এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অন্যান্য

  • ধনগোপাল মুখার্জি

    lcm লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ২৫ মে ২০২৩ | ৪১৪ বার পঠিত

  • পৃথিবীর প্রথম শিশুসাহিত্য পুরস্কার নিউবেরি অ্যাওয়ার্ড চালু হয় আমেরিকায় ১৯২২ সালে। সেই থেকে প্রত্যেক বছর একটা বইকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়, এবং কোনো কোনো বছর কয়েকটি বই-এর সাম্মানিক উল্লেখ করা হয়। যেহেতু কেবলমাত্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদের লেখা বইকেই পুরস্কারের জন্য গ্রাহ্য করা হয়, তাই এটিকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার বলা যায় না। তবু এই সম্মান খুবই অভিজাত -  পুরস্কৃত বই নিয়ে সাহিত্যমহলে চর্চা হত এবং লেখকও প্রচারের পাদপ্রদীপের আলোয় আসতেন।

    নিউবেরি অ্যাওয়ার্ড-এর সপ্তম বর্ষে, অর্থাৎ ১৯২৮ সালে, এই পুরস্কার পান একজন বাঙালি - ধনগোপাল মুখার্জি  - "Gay Neck, the Story of a Pigeon" - বই এর জন্য। নাম থেকে বোঝা যাচ্ছে, বইটা একটি পায়রার আত্মজীবনী যার গলা এবং ঘাড় ধূসর বর্ণের। গল্পে এক কিশোর তাকে মানুষ করে, বা বলা যেতে পারে পাখি করে। খুব অল্প বয়েসে পায়রাটির বাবা এক বিধ্বংসী ঝড়ে মারা যায়, পরে তার মা এক জঙ্গি ঈগলের আক্রমণে প্রাণ হারায়। কিশোরটি তাকে বার্তাবাহকের কাজ শেখায়। এই কিশোরই কাহিনীর কথক, তার চোখ দিয়েই পায়রাটির জীবনপ্রবাহ লিপিবদ্ধ হয় - কলকাতার শৈশব থেকে শুরু করে হিমালয় ভ্রমণ, ইউরোপ যাত্রা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্তাবাহকের কাজ নিয়ে ফ্ৰান্স যায় পায়রাটি, সেখানে দানবিক যান্ত্রিক ঈগল (যুদ্ধবিমান) দেখে ভয় পায় - বিশেষ করে এক বন্ধু পায়রা যখন তার চোখের সামনে উড়তে উড়তে দানব ঈগলের গুলিতে মারা যায়। যাই হোক, এই পায়রাটির জীবনকাহিনী নিয়েই গল্প।

    এখানে আমি যে গল্পটা বলতে চাইছি সেটা বই এর নয়, লেখকের। ধনগোপাল ছিলেন আমেরিকাতে প্রথম সফল ভারতীয় লেখক যার লেখার বিষয়বস্তু ছিল ভারত কেন্দ্রিক। ওঁর জীবনকাহিনী ছিল ঘটনাবহুল। গত শতাব্দীর প্রথম দশকে ১৯০৯ সালে আমেরিকা আসেন। এর ষোলো বছর আগে বিবেকানন্দ শিকাগো এসেছেন, এর তিন বছর পরে রবীন্দ্রনাথের ইলিনয়-তে আরবানা-শ্যাম্পেন এ প্রথমবার আমেরিকা আসবেন - তখনও তিনি নোবেল প্রাইজ পান নি, তেমন নামডাকও  হয় নি। তারও দুবছর বাদে শুরু হবে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এমন এক সময়ে, আজ থেকে প্রায় ১০৮ বছর আগে মেদিনীপুরের তমলুকের উনিশ বছরের ছেলে কিভাবে আনডকুমেন্টেড লেবার হিসেবে আমেরিকা এলেন, ক্যালিফোর্নিয়ায় পড়াশোনা করতে শুরু করলেন, ইংরেজিতে লেখালেখি  শুরু করলেন, ইস্ট-কোস্টে বাসা বাঁধলেন, আমেরিকার শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যের পুরস্কার পেলেন, আগাগোড়া লেখালেখিকে সম্বল করে জীবিকা চালিয়ে গেলেন এবং ১৯৩৬ সালে আত্মহত্যা করে মারা গেলেন  - সেই কাহিনী।

    ৬ জুলাই, ১৮৯০ এ মেদিনীপুরে জন্ম। পাঁচ ভাই, তিন বোনের সংসারে কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন তিনি। তমলুক-এ হ্যামিলটন স্কুল এবং কলকাতার ডাফ স্কুল (এখন, স্কটিশচার্চ কলিজিয়েট স্কুল) পেরিয়ে এসে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধনগোপালের দেশ ছাড়ার নেপথ্যে ছিলেন তার দাদা যদুগোপাল। যদুগোপাল সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ব্রিটিশ পুলিশের তালিকায় ওর নাম ছিল। ধনগোপাল পরোক্ষভাবে সাহায্য করতেন দাদাকে - মূলত বিভিন্ন সংগ্রামী দলের মধ্যে সংবাদবাহকের কাজ করে। যদুগোপাল ধরা পড়েন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে। দাদা বলে রেখেছিলেন ধরা পড়লে যেন সঙ্গে সঙ্গে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়, আর পারলে দেশের বাইরে থেকে ব্রিটিশ বিরোধী কাজকর্মে সাহায্য করে। দাদা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে শুনে ধনগোপাল গঙ্গায় এক ডাচ জাহাজে লুকিয়ে উঠে পড়েন যার গন্তব্য ছিল জাপান।

    টোকিওতে গিয়ে দুটি মুশকিল হয় - এক, ভাষা  আর, দুই, জাপানিদের কাছ থেকে ব্রিটিশ বিরোধী সহায়তা যতটা পাবেন ভেবেছিলেন তেমন কিছু দেখলেন না। খুব বেশি চেনাজানা নেই, জীবিকা অর্জন কঠিন হয়ে উঠল, এদিক ওদিক টুকটাক কাজ করতে লাগলেন, মূলত পোর্টের অস্থায়ী শ্রমিকের কাজ । এর মধ্যে একদিন ফ্রি খাবার দিচ্ছে দেখে এক জাহাজের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন। সুস্বাদু খাবার খেয়ে তিনি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ জানান। তার বিশুদ্ধ ইংরেজি শুনে জাহাজের কর্মকর্তারা তাকে আটকে দেন, আমেরিকায় কন্ট্র্যাক্ট লেবার হিসেবে কাজ করবার চুক্তিতে সই করিয়ে জাহাজে রেখে দেন। জাহাজের গন্তব্যস্থল ছিল স্যান ফ্রানসিসকো। এইভাবে ধনগোপাল ভাসতে ভাসতে চলে এলেন আমেরিকা।

    আমেরিকায় এসে কাজ শুরু করেন ফার্ম লেবার হিসেবে। ইংরেজি ভাষার দক্ষতার জন্য লেবারদের হয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন তিনি। এমনভাবে কয়েক মাস চলার পরে এক আমেরিকান ফ্যাক্টরি ফোরম্যান ধনগোপালের কথাবার্তায় বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ পেয়ে তাঁকে ফার্ম লেবারের কাজ ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজে ভর্তি হতে পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ মতন উচ্চশিক্ষার অজুহাত দেখিয়ে তিনি লেবার কনট্র্যাক্ট থেকে বেরিয়ে ১৯১০ সালের আগস্ট মাসে বার্কেলে-তে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় ভর্তির আবেদন করেন এবং ভর্তি হন।
     
    (চলবে - সময় সুযোগ মতন)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অন্যান্য | ২৫ মে ২০২৩ | ৪১৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    দুটি গান -- - lcm
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • hu | 24.53.190.120 | ২৬ মে ২০২৩ ০৯:০৮520058
  • একেবারেই জানতাম না। আগ্রহ সহকারে পড়ছি।
  • Sara Man | ২৬ মে ২০২৩ ১২:৫৮520060
  • ছোটবেলায় সরকারি কিশলয় বইতে ছিল "চিত্রগ্রীবের ওড়ার শিক্ষা", সেই সময়ে লেখক ধনগোপালের সঙ্গে পরিচয়। আমাদের ইস্কুলের বাংলার দিদিমণি লাইব্রেরি থেকে আসল বইটি নিয়ে এসে পড়ে শোনাতেন। 
  • যোষিতা | ২৬ মে ২০২৩ ১৭:৩২520062
  • Sara Man | ২৬ মে ২০২৩ ১২:৫৮
    একদম। চিত্রগ্রীবকে শেষ দিকটায় ঠেলে ফেলে দিয়ে উড়তে শিখিয়ে ফেলেছিল। 
     
  • Bratin Das | ২৬ মে ২০২৩ ২৩:৩০520065
  • বাহ দারুণ  লাগলো এলসিএম দা
  • Sandipan Majumder | ২৭ মে ২০২৩ ০৮:৩২520068
  • পরের পর্বের  অপেক্ষায়  রইলাম। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন