এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পোষা ভূত ও ভয়াল তান্ত্রিকদের কথা - ৭

    Sudip Ghoshal লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১০১ বার পঠিত
  • | | | | | | |
    ৩২

    পিসেমশাই বললেন, আরে বাবা ভূত পেত্নীর একটু ভালোবাসাবাসি করার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। একটু নিরালা একটু আড়াল নেই। শুধু বসন্তকাল জুড়ে হরিনাম সংকীর্তনের পালা। আর এই বসন্ত কালেই তো একটু পেত্নীর মাথায় সোহাগের হাত দিয়ে উকুন বাছতে ইচ্ছে হয়। তারও জো নেই। মানুষগুলোর হরিভক্তি যেন উছলে উঠেছে। 

    পিসেমশাই  এর তিরানব্বই বছরের ভূত বিশেষজ্ঞ জিতেন দাদু এই বসন্তকালেই ভূতপেত্নী নিয়ে গবেষণায় মাততেন। কারণ এই বসন্তে গত বছর লাইনে বুক পেতে দিলো রমা সুন্দরী চলন্ত ট্রেনের সামনে। দেহের একভাগ এপারে আর এক ভাগ ওপারে পড়লো। রমার আত্মা ভাবলো মুন্ডু থাকা অংশেই প্রবেশ করে শয়তান মানুষকে ভয় দেখাবো। সঙ্গে সঙ্গে জিতেন দাদুর সামনেই রমার মৃত মুন্ডুযুক্ত অংশের দেহটা সোঁ সোঁ করে উড়ে গিয়ে অজানা অঞ্চলে মিশে গেলো। এই রমার আত্মা জিতেন দাদুর বিছানার পাশে রাতে কাঁদত।দাদু বলতেন, বেঁচে থাকতে দাদুকে কিছু বললিন না।একই পাড়ায় আমাদের বাড়ি। একদিন যদি আমাকে এসে তোর স্বামীর অত্যাচারের কথা আমাকে বলতিস তো দেখা যেত। তবে এখনও উপায় আছে। তুই কি জানিস তোর স্বামী তোর মৃত্যুতে খুশি না অখুশি। হাসছে না কাঁদছে? রমার মুন্ডু উত্তর দিল, না দাদু সে খুশি নয়। বরং কাঁদতে কাঁদতে বলছে, রমা, আমি ভুল করেছি। ফিরে এস। দাদু বললেন, বাঃ তাহলে ফিরে যা। আর ঘুমন্ত স্বামীর বুকে আধখানা দেহ নিয়ে আদর কর। তোকে দেখেই ভিরমি খেয়ে মরবে আর তোর সাথে মিলিত হবে কাল ভূত চতুর্দশীর রাতে। রমা দাদুর কথামত চলে গেলো হাওয়ায় উড়তে উড়তে প্রথম প্রেমিকার মত। শ্বশুরবাড়ির দরজা খুলে স্বামীর ঘরে ঢুকে রমা দেখলো, স্বামী তার ছবি বুকে নিয়ে বসে কাঁদছে হাপুস নয়নে। আহা কি ভালোবাসা। রমা বুকে শুয়ে বললো, এই তো আমি এসে গেছি। চলো যাই একসাথে। স্বামী তাকে দেখামাত্রই পগার পাড়। পপাত মেঝেতলে। আর সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল। রাতেই উড়ে চলে গেলো প্রাণপাখি। আর আগামীকাল ভূত চতুর্দশীর রাতে মিলিত হবে তাদের আত্মা। অপঘাতে মৃত দুইজনে ঘুরে বেড়াবে অনন্তকাল।

    আর একবার, জিতেন দাদু এই বসন্তে প্রেমিক যুগলের দেহে দুটি আত্মার সন্ধান পেয়েছিলেন। তারা দেহে প্রবেশ করে অতৃপ্ত শখ পূরণ করেছিলো। এইসব ঘটনা বসন্তকালেই ঘটেছে। অন্য ঋতুর সময় তারা ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন কাজে। কিন্তু বসন্তকালে হৃদয়ে জেগে ওঠে মানুষের প্রেমজীবনের প্রতি হিংসার ভয়াল রূপ। এই প্রেমে পরাজিত বা প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রাণ যায় হাজার হাজার প্রেমিক প্রেমিকার। শুধু ভ্যালেনটাইনস ডে তে নতুন ভূত পেত্নীর তালিকায় যুক্ত হয় শত শত ব্যর্থ হৃদয়। এই তো গত বছর চোদ্দ তারিখে ফেব্রুয়ারী মাসে জিতেন দাদুর নাতনী পাড়ার জগা গুন্ডার সঙ্গে একসাথে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিলো।
    তারপর থেকে গবেষক ও পুরোহিত দাদু নাতনির খোঁজে দুস্তর গবেষণা করে তার আত্মাকে বন্দী করতে পেরেছেন।ভালোবাসার জন্য ভ্যালেনটাইন্সের মত দাদুও অনেক আত্মত্যাগ করছেন। মৃত প্রেমিক যুগলের মিলন ঘটানোই তার প্রধান উদ্দেশ্য। তার জন্যে দিনরাত তিনি না খেয়ে গবেষণা করেন নিরন্তর। মৃত নাতনি শুধু বলে, দাদু, আমার জগাকে ও এনে দাও।দাদু বললেন শুনবি জগা গুন্ডার কথা। নাতনি বললো শুনবো। দাদু বললেন, ওর আসল নাম গদাই। ওরা সময়মত নাম পরিবর্তন করে। শোন তাহলে তার কথাই বলি, 
    সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একসাথেই বেড়ে উঠেছিল গদাই। তবু এক অন্য ছাঁচে গড়ে উঠেছিল তার জীবন যৌবন। যখন কোনো ছেলে লুকোচুরি খেলায় খুঁজে পেত আনন্দ ঠিক তখনই গদাই কারও পকেট থেকে তুলে নিত টাকা পয়সা বা কোনো খাবার। কি করে বোকা বানিয়ে অন্যকে ঠকাতে হয় তা ঠিক সে জানত। আর এই কাজেই সে আনন্দ পেত সর্বাধিক। বিধির লেখা প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদাভাবে লেখা হয়। 

    যখন গদাই চোদ্দ বছরের কিশোর তখন অন্য কিশোরদের মত সে স্কুলের গন্ডিতে পা রাখে নি। একটা বাড়িতে ঢুকে সাইকেল নিয়ে পালিয়ে গেলো পিসির বাড়ি। একদিন সবকিছু জানাজানি হলে গদাই বললো, আমাকে খাওয়ালে সাইকেল পেয়ে যাবি। সাইকেলের মালিক তাকে পেট ভরে খাওয়ানোর পরেও সে সাইকেল দেয় নি। শেষে মার খেয়ে শোধ করলো সাইকেলের ঋণ। 

    সেই শুরু চুরিবিদ্যার। তারপর থেকে সে হাত পাকিয়ে নিয়েছিলো ডাকাতির দলে। তার নাম শুনলেই এলাকার লোক ভয় করত তাকে। পুলিশ ধরেছে বহুবার। সে বলত, পুলিশের মার খাওয়ার আগে গাঁজা টেনে নিয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতাম। লাঠির আঘাত কাবু করতে পারে নি আমাকে। এইসব শুনিয়ে সে সকলের কাছে বাহাদুরি কুড়োত। 

    এই গদাই একদিন এক শহরের বউকে পটিয়ে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করত। বউটির স্বামী চাকরির জায়গায় থাকত। এই সুযোগে গদাই তার বাড়িতে ঢুকে তার বউএর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করত। বউটাও তাকে প্রশ্রয় দিত, টাকা পয়সাও দিত। একদিন পাড়ার লোকের কাছে ধরা পড়ার পরে গদাই মার খেয়ে শহর ছাড়লো। এখন সে রিক্সা চালায়। খেটে খায়। তারপর একদিন শোনা গেলো গদাই সবকিছু ছেড়ে সাধুর বেশে ঘুরছে। মটরসাইকেল, ট্যাক্সি -র ড্রাইভারদের কাছ থেকে ঠাকুরের নামে সিঁদূর পরিয়ে টাকা আদায় করত সারাদিন। তারপর একদিন শুনলাম সে প্রেমিক হয়েছে আমার নাতনীর। হয়ত পরশপাথরের ছোঁয়ায় সোনা হয়েছে। কিন্তু তুই আমাকে কিছু না জানিয়ে লাফ দিলি বাইরের এক অজানা প্রেমিকের সাথে। ছোটো থেকে তুই মা বাবা হারা একমাত্র এই বংশের প্রদীপের সলতে। তাও তুই চলে গেলি দাদুর কথা না ভেবে। কেন একবারও কি বলতে পারতিস না তোর ভালোবাসার কথা। নাতনির আত্মা বলে উঠলো, ক্ষমা করে দাও দাদু। আর আমার প্রেমিককে এনে দাও আমার কাছে। আমি আর তাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। নাতনি নাছোড়বান্দা। দাদু আবার বললেন, ওর আত্মা দুষ্টু আত্মা। ওকে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। 

    কিন্তু নাতনি সব শোনার পরও বললো, ওসব আমি জানি না। আমার ওকেই চাই। দাদু বললেন, ওর আত্মাটা নিম্নস্তরের। তোকে জ্বালাবে তার সঙ্গে সমাজটাকেও জ্বালাবে। ওইসব আত্মা মুক্তি পায় না সহজে। তবু তোর খুশির জন্য আমি ওকে তোর কাছে নিয়ে আসবো। নাতনির কথা অনুযায়ী দাদু তাই করলেন। এক্ষেত্রে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি দাদুকে। কারণ জগা সত্যিই ভালোবাসত তার নাতনিকে। কিন্তু দাদু বুঝতে পারেন নি নাতনি বেঁচে থাকতে । তাই এখন তিনি দুই আত্মার মিলন ঘটাতে চান যে কোনো উপায়ে। তিনি দুই আত্মাকে ঘরে বন্দী করেছেন। এখন প্রয়োজন দুটি মৃতদেহের। নামকরা বিশেষজ্ঞ তিনি। মৃতদেহ পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। হাসপাতাল থেকে পেয়ে গেলেন দুটি মৃতদেহ। তাদের কোনো অভিভাবক বা আত্মীয়স্বজন ছিলো না বা খোঁজ পাওয়া যায় নি। তাই দাদু সমস্ত আইন মান্য করে গবেষণার জন্য এই দুটি দেহ নিজের কাছে আনলেন। পরের দিন সকাল বেলা থেকে প্রায় সপ্তাহখানেক দাদুর দেখা পাওয়া গেলো না। ব্যস্ত দাদু তার গবেষণা নিয়ে। 

    তারপর এক সপ্তাহ পরে দাদু অন্য দেহে আত্মা প্রতিস্থাপনের কাজে সফল হলেন। নাতনি এখন সমস্ত শখ পূরণ করতে পারবে জেনে দাদুর খুব আনন্দ হলো। দুটি দেহ ঘুরেফিরে বেড়াতে লাগলো চোখের সামনে। একটা নর ও আর একটা নারীদেহ। জগা গুন্ডার আত্মা দেহ ফিরে পেয়ে শয়তানি শুরু করলো। নাতনি বোঝালো, বেশি বাড়াবাড়ি করো না। দাদু রেগে গেলো দেহ কেড়ে নেবে। সুন্দর মানুষ হও। তা না হলে কদিনের এই দেহের মায়া ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেহ দুটি দেখে অবাক হয়েছিলেন। তাহলে মৃত মানুষকে বাঁচানো যাবে জিতেন দাদুর গবেষণার মাধ্যমে। কিন্তু জিতেন দাদুর খোঁজে এসে পুলিশ কমিশনারসহ বিজ্ঞানীরা এসে দেখতে পেলেন জগা গুন্ডা, দাদুর গলা টিপে ধরে খুন করলো। শেষ হয়ে গেলো এক বিশাল বিশেষজ্ঞের জীবন। কমিশনার গুলি ছুঁড়লেন। সামনে এসে দাঁড়ালো প্রেয়সী, প্রিয় দাদুর নাতনির দেহ। সে মরলো আর জগা গুন্ডা ছুটে চলে এলো কমিশনারকে খুন করতে। বিন্দুমাত্র কাল বিলম্ব না করে তিনি গুলি করলেন, ভয়ঙ্কর কালপুরুষ জগা গুন্ডার দেহে। লুটিয়ে পড়লো দেহ। আর শেষ হয়ে গেলো জিতেন দাদুর গবেষণার সফলতার প্রমাণ। 

    হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হায় হায় করে উঠলো এতবড় সফলতার করুণ পরিণতিতে।

    পিসেমশাই বললেন, এই ঘটনাটা আমি অনেক জায়গায় বলেছি কারণ আমার তান্ত্রিক মনে এটা গভীর দাগ কেটে চলে গেছে। জিতেন দাদুর কাছে অনেক তন্ত্র মন্ত্র শিখেছি। তিনি বলতেন, নিছক ভূতকে নিয়ে ঠাট্টা করতে নেই। অথচ তিনিই ভূতের শিকার হলেন।
    রতন ফিসফিস করে আমাকে বললো, আপনারও এই অবস্থা হবে না তো?  
    আমি বললাম, চুপ। পাকামি করিস না।
    পিসেমশাই তখন কপালভাতি আর অনুলোম বিলোম শুরু করেছেন। এখন তিনি কথা বলবেন না। প্রাণায়াম  চলবে প্রায় দু ঘন্টা। 

    র উপর থমকা মন্ত্র লাগাবো। তোরা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠতে পারবি না....

    ৩৩

    পিসেমশাই বললেন, ইতিহাসে পড়েছি এই গল্পটা। ইতিহাস মিছে কথা বলে না।
    রতন ফোড়ং কাটলো, ফিস ফাস কথা কয় পুরোনো দেওয়ালে। আমি বললাম, চুপ কর না...

    তারপর পিসেমশাই মুখে এককুচি কি একটা নিলেন। ওটা কাউকে বলেন না। তারপর শুরু করলেন কাহিনী। 

    কালীঘাট পার্কের পিছনে নির্জন ফাটক দিয়ে ঢুকলে বিরাট সমাধিস্থল দেখা যায়।টিপু সুলতানের আত্মীয়দের সমাধিস্থল রয়েছে। টিপু সুলতান জাহাজে করে ফরাসি অস্ত্রশস্ত্র আনিয়েছিলেন।শেরালিঙ্গট্রমের যুদ্ধে টিপু মারা যান। ব্রিটিশ সৈন্য অনেক বেশি থাকার জন্য টিপু যুদ্ধে হেরেছিলেন। টিপুর দুই ছেলে আনোয়ার শাহ্ আর গোলাম মহম্মদ শাহ শিক্ষিত ও রুচিবান মুসলমান ছিলেন।

    কলকাতার সতীশ মুখার্জি রোডের আশেপাশে এক বিরাট জনবসতি গড়ে উঠেছে। অফিসের কাজে বিকেলবেলা আমি আর অজয় একটা লজে ঘর ভাড়া করে থাকলাম। আজকের রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে তারপর আগামীকাল অফিসের কাজ সারা যাবে। এই মনে করে আমরা হোটেল থেকে বিরিয়ানি আনালাম। অজয়ের খুব প্রিয়। 

    খাওয়া দাওয়া হয়ে যাওয়ার পরে ঠিক  রাত বারোটার সময় অফিসের ফাইল রেডি করে আমরা শুতে গেলাম।আমার আজকে ঘুমোতে ইচ্ছে হলো না। এক স্বর্গীয় চাঁদের আলোয় আজকের রাতটা আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে।

    হঠাৎ আমি দেখলাম সমাধিস্থলের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আলখাল্লা পরিহিত এক মূর্তি। আজ সন্ধ্যাবেলায় লজের দারোয়ান বলছিলো,রাতে শুয়ে পড়বেন বাবু। এদিকে বারান্দায় আসার প্রয়োজন নেই।

    তারপর আমি অজয়কে ডেকে তুললাম। অজয় বললো,এ নিশ্চয় গোলাম মহম্মদ শাহের অতৃপ্ত আত্মা। চারদিকে বট, অশ্বত্থের ঝুরি নেমেছে। আমাদের ভয় লাগছে না তবু হাড়ের ভিতর দিয়ে একটা ঠান্ডা অনুভূতি খেলে চলেছে।

    আমরা দুজনে একবার এক প্রত্যন্ত গ্রামের পোড়ো বাড়িতে দু রাত কাটিয়েছি। ভ্রমণ আমাদের রক্তে মিশে আছে। সুযোগ পেলেই অফিসের কাজে হোক কিংবা ছুটিতে আমরা ঘুরতে চলে যাই বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। এই বাংলার বাতাসে মিশে রয়েছে ঐতিহাসিক অনেক কান্ড যা খুঁজলে এক মহাভারতের আকার নেবে।সেখানে আমরা এই আল্খাল্লা পরিহিত সুলতানের সাজ দেখেছিলাম। হয়ত এর সঙ্গে তার কোথাও মিল আছে। 

    খোঁজ নিয়ে জানলাম টিপু সুলতান একবার শিকারে এসে এই জঙ্গলে আস্তানা গেড়ে এই বিরাট সৌধ তৈরি করেছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে গ্রাম। গ্রামের সমস্ত সুযোগ সুবিধা সুলতানের দয়ায় হয়েছিলো।রাস্তাঘাট,হাট,মাঠ সর্বত্র এক উন্নয়নের জোয়ার ছিলো। তারপর কালক্রমে এই পুরোনো বাড়ি ভগ্নাবশেষে পরিণত হয়েছে।আমি আর অজয় এই বাড়ির পাশের বাড়িতে এক রাত কাটিয়েছিলাম। আজ কলকাতা এসে সেই কথা খুব মনে পড়ছে।

    গভীর রাতে আলখাল্লা পরিহিত সুলতান ধীরে ধীরে কবরের আশেপাশে ঘুরতে লাগলো।তারপর নর্তকি এলো,গান,বাজনা হলো।জানলা খুলে আমরা দুজনেই অই দৃশ্য দেখে ভয়ে কম্পমান,এই যুগে নবাব এলো কোথা থেকে। হঠাৎ কি করে গজিয়ে উঠলো নৃত্যশালা। ভয়ে আমরা দুজনেই  কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। সকালে উঠে দেখলাম, ফাঁকা জায়গা। কোথাও কিছু নেই। তাহলে এটা নিশ্চয়  কোনো ভূতের কারসাজি। অই মাঠের কাছে বয়স্ক লোকদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম,এখনও নবাব প্রতি রাতে নৃত্য আর সংগীতের মেহফিল বসান নিয়মিত।
    পিসেমশাই আবার বলতে শুরু করলেন, পাড়ায় একটা সুন্দরী মেয়ে ঘুরে বেড়ায় কয়েকদিন ধরেই। এত সুন্দরী মেয়ে এপাড়ায় আছে বলে তো মনে হয় না। রমেন বলল, চায়ের দোকানে চা পান করতে করতে। তার বন্ধু বিমান একটু নারীঘেঁষা পুরুষ। সে বলল, আহা মেয়েটাকে বিছানায় কেমন মানাবে বল তো?  মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি রাজি। যাব তোমার সঙ্গে। রমেন বলল, এত  দূর থেকে আপনি কি করে কথা শুনলেন।মেয়েটি বলল, আমি শুনতে পেলাম। তাই বললাম। বিমান বলল, আমিও রাজি। চল আমার সঙ্গে।
    রমেন বলল, যাস না। জানি না শুনি না। মেয়েটাকে নিয়ে তুই চললি বিছানায়?  বিমান একা। অকৃতদার সে। বাড়ি ফাঁকা। বেশ আয়েস করে বলল, চল সুন্দরী তোমার কোন অভাব রাখব না।রমেন পরের দিন রাতে বিমানের বাড়ি গেল। বিমান চায়ের দোকানে আসে নি। হয়ত সুন্দরীর পাল্লায় পরে সব ভুলে গেছে।

    রমেন বিমানের বাড়ি ঢোকার আগেই একটা বাদুড় ডানা ঝটপট করে বেরিয়ে গেল বিমানের বাড়ি থেকে। সে দেখল, বিছানায় বিমানের রক্তাক্ত দেহটা পড়ে। পুলিশকে ফোন করল সে। পুলিশ এসে দেখল, বিমানের ঘাড়ের কাছে দুটো দাঁতের দাগ। গলার নলিতে কামড়ে কে  যেন নলি ছিঁড়ে নিয়েছে।

    সুন্দরী মেয়েটা গুরুগুরু করে আজও বেড়াচ্ছে। রমেন দেখল চায়ের দোকানে  পাশে এসে বসে দশবার দাঁত বের  করে হাসছে।

    রমেনেরর সন্দেহ হলো এই মেয়েটাকে বিমান নিয়ে গিয়েছিলো। অথচ বিমানের রক্তাক্ত দেহ বিছানায় পড়ার সময় তাকে তো দেখা যায়নি।সুন্দরী মেয়েটি  সোম কে বলল, যাবে নাকি তুমি বিমানের মত? 
    রমেন ছুটে পালাতে চাইলো। কিন্তু ছুটতে পারল না। পা দুটো যেন আঠার মত আটকে গেছে।রমেনের বিরক্তিকর মুখ দেখে মেয়েটি আর কিছু বলল না। সে  আরেক জনকে বললো যাবে আমার সঙ্গে। সোম ভাবল, মেয়েরা এত নির্লজ্জ হতে পারে? কেউ ভাবতে পারিনি। তবু সেই ছেলেটি বলল,হ্যাঁ যাব। সুন্দরী বলল, আমি রাতে দেহ ব্যবসা করি। লজ্জা করলে হবে বলো নাগর?
    সোম আহ্লাদিত হল। সে বলল, আমার গাড়ি আছে পার্কিং জোনে। চল গাড়ির ভিতরে যাই।আবার সকাল হলে সোমের রক্তমাখা দেহ পরে থাকতে দেখল সবাই। রমেন থানায় ফোন করে বলল, সোম একটা মেয়ের সঙ্গে রাতে ছিল। মেয়েটিই খুনী মনে হয়।আজ রাতে পুলিশ সদলবলে চায়ের দোকানে বসল সিভিল ড্রেসে। রমেনের কাছে মেয়েটি এল। সে রমেনকে বলল,এবার তোমার পালা। চল আমার সঙ্গে।রমেন কাঁপতে শুরু করল। পুলিশ সক্রিয় হল। মেয়েটিকে ধরে নিয়ে চলে গেল থানায়। রাতে বন্দি হল সে।
    পরের দিন সকালে আই সি দেখলেন, গারদের মেঝেয় পড়ে আছে একটা মরা বাদুড়।

    পিসেমশাই ভয়ংকর ভৌতিক কাহিনীও বলেন। তাকে অনেক জায়গা যেতে হয়। সেইজন্য তার স্টক ফুরোয় না। পাশপর বাড়ির অজয় আজ তার মোটর বাইকের চাবিটা খুঁজে পাচ্ছে না। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরে দেখলো একটা লোক দোতলার ঘরে সিলিং ফ্যানে ঝুলছে। তার পকেট হাতড়ে খুঁজে পেলো বাইকের চাবিটা। আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে। আজকে রিয়াকে নিয়ে মায়াপুর যাবে। গতকাল রিয়াকে সন্টুর বাইকের পিছনে দেখে পাগল হয়ে গেছিলো। মরতেও গেছিলো। আজ চাবিটা নিয়ে ছুটে চলেছে রিয়ার কাছে। সন্টুর আগে তাকে পৌঁছতে হবে প্রেমিকার কাছে। আজ বেশ হাল্কা লাগছে নিজের শরীরটা। অজয় মনে মনে ভাবলো,প্রেম বেশ জটিল ব্যাপার। রিয়াকে আজ গাড়িতে চাপিয়ে বেশ মজা করে ঘুরে বেড়াবে। মানুষ ছাড়া গাড়িটা চলতে দেখে অনেকে ভয়ে পালিয়ে গেলো। রিয়া আর সন্টু দেখলো,বাইকটা ছুটে আসছে তাদের দিকে ঝড়ের গতিতে...পিসেমশাই বললেন, আমার ঘরের জানালা থেকে আরোহীবিহীন মটর সাইকেল দেখেই বুঝেছিলাম, মালে গিঁট আছে... 

    আমার ফোনটা বেজে উঠল। কানে ঠেকাতেই কর্ণ বিদারক কান্না। এই শুনছো, আমি স্টেডিয়ামে আছি। তুমি চলে এস।  পিসেমশাই বললেন, প্রেম করতাম তখন আদৃজার সঙ্গে।   তড়িঘড়ি স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখি অনুপমের কোলে আদৃজা। অনুপম দৃশ্য। 
    কি রে তোর রমার  খবর কি?  অনুপম কুকুর দাঁত বের করে বললো, আমি আদৃজাকে ভালোবাসি।রমা আমার অবসরের সঙ্গিনী। ভ্যালেনটাইন্স ডে তে সত্যিটা জেনে যা। আদৃজা আমায় মোবাইলে কল করে ডাকলে কেন,আমি বললাম আদৃজাকে। তাকে আমি ভালোবাসতাম। আদৃজা কোনদিন আমাকে সত্যিটা বলে নি। আদৃজা বললো, তুমি একবার বললে আমার মা বাবা রাজী হবে আমাদের বিয়েতে।  আমি অনুপমকে বিয়ে করতে চাই। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো, তাহলে এইটুকু স্বার্থত্যাগ করতে পারবে না?  প্লিজ আমার জন্য, প্লিজ... আমি সম্মতি দিয়ে আদৃজার বাড়ি গেলাম।  বাড়ি গিয়ে কাকিমা আর কাকুকে ডেকে বললাম, অনুপম ভালো চাকরি করে। আদৃজার বিয়েটা ওখানেই দিন। আমার কথা শুনে কাকু আর কাকিমা কাঁদতে শুরু করলেন। আমি বললাম, কি হলো। কাঁদছেন কেন?  কাকু বললেন, ওরা দুদিন আগে আমাদের বলেছিলো। কিন্তু আমরা রাজী না হওয়ায় ওরা নিজেরাই বিয়ে করেছে আর... 
    আর কি?  বলুন?  আজ ওরা দুজনেই শান্তিতে শুয়ে আছে শ্মশানে। বিয়ে করলো তো মরল কেন? 
    কাকু বলল, আমাদের  শাস্তি  দেবে বলে। 
    এরা তো আচ্ছা  আহাম্মক, আমি একটা টোটো ভাড়া করে শ্মশানে গেলাম। তখন ইলেকট্রিক চুল্লিতে সব শেষ। হঠাৎ চুল্লীর ওপারে আদৃজাকে দেখতে পেলাম।সিঁদূর ঢেলে সিঁথি সাজানো । দারুণ লাগছে । ঠিক মা মা ভাব। সে বলছে, কি গো। আমার বাবা মা রাজী হলো অনুপমের সঙ্গে বিয়েতে?  হবে না জানতাম । এবার আমরা ভালভাবে সংসার করব। আত্মার মিলনে আমাদের সংসার।
    আমার চোখকে বিশ্বাস  করতে পারলাম  না,আমি নিজেইম।আর আদৃজার  প্রশ্নের আমি কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না...এই ভৌতিক ঘটনাটি আজও আমি  ভুলতে পারি নি...পিসেমশাই চোখ মুছে বললেন, তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি মহাতান্ত্রিক হব। তারপর আর বিয়ে করি নি। এখনও প্ল্যানচেট করলে রাতে আদৃজা আসে, কথা বলে।
    রতন বললো, এই হলো আসল প্রেম। তাহলে..
    রতন খুব বেয়াড়া। দেহ সম্পর্কের কথা জানতে চাইছিলো। আমি বললাম, যতই হোক পিসেমশাই হন আমাদের। আদৃজাকে আমরা পিসি বলতাম। সেই থেকে পিসেমশাই বলি এনাকে। আসল নামটা কেউ জানে না ভাই। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন