এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রাগ দরবারী (হিন্দি থেকে অনুবাদ)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২২ জুন ২০১৬ | ২৪৮৮ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • রাগ দরবারী
    ==============
    শ্রীলাল শুক্লা

    [ কিছুদিন আগে গত হয়েছেন হিন্দি সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক শ্রীলাল শুক্লা। তীক্ষ্ণ ব্যংগাত্মক দৃষ্টি আর সুগভীর জীবনবোধ তাঁর উপন্যাসগুলোয় আলাদা স্বাদ এনেছে। স্বাধীনতাপরবর্তী উত্তরভারতে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তাঁর রচনার বিষয়। তাঁর চলার পথ আলাদা। চাবুক চালিয়েছেন কিন্তু মুখে লেগে আছে হাসিটি। ১৯৬৮তে প্রকাশিত তাঁর "রাগ দরবারী" উপন্যাসটি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত। ১৯৯১ এর মধ্যেই দশম সংস্করণ জনপ্রিয়তার বিরল উদাহরণ।
    পাঠক অনুভব করবেন প্রথম বা দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ হতে না হতেই শিবপালগঞ্জ নামক গ্রামটি গো-বলয়ের সমগ্র গ্রামজীবনের প্রতিভু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার আধখেঁচড়া অনুবাদে যদি কোন পাঠকের মনে মূল হিন্দি বইটি পড়বার আগ্রহ জাগে তাহলেই আমার শ্রম সার্থক।]

    অধ্যায়-১
    ----------
    শহরের সীমানা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই গ্রাম-ভারতের মহাসাগরের ঢেউ।
    ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ট্রাক। দেখলেই মনে হয় যে শুধু সড়কের সাথে বলাৎকার করার জন্যেই এর জন্ম। সত্যের যেমন নানা রং,এই ট্রাকেরও তেমনি। ওদিক থেকে দেখলে পুলিসের মনে হবে যে ওটা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আবার এদিক থেকে দেখলে ড্রাইভার ভাববে যে ও তো রাস্তার একপাশে দাঁড় করানো রয়েছে। চালু ফ্যাশনের হিসেবে ড্রাইভার ওর ডানদিকের দরজাটা খুলে ডানার মত ছড়িয়ে রেখেছে। এতে ট্রাকের সৌন্দর্য নিঃসন্দেহ বেড়ে গে্ছে, আর ওর পাশ কাটিয়ে কোন গাড়ি যে এগিয়ে যাবে তার ভয় ও এড়ানো গেছে।
    রাস্তার এক দিকে পেট্রল পাম্প, উল্টো দিকে খাপরা কাঠ আর টিনের পচে যাওয়া টুকরোটাকরা নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী তৈরি কিছু দোকানের চালাঘর। একবার চোখ বোলালেই বোঝা যায় যে এগুলোকে দোকানের মধ্যে গন্য করা মুশকিল। সবগুলোতে জনগণের প্রিয় একটি পানীয় পাওয়া যায়-- যা কিনা ময়লা কালো চা বানাতে বার কয়েক ব্যবহৃত পাতা আর গরম জলের মিশ্রণ মাত্র। এর মধ্যে বারকোশে কিছু মেঠাই আপনার চোখে পড়বে যেগুলো রাত-দিন ঝড়-ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাত ও মশা-মাছির হামলার বাহাদুরের মত মোকাবিলা করে টিঁকে আছে। এগুলো আমাদের দেশি কারিগরের হস্তশিল্প ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির নমুনা বটে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে যদিও আমরা এখনো ভালো ব্লেড বানাতে পারিনি কিন্তু আবর্জনাকে সুস্বাদু খাদ্য পদার্থে পরিবর্তিত করার দক্ষতা গোটা দুনিয়ায় শুধু আমাদেরই আয়ত্ত্বে।
    ট্রাকের ড্রাইভার ও ক্লিনার একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল।
    রঙ্গনাথ দূর থেকে ট্রাকটাকে দেখতে পেয়ে জোরে পা চালাতে লাগল। আজ রেলওয়ে ওকে ধোঁকা দিয়েছে। লোক্যাল প্যাসেঞ্জার ট্রেনটাকে ও রোজকার মত দু'ঘন্টা লেট ধরে নিয়ে ঘর থেকে রওনা দিয়েছিল। গিয়ে দেখল সে ব্যাটা আজ মাত্তর দেড় ঘন্টা লেট। নালিশ-বইয়ের কথাসাহিত্যে নিজস্ব যোগদান করে আর রেলওয়ের অফিসারদের চোখে বোকা সেজে ও স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসেছিল। রাস্তায় চলতে চলতে ট্রাক দেখতে পেয়ে ওর মন- সেটা শরীরের যে জায়গাতেই থাকুক না- নেচে উঠল।
    ট্রাকের কাছে পৌঁছে গিয়ে দেখল ড্রাইভার ও ক্লিনার চায়ের শেষ চুস্কি-চুমুক নিচ্ছে। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের খুশি ঢেকে ড্রাইভারকে একটু নির্বিকার ভাবে জিগাইল,--কি গো ড্রাইভার সাহেব, ট্রাক শিবপালগঞ্জের দিকে যাবে?
    ড্রাইভার খাচ্ছিল চা আর দেখছিল চা-ওয়ালিকে; দায়সারা জবাব দিল--যাবে।
    " আমাকে সঙ্গে নেবেন? পনের মাইলের মাথায় নেমে যাবো। শিবপালগঞ্জ পর্য্যন্ত ।"
    ড্রাইভার এতক্ষণে চা-ওয়ালির মধ্যে নিহিত সমস্ত সম্ভাবনাকে জরিপ করে নিয়েছে। এবার চোখ ফিরেছে রঙ্গনাথের দিকে। আহা! চেহারা বটে! নব্কঞ্জলোচন-কঞ্জমুখকর-কঞ্জপদ-কঞ্জারুণম্! মাথায় খদ্দরের টুপি, গায়ে খদ্দরের খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবী। কাঁধে ঝুলছে বিনোবা ভাবের ভূদানী-ঝোলা। হাতে চামড়ার অ্যাটাচি। ড্রাইভার ওর দিকে অবাক হয়ে দেখতেই থাকল। তারপর কিছু ভেবে বলল-- বসুন শিরিমানজী, এক্ষুণি রওনা দেব।

    ঘরঘরিয়ে চলছে ট্রাক। শহরের আঁকাবাঁকা মোড়ের প্যাঁচ থেকে ফুরসত পেয়ে একটু এগোতেই অনেক দূর পর্য্যন্ত জনহীন পরিষ্কার রাস্তা। ড্রাইভার প্রথমবার টপ গিয়ার লাগালো, কিন্তু সেটা পিছলে পিছলে নিউট্রাল হতে শুরু করল। প্রতি একশ'গজ চলতেই গিয়ার পিছলে যায় আর অ্যাকসিলারেটরে চাপ থাকায় গাড়ির ঘর-ঘর আরো বাড়ে।
    রঙ্গনাথ বলল," ড্রাইভার সাহেব, তোমার গিয়ার তো একদম দেশের সরকারের মত"।
    ড্রাইভার মুচকি হেসে এই সার্টিফিকেট গ্রহণ করল। রঙ্গনাথ ভাবল যে নিজের বক্তব্যটি আরো একটু স্পষ্ট করে দেয়। --" ওকে যতই টপে চড়াও না কেন, দু'গজ যেতে না যেতেই পিছলে ঠিক নিজের পুরনো খাঁচায় ফিরে আসে।"
    ড্রাইভার হেসে উঠলো " অনেক বড় কথা বলে দিলেন শিরিমানজী।"
    এইবার ও গিয়ার কে টপে নিয়ে নিজের এক পা' প্রায় নব্বই ডিগ্রি কোণে বেঁকিয়ে গিয়ারের জঙ্ঘার নীচে চেপে দিল। রঙ্গনাথ ভাবল যে বলে- দেশ শাসনের স্টাইলও এমনিই হয়। কিন্তু কথাটা বড্ড বেশি বড় হয়ে যাবে ভেবে চুপ করে রইল।

    ইতিমধ্যে ড্রাইভার নিজের ঠ্যাংখানা গিয়ারের জঙ্ঘার থেকে সরিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।আর গিয়ারের ওপর একটা কাঠের লম্বা টুকরো গুঁজে দিয়ে ওর আর এক মাথা প্যানেলের নীচে ঠুকে দিয়েছে।
    ট্রাক দৌড়ুচ্ছে ভীমবেগে। ওটাকে দেখামাত্র সাইকেল-আরোহী, পথচারী, এক্কাগাড়ি সবাই ভয়ের চোটে অনেক দূর থেকেই রাস্তা ছেড়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। ওদের পালানোর স্পীড দেখে মনে হচ্ছে যে ওটা ট্রাক নয়, কোন দাবানল, বঙ্গোপসাগরের ঘুর্ণিঝড়, অথবা পিন্ডারি দস্যুদলের হামলা।
    রঙ্গনাথ ভাবছিল যে অনেক আগেই হাঁকা পাড়া উচিৎ ছিল---শোনো গ্রামবাসী ,শোনো! নিজেদের পশু ও বাচ্চাদের ঘরের ভেতর আটকে রাখো। শহর থেকে এক্ষুনি একটা ট্রাক বেরিয়েছে।
    এবার ড্রাইভার বলল, " বলুন শিরিমানজী! কী খবর? অনেক দিন পরে গাঁয়ের দিকে যাচ্ছেন।"
    রঙ্গনাথ শিষ্টালাপের জবাবে একটু মুচকি হাসলো। ড্রাইভার বললো," শিরিমানজী, আজকাল কি করছেন?"
    --"ঘাস কাটছি।"
    ড্রাইভার হেসে ফেললো। কপাল খারাপ, একটা ন্যাংটো-পুঁটো বাচ্চা ট্রাকের নীচে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল আর পাশের নয়ানজুলিতে টিকটিকির মত আছড়ে পড়ল। ড্রাইভার অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়িয়ে দাঁত বের করে বলল," কি কথাই বল্লেন! একটু খুলে বলুন।"
    --" বল্লুম তো, ঘাস কাটছি। একেই ইংরিজিতে রিসার্চ করা বলে। গত বছর এম এ পাশ করেছি, এবছর রিসার্চ শুরু করেছি।"
    ড্রাইভার যেন ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্প শুনছে। মুচকি হেসে বললো," তো শিবপালগঞ্জে কি করতে যাচ্ছেন?"
    -" ওখানে আমার মামা থাকেন। অসুখে পড়েছিলাম। কিছুদিন গাঁয়ে থেকে শরীর ভাল করে আসব।"
    এবার ড্রাইভার অনেকক্ষণ হাসতে থাকলো," কি যে গল্পো বানিয়েছেন শিরিমানজী?"
    রঙ্গনাথ ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো," এর মধ্যে গল্প বানানোর কি হল?"
    ড্রাইভার ওর সারল্যে হাসতে হাসতে বিষম খেল। " কি যে বলেন! আচ্ছা, কাটিয়ে দিন ওসব। বলুন, মিত্তাল সাহেবের কি অবস্থা? ওই পুলিশের গারদে খুনের ব্যাপারটা কদ্দূর?"
    রঙ্গনাথের রক্ত শুকিয়ে গেছে। শুকনো গলায় বললো," আরে, আমি কি জানি এই মিত্তাল কে?"
    ড্রাইভারের হাসিতে ব্রেক লেগে গেছে। ট্রাকের গতি কিছু কমেছে। রঙ্গনাথের দিকে কড়া করে তাকিয়ে ও জিগ্যেস করলো," আপনি মিত্তাল সাহেবকে চেনেন না?"
    -" না তো।"
    --" আর জৈন সাহেবকে?"
    --" একদম না।"
    ড্রাইভার এবার ট্রাকের জানলা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলে সাদা গলায় বলল," আপনি সি আই ডি বিভাগে কাজ করেন না?"
    রঙ্গনাথ এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল," সি আই ডি? সেটা কি জিনিস? খায় না মাথায় দেয়?"

    ড্রাইভার বেশ জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। ক'টা গরুর গাড়ি যাচ্ছে। একটি জনপ্রিয় থিয়োরি হল যখ্ন যেখানে জায়গা পাবে, ঠ্যাং লম্বা করে দখল নেবে। গাড়োয়ানের দল ওই থিয়োরি মেনে গরুর গাড়ির ওপর মুখ ঢেকে পা লম্বা করে শুয়ে আছে। গরুগুলো নেহাৎ অভ্যেসবশে গাড়িগুলোকে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়েও 'জনগণ-জনার্দন' মার্কা ডায়লগ আছে, কিন্তু রঙ্গনাথের মুখ খোলার সাহস হল না। সি আই ডিওলা কথায় ওর মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। ড্রাইভার প্রথমে রবারের হর্ন বাজালো। তারপর এমন একটা হর্ন বাজালো যা সঙ্গীতের আরোহ-অবরোহ সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বড় ভয়াবহ। কিন্তু গরুর গাড়ি আপন মনে আগের মতই যাচ্ছিল। ড্রাইভার বেশ স্পীডে ট্রাক চালাচ্ছিল, ভাবখানা যেন গাড়িগুলোর ওপর দিয়ে পার করবে। হটাৎ ওর আক্কেল হল যে ও ট্রাক চালাচ্ছে, হেলিকপ্টার নয়। তাই আচমকা ব্রেক কষলো, প্যানেলে ঠুঁসে রাখা কাঠের টুকরোটাকে ফেলে দিয়ে গিয়ার বদলে গরুর গাড়িগুলোকে প্রায় ছুঁয়ে দিয়ে আগে বেরিয়ে গেল। এবার ও ঘেন্নার চোখে রঙ্গনাথের দিকে তাকিয়ে বলল," সি আই ডি না হলে অমন খাদির কাপড় কেন পরেছ?"
    এই আচমকা আক্রমণে রঙ্গনাথ হড়বড়িয়ে গেল। কিন্তু এটাকে সামান্য কথাবার্তা ভেবে সহজভাবে বলল," খদ্দর তো আজকাল সবাই পরে।"
    --"দূর! কোন ঢঙের লোক এইসব পরে নাকি?" তারপর ও আবার জানলা দিয়ে থুতু ফেলে টপ গিয়ারে গাড়ি চালাতে লাগল।
    রঙ্গনাথের পার্সনালিটি কাল্ট শেষ হয়ে গেছল। খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ও ঠোঁট গোল করে সিটি বাজাতে লাগল। ড্রাইভার ওকে কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে বললো-- দেখো জী! চুপচাপ বসে থাকো, এটা সংকীর্তনের জায়গা নয়।"
    রঙ্গনাথ চুপ করল। তখন ড্রাইভার বিরক্তির সঙ্গে বলল," এই গিয়ার হতচ্ছাড়া বারবার পিছলে গিয়ে নিউট্রাল হয়ে যাচ্ছে। দেখছ কি? একটু ধরে থাক না!"
    পরে আবার চটে গিয়ে বলল, " আরে অমনি করে নয়, এমনি করে! ভালকরে চেপে ধরে বসে থাকো।"
    ট্রাকের পেছন থেকে বার বার হর্নের আওয়াজ ভেসে আসছে। রঙ্গনাথ শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু ড্রাইভার না শোনার ভান করছিল। এমন সময় ক্লীনার ঝুলতে ঝুলতে এসে ড্রাইভারের কানের পাশের জানলায় খট খট করতে লাগল। ট্রাকওয়ালাদের ভাষায় এই কোডের নিশ্চিত কোন গূঢ় ভয়ংকর মানে আছে। কারণ, ড্রাইভার তক্ষুণি স্পীড কম করে ট্রাককে বাঁদিকের একটি লেনে চালান করে দিল।
    হর্নের আওয়াজ এমন একটি স্টেশন-ওয়াগন থেকে আসছিল যেগুলো আজকাল বিদেশের আশীর্বাদে শ'য়ে শ'য়ে আমাদের দেশের প্রগতির জন্যে আমদানি হচ্ছে। স্টেশন-ওয়াগনটি ডানদিক দিয়ে এগিয়ে গিয়ে স্লো হয়ে একপাশে থামছিল। ওর থেকে বেরিয়ে আসা একটি খাকি হাত ট্রাককে থামতে ইশারা করল। এবার দুটো গাড়িই থেমে গেল।
    স্টেশন-ওয়াগন থেকে নামল একজন অফিসারের মত দেখতে চাপরাশি আর চাপরাশির মত দেখতে এক অফিসার। খাকি পোশাকে গোটা দুই সেপাই ও নেমে পড়েছে। দলটা এসেই পিন্ডারী-দস্যুদের মত লুটপাট শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেড়ে নিয়েছে ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স, তো কেউ নিয়েছে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্ড।কেউ ব্যাক-ভিউ মিররের নড়া ধরে নেড়ে দেখছে , তো কেউ ট্রাকের হর্ন বাজিয়ে দেখছে। তারপর এরা ব্রেক দেখল, ফুটবোর্ড নাড়িয়ে দেখল, লাইট জ্বালালো, ব্যাক করার সময় যে ঘন্টি বাজে তাও বাজালো। ওরা যা নেড়েচেড়ে দেখল তাই খারাপ। যেটাকে ছুঁলো সেটাই বিগড়ে গেল। এই ভাবে চারজনের দলটি চারমিনিটে প্রায় চল্লিশটি দোষ খুঁজে বের করল। তারপর একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ডিবেট শুরু করল যে এই শত্রুর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিৎ?
    রঙ্গনাথ বুঝে গেল যে এই দুনিয়ায় কর্মফলের সিদ্ধান্ত, 'পোয়েটিক জাস্টিস' আদি গল্প--সব সত্যি। এখন ট্রাকের চেকিং হচ্ছে -মানে ওকে অপমান করার জন্যে ভগবান ড্রাইভারকে শাস্তি দিচ্ছে, হাতে হাতে । ও নিজের সীটে বসেছিল। এক ফাঁকে ড্রাইভার ওকে বললো--"শিরিমানজী, একটু নীচে নেমে আসুন। এখন আর গিয়ার ধরে বসে থেকে কি লাভ?"
    রঙ্গনাথ নীচে নেমে অন্য একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। ওদিকে ড্রাইভার আর চেকিং স্কোয়াড ট্রাকের এক-একটা পার্টস্‌ নিয়ে তর্ক জুড়েছে। দেখতে দেখতে তর্ক ট্রাক ছেড়ে দেশের পরিস্থিতি ও আর্থিক দুরবস্থা পর্য্যন্ত পৌঁছে গেল। আর একটু পরেই ওখানে উপস্থিত জনগণের মধ্যে ছোট ছোট সাব-কমিটি তৈরি হয়ে গেল। তারা আলাদা আলাদা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে এক একটি বিষয় নিয়ে এক্স্পার্ট ওপিনিয়ন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনেক তর্ক-বিতর্কের পরে সবাই মিলে একটি গাছের নীচে ওপেন সেশন শুরু করে দিল। আর একটু পরে বোঝা গেল সবার দম ফুরিয়ে এসেছে, সেমিনার সমাপ্ত প্রায়।
    সব শেষে রঙ্গনাথের কানে এল অফিসারের মিনমিনে কন্ঠস্বরঃ
    -- কি গো মিয়াঁ আশরফ, কি ভাবছ? ছেড়েই দিই?
    চাপরাশি বলল,-- আর কি করবেন হুজুর! কহাঁ তক চালান-টালান বানাতে থাকবেন? এক-আধটা ভুলচুক হলে না হয় চালান করতেন?
    এক সেপাই বলল,-- চার্জশীট ভরতে ভরতে রাত কাবার হয়ে যাবে।
    কিছু আশকথা-পাশকথার পর অফিসারটি বলল,--- যা ব্যাটা বন্টা সিং, তোকে এবার মাপ করে দিলাম।
    ড্রাইভার খোশামুদে স্বরে বললো-- এটা শুধু শিরিমানজী বলেই করতে পারলেন।
    অফিসার অনেকক্ষণ ধরে দূরে একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গনাথকে দেখছিলেন। কাছে এসে বল্লেন," আপনিও এই ট্রাকে চড়ে যাত্রা করছেন?"
    --আজ্ঞে হ্যাঁ।
    --- কোন ভাড়া-টাড়া দেন নি তো?
    -- আজ্ঞে না।
    - - সে আপনার পোশাক দেখেই বুঝেছি। তবু জিগ্যেস করা আমার কর্তব্য।
    রঙ্গনাথ ওকে একটু খ্যাপাবার জন্যে বলল,-- এটা আসল খদ্দর ভেবেছেন নাকি? এতো মিলে তৈরি খাদি।
    কিন্তু অফিসারটি বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, " খাদি খাদিই হয়, তার আর আসল-নকল!
    অফিসার চলে যেতেই চাপরাশি আর ড্রাইভার রঙ্গনাথের কাছে এল। ড্রাইভার বলল, "দুটো টাকা বের কর দিকি!"
    ও মুখ ঘুরিয়ে কড়া সুরে বলল," ব্যাপারটা কি? আমি কেন টাকা দিতে যাব?"
    ড্রাইভার তখন চাপরাশির হাত ধরে বলল," আসুন শিরিমানজি, আমার সঙ্গে এদিকে আসুন।" যেতে যেতে ও রঙ্গনাথকে শুনিয়ে দিল," তোমার জন্যেই আমার চেকিং হল, আর আমার বিপদের সময় তুমিই এমন ব্যভার করলে? এই লেখাপড়া শিখেছ?"
    বর্তমান শিক্ষা-পদ্ধতি হল রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরের মত, যার ইচ্ছে দুটো লাথি মেরে যাবে। ড্রাইভারও যেতে যেতে ওর ওপর দুটো ডায়লগ ঝেড়ে চাপরাশির সঙ্গে ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল।
    রঙ্গনাথ দেখল--- সন্ধ্যে নেমে আসছে, ওর অ্যাটাচি ট্রাকে তোলা রয়েছে, শিবপালগঞ্জ এখনো মাইল পাঁচেক হবে, ফলে ওর এখন মানুষের সহানুভূতির একান্ত দরকার। ও ধীরে ধীরে ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল। এদিকে স্টেশন-ওয়াগনের ড্রাইভার বার বার হর্ন বাজিয়ে চাপরাশিকে তাড়া দিচ্ছে। রঙ্গনাথ ড্রাইভারকে দুটো টাকা দিতে চাইল। ও বলল," যদি দেবেই তো আর্দালি সাহেবকে দাও। আমি তোমার টাকা নিয়ে কি করব?"
    বলতে বলতে ওর গলার স্বরে সেই সব সন্ন্যাসীর প্রত্যয় এসে গেল, যাঁরা কারো পয়সা নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখেন না, শুধু অন্যদের বলতে থাকেন- আরে, তোমার পয়সা তো হাতের ময়লা মাত্র। চাপরাশি টাকা ট্যাঁকে গুঁজে বিড়ির সুখটান দিয়ে ওটার আধজ্বলা টুকরোটা প্রায় রঙ্গনাথের পাজামার ওপর ছুঁড়ে ফেলে সটান স্টেশন-ওয়াগনের দিকে চলে গেল। ওরা রওনা হয়ে গেলে ড্রাইভারও স্টার্ট দিল আর আগের মত টপ গিয়ারে গিয়ে রঙ্গনাথের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর কী জানি কী ভেবে মুখ ছুঁচলো করে শিস দিয়ে সিনেমার গানের সুর ভাঁজতে লাগল। রঙ্গনাথ চুপচাপ শুনছিল।

    রাস্তার দুপাশে ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্টতার মাঝে কিছু যেন কাপড়ের গাঁঠরি মতন দেখা যাচ্ছে। এরা হল গাঁয়ের মেয়েছেলের দল, লাইন বেঁধে রাস্তার দুপাশে বসে আছে। এরা নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বসে বাক্যালাপ চালিয়ে যাচ্ছে, হাওয়া খাচ্ছে আর হয়ে যায় তো মলমূত্র ত্যাগও করছে। রাস্তার নীচে নোংরা ছড়িয়ে আছে আর তার দুর্গন্ধের ভারে সন্ধ্যের হাওয়াও কোন গর্ভবতী নারীর মতন আলস্যভরা চালে বয়ে চলেছে। একটু দূর থেকে কুকুরের খ্যাঁক-খ্যাঁক শোনা যাচ্ছে। চোখের সামনে ধোঁয়ার একটি জাল ছড়িয়ে পড়ছে। কোন সন্দেহ নেই যে আমরা একটি গাঁয়ের সীমানায় এসে পড়েছি। হ্যাঁ, এটাই শিবপালগঞ্জ।

    -----------------------**********------------------------------------

    অধ্যায়-২
    ------------
    শিবপালগঞ্জ থানাতে একটি লোক দারোগাজীকে বলছে--- "আজ-কাল করতে করতে অনেক দিন গড়িয়ে গেছে হুজুর! আমার চালান পেশ করতে আর দেরি করবেন না।"
    এই আরামকেদারাটি বোধ্হয় মধ্যযুগীন কোন সিংহাসন ছিল, ঘষে ঘষে আজ এই হাল। দারোগাজী ওতে বসে ছিলেন, আবার শুয়েও ছিলেন। এমন কাতর আবেদন শুনে মাথা তুলে বললেন," চালানও হয়ে যাবে, তাড়া কিসের? কিসের বিপদ?"
    লোকটি আরামকেদারার পাশে পড়ে থাকা একটি প্রাগৈতিহাসিক মোড়ায় চেপে বসে বলতে লাগল," আমার জন্যে তো সমূহ বিপদ। আপনি আমায় চালান করে দিন, তো ঝঞ্ঝাট মিটে যায়।"
    দারোগাজী গুজগুজ করতে করতে কাউকে গালি দিতে লাগলেন। একটু পরে বোঝা গেল যে উনি বলছেন--- কাজের ঠ্যালায় চোখে অন্ধকার দেখছেন। এত কাজ যে অপরাধের তদন্ত হচ্ছে না, মামলার চালান পেশ হচ্ছে না, আদালতে সাক্ষী যাচ্ছে না। এত কাজের বোঝা যে একটা কাজও হচ্ছে না।
    মোড়া ঘষটে আরামাকেদারার গা ঘেঁষে এল। বলল, " হুজুর, শত্রুরা বলাবলি করছে যে শিবপালগঞ্জে দিনেদুপুরে জুয়োর আড্ডা বসছে। পুলিস কাপ্তেনের কাছে বেনামী চিঠি গেছে। আর আপনার সঙ্গে তো আমাদের সমঝোতা ছিলই যে বছরে একবার চালান করবেন। এই বছর চালান করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেধ্হে। এই সময় করে ফেলুন, তো লোকের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।"

    শুধু আরামকেদারা কেন, সবকিছুই যেন মধ্যযুগের। তক্তপোষটা, ওর ওপরে বিছিয়ে দেয়া ছেঁড়াখোড়া শতরঞ্জি, শুকনো খটখটে দোয়াত,কোনামোড়া আধময়লা রেজিস্টার --- সবগুলো যেন কয়েকশ' বছর আগের থেকে রাখা আছে।
    এখানে বসে চারদিকে চোখ ঘোরালেই মনে হবে যেন ইতিহাসের কোন কোণায় দাঁড়িয়ে আছি। এখনো এই থানায় ঝর্ণাকলমের আমদানি হয় নি, তবে খাগের কলম বিদায় নিয়েছে। টেলিফোন আসেনি। অস্ত্রশস্ত্র বলতে কিছু পুরনো রাইফেল, মনে হয় সিপাহীবিদ্রোহের সময় কব্জা করা। এমনিতে সেপাইদের জন্যে অনেকগুলো বাঁশের লাঠি আছে। কবি বলেছেন যে ওগুলো নদী-নালা পেরোতে বা খেঁকি কুকুর ঠ্যাঙাতে বেশ কাজে লাগবে।
    থানার জন্যে কোন জীপ-টিপ নেই। তবে বাহন হিসেবে জনাকয় চৌকিদারের আদরে টিঁকে থাকা ঘোড়া আছে। সে তো শেরশাহের আমলেও ছিল।
    আগেই বলেছি যে থানার ভেতর ঢুকলেই মনে হবে যেন হুড়মুড়িয়ে কয়েক্শ' বছর পেছনে এসে পড়েছি। আমেরিকান থ্রিলার পড়ার অভ্যেস থাকলে তো প্রথমেই মনে হবে কোথায় আঙুলের ছাপ দেখার আতসকাঁচ, কোথায় ক্যামেরা আর ওয়ারলেসওলা গাড়ি? তার জায়গায় যা যা আছে সেতো বলাই আছে।
    আরও আছে--- সামনে তেঁতুলগাছের নীচে বসে একটা আধন্যাংটো ল্যাংগোটপরা লোক, ভাঙ্গের শরব্ত বানাচ্ছে। একটু পরে জানতে পারা যাবে যে একা ওই একটা লোক বিশটা গ্রামের দেখাশুনোর জন্যে আছে। ও যেমন আছে তেমনি অবস্থায় ওখানে বসে বসেই বিশ গাঁয়ের ক্রাইম ঠেকাতে পারে, ঘটনা ঘটে গেলে তার খোঁজখবর করতে পারে, আর কিছু না ঘটলে কিছু করিয়ে দিতে পারে। আতসকাঁচ, ক্যামেরা,কুকুর, ওয়্যারলেস ওর জন্যে নিষিদ্ধ বস্তু। দেখলে কিন্তু থানার পরিবেশ বেশ রোম্যান্টিক আর অতীতদিনের গৌরব নিয়ে মজে থাকার অনুকূল। যেসব রোম্যান্টিক কবি হারিয়ে যাওয়া অতীতের কথা ভেবে ভেবে কষ্ট পান, তাঁদের এখানে কিছুদিন থাকতে বললে ভালো হয়।
    তবে জনগণের আশা-ভরসা বলতে থানার ওই দারোগাজী আর তার কুল্যে গোটা দশ-বারো সেপাই। থানাটির অধীনে প্রায় আড়াই থেকে তিনশ' গাঁ; তবু যদি আট মাইলের মধ্যে কোন গাঁয়ে সিঁধ পড়ে তবে জনতা আশা করবে যে এই সেপাইদের মধ্যে থেকে কেউ না কেউ নিঘ্ঘাৎ দেখে ফেলেছে। আর যদি মাঝরাতে বারো মাইলের মধ্যে ডাকাতি হয় তাহলে পুলিশ নিশ্চই ডাকাতদের আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে। এই বিশ্বাসের জন্যেই কোন গাঁয়ে একটা-দুটো বন্দুক ছাড়া কোন হাতিয়ার রাখতে দেয়া হয় নি।
    আর ভয় আছে যে গাঁয়ে হাতিয়ার রাখার অনুমতি দিলে ওখানের বর্বর-অসভ্য লোকজন হাতিয়ার চালানো শিখে নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা বাধাবে,খুনজখম শুরু হবে, রক্তের নদী বইবে। আর ডাকাতদের থেকে নাগরিকদের বাঁচানো? সেসব দারোগাজী আর তাঁর দশ-বারো সেপাইয়ের জাদুকরী-ক্ষমতার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
    এঁদের এই ম্যাজিক পাওয়ারের সবচেয়ে বড় প্রমাণ খুনের মামলায় দেখা গেছে। ফলে বিশ্বাস জন্মেছে যে তিনশ' গাঁয়ে কার মনে কার জন্যে ঘৃণা জন্মেছে, কার সঙ্গে কার শ্ত্রুতা, কে কাকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে চায়-- তার খুঁটিনাটি খবর আগে থেকেই এদের কাছে আছে। তাই এঁরা আগে থেকেই এমন চাল চালবেন যাতে কেউ কাউকে মারতে না পারে, আর মারলেও চটপট ধরা পড়ে যায়।
    কোথাও খুন হলে এঁরা হাওয়ার বেগে অকুস্থলে গিয়ে খুনীকে ধরে ফেলবেন, শবদেহ নিজেদের কাস্টডিতে নেবেন, রক্তে-ভেজা-মাটি হাঁড়িতে ভরে ফেলবেন আর প্রত্যক্ষদর্শীদের এমন দিব্যদৃষ্টি দেবেন যাতে তারা যেকোন আদালতে মহাভারতের সঞ্জয়ের মতন যা ঘটেছে তার হুবহু বর্ণনা করতে পারে।
    সংক্ষেপে বলতে গেলে দরোগাজী আর তার সেপাইরা মানুষ নয়, আলাদীনের প্রদীপ থেকে বেরিয়ে আসা দৈত্য। এদের এমনি বানিয়ে রেখে ইংরেজ ১৯৪৭ এ এদেশ ছেড়ে নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। তারপরে ধীরে ধীরে রহস্য ফাঁস হল যে এরা দৈত্য নয় মানুষ, আর এমনি মানুষ যারা নিজেরাই দৈত্য বেরিয়ে আসবে এই আশায় প্রদীপ ঘষেই যাচ্ছে।
    শিবপালগঞ্জের জুয়াড়ি কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বেরিয়ে গেলে দারোগাবাবু একবার চোখ তুলে চারদিক দেখে নিলেন। সর্বত্র শান্তি। তেঁতুলগাছের নীচে ভাঙ্গ ঘুটতে থাকা ল্যাংগোটছাপ সেপাইটা পাশে স্থাপিত শিবলিঙ্গের ওপর ভাঙ্গের সরবত ঢালছে, জনৈক চৌকিদার ঘোড়ার পাছায় দলাই-মলাই করছে, লক-আপের ভেতর এক ডাকাত জোরে জোরে হনুমান-চালিশা পড়ছে আর বাইরের ফটকে ডিউটিরত সেপাই- সম্ভবতঃ সারারাত্তির জেগে থাকার ফলে---একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে ঢুলছে।
    দারোগাবাবু একটা ছোট্ট ভাতঘুম মারবেন বলে খালি চোখ বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, দেখতে পেলেন রূপ্পনবাবু আসছে। উনি গজগজ করতে লাগলেন-- একটু যে চোখ বন্ধ করব তার জো নেই!
    রূপ্পনবাবু ঢুকতেই উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আর 'জনতার সঙ্গে ভদ্র-ব্যবহার সপ্তাহ' অনেক আগে চলে গেলেও উনি বেশ বিনম্র ভাবে হ্যান্ডশেক করলেন। রূপ্পনবাবু বসতে বসতেই শুরু করলেন, " রামাধীনের বাড়িতে লাল কালিতে লেখা চিঠি এসেছে। ডাকাতের দল পাঁচহাজার টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে। লিখেছে অমাবস্যার রাতে দক্ষিণের টিলার ওপরে--"।
    দারোগাবাবু মুচকি হেসে বললেন," এতো মশায় বড্ড বাড়াবাড়ি! কোথায় পুরনো দিনে ডাকাতেরা নদী-পাহাড় ডিঙিয়ে এসে টাকা নিয়ে যেত, আর এখন চায় কি ওদের ঘরে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হবে!"
    রূপ্পনবাবু বল্লেন," যা বলেছেন। যা দেখছি এত ডাকাতি না, ঘুষ চাওয়া।"
    দারোগাবাবু একসুরে বল্লেন, " ঘুষ, চুরি, ডাকাতি---আজকাল সব এক হয়ে গেছে। ---পুরো সাম্যবাদ।"
    রূপ্পনবাবু," আমার বাবাও তাই বলছিলেন।"
    --"কী বলছিলেন?"
    --" এই, সব সাম্যবাদ হয়ে যাচ্ছে।"
    দুজনেই হেসে উঠলেন।
    এবার রূপ্পন বললেন, " না, আমি ঠাট্টা করছি না। সত্যি সত্যি রামাধীনের ঘরে এমনি চিঠি এসেছে। বাবা আমাকে তাই পাঠালেন। উনি বলেছেন যে রামাধীন আমাদের বিরোধী হতে পারে, কিন্তু ওকে এমন করে বিরক্ত করা উচিৎ হবে না।"
    --" সুন্দর বলেছেন। বলুন, কাকে কাকে বলতে হবে,- বলে দেব।"
    রূপ্পনবাবু গর্তে ঢোকা চোখ কুঁচকে খানিকক্ষণ দারোগার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
    দারোগা চোখ নামান নি। হেসে বল্লেন," ঘাবড়াবেন না। আমি থাকতে ডাকাতি হবে না।"
    রূপ্পনবাবু আস্তে আস্তে বল্লেন, " তা জানি। চিঠিটা জাল। আপনার সেপাইদেরও একটু জিগ্যেস করে দেখবেন। হতে পারে ওদেরই কেউ লিখেছে।"
    " হতে পারে না। আমার সেপাইগুলোর মধ্যে কেউ লিখতে জানে না। এক-আধটা হয়তো খালি নাম সাইন করতে পারে।"
    রূপ্পন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ওনাকে থামিয়ে দিয়ে দারোগাবাবু বল্লেন," এত তাড়া কিসের? আগে রামাধীন এসে রিপোর্ট তো লেখাক। চিঠিটা তো সামনে আসুক।"

    খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। দারোগাবাবু যেন কি ভেবে বল্লেন," সত্যি বলতে কি আমার তো এর সাথে শিক্ষাবিভাগের কোন সম্পক্ক আছে বলে মনে হচ্ছে।"
    -" কি করে"?
    -" আরে শিক্ষাবিভাগ-টিভাগ মানে আপনার কলেজের কথাই বলছি।"
    এবার রূপ্পনবাবু রেগে গেলেন। " আপনি তো আমার কলেজের পেছনে আদাজল খেয়ে লেগেছেন।"
    --" সে যাই বলুন, আমার তো মনে হয় রামাধীনকে ওই ভয়-দেখানো চিঠিটি আপনার কলেজের কোন ছোকরার কীর্তি, আপনি কী বলেন?"
    --" আপনাদের চোখে তো সমস্ত ক্রাইম কেবল স্কুলের ছোকরাদের কীর্তি! আপনার সামনে কেউ বিষ খেয়ে মরে গেলেও সেটাকে আপনি আত্মহত্যা না বলে বলবেন যে বিষ-টিষ কোন স্কুলের ছোঁড়াই এনে দিয়েছে।"
    --" ঠিক বলেছেন রূপ্পনবাবু! দরকার পড়লে বলব বই কি! আপনি হয়ত জানেন না যে আমি বখ্তাবর সিং এর চ্যালা!"
    এরপর শুরু হল সরকারী চাকরি নিয়ে কথাবার্তা--- ঘুরে ফিরে একটাই গান যার ধূয়ো হল সরকারী কর্মচারি আগে কেমন ছিল আর আজকাল কেমন! শুরু হল বখ্তাবর সিং এর গল্প। এক বিকেলে দারোগা বখ্তাবর সিং একা একা বাড়ি ফিরছিলেন। পার্কের পাশে ওনাকে ঘিরে ধরল দুই খাঁটি বদমাশ---ঝগরু আর মঙ্গরু। তারপর দে দনাদন্।
    কথা চাপা রইল না, তখন উনি থানায় গিয়ে নিজের ঠ্যাঙানি খাওয়ার রিপোর্ট লিখিয়ে দিলেন।
    পরদিন দুটো বদমাশ এসে ওনার পা' জড়িয়ে ধরল। বল, " হুজুর আমাদের মা-বাপ! বাচ্চা যদি রাগের মাথায় মা-বাপের সঙ্গে বেয়াদপি করে বসে তখন তাকে মাপ করে দেয়াই দস্তুর।"
    বখতাবর মা-বাপের কর্তব্য করে ওদের মাপ করে দিলেন। ওরাও ছেলের কর্তব্য পালন করে ওনার বুড়োবয়সের খাওয়া-পরার ভালমত ব্যবস্থা করে দিল।মামলা ভালয় ভালয় মিটে গেল।

    কিন্তু পুলিস কাপ্তেন রেগে কাঁই, ইরেংজ যে!
    রেগেমেগে বখতাবর সিং কে বলল," টুমি শালা নিজের মামলাটারও ঠিক করে তদন্ত করতে পারলে না,টো অন্যদের কি বাঁচাবে? অন্ধকার ছিল তো কি? কাউকে চিনতে পারোনি? তাতে কি? টুমি কাউকেই চিনতে পারোনি, তো কী? কাউকে সন্দেহ তো করতে পারো! করলে ঠেকাচ্ছে কে?"
    তখন বখ্তাবর সিং তিনজনকে সন্দেহের বশে জেলে পুরলেন। তিনজনের সঙ্গেই ঝগরু- মঙ্গরু'র পুরুষানুক্রমে শত্রুতা। ওরা কেস খেল। মামলা চলল। ঝগরু-মঙ্গরু আদালতে বখতাবর সিংয়ের পক্ষে সাক্ষী দিল। কারণ ওরা দেখেছে! হ্যাঁ, ওরা দুজনেই নাকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে বাহ্য করতে পার্কে ঢুকেছিল। তিন ব্যাটারই জেল হল।
    ঝগরু-মঙ্গরুর দুশমনের গতি দেখে পাড়ার বেশ ক'টা ছোকরা রোজ এসে ধর্না দিতে লাগল--" হুজুর! মাই-বাপ! একবার আমাদেরও সুযোগ দিন। আপনাকে ভালো করে প্যঁদাবো। "
    কিন্তু বখ্তাবর সিংহ দেখলেন যে বুড়োবয়সের খাওয়াপরার জন্যে ঝগরু আর মঙ্গরুই যথেষ্ট। উনি আর ছেলেপুলের সংখ্যা বাড়াতে চাইলেন না।
    গল্পটা শুনে রূপ্পনবাবু খুব হাসলেন। দারোগাবাবু খুশি - একটা চুটকি গপ্পেই রূপ্পনবাবু কাত। আর দরকার নেই। বাকি চুটকিগুলো অন্য লিডারদের হাসাতে কাজে লাগবে। হাসি ফুরোলে রূপ্পন বল্লেন,-" তো আপনি সেই বখ্তাবর সিংয়ের চেলা?"
    --" ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। কিন্তু এখন তো আমরা জনগণের সেবক। আমাদের গরীবের দুঃখকষ্টের ভাগ নিতে হবে। নাগরিকদের ---"।
    রূপ্পন দারোগার হাতে খোঁচা মেরে বললেন," ওসব ছাড়ুন, এখানে শুধু আপনি আর আমি, আপনার বক্তিমে শুনবে কে?"
    কিন্তু দারোগা দমার পাত্র ন'ন। বলতে লাগলেন," বলছিলাম কি আজাদীর আগের যুগে বখ্তাবর সিংয়ের চেলা ছিলাম। এ যুগে আপনার পিতাশ্রীর চেলা হয়েছি।"
    রূপ্পনবাবু সৌজন্য দেখিয়ে জবাব দিলেন," এটা আপনার মহত্ব, নইলে আমার বাবা এমন কি তালেবর?"
    এবার উনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। রাস্তার দিকে চোখ যেতে বল্লেন," দেখুন তো,মনে হচ্ছে রামাধীন এদিকেই আসছে, আমি চলি। ওই ডাকাতির চিঠিটা একটু ভাল করে দেখে নেবেন কিন্তু।"

    রূপ্পনবাবুর বয়স আঠেরো। পড়ছেন ক্লাস টেন এ। পড়তে , বিশেষকরে ক্লাস টেন এ পড়তে উনি খুব ভালোবাসেন। তাই গত তিনবছর ধরে একই ক্লাসে রয়েছেন।
    উনি লোক্যাল নেতা। যাঁরা ভাবেন যে ইন্ডিয়াতে রাজনৈতিক নেতা হতে গেলে অনেক অভিজ্ঞতাও পাকাচুল হওয়া দরকার, তাঁরা একবার রূপ্পনবাবুকে দেখুন,--- ভুল ভেঙে যাবে।
    উনি নেতা, কারণ উনি সমদর্শী। সবাইকে একই চোখে দেখেন। এটাই ওনার ভিত। ওনার চোখে থানার ভেতরে দারোগা আর লক্‌ আপের ভেতর চোর-- দুইই সমান।
    একই ভাবে, পরীক্ষায় টুকতে গিয়ে ধরা পড়া ছাত্র আর কলেজের প্রিন্সিপাল-- ওনার চোখে এক। উনি সবাইকে দয়ার পাত্র ভাবেন। সবার কাজে লাগেন, সবাইকে কাজে লাগান।
    লোকের চোখে ওনার স্থান এমন উঁচুতে যে পুঁজিবাদের প্রতীক দোকানদার ওনাকে জিনিস বেচে না, সমর্পণ করে। তেমনি শোষিতের প্রতীক টাঙ্গাওলা ওনাকে গাঁ থেকে শহরে পৌঁছে দিয়ে ভাড়া চায় না, আশীর্বাদ চায়। ওনার রাজনীতির হাতেখড়ির জায়গা ও রঙ্গমঞ্চ হল ওখানকার কলেজ। সেখানে একশ ছাত্র ওনার আঙুলের টুসকিতে তিল কে তাল বানাতে পারে , আবার দরকার হলে সেই তালগাছে চড়তেও পারে।
    উনি রোগাপাতলা, লম্বা গলা, লম্বাটে হাত-পা। কিন্তু লোকে ওনার সঙ্গে সহজে লাগতে চায় না।
    জনগণের নেতা হতে গেলে একটু উল্টোপাল্টা পোষাক দরকার বলে উনি ধুতির সঙ্গে রঙিন বুশশার্ট পরে গলায় রেশমি রুমাল বেঁধে ঘুরে বেড়ান। ধুতির কোঁচাটি আবার গলায় জড়ানো। দেখতে উনি একটা মরুটে বাছুরের মত, কিন্তু ঠ্যাকার যেন সামনের দু'পা তুলে চিঁহি করা ঘোড়া।
    উনি জন্ম থেকেই জনগণের নেতা, কারন ওর বাপও তাই। ওর বাপের নাম বৈদ্যজী।
    ------------------------------*******------------------------------
    অধ্যায়-৩

    জেলা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ছেড়ে যাওয়া একটি ডাকবাংলা, তাতে গোটা দুই ছোটবড় কামরা। ওর পাশে গোটা তিন কাঁচা দেয়ালের মাথায় খাপরা লাগিয়ে তৈরি আস্তাবল।তার থেকে একটু দূরে পাকা ইঁটের দেয়ালের মাথায় টিন লাগিয়ে একটা দোকান-মতো। একপাশে রেল-ফটকের গুমটিঘরের মত কিছু। উল্টোদিকে একটা বড় বটগাছের নীচে শান-বাঁধানো কবরের মত। আস্তাবলের পাশে একটা নতুন ধরণের ঘর তোলা হয়েছে যার ওপর বড় বড় করে লিখে দেয়া--" সামুদায়িক মিলন কেন্দ্র, শিবপালগঞ্জ", অর্থাৎ কম্যুনিটি সেন্টার। এই বাড়িগুলোর পেছনদিকে তিন-চার একর পড়তি উষর জমি, তাতে দূব্বোঘাস লাগানো হয়েছে। কোথাও কোথাও ঘাস গজিয়ে উঠেছে।
    এইসব কাঁচাপাকা বাড়িঘর-আস্তাবল-গুমটিকে সম্মিলিত ভাবে বলা হয় " ছংগামল বিদ্যালয় ইন্টারমিডিয়েট কলেজ"।
    এখান থেকে যারা ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বেরোয় তারা বিল্ডিং এর তুলনা করে গর্বের সঙ্গে বলতে পারে-- আমরা শান্তিনিকেতনের থেকেও এগিয়ে। আমরাই আসল ভারতীয় ছাত্র। আমরা জানিনা- বিদ্যুত কী, কলের জল কী, পাকা মেজে কাকে বলে, স্যানিটারি ফিটিংস কী জিনিস। আমরা বিদেশি শিক্ষাও দেশি পদ্ধতিতে শিখেছি। তাই আমরা এখনো মাটির কাছাকাছি। এত পড়াশোনা করেও আমাদের হিসি গাছের গায়ে সহজে ঝরে পরে, বন্ধ বাথরুমে ঝরে না, মাথায় চড়ে।
    ছংগামল ভদ্দরলোক কোন একসময় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। একটি জালি রেজোলুশন পাস করিয়ে উনি বোর্ডের ডাকবাংলোটা এই কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সম্পত্তি বানিয়ে দিলেন। তার আগে কলেজটার সম্পত্তি বলতে হাতে ছিল শুধু ওই ম্যানেজিং কমিটি। আর রেজোলুশনের শর্ত অনুযায়ী কলেজটার নাম হয়ে গেল ছংগামল বিদ্যালয়।
    কলেজটার প্রত্যেকটা বিল্ডিং এর আলাদা আলাদা ইতিহাস আছে। যেমন কমিউনিটি সেন্টার ভবন তৈরি হয়েছিল সরকারি পয়সায়, গ্রামসভার নামে আসা ফান্ড থেকে। কিন্তু ওটায় প্রিন্সিপালের অফিস আর ইলেভেন-টুয়েলভের ক্লাস চলে। আস্তাবলের মত দেখতে বাড়িটা গ্রামের লোকজনের শ্রমদানে গড়ে উঠেছে। টিনের শেডটা কোন মিলিটারি ছাউনির ভগ্নস্তুপ থেকে মাল ঝেড়ে এনে রাতারাতি দাঁড় করানো হয়েছে। লাঙলদেয়া উষর জমি কৃষিবিজ্ঞান পড়াতে কাজে লাগে। আর তাতে গজিয়ে ওঠা জোয়ারের দানা প্রিন্সিপালের পোষা মোষের কাজে লাগে। আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়র আর ডাক্তারের বড়ই অভাব। কারণ এই দেশের লোকজন বড্ড কবিস্বভাবের। কোন জিনিসকে ভাল করে বোঝার আগেই মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখে ফেলে। ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধ দেখে ওদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে---" আহা! অঘটনঘটনপটু ঈশ্বর নিজের লীলা দেখাতে আবার ভারতভূমিকেই বেছে নিয়েছেন।"
    অপারেশন টেবিলে শোয়া যুবতীকে দেখেও ওরা বিদ্যাসুন্দর-গীতগোবিন্দ আওড়াতে পারে।
    কিন্তু সেন্টিমেন্টের এমন ঝঞ্ঝাবাতাসের মধ্যেও এদেশ থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র জন্মায়।
    তবে তারা আসল ইঞ্জিনিয়র-ডাক্তার হয় আমেরিকা বা ইংল্যান্ড ঘুরে এলে। কিন্তু তার কিছু প্রারম্ভিক কাজকম্ম-- ওই টেক অফ্‌ স্টেজ আর কি--- এদেশেই হয়। সে জাতীয় কিছু কাজকম্ম এই "ছংগামল বিদ্যালয় ইন্টারকলেজ" ও করে যাচ্ছে।

    ক্লাস নাইন। সায়েন্সের ক্লাস চলছে। মাস্টার মোতিরাম ছাত্রদের অপেক্ষিক ঘনত্ব বোঝাচ্ছেন। উনি একধরণের বি এস সি পাশ। বাইরে তখন এই ছোট্ট গাঁয়ের ছোটোলোকোমির অনুপ্রাসের ছটা ছেয়ে আছে। আখবোঝাই গরুর গাড়িগুলো চিনিকলের রাস্তায় এগিয়ে চলেছে। কিছু ক্ষয়াটে চেহারার ছোঁড়া পেছন থেকে টেনে টেনে আখ বের করে দৌড়ে পালাচ্ছে আর সামনে বসা গাড়ির গাড়োয়ানও টেনে গাল দিচ্ছে।
    গালাগালের আওয়াজ যত উঁচুতে ওঠে, তত তার সম্মান বাড়ে,-- উড়ন তুবড়ির মত। শেষে একটা গালি আকাশে অন্য গালির সঙ্গে কাটাকাটি খেলে জানলা দিয়ে ক্লাস রুমে ঢুকে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ করে। আজকেও তাই হচ্ছিল। ছেলেরা তামাশা দেখছিল আর সায়েন্স পড়ছিল।
    একটি ছেলে বলল, -- মাস্টারজী, আপেক্ষিক ঘনত্ব কাকে বলে?
    উনি বল্লেন--- আপেক্ষিক ঘনত্ব মানে রিলেটিভ ডেনসিটি।
    এবার অন্য একটি ছাত্র বলল,-- দেখুন, আপনি কিন্তু সায়েন্স ছেড়ে ইংরেজি পড়াচ্ছেন!
    মাস্টারসাহেব উবাচ-- সায়েন্স শালা ইংরেজি ছাড়া পড়ানো যায়?
    এবার ছেলের দল দাঁত বের করল। কারণ, হিন্দি-ইংরেজির দ্বন্দ্বযুদ্ধ নয়, মাস্টারমশাইয়ের মুখে "শালা" শব্দের ইডিয়মেটিক প্রয়োগ।
    -- এটা কোন হাসির কথা না।
    ছেলেদের বিশ্বাস হল না, ওরা আরও জোরে হেসে উঠল। এবার মোতিরাম মাস্টারও তাদের সঙ্গে হাসতে লাগলেন। ছেলেরা চুপ মেরে গেল।
    মাস্টার ওদের মাপ করে দিয়েছেন। বল্লেন,-- যদি রিলেটিভ ডেনসিটি বুঝতে না পারো, তো আপেক্ষিক ঘনত্বটা একটু অন্যভাবে বোঝার চেষ্টা করে দেখ। আপেক্ষিকের অর্থ -- অন্যের সঙ্গে তুলনা করে নিজের অবস্থা বোঝা। ধর, তুমি একটা গমপেষাইয়ের কল খুলেছ, আর তোমার ঘরের পাশে তোমার পড়শি আর একটা কল খুলেছে। তুমি হয়ত মাসে পাঁচশ টাকা আয় কর আর তোমার পড়শি চারশ'। তোমার লাভ ওর তুলনায় বেশি হল। একেই সায়েন্সের ভাষায় বলে তোমার আপেক্ষিক লাভ বেশি। বুঝেছ?
    একটি ছেলে বলে উঠল,-- বুঝতে পেরেছি মাস্টারমশায়, কিন্তু আপনার যে গোড়ায় গলদ। এ গাঁয়ে কেউই গমপেষাইয়ের দোকান চালিয়ে মাসে পাঁচশ রোজগার করতে পারবে না।
    মোতিরাম মাস্টার টেবিল চাপড়ে বল্লেন--- কেন পারবে না? মানুষ চাইলে কি না পারে?
    ছেলেটার এই কথায় আর কথা বলার কায়দায় একটুও হেলদোল হল না। বলল,--- কিচ্ছু পারে না। আমার কাকার গমপেষাই মেশিন হুড়ুম-দুড়ুম করে সারাদিন চলতে থাকে। কিন্তু কাকার মাসের আয় মাত্র দু'শ টাকা।
    --- কে তোমার কাকা?
    মোতিরাম মাস্টারের গলা যেন ঘামে ভিজে গে্ল। উনি ছেলেটাকে ভাল করে দেখতে দেখতে বলে উঠলেন,--- তুমি ওই বেইমান-মুন্নুর ভাইপো' নাকি?

    ছেলেটা অহংকার লুকোনোর কোন চেষ্টা করল না। যেন কিছু যায় আসে না এমনি ভঙ্গিতে জবাব দিল,--- আমি নয়ত কে?
    বেইমান-মুন্নু ওনার গাঁয়ের প্রতিশ্ঠিত নাগরিক। যদিও গোলাপ ফুলে নামমাত্র গন্ধ হয়, তবু ইংরেজি সাহিত্য বলে যে গোলাপকে যে নামেই ডাক না কেন, ও আগের মতই সুগন্ধ ছড়াবে। তেমনি ওনাকে যে কোন নামেই ডাকা হোক , বেইমান-মুন্নু আগের মতই নির্বিকার চিত্তে আটা পিষতে থাকবেন, পয়সা কামাতে থাকবেন আর সম্মানিত নাগরিক হয়ে টিঁকে থাকবেন।
    তবে সত্যের খাতির এটুকু বলতেই হবে যে "বেইমান-মুন্নু' জনগণের দেয়া নাম নয়, পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। ওনার বাপু ছোটবেলায় অতি-আহ্লাদে ওনাকে বেইমান বলে ডাকতো আর ওর মা আদর করে মুন্নু। ফলে দুটো জুড়ে ওর নাম হয়ে গেল "বেইমান-মুন্নু"।
    ইদানীং গোটা গাঁ ওকে বেইমান-মুন্নু বলে ডাকে। আর উনি বড় সহজভাবে এই উপনামকে স্বীকার করে নিয়েছেন, যেমন আমরা অনায়াসে আচার্য্য জে বি কৃপলানীকে "আচার্য্যজী", জে এল নেহরুকে "পন্ডিতজী" আর গান্ধীকে "মহাত্মাজী" করে নিয়েছি।
    মোতিরাম মাস্টার খানিকক্ষণ বেইমান-মুন্নুর ভাইপোর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর নিঃশ্বাস ছেড়ে বল্লেন,--- যেতে দাও।

    তারপর উনি বইয়ের খোলা পাতায় চোখ রাখলেন। একটু পড়ে চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলেন ছেলের দল অনেকক্ষণ ধরে ওনার দিকেই তাকিয়ে আছে। উনি জিগাইলেন," কি ব্যাপার"?
    একটি ছেলে বলল," তো এটাই বোঝা গেল যে গম পিষে মাসে পাঁচশ টাকা ঘরে আসে না।"
    " কে বলেছে?", মাস্টারমশাই বলে চললেন," আমি নিজে গম পিষিয়ে মাসে সাত-সাতশ' টাকা পেয়েছি। কিন্তু বেইমান-মুন্নুর ঠ্যালায় সব ভোগে গেছে।"
    বেইমান-মুন্নুর ভাইপো বেশ ভদ্রভাবে বলল," এত হা-হুতাশ করার কি আছে? এটা বিজনেস। কখনো আসে কখনো যায়। কম্পিটিশনে এ'রম হতেই পারে।"
    " সৎ ও বেইমানের মধ্যে কিসের কম্পিটিশন? কি যে ফালতু বকবক কর?" মোতিরাম মাস্টার ধমকে উঠলেন। এমন সময় কলেজের চাপরাশি ওনার কাছে একটা নোটিস ধরিয়ে দিল। উনি পড়তে পড়তে বিড়বিড় করতে লাগলেন," যাকেই দেখ , একটা কিছু এনে পড়ে দিতে বলবে। পড়তে পারে একজন, তো পড়াতে চায় দশজন।"
    একটা চ্যাংড়া বলল, " ঘোর অন্যায়!"
    উনি চমকে উঠলেন, " কে বলল রে?"
    একটা ছেলে হাত তুলল," আমি মাস্টারজী! জিগ্যেস করছিলাম, আপেক্ষিক ঘনত্ব কি করে বের করতে হয়?"
    মোতিরাম মাস্টার উবাচ, " আপেক্ষিক ঘনত্ব বের করতে হলে বস্তুটির ওজন এবং আয়তন মানে ভল্যুম জানতে হবে--- তারপর আপেক্ষিক ঘনত্ব বের করার কায়দা বা পদ্ধতি জানতে হবে। পদ্ধতির কথা শুধোলে বলব ---যেকোন জিনিসের দুটো পদ্ধতি হয়। একটা সঠিক, অন্যটা বেঠিক। সঠিক পদ্ধতিতে ঠিক ফল পাওয়া যায় আর বেঠিক পদ্ধতিতে ভুল । একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা সহজে বুঝতে পারবে। ধর তুমি একটা গমপেষাইয়ের মেশিন বসিয়েছ। নতুন মেশিন, গ্রিজ-টিজ লাগিয়ে একেবারে ঝকঝক করছে।
    ইঞ্জিন নতুন, বেল্ট নতুন। সবকিছু আছে, কিন্তু কারেন্ট নেই। তো ফল কি হবে?"
    প্রথমে কথা বলেছিল যে ছোকরা, সে বলল," তখন ডিজেল ইঞ্জিন লাগাতে হবে, মুন্নুচাচা তাই করেছিল।"
    মোতিরাম মাস্টার বল্লেন," একলা মুন্নুচাচার মাথাতেই ঘিলু আছে নাকি? এ গাঁয়ে সবার আগে ডিজল ইঞ্জিন কে এনেছিল? কেউ বলতে পারবে?"
    ছেলের দল হাত তুলে কোরাস গাইল, " আপনি স্যার ,আপনি"!
    স্যার এবার প্রসন্নচিত্ত হয়ে মুন্নুর ভাইপোকে বল্লেন," শুনলে তো! বেইমান-মুন্নু আমার দেখাদেখি ডিজল ইঞ্জিন লাগালো বটে, কিন্তু আমার গমপেষা কল তো কলেজ শুরু হওয়ার আগের থেকে চলছে। আমার কল থেকেই গম পেষাতে আসা গ্রাহকদের থেকে কলেজ খোলার জন্যে সের-সের আটা দান নেয়া হয়েছিল। আমার মেশিনে পিষেই সেগুলো আটা হয়ে শহরে বিক্রি হতে গেল। আমার গমপেষাই কলের পাশে বসেই কলেজের বিল্ডিংয়ের নকশা তৈরি হল আর ম্যানেজার কাকা বল্লেন,' মোতি, কলেজে তুমি মাস্টার হবে, কিন্তু আসল প্রিন্সিপালগিরি তোমাকেই করতে হবে।' সব কিছু আমার কলঘরে হল আর এখন গাঁয়ে গমপেষা কল বলতে বেইমান-মুন্নুর! আমার কলটা যেন কিছুই না!"
    ছেলের দল মন দিয়ে শুনছিল। এই কথকতা এরা আগেও অনেকবার শুনেছে, এবং যেকোনো সময় শোনার জন্যে তৈরি আছে। ওদের আর এই নিয়ে কোন হেলদোল হয় না। তবে মুন্নুর ভাইপো বলল," চিজ তো আপনার বেশ ভাল, মাস্টারমশাই। আর মুন্নুচাচারটাও খাসা। তবে আপনার ধান-কুট্টিটার ওভারহলিং দরকার। ধান বড্ড ভেঙে যায়।"
    মোতিরাম মাস্টার নরম সুরে বললেন," এমন কিছু নয়। আমার মত ধান-কুট্টি মেশিন গোটা তল্লাটে নেই। কিন্তু বেইমান-মুন্নু ধানকোটা গমপেষার রেট সমানে কমিয়ে দিচ্ছে, তাই লোক ওদিকে চলে যাচ্ছে। সব হিন্দুস্থানীরই এক অবস্থা, কোথাও দু'পয়সা শস্তা দেখলেই পাগলের মত দৌড়ুবে।"
    " এতো সব জায়গাতেই হয়", ছেলেটা তর্ক জুড়ল।
    " মোটেই না, শুধু এদেশেই হয়। তবে ও রেট কমানোর লোকসানটা ওজনে মেরে পুষিয়ে নেয়।
    আর মোতিরাম মাস্টার আর যাই করুক, ওই কম্মটি কখনো করবে না।"
    একটা ছেলে জিগ্যেস করল," তো আপেক্ষিক ঘনত্ব বের করতে গেলে কি করতে হবে?"
    উনি ঝটপট বললেন, " তাই তো বলছিলাম!"

    ওনার দৃষ্টি জানলা দিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো আখবোঝাই গাড়ির তিনফুট ওপর দিয়ে দিকচক্রবালে হারিয়ে গেল। বিগত যুগের সারাক্ষণ ভাবুক পোজ-দেয়া কবিদের স্টাইলে উনি ধীরে ধীরে বলে চললেন," গোটা এলাকায় একটাই মেশিন ছিল, লোহার বডি, কাঁচের মত ঝকঝকে---"। হটাৎ উনি সম্বিত ফিরে পেয়ে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, কিসের যেন কথা হচ্ছিল?"
    ছেলেটা আবার নিজের প্রশ্নটা বলল। কিন্তু সব্টা শোনার আগেই ওনার মনযোগ কেড়ে নিয়েছে একটি শব্দ। ছেলেরাও শুনতে পেয়েছে। বাইরে আখচুরি নিয়ে উঁচু গলার খিস্তি-খেউড়, চাপরাশিকে প্রিন্সিপালের গালমন্দ আর মিউজিক ক্লাসে হারমোনিয়ামের ম্যাঁও-ম্যাঁও--- সব কিছু ছাপিয়ে হটাৎ জেগে উঠেছে একটা বিকট আওয়াজ-- ভক্‌ ভক্‌ ভক্‌ ভক্‌ ! মোতিমাস্টারের গমপেষা মেশিন চালু হয়েছে। এটা তারই আওয়াজ। এটাই আসল আহ্বান। অন্ন-বস্ত্র না জোটার চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা-ঝগড়ার হুংকার, এসব না শুনে খাঁটি নেতারা শুধু আত্মার আওয়াজ শুনতে পান। মোতিমাস্টারেরও সেই দশা। উনি আর কোন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন না, শুধু ওই ভক্‌ -ভক্‌ -ভক্ !
    উনি ক্লাস থেকে ছুটে বেরোতে গেলেন।
    ছেলেরা বলল, " কি হল মাস্টারজী? এখনো তো ঘন্টা পড়েনি?"
    --" মনে হচ্ছে মেশিনটা ঠিক হয়ে গেছে। দেখি গিয়ে , কেমন চলছে।"
    দরজা অবদি গিয়ে হটাৎ ফিরে এলেন। চেহারায় কষ্টের ছাপ, যেন কেউ খুব জোরে চিমটি কেটেছে। বল্লেন, " বই থেকে পড়ে নিও। আপেক্ষিক ঘনত্বের চ্যাপটার খুব দরকারি।" উনি জিভে জল টেনে নিলেন। একটু থেমে বল্লেন," ইম্পর্ট্যান্ট!" বলেই চেহারায় প্রফুল্ল ভাব।
    ভক্‌ ! ভক্‌ ! ভক্ !
    বাইরের জটিল কর্মক্ষেত্র থেকে কর্তব্যের আহ্ববান ভেসে আসছে। ছাত্রের দল ও বইয়ের মোহ ওনাকে বেঁধে রাখতে পারল না।
    ঘড়িতে চারটে বাজল। প্রিন্সিপাল সাহেব নিজের কুঠুরি থেকে বাইরে বেরোলেন। রোগা-প্যাংলা শরীরের খানিকটা হাফ-প্যান্ট আর খানিকটা শার্টে ঢাকা পড়েছে, বগলে পুলিস এর সার্জেন্টমার্কা বেত, পায়ে স্যান্ডেল। সব মিলিয়ে বেশ চটপটে আর চালাক দেখাচ্ছে। আর যত না দেখায় তার থেকে উনি নিজেকে একটু বেশি ভাবেন।
    ওনার পেছন পেছন চলছে কলেজের ক্লার্ক, রোজকার মতন। প্রিন্সিপাল এবং ক্লার্কের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের কথা সবাই জানে।
    এরা এখন মোতিরাম মাস্টারের ক্লাসের ধারে পৌঁছেচেন। ক্লাস চলছে ওই আস্তাবলের মত ঘরটায়। ক্লাসে যে কোন মাস্টার নেই সেটা দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। একটা ছেলে মাস্টারের টেবিলে চড়ে বসে বসে কাঁদছে। ওর পরণের পাজামাটা নীচের থেকে উরু পর্য্যন্ত ছেঁড়া। প্রিন্সিপালকে ক্লাসের ধার দিয়ে যেতে দেখে ও আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। উনি জিগ্যেস করলেন, " কি হয়েছে? মাস্টারমশাই কোথায়?"
    তাতে ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আরেকটা ছেলে জবাব দিল-- " এটা মোতিরাম মাস্টারের ক্লাস।"
    ব্যস্‌, প্রিন্সিপাল তৎক্ষণাৎ বুঝে গেলেন মাস্টারমশাই কোথায়। ক্লার্ক বললো," সেকেন্ডহ্যান্ড মেশিন চালাতে হলে চব্বিশ ঘন্টা চোখে চোখে রাখতে হয়। কতবার মোতিরাম মাস্টারকে বলেছি এই আটা-চাক্কিটা বেচে দাও, কিন্তু ওর মাথায় ঢুকলে তো? আরে আমিই একবার হাজার দেড়েক দিতে চেয়েছিলাম।"
    প্রিন্সিপাল বল্লেন," ছাড়ান দাও, ওদিকের ক্লাস থেকে মালবীয়কে ডেকে আনো।"
    ক্লার্ক একটি ছেলেকে বললো, " যাও, ওদিকের ক্লাস থেকে মালবীয়কে ডেকে আনো।"
    একটু পরে ওদিক থেকে একটি ভালোমানুষ গোছের অল্পবয়সী তরুণকে আসতে দেখা গেল।
    প্রিন্সিপাল ওকে দেখা মাত্র চেঁচিয়ে উঠলেন, " ভাই মালবীয়, এই ক্লাসটাও একটু দেখে নিও।"
    মালবীয় কাছে এসে ছাদের একটা খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর বললো," একটা পিরিয়ডে দুটো ক্লাস? কি করে করবো?"
    কাঁদুনে ছেলেটা কেঁদেই চলেছে। কিছু ছেলে ক্লাসের পেছন দিকে বসে জোরে জোরে হাসছে। বাকি সবাই এনাদের সামনে এমন ভীড় করে দাঁড়িয়েছে যেন চৌরাস্তার মোড়ে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
    প্রিন্সিপাল সাহেব এবার গলার আওয়াজ চড়িয়ে বল্লেন, " বেশি নিয়মকানুন দেখাবে না! যেদিন থেকে তোমার খান্নামাস্টারের সঙ্গে ওঠবোস শুরু হয়েছে , সেদিন থেকেই সব কাজে খালি অজুহাত।"
    মালবীয় অবাক হয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের মুখ দেখছিল। ক্লার্ক বলল,"সরকারী বাসের হিসেবে ক্লাস চালিয়ে নাও, মালবীয়। দেখনি, একটা বাস খারাপ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লে কেমন যাত্রীদের পরের বাসে তুলে দেয়া হয়? এই ছেলেগুলোকেও অমনি করে তোমার ক্লাসে নিয়ে বসাও।"
    ও বেশ মিষ্টি করে জবাব দিল, " কিন্তু এটা তো ক্লাস নাইন। আমি ওখানে তো সেভেনের ক্লাস নিচ্ছি।"

    প্রিন্সিপালের ঘাড় পেছনে ঘুরলো। যারা জানে তারা বুঝে গেছে যে এবার প্রিন্সিপালের হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকবে আর ওনার চিৎকার শোনা যাবে। হলও তাই। উনি বললেন, " আমি সব জানি। তুমিও খান্নার মত তক্কো করা শুরু করেচো, আমাকে ক্লাস সেভেন আর নাইনের তফাৎ শেখাতে এয়েচো? আমাকে আর প্রিন্সিপালগিরি শেখাতে এসো না। যেমন যেমন হুকুম হবে , তেমন তেমন ক্যারি আউট করে যাও বুঝেচো কি বোঝনি? "
    প্রিন্সিপাল থাকেন কাছের এক গাঁয়ে। লোকমুখে ওনার দুটো গুণের খ্যাতি দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। একটা হল জালি খরচের হিসেব দেখিয়ে ঢের সরকারি ফান্ড আদায় করা। অন্যটা রাগের চরমসীমায় শুদ্ধ হিন্দি ছেড়ে স্থানীয় অবধী বুলি আওড়ানো। উনি যখন জালি হিসেবপত্তর বানান তখন আচ্ছা-সে-আচ্ছা খাঞ্জা খাঁ অডিটরও কলম চালাতে হিমসিম খেয়ে যায়। তেমনি ওনার অবধী বুলির খই ফুটলে বড় বড় তর্কপঞ্চাননেরও বাক্যি হরে যায়।
    মালবীয় মাথা নীচু করে ফিরে গেল। প্রিন্সিপাল ছেঁড়া পায়জামা পরা ছেলেটার পিঠে দু'ঘা বেত কষিয়ে বল্লেন, " যাও, সবকটা গিয়ে চুপচাপ ওই ক্লাসে বসে থাক। একটু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেছি কি চামড়া গুটিয়ে নেব।"
    ছেলের দল চলে গেলে ক্লার্ক মিচকি হেসে বলল, " চলুন, খান্না মাস্টারের তামাশাটাও দেখে আসি।"

    খান্নামাস্টারের আসল নাম খান্নাই বটে; যেমনি , তিলক, গান্ধী, প্যাটেল, নেহরু ইত্যাদি কোন জাতিসূচক পদবী না হয়ে লোকের নাম হয়ে গেছে। এই দেশে জাতপাত তুলে দেয়ার এটাই সহজ উপায়। জাতের থেকে ওর নামটা কেড়ে নিয়ে কোন মানুষের নাম বানিয়ে দিলে জাতের হাতে আর থাকে কী? তখন বাধ্য হয়ে জাতিপ্রথা নিজে নিজেই শেষ হয়ে যায়।
    খান্নামাস্টারের চাকরি ইতিহাসের লেকচারারের, কিন্তু এখন উনি একটি ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ইংরেজি পড়াচ্ছেন। দাঁতে দাঁত পিষে বলছেন, " হিন্দিতে তো বড় বড় প্রেমের গল্প লিখে ফেল, কিন্তু ইংরেজির ক্লাসে কোন উত্তর না দিয়ে ঘোড়ামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?"
    ক্লাসের মাঝখানে একটা ছেলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতে আমাদের দেশে ঘি-দুধের দুষ্প্রাপ্য হওয়ার আর খেলাধূলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠ্যালায় বেশির ভাগ ছাত্রই ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়ার মত দেখায়, কিন্তু এই ছেলেটার মুখের গঠনে এমন একটা ভাব আছে যে এটা টাইটেল হয়ে ওর নামের সঙ্গে সেঁটে গেছে। ক্লাসের ছেলেরা জোরে জোরে হাসছে। খান্নামাস্টার এবার ইংরেজিতে জিগাইলেন, " বল, 'মেটাফর' মানে কী?"
    ছেলেটা ঢ্যাঁটার মত দাঁড়িয়ে রইল। কিছুদিন আগে দেশে গুজব রটে ছিল যে অশিক্ষিত লোক মানে শিং-লেজ ছাড়া পশু। ওই গুজবের ফলে অনেক অশিক্ষিত পরিবারের ছেলে হাল-কোদাল ছেড়ে স্কুল-কলেজে হামলে পড়ল। হাজার হাজার ছেলের পাল এসে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিকে ঘিরে ফেলে এমন হল্লা শুরু করল যে শিক্ষাক্ষেত্রে হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল। এখন আর কেউ বলে না যে অশিক্ষিত মানুষ জানোয়ারের মত। বরং ফিসফিস করে বলা হচ্ছে যে উচ্চশিক্ষা সবার জন্যে নয়, এর জন্যে 'স্ক্রীনিং' দরকার। এইভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেঁয়ো ছেলেদের আবার হাতে লাঙল ধরিয়ে ক্ষেত-খামারে ফেরৎ পাঠানোর ফতোয়া দেয়া শুরু হয়ে গেল।
    কিন্তু বার বার ফেল, ক্লাসের মধ্যে নানারকম বকাবাদ্যি-নিন্দেমন্দ,তারপর নেতাদের মুখে কৃষিকাজের মহিমাকীর্তন,-এতকিছু শোনার পরেও ওই ছেলের দল কিছুতেই লাঙল-কোদালের দুনিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হল না। এরা কানখাজুরার মত স্কুলের গায়ে সেঁটে রইল আর যেভাবেই হোক, সেঁটে থাকতেই চাইল।

    ঘোড়ামুখো ছেলেটাও এইরকম একটি ভীড়ের অংশ। ওকে রোজ ক্লাসের ভেতর নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হত --যাও বাছা! ঘরে গিয়ে তোমার মোষ দোয়াতে থাক, বলদের ল্যাজে মোচড় দাও,-- শেলী - কীটস ঠিক তোমার জন্যে নয়। কিন্তু ছেলে নিজের বাপের থেকে কয়েক শতাব্দী এগিয়ে গিয়েছে, এইসব ইশারা বুঝতে ওর বয়েই গেছে। ওর বাপ আজও দ্বাদশ শতাব্দীর গাঁড়াশি দিয়ে বলদের জন্যে চারা কাটে। ছেলে একটা আধময়লা বইয়ের আড়ালে নিজের ঘোড়ামুখ লুকিয়ে বিংশ শতাব্দীর কোলকাতার রঙীন রাতের দৃশ্য মগ্ন হয়ে দেখে। এই অবস্থার কোন পরিবর্তনে ও আগ্রহী নয়। তাই ও মেটাফরের মানে বলতে পারে না, নিজের ঘোড়ামুখ নিয়ে কোন পাল্টা জবাব দিতে পারে না।
    কলেজের সমস্ত ছাত্রের মত এই ছেলেটারও নিজের পোশাক-আশাক নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। ছেলেটার পায়ে জুতো নেই, আর এমন একটা ডোরাকাটা কাপড়ের ময়লা পাজামা পরেছে যেগুলো দিয়ে শহুরে লোকেরা স্লিপিং স্যুট বানায়। ও গাঢ় খয়েরি রংয়ের মোটা জামা পরেছে। ওর বোতাম গুলো ভাঙা। মাথায় শক্ত রুক্ষ্ম চুল। মুখধোয়া হয় নি। গিচ্‌পিচ্‌ চোখ। দেখলেই মনে হয়, ও কোন প্রোপাগ্যান্ডার চক্করে ফেঁসে কলেজে পালিয়ে এসেছে।
    ছেলেটা গত বছর কোন শস্তা ম্যাগাজিন থেকে একটি প্রেমের গল্প নকল করে কলেজের ম্যাগাজিনে নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়েছিল। খান্নামাস্টার ওর লেখকখ্যাতিতে কাদা ছিটোতে উঠে পড়ে লেগেছেন। উনি গলার স্বর বদলে বল্লেন, " লেখক মহাশয়, কিছু বলুন। মেটাফর কারে কয়?"
    ছেলেটা ওর উরু চুলকোতে লাগল। মুখটা কয়েকবার আঁকাবাঁকা করে হটাৎ বলে উঠল, " যেমন মহাদেবীজির কবিতায় বার বার বেদনার মেটাফর দেখা যায়।"
    খান্নামাস্টার গর্জে উঠলেন, "শাট্‌ আপ! এটা ইংরেজির ক্লাস।" ছেলেটা চুলকানো বন্ধ করল।

    খান্নামাস্টার খাকি রঙের প্যান্ট আর নীল রঙের বুশশার্ট পরেন আর স্মার্ট দেখাবে বলে কালো চশমা। চেয়ার ছেড়ে উনি এবার টেবিলের সামনে এসে পাছার একটু ছোট অংশ টেবিলে ঠেকিয়ে কায়দা করে দাঁড়ালেন। ছেলেটাকে কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় চোখে পড়ল পেছনের দরজায় প্রিন্সিপালের চোখ আর বারান্দায় ক্লার্কের কাঁধের অংশ।
    তক্ষুণি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বল্লেন," জী, শেলীর কবিতা পড়াচ্ছিলাম।"
    প্রিন্সিপাল একটি শব্দের গায়ে আর একটি শব্দ চড়িয়ে দিয়ে বল্লেন," কিন্তু আপনার কথা শুনছে কে? এখানে তো এরা ছবি দেখায় মত্ত।" উনি এবার সোজা ক্লাসের ভেতরে ঢুকে এক এক করে দুটো ছেলের পিঠে বেত ছোঁয়াতেই ওরা উঠে দাঁড়াল। একজনের নোংরা পাজামা, বুশশার্ট আর তেল-চুপচুপে চুল; অন্যজনের ন্যাড়ামাথা, কামিজ ও পালোয়ানিমার্কা আন্ডারওয়ার। প্রিন্সিপাল ওদের বল্লেন, " কি, এসবই পড়ানো হচ্ছে?"
    উনি নীচু হয়ে আগের ছেলেটির চেয়ার থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিলেন। ওতে ভরপুর সিনেমা সাহিত্য ছিল। একটা পাতা খুলে উনি হাওয়ায় ঘোরালেন। ছেলেরা দেখল, ফটোতে কোন বিলেতি মেমের উদ্ধত বুক ফড়ফড় করছে। এবার পত্রিকাটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে অবধীতে চেঁচিয়ে উঠলেন, " এটাই পড়ানো হচ্ছে নাকি?"
    ক্লাসরুমে সন্নাটা। " মহাদেবী কী বেদনা"র প্রেমিকপ্রবর ছেলেটি মওকা দেখে চুপচাপ নিজের সীটে বসে পড়েছে। ক্লাসের এ মুড়োয় দাঁড়িয়ে প্রিন্সিপালসাহেব ও মুড়োয় দাঁড়িয়ে থাকা খান্নামাস্টারকে তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে বল্লেন," আপনার ক্লাসে ডিসিপ্লিনের এই অবস্থা? ছেলেরা সিনেমার পত্রিকা পড়ছে! এরই জোরে আপনি প্রেসার দেয়াচ্ছিলেন যে আপনাকে ভাইস প্রিন্সিপাল বানানো হোক? এই ক্ষ্যামতায় ভাইস প্রিন্সিপালগিরি কোরবেন? ভাইয়া, যদি এমনি চলতে থাকে তো ভাইস প্রিনসিপালি যাক চুলোয়, আসছে বছর জুলাই মাস থেকেই পথে পথে ঘুরে বেড়িও।" বলতে বলতে অবধীভাষার মহাকবি গোস্বামী তুলসীদাসের আত্মা ওনার শরীরের একদিক দিয়ে ঢুকে আর একদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল।তারপর উনি শুদ্ধ হিন্দিতে ফিরে এলেন," লেখাপড়াই সব নয়, আসল হল ডিসিপ্লিন, বুঝলে হে খান্নামাস্টার!"
    এইসব বলে প্রিন্সিপাল সাহেব ওমর খৈয়ামের নায়কের মত " বৃষ্টিধারার মত এসে ঝড়ের মত যাই" ভঙ্গিতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।পেছন থেকে খান্নামাস্টারের ভনভনানি ওনার কানে আছড়ে পড়ল।
    উনি কলেজের ফটকের বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় উঠলেন। সাইকেল চড়ে একটি লোক আসছে-- পরনে শার্ট-প্যান্ট। কাছ দিয়ে যাবার সময় ও প্রিন্সিপালকে আর উনি ওকে নমস্কার করলেন। ও এগিয়ে গেলে ক্লার্ক জিগ্যেস করল এটা আবার কোন ইস্কাপনের গোলাম?
    -" ম্যালেরিয়া ইন্স্পেকটর, নতুন এসেছে। শুনেছি বিডিও'র ভাগ্নে। বড্ড চালু। আমি এখনো কিছু বলিনি। ভাবছি, কখনো তো কাজে আসবে।"
    ক্লার্ক বললো," আজকাল এমনিসব ইস্কাপনের গোলাম দিয়েই কাজ হয়। ভালমানুষের দল তো কখনো কিছু করে দেয় না।"
    খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ, শুধু রাস্তায় পা ফেলে চলেছেন। তারপর প্রিন্সিপাল শুরু করলেন," সবরকম মানুষের সঙ্গেই মেলামেশা করা উচিৎ। এই কলেজের জন্যে গাধাকেও বাবা ডাকতে হয়েছে।"
    ক্লার্ক উবাচ, " সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সারাদিন তো এই করেই কাটাচ্ছেন।"
    --- " বলুন, বলুন দেখি! এর আগে পাঁচ-পাঁচজন প্রিন্সিপাল ছিল। কেউ এমন বড় পাকা বাড়ি তুলতে পেরেছে?" উনি এবার শান্ত হলেন," এই কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করা তো আমারই পরিশ্রমে সম্ভব হল। ঠিক বল্লাম কি না?"
    ক্লার্ক সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
    একটু পরে উনি কিছু ভাবতে ভাবতে বল্লেন," আমি তো এই তালে আছি যে কোন ব্যাটা চন্ডুল ফেঁসে গেলে এই বিল্ডিং এর আর এক-আধ ব্লক তৈরি করে ফেলব।"
    ক্লার্ক চুপ্চাপ সঙ্গে চলতে চলতে হটাৎ থেমে গেল, " দুটো বিল্ডিং তৈরি হল বলে।"
    প্রিন্সিপাল উৎসাহের চোটে ঘাড় তুলে বল্লেন,"কোথায়?"
    -" একটা তো অস্পৃশ্যদের জন্যে চামড়া সাফ করার কারখানা। ঘোড়ার ডাক্তার বলছিল। আর একটা হল হাসপাতালে কলেরার জন্যে আলাদা ওয়ার্ড। এদিকে খালি জমি পাওয়া কঠিন। কলেজেরই আশেপাসে "টিপ্পস" দিয়ে এই বিল্ডিংগুলো বানিয়ে নিন। তারপর কায়দা করে হাতিয়ে নেব।"
    প্রিন্সিপাল একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন। বিড়বিড় করতে লাগলেন," আগে থেকেই জানতাম, এখানে 'টিপ্পস্‌ চলবে না"।
    খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ চলতে লাগলেন।

    রাস্তার ধারে একজন লোক গোটা চার মজদুরকে ধরে ভারি বকাঝকা করছিল। প্রিন্সিপালসাহেব ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দু-চারমিনিটে বুঝে গেলেন লোকটা কেন বিগড়েছে। মজদুরের দল কাকুতি-মিনতি করছিল। প্রিন্সিপাল বুঝে গেলেন যে ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, এসব ঠিকেদার আর মজুরের মধ্যে রোজ-রোজ হতেই থাকে। আজ কথাবার্তায় কিছু খিঁচ ধরেছে। উনি আগ বাড়িয়ে মজুরদের বল্লেন, " যাও রে! সব নিজের নিজের কাজে লেগে যাও। ঠিকেদার সাহেবকে ঠকাবার চেষ্টা করলে জুতো খাবে।"
    মজুরের দল কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে প্রিন্সিপালের দিকে তাকালো, তারপর সুযোগ বুঝে যে যার কাজে লেগে গেল। এবার ঠিকেদার প্রিন্সিপালকে বেশ আত্মীয়্তা দেখিয়ে বলল," বুঝলেন, সব ক'টা বেইমান! একটু চোখ বুজেছেন কানের ময়লাও চুরি করে সাফ করে দেবে। দেড়গুণো মজুরি চায় আবার কাজ দেখলে পালাই -পালাই করে।"
    প্রিন্সিপাল সাহেব বল্লেন," সবজায়গায় একই অবস্থা। আমার এখানেই দেখুন। কোন ব্যাটা মাস্টার পড়াতে চায়? আমি পেছনে লেগে লেগে তবু একটু--"।
    লোকটা ঠা-ঠা করে হাসল। বলল," আমায় কি বলবে? এই তো করে যাচ্ছি। সব জানি।" তারপর একটু থেমে বলল, " এদিকে কোথায়?"
    জবাব দিল ক্লার্ক, " বৈদ্যজীর ওখানে। চেকে দস্তখত করতে হবে।"
    " দস্তখত করিয়ে আনুন।" ও প্রিন্সিপালকে কেটে পড়ার ইশারা করলো। কিন্তু ওরা পা' বাড়াতেই প্রিন্সিপালকে বল্লো," আর কি খবর? কেমন চলছে?"
    প্রিন্সিপাল দাঁড়িয়ে পড়লেন।
    -" এমনিতে সব ঠিকই আছে। ওই খান্না-বান্নার দল লিবির-শিবির করছে। মানে, আপনাদের আর আমার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করে বেড়াচ্ছে।"
    ও জোর দিয়ে বল্লো," আপনি চিন্তা করবেন না। ডাঁটের সঙ্গে প্রিন্সিপালগিরি চালিয়ে যান। ওদের বলে দিন যে প্রোপাগান্ডার জবাব হল ডান্ডা! বুঝিয়ে দিন যে এটা শিবপালগঞ্জ। এখানে ছোট-বড় দেখে চলতে শিখুক।"
    একটু এগিয়ে যাবার পর ক্লার্ক বলল," ঠিকেদারসায়েবকেও কলেজ-কমেটিতে মেম্বার করে নিন। কাজে আসবে।"
    প্রিন্সিপাল ভাবতে লাগলেন। ক্লার্ক বলল," ওনার নামে চার বছরের পুরনো তারিখে পেট্রনের রসিদ কেটে দেব। ম্যানেজিং কমিটিতেও ওনার থাকা জরুরি। তাহলে বেশ হবে।"
    প্রিন্সিপাল সাহেব তক্ষুণি কিছু বললেন না। একটু পরে বল্লেন,"আগে বৈদ্যজীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। এসব হাই-পলিটিকসের ব্যাপার। তোমার-আমার ক্ষ্যামতার বাইরে।"
    সাইকেলে চড়ে আর একজন কেউ আসছে। প্রিন্সিপাল ওকে নামতে ইশারা করে বল্লেন," নন্দাপুরে বসন্ত মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে, আর আপনি এখানে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শায়রী করে বেড়াচ্ছেন?"
    বেচারা হাত জোড় করে বলল," কই? কবে থেকে? আমার কাছে তো কোন খবর নেই!"
    প্রিন্সিপালের ভুরু বেঁকে গেল। "তোমার শহরের চক্কর থেকে ফুরসৎ হবে তবে তো খবর পাবে? চুপচাপ ওখানে চলে যাও, গিয়ে টিকে লাগাও। নইলে নালিশ হবে আর তোমায় কান ধরে বের করে দেয়া হবে। ওই টেরিলিনের বুশশার্ট গা' থেকে নেমে যাবে।"
    লোকটি হেঁ-হেঁ করে কেটে পড়ল।প্রিন্সিপাল ক্লার্ককে বল্লেন," এ ব্যাটা এখানের পাব্লিক হেল্থ বিভাগের এ ডি ও। যারই নামের পেছনে অফিসারের লেজ জুড়ে যায় সে'ব্যাটাই ধরাকে সরা জ্ঞান করে।"
    " এ ব্যাটাও নিজেকে কি যে ভাবে, রাস্তায় দেখা হলে চিনতে চায় না।"
    --" আমিও ভাবলাম দাও ব্যাটাকে ঝেড়ে!"
    ক্লার্ক বলল," আমি জানি, এটাও একটা ইস্কাপনের গোলাম।"
    ---------------------******----------------------
    ________________________________________

    অধ্যায়-৪
    ----------
    খানকয়েক কুঁড়েঘর, তার চেয়েও খারাপ অবস্থার গোটাকয় দোকান, তহসীল অফিস, থানা, তাড়ির দোকান, ব্লক অফিস, মদের দোকান, কলেজ--- ব্যস্‌, পথচলতি কারো চোখে এইটুকুই ধরা দেবে। একটু এগিয়ে গেলে একটা আমের বাগান--- বেশ ঘন, তাতে একটা কাঁচা ঘর, রাস্তার দিকে পিট,। আর কবাটহীন দরজাটার মুখ জঙ্গলের দিকে।
    বৃষ্টির দিনে রাখালের দল গাছের ছায়া ছেড়ে ঘরটার মধ্যে ঢুকে জুয়ো খেলে, বাকি দিন এটা খালিই পড়ে থাকে। কিন্তু খালি থাকলেও লোকজন খালি থাকতে দেয় না যে! মেয়ে-পুরুষেরা সময় সুযোগ বুঝে একে নানা ভাবে ব্যবহার করে থাকে।
    শিবপালগঞ্জে এই ঘরটার যা প্রচলিত নাম সেটা শুনলে হেনরি মিলারও ব্যোমকে যাবেন। কলেজের এক মাস্টার তাতে খানিকটে জল মিশিয়ে নাম দিয়েছেন-'প্রেম-ভবন'।
    কুঁড়েঘর আর প্রেম-ভবনের মাঝখান দিয়ে চলা সড়কের এ'পাশটা শিবপালগঞ্জের শুধু একটা কোণাকে ছুঁয়েছে। আসল শিবপালগঞ্জ রাস্তার ওপারে। আসল শিবপালগঞ্জকে পাওয়া যাবে বৈদ্যজীর বৈঠকখানায়।
    বৈঠকখানার হদিস পেতে হলে একটু গলিঘুঁজির মধ্যে ঢুকতে হবে। দুপাশে খাপরায় ছাওয়া এলোমেলো-ধ্যাবড়া গোছের ঘরবাড়ি। বাড়ির বাইরের রোয়াকগুলো গলা বাড়িয়ে গলির মধ্যে মৌরসীপাট্টা নিয়ে বসেছে। দেখলেই এদের ফিলজফিটা বোঝা যায়--নিজের চৌহদ্দির আশেপাশে খালি জায়গা দেখলেই অন্যের চোখ এড়িয়ে কব্জা কর।

    এই সবুজে সবুজে ছাওয়া এলাকায় খোলা মাঠের মধ্যে একটি বাড়ি একটা কোণ আটকে এমন ভাবে গড়ে উঠেছে যে ওদিকে আর এগিয়ে যাওয়া মুশকিল। ওটি বৈদ্যজীর বাড়ি। বৈদ্যভবনের সামনের দিকটা পাকা আর গেঁয়ো স্টাইলে বেশ সম্ভ্রম জাগানো, কিন্তু পেছনের দিকে কাঁচা দেয়াল আর তার পিছে প্রাতঃকৃত্য হয়, তাই কিছু নোংরা পড়ে থাকে। যেমন ঝিলিমিলি এয়ারপোর্ট আর লকলক হোটেলের সারি দিয়ে এদেশের 'সিম্বলিক মডার্নাইজেশন' মাপা হয়, তেমনি এর প্রভাব এই দেহাতি বাড়িটার আর্কিটেকচারেও দেখা যাচ্ছে।এর থেকে প্রমাণিত হয় যে দিল্লি হোক কি শিবপালগঞ্জ, কাজের ক্ষেত্রে দেশি বুদ্ধি সর্বত্র এক।
    বাড়িটার সামনের ভাগ, যাতে বাঁধানো রোয়াক, বারান্দা আর একটা বড় কামরা রয়েছে, বৈঠকখানা নামে প্রখ্যাত। ইঁট-বালি মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া মজদূরও জানে যে বৈঠকখানার মানে শুধু ইঁট-চূণ-সুরকির তৈরি বাড়িটা নয়। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রীট, হোয়াইট হাউস, ক্রেমলিন -এসব বাড়ির নাম না, ক্ষমতার নাম।

    থানার থেকে ফিরে এসে রূপ্পনবাবু দেজ্খতে পেলেন - দরবার-এ-আম, অর্থাৎ,বারান্দায় খুব ভীড় জমেছে ,অমনি চলার গতি বেড়ে গেল। পরনের ধূতি ফড়ফড় করতে লাগল।
    বৈঠকে ঢুকতেই উনি জানতে পারলেন যে ওনার মামাতো ভাই রঙ্গনাথ শহর থেকে ট্রাকে চড়ে এসেছে; কিন্তু রাস্তায় ড্রাইভার ওর থেকে দু' টাকা উসুল করেছে।

    একটা রোগাভোগা লোক ময়লা গেঞ্জি আর ডোরাকাটা আন্ডারওয়ার পরে এই নভেম্বর বিকেলের শীত-শীত আবহাওয়ার মধ্যেও দিব্যি খুশি-খুশি বসে আছে।
    ওর নাম হল মঙ্গল, কিন্তু লোকে ডাকে শনিচর বলে। চুলে পাক ধরেছে, সামনের দাঁত ক'টা পড়ে গেছে।ওর পেশা বলতে বৈদ্যজীর বৈঠকে বসে থাকা। ও সাধারণতঃ শুধু আন্ডারওয়ার পরেই থাকে, আজ গায়ে গেঞ্জি উঠেছে দেখে রূপ্পনবাবু বুঝে গেলেন যে শনিচর "ফর্ম্যাল" হতে চাইছে। ও রূপ্পনবাবুকে একশ্বাসে রঙ্গনাথের সমস্যাটা বলে দিয়ে নিজের নগ্ন উরূতে তবলার কিছু কঠিন বোল বাজিয়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, " আজ বদ্রীভাইয়া এখানে থাকলে কিছু একটা হয়ে যেত।"
    রূপ্পনবাবু রঙ্গনাথকে বল্লেন--" তুমি ঠিক করেছ, রঙ্গনাথদাদা। দু'টাকা দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দিলে। কথায় কথায় খুন-খারাপি উচিৎ নয়।"
    রূপ্পনবাবুর সঙ্গে রঙ্গনাথের দেখা হল প্রায় দেড় বছর পরে। রূপ্পনবাবুর সিরিয়াস ভাবটাই ওর কাছে সারাদিনের সবচেয়ে মজার ব্যাপার ধরে নিয়ে ও বলল, " আমি তো মারামারি করতেই যাচ্ছিলাম, কি ভেবে সরে এলাম।"
    রূপ্পনবাবু মারপিটের বিশেষজ্ঞ হওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে বল্লেন-- তুমি ঠিক করেছ। এইসব ঝগড়া-ঝাঁটিতে ইস্টুডেন্ট কমিউনিটির বদনাম হয়।
    রঙ্গনাথ এবার ওকে ভাল করে চেয়ে দেখলো। কাঁধের ওপর ধুতির কোঁচা,একটু আগে মুখে পোরা পান, চুলে কয়েক লিটার তেল-স্থানীয় গুন্ডাগিরির যেকোন স্ট্যান্ডার্ডে একদম প্রথমসারির বলে মনে হবে। রঙ্গনাথ কথা পাল্টানোর চেষ্টায় বলল," বদ্রীদাদাকে দেখছি না! উনি কোথায়?"
    শনিচর আন্ডারওয়ার ঝাড়তে লাগল, যেন কয়েকটা পিঁপড়েকে ঘরছাড়া করবে। ভুরু কুঁচকে বলল, " আমিও বদ্রীভাইয়ার কথাই ভাবছিলাম। আজ ও থাকলে এতক্ষণে তো--"।
    রঙ্গনাথ ওর কথায় কান না দিয়ে রূপ্পনবাবুকে বলল," বদ্রীদাদা এখন কোথায়?"
    রূপ্পনবাবু একটু কড়া ভাবে জবাব দিলেন-- শনিচর বলল তো! আমায় বলে যায় নি। হয়তো বাইরে গিয়েছেন। এসে যাবেন। কাল হোক, পরশু হোক বা তরশু--ঠিক এসে যাবেন।"
    ওনার কথার ভাবে বোঝা মুশকিল যে বদ্রী ওনার আপন বড়ভাই, ওনার সাথে এক ঘরেই থাকেন। রঙ্গনাথ জোরে শ্বাস টানল।
    শনিচর বসে বসেই পা টা লম্বা করল। তারপর শরীরের যে অংশ থেকে বাঁ-পাটা বেরিয়েছে ঠিক সেখানে চামড়ার একটা টুকরোয় চিমটি কেটে চেপে ধরল। ওর চোখ তৃপ্তিতে বুজে গেল। একটু পরে চিমটির জায়গাটায় আস্তে আস্তে হাত বোলাতে বোলাতে ও নেকড়ের মত মুখব্যাদান করে হাই তুলল। তারপর ঝিমধরা স্বরে বলল, "রঙ্গনাথ ভাইয়া শহর থেকে এসেছেন, ওনাকে আর কি বলব? কিন্তু কেউ কোন 'গঞ্জহা'র থেকে দুটাকা তো দূর, একটা কড়ি কেড়ে নিয়ে দেখাক তো?"
    'গঞ্জহা' শব্দটা রঙ্গনাথের অপরিচিত নয়;মানে,গঞ্জ অর্থাৎ শিবপালগঞ্জের নিবাসী।এটা একটা টেকনিক্যাল শব্দ যেটাকে শিবপালগঞ্জের অধিবাসী বেশ সম্মানসূচক টাইটেলের মতন ব্যবহার করে থাকে। আশপাশের গাঁয়ের অনেক 'শান্তির পূজারী'ও কখনো কখনো নীচু গলায় পরামর্শ দেন-তুমি ওর সঙ্গে লাগতে যেয়ো না। জান না তো, ও শালা একজন 'গঞ্জহা'।

    বৈঠকখানার মেজেতে একটি চোদ্দ-পনের বছরের ছেলেও বসে ছিল। দেখলেই বোঝা যায় যে ও সরকারের শিক্ষা-প্রসারের ফাঁদে পা দেয় নি। শনিচরের কথা শুনে বেশ দম্ভের সঙ্গে বলে উঠলো-" শহুরে ছেলেরা বড্ড সিধেসাদা আর সরল । কেউ আমার কাছে টাকা চেয়ে দেখুক তো---" বলে ও হাতটা হাওয়ায় এমন করে ঘোরাতে লাগলো যেন লরিতে একটা বড় হ্যান্ডল লাগিয়ে প্রাণপণে স্টার্ট করতে চাইছে।সবাই হেসে উঠল, কিন্তু রূপ্পনবাবু আরো গম্ভীর।
    উনি রঙ্গনাথকে জিগ্যেস করলেন," তুমি ড্রাইভারকে টাকাটা নিজের থেকে দিলে কি ও ধমকে-ধামকে নিয়ে নিল?"
    রঙ্গনাথ প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "আজকাল তুমি কোন ক্লাসে পড়ছ, রূপ্পন?"
    প্রশ্নটা যে পছন্দ হয় নি, সেটা ওনার চেহারায় স্পষ্ট।
    -" ক্লাস টেন এ। তুমি বলবে সে তো দু'বছর আগেও পড়ছিলে। কি করব, আমি তো শিবপালগঞ্জে এই ক্লাস টেন থেকে বেরোনোর রাস্তাটাই খুঁজে পাচ্ছিনে। তুমি জান না দাদা, এ দেশের শিক্ষাপদ্ধতি বিলকুল বেকার। বড় বড় নেতারা বলছেন। আমিও সহমত। তারপর ধর এই কলেজের হাল-হকিকত, সেসব তো তুমি কিছুই জান না। যত লুচ্চা ছ্যাঁচড়ের আড্ডা হয়েছে।মাস্টারের দল পড়ানো-টরানো ছেড়ে খালি পলিটিক্স করছে। দিন রাত পিতাজীকে তিতি-বিরক্ত করে ছাড়ছে। খালি এটা করো, সেটা করো, মাইনে বাড়াও, আমার ঘাড়ে তেল মালিশ করো। এখানে কেউ পাশ করতে পারে?
    আছে, কিছু নির্লজ্জ ছেলেপুলে আছে, যারা কখনো কখনো পরীক্ষায় পাশ হয়ে যায়, কিন্তু তাতে---"।
    কামরাটার ভেতরে বৈদ্যজী রোগীদের ওষুধ দিচ্ছিলেন। আচমকা ওখান থেকেই বল্লেন," শান্ত হও রূপ্পন! এই কু-ব্যবস্থা শীঘ্র সমাপ্ত হবে।"
    যেন আকাশবাণী হল," শান্ত হও বসুদেব! কংসের বিনাশকারী ধরাধামে অবতরিত হল বলে।" রূপ্পনবাবু শান্ত হয়ে গেলেন। রঙ্গনাথ ভেতরের কামরার দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে বলল, " মামাজী, এই কলেজটার সঙ্গে আপনার কিসের সম্পর্ক?"
    " সম্পর্ক"? কামরার ভেতর থেকে বৈদ্যজীর হাসির প্রতিধ্বনি শোনা গেল।" তুমি জানতে চাইছ এই কলেজের সঙ্গে মামার কিসের সম্পর্ক? রূপ্পন, রঙ্গনাথের কৌতূহল নিবারণ কর।"
    রূপ্পন বড় বিজনেসম্যানের ঢঙে বলল," পিতাজী কলেজের ম্যানেজার। মাস্টারদের কলেজে ঢোকা-বেরনো সব এনার হাতে।"
    রঙ্গনাথের চেহারায় এই কথাটার প্রভাব দেখে আরো বলল," এমন ম্যানেজার পুরো তল্লাটে পাওয়া যাবে না। ভালর জন্যে ভাল, আর হারামীর জন্যে খানদানী হারামী।"
    রঙ্গনাথ এই নতুন খবরটা চুপচাপ হজম করল। তারপর কিছু বলতে হবে বলে বলল," তাহলে কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের কি হবে? মামাজী ওটারও কিছু ছিলেন না?"
    " ছিলেন না, আছেন।" রূপ্পনবাবু একটু চড়া সুরে বল্লেন," উনি ম্যানেজিং ডায়রেক্টর ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।"

    বৈদ্যজী ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।
    ইংরেজ- শাসনের যুগে উনি ইংরেজদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত ছিলেন। দেশি সরকার এলে দেশি শাসকদের প্রতি। উনি অনেকদিনের দেশসেবক। বিগত মহাযুদ্ধের সময় , যখন এই দেশ জাপানী আক্রমণের ভয়ে কাঁপছিল, তখন উনি ফার-ইস্টে লড়ার জন্যে অনেক সেপাই রিক্রুট করিয়েছিলেন। আজকাল দরকার পড়লে নিজের রাজনৈতিক ফ্যাকশনে রাতারাতি অনেক সদস্য ভর্তি করাতে পারেন। আগেও উনি নানাভাবে জনগণের সেবা করেছেন--- যেমন জজের এজলাসে জুরির সদস্য এবং 'অ্যাসেসর' হওয়া, দেওয়ানি মোকদ্দমায় সম্পত্তির রিসিভার হওয়া। ইদানীং উনি কো-অপারেটিভ ইউনিয়নের ম্যানেজিং ডায়রেক্টর এবং কলেজের ম্যানেজার।
    গল্পটা হল উনি এই সব পোস্টে কাজ করতে চান না, কেন না ওনার পদের লালসা নেই। কিন্তু এ'তল্লাটে এইসব দায়িত্বপূর্ণ পদে সাহস করে দায়িত্ব নেবে-এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। আর এলাকার যত নব্যযুবক? সবগুলো গোটা দেশের নব্যযুবকদের মতই অকম্মার ঢেঁকি। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে ওনাকে এই বৃদ্ধবয়সেও এই সব দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে।
    বৃদ্ধবয়স! বৈদ্যজীর জন্যে এই শব্দটি মাত্র পাটিগণিতের ফাঁদে পড়ে করতে হল। কর গুনলে ওনার বয়েস বাষট্টি ছাড়িয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে থেকে দেশসেবায় রত অগুনতি মহাপুরুষদের মত ওনারও বয়স বেড়েছে, উনি বুড়ো হন নি।
    ওই মহাপুরুষদের মত উনিও পণ করেছেন যেদিন মরবেন সেদিনই বুড়ো হবেন, তার আগে নয়। আর সেদিনই মরবেন যেদিন লোকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বে যে সত্যি সত্যি মরে গেছেন। তার আগে নিজেকে জীবিত ধরে নিয়ে দেশসেবা করেই যাবেন।

    সমস্ত বড় পলিটিশিয়ানদের মত উনি পলিটিক্সের মা-মাসি করে থাকেন এবং পলিটিশিয়ানদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন না। গান্ধীজির মত উনিও নিজের রাজনৈতিক দলে কোন পোস্ট নেন নি, কারণ উনি দলের মধ্যে তরুণদের উৎসাহ দিতে চান। কিন্তু কো-অপারেটিভ আর কলেজের ব্যাপারে লোকেরা ওনাকে চাপ দিয়ে বাধ্য করল আর উনি সেই চাপ মেনে নিলেন।
    বৈদ্যজীর একটি পেশা হল কবরেজি। এই পেশায় দুটো ফর্মূলা ওনার একেবারে ঠোঁটের ডগায়; একটা হল ' গরীবের দাতব্য চিকিৎসা ' আর অন্যটা ' রোগ না সারলে পয়সা ফেরৎ'। এই দুই ফর্মূলায় রোগীদের কতটা আরাম হয় তা বলা বাহুল্য, কিন্তু বৈদ্যজী যথেষ্ট আরাম পাচ্ছেন।
    উনি সমস্ত রোগকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন,-- প্রকট রোগ আর গুপ্ত রোগ। প্রকট রোগের চিকিৎসা প্রকট ভাবে হয় আর গুপ্ত রোগের চিকিৎসা গুপ্ত ভাবে। সমস্ত রোগের জন্যে ওনার একটাই থিওরি---সব রোগের মূল কারণ ব্রহ্মচর্য্যের ক্ষয়। কলেজের ছেলেদের কান্তিহীন, শিড়িঙ্গে চেহারা দেখলে প্রায়ই উনি এই থিওরি ঝাড়তে থাকেন । কেউ যদি বলে যে ছেলেদের অপুষ্টির কারণ গরীবি এবং ঠিকমত খেতে না পাওয়া তো উনি ধরে নেন যে ব্যাটা আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্রহ্মচর্য্যের গুরুত্বকে ছোট করে দেখছে। আর কে না জানে যে কেবল চরিত্রহীনেরাই ব্রহ্মচর্য্যের গুরুত্ব মানে না। দারিদ্র ও আধপেটা খাওয়ার কথা যে তুলবে সেই চরিত্রহীন।

    ব্রহ্মচর্য ক্ষয়ের ফলাফল নিয়ে উনি বেশ ভয়-জাগানো লেকচার দিয়ে থাকেন। সক্রেটিস, সম্ভবতঃ ওনাকে কি অন্য কাউকে, বলেছিলেন যে জীবনে তিনের পর চতুর্থবার ব্রহ্মচর্য ক্ষয় করার আগে নিজের কবর খুঁড়ে নেয়া ভাল। এই ইন্টারভিউয়ের উনি এমন ছবির মত বর্ণনা করেন যে লোকে ভাবে সক্রেটিস ব্রহ্মচর্যের ব্যাপারে আজও ওনার অবৈতনিক কন্সালট্যান্ট। ওনার মতে ব্রহ্মচর্য নষ্ট করার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল লোকে পরে চাইলেও নষ্ট করতে পারে না। সংক্ষেপে, ব্রহ্মচর্য নষ্ট করতে হলে আগে ব্রহ্মচর্যকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
    ওনার এইসব লেকচার শুনে কলেজের তিন-চতুর্থাংশ ছেলে জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে গেছল। কিন্তু ওরা যে একসাথে আত্মহত্যা করেনি তার কারণ বৈদ্যজীর ঔষধালয়ের একটি বিজ্ঞাপনঃ
    " হতাশ নবযুবকদের জন্যে আশার বার্তা"।
    এই 'আশা' যদি কোন মেয়ের নাম হত তাহলেও ছেলের দল এতটা উৎসাহিত হত না। কিন্তু ওরা জানে যে এই আশার বার্তা আসছে একটি 'গুলি' থেকে , যেটা দেখতে ছাগলের নাদির মত, কিন্তু পেটে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে শিরায় শিরায় নাচে রক্তধারা।

    একদিন বৈদ্যজী রঙ্গনাথকে চেপে ধরে ব্রহ্মচর্য্যের গুণ বোঝাতে শুরু করলেন। উনি এক উদ্ভট বায়োলজি আওড়ালেন যার হিসেবে কয়েক মণ খাবার খেলে কয়েক ছটাক রস তৈরি হয়। তারপর রস থেকে রক্ত, রক্ত থেকে আরো কিছু, এই ভাবে চলতে চলতে শেষে গিয়ে এক ফোঁটা বীর্য তৈরি হয়। উনি প্রমাণ করে ছাড়লেন যে এক ফোঁটা বীর্য বানাতে যা খরচ হয় সেটা একটা অ্যাটম বোমা বানানোর খরচকেও ছাড়িয়ে যায়। রঙ্গনাথের বোধোদয় হল যে এ পোড়ার দেশে অমূল্য কিছু রয়েছে তো তা হল বীর্য। উনি বললেন যে বীর্যের অনেক শত্রু, সবাই চায় অন্যের বীর্য লুঠ করতে। কোন রকমে যদি তোমার বীর্য রক্ষা করতে পারো, তো ধরে নাও যে তোমার চরিত্র বেঁচে গেল।
    বোঝা গেল যে আগে হিন্দুস্থানে বীর্যরক্ষার ওপর খুব জোর দেয়া হত। একদিকে ঘি-দুধের নদী বয়ে যেত, তো অন্যদিকে বীর্যের। লেকচারের শেষে উনি একটি সংস্কৃত শ্লোক শোনালেন যার অর্থ হল -- এক ফোঁটা বীর্যের পতন হলে মানুষ মরে যায়, কিন্তু এক ফোঁটা তুলে নিতে পারলে জীবন ফিরে পায়।
    সংস্কৃত কানে যেতেই শনিচর হাতজোড় করে বলে উঠলো---" জয় ভগবান কী!"
    ও মাথা নুইয়ে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা ও আবেগের বশে নিজের পশ্চাৎদেশকে প্রায় ছাতের দিকে উঁচু করে তুলল। বৈদ্যজী আরো বার খেয়ে রঙ্গনাথকে বললেন," ব্রহ্মচর্য্যের কথা নিজের মুখে কি বলব! কিছুদিন যাক, আয়নায় মুখ দেখলে নিজেই বুঝতে পারবে।"
    রঙ্গনাথ মাথা নেড়ে ভেতরবাড়িতে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো। মামার এই স্বভাবের কথা ও আগে থেকেই জানত। দরজার পাশে রূপ্পনবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। রঙ্গনাথকে ফিসফিসিয়ে বললেন," চেহারায় কান্তি আনার জন্যে আজকাল ব্রহ্মচর্য্য লাগে না। ক্রিম-পাউডার লাগালেই কাজ হয়ে যায়।"

    --------------------********-------------------------
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২২ জুন ২০১৬ | ২৪৮৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন