প্রবন্ধ রচনায় হাত দিতে শুরু করলেন। ভারতে ভারতীয়দের উদ্যোগে সুনির্দিষ্ট তথ্য সহযোগে অতীতের পুনরুদ্ধারের এই ছিল প্রথম প্রয়াস। দশ বছর পরে তিনি অন্য চাকরিতে (চিৎপুরে পিতৃহীন জমিদারপুত্রদের স্কুল ওয়ার্ড্‌স ইন্সটিটিউশনে শিক্ষক হিসাবে) যোগ দিলেও এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বা সম্পর্ক অটুট ছিল আমৃত্যু! কখনও সদস্য, কখনও সম্পাদক, কখনও সভাপতি হিসাবে সাম্মানিক পদমর্যাদায়!

    ।। ২।।

    এবারে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের দেশ-কালগত প্রেক্ষাপটটিকে একটু দেখে নেওয়া যাক। তাতে তাঁকে আমরা হয়ত আরও ভালো করে বুঝতে পারব।
    রামমোহন রায়ের সামাজিক ধর্ম ও শিক্ষা সংস্কার প্রচেষ্টা ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে যে নতুন চিন্তাভাবনা এবং সমাজ বিন্যাসকে নতুন সাজে সাজানোর প্রয়াস সূচিত হয়েছিল, তাকে আমরা বাংলা বা ভারতের নবজাগরণ বলে চিহ্নিত করি। ইউরোপীয় রেনেশাঁসের সঙ্গে ব্যাপ্তি বা বিস্তারে ভারতীয় নবজাগরণের প্রভেদ অনেক এবং সুস্পষ্ট; কিন্তু গুণগত বিচারে বা মূলগত চরিত্রে যে সাদৃশ্য বা রক্তের সম্পর্ক, তাকে অনেক পণ্ডিতই ধরতে পারেননি। যে কারণে এই রেনেশাঁস নিয়ে, এর চরিত্র বা জাত নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে আমাদের সমাজে। তবে, আক্ষেপের কথা হল, প্রচলিত ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী বা জাতীয়তাবাদী মানসিকতা সম্পন্ন বুদ্ধিজীবী পণ্ডিতরা যতটুকুও এগিয়েছেন, যাঁদের বেশি বোঝার কথা, সেই মার্ক্সবাদী বলে পরিচিত বিশ্লেষকরা অনেকে বরং তার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেননি। এখানে এই ব্যর্থতার ইতিহাস বা কারণ নিয়ে বেশি কথা বলার সুযোগ নেই। আপাতত শুধু একটি কথাই বলে নিতে চাইব।
    এই দেশে বিশ ও তিরিশের দশক থেকে যে তথাকথিত কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার মূল ধারাই ছিল রুশ-চিন-ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে অনুবাদ ও অন্ধ অনুকরণ করে ভারতের অর্থনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সামাজিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বিকাশ—ইত্যাদি সব কিছুকে বোঝার ও ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টা। সেই বিচার পদ্ধতি—যাকে তাঁরা মার্ক্সবাদসম্মত বলে মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে মার্ক্সবাদের চোখে যান্ত্রিক পদ্ধতি হিসাবেই সমালোচিত—সেই অনুযায়ী ইউরোপীয় রেনেশাঁসের একটা আদর্শ মনগড়া মডেল বা কাঠামো তৈরি করে নিয়ে তার হুবহু এক অনুলিপি যেহেতু তাঁরা ভারতীয় রেনেশাঁসে দেখতে পাননি, ফলে তাঁরা সিদ্ধান্ত করে বসেছিলেন, এখানে কোনো রেনেশাঁস হয়নি, হলে অমুক হত, তমুক হত, ইত্যাদি। এখানে যা হয়েছে তা নাকি আসলে এক ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপনায় ইউরোপীয় রেনেশাঁসের ক্যারিকেচার। শহুরে দালাল পরগাছা জমিদার ইংরেজদের ধামাধরা বুদ্ধিজীবী ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের একটু আধটু আধুনিক ভাব নিয়ে কলকাতায় মাঝে মধ্যে শৌখিন রঙ্গরসের খেলা।
    তাঁরা যেটা বুঝতে পারেননি তা হল, বাংলার এই নব অভ্যুত্থানকে “রেনেশাঁস গোত্রস্থ” বলে না মানলে শুধু যে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-অক্ষয় কুমার দত্ত-জগদীশ চন্দ্র বসু-প্রফুল্ল চন্দ্র রায়-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্র-মাইকেল-রোকেয়া সাখাওয়াত-নজরুল ইসলাম প্রমুখর আবির্ভাবকে বোঝা বা ব্যাখ্যা করা যায় না, তাই নয়, এঁদের যাবতীয় প্রতিভা এবং সৃষ্টিকে হয় অস্বীকার করতে হয়, অথবা শুধু মাত্র ব্যক্তিগত কৃতিত্বের ঘটনা হিসাবে মেনে নিতে হয়। দেশ-কাল সমাজ ইতিহাসকে ধরে নিতে হয় এই সব পরিঘটনা ও ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব-কর্মের নিষ্ক্রিয় আধার—ইতিহাস বা সাহিত্য আলোচনায় যা এক গভীর স্ববিরোধিতা ডেকে আনে।
    যেমন ধরা যাক, বিনয় ঘোষ। ১৯৫০-এর দশকে, যখন তাঁর মতে রেনেশাঁস হয়েছিল, বিদ্যাসাগরের উপর তিন খণ্ডে বিভক্ত এক চমৎকার বিশ্লেষণাত্মক রচনায় [বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ] তিনি খুবই সঠিক মূল্যায়ন করেছিলেন। আমরা এখনও সেই বইটিকে সেই যুগ ও বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ আলোচনার সময় এক আকর গ্রন্থ হিসাবেই বিবেচনা করে থাকি। অথচ, ১৯৬৮ সালে নকশাল আন্দোলনের উত্তাপে তেতে উঠে যখন থেকে তিনি সামন্ততন্ত্র ও উপনিবেশবাদের ব্যাপক প্রভাব দেখতে শুরু করলেন, তখন পুরনো বিশ্লেষণ থেকে পিছিয়ে এলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন, রেনেসাঁস-টেনেসাঁস জাতীয় কিছু হয়নি এদেশে। অথচ, তখন তিনি বুঝতেই পারলেন না, বইটির ভূমিকায় বিদ্যাসাগর সম্পর্কে “শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা” বিষয়ক দু-চারটে নতুন ধরনের বিপ্রতীপ মন্তব্য সংযোজন করে দিলেই তাঁর বিশাল আকারের মূল বইটিতে যে বিপুল তথ্যরাজি তা বাতাসে মিলিয়ে যাবে না বা তার তাৎপর্যও রাতারাতি পালটে দেওয়া যাবে না। ফলে মাঝখান থেকে তাঁর নব প্রক্ষিপ্ত ভূমিকা আর পুরনো সুচিন্তিত মূল্যায়নের মধ্যে এক সাত যোজনের ফাঁক তৈরি হয়ে গেল।
    অবশ্য ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। খুব উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসাবে ছিলেন অরবিন্দ পোদ্দার এবং শিবদাস ঘোষ। তাঁরা বাংলার বুকে ঊনবিংশ শতাব্দের নব চিন্তার স্ফূরণকে রেনেশাঁস হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন এবং মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তথা আর্থসামাজিক বিশ্লেষণের মাপকাঠিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের মূল্যায়ন করেছেন, যা এই বৃহৎ বামপন্থী ধারার স্ববিরোধিতা থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল। তাঁদের মতে, ইউরোপের ইতিহাস থেকে রেনেশাঁসের সাধারণ তাৎপর্যকে বুঝতে হবে সামন্ততন্ত্র বিরোধী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠভূমি হিসাবে।
    সেই দিক থেকে বিচার করলে আমরা এর মধ্যে পাঁচটা খুব স্পষ্ট সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য চিনে নিতে পারি: (ক) গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী চিন্তা চেতনা; (খ) ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নারীমুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও তা অর্জনের প্রয়াস; (গ) যুক্তি ও তথ্যের আলোকে অতীত ইতিহাস সম্পর্কে পুনর্মূল্যায়নের প্রচেষ্টা; (ঘ) গোঁড়ামি মুক্ত মনে জ্ঞানজগতের নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিচরণ ও অভিযান, বিশেষ করে আধুনিক বিজ্ঞানের দিকে পদক্ষেপ; এবং (ঙ) ধর্ম ও ঈশ্বরকে হয় বিদায় জানানো হয়েছে অথবা সমাজ ও দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব উত্তরোত্তর কমিয়ে ফেলা হয়েছে, উহলোকের তুলনায় ইহলোকের গুরুত্ব বেড়ে গেছে মানুষের কাছে। আমরা যদি ইউরোপের নবজাগরণের সাথে ভারতের আলোচ্য সময়কালের ঘটনা ধরে ধরে একৈকিক সাদৃশ্য (one-to-one correspondence) না খুঁজে মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে তুলনা করি, তাহলে ঊনবিংশ শতকের ভারতেও দেখতে পাব, উপরোক্ত লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। দুর্বলভাবে হলেও। একটু আগেই যে নামগুলি উচ্চারণ করেছি, তাঁদের প্রত্যেকেই এই লক্ষণগুলিরই এক বা একাধিক সংমিশ্রণের ব্যক্তিরূপে অভিব্যক্তি।
    রেনেশাঁসকে এইভাবে স্পষ্ট চিহ্নে চিনে নেবার ফলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও আমরা সফলভাবে করতে সক্ষম হয়েছি। যে চিহ্নগুলিকে সিপিআই সম্পৃক্ত একদল বুদ্ধিজীবী ভারতে রেনেশাঁসের অনুপস্থিতির সাক্ষ্য বলে ভুল বুঝেছিলেন, সেইগুলিকে দেখান যায়, উপনিবেশের ছত্রছায়ায় এবং জমিদারি ব্যবস্থার সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত উদীয়মান ভারতীয় বুর্জোয়াদের সামন্ততন্ত্র ও বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রধানত আপসমুখী প্রবণতার লক্ষণ হিসাবে। এর ফলে ভারতীয় নবজাগরণের ঐতিহাসিক অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতাগুলিকে এক বাস্তব আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ফেলে বিচার করা সম্ভব হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ দয়ানন্দ ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখর রেনেশাঁস বিরোধী রক্ষণশীল ও কার্যত প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকাও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হতে থাকে। যদিও, খুব বিস্ময়কর লাগে যখন দেখি, তাঁদের রচনাবলিতেও, অক্ষয় কুমার দত্ত বা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নামগুলি সম্পূর্ণই অনুচ্চারিত বা উপেক্ষিত।
    কেন না, এই নবজাগৃতির এক অন্যতম ফসল হিসাবেই আমরা পাই রাজেন্দ্রলাল মিত্রকে।
    তাঁর জন্ম বিদ্যাসাগরের অল্প দিন পরেই, ১৮২৩ বা ১৮২৪ সালে। তাঁর বড় হয়ে ওঠার কালে রেনেশাঁস তখন আর অঙ্কুর নয়, পূর্ণ বিকশিত চারাগাছের স্বমহিমায় সে আত্মপ্রকাশ করেছে। রামমোহনের কাল পেরিয়ে তখন আসতে চলেছে বিদ্যাসাগরের যুগ। রাজা হিন্দু সমাজের ধর্মীয় আচার বিচারের সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন, এক দিকে সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, অপর দিকে কালের অবলেপে জীর্ণ কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অসংখ্য দেবদেবীর পূজা ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করে এক ব্রহ্ম উপাসনার কথা বলেছিলেন। তিনি তখন বেদান্ত ও উপনিষদ চর্চার জন্য বিভিন্ন প্রামাণ্য শাস্ত্রের বঙ্গানুবাদে হাত দিয়েছিলেন। এই সবই ছিল আধুনিক এক সামন্তবাদ ও উপনিবেশ উত্তর সমাজ নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ। আর তারই ধারাবাহিকতায় বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের প্রচেষ্টার পাশাপাশি হাত দিলেন শিক্ষাসংস্কারে। ঘোষণা করলেন, বিশ্ববীক্ষা হিসাবে সাঙ্খ্য ও বেদান্ত একেবারেই ভ্রান্ত ও অকার্যকরী দর্শন। কিন্তু নানা কারণে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের যেহেতু এসব হাবিজাবি জিনিস পড়াতে হবে, এর শক্তিশালী প্রতিষেধক হিসাবে পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী চিন্তা ও দর্শনের সাথে ছাত্রদের পরিচয় ঘটিয়ে দিতে হবে। এইভাবে তিনি ছাত্রদের মধ্যে যুক্তিবাদ, সত্যান্বেষী মন, উদারতা ও মানবতাবাদী মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। বাংলার মনন জগতে এই সব চিন্তার ছাপ পড়ছে, একটু একটু করে তা জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। অক্ষয় কুমার দত্ত এবং ডিরোজিওর কয়েকজন ভাবশিষ্যও তখন সমান্তরালভাবে বৈজ্ঞানিক ভাবনা চিন্তাকে বিভিন্ন পথ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে কাজ শুরু করেছেন। পত্র পত্রিকা যেগুলো তখন বেরচ্ছে তাদের নামেও এই প্রচেষ্টার আভাস—“তত্ত্ববোধিনী”, “জ্ঞানান্বেষণ”, “Enquirer”, ইত্যাদি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রতিষ্ঠিত “তত্ত্ববোধিনী” পত্রিকার মাধ্যমে “মানবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক” প্রচার করতে চেয়েছিলেন। অক্ষয় দত্ত তাতে “মানব প্রকৃতির সহিত বাহ্য বস্তুর সম্বন্ধ” বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কলকাতার বুকে এই রকম একটি বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলের মধ্যে রাজেন্দ্রলালের প্রবেশ।
    সুতরাং এটা আদৌ আশ্চর্যের বিষয় নয় যে তিনি রেনেশাঁস যুগের এক অন্যতম কর্তব্য নিজের জন্য স্থিরীকৃত করে নেবেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুসন্ধান—পৌরাণিক কাহিনি পরম্পরার কাল্পনিক ইতিবৃত্তের বিপুল ভগ্নস্তুপ থেকে প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার। যুক্তিবাদী তথ্যপিপাসু কৌতুহল যার প্রধান বা আসলে একমাত্র অবলম্বন। তাই অচিরেই তাঁকে দেখি ইতিহাস চর্চায় এক বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে। তাঁরই স্থাপিত “বিবিধার্থসংগ্রহ” পত্রিকায় বলতে শুনি, “ভারতবর্ষীয় ইতিহাসে বর্ণিত ঘটনাসকল কোন কোন সময়ে হইয়াছিল ইহার কোনো নির্ণয় না থাকায় এতদ্দেশের ইতিহাস বহুকালাবধি বৃথা রূপে গণ্য হইয়াছিল।” চন্দ্রগুপ্ত রাজাকে নিয়ে প্রচলিত লোকশ্রুতিগুলির সত্যতা সম্পর্কে তিনি সন্দেহ পোষণ করেন: “এতদ্রূপ স্পষ্টব্যক্ত অলীক গল্প হইতে যাথার্থ্য নিরূপণ করা অতি কঠিন; প্রত্যেক প্রসঙ্গের বিরুদ্ধ প্রমাণ অনায়াসেই প্রাপ্ত হওয়া যায়; অতএব কি সত্য কি মিথ্যা ইহা কি প্রকারে নিশ্চয় হইতে পারে?” এমনকি ইতিহাস পুনরুদ্ধারে পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারের যে অপরিসীম গুরুত্ব রেনেশাঁস উত্তরকালীন ইতিহাস রচয়িতাদের গবেষণায় স্বীকৃত হয়েছিল, তা-ও রাজেন্দ্রলাল অনুভব ও অনুধাবন করেছিলেন। তাই তো তাঁর কণ্ঠে আক্ষেপের ধ্বনি: “ইতিহাস বিষয়ে এতদ্দেশে যে প্রকার অনাদর, পুরাবৃত্ত বিষয়েও তদ্রূপ; ও কেহ কোনো প্রাচীন স্থানের কিংবা ব্যক্তির আখ্যান অনুসন্ধান করিতে নিযুক্ত হইলে অনেকে তাঁহাকে উপহাসও করে। . . . নিবিড় বনমধ্যে পুরাতন অট্টালিকার অবশিষ্ট অনুসন্ধান করা, কোনো কাল-বশত জীর্ণ দেবালয় কিংবা জয়স্তম্ভের বিজয়ের অর্থ নিরূপণ করণে প্রবৃত্ত হওয়া, অথবা কোনো প্রাচীন ঘৃষ্টিত অস্পষ্ট মুদ্রার মর্মানুসন্ধানে নিযুক্ত হওয়া, আশু নিষ্ফল কর্ম বোধ হয় বটে; কিন্তু এভাবেই দেশকে জানা যায়।”
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ জুলাই ২০১৬ | ১৭৯৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Debabrata Chakrabarty | 212.142.91.159 (*) | ১৭ জুলাই ২০১৬ ০৭:১৯58338
  • অশোক বাবু , গুরুতে আপনাকে স্বাগত , আপনার লেখার প্রথম পর্ব পড়ে এখনি মন্ত্যব্যর মত জায়গায় নেই , বাকি পর্ব গুলি আসুক । ধন্যবাদ ।
  • ranjan roy | 132.176.10.197 (*) | ১৮ জুলাই ২০১৬ ০২:০৪58339
  • ডিট্টো!
    অশোকবাবু আশা করি এর পর অক্ষয়কুমার দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও শিবনাথ শাস্ত্রীকে নিয়েও এমন লেখা লিখবেন।
  • b | 113.220.208.170 (*) | ১৮ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫৪58340
  • রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কাজকর্ম নিয়ে আরেকটু হোক।
  • সে | 198.155.168.109 (*) | ১৮ জুলাই ২০১৬ ০৫:১৯58341
  • খুব তথ্যপূর্ণ লেখা।
  • রৌহিন | 113.42.127.101 (*) | ১৮ জুলাই ২০১৬ ০৭:০৭58342
  • পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। এবং গুরুচন্ডা৯ তে স্বাগত অবশ্যই। আপনার অনুমতি থাকলে এই লেখাটি গুরুর ফেসবুক গ্রুপেও একটু শেয়ার করতে চাই।
    লেখা প্রসঙ্গে - ভারতীয় রেনেসাঁস বিষয়ে ভারতীয় কম্যুনিস্টদের যে ভুল ব্যখ্যার কথা বলেছেন তার সঙ্গে একেবারে একমত। বস্তুত ভারতীয় কম্যুনিস্টদের এই ভুলের তালিকা এত দীর্ঘ যে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তারা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আদৌ বুঝেছিলেন কি না? কম্যুনিজম দুনিয়ার আল্টমেট মতবাদ নয় - কিন্তু তার মধ্যেও যে সারবস্তু রয়েছে, সেটা যে টুকে মারার বিষয় নয়, এটাই ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টিরা বুঝে উঠতে পারলেন না।
  • ashoke mukhopadhyay | 127.194.35.188 (*) | ১৮ জুলাই ২০১৬ ০৮:৩০58343
  • আগ্রহ প্রকাশের আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আরও তিন বা চার কিস্তি লিখব। তাতে কতটা তুলে ধরতে পারব জানি না। চেষ্টা করছি। হ্যাঁ, এইভাবে আরও কয়েকজনকে নিয়েও লেখা দরকার, বিশেষ করে যাঁদের আমরা এত কাল তেমন করে চিনবার প্রচেষ্টা করিনি। ইচ্ছে আছে, ডিরোজিও, অক্ষয় দত্ত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শিবনাথ শাস্ত্রী, ... দের নিয়ে লেখার।
  • Debabrata Chakrabarty | 212.142.91.86 (*) | ১৯ জুলাই ২০১৬ ০৫:০৭58346
  • অশোক বাবুর ' আইনস্টাইন এর শতবর্ষের ওপরে বিস্তারিত লেখা পত্তর , এবং লেনিনের বিজ্ঞান প্রীতি নিয়ে বিশদে বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ বর্তমান , সম্ভবত পুস্তক ও আছে । অশোক বাবু সেই লেখাগুলি আমাদের এই গুরুতে দেওয়ার জন্য আগাম অনুরোধ জানিয়ে রাখলাম ।
  • ranjan roy | 132.176.10.197 (*) | ১৯ জুলাই ২০১৬ ০৮:৫১58344
  • ওয়াহ্‌ ওয়াহ্‌ রৌহিন!
    অশোকবাবু ,
    আপনার কলমে গুরুর পাতায় ফুটে উঠুক বঙ্গীয় রেনেসাঁর নব-মূল্যায়ন। ডিরোজিও, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কেউ বাদ যাবেন না। শেষে আপনার মুখে শুনতে চাইব সুশোভন ও সুমিত সরকার, বিনয় ঘোষ ও চিন্মোহন সেহানবীশ বা ভবানী সেনদের মূল্যায়ন ( সরোজ দত্তও কেন বাদ পড়বেন?) নিয়ে আজকে আপনার উপলব্ধি।
    এখন থেকেই গুরুর অ্যাডমিনদের কাছে আর্জি জানাচ্ছি-- বঙ্গীয় রেনেসাঁর নব-মূল্যায়ন নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি চটি বের করার।
    দুই খন্ডেও বেরোতে পারে।
    বছর নয় আগে টইপত্তরে হুতোম ও আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি নামের আড়ালে দুই গুরু ও চন্ডালের যুগলবন্দীতে খাসা জমে উঠেছিল উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গের কিছু ছবি। সেগুলো সামিল করা যেতে পারে।
  • রৌহিন | 212.142.125.110 (*) | ১৯ জুলাই ২০১৬ ০৯:০২58345
  • অত্যন্ত সাধু প্রস্তাব রঞ্জনদা
  • π | 24.139.209.3 (*) | ২১ জুলাই ২০১৬ ০১:৪৪58347
  • ভালো লাগল। আরো হোক, রাজেন্দ্রলা মিত্রের কাজকর্ম নিয়ে আরো বিস্তারিত এবং অন্যান্যদেরও।
    বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগরকে মূল্যায়ন ও পরে কিছু বিপ্রতীপ মন্তব্য সংযোজন, এ বিষয়েও একটু বিস্তারিত জানতে চাই।

    আর এই জায়গাটা নিয়েও আরো একটু বিস্তারিত চাই।
    ' যে চিহ্নগুলিকে সিপিআই সম্পৃক্ত একদল বুদ্ধিজীবী ভারতে রেনেশাঁসের অনুপস্থিতির সাক্ষ্য বলে ভুল বুঝেছিলেন, সেইগুলিকে দেখান যায়, উপনিবেশের ছত্রছায়ায় এবং জমিদারি ব্যবস্থার সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত উদীয়মান ভারতীয় বুর্জোয়াদের সামন্ততন্ত্র ও বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রধানত আপসমুখী প্রবণতার লক্ষণ হিসাবে। এর ফলে ভারতীয় নবজাগরণের ঐতিহাসিক অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতাগুলিকে এক বাস্তব আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ফেলে বিচার করা সম্ভব হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ দয়ানন্দ ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখর রেনেশাঁস বিরোধী রক্ষণশীল ও কার্যত প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকাও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হতে থাকে।'?

    এখানে একেকজনের উদাহরণ দিয়ে এলে বুঝতে সুবিধে হয়। মানে যাঁদের কাজকে সিপিআই সম্পৃক্ত বুদ্ধিজীবীরা রেনেসাঁয় ফেলতে চাননি, কী কী কারণে চাননি, আর তার খণ্ডনই বা কারা কারা কীভাবে করেছেন।
    'ইউরোপীয় রেনেশাঁসের একটা আদর্শ মনগড়া মডেল বা কাঠামো তৈরি করে নিয়ে তার হুবহু এক অনুলিপি যেহেতু তাঁরা ভারতীয় রেনেশাঁসে দেখতে পাননি, ফলে তাঁরা সিদ্ধান্ত করে বসেছিলেন, এখানে কোনো রেনেশাঁস হয়নি, হলে অমুক হত, তমুক হত, ইত্যাদি। এখানে যা হয়েছে তা নাকি আসলে এক ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপনায় ইউরোপীয় রেনেশাঁসের ক্যারিকেচার। ' - হলে অমুক হত, তমুক হত -এই অমুক, তমুকদের নিয়ে একটু স্পেসিফিক্যালি জানতে চাইছি আর কি।

    ওদিকে রামকৃষ্ণদের প্রতিক্রিয়াশীল , আন্টি-রেনেসাঁর বলা হচ্ছে কি ধর্ম নিয়ে মাতামাতির জন্য ? বিবেকানন্দ কোন ক্যাটেগরিতে ?

    এখানেই উত্তর দিতে হবে এমন না, আলাদা লেখাই হোক না এই নিয়ে।
  • ashoke mukhopadhyay | 127.194.38.155 (*) | ২২ জুলাই ২০১৬ ০৯:২৩58348
  • সত্যিই ভালো ভালো প্রস্তাব আসছে। হ্যাঁ, এই প্রবন্ধে এর বেশিরভাগই হয়ত ধরা সম্ভব হবে না। আলাদা করেই লিখতে হবে। কলকাতার বা বাংলার রেনেশাঁস নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে, প্রচুর বিতর্কও হয়েছে। সেই সব সমীক্ষা করে আবারও নিশ্চয়ই লিখতে হবে, এবং ইচ্ছে আছে, পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করার। তবে, সব ক্ষেত্রে হয়ত ব্যক্তি চরিত্র ধরে ধরে লেখা মুশকিল, যদিও ভিআইপি-দের অবশ্যই ছুঁয়ে যেতে হবে। আবার বিজ্ঞান নিয়েও যদি আলোচনা করতে শুরু করি, সে আর এক জগত। পুরনো লেখা পুনরুত্তোলনের অনুমতি দিলে অবশ্য কম খেটে অনেক বেশি কাজ করে দেখাতে পারি। বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর প্রকল্প নিয়ে স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করার প্রস্তাবটা বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করছে। এক ঢিলে অনেক পাখি তাড়ানো যাবে। সবাইকে আবার ধন্যবাদ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন