এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কাজু কিশমিশ এবং হাহুতাশ 

    Suvasri Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ মার্চ ২০২৪ | ২৪৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • কাজু কিশমিশ এবং হাহুতাশ

    শৌখিন খাওয়াদাওয়া ও স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে এই সামান্য লেখা। তাও খুব বেশি ঘটনার কথা বলব না।

    আমার বোন মামনের বন্ধু, ধরা যাক তার নাম টুয়া। এই টুয়া বাবা মায়ের একটি মাত্র সন্তান। বেলঘড়িয়ায় তাদের বাড়ি। টুয়ার মায়ের লিভারে ক্যানসার হয়েছিল। সেই সময় মামন ও টুয়া দুজনেই এম এ পড়ছে। এক জন কলেজ স্ট্রিট, আরেক জন হাজরা ক্যাম্পাসে। টুয়ার বাবা স্ত্রীকে নিয়ে খুব বেশি দৌড়োদৌড়ি করতে পারতেন না। ফলে টুয়াকেই দৌড়তে হ'ত। হাজরা ক্যাম্পাসে ছোটা, আর জি কর হাসপাতাল দু' জায়গা সামলাতে সামলাতে সে হাঁপিয়ে উঠেছিল। সেই সময় মামন ওকে অনেক সাহায্য করেছে। টুয়া একেক দিন রাতে আমাদের বাড়িতে থেকেও যেত।

    টুয়ার মায়ের অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি চলেও গেলেন। শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে যাওয়ার কিছু দিন পরে মামন আর টুয়া মিলে ওদের বাড়ির রান্নাঘর পরিষ্কার করছিল। একটা কোটো থেকে বেশ কিছুটা দাগ ধরা কাজু আর কিশমিশ বেরলো। দেখে টুয়ার চোখে জল। শেষের দিকে ডাক্তার ওদের বলে দিয়েছিলেন, "মা যা খেতে চাইবেন, খাওয়ান।" ওঁর ইচ্ছা মতো কাজু, কিশমিশ আনাও হত। কিন্তু সেগুলোর বেশিরভাগই উনি পরে ভালো ভালো খাবারে দেওয়ার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। নিজে কমই খেয়েছিলেন।

    মানুষের ছোটো ছোটো বাসনা থাকে। বেশিরভাগই মেটে না। এমন কী মৃত্যুপথযাত্রিণী এক মহিলাও সেরে উঠে পায়েস আর পোলাও বানানোর বাসনা রাখতেন। হায় রে, বাসনার খাঁচায় বন্দী সামান্য মানুষ!

    আরেকটি ঘটনা বলি। তখন আমি স্কুলে পড়ি। তখন এ কে মুখার্জি রোডের সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম। কাছাকাছি থাকত কিছু দরিদ্র মানুষ যারা কায়িক পরিশ্রম করে পেটের ভাত যোগাড় করত। ওদের গলিতেও ফলওয়ালা যেত। এক দিন একটা বাচ্চা ছেলে ওই ফলওয়ালার ঝুড়ি থেকে একটা আপেল চুরি করেছিল। ছোট্ট ছেলেটার জীবনে আপেল নিশ্চয় এক দুস্পাপ্য ও লোভনীয খাবার ছিল। কিন্তু তার চুরি ধরা পড়ে যায়। ফলওয়ালা তার মায়ের কাছে অভিযোগ করলে মা কোনো রকমে আপেলটার দাম দিয়ে দেয়। সেই যুগে একটা আপেলের দাম হয়তো দু' তিন টাকাই ছিল। কিন্তু তাদের মতো গরীব পরিবারে হঠাৎ করে দু' তিনটাকা বার করাও সহজ ছিল না। যাক গে, মা ফলওয়ালাকে টাকা দিয়ে ঘরে এসে ছেলেটাকে আপেল খাওয়ার জন্য ডাকল। ছেলে সাগ্রহে খেতে এল কিন্তু আপেলের খোঁজ নেই। ততক্ষণে তার দুই ছোট ভাই মিলে আপেলটা খেয়ে নিয়েছে। তাদের কাছেও তো ওটা দুর্লভ, মা দাদাকে পুরোটা খাইয়ে দেবে, সেই ভয় ছিল। নিঃসন্দেহে কষ্টের ব্যাপার।

    আমার বাবা ভাইবোনদের সঙ্গে বীরভূম জেলার বামপুরহাটে বড় হয়েছিল। ঠাকুর্দার বদলির চাকরির সূত্রে কিছু দিন দিনাজপুর শহরে থেকেছিল তা ঠিক। তবে বাবার কৈশোর-যৌবনের বেশিটাই রামপুরহাটে কেটেছে। বাবাদের শৈশবে কৈশোরে এখনকার মতো এত ডিম পাওয়া যেত না। এত পোলট্রি ছিল না তখন, ভিন রাজ্যের ডিমও আসত না। পাওয়া যেত না বলেই ডিম বাবাদের কাছে লোভের জিনিস ছিল। অনেক দিন পরে হয়তো কুড়ি বাইশ বছর বয়সে ট্রেনে কোথাও যাওয়ার সময় খড়গপুরে সেদ্ধ ডিম বিক্রি হতে দেখে বাবা তো অবাক। আনন্দ করে কিনে খেয়েছিল।

    পরের ঘটনা মায়ের মুখে শোনা। আমাদের অনেক অনেক দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র কথা। প্রথম স্ত্রী একটি মেয়েকে রেখে মারা যাওয়ার পর ভদ্রলোক আবার বিয়ে করেন। সৎ মা আগের পক্ষের মেয়েকে সহ্য করতে পারত না৷ বাবা মেয়েকে ভালোবাসে৷ সে জন্য স্বামীর থালায় সে ভাতের সঙ্গে রোজ ছাই বেড়ে দিত।

    আগের পাড়ায় দেখেছি, হাঁড়িতে করে খেজুর রস বিক্রি করতে এসেছে একটা লোক। কতকগুলো ছেলে পয়সা দিয়েই এক গ্লাস করে নিল। এমন সময় লোকটাকে গলির ভেতর থেকে কেউ ডাকায় সে একটু ভেতরে গিয়েছিল। সেই সুযোগে ছেলেগুলো তার হাঁড়ির থেকে গ্লাসে করে বেশ কিছুটা রস তুলে নিল।

    এবার আমার নিজের অভিজ্ঞতা। ক্যুরিয়ার থেকে একটা লোক আমাদের বাড়িতে কিছু দিতে এসেছিল। ২০০২-৩ সালের ঘটনা। তখন তো বাড়িতে বাবা, মা আর আমি। চারতলা থেকে নিচে নেমে সই করে জিনিসটা নিলাম। যিনি দিতে এসেছিলেন তিনি আমাকে বললেন, "দিদিভাই, একটু চা খাওয়াবেন? সেই কখন থেকে ঘুরছি, চা খেতে এত ইচ্ছে করছে!"
    আমি সম্মতি জানালাম। লোকটিকে বললাম - আমার সঙ্গে ওপরে আসুন। ওপরে এসে বাবামাকে লোকটির কথা বললাম। তারপর চার জনে চেয়ারে বসে চা আর মুড়ি খাওয়া আর গল্প হল। কথায় কথায় লোকটি জানিয়েছিল, ক্যুরিয়ার কোম্পানি তাকে সাতশো-আটশো দেয়। তাছাড়া স্ত্রী টিউশনি করে কিছু কিছু রোজগার করে। সব মিলিয়ে সংসার ভালো করে চলে না। কষ্ট করেই চালাতে হয়।
    সে দিন বাড়িতে মিষ্টি ছিল না, লোকটিকে আমরা চা আর তেল ও পেঁয়াজ সমেত মাখা মুড়ি দিয়েই আপ্যায়ন করেছিলাম। লোকটিকে ওপরে আনার মতো সাহসও আমার ছিল। জানতাম বাবা-মা খিঁচিয়ে উঠবে না। মনে আছে, ওই সামান্য আপ্যায়নেই লোকটি খুব খুশি হয়েছিল।

    বোধহয় আমাদের সবারই খাওয়া ও খাওয়ানো নিয়ে অনেক রকম অভিজ্ঞতা আছে। মানুষকে খাইয়ে পুণ্য হয়, এটা আমি মানি না তবে একটু আনন্দ অবশ্যই পাওয়া যায়।

    অবশ্যই খাওয়ান, মানুষকে পেট ভরে খাওয়াতে না পারেন, মন ভরে খাওয়ান, আন্তরিকতার সঙ্গে খাওয়ান। আর হ্যাঁ, যার পেট ভর্তি তাকে জবরদস্তি করে খাওয়ানো আমার পছন্দ নয়। বাকিটা রান্নাঘর আর পকেটের দশা, অন্তর্দশা অনুযায়ী!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Aranya | 2601:84:4600:5410:9d25:34d1:80b1:4613 | ১৮ মার্চ ২০২৪ ০০:৫৬529523
  • বেশ 
  • রৌহিন | 2401:4900:7066:55f1:141e:1271:3d89:acdc | ১৮ মার্চ ২০২৪ ০৯:১১529527
  • পূণ্য বলে কিছু যদি আদৌ হয়, তবে তা মানুষের সাথে মানুষের মত ব্যবহারেই একমাত্র অর্জন করা সম্ভব মনে হয়। আর কোনো কিছুতে নয়।
     
    লালন বলেছেন,
    "সহজ মানুষ 
    ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে
    পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে
    ভজো মানুষের চরণ দুটি
    নিত্যবস্তু পাবে খাঁটি
    মরিলে সব হবে মাটি
    ত্বরায় এ ভেদ লও চিনে।"
  • শুভশ্রী রায় | 2401:4900:7077:c6d9:fe7a:846c:a685:ff45 | ২১ মার্চ ২০২৪ ০৭:২৬529618
  • যারা যারা লেখাটি পড়েছেন, যারা মতামত দিয়েছেন, তাদের সবাইকে অফুরন্ত ধন্যবাদ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন