এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  জাদু দুনিয়া

  • ভীমবেটকা

    দীপাঞ্জন মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | জাদু দুনিয়া | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ৬৬২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার এই মালওয়া এলাকায় প্রাচীনকাল থেকে গোন্দ এবং ভীল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। হাজার বছর আগের পারমার বংশের রাজা ভোজের তৈরী বাঁধ ভোজপাল থেকে অপভ্রংশে বর্তমানে ভোপাল। ভোজের সময়ে বাস্তু শাস্ত্রের ওপর সংস্কৃতে লেখা 'সমরাঙ্গন সূত্রধর' তৎকালীন ভারতীয় স্থপতিদের ম্যানুয়াল ছিল। শহরের পরিকল্পনা এবং মন্দির, বাড়ির নকশা, মূর্তিশিল্প, ছবি আঁকা, কাঠের কাজ, ইঁট পাতার কায়দা এইসবের ওপর বিশদে লেখা আছে সে বইতে।

    শেষ গোন্দ রাজা নিজাম শাহর স্ত্রী ছিলেন রাণী কমলাপতি। কমলাপতি মারা যাবার পর আফগান দোস্ত মহম্মদ খান ভোপালের রাজপাট দখল করলেন সতেরোশতে। তারপর মারাঠারা এবং বৃটিশরা মালওয়াতে এসেছে। একসময় শুরু হয় নবাব বেগমদের বংশের রাজত্ত্ব। ভোপালের শেষ নবাব হামিদুল্লা খানের সময় ভোপাল রাজ্য স্বাধীন ভারতে যোগ দেয়। ১৯৮৪ তে ইউনিয়ন কার্বাইডের গ্যাস লিক করে বেসরকারি হিসেবে শহরের পনেরো হাজারের কাছাকছি মানুষের মৃত্যু এবং অসংখ্য মানুষের অন্ধ এবং সারাজীবনের মত পঙ্গু হয়ে যাওয়া। কারখানা চত্ত্বর ধ্বংসস্তুপ বহুদিন। চল্লিশ বছর হতে চলল। ভোপাল জংশন থেকে দূরে হাবিবগঞ্জ স্টেশনকে নতুন করে গড়ে তুলে নাম দেওয়া হয়েছে রাণী কমলাপতির নামে। নিজামুদ্দিন রানী কমলাপতি এসএফ এক্সপ্রেস, বন্দে ভারত এইসব দূরপাল্লার ট্রেন সেই চকচকে স্টেশনে থামে।

    সকালবেলা ট্রেন ভোপাল জংশন ঢোকার একটু আগে থেকেই দুদিকে দেখা যায় আগাছার জঙ্গল। পরিত্যক্ত সমস্ত বাড়ি। এই সেই কারখানার শ্রমিকদের থাকার জায়গা ছিল এককালে। রানী কমলাপতি স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম একের দিকে এখন মেট্রো বানানোর কাজ চলছে। পেছন দিকে প্ল্যাটফর্ম পাঁচের দিক দিয়ে যাবতীয় অটো, ওলা, উবার যাত্রী ওঠানো নামানো করছে। সকাল সাতটায় সেই গেট দিয়ে বেরোতে দেখি সামনে চায়ের দোকানের সারির পিছনে বুলডোজারে টাটকা ভাঙা কংক্রিটের ঝুপড়ির ধংসস্তুপের মাঝে মাঝে মাটিতে উঁকি দিচ্ছে তাদের টিভির ডিশ এন্টেনাগুলো।

    এই দিকের গেটের একটু পাশেই ভোপাল ইন্টারস্টেট বাস স্ট্যান্ড। সোজা জাতীয় সড়ক ৪৬ চলে গেছে ওবাইদুল্লাগঞ্জ হয়ে সাতপুরা জাতীয় উদ্যান, পাঁচমারি ইত্যাদি হয়ে হোসাঙ্গাবাদের দিকে। ওবাইদুল্লাগঞ্জের পরেই ডানদিকে কিছুটা বেঁকে গিয়ে বিন্ধ্য পর্বতের কোলে রাতাপানী ব্যাঘ্র প্রকল্পের মধ্যে ভীমবেটকা। মহাভারতের ভীম বনবাসের সময় নাকি কিছুদিন এখানে ছিলেন, সেই ভীমের বৈঠক থেকে জায়গার নাম স্থানীয়দের মতে ভীমবেঠকা। ভীমের জন্য নয়, জায়গাটা আদিম মানুষদের গুহাচিত্রের জন্য বিখ্যাত। আদিম মানুষ এখানে গুহায় রাত্তিরবেলা থাকত, সকালবেলা বাইরে বেরিয়ে শিকার করত, হান্টার গ্যাদারার তারা চাষবাস শেখেনি তখনও। একসময় তারাই সেখানকার পাহাড়ের আশ্রয়গুলোর দেওয়ালে আঁকতে শুরু করে। প্রথমে সরলরেখায়। কাঠির মাথায় আলুর দম। আলতামিরায় বা ফ্রান্সের ল্যাসকো, শোভে ইত্যাদি মাটির তলার গুহাগুলোতে রঙিন টানা স্কেচের মত যেসব ছবি দেখা যায় তার থেকে ভীমবেটকার ছবি অনেকটা আলাদা। দশহাজার বছর আগে তারা জ্যামিতি না জানলেও পরিষ্কার ত্রিভুজ, বর্গক্ষেত্র ইত্যাদি আঁকতে পারত। ভীমবেটকা ছাড়াও এই রকম নব্য প্রস্তর যুগের গুহাচিত্র পাওয়া গেছে আশেপাশের সাতধারা, জাওরা এবং পাঁচমারিতে।

    স্পেনের আলতামিরায় এখন দিনে তিনজনের বেশি পর্যটককে ঢুকতে দেওয়া হয়না। ট্রেন লাইন পাশ দিয়ে গেলেও সেই যুক্তি দেখিয়েই এ এস আই ভীমবেটকায় আলাদা ট্রেন স্টেশন গড়তে বারণ করেছে যাতে এটা জনতার দরবার না হয়ে যায়।
    ১৯৫৭ সালে বিষ্ণু শ্রীধর ওয়াকঙ্কর ট্রেনে করে যাবার সময়ই দূর থেকে দেখে কৌতূহলী হয়ে জায়গাটায় আসেন। তিনি এই অঞ্চলের গুহাগুলোকে সাতটা সময়কালে ভাগ করেছেন, সবথেকে পুরোনোটা আপার প্যালিওলিথিক, আদি প্রস্তর যুগ মানে ৪০০০০ বছর আগেকার। এছাড়াও মেসোলিথিক, চ্যালকোলিথিক এবং আদি এবং মধ্যযুগীয় গুহা আছে। হোমো ইরেকটাস বসবাসের চিন্হ পাওয়া গেছে এক লক্ষ বছর আগেকার। একটা আশ্রয়ের ছাদে পাওয়া গেছে 'Dickinsonia' বলে সুপ্রাচীন প্রাণীর জীবাশ্ম। সর্বশেষ এক সময় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা থাকতেন, তাদেরও শিলালিপি, ছোট স্তুপ ইত্যাদি পাওয়া গেছে।

    নিরালা জাতীয় সড়ক। ওলা আউটস্টেশনে আসা যাওয়া মিলিয়ে মোট ষোলোশো টাকা গচ্চা।


    ট্রেনের লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে ভীমবেটকার জঙ্গলের এলাকা শুরু।

    হেমাটাইট থেকে পাওয়া লাল ওকরা (ochre) আর চুনাপাথর থেকে পাওয়া হলুদ রঙ। তাদের সঙ্গে গাছের রস থেকে পাওয়া আঠা, পশুর চর্বি, জল ইত্যাদি মিশিয়ে হাতের আঙ্গুল বা গাছের ডাল কালি হিসেবে ব্যবহার করে দাঁড়িয়ে বা বসে আঁকা। অনেকগুলো ছবিতে আবার সাদার ওপর লাল রঙের আঁকা সুপারইম্পোজ করা হয়েছে। লাল রঙের আঁকাগুলো তুলনায় নতুন। সাদাগুলো পুরোনো। মানে পুরোনো আঁকা গুলোর ওপর দিয়েই নতুন আঁকা এঁকেছে আদিম জনতা। পাথরের আশ্রয়ের আড়ালে আঁকা বলে ঝড় বৃষ্টিতে অনেক আঁকাই এতদিন রয়ে গেছে। তবে আস্তে আস্তে মলিন হয়ে আসছে কিছু কিছু জায়গায়।

    অনেকগুলো পাহাড়ের পাঁচশোর ওপর গুহা জুড়ে এই সব আঁকা ছড়ানো হলেও দর্শকদের দেখার জায়গাটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কাঁটাতারে ঘেরা। সেখানে পনেরোটা গুহা নিয়ে একটা পরিক্রমণের পথ তৈরী করা হয়েছে।



    ১ম আশ্রয়ের ছাদের আঁকায় ছোট হাতিটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ যার একহাতে একটা দন্ড অন্যহাতে বর্শা। কোমরে তরবারী। একটু দূরে একজন শামান দাঁড়িয়ে আছে দন্ড হাতে। ভীমবেটকার ছবিগুলোতে একজন করে শামানের অস্তিত্ত্ব প্রায়ই দেখা যায়।

    কিন্তু এটুকুই সব নয়। এই ছবিতে আরো আছে হাতিওয়ালার ওপরে বাঁদিক ঘেঁষে ভাল করে দেখুন দুই ঘোড়াওলার ছবি। তাদের নিচে লাল রঙে আঁকা দুটো ফিগার ও আছে, যদিও অস্পষ্ট।

    ৩য় আশ্রয় অডিটোরিয়াম গুহা নামে খ্যাত। এই গুহাতে সবাই সমবেত হত এবং উঁচু পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে তাদের নেতা বক্তৃতা দিত।

    বক্তৃতা দেওয়ার উঁচু পাথরটার গায়ে এরকম গর্ত করা আছে যেগুলো একলক্ষ বছরের পুরোনো cupules, সেই সময়কার মানুষের প্রথম কোনো সংকেত বোঝানোর মাধ্যম/প্রাগৌতিহাসিক শিল্পকলার চিহ্ন বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন।



    এই গুহাতে এক প্রাগৌতিহাসিক যুগের বাচ্চার হাতের ছাপও পাওয়া গেছে

    তৃতীয় গুহায় আরো কয়েকটি পশুর ছবি। একদম ওপরে একটা ময়ূরের ছবি।

    একটা জিনিস বলে রাখা দরকার। এই পর্বের অনেকগুলো আঁকার ছবি জুম করে তোলা। আসলে ছবিগুলো কিন্তু এতটা সামনে বা কাছে নয়। অনেক সময় মাথার অনেকটা ওপরে কোনো বেখাপ্পা জায়গায়, ভালো করে না খুঁজলে দেখতে পাবেন না।

    যেমন এই ছবিটা হচ্ছে জুম না করে তোলা সাধারণ ছবি।


    তিন নং আশ্রয়ে আদিম মানুষের কবর। এখানে খুঁড়ে তাদের হাড়ের গুঁড়ো, মাইক্রোলিথ ইত্যাদি পাওয়া গেছে।


    সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোলিথের বিবর্তন

    ৪ নং আশ্রয়ে আছে বিখ্যাত চিড়িয়াখানা পাথর। ছবিতে ষোলোটা বিভিন্ন প্রজাতির ২৫২ টা জন্তুর রেখা আঁকা আছে। নিচে লাল আঁকাটা এক রাজকীয় শোভাযাত্রার।


    জুম করে এই ছবিতেও ডানদিকে ওপরে দেখুন হাতির ওপর মানুষ। এছাড়াও ছবির মাঝামঝি দেখুন নিচের মানুষের ছবিটা আছে -



    পাশে আরেকটা আশ্রয়ে শামানের ছবি। দুটো ত্রিভুজ দিয়ে লাল মানুষ আঁকা হয়েছে।

    ভীমবেটকার পুরো পার্ক এইরকম সব অদ্ভুতদর্শন পাথর দিয়ে ভর্তি। বিন্ধ্যাচলের পাললিক বেলেপাথর গুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে হতে অর্থো কোয়ার্টজাইটে পরিণত হয়েছে।

    এক জায়গায় গিয়ে পথ দুভাগ হয়ে যায়

    ভীমবেটকার আরেকটা বিখ্যাত পাথর। নিচের ওই খোঁদলটার ছাদে এবং দেওয়ালে ছবি আঁকা আছে। এছাড়াও ওপরে ডানদিকে যে কার্ণিশটা আছে, তার ভেতর আঁকা আছে নিচের বিখ্যাত ছবিটা -


    হাল্লা চলেছে যুদ্ধে



    খোঁদলের ভেতরের দেওয়ালের ছবি




    খোঁদলের ছাদের শামানের ছবি। সম্ভবত পশুবলি হচ্ছে। যেভাবে শুয়ে এই ছবি তোলা, সেভাবেই শুয়ে শুয়ে আদিম মানুষ এই ছবি এঁকেছিল।

    সুপারইম্পোজ করা ছবির উদাহরণ




    এই ছবিতে আছে লাল এবং সাদা ছাড়াও হলুদ রঙের ব্যবহার। শামান একটি ঘোড়াকে নির্দেশ দিচ্ছে। ঘোড়াটি একেবারে নিখুঁত আঁকা।


    হাতি


    ছবি নেই, শ্যাওলা রয়েছে


    ভীমবেটকার আদিম বাস্তুতন্ত্রের এক নিদর্শন। Kari গাছের একটা কালো ডালে একটা সবুজ papda গাছ গজিয়েছে।

    ভীমবেটকার জঙ্গল থেকে স্থানীয় অধিবাসীরা ফুল, ফল ছাড়াও ভেষজ ওষুধ এবং মহুয়া ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এছাড়াও তাদের অনেকে এই পার্কে সাফাইকর্মী, নিরাপত্তা রক্ষী, বনকর্মী ইত্যাদিদের কাজ করে।


    এই তেরো নং আশ্রয়ের ছবির ওপরের দিকে পাথরের কাটা দাগের নিচেই দেখুন মাছের কাঁটার মত চারটে প্রাণী। ওগুলো আসলে চারটে চিতল হরিণ পাহাড় থেকে নেমে আসার ছবি বোঝানো হয়েছে।

    বর্গক্ষেত্র দিয়ে একটি বরাহ বোঝানো হয়েছে। নিচের ল্যাজওয়ালা প্রাণীর ছবিটাও একটা বরাহের।

    এই ছবিটা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। এখানেও ওপরে বাঁদিকে শামানকে দেখতে পাবেন। সবাই পশুশিকারে ব্যস্ত।


    পাথরের কার্নিশ


    এই ছত্রাকের মত দেখতে পাথরটা বরাহ পাথর হিসেবে বিখ্যাত।

    জুম করে বরাহ পাথরের গায়ে এক মিথিক্যাল জন্তুর মানুষকে তাড়া করার ছবি। প্রাণীটির মাথার বেঁকানো শিং নাকের কাছে লোম দেখে বরাহ বলেই মনে করা হয়। কিন্তু আয়তন মস্ত বড়। পালিয়ে যাওয়া মানুষটি ছাড়াও আরো দু তিনজন মানুষ পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে।


    ঘোড়সওয়ারের দুহাতে অস্ত্র। মাথার ওপরের ক্রসটা মনে হয় চাঁদ বা কোনো পাখি।

    গাছ এবং পাথরের সহাবস্থান।

    কোথাকার তরবারি, কোথায় রেখেছে


    যুদ্ধের ছবি

    ঘোড়সওয়ারদের লাইন। দুটো ত্রিভুজ দিয়ে প্রথমে ডমরুর মতন আঁকা হয়েছে। তারপর তাতে পা, মাথা, ল্যাজ জুড়ে ঘোড়া বানানো হয়েছে। দশহাজার বছর আগেকার পাকা শিল্পীর কাজ।

    ৬ নং আশ্রয়ের গায়ে আদিম নাচগানের ছবি। ঢোল নিয়ে বাজনদার, বাকিরা হাতে হাত ধরে নাচছে।

    পশু

    ফেরার সময় ক্যাব চালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাকে মাসে ব্যাংককে পঁচান্ন হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয় তিনটে গাড়ির জন্য। যেখানেই যাই সব অটো, ক্যাব, টাঙাওয়ালাদের একই গল্প। সবাই করোনাকালে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করেছেন, এখন সুদে আসলে মেটাচ্ছেন। সবাই বলেন ওলা মানি হলে যাবো না, যাত্রাশেষে ক্যাশ দিন বা ইউ পি আই করুন। সাঁচীর সেই অটো চালকের মত ইনিও ভীমবেটকায় স্কুল পাশ করে যাবার পর একবার এসেছিলেন, তারপর আর আসা হয়নি।

    ওলা আউটস্টেশন যেখান থেকে তোলে সেখানেই নামায়। সেদিন আবার সেখানে বায়ুসেনার আকাশে কুচকাওয়াজ, উল্টে পাল্টে যাওয়া ইত্যাদি কেরামতি দেখানো হচ্ছিল যা আগে থেকে জানতাম না। নেমে যাকেই জিজ্ঞেস করি কমলা পার্ক বা তাজ উল মসজিদ যাবে কিনা, সবাই বলে ওদিকে ভিড় ভাট্টা আছে, সকালে এয়ার শোর পর এখন সবাই বাড়ি, হোটেল ফিরছে, ওদিকে যাবো না। শেষে বুদ্ধি খরচ করে তার নীচে আদিবাসী সংগ্রহশালায় চলে এলাম। ভোপাল রাজ্য সংগ্রহশালা এবং মধ্য প্রদেশ আদিবাসী সংগ্রহশালার পিছনেই আছে বন বিহার জাতীয় উদ্যান। এই আসার রাস্তার মাঝখানে রেলিং দিয়ে আলাদা করা দুলেনের ভোপাল বাস ড়্যাপিড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, অমৃতসরের মেট্রোবাস সিস্টেমের আদলে। ওই মাঝখানের লেনে অন্য কোনো গাড়ি চলেনা।


    লাল দাগ দেওয়া জায়গাটা রাণী কমলাপতি স্টেশন। বড় আর ছোট তালাওয়ের মাঝে বাঁধের রাস্তার পাশে সবুজ জায়গাটা কমলা পার্ক।

    ভোপাল শহরটার এদিকে প্রচুর গাছ। এছাড়া বড় এবং ছোট তালাওয়ের জন্য চারদিকে গরম হলেও এই শহরটায় একটা ঠান্ডা আমেজ থাকে।

    আদিবাসী সংগ্রহশালায় ঢুকতে কুড়ি টাকা। ছবি তোলার টিকিট আলাদা তাই ছবি তোলা হয়নি। ঢুকে প্রথমেই আছে নানারকম জাতিগোষ্ঠীদের বাড়িগুলোর বড় বড় নকল মডেল। যার মধ্যে ঢুকে ঘুরে বেড়ানো যায়। তারপর আছে আদিবাসীদের নানারকম উপকথার থিমের ওপর নির্ভর করে আদিবাসী শিল্পীদেরই তৈরী নানা ইনস্টলেশন। ইনস্টলেশনগুলোর ছবি নেটে, গুগুল ম্যাপে পেয়ে যাবেন।
    গোন্ডদের বাড়িতে যেমন লিল্লার কোঠি বলে একটা গোলা থাকত, যেটা মূলত মাটি, বাঁশ, গোবর দিয়ে তৈরী শস্যভাণ্ডার।

    ভীল জনগোষ্ঠীর বাড়িগুলো দুভাগে বিভক্ত - ওহারিওয়ালাতে রান্না হয়, এছাড়াও সেখানে ঘিনচারী বলে একটা কাঠের লম্বা পবিত্র স্তম্ভ থাকে যেখানে বাড়ির কূলদেবী অধিষ্ঠান করেন। আর শোবার জন্য মেওয়াড়া ঘর থাকে। ভিলদের ঘোড়ার দেবতা হচ্ছেন পিথোরা। জলকষ্টে ভোগা ভিলদের দেশে তিনিই প্রথম জল এনেছিলেন। গৃহ প্রবেশের সময় বাড়ির বাইরের প্রথম দেওয়ালে তার ছবি আঁকা হলে বাড়ির মঙ্গল হয় বলে ভিলদের বিশ্বাস। এই গৃহ প্রবেশের সময় দু ধরনের ভিলকে ডাকা হয়। একদল 'মালগা' যারা পিথোরার গল্প কথকের ভূমিকা নেন আর অন্যদল 'লিখেন্দ্র' যারা সেই গল্প শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেই আখ্যানের ছবিটা আঁকতে থাকেন। এই কাজটা এক রাতের মধ্যে করতে হয়। গল্পগুলো আবার বদলে বদলে যায়, সব বাড়ির দেওয়ালে একই ছবি পাওয়া যাবে না।
    ভীল ধাবা অথবা ঘুমাট হচ্ছে টেরাকোটার বানানো অস্থায়ী বাড়ি যেখানে পূর্বপুরুষদের আত্মারা থাকেন। ভীলদের কবরের ওপর পোঁতা স্মৃতি পাথরগুলোকে গাতলা বলে। কোলদের সানেহি। এগুলো অনেকটাই ইউরোপের মেনহিরের মত দেখতে।
    আদিবাসীরা মূর্তিপুজো করেন না, টোটেম পুজো করেন। একটা কাঠের টুকরোর ওপর বা গলার চারদিকে ময়ূরের পেখম থেকে পাওয়া পালক দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। ওটাই টোটেমের রূপসজ্জা। তাদের কাছে পৃথিবী এবং আকাশের বিবাহ সবথেকে আদিমতম বিবাহ।
    ইনস্টলেশন গুলোর মধ্যে কয়েকটার গল্প বলি। যেমন দুর্গাবাঈ ভ্যামের করা বাঁশের জন্ম নিয়ে ইনস্টলেশন। এই উপকথা অনুযায়ী সুন্দরিয়ার ছজন ভাই তাকে মেরে তার মাংস খেতে চেয়েছিল। সপ্তম ছোট ভাই চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি। সাপ, মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ এবং ব্যাঙের সাহায্যে সে সুন্দরিয়ার মৃতদেহের কিছু অংশ মাটিতে পুঁতে দেয় এবং সেই কবরের ওপর ঝরে পড়া ভাইয়ের চোখের জল থেকেই সুন্দরিয়ার পুনর্জন্ম হল বাঁশ হিসেবে।
    গোন্ডদের ভাবনায়, বড়দেব নিজের পাঁজর থেকে জীবন্ত প্রাণী তৈরী করতে শুরু করেন। এদেরকে রাখার জন্য তিনি তাকালেন পৃথিবীর দিকে কিন্তু পৃথিবী তখন জলে ডুবে আছে। তিনিও একটা কাককে বললেন পৃথিবীকে খুঁজে নিয়ে এসো। উড়তে উড়তে কাক একটা কাঁকড়াকে খুঁজে পেল যার একটা দাঁড়া আকাশে আরেকটা দাঁড়া পাতালে। তাকে পৃথিবীর কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলল পৃথিবীকে কেঁচো বন্দী করে রেখেছে। কাঁকড়া কেঁচোর গলা দাঁড়ায় টিপে ধরলে কেঁচো পৃথিবীকে বমি করে দিল। তাকে নিয়ে উড়তে উড়তে কাক ফিরে এল বড়দেবের কাছে। বড়দেব মাকড়শাকে বললেন জলের ওপর তার জাল বুনতে যাতে পৃথিবীকে সেই জালের ওপর স্থাপন করা যায়। কিন্ত পাতলা জালের ওপর রাখা পৃথিবী মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠত। বৈগা বৈগিন তখন নানা রকম পাথর, গাছ থেকে তৈরি পেরেকের ওপর রেখে পৃথিবীকে সুস্থির করলেন। বড় দেব সেই পৃথিবীর ওপর সমস্ত জীবজগৎকে স্থাপন করলেন।
    বৈগা উপজাতির এই গল্পটা আবার একটু অন্যরকম। তাদের কাছে 'ধরতলী'র প্রথম দম্পতি নাগা বৈগা এবং বৈগিন হলেন আদম ঈভ। পদ্মপাতায় বসে থাকা দেবতারা এই দুজনকে পৃথিবীকে খুঁজে বার করার দায়িত্ত্ব দিলেন। তারা আবার সেই কাজটা একটা কাককে আউটসোর্স করে দিল। কাক আর কাঁকড়া মিলে এক নাগকন্যাকে পৃথিবী বলে ভুল করে নিয়ে এলেন। নাগকন্যার গলায় তাদের মালা দিতে দেখে রেগে গিয়ে বৈগা তার কন্যাসমা নাগকন্যাকে কেটে ফেললেন। সেই রক্ত শুকিয়ে গিয়ে জলের ওপর একটা শুকনো স্তর তৈরী হল সেটাই পৃথিবী। কিন্তু এভাবে তৈরী পৃথিবী অস্থায়ী এবং মাঝে মাঝে কেঁপে উঠত দেখে বৈগা দম্পতি ঠিক করলেন তাদের সন্তান সন্ততি দেরও বলি দিতে হবে। কিন্তু বাকি পশুরা তখন বলল আমাদের শিশুদের তোমরা বলি দাও। এভাবে মানুষরা বেঁচে গেল বলির হাত থেকে এবং তাদের জনসংখ্যা বাড়তে থাকল।
    খুমন সিংয়ের করা ইনস্টলেশনটা পৃথিবীর জেগে ওঠা নিয়ে। সেই মিথ অনুযায়ী ভিলু বাঈ পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, গাছপালা, মানুষ, মহাদেব সব সৃষ্টি করলেন। কিন্তু কোনো শব্দ ছিল না। মহাদেব দেখলেন নিঃশব্দ এই সবুজ পৃথিবীকে খুব আলুনি লাগছে, মজা হচ্ছে না। তিনি একজন ছুতোরের কাছে গিয়ে বললেন ড্রাম বানাও। ছুতোর জঙ্গলে গিয়ে এক স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তৃত টিক গাছকে কাটার পর সেই গাছ মাটিতে পড়ার সময় প্রথম 'নাদ' বা শব্দ তৈরী হল। সেই গাছের কাঠ থেকে তিনি ঢোল, ঢোলকি, ঢাক ইত্যাদি বানিয়ে ফেললেন এবং সেগুলো বাজানোর ভার নানা রকম উপজাতিদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। তারপর থেকে নাচগানের সময় আওয়াজ পেলে মহাদেব বলেন - "ওই তো, আমার বোন পৃথিবী জেগে উঠছে। "
    ইন্দ্রর মত বাবদেব হচ্ছেন ভিলদের বৃষ্টির দেবতা। বছরে দুটো অমাবস্যার সময় গ্রামের সব ভিলরা একত্র হয়ে পশু অথবা শস্যবলি দিয়ে তার পুজো করে।
    একবার প্রচন্ড খরা হল। 'কাঁসার' বলে একটা জীব যে গোটা শস্যদানা খেত, সমুদ্রের তলায় গিয়ে লুকোল। ক্ষিদের চোটে সবাই সমুদ্রে গিয়ে জীবন্ত মাছ ধরে খেতে লাগল। তাদের কথা শুনে এক ভাই বোন ও সমুদ্রের ধারে গিয়ে জীবন্ত মাছ ধরে খেতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। মাছ তখন তাদের বলল তিনদিন বাদে প্লাবন আসবে পৃথিবীতে। তার আগে তোমরা লোহার একটা ডিঙা [নোয়ার নৌকা] বানিয়ে রাখো। তিনদিন বাদে প্লাবনে পাবাগড় পর্বত ছাড়া সব ভেসে গেল। সেই ভেলায় ভাসতে ভাসতে যাওয়া ভাই বোনকে দেখে পাবাগড় পর্বত নিজের কাছে আশ্রয় দিলেন। তিনি কাঁসারকেও খুঁজে বার করলেন। কিছু সময় পর জল কমে গেলে মহাদেব ভাবলেন এবার আবার পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার করা যাক। তিনি ভাই বোনের পুরোনো স্মৃতি ভুলিয়ে দিলেন যাতে তারা একসঙ্গে দম্পতির মত থাকতে শুরু করে এবং ছেলেমেয়ের জন্ম দিতে পারে। আর কাঁসার থেকে সমস্ত গাছপালা, জীবজন্তুর জন্ম হল।
    পূর্বপুরুষরা পৃথিবীতে নেমে আসার জন্য যে পথ ব্যবহার করেন সেটাও আরেকটা গল্প। নান্দলু বরন বলে একজন পশুপালক একটা আম বাগানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই বাগানের মালিকের মেয়েকে দেখে সে উত্যক্ত করতে শুরু করে। বাগান মালিক একটা বর্শা ছুঁড়ে তার মাথা কেটে ফেলেন। সেই কাটা মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোনো তিনটে রক্তধারার জন্ম হল। সেই রক্তধারাই পূর্বপুরুষরা পৃথিবীতে আসার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করলেন। যারা অল্পবয়সে মারা যায় তারা সাদা রঙের রক্তধারা, দুষ্ট আত্মারা কালো রক্তধারা এবং বাকিরা লাল রক্তধারা ব্যবহার করে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসেন।
    গোন্ডদের সবথেকে প্রিয় তারের তৈরী বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে বানা। বড়দেবকে আহ্বান করার জন্য গোন্ডরা এই বাজনাটা ব্যবহার করে। এক গোন্ড রাজাকে স্বপ্নে বড়দেব নিজেই সাজা গাছের কাঠ থেকে বানানোর পদ্ধতি বাতলে দিয়েছিলেন। রাজা তার ছোটভাইকে স্বপ্নটা বলায় তিনি সাজা গাছ থেকে যন্ত্রটা বানিয়ে একটা হাতুড়ি দিয়ে বাজাতে থাকেন। তখন মাথার ওপর দিয়ে 'ভারাহী' বলে পাখিটা উড়ে যাচ্ছিল। আওয়াজ শুনে সে সেই তালে তালে নাচতে শুরু করে এবং সেই অনুযায়ী সুর তৈরী হয়।

    ভীলদের তাতাল দেবী ভাঙা হাত পা সারিয়ে দিতে পারেন। ছোটবেলায় তিনি খুব দই খেতে ভালোবাসতেন বলে তার বাবা তাকে লাঠি দিয়ে মারার পর পঙ্গু হয়ে যান। রেলা কুলমি তাকে বর দেন যে তিনি বাকি সবার ভাঙা হাত পা সারিয়ে দিতে পারবেন।
    ছত্তিসগড় এই সংগ্রহশালায় অতিথি রাজ্য। মউলী হচ্ছেন তাদের বাস্তারের প্রধান দেবী। তাদের মুরিয়া ছেলে মেয়েরা বিয়ের আগে ঘোটুলে একত্রবাস করে।
    একটা গ্যালারিতে আদিবাসী শিল্পীদের আঁকা ছবি টাঙানো আছে বিক্রীর জন্য। জিএসটি সমেত দাম আড়াই হাজার টাকা থেকে শুরু।

    এর পাশে ভোপাল রাজ্য সংগ্রহশালাতেও ঢুকতে কুড়ি টাকা। বাইরে লকারে নিজের ব্যাগ রেখে চাবি দিয়ে চাবি নিজের কাছে রাখতে হল। সংগ্রহশালা দোতলা এবং দুটো ডানা নিয়ে অনেকটা ছড়ানো, অনেকগুলো গ্যালারি আছে।
    মূর্তি গ্যালারিতে মূলত দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেকার মূর্তিগুলো সাজানো। সম্ভাবনাথ, নেমিনাথ, সুরপার্শ্বনাথ ইত্যাদি জৈন মহাগুরুদের মূর্তি। শিবের গজসুরসংহারী মূর্তি এবং শিবভক্ত বামন লাকুলিশের [ লাকুল মানে লাঠি, ঈশ মানে দেবতা] মূর্তি। এছাড়াও বরাহী, গঙ্গা মকরবাহিনী, চামুণ্ডার মাথা ইত্যাদি আছে।
    প্রাচীন গ্যালারিতে আছে নর্মদা উপত্যকার পঁচিশ লক্ষ বছর আগেকার গাছের এবং হাতির জীবাশ্ম। রাখা আছে ভীমবেটকা থেকে পাওয়া নব্যপ্রস্তর যুগের মাইক্রোলিথগুলো, যাদের দৈর্ঘ্য ৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে অথচ তীক্ষ্ণ ধারালো ফলক। এগুলি নানান কাজে ব্যবহার হত, পশুর চামড়া ছাড়ানো বা মাংসের ফালি কেটে নেওয়ার ছুরি, শস্য কাটার কাস্তে, হাতির দাঁত বা পশুর হাড় থেকে পুঁতি এবং গয়না বানানোর কাজে। নিওলিথিক যুগের টুল বা যন্ত্রপাতিও রাখা আছে। আর নানা গুহাচিত্রের বড় বড় ছবি।

    পাণ্ডুলিপি গ্যালারিতে আছে সতেরোশোতে কপিরাইটারদের দ্বারা মূল লেখার প্ৰতিলিপি করা সংস্কৃত, উর্দু ভাষার নানা পাণ্ডুলিপি। প্যালেলিওগ্রাফি, লিপি খোদাই করা তামার পাত। মান্দাসুরের চুক্তি, রাইসেনের চুক্তি, গ্বলিয়র এবং ভারত সরকারের মধ্যেকার চুক্তির প্রতিলিপি। ভোপালকে ভারতে যোগ দেবার অনুরোধ করে টাইপ করা চিঠিতে প্যাটেলের সই। স্ট্যাম্প, মুদ্রা, অটোগ্রাফ। স্বাধীনতা যুদ্ধের গ্যালারি। রাজকীয় শিল্পের গ্যালারিতে ছোট ছোট সব সিন্দুক রাখা। গায়ে নানারকম সূক্ষ ডিজাইন।

    এখান থেকে বেরিয়ে দুপুর তিনটের সময় রোশনপুরা চৌমাথায় এসে দুপুরের খাবারটা খাওয়া গেল। এরপর তাজ উল মসজিদের দিকে যেতে হবে।


    তাজ উল মসজিদ ভারতের সবথেকে বড় মসজিদ। ভোপালের নবাব শাহজাহান বেগম শুরু করেছিলেন, শেষ করেন তার মেয়ে এবং পরবর্তী নবাব সুলতান জাহান বেগম। সুলতান জাহানের ছেলে এবং ভোপালের শেষ নবাব হামিদুল্লা খানের সময় ভোপাল রাজ্য স্বাধীন ভারতে যোগদান করে। এই বংশের সিকান্দার বেগম ১৮৫৭র বিদ্রোহে বৃটিশদের পক্ষ নিয়ে পরে নাইট উপাধি পেয়েছিলেন।



    এর পর হেঁটে যেতে থাকি পাশেই আরেকটা ছোট বিখ্যাত মসজিদ, সাদা রঙের মতি মসজিদের দিকে। মাথার ওপর দিয়ে উড়োজাহাজের নামতে থাকা দেখে বোঝা গেল ভোপাল বিমানবন্দরটি শহরের এই দিকেই। এদিকটাই পুরোনো ভোপাল। রাস্তায় মানুষের ভিড়। রাস্তার ধারে ঠেলায় ঢেলে পানিফল বিক্রি হচ্ছে। ভারতের এই সমস্ত রাস্তায় কপালে তিলক বা ছাই মাখা, গলায় হাতে রুদ্রাক্ষের মালা জড়ানো প্রায়ই এক শ্রেণীর লোককে একটা ঢাকা খোলা চোঙের মত লম্বা টিফিন কৌটো নিয়ে ভিক্ষা চাইতে দেখি। ওই কৌটোর ভেতরে ভিক্ষার মুদ্রাটা ফেলে দিতে হয়। ভিক্ষা না দিয়ে সবসময় কৌটোগুলোর দিকে লক্ষ্য করি, অনেকসময় কৌটোর অর্ধেক মুদ্রা ধোয়া গাঢ় হলুদ রঙের জলে ভর্তি থাকে যেটা ভুল করে খেলে মনে হয় কেউ সঙ্গে সঙ্গে ওপরে চলে যাবে। একজায়গায় দুজন বৃহন্নলা একটা বাঁদরকে কলা খেতে দিয়ে, মোবাইলে তার কলা খাবার ভিডিও করতে করতে নিজেদের মধ্যে হেসে গড়িয়ে পড়ছিলেন। এক দোকানে চা খেতে গিয়ে দেখলাম পায়ের কাছে একটা কমলা রঙের দুশো টাকার নোট পড়ে আছে। নিশ্চয় চা ওলার হবে। কিন্তু সে একবার নোটটা দেখে বলল -"নকল, আসলটার থেকে দেখুন সাইজ ছোট " বলে নোটটা তুলে কংক্রিটের স্ল্যাব ঢাকা নর্দমার দিকে আবার দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারল।

    সন্ধ্যেবেলা স্টেশনে ফিরে এসে দেখি মরচেবিহীন নতুন সারি সারি স্টিলের বেঞ্চ। এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আরেক প্ল্যাটফর্মে যাবার জন্য গোল কাঁচে ঢাকা সিসিটিভি লাগানো সাবওয়েটা ঝকঝক করছে আলোয়। একটা পানের পিক পর্যন্ত নেই [অবশ্যই কলিন দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করে]। প্ল্যাটফর্ম শেডের ওপর টানা সোলার প্যানেল বসানো। শেডের নিচে সাদা টিউব গুলো সারি দিয়ে জ্বলছে। ওভারব্রিজের বদলে স্টেশনের ওপরের কনকোর্স লেভেলটাই যাত্রীদের অপেক্ষা করার জায়গা। সেখানে বিমানবন্দরের অনুকরণে খাবার বা অন্যন্য দোকানের স্টল। ক্রেডিট কার্ড গছানোর জন্য কিছু ছেলেমেয়ে ঘোরাঘুরি করছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ | ৬৬২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2607:fb90:ea0c:cd31:c5e4:bfd6:bab5:f55f | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৪৭525572
  • দারুণ! ইতিহাস-ছবি-মাইথোলজি-গল্প সব মিলিয়ে রঙীন ঠাসবুনোট। মাইথোলজির গল্পগুলো বেশ ডার্ক, না? আমার খুব ভালো লাগলো পাথরের অদ্ভুত শেপগুলো। আচ্ছা, গুহায় আঁকা ছবিগুলো তো অনেকই ফেড হয়ে গেছে, তাই না? এগুলো কোনোভাবে প্রিজার্ভ করা হয় নিশ্চয়ই। কী ভাবে হয়, জানেন?
    সিরিজটা খুব উপভোগ করছিলাম। শেষ হয়ে গেলো বলে একটু ফাঁকা লাগবে। তবে পরের সীজনের অপেক্ষায় থাকবো।
  • | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ২১:১৪525576
  • ভীমবেটকায় যাবার পরিকল্পনা করেও যাওয়া হপ্য নি নানা কারণে। 
    উপকথার কাহিনীগুলো  এই লেখাটাকে একেবারে অন্য লেভেলে তুলে দিয়েছে। 
    আচ্ছা এখানে এক দুদিন থাকতে চাইলে ভীমবেটকার ৩-৪ কিমির মধ্যে কোন হোমস্টে বা সরকারি বাংলো আছে? 
  • দীমু | 182.69.178.81 | ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ২১:৩৭525581
  • কেকে, পাথরের ওপর আঁকা ছবি রেস্টোর করা যায় না বলেই মনে হয়। বেশি ক্ষয় হলে ওরা হয়ত দিনে একশো জনের বেশি লোক ঢুকতে পারবে না, এরকম কিছু করবে। যদিও এই কয়েকটা গুহা ছাড়াও আরো অনেক গুহাচিত্র আছে যেগুলো পাবলিকের জন্য ওপেন নয় - 
     
    মাইথোলজির গল্প সামাজিক কাঠামো, সমাজে মানুষদের মধ্যেকার সম্পর্ক এরকম কিছু বুনিয়াদি জিনিসের থেকে উঠে আসে। এই ভীমবেটকার ছবি আঁকা মানুষদের মতই আদিবাসীদের জীবনও অনেক দিন পর্যন্ত হান্টার গ্যাদারারেই ছিল। সেই জীবনযাত্রা খুবই কঠিন, প্রচুর রক্তারক্তি করে রোজ বেঁচে থাকা। সেজন্য গল্পগুলোও অন্ধকার। 
     
    দ, ওই ট্রেনের লেভেল ক্রসিংয়ের পাশেই মধ্যপ্রদেশ সরকারের হাইওয়ে ট্রিট বলে একটা খাবার জায়গা/রিসর্ট আছে। তবে জায়গাটা বেশ নিরালা।
     
  • &/ | 107.77.236.185 | ০৬ নভেম্বর ২০২৩ ০১:৪৩525598
  • দশ হাজার বছর আগের পাকা শিল্পীর আঁকা ঘোড়াগুলো দেখে আমি জাস্ট থ, একেবারে থ হয়ে রইলাম। অনেক ধন্যবাদ। অপূর্ব লেখা, অপূর্ব ছবি। 
  • সুদীপ্ত | ০৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:১৪525624
  • এই হাম্পি আর ভীমবেটকা লিস্টে আছে, তবে একটু পরের দিকে। দশ হাজার বছর আগের আঁকা বলে মনেই হয় না! লেখা-ছবি দুইই ভালো লাগলো! 
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ০৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:৩৯525625
  • ট্রাইবাল মিউজিয়াম টা ভোপালের এক অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু সেরা আকর্ষণ হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধী মানব সংগ্রহালয়। ভারতের সমস্ত উপজাতি ও জনজাতি র ব্যবহৃত জিনিস, ঘরবাড়ি, বাসন, মুখোশ, আসবাব, গয়না, কারুকাজ এর অপূর্ব সংগ্রহশালা। সুবিশাল জায়গা জুড়ে তৈরি, ভালো করে দেখতে হলে প্রায় এক গোটা দিন লেগে যায়। ওপেন এয়ারে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের প্রাচীন বাড়ি, সমাধি , উপাসনা স্থল 1:1 আসল বানানো আছে। ঘুরে ঘুরে দেখা যায়। নেটে সার্চ করে বা ইউ টিউবে থাকতে পারে। ভোপাল গেলে এটা দেখতেই হবে। ট্রাইবাল মিউজিয়াম টাও। ট্রাইবাল মিউজিয়ামের ইনস্টলেশন গুলো তো এককথায় অনবদ্য।
  • সম্ভবত: | 14.139.196.230 | ০৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৩২525629
  • এই ঘোড়ার ছবি দিয়ে "ভারতে আর্য্যরা বাইরে থেকে ঘোড়া নিয়ে এসেছিলো" এই তথ্য কাউন্টার করা হয়। অবশ্য ঐতিহাসিক বা পুরাতত্ত্ববিদেরা আরো ভালো বলতে পারবেন। 
  • দীমু | 182.69.178.81 | ০৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৪৩525681
  • সুদীপ্ত/ দ, সময় নিয়ে গেলে পাঁচমারিটাও ঘুরে আসবেন। সাতপুরা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে মধ্যপ্রদেশের সবথেকে উঁচু জায়গা। পান্ডব গুহা ইত্যাদিও আছে। 
     
    রমিত, হ্যাঁ ইন্দিরা গান্ধী মানব সংগ্রহালয়টা যাওয়া হয়নি। 
     
    &/, সম্ভবত: ​​​- হ্যাঁ এই ছবিগুলো দিয়ে ঘোড়া কারা পোষ মানিয়েছিল সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে। আলাদা আলাদা ভাবে ভীমবেটকার ছবিগুলোর সময় নির্ণয় করা হয়নি। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় ঘোড়ার ছবিগুলো সাত আট হাজার বছর আগেকার বুনো ঘোড়ার। দশহাজার নাও হতে পারে। নিচের লিংকটা দেখতে পারেন এবিষয়ে -
     
  • দীমু | 182.69.178.81 | ০৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৪৫525682
  • ওপর ওপর সব এই পাবলিক গুহাগুলোর ছবিগুলোর গড় বয়স দশহাজারের আশেপাশে, এরকমই মনে করা হয়। 
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ০৭ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৩৬525692
  • আপনার ভ্রমণ সিরিজের লেখা গুলো খুব ভালো লাগছে। গোয়ালিয়র থেকে পড়া শুরু করে ছিলাম, সবকটাই পড়ছি এবার। পাঁচমারি নিয়েও লিখুন না। পাঁচমারি নিয়ে তেমন কথাবার্তা দেখিনা। ইচ্ছে ছিল যাওয়ার, আপাতত আপনার লেখা পড়েই একটু রসাস্বাদন করি।
  • দীমু | 182.69.178.81 | ০৭ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৫৮525694
  • না না আমি পাঁচমারি যাই নি। কখনো গেলে লিখব।
  • SM | 196.15.23.6 | ০৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৩১525721
  • ভোজ পুর মন্দির এ গিয়ে থাকলে ওটা নিয়েও লিখবেন। 
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ১০ নভেম্বর ২০২৩ ০০:৪৪525861
  • দুরন্ত সিরিজ হয়েছে এটা। কিছুটা তাড়াহুড়ো করে পড়েছি। আবার পড়তে হবে, গুছিয়ে, সময় করে। আসলে অনেক বার পড়তে হবে আর দেখতে হবে। 
  • দীমু | 182.69.176.112 | ১০ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৩525890
  • SM, না ভোজপুরও যাওয়া হয়নি। ভোজপুর গেলে সেদিন আর আদিবাসী সংগ্রহশালা / ভোপাল মিউজিয়ম দেখা হত না। ওই গল্প আর ইনস্টলেশনগুলো আমার মনে হয়েছিল দেখা বেশি জরুরি। 
     
    ধন্যবাদ অমিতাভদা , অবশ্যই সময় করে যতবার ইচ্ছে দেখবেন আর পড়বেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন