নেমে এসে আবার প্রাসাদের দিকে ফিরে এলাম একটা অটোতে। প্রাসাদে ঢোকার প্রবেশমূল্য তিনশো টাকা। ভেতরে সিসিটিভি এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীরা খেয়াল রাখছে। প্রাসাদের ট্যুর একমুখী। একটি নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে ঢুকে পূর্বনির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য পথ বা দরজা শিকল তোলা।
গাইড নেওয়া বেকার। ভুলভাল বকে, তাড়াতাড়ি আপনাকে ঘুরিয়ে আরেকজনকে ধরতে চায়। তার থেকে চাইলে অডিও গাইড ভাড়া নিতে পারেন। একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আর হেডফোনের মত দিত, মাইসুরুতে দেখেছিলাম। এখানেও সেই ব্যবস্থা আছে, হয়ত ক্যাসেট প্লেয়ারের বদলে এখন মোবাইলে কিছু একটা। দুশো টাকা ভাড়া মনে হয়, মানুষ গাইডের থেকে কম।
প্রাসাদে ঘুমক্কড় প্রথমেই শুরু হয় সালেহ খানা [অস্ত্রাগার] এবং তার নানারকম অস্ত্রের সংগ্রহ দিয়ে। কাতার / জামাধার গুলো হচ্ছে পাঞ্চ ছোরা আর সাজানো আছে একগাদা তোপিদার পিস্তল , তোদাদার পিস্তল এবং তোদাদার বন্দুক।
প্রাসাদটা নানারকম মহল আর চকে বিভক্ত। একেকটা চক একেকজন রাজা বানাতেন এবং থাকতেন [ যেমন অমর মহল বানিয়েছিলেন রানা অমর সিং ]। এভাবে ধীরে ধীরে যুগে যুগে প্রাসাদটা বড় হয়েছে। রাজপুত প্রাসাদগুলোর একটা বৈশিষ্ট হচ্ছে - ছাদটা খুব নীচু। সবজায়গায় মাথা বাঁচিয়ে চলতে হয়। এরকম গুঁড়িসুড়ি মেরে থাকার মত জায়গা কেন বানাতেন জানি না। চকগুলোর মধ্যে আছে মোর চক, মানেক চক।
চকগুলোতে সুন্দর সুন্দর কাঁচের কাজ বা দেওয়ালে ছবি আঁকা। এগুলো সবই যে পাঁচশো বছরের পুরোনো তা নয় , পরবর্তীকালে নানা শিল্পীদের দিয়ে রিস্টোর করানো হয়েছে।
উদয়পুরি ঘরানায় আঁকা অনেক ছবি রাখা আছে প্রাসাদের চকগুলোর ভেতরে। এমনকি একজন গাইড দেখলাম এক বিদেশী দম্পতী এবং তাদের ছেলেকে ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় সেসব বোঝাচ্ছেন। ভদ্রলোক জুম করে এক রানার মুখের ছবি তুলতে ব্যস্ত।
প্রাসাদের জেনানা মহল, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের মত। এখানকার লক্ষ্মী চকে বিয়ে ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো হত। দুটো মানেক স্তম্ভ রাখা আছে। রাজপুত বিয়েতে এই স্তম্ভগুলো নানা আচারের কাজে লাগে। আর ভান্ডার চকে প্রাসাদের রান্নাবান্না হত।
একজায়গায় 'খেলাকনিয়া'র সরঞ্জাম রাখা আছে। জেনানা মহলের মেয়েরা এবং বাচ্চারা সময় কাটানোর জন্য সতরঞ্জ ইত্যাদি খেলত। কড়ি দিয়ে চৌপার খেলা হত।
কড়ির সঙ্গে খেলা উদয়পুরের কাছেই শ্রী একলিঙ্গজী মন্দিরের আশপাশ থেকে উদ্ধার করা কিছু মূর্তিও প্রাসাদের সংগ্রহশালায় রাখা আছে। সেগুলোর মুখ ঘষে গেছে, হাত কাটা, মাথা কাটা।
বিষ্ণুমূর্তি
প্রাসাদের ভেতরের 'রাই অঙ্গন' কিছু দোকানের স্টলকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রাসাদ দেখা হয়ে গেলে বেরিয়ে ঘন্টাঘরের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে খাবার দোকান খুজছিলাম। কিন্তু ঘন্টাঘরকে ঘিরে সবই সোনা রুপোর দোকান। অলংকার বেচাকেনা চলছে। আবার ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে জগদীশ মন্দিরের রাস্তায় একটা খাবার জায়গা পেলাম। নিরামিষ থালি। ৩টে ঘি দেওয়া রুটি, একমুঠো ভাত, পাঁচমিশালি সবজি, পনির, ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা। আর একটা রাজস্থানি থালি ছিল - ডাল বাটি চুরমা ওয়ালা।
উদয়পুরের ঘন্টাঘর হাতে সময় আছে বলে আরেকবার পিচোলা পেরিয়ে অম্বরাই ঘাটে ঢুঁ মারলাম যেখান থেকে লেক প্যালেস এবং জগ মন্দির দেখা যায়। পিচোলাতে যত্র তত্র বোটিং বারণ। বোটিং করতে গেলে আপনাকে আলাদা টিকিট[কুড়ি টাকার] কেটে রাজপ্রাসাদের ঘাট থেকে নৌকাতে উঠতে হবে। সেই মোটর নৌকা পুরো পিচোলা হ্রদে আপনাকে সফর করাবে অথবা জগ মন্দির বা লেক প্যালেসে নিয়ে যাবে বুকিং থাকলে। সন্ধেবেলা অম্বরাই ঘাটের মন্দিরে আরতি ইত্যাদি হয়। এছাড়াও সূর্যাস্তের সময় পুরো সোনার মত ঝকমকে রাজপ্রাসাদের আলোছায়া পিচোলার জলে পড়ে, সেই ছবি তোলার জন্য অনেকে এখানে আসেন।
অম্বরাই ঘাট থেকে লেক প্যালেস এবং জগ মন্দির [ঢাকা পড়ে গেছে]
অম্বরাই ঘাট থেকে উদয়পুর রাজপ্রাসাদ
অম্বরাই ঘাট থেকে প্রাসাদের উল্টোদিকে পাহাড়ের ওপর সজ্জনগড় মনসুন প্যালেস। ছটার ফিরতি মেবার এক্সপ্রেস ধরতে অটো নিয়ে স্টেশনে ফিরে এলেম। এইসব বড় স্টেশনে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে করতে প্রায়ই এক দৃশ্য দেখি। বহু মানুষ চাদর মুড়ি দিয়ে প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে বা বেঞ্চে শুয়েবসে ঘুমে ঢোলেন। সমস্ত দূরপাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেন [রাজধানী, শতাব্দী এসব ছাড়া] স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে, লোকোমোটিভের ভোঁ শুনলেই তারা জেগে উঠে এক একটা কাঁধের রংচটা ব্যাগ নিয়ে দৌড়তে শুরু করেন জেনারেল কামরাগুলোর দিকে।