সকাল সকাল ম্যাপচ্যাটে প্রথম যখন আজকের ছবিটা ভেসে উঠেছিল , ভালো করে দেখা হয়নি। এখন আবার ছবিটা খুঁজতে গিয়ে নিলয়ের মনে পড়ল , ম্যাপচ্যাটে একবার ভুল করেও কিছু দেখে ফেললেই সেটা মুছে যায়, পরে ইচ্ছে হলেও আর ফিরে দেখা যায় না। ভেবেছিল লিখবে - লুকিং লাইক এ ওয়াও। আজ আর হল না। কাল আবার। এই মেয়েটি ম্যাপচ্যাটে রোজ সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা করে সাহসী ছবি দেবেই। যদিও এ একা নয়, শয়ে শয়ে এরকম মেয়েদের ছবি নিলয়ের ম্যাপচ্যাটে রোজ ভেসে ওঠে এবং তলিয়ে যায়।
মাঝে মাঝে এক একদিন যায় সেদিন নিলয়ের বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছেই করে না। কিন্তু আজ একবার বেরোতেই হবে।
মাথার ওপর কেরোসিনের মত ভিজে সপসপে আকাশ কারুর দেশলাই জ্বালার অপেক্ষায়। আরও তিনজন ছেলেমেয়ে অফিস যাবার জন্য অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে। নিচুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে শেয়ার বাজারের স্মল ক্যাপ , বিগ ক্যাপ , বিট কয়েন কেনাবেচা এই সব নিয়ে। নিজের দুকানে সাদা ডাঁটি গোঁজা থাকলেও নিলয় ওদের সব কথাই শুনতে পাচ্ছে কারণ আসলে সে কোনও গানই শুনছে না। কানে কিছু গোঁজা থাকলে আর চারপাশের কেউ বিরক্ত করে না বলে নিলয় ডাঁটিগুলো সবসময় কানে লাগিয়ে রাখে।
পাশেই চায়ের দোকান , ভাঙাচোরা নীলসাদা বাসস্টপে ছোট টেবিল পেতে বিক্রী হচ্ছে লটারীর টিকিট। বাম্পার, লেগে গেলেই প্রথম পুরস্কার তিন কোটি টাকা। নিলয় প্রায় দিনই পাঁচ টাকার কেনে ভাগ্য পরীক্ষার জন্য। লেগে গেলে বাজারের ধারগুলো শুধরে যাবে।
ধারের কথা মনে পড়তেই নিলয়ের মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়। অ্যাপ কোম্পানি থেকে পাঁচ লাখ টাকা কেউ ইচ্ছে করে ধার করতে চায় না। মনোর জোরাজুরিতে ধারটা নিতে হল। অথচ টাকাটা পেয়ে মনো এক লাখের মোবাইল কিনে ফেলল। বাকি টাকায় ফ্ল্যাট ভাড়ার ডিপোজিট, স্কুটি কেনা, থাইল্যান্ড ঘুরে আসা।
অটোতে উঠেও পিছনে ওরা এখনো সবাই কথা বলছে স্টকে টাকা শর্ট করা নিয়ে। এরা পোচ্চুর নোট ছাপে নিশ্চয়। মাথার ওপর আপাতত কোনও ধারও নেই, ফাটকা খেলছে বাজারে।
মেট্রোয় উঠেও ভিড়। বসার জন্য ছোটাছুটি। আরামে সিটে বসে অনেকের মোবাইলে চোখ , কেউ কেউ ক্লান্তিতে ঝিমোচ্ছে। পাশের ছেলেটার মোবাইলে চোখ যেতেই নিলয় মনোলীনার মুখ দেখল। মনো নাচছে আয়নার সামনে, এই বুমেরাং ফিতে ভিডিও কাল নিলয়ই করে দিয়েছে। ছেলেটা পাঁচ সেকেন্ড দেখে আঙ্গুল টিপে ভার্চুয়ালি হৃদয়ের প্রতিক্রিয়া দিল। তারপর নেমে চলে গেল পরের ফিতে ভিডিওতে।
অন্য পাশেও দুজন লোক বসে নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলছে।
- ওঃ, কালকে রাতেও ত খবরে দেখলাম। এবার কত কোটি বেরোলো?
- বেশি নয়। সাত আট মতন।
- আমাদের মাথাপিছু কিছু দিলেও পারে।
- কিন্তু কালকে খেলা ছেড়ে ওসব বালবাজারি দেখলে?
- ক্রিমএগারোতে টাকা আর লাগাই না। শুধু লস শুধু লস। তার থেকে লুডো ভাল।
ক্রিমএগারোর কথাটা নিলয় ভুলেই গেছিল। নিজেও কালকে রাতে একশো দশ লাগিয়েছিল। মোবাইল বের করে দেখল – না জেতেনি। পঞ্চাশ টাকা হার। ষাট পড়ে আছে। লুডো আর তাস খেলার অ্যাপটা নামাতে হবে।
মেট্রো থেকে বেরিয়ে পানশালাটা একটু দূরেই। মনোলীনা নিজে কদিন আগেও এই পানশালাতেই ম্যনেজারি করত। এখন সামনে শীতকাল , ঢেউয়ের সময়। বছরের এই সময় রাতক্লাবে , পানশালায় আছড়ে পড়বে মজা করতে চাওয়া তারুণ্যের ভিড়। এসব সময়ে ব্যবসা সামলাতে প্রতি তলার ম্যানেজারিতে এক একজনকে আলাদা আলাদা করে লাগে। নিলয়ের আন্ডারে সেরকমই পানশালার একটা গোটা তলার সব পরিচারকরা কাজ করবে। নিলয় বিল বানায়, খেয়াল রাখে কোন টেবিলে কত অর্ডার হল।
পানশালার বাইরে ফুটপাথের ভাতের হোটেলে ভিড়। ভিড়ের গা থেকে খসে খসে পড়ছে 'গোপনে বাংলা ছাড়ান' পোস্টার। কিছু ছেলেমেয়ে এসে মোবাইলে ভাতের হোটেলের ভ্লগ করছে। ভাইরাল চিনেবাদাম গান জোরে জোরে হোটেলের বক্সে বাজছিল। একজন লোককে ঘিরে জমে উঠেছিল সেলফি তোলার ভিড়। ফিতে ভিডিওতে নিলয় প্রায়ই এনার করা ইয়ার্কি ভেসে উঠতে দেখেছে। নিলয় এতদিন জানত ইনি কোনও স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান। এখন দেখছে মন্ত্রী , সঙ্গে পুলিশ আছে নিরাপত্তার জন্য।
আজকে মেঘনা যদি এই ব্যাপারটা দেখত, কি বলত ও? মাঝে মাঝে এরকম কিছু সময়ে নিলয় সত্যি একজন বন্ধু হিসেবে মেঘনার অভাব বোধ করে। স্কুল থেকেই এসব ব্যাপারে মেঘনার মতামত ভিড়ের থেকে একেবারে অন্যরকম। রাজনীতি শুনলেই সবার বমি পেত কিন্ত মেঘনা বলত রাজনীতি ছাড়া পোকামাকড়ের মত বেঁচে থেকে লাভ নেই। আজকে হয়ত মেঘনা থাকলে বলত, একটা সময় আসবে যখন ফিতে ভিডিওতে না দেখা গেলে রাজনীতিবিদদের কেউ সত্যিকারের জীবনে চিনতেই পারবে না।
মনোলীনা চ্যাট করেছিল, একটা ভাল খবর দিতে।
সকালের ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে। জ্বরের মত সবাই তাতে আপাতত আক্রান্ত। এক কেকের দোকান ইতিমধ্যেই তাকে নিয়ে বিজ্ঞাপন করতে চায়, ফোন করেছিল।
আগেও এরকম বার বার মনোর সঙ্গে হয়েছে। সরকার রাতারাতি টিকটিক নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল বলে মনোকে অন্য এক অ্যাপে ঢুকতে হয়েছিল । লকডাউনের পর মনো সেখানেই তার প্রোফাইলের অনুসরণকারীদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব রেখেছিল। সেখানে সে এক প্রশ্নের এমন বেফাঁস জবাব দিয়ে ফেলে যে অনেক অনুসরণকারী ক্ষেপে ওঠে। রাতারাতি জনপ্রিয়তা কমে গেছিল মনোর। মেঘনা বলেছিল ক্যান্সেল কালচার। বাতিল সংস্কৃতি। অবশ্য তার পরে মনো এই টিভিসিরিয়ালের কাজটা পেয়ে গেছিল বলে অসুবিধে হয়নি। এদ্দিনে আবার ভাইরাল হয়েছে মানে সবাই সেই পুরনো ঘটনা ভুলে গেছে। তা ওসব ভুলে গেলেই ভাল, মনে রাখার মত তো কিছু নয়।
- গ্রে৮
- খারাপ খবরও আছে।
মনোর এক বন্ধু , এখন মনো যে সিরিয়ালে অভিনয় করে, সেখানেই সহাভিনয় করত, মারা গেছে। আত্মহত্যা না স্বাভাবিক মৃত্যু না খুন বোঝা যাচ্ছে না। পুলিশ এবং মিডিয়ায় তার বাড়ি ছয়লাপ। সিরিয়ালের বাকিদের সঙ্গে মনোকেও সেখানে একবার যেতে হবে , দেরী হবে ফিরতে।
স্কুটিতে তেল ভরতে হবে। একদিন সিগন্যালে লাল আলো ভাঙার ফাইনও বাকি আছে, দেওয়া হচ্ছে না। এমাসের টাকাটা পেলে, নিয়মমাফিক একগাদা ধারের কিস্তি শোধ করে যদি পকেটে কিছু বাকি থাকে, দিয়ে দিতেই হবে। আসল সমেত পুরো ধার যে কবে শোধ হবে , নিলয় সে হিসেবের কথা ভাবতেও অস্বস্তি বোধ করে।
ফোন বাজছিল। অচেনা নম্বর।
- চিনতে পারছেন?
- না। রঙ নাম্বার।
- কোনও রঙ নাম্বার না। নিলয়বাবু তো?
- হ্যাঁ
- অলিন্দ বলছিলাম। লোনপেতে তিরিশ হাজার পাঠাচ্ছি। রায়বাবুর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। টাকাটা ঢুকলে ওনাকে ফরওয়ার্ড করে দেবেন।
- না কোনও টাকা পাঠাবেন না। আপনাকে চিনতে পারছি না। রাখছি।
- আরে দাঁড়ান দাঁড়ান চিনতে পারছেন না মানে...
নানা টাকা মারার ফন্দি আঁটা ফোন। এইসব আসতেই থাকে রোজ।
বাইরের ঘরের এই সবুজ রঙের সোফাটা এমনিতে দেখলে মনে হয় একবারে কালচে শ্যাওলামাখা একটা পাথরের স্ল্যাব। হাত রাখলেও মনে হয়, ওপরে চাদর পাতা কঠিন কাঠের বেঞ্চ। কিন্তু জিনিসটার ওপর শুলেই কাঠিন্য আর বোঝা যায় না, আচ্ছাদনটা ধীরে ধীরে নরম হতে থাকে। তারপর একসময় নিলয় ডুবে যায় সোফার ভেতর। আর শুয়ে মোবাইল ঘাঁটতে শুরু করলে এই পুরো ডুবে যাওয়াটা এত তাড়াতাড়ি হয় যে নিলয় ইদানীং আলাদা করে কিছু বুঝতেও পারে না।
এই এক কামরার ছোট ফ্ল্যাট সমস্ত আসবাব সমেত ভাড়া নেওয়া। অর্থাৎ সোফাটা আদতে ফ্ল্যাটমালিকের। প্রথম যখন নিলয় জিনিসটা খেয়াল করেছিল, মনোকে বলেছিল যে সোফাটা জীবন্ত এবং নিলয়কে গিলে ফেলবে একদিন। মনো অবশ্য ওখানে শুয়ে কিছুই বুঝতে পারেনি, বলেছিল এটার ভেতরে শোলার অসংখ্য ছোট ছোট বল আছে বলে ওরকম মনে হয়।
প্রতি মুহূর্তে অর্বুদ অর্বুদ দৃশ্যের জন্ম এবং মৃত্যু হয়ে চলেছে। প্রত্যেক মানুষই বর্তমানে একেকটি জনবিচ্ছিন্ন কাঠের ভেলার মত সেইসব অসংখ্য ঢেউয়ের সঙ্গে উঠছে ,নামছে। বেশি উঁচু থেকে নীচে আছড়ে পড়া সামলাতে না পারলে ডুবে যাচ্ছে।আজকাল চাকরিও কিছু বোঝার আগেই ফুড়ুৎ। ভেলকিবাজি যেন। এই আছে এই নেই। মিলিয়ে গেল হাওয়াতে।
এগুলো নিলয়ের কথা নয়। তার স্ট্যাটাস আপডেটে কিছুদিন আগেও মাঝে মাঝে এইসব ছাড়াও মেঘনার আরও অনেক লেখা ভেসে উঠত। যেমন সোশ্যাল মিডিয়াতে বিপ্লব হয় না। এখন সবাই একটা চৌকো জানলার মধ্যে দিয়ে চ্যাপটা পৃথিবীকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে সরে এসে একদিন গোল বাস্তবটা বোঝা দরকার। আমরা যে একটা বৃহত্তর সমাজের এবং সভ্যতার অংশ সেটা বোঝা দরকার। দ্যাট ইজ আওয়ার নিয়তি।
মেঘনা একসময় এইসব কথা বলত। কোভিডের নানা ঢেউয়ের সময় অক্সিজেন, নেবুলাইজার নিয়ে বাড়ি বাড়ি দৌড়ে বেড়াত। এখন মেঘনা নেই।
অতদিন আগের কথা নিলয়ের এখন এক ঝাপসা কাঁচের আড়ালে বলে মনে হয়। সেই ঘষা কাঁচের কোভিডিকালের ওপারে নিলয় ফেলে এসেছে নীচু তারে বাঁধা তার পুরোনো জীবন। তার আগে হোটেল ম্যনেজমেন্ট কোর্স শেষ হলে সে আর মনোলীনা বহুদূরের পাহাড়ের কোলে এক হোটেলে কাজ পেয়েছিল। সেখানে পাকদণ্ডী বেয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে স্কুলের দিকে মিলিয়ে যেত পাহাড়ি বাচ্চারা।
মেঘনা বলত আমাদের নিউজফিড আমাদের মত দেখতে। মাঝে মাঝে এক একটা অদ্ভুত জিনিসে নিলয়ের নিউজফিড ভরে যায়। অথচ পাশাপাশি মনোর মোবাইল রেখে নিলয় দেখেছে মনোর নিউজফিড সম্পূর্ণ আলাদা।
ওপর থেকে নিচের দিকে ভিডিওরা সিনেমা শেষের ক্রেডিট তালিকার মত নামে। একটা পডকাস্টে দুজন কথা বলছে। এগারো সেকেন্ড। সেটা হাত দিয়ে নিলয় উঠিয়ে দেয়। ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে একশো বারো জন। উঠিয়ে দিল। দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধে হাজার মানুষের মৃত্যু। চটপট উঠিয়ে দিল। তারপরেই এক ছবির প্রিমিয়ারে ঝলমলে হাসছে সবাই। এটা পুরোটা দেখল। তারপর ফিল্টারে সাদা রঙের কুকুর আর সোনালী মাছের মাথাওলা দুজন ছেলে মেয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। এটাই নিলয় দেখে , দেখতে থাকে। বারবার। রাত আড়াইটের সময় আঠার মত নিলয়ের চোখ মোবাইলের স্ক্রিনে আটকে থাকে। এসবের ফাঁকে নিলয় অক্লেশে ভুলে যেতে থাকে প্রতিদিন সকালে ম্যাপচ্যাটে দেখা মেয়েটির নাম এবং মুখ।
দ্যাট ইজ দ্য দুঃখ। তার অজ্ঞাতসারেই , অন্ধকারে স্ক্রিন থেকে কিছু কিছু ফুলকি ওপরের দিকে লাফিয়ে উঠেও নিভে গিয়ে বুমেরাং ভিডিওর মত ফিরে আসে। শুধু একটা দুটো ফুলকি হয়ত ফেরে না। ক্রমাগত, দাহ্য আকাশের দিকে উঠে যেতে থাকে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।