আমরা বাচ্চারা ফুটপাথ আর গলির মুখে চার আনার রবারের বল নিয়ে ক্রিকেট খেলায় মশুগুল। ব্যাট করছে নীচের তলার আখতারদা -- নিলোফারের ছোড়দা -- ক্লাস এইটে পড়ে। বল করছি আমি, ক্লাস টু। লোপ্পা বলটায় আখতারদা এমন মারলো যে রাস্তা পেরিয়ে সার্কাস হোটেলের বারান্দায় শিককাবাব তৈরির উনুনের পাশে গিয়ে পড়লো। ওরা গেল খেপে, বল আটকে রেখে দিল। আখতারদা গিয়ে কীসব বলে নিয়ে এল বটে, কিন্তু তারপর ব্যাটটা অভিজিতের হাতে দিয়ে নিজে বল তুলে নিল। ... ...
কিশোর কবি সুকান্ত এসব ছড়া লিখেছিলেন সম্ভবতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলিতে বেলেঘাটায় বসে। আমাদের বাড়িতে রেডিও এল ১৯৫৭ সালে, তখন ক্লাস টু’তে পড়ি। এর আগে কাকারা রেডিও ভাড়া করে আনতেন মহালয়ার একদিন আগে, বাড়ির সবাই ভোর চারটেয় উঠে ‘শ্রীমহিষাসুরমর্দিনী’ শুনবে যে! সেটা আসলে কালীবাবুর ইলেক্ট্রিকের দোকানে তৈরি লোক্যাল সেট, খালি কোলকাতা ক’ স্টেশন শোনা যায়। ... ...
বুড়ার গেস্ট হাউসে জায়গা নেই, কারণ দুটো মাত্র ঘর। সে দুটোয় আমি এবং দুই বাঙালি দিদি আগে থেকেই রয়েছি। তাই আমার বস কোসলে স্যার আর বিলাসপুরের এসপি মিঃ শ্রীবাস্তব রাজবাড়িরই একটা ঘরে আস্তানা গেড়েছেন। ওঁরা সন্ধ্যেবেলা পৌঁছে আগে কুমারসাহেব এবং থানেদার ঈশ্বর পান্ডের সঙ্গে কথা বলে সব শুনে নিয়েছেন। জবানবন্দীর ফাইলের এক সেট কপি এখন ওনাদের কাছে। বডি রয়েছে বুড়ারের সরকারি হাসপাতালের মর্গে। সেখানে পাঠানোর আগে থানেদার ঈশ্বর পান্ডে বডি যে অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিল তার ছবি তুলে নিয়েছেন। হাসপাতালের ডাক্তার রক্তের স্যাম্পলও নিয়েছে। ... ...
সুজিত ডাক্তার চোঁয়া ঢেঁকুরের রুগী দেখতে এসে আধঘন্টার মধ্যে লিভার ক্যান্সার প্রেডিক্ট করে "খুবই ভয়ের ব্যাপার" বলে শেষ করেছেন। সেই থেকে ভিড় জমে গেছে সান্যালের আঙিনায়; গুমরে-ডুকরে বিলাপ উঠছে -- ডাক্তারবুড়োর সহজ কালমেঘের অঙ্কে যে সমস্যা মিটতে পারতো, এখন মনে হচ্ছে অঙ্কলজিস্ট ছাড়া গতি নেই। মুড়িমাসিও নাকিসুরে কেঁদে বললো, তার মুড়ির ধুলো চোখে ঢুকে করকর করছিল, সুজিত ডাক্তার দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক ঝলক দেখে নাকি বলেছে, রেটিনা ফেটে গেছে। ... ...
বেলা ১টা নাগাদ পৌঁছে গেছিলাম কার্জন পার্কে। সে এক উৎসবের মেজাজ সারা পার্কটাকে ছেয়ে ফেলেছে। জায়গায় জায়গায় গোল হয়ে বসে গেছে গানের দলগুলো। এখানে অরণি তো ওখানে মাস সিংগার্সের বন্ধুরা। ওদিকে উত্তরপাড়ার ইউনিট থিয়েটারের (যারা ‘হচ্ছেটা কী’ আর ‘লাশ বিপণি’ করত) বন্ধুরা নাটকের একটা বিশেষ অংশের মুভমেন্টগুলো ঝালিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আরএকজন একটা আশ্চর্য মূকাভিনয় করে দেখাচ্ছে - প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে সামনের দিকে কিন্তু আসলে পেছনে হাঁটছে - ইন্দিরার ‘প্রগতিশীলতার’ আসল চেহারা। ... ...
ছোটবেলায় কাজ ছিল, নতুন নতুন রাস্তায় গিয়ে সে রাস্তার নাম দেওয়া দেশের মতো করে। তখন মাথায় সবে সবে কলম্বাস! একটা কানাগলির নাম ছিল বারান্দাপুরী, সে গলির বাড়িগুলোর বারান্দা আমরা কিনে নেব। ঝিলের পাশের যে ঘরোয়া আলোছায়া রাস্তা, তার নাম দি রেখেছিল দীঘিনগর। এই দীঘিনগর নাকি অভিশপ্ত। দীঘিতে যারা যারা আজ অব্দি ডুবে গেছে, রাত্রে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁলে জলে নাকি আজও বুদবুদ ওঠে, জলে কি যেন ভেসে ওঠে … ... ...
ফুলবানু বাস-টারমিনাল এলাকাতে থাকতেই পছন্দ করে। বাস-টারমিনালে ঢুকতে দশ টাকা দিতে হয় বটে, তবে এখানে আয় ভালো। কল্যাণপুর থেকে শত শত বাস ছেড়ে যায়। কিন্তু ওখানকার মানুষগুলো দান-খয়রাতে তেমন পটু না। হাতটা বড়িয়ে দিলেই রেগে যায়। গাবতলী বাস-টারমিনালই তার পছন্দ। এখানকার মানুষগুলোর বেশভূষা দেখলেই বোঝা যায় এরা কল্যাণপুরের মানুষগুলোর চেয়ে অর্থবিত্তে কমা। তবুও এরাই বাসে ওঠার আগে না হলেও দু’ টাকা দেয়। জ্ঞান হওয়া অবধি সে এখানেই। ... ...
মজার ছলে লেখা অসামান্য এই গল্পগুলি জীবজন্তুকে অন্যভাবে দেখতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মাত্র চার বছর, ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত সময়ে তাঁরা কর্ফু দ্বীপে ছিলেন। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই জন্ম দিয়েছিলো ভবিষ্যতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষক জেরাল্ড ড্যারেল-এর। সুদূর ১৯৫৬ সালে লেখা এই বইটিকে আজও সাধারণ পাঠকের পক্ষে পশুপ্রেম ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রথম পাঠ বলা যেতে পারে। ... ...
কাউন্সেলিং নিয়ে ভাবনা আমার ছিলই নিজের সেক্সুয়্যালিটি নিয়ে বুঝতে পারার সময় থেকেই, আমার প্রথম সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সেটা কতটা প্রয়োজন হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম, কেননা অন্য যৌনতা যাপন তখন আজকের মত সবাইকে বলা যেতনা , আজও অনেকেই বলতে পারেনা। এর সঙ্গে যোগ হল এইচ আই ভি যাপন। বুঝলাম আমাদের মত মানুষের পাশে পজিটিভ ভাবে থাকাটা আমার মত পজিটিভ লোকের ভীষণ জরুরি। আর তাই তো মনখারাপ, বিচিং বা কোনও নেগেটিভ ভাবনাকে পাত্তা না দিয়ে সবসময় ভাল থাকার অভিনয় করতে করতে কখন যেন ভালো থাকাটাই অভ্যেস হয়ে গেছে আমার । ভাল থাকা একটা আর্ট। ওটা রপ্ত করলেই হয়। আমি জানি জাতকের গল্পের মত একমুঠো সর্ষে কারও কাছে পাবনা যার খারাপ থাকা নেই। নিজেকে বোঝাই আমার মাথার ওপর বর্ষায় ছাদ আছে, দু'বেলা পেটপুরে খেতে পাই, শীতে গায়ে গরম পোষাক দিতে পারি, তাই বাকী দুঃখ নিয়ে ভাবনাটা বিলাসিতা! ... ...
আমার একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। যার বেশীরভাগ প্রবন্ধই এই ব্লগে প্রকাশিত। সেই বই বিষয়ে দু'চার কথা ভাগ করে নিলাম আমার পাঠকদের সাথে। নিজের বই নিয়ে ফেসবুক জাতীয় সমাজমাধ্যমে আলোচনা করাটাই রীতি। কিন্তু আমি ফেসবুক বা অন্য প্রচলিত সমাজমাধ্যম থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছি। গুরুচন্ডালিই আমার একমাত্র মাধ্যম নিজের কথা বলার জন্য। আশা করি নিজের ব্লগে, নিজের বই নিয়ে লেখা একটু রীতি বহির্ভুত হলেও নীতি বহির্ভুত বলে বিবেচিত হবে না। ... ...
আচ্ছা, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এই যে আমাদের এত কান্নাকাটি, এইটা আদৌ করছি কেন আমরা? শুধুই ওটা আমাদের সংবিধানে সসম্মানে উল্লিখিত আছে বলে? শুধুই কি এই কারণে যে, পশ্চিম একে এক অবশ্য-পালনীয় আদর্শ বলে মনে করে, এবং আমরা পশ্চিমকে অনুকরণ করতে ভালবাসি? শুধুই কি এই কারণে যে, ওর মধ্যে ‘নিরপেক্ষতা’ কথাটা আছে এবং সেটা শুনতে বেশ চমৎকার লাগে? ... ...
কোত্থেকে যে শুরু করব বুঝতে পারছি না। গত ৪৮ ঘন্টা, মানে পরশু বুড়ার স্টেশনে নামার সময় থেকে এখন অব্দি যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে। এইটুকু বলে দিই যে ছিন্নমস্তা দেবীর পুজো তো নয় যেন দক্ষযজ্ঞ! তাতে বলি চড়েছে একাধিক প্রাণী। যেমন আমি, যেমন ওই দুই বাঙালি দিদি। আমাদের টিকিট ফিকিট গেছে চুলোয়। বুড়ার থানার ওসি’র নির্দেশে আমরা তিনজন আগামী আদেশ পর্য্যন্ত বুড়ারের বাইরে যেতে পারব না। বলতে গেলে একরকম নজরবন্দী। কারণ যুবরাজ বীরেন্দ্রপাল প্রতাপ সিংহ হত্যায় আমরা তিনজনই স্থানীয় পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। ... ...
গত ৫ তারিখে হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মারা গেলেন স্ট্যান স্বামী; ৮৪ বছরের এক বুড়ো, যার পার্কিনসনগ্রস্ত হাতে জলের গেলাস ধরা মুশকিল, চামচ ধরে রাখতে পারেন না, লেখা বা টাইপ করা তো দূরের কথা। আদালত মেডিক্যাল রিপোর্ট থেকে জেনেছে যে উনি কানেও কম শুনছেন, চোখে দেখেছে যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অভিযুক্ত লোকটি একজন দুর্বল অশক্ত বৃদ্ধ। তবু তার জামিনের আবেদন বারবার খারিজ হয়। ... ...
লরার সাথে আমার আলাপ হয়েছিল নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে এক শীতকালীন সেমেস্টারে; আমরা দুজনেই কনভেক্স অপ্টিমাইজেশনের একটা কোর্স নিয়েছিলাম আর কোর্স প্রজেক্টে আমি ছিলাম ওর পার্টনার। লরা এসেছিল এল.এ. থেকে। নিউইয়র্কের শীত আমি পছন্দ করিনা, সে প্রায়ই বলত। ... ...
একটা রক্তজমানো চিৎকার অন্ধকারকে খান খান করে দিল। আবার, আবার! তারপর সব চুপ। দু’সেকেন্ড। পকেট থেকে রিভলবার বের করে আমি দৌড়ুতে থাকি যুবরাজের আবাসের দিকে। চিৎকারটা ওদিক থেকেই আসছে, প্রথম আওয়াজটি স্পষ্টতঃ কোন নারী কন্ঠের। ... ...
ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিএম নেতা মানিক সরকার যদিও প্রচারে এসে তাঁর বক্তব্যে বার বার সাবধান করেছেন যে, বিজেপির ক্ষমতায় আসার মারাত্মক ভুল যেন না করা হয়। কারণ, ত্রিপুরার মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন যে, বিজেপি ক্ষমতায় বসলে মানুষের কি পরিমান সর্বনাশ হয়। অমর্ত্য সেন সহ বহু বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞ পন্ডিত মানুষেরা সবাই বিজেপিকে প্রতিহত করাই প্রধান কর্তব্য বলে বার বার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ভবি যে ভুলবার নয় এবং চোরের সাক্ষী মাতালের মতো জুটে গেল রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব। ... ...
বিভিন্ন সময়ে শুরু থেকেই পশ্চিমবঙ্গে এল জি বি টি সংগঠনগুলোর মধ্যে আর্থিক অনুদান পাওয়া নিয়ে রেষারেষি ছিলই। তখনও ভারতবর্ষে ৩৭৭ বিদ্যমান।এল জি বি টি ইস্যুতে আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাও তো তখন অনেক কম ছিল। এমনকি যে সংগঠন তথা নেটওয়ার্কটায় আমার কর্মজীবনের শুরু, আর্থিক সহায়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাতারাতি তা তৈরির ইতিহাসেও একে অন্যকে বঞ্চিত করার মতো অনেক “কালিমাযুক্ত ঢাকঢাক গুড়গুড়” ছিল যে পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গে এল জি বি টি সংগঠনগুলোর মধ্যে আর কখনো সদ্ভাব তৈরী হলো না। এমনকি আজ যে এল জি বি টি কমিউনিটির মানুষ একে অন্যকে বিশ্বাস করেননা তার কারণও এর পিছনেই নিহিত আছে বলে আমি মনে করি। আর তাই " না আঁচালে বিশ্বাস নেই" এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী ছিলাম সকলেই কমবেশি। অথচ এইচ আই ভি এডসের বাইরে গিয়ে, সংগঠনের জন্য সরাসরি আর্থিক সহায়তা আসুক এটা আমরা সকলেই চাইতাম। ... ...
নারী, পুরুষ, ছেলে, বুড়ো সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে ,কাঁদছে, আর্তনাদ করছে, ছবি তুলছে, শেয়ার করছে, লাইক দিচ্ছে ,কমেন্টস করছে কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করছে না। ... ...
সকলের এক একটি বহ্নি আছে। সকলেই সেই বহ্নিতে পুড়িয়া মরিতে চাহে। সকলেই মনে করে সেই বহ্নিতে পুড়িয়া মরার তার অধিকার আছে। “ কেহ মরে, কেহ কাঁচে বাধিয়া ফিরিয়া আসে”। ... ...
বাজার করাটা নিঃসন্দেহে একটা শিল্প। তাতে বিশেষ কারিগরি দক্ষতা লাগে, ইচ্ছা লাগে, ধৈর্য লাগে, বুদ্ধি, দুষ্টবুদ্ধি লাগে, অতি দ্রুত অঙ্ক-কষার ক্ষমতা লাগে। বাপরে, এত কিছু যদি আমার এই এক দেহতেই থাকে, তাহলে বাজার কেন করব বাপু, অ্যাষ্ট্রনট হব, চাঁদে যাব, মঙ্গলে যাব। কিন্তু তা বললে চলবে কেন? বাজার অতি বিষম বস্তু, না করলে পেটে কিছু পড়বে না, তবে কিনা যাঁরা গৃহিণী নিয়ে ঘর করেন তাঁদের অবশ্য পেটে না পড়লেও পিঠে ঠিক পড়বে। ... ...