এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • যে শহরে আমি বেমানান

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ আগস্ট ২০১৬ | ৬৯৭ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • আমি তখন নিজের শহর খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার শহরে একটা নদী থাকবে, অসংখ্য গাছ, বৃষ্টিভেজা পাখিরা জানালার কার্ণিশে এসে বসবে, রোদ ঝলমলে দিনে নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে বেড়ানো যাবে আর তৃষ্ণা পেলে ঢেউ খেলানো জলের দিকে মুখ করে বসানো চেয়ারের একটা কফির দোকান থেকে নিয়ে নেওয়া যাবে পছন্দের কাগজের কাপ – আরো অনেক কিছু – শহর আমাকে নষ্টালজিক করে তুলবে –

    নষ্টালজিক কাকে বলে? আমার তো কোন শহর ছিল না কোন দিন – তাহলে শহর কি করে আমাকে ফিরিয়ে দেবে নষ্টালজিয়া? আমি ঠিক জানি না – নাকি আমি প্রকৃত অর্থে জানিই না যে নষ্টালজিয়া কাকে বলে! আরো অসংখ্য লোক মুখে শেখা শব্দের মত আমিও ব্যবহার করি কিছু শব্দবন্ধ গভীরে না ঢুকেই। আমি কি গভীরে ঢুকতে ভয় পাই? নানা লোকমুখ বলে ভিতরে ঢুকতে হলে নাকি আবেগ চাই! আমি যদি নিজের শহর খুঁজে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাই তাহলে কি সেই শহর আমাকে পরিমাণ মত আবেগ ফিরে দেবে? আবেগ কিভাবে উদ্ভাবন করা যায়? নাকি কবিতার মত, ভালোবাসার মত, অঙ্কের মত – আবেগও ভিতরে থাকা চাই!

    বন্ধু বলল অপরিমিত আবেগের প্রকাশ আর্টকে নষ্ট করে। আমি তো শুনেছি ভালোবাসাও একধরণের আর্ট – তাহলে ভালোবাসাতেও কি আবেগের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে? বন্ধু আরো বলল পরিমিত আবেগের প্রকাশও নাকি আর্টকে নষ্ট করে। এবার চেনা গল্প শুনলাম – পরিমিত আবেগের প্রকাশ ভালোবাসাকে বারে বারে চ্যালঞ্জের সামনে ফেলে। আমি জানালাটা খুলে সামনের বাড়ির রোদ পোয়ানো মেয়েটিকে দেখতে দেখতে ভাবতে থাকলাম নষ্টালজিয়ার সাথে আবেগের কেমন ধরণের গাণিতিক সম্পর্ক থাকা উচিত। বেশী ভিতরে ঢোকার আগে আমার স্মৃতি পথ ঝালিয়ে নিল যে ঠিক তিন মাস আগেও ওই ছাদের মেয়েটি অবিবাহিত ছিল। অবশ্যই মেয়েটি আমার নষ্টালজিক শহরের ছবিতে ছিল না, সাইকেল রাখতে গিয়ে তার চাউনি একজনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে মাত্র।

    নিজের শহর আমি হাতে সময় থাকলেই খুঁজি – খোঁজার সাথে ভাবনার সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই, আবার আছেও। আমি নিজের শহরে নানা জিনিস প্রতিস্থাপিত করেছি ইচ্ছে মত – পচ্ছন্দের পরিবর্তন হয়েছে, রঙেরও বা কেমনভাবে তাকে দেখতে চাই, সেটারও। কিন্তু কোন সময়েই আমার শহরে উঁচু বাড়ি ছিল না। উচ্চতার সাথে আমার কোন বিশেষ প্রেম নেই, যেমন ছিল বন্ধুর। আমেরিকার বড় কোন শহরে ফ্লাইট ল্যান্ড করার আগে যে মৃদু স্বরে বলে উঠত, “আই লাভ টল্‌ বিল্ডিং” – আমার কানের কাছে সেই বাক্য গুন গুন করত, বন্ধুর ঘোর লাগা চোখ – আমি কিন্তু তা সত্ত্বেও কখনো উচ্চতা ভালোবাসতে পারি নি।

    তাই আমাকে যখন সেই নতুন শহরে গিয়ে অফিসের লোকদের সাথে প্রথম আলাপ করতে বলল – “গেট টু নো” যার গাল ভরা নাম – আমি তখনো অফিসের লোকজনদের থেকে বেশী চিন্তিত ছিলাম উঁচু বাড়ি নিয়ে। আমাকে বার বার বলে দেওয়া হয়েছিল স্টেশনে নেমে ‘উত্তর’ দিক লেখা বাহির পথ দিয়ে বেরিয়ে সামনের চারটে দাঁড়িয়ে থাকা ফেরির মাঝের দু-টোর যে কোন একটা নিয়ে নদী পেরিয়ে শহরের উল্টোদিকের আমাদের অফিসে যেতে। আমি স্টেশনে নেমে ‘উত্তর’ খোঁজার প্রয়োজনিয়তা হারিয়ে ফেলে উঁচু বাড়ি খুঁজছি। প্রথম দেখায় কিছু পেলাম না কেবল আমাদের অফিসের কম্পাউন্ডের সেই চোদ্দ তলা কুৎসিত বাড়িটা ছাড়া। সেটা ইগনোর করতে অভ্যাস করতে হবে ভাবলাম।

    অফিসের সাথে প্রথম মেলামেশা হয়ে গেলে আমি বেরিয়ে নদী পেরিয়ে মূল শহরে ঢুকলাম। একটাও উঁচু বাড়ি চোখে পড়ল না – মসৃণ ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়, ক্যানালের ধার – নানা দোকানের মাঝে প্রায়শই উঁকি মারছে কফির দোকান, রোদ চশমা পড়ে ক্যানালের জলের উপর দিয়ে চলে যাওয়া নৌকা দেখতে দেখতে চুমুক দিচ্ছে অনেকে নানাবিধ জিনিসে। আমার চোখের সামনে কি তাহলে নষ্টালজিয়া ভেসে ওঠা উচিত? এটাই কি তবে আমার শহর? এই শহরেই কি তবে আমি ঠিক মানিয়ে যাব?

    “এ শহরে আমি বেমানান
    বেহালাবাদকের যৌনসঙ্গীনি ফ্রিৎস্‌ - এ মেয়োনিজ্‌ মাখিয়ে
    চারপাশে দেখে নেয় কিছু অধিক চর্বিওলা লোকের চোখের তারিফ
    বাঁহাতে লেপ্টে থাকা অধিক ব্যবহারে জীর্ণ পূর্ব ইউরোপ
    গাঁজা সম্পৃক্ত পাব্‌গুলিতে উইকএন্ড ঢেলে দেয় সস্তা এয়ারলাইন ফেরত
    অসংখ্য বিয়ার পিপাসু - আমি তখনো সঙ্গীবিহীন
    প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হেঁটে যাই
    এক আপাত উদাসীনতার প্রলেপে

    এ শহরে আমি বেমানান
    লাল আলোর জানালায় মায়াবী চোখ দেখি, সিগারেট হাতে
    মৃদু সংগীত আর ব্রেসিয়ারের মাঝখানে লুকানো ক্লান্তি সেই উঁচু টেবিলের
    দিকে প্যান্টির আঁশগুলো ঘষটাতে বাধ্য করে এমনি সন্ধ্যাবেলা
    আমাকে তো অফিসফেরত আঁকা ভ্রু থমকে দেয়
    দিনের আলোতে কদাচিৎ সুপারমার্কেটে

    এ শহরে আমি বেমানান
    অধিক ভীড় থেকে ক্রমশঃই দূরে
    প্রথম স্বাদপ্রাপ্ত অতিথির দল জলপথ দিয়ে ঘুরতে থাকে বৃত্তাকারে
    পান্থশালা না পেয়ে ধূঁয়ার কেন্দ্রে সেই মায়াবী চোখ দেখি
    কেউ তো বেহালার সাথে নিষ্পাপ হতে চায়
    আনা ফ্রাঙ্ক মিউজিয়াম কর্ণারে”।

    এ আরো অনেক পরের লেখা – শহর ততদিনে জাঁকিয়ে বসছে আমার সত্ত্বায়। আমার স্মৃতি কি আমার মোহভঙ্গে সাহায্য করবে, নাকি অভিযোজনে? অথবা মানিয়ে নেওয়া সেই গাণিতক সূত্রকে ঈষৎ নিজের মত করে নিয়ে যেখানে নষ্টালজিয়ার সাথে আবেগের কিছু সম্পর্ক দেখানো হয়েছিল?
    আনা ফ্রাঙ্ক আমার কাছে আর কোন বালিকা নেই, সে এক যেন পূণ্যস্থানে পরিবর্তিত হয়েছে, এক টিক-বক্সে যা দাগানো প্রয়োজন এই শহরে একদিন এলেও। আমি তার পাশ দিয়ে ছূটি অফিস ফেরত, উইক-এন্ডের দিনগুলি – আর দেখি আঁকা বাঁকা লাইন টিকিট কাউন্টারের সামনে দিয়ে সর্পিল এগুচ্ছে আমার বাড়ির দরজার দিকে। এরা প্রায় সবাই সেই সুরঙ্গের গল্প করবে আরো অনেক দিন, বইয়ের তাকের পিছনে যার স্থান ছিল। কপাল থেকে ঘাম উলের দস্তান দিয়ে মুছে নিয়ে ভাবি, এরা কি সবাই আনা ফ্রাঙ্ককে আদপেই চেনে? বা চিনত এই শহরে উঠার আগে?

    এই প্রশ্নের কোন অর্থ হয় না, অন্তত এরা তো এসেছে স্টেশন থেকে ডান দিকে বেঁকে – আর বেশীর ভাগই তো ঢলে পরে স্টেশনের বাঁদিকে যেখানে আরো এক টিক-বক্স থাকে ‘রেড লাইট ডিষ্ট্রিক্ট’ নাম দিয়ে। লাল আলোর জানালায় মায়াবী চোখ নিয়ে বসে থাকা মেয়েটি আনা ফ্রাঙ্কের থেকেও বেশী অচেনা। এদেরই অন্তত একজনের সাথে আমার প্রায়শই সুপারমার্কেটে দেখা হয় – আমার এক বন্ধুর ভাড়া নেওয়া অ্যাপার্টমেন্টের প্রায় গায়ে গায়ে লেগে থাকা লাল জানালায় থাকে যে। একদিন রবিবার সকালে বন্ধুকে নিয়ে সুপারমার্কেট যাব বলে দরজায় বেল টিপছি, দেখি সেই সকাল নয়-টা তেও এক প্রায় বৃদ্ধর জন্য লাল জানালার দরজার খুলে দিচ্ছে মেয়েটি – চোখা চোখি হতে মেয়েটির কি লজ্জা হয়েছিল? বোকা বোকা প্রশ্নের জন্য বন্ধুর কাছে হ্যাঠা খেলাম – বন্ধু বলল তোর মতন ওদের কোন নষ্টালজিয়া নেই। আরো অনেকের মত আমার বন্ধুও নষ্টালজিয়া শব্দটির অপপ্রয়োগ করল। নষ্টালজিয়ার সাথে বেহালার তো সম্পর্ক থাকতেই পারে – মেয়েটি শেষ রাতে বেহালার সুরে হয়ত ঘুমিয়ে পড়ে। পূর্ব ইউরোপে ওর বোনের কলেজে পড়ার টাকা পাঠানো হয় যে শহর থেকে, সেই শহর কি তার নিজের শহর হয়ে উঠতে পারে না? আমি সেই মেয়ের সাথে বেহালাবাদকের এক নষ্টালজিক সম্পর্ক দেখি বন্ধুর হ্যাঠা উপেক্ষা করেও।

    “এই বিষ্মরণে যায় রসিক নাগর
    সহিবার তরে অগণিত উন্মুখ অধরগুলি
    সে জানে তাহাদের প্রাণ আছে আর যে বাসরখানি
    আজো ভেবে সন্ধ্যা ঘনিবার পরে ফুলসাজ আছে যে শ্বেতপাথরে
    আর আছে চিনামাটির উষ্ণতা সেই হিম বেলায়
    হে রসিক নাগর - তুমি জান অধরের স্বাদ
    আমি জানি নোনতা হয়ে ওঠা শরীর গুলো
    পাথরের থেকে শুষে নিতে পারে একাকিত্ব

    নাগর রসিক না হলে তবুও সবুজ দিনেরা
    চায় যে অধরযুগল বা আরো কিছু - ফুলসাজ ঝরে পরে
    এমন ক্ষণেই তারে সিক্তবসনা বলিলে
    কেমনে গতানুগতিক হয়ে ওঠে ক্রমিকেরা

    তারে বলিবার যো নাই, এ পথের তাড়া
    আমি ক্রমশঃই অনেক সংখ্যার মতই ক্রমিক হয়ে উঠি
    শুধু সেই ফুলসাজে লেগে থাকা ঋতুর গন্ধ জানায়
    এখনো বসন্ত যায় নি এবং এখনো বসন্ত আসেনি
    কেবল আমাদেরই সেই গোধূলি বেলায় আর
    লালচে আভায় থাকিতেই পারে লুকানো একাকিত্ব

    কেন যে তারে গেল না বলা
    এসো না খুঁজে বের করি সেই বিষ্মরণ”!

    আমি এ কবে লিখেছিলাম জানি না – চেষ্টা করলে জানা যেতেই পারে, খাতায় বা কম্পিউটারে দেখে – কিন্তু জানতে আর ইচ্ছা করে না। সামনে যখন কোন গল্প তৈরী হয়, তখন তার দর্শক অনেক সময় টেরই পায় না যে গল্প বোনা হয়ে চলেছে, এমনকি অনেকে টেরই পায় না যে তারা আদপেই দর্শক। অভিনেতা কাকে দর্শক ঠাউরে নিয়েছে সে নিয়েও কোন রোমান্টিক গল্প চালু হতেই পারে। আমার মনে হত যে সেই মেয়েটির চোখে আমরা দর্শক হয়ে উঠেছি – আমি না আমরা? আমার বন্ধু কি বাদ? মেয়েটি কি টের পেয়েছে যে আমার বন্ধুর কোন নষ্টালজিয়া নেই? আমার চোখে কি কেবলই অভিনেতা তারা? মেয়েটি আর বেহালা বাদক? বেহালাবাদক কি জেনে শুনে বিষের দিকে এগুচ্ছে? বন্ধুর কোন রোমান্টিকতাও নেই, ওর কাছে এই সবই বিষ মরণ। সে শহর যদিও আমার আপন হয়ে ওঠে নি, তবুও আমি যেন চাইছিলাম বেহালা বাদক রসিক নাগর হয়ে যাক লাল-জানালা থেকে ছুটির কোন এক দিন। মেয়েটির বিছানায় না হয় একদিনেও জন্যও থাক ‘ফ্লাওয়ার মার্কেট’ থেকে নিয়ে আসা ফুলের গন্ধ, আর সেই দিন বিছানার সাথে ঘড়ির সম্পর্কটাও থাক না হয় স্থগিত! বহুজনের শুষে নেওয়া ঠোঁট থেকে বেহালাবাদক তুলে নিক নিজেদের মত করে গড়ে নেওয়া স্বাদ।

    এতো গেল একটি মেয়ের গল্প – লাল জানালায় যারা শুধুই জীবিকা অর্জন করছে, তাদের নিয়ে কি তাহলে আমার রোমান্টিকতা হোঁচট খাওয়া উচিত? তাদের নিয়ে আমার কোন নষ্টালজিয়া গড়ে ওঠা কি সম্ভব? আসলে নষ্টালজিয়া দাবী করে কিছু অণুক্ষণ তাদের সাথে কাটানো – নষ্টালজিয়ার সাথে কিভাবে কিছু ক্ষণ কাটানো উচিত সেই নিয়ে ভাবতে গেলে লাল-জানালা গুলি যেন ক্রমিক সংখ্যা হয়ে ওঠে। কেউ যেন সময়ের দাবী জানায় – এ শহর জানায় আরো ভিতরে ঢোকার আহ্বান – আরো সাধারণে ঢোকার আহ্বান।

    “প্রত্যহ সকালগুলি আমার কর্মক্ষেত্রে
    সুদূরপরাহত ট্রাফিকের ভিড়ে মৌনতা অবলম্বন করে
    পাশের কাঁচের থেকে জানালা
    সেখান হতে কোঁকড়ানো চুলের গাছি
    সবাই আগামী ভালোবেসে মগ্ন নীল
    কোলে লেপ্টানো ওয়াইন সংক্রান্ত বুকে
    যেমনে বাদামী কাঁচ উঠে যায়
    বলিরেখা
    গ্রীষ্মের সকালেই ডেকে আনে এক প্রগাঢ় নির্লিপ্ততা
    পোষাকের আড়াল থেকে
    গতরাতের গ্লানি অথচ আনন্দেও আবছা সরিয়ে নিতে
    হয় ডোরাকাটা লালদাগ
    ঠোঁট ভিজিয়ে দিতে চাওয়া রাতের লালা
    ফিরে আসে পালকে - সাদা চাদরে
    মোমত্বক জানে স্পর্শের সুখ - জড়ানো ফেমিনা
    কদাচিৎ মৌন ট্রাফিক আটকে দেয় কোঁকড়ানো চুল” ........

    আমি আরো সাধারণে ঢোকার চেষ্টা করি, শহরে নিজেকে মানিয়ে নিতে হলে কেমন ভাবে জড়িয়ে নিতে হবে তাকে – সেই সব ভাবতে ভাবতে সকালে অফিস যাই। আমার বাড়ি ক্যানালের ধারে, আমার অফিস নদীর ধারে। বাড়ি থেকে জলের পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেও জলের শব্দ পাই না – এখানে জলের কোন শব্দ নেই। জলের ধারে রাখা জলের উপরের বাড়ি গুলি থেকে গভীর রাতে ভেসে আসা অর্থপূর্ণ বা প্রগলভ আওয়াজ থেকে যেন চিনে নিতে হয় ঘটনাপ্রবাহ। সকাল রাতের কথা বলে – জল কিছু মনে রাখতে পারে না, জল কিছু ধরে রাখতেও পারে না – জল নিজে কোথাও কোথাও আটকে থেকে সবুজ করে তোলে নিজেকে – আমরা সবাই সেই জল এরিয়ে চলি। এ গল্প বহতা জলের গল্প – গল্পের রাত শেষ হলে, রাতের গল্প জল স্বাভাবিক নিয়মেই সরিয়ে রেখে সকালের জন্য প্রস্তুত করে নিজেকে –

    আমি তা বুঝতে পারি – গতরাতের জলের গল্প লেগে আছে পর্দা সরানো বিছানায়। ওরা হয়ত নিজেদের গল্প শোনাতে চেয়েছিল জলের পাশের রাস্তাকে, পথ ভুল করে ম্যাপ হাতে ঘুরে বেড়ানো টুরিষ্টকে – বা হয়ত একজন বলেছিল এসো না মোমত্বক দিয়ে শুষে নিই কালো কারুকাজ থামের উপর রাখা ক্লান্ত বাতির আলো। আমি জানি না কোন সম্ভবনাটি সত্যি - গ্রীষ্মের সকাল হয়ত সত্যিই ডেকে এনেছিল প্রগাঢ় নির্লিপ্ততা – হয়ত পর্যবেক্ষকের চোখ দিয়ে দেহকে দেখার কথা বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে ভেবেই দেখেনি কেউ! কারো কাছে গল্প গ্লানির হলেও, অনেকের কাছে তা আবেশের, লেপ্টে থাকার – চিহ্ন ছড়িয়ে দেখার। আমি রাতের আবেগের সাথে দিনের অফিসকে আলাদা করে নেবার প্রচেষ্টার কথা ভাবি – আবেশী চোখ নিয়েই কি এরা অফিস যায়? নাকি এদের চোখ কিছু বলে না আলাদা করে, মৌনতা দিয়েই প্রকাশ করা যায় যেটুকু দরকার। কোঁকরানো চুলের মুখে কি আবেশ লেগে আছে? আমি তাকিয়ে আছি – আর দেখছি কোঁকড়ানো চুল ট্রাফিক আটকে দিয়েছে। আচ্ছা গাড়ির কাঁচের ওপাশে কি কারো নষ্টালজিক হবার প্রচেষ্টা নেই?

    “আজ বড়ই গ্রীষ্ম পড়েছে
    আজ হলুদ গেঞ্জী উপুড় হয়ে রোদ শুষে নিতে ভালোবাসে
    আজ থেকেই সবুজ ঘাস ফিকে হতে হতে
    অনবরত মনে রাখে এখানেই হলুদ গেঞ্জী
    তখনো রোদ তখনো হলুদ

    পরিবর্তনকল্পে সমস্ত মায়াবী ফানুস রঙীন দ্বিচারিতায়
    হলুদ শুষে লয়ে যে অভিব্যক্তিজনিত শামুকখোল ফুটায়ে তোলে
    কোন এক অমলিন প্রভাতে তাহারেই আলোকদুর্বলতা ভাবিয়া
    আগত গ্রীষ্মের স্বপ্ন দ্যাখে ফানুস অর্জনকারী হলুদ গেঞ্জীর দল
    এবং ফিকে ঘাসে নজর আনা শুরু করে

    তারে কি বলিবে বলো কুসুমকলি তোমার গায়ে রৌদ্রের রঙ খয়েরী”।

    সামনের বাড়ির মেয়েটি মনে হয় নষ্টালজিক হতে ভালোবসত – অন্তত তিনমাস আগে বিয়ে হবার আগে পর্যন্ত। আমি ওকে ছাদের উপরে হলুদ গেঞ্জি পরে রোদ শুষে নিতে দেখতাম – আবার গেঞ্জি না পরেও। ছাদের কার্ণিশে দুই কুনুইয়ে ভর দিয়ে নিচের রাস্তায় সাইকেলের সাথে কথা বলছে, আর আমি দেখছি রৌদ্রের রং খয়েরী হয়ে ঢেউ খেলে নীচে নেমে গেছে। আমি ডাচ ভাষায় কুসুমকলির প্রতিশব্দ খুঁজতে খুঁজতে নষ্টালজিক হয়ে পড়তাম – ভাবতাম যে এই শহরে হয়ত আমি মানান সই হয়ে উঠছি – পাশের ছাদ, সর্ষের তেলে, কৈশোর কেমন যেন সব মিলে মিশে যাচ্চিল।

    গত তিনমাস ধরে মেয়ে আর ছাদে রোদ শুষে নেয় না – এখন তারা দুই জন হলুদ সাইকেলের সামনে কাঠের বাক্স বসিয়ে বিকেলের রোদে ‘ওয়েষ্টার পার্কে’ যায় – হলুদ চাদর ছড়িয়ে ঘাসের আগা থেকে দুজনায় মাখিয়ে নেয় যা কিছু লেগে থাকা রোদ। মেয়েটির গল্প আমার ব্রেন থেকে গুটিয়ে আসছিল – তাদের পাঁচতলার ফ্ল্যাট আর ওয়েষ্টার পার্ক আমাকে স্থিতিশীলতার আশ্রয় দিচ্ছিল, আমাকে আমার খুঁজে পাওয়া শহরের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু তাদেরই ঠিক নীচের তলার ফ্ল্যাট আমাকে আবার বেমানান ভাবনার দিকে ঠেলে দিল – চার তলার ছেলেটিকে তার ছেলে বন্ধুর সাথে একসঙ্গে বিছানা থেকে উঠে জামা কাপড় পড়ে নিতে দেখে। আমার শহরে এমন কোন গল্পের কথা আমি ভেবে দেখি নি – অথচ স্বাভাবিক – আমার নষ্টালজিয়া নোট করে - রোদের রং তখনো হলুদ।

    “ফুলওয়ালার ভ্যান গাড়ি তখনো পার্কিং-এ নেই
    ওর মালকিন যে সিগারেট খায়
    পাপড়িতে তার ছোঁয়া বুঝে নিতে
    শনিবার সকালে ফুলের দোকান ভালোবাসি
    যেখানে আমার একটা প্রিয় গান সবুজ বৃন্তোপরে জড়ানো

    লাইনে দাঁড়ানো ছায়াহীন ঘুম চোখ জানে না
    আমার প্রাথমিক রঙের ফুলদানির সংখ্যা সীমিত
    তাই সতর্পণে জরিপ করে নেয়
    কাগজে জড়ানো কিছু লতানো বিন্যাস

    অন্ধকার কেবলই গতানুগতিক বিশ্রাম মাত্র
    ভোরের বেলা তাই সে ফুলের কাছে -
    কানের ভিতর প্রিয় গান
    নিয়তই চেনা হাসি দ্যাখে সর্পিলতায়

    কাঠের টেবিলে কুকুরটার আবিষ্ট ঠোঁট
    কোনদিনই মিথ্যা কুশল জিজ্ঞাসা করে না

    আমার প্রিয় গানে অন্য কুকুরগুলি
    সকালেই হেঁটে যায়”।

    প্রিয় গান ভাবতে ভাবতে আমি নীচে নেমে আসি – প্রিয় গানের সাথে প্রিয় শহরের একটা সম্পর্ক তৈরী করাই যায়, অন্ততঃ তেমনটাই হওয়া উচিত। প্রিয় গানের সাথে আমি শহর মিলিয়ে নিই – আসলে প্রিয় গান তো আর একটা নয়! অনুক্ষণ মনে হয় এমন গান যদি এমন ভাবে এই শহরে নেমে আসত, তাহলে কি আমার নষ্টালজিয়ার সমস্যা সমাধানে সুবিধা হত? ডাচেরা তো ফুল ভালোবাসে – এই নিয়ে আমি মাঝে মাঝে আদিখ্যেতাও করি – যেন মনে হয় আমাদের নরম-সরম রোমান্টিকতার সাথে চট করে মিশিয়ে দেবার জন্যই এই আয়োজন। কিন্তু শরীর তো আর এক নয় – ফুলওয়ালিও নয় তেমন একধরণের। আমার গানের ফুলওয়ালি কার-পার্কিং এ দাঁড়িয়ে সিগারেট খায় না। একদিকে না-মেলা ফুলের মালকিন ও অন্যদিকে মিলে-যাওয়া ফুলের স্তবক আমার দোটানাকে বাড়িয়ে দেয়। কোন শহর তাহলে আমার? আমার নষ্টালজিয়ার রাত গতানুগতিক – আমার নিজের শহরের রাত আবেশী হোক এমনটাই ভাবতে ভালোবাসি। রাত আর অন্ধকারের সম্পর্ক নিয়ে নাড়াচাড়া করি – গভীরে ঢোকার চেষ্টা করে দেখি পশুদের কাছে অন্ধকার প্রায়শঃই গতানুগতিক বিশ্রাম মাত্র, আমাদের অনেকের কাছে নয়। কুকুরের সাথে মানুষের সম্পর্ক ভাবি - অন্ধকার বিষয়ক প্রিয় গান ভাবা জরুরী মনে হয়ে আসে নিজের শহরকে খুঁজে পেতে গেলে –

    [ক্রমশঃ]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ আগস্ট ২০১৬ | ৬৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শঙ্খ | 113.242.197.33 (*) | ১৫ আগস্ট ২০১৬ ০৭:২৯55504
  • পড়ছি
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 (*) | ১৫ আগস্ট ২০১৬ ০৭:৪১55505
  • এ এক অন্য সুকিকে দেখতে পাচ্ছি। চলুক।
  • san | 113.245.14.101 (*) | ১৫ আগস্ট ২০১৬ ০৮:২০55506
  • খুব ভাল লাগছে।
  • | 213.132.214.83 (*) | ১৬ আগস্ট ২০১৬ ১২:০৯55507
  • খুব ভালো লাগছে সুকান্ত।
  • pi | 192.66.17.7 (*) | ২০ আগস্ট ২০১৬ ০২:৫২55510
  • ভাল লাগছে , চলুক ..
  • সুকি | 129.160.188.96 (*) | ২০ আগস্ট ২০১৬ ০৯:০৭55508
  • সরি মাঝে আসা হয় নি -

    আপনাদের অনেক ধন্যবাদ লেখা পড়ার জন্য -
  • b | 24.139.196.6 (*) | ২০ আগস্ট ২০১৬ ১০:০৩55509
  • আরো হোক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন