এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রাজেন্দ্রলাল মিত্র: উনিশ শতকের ভারতবিদ্যা পথিক # চতুর্থ পর্ব

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩১ জুলাই ২০১৬ | ১৮৮২ বার পঠিত
  • [এবছর ২৬ জুলাই ২০১৬ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যুর একশ পঁচিশ তম বছর সূচিত হচ্ছে। উনিশ শতকের ভারতের এই অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রকে আমরা আজ ভুলে গেলেও তাঁর জীবনের কর্ম ও সাধনাকে যতটুকু স্মরণ করব সেই অনুপাতে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতে ইচ্ছে হবে। সেই তাগিদ থেকেই এই রচনার জন্ম। ধাপে ধাপে কয়েকটি ক্রমে আমরা চেষ্টা করছি স্মরণ করার ফাঁকে ফাঁকে এই মহৎ মানুষটিকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানের কিছু ভাগ অন্তত ফিরিয়ে দিতে। এবারে চতুর্থ পর্ব। সূত্রোল্লেখ পঞ্চম বা শেষ পর্বে থাকবে।]

    ।। ৬ ।।
    উপরোক্ত গ্রন্থ কয়টির কথা জানার পর রেনেশাঁসের পঞ্চম ধ্রুপদী লক্ষণটিকে স্মরণ করে এখানে এবার একটা প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই উত্থাপন করা যেতে পারে: ধর্ম সম্পর্কে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ঠিক কেমন মত পোষণ করতেন? ভারতের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এটি খুবই অস্বস্তিদায়ক স্পর্শকাতর অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
    পারিবারিক ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, তাঁদের বাড়িটি ছিল বৈষ্ণব ধর্মের প্রেম আধ্যাত্মিকতা ভাবুকতার একটা কেন্দ্র। এর একটা স্থায়ী ছাপ তাঁর চেতনায় পড়েছিল। তার থেকে তাই গড়-পরতা এক ঈশ্বরের কল্পনায় তাঁর বিশ্বাস ছিল। বিবিধার্থসংগ্রহ পত্রিকায় কোনো এক সংখ্যায় ঈশ্বরের প্রশস্তিও ছাপা হয়েছে। কিন্তু রেনেশাঁস যুগের মনীষীদের জীবনবোধে যে ঐহিকতার প্রভাব একটা বিশ্বজনীন লক্ষণ, রাজেন্দ্রলালের মধ্যেও তা পুরোমাত্রায় দেখা যায়। তাছাড়া, পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র রামকৃষ্ণ কেশব সেন বিবেকানন্দের হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চিন্তাধারা ও ধর্মীয় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার রেনেশাঁসকে বিপ্রতীপ এক অভিমুখে টেনে নিয়ে যাওয়ার যে প্রবল প্রয়াস সৃষ্টি হয়েছিল, তাঁর জীবনের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তার তেমন অস্তিত্ব বা জোর ছিল না। ১৮৭০-এর দশকে যখন সেই ভাঁটির টান এল, তত দিনে তাঁর চিন্তা ও কর্মের দু-তিন মহলা সৌধটি নির্মিত হয়ে হয়ে গিয়েছিল বলে তাঁকে আর সেই বিপরীতমুখী চিন্তাস্রোত তেমন করে প্রভাবিত করতে পারেনি। এই তথ্যটি আরও বেশি করে উল্লেখ দাবি করে, কেন না, বাংলার সেই দিনের নবজাগৃতির অধিকাংশ স্রষ্টারাই ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলন থেকে নিঃসৃত। রাজেন্দ্রলাল মিত্র এই ক্ষেত্রে বোধ হয় একক অনন্য ও ব্যতিক্রম। বৃহত্তর হিন্দু ধর্মীয় বৃত্ত থেকে বিনির্গত হয়েও, আপন ধর্ম বিশ্বাস না হারিয়েও, রাজেন্দ্রলাল মিত্র কিন্তু ভারত ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চায় ধর্মীয় চেতনা মুক্ত বাস্তববাদী বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তা যদি না হত, তাঁর পক্ষে উপরোক্ত বইগুলি রচনা করা সম্ভবই হত না।
    এই ধর্মনিস্পৃহ মনোভাব তিনি আগাগোড়া ধরে রেখেছেন। ১৮৫৪ সালে যখন তিনি “চৈতন্যচন্দ্রোদয়” শীর্ষক কবি কর্ণপুর রচিত চৈতন্যদেবের জীবনকাহিনি অবলম্বনে সংস্কৃত নাটকটি এশিয়াটিক সোসাইটির তরফে প্রকাশ করেন, তার ভূমিকায় চৈতন্যদেবের আন্দোলনের সামাজিক ভূমিকা, মার্টিন লুথারের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য ও সাদৃশ্য, সুফি মতবাদের সঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মের সম্পর্ক, ইত্যাদি বিষয় নিয়েই তিনি বিস্তৃত পর্যালোচনা করেন। আসলে তিনি নিশ্চয়ই বাহ্য কর্মক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের সত্য-প্রতিসরণ ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই জাগতিক ব্যাপারে ধর্মের অনুপ্রবেশকে তিনি সরাসরি বিরোধিতা করেছেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের ১৮৭৭ সালের সভায় ভাষণ দিতে উঠে তিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সরকারি অনুদান প্রদানের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। বলেছেন—ধর্ম ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের নিজস্ব গণ্ডীর মধ্যে স্বাধীনভাবে টিঁকে থাকুক। সরকার যেন ধর্ম সম্পর্কে নিরপেক্ষ থাকে, কাউকেই যেন কোনো রকম পৃষ্ঠপোষকতা না করে। প্রসঙ্গত, একটা বিশেষ ঘটনার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ডঃ হর্নলেকে অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগের সময় বাধা দিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে হর্নলে একজন সক্রিয় ধর্ম প্রচারক।
    এটা যে শুধু তাঁর মুখের কথা ছিল না, চেতনার স্তম্ভ হিসাবেই কাজ করত, তা খুব সুন্দরভাবে বোঝা যায় “চৈতন্যচন্দ্রোদয়” নাটকের পুঁথি সম্পাদনা করে মুদ্রণের সময়ে তিনি এর যে ভূমিকাটি লিখেছিলেন তাতে। তাঁর পরিবারে ছিল বৈষ্ণব ধর্মের অনুশীলন। অথচ তাঁর “আলোচনায় কোথাও ব্যক্তিগত সংস্কার বা আবেগ প্রাধান্য পায়নি, তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকায় যুক্তি ও তথ্যের সাহায্যে চৈতন্যদেবের জীবন ও ধর্মাদর্শ বিশ্লেষণ করেছেন”। প্রোটেস্টান্ট সংস্কারক মার্টিন লুথারের সঙ্গে তাঁর তুলনা টেনে এনে দেখিয়েছেন, লুথার যেখানে পুরনো খ্রিস্ট ধর্মকে তার অনেক অনাচার ভ্রষ্টাচার থেকে মুক্ত করে পাদ্রিদের দাপট থেকে বের করে এনে এক সরল ধর্ম পালনের পদ্ধতিতে পরিণত করেছিলেন, চৈতন্য তা পারলেন না। তিনি ভাগবত ধর্মকে পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে জাতপাতের জটিলতা থেকে হিন্দু সমাজকে মুক্ত করতে চেয়েও এক রহস্যবাদী মরমিয়া ধর্মচর্চার বাইরে আর বেরতে পারলেন না। উপসংহারে এসে তাঁর বক্তব্য, প্রাচীন বেদান্তের সাথে মধ্যযুগীয় পৌত্তলিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে যে মরমিয়াবাদের জন্ম দেওয়া হল তাতে “it is more calculated to produce a ‘hypertrophy of religious feelings’, than a healthy heart-felt veneration for the great Father of the universe— … it is more suited to the temper of lazy monks than the requirements of honest citizens.” [উদ্ধৃত, রায় ১৯৬৯, ২১৫-১৭] এরকম শক্ত শক্ত কিছু শব্দগুচ্ছ শোনার পর অধ্যাপক রায়ের কথাটি অবশ্য স্মর্তব্য: “ভক্ত বৈষ্ণব সম্প্রদায় রাজেন্দ্রলালের মন্তব্যে অসন্তুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু রাজেন্দ্রলাল সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ বা বৈষ্ণবশাস্ত্র সম্পাদনাকালে ভক্তির প্রেরণা অপেক্ষা যুক্তির অনুরোধেই সর্বদা চালিত হয়েছেন।” [রায় ১৯৬৯, ২১৭]
    অক্ষয় কুমার দত্ত নিরীশ্বরবাদী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর ক্ষেত্রে এরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছনো তত কঠিন হয়ত ছিল না; কিন্তু রাজেন্দ্রলাল মিত্র, যিনি স্বয়ং ধর্মবিশ্বাসী, তাঁর পক্ষে কাজটা অত্যন্ত কঠিন! তবু তিনি পেরেছিলেন।
    তাঁর পরবর্তী যুগে যাঁরা সামাজিক সাংস্কৃতিক বা জাতীয়তাবাদী চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে ধর্মকে বসিয়েছিলেন, তাঁরা যে ভারতের বুকে ইতিহাস পুরাতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে কতখানি ক্ষতি করেছিলেন—সেই দুই পর্বের জ্ঞানচর্চার গুণ ও মানের তুলনা করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অক্ষয় কুমার দত্তের “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস” বা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের The Indo-Aryans–এর মতো গ্রন্থ তাঁদের মৃত্যুর পরবর্তী পঞ্চাশ বা একশ বা একশ পঁচিশ বছর পেরিয়ে এসেও আর লেখা হল কই?

    ।। ৭ ।।
    হ্যাঁ, আর একটা কৌতুহল। রাজেন্দ্রলাল মিত্র মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন? ধর্ম প্রসঙ্গ উঠলেই আমার মনে হয় আলোচ্য ব্যক্তির নৈতিক চরিত্রের একটা তৌলমাপ গ্রহণ করা উচিত। ধর্মতাত্ত্বিকরা মনে করেন, ধর্মে মতি না থাকলে নাকি মানুষের নৈতিক চরিত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। ধর্ম আর নীতিধর্ম দ্বন্দ্ব সমাসে একাকার হয়ে গিয়ে এই বিপত্তির জন্ম দিয়ে থাকে। এমনিতে, বিদ্যাসাগর, শরৎ চন্দ্র, ভগত সিং, সূর্য সেন, প্রমুখ প্রায় ঘোষিত নাস্তিক চরিত্রের সামনে রাখলে সমকালে ধর্মবিশ্বাসীদের কাউকেই সেই উচ্চতায় উঠতে দেখি না। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো আর আমাদের মতো করে তুলনামূলক বিচার করে না। তারা প্রত্যেক ব্যক্তিকেই ধরে আলাদা আলাদা করে। সুতরাং, আমাদেরও সেইভাবে রাজেন্দ্রলালকে ইতিহাসের সিসিটিভি-র স্ক্রিনে তাঁর চলাফেরা লক্ষ করে এই প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজতে হবে।
    রাজেন্দ্রলাল যেহেতু সমকালে অজস্র কর্মকাণ্ড ও সমিতি বা কমিটির সাথে যুক্ত ছিলেন, তাঁকে সেই সময়ের বহু বিশিষ্ট মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল। ইংরেজ এবং ভারতীয়। লক্ষণীয়, উভয় পক্ষের কাছ থেকেই তিনি প্রশংসা যেমন পেয়েছেন, গাল মন্দও শুনেছেন কম নয়। একদল সমকালীন ইংরেজ পণ্ডিত তাঁকে নকলনবিশির অভিযোগ এনে ছোট করতে চেয়েছেন (আর সত্যিই তো, তাঁর তো কোনো বিদ্যায়তনিক ডিগ্রি বা প্রতিষ্ঠা ছিল না; তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ফ্রিল্যান্স স্বশিক্ষিত পুরাতাত্ত্বিক ও ভারতবিদ্যা পথিক; প্রতিষ্ঠিত পেশাদার নৈপুন্যের অধিকারীদের অস্মিতায় লাগারই কথা!)। অন্য দিকে একদল ভারতীয় সংস্কৃত পণ্ডিতও তাঁর কাজের গুরুত্ব কমাতে চেয়েছেন এই বলে, তাঁরাই নাকি সব কাজ গুছিয়ে করে দিতেন, আর তিনি নাকি শুধু সম্পাদক হিসাবে নাম কুড়োতেন।
    এই সব অভিযোগ সত্য হলে তাঁর চারিত্রিক মান নিয়ে আর কোনো সংশয়ই থাকত না। কিন্তু সমসাময়িক কালেরই আর একদল ইংরেজ এবং ভারতীয় মনীষী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এই সব অভিযোগ নস্যাত করে দিয়েছেন। সংস্কৃত পণ্ডিত ম্যাক্সম্যুলার বা পুরাতত্ত্ববিদ কানিংহাম রাজেন্দ্রলালের ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন। অধ্যাপক অলোক রায়ের সূত্রে জানতে পারি, হাঙ্গেরির থিওডোর দুকা তাঁর স্মরণে উচ্ছ্বসিত শ্রদ্ধায় প্রায় ৪০ পৃষ্ঠার এক প্রবন্ধ লিখেছেন। [Duka 1892; উল্লেখিত, রায় ১৯৬৯] আর এদিকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর “জীবনস্মৃতি” গ্রন্থে এই সব অভিযোগকারীদের বলেছেন “মহত্ত্ব বিদ্বেষী ঈর্ষাপরায়ণ”। বাস্তবে, প্রতিটি সংস্কৃত পুঁথি সম্পাদিত আকারে মুদ্রণের সময় রাজেন্দ্রলাল তাঁর সহকারী পণ্ডিতদের নাম ও সাহায্যের বিস্তারিত স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। না দিলে হয়ত আজ আর তাঁদের কারোরই অস্তিত্ব বা সহকৃতির কোনো সাক্ষ্য থাকত না। সুতরাং এই বিরূপ সমালোচনাগুলিকে অগ্রাহ্য করেই আমরা তাঁর ভেতরের মানুষটিকে চিনবার জন্য অগ্রসর হতে পারি।
    আসলে সমস্যা ছিল মতান্তর এবং তজ্জনিত মনান্তর। সমসাময়িক ব্যক্তিদের স্মৃতিকথায় দেখা যায়, বিদ্যাসাগর রাজেন্দ্রলালের সংকৃত ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে কটাক্ষ করেছেন। ওয়ার্ড ইন্সটিটিউশন নিয়ে তাঁদের দুজনের মধ্যে যথেষ্ট খটাখটিও হয়েছিল। দুজনেই দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। কেউ কাউকে ছাড়ার পাত্র নন। ফলে তাঁদের মধ্যে হয়ত সব সময় সুসম্পর্ক ছিল না। অথচ বিদ্যাসাগর যে রাজেন্দ্রলালের গুণের সমঝদার ছিলেন তারও বেশ কিছু সাক্ষ্য আছে। তত্ত্ববোধিনী, Hindu Patriot ইত্যাদি পত্রিকার কাজে দুজনে এক সঙ্গে দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। বহুবিবাহ বিরোধী প্রস্তাব যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে রাজেন্দ্রলালের উদ্যোগে সমাজোন্নতি বিধায়িনী সভায় প্রথম গৃহীত হয়েছিল, বিদ্যাসাগর তার উল্লেখ করেছেন। অসংখ্য সরকারি বেসরকারি কমিটিতে দুজনে পাশাপাশি বসে সমানে সমানে কাজ করেছেন। এইভাবে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মধ্যে বিবাদ বিতর্ক হওয়া খুবই স্বাভাবিক। হ্রস্ববুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সেই সশব্দ বিবাদকেই দেখে, মিলিত নিঃশব্দ কর্মপ্রয়াসকে দেখতে পায় না। আর, নানা সামাজিক ঐতিহাসিক কারণে বিদ্যাসাগরে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের চাইতে অনেক বেশি ছিল। যথার্থ কারণেই ছিল। ফলে শেষ অবধি রাজেন্দ্রলালের কপালেই “অহং-সর্বস্ব”, “খিটখিটে”, “প্রচারমুখী”, ইত্যাদি ভালো ভালো খেতাব জুটেছে। অলোক রায়ের মতে, “ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিরলতম ভারতীয় কয়েকজনের মধ্যে তিনি একজন, যিনি অন্য জীবিকার জন্য প্রস্তুত হয়েও, অন্যতর ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য লাভের সুযোগ পেয়েও, জ্ঞানচর্চাতেই জীবন অতিবাহিত করলেন। পথিকৃতের মর্যাদা তিনি পেয়েছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে অবিশ্বাস এবং বিদ্বেষলাভও ললাটলিপি।” [রায় ১৯৬৯, ১১]
    যেখানে যে বিষয়েই মতামত দিন, রাজেন্দ্রলাল নিজের বক্তব্য থেকে সহজে সরে যেতেন না। দাপুটে সুবক্তা ছিলেন বলে বিরোধী মতাবলম্বীদের সঙ্গে তাঁর প্রবল বিবাদ ঘটত। শাসক সাহেবরাও এই কারণেই বিরক্ত হতেন। যা তিনি সমাজের পক্ষে পাঁচ জনের জন্য ভালো এবং সঠিক বলে বুঝতেন, তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কলকাতার কমিশনার হিসাবেও তাঁর ছিল এই তেজোদ্দীপ্ত ভূমিকা। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসাবে সেখানেও এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, কৃতবিদ্য চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৮৭৮ সালে মেডিসিন ফ্যাকালটিতে সদস্য করতে চেয়েছিল। ফ্যাকালটির অন্য চিকিৎসক সদস্যরা কিছুতেই রাজি নন, কেন না, ডাঃ সরকার এম-বি পাশ করেও হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর হয়ে সিন্ডিকেটের সভায় এমন ভাষণ দেন যে সদস্যরা মত পাল্টাতে বাধ্য হন। “মিথ্যাচার এবং কলুষতার বিরুদ্ধে তাঁর দৃপ্ত সংগ্রাম সে-যুগে তাঁকে সকলের কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র করেছিল”, কেন না, রায় যথার্থই লক্ষ করেছেন, “জ্ঞানের মন্দিরে সত্য নির্ধারণের জন্য ‘মা ব্রুয়াত সত্যমপ্রিয়ম্‌’ নীতি তিনি গ্রহণ করা অপরাধ মনে করতেন।” [রায় ১৯৬৯, ২৩ এবং ৩৮]
    তাঁর সমসাময়িক এক ব্যক্তি তাঁর অহমিকা নিয়ে অনেক নিন্দামন্দ করার পরও তাঁর সততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রশংসা করতে বাধ্য হন। বলেন, “His real power lay in combativeness. Opposition was his forte. His dearest wish was to cudgel his opponents into a respect for his opinions, and his life was one long ostentatious display of literary pugilism.” [উদ্ধৃত, রায় ১৯৬৯, ৩৮] রবীন্দ্রনাথেরও একই অভিমত, “যোদ্ধৃবেশে তাঁর রুদ্রমূর্তি বিপজ্জনক ছিল। ম্যুনিসিপাল সভায় সেনেট সভায় সকলেই তাঁকে ভয় করে চলত। তখনকার দিনে কৃষ্ণদাস পাল ছিলেন কৌশলী, আর রাজেন্দ্রলাল ছিলেন বীর্যবান। বড় বড় মল্লের সঙ্গেও দ্বন্দ্বযুদ্ধে কখনও তিনি পরাঙ্মুখ হননি, ও কখনও তিনি পরাভূত হতে জানতেন না।” [ঐ, ৭৫; সাধুভাষা থেকে চলিত ভাষায় রূপান্তরিত] তিন দশক পরে এক কবি, রাম শর্মা, তাঁর স্মরণে লেখা কবিতায় তাঁকে উল্লেখ করেন “The bravest captain of his clime and clan” [ঐ, ২৩] হিসাবে। হওয়ারই কথা। জ্ঞান, নৈতিকতা ও সাহস সেই সোক্রাতেসের আমল থেকেই এক অচ্ছেদ্য সূত্রে বাঁধা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩১ জুলাই ২০১৬ | ১৮৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন