এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • প্রতিবেশী গতি শেষই

    Suvasri Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ মার্চ ২০২৪ | ১৬৬ বার পঠিত
  • যেখানেই থাকো তুমি, আশেপাশে নানা রকম প্রতিবেশী থাকবেই। তাদের সঙ্গে তোমাকে মানিয়ে চলতে হবে। সে তো সত্যি, তবে অনেক জায়গায় অনেক রকম প্রতিবেশী পেয়েছি। সেই বৈচিত্র আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে ভরপুর করে তুলেছে এবং করেই চলেছে। প্রতিবেশীদের নিয়ে যত রকম অভিজ্ঞতা আছে সব বলতে গেলে আমার বাকি জীবনটাও যথেষ্ট নয়। তাই কিছু অভিজ্ঞতার উল্লেখ করছি।

    এখন তো পাইকপাড়ায় থাকি। এখানে থিতু হওয়ার আগে বেশ অস্থির বাস গেছে আমাদের। সেই অতীতের কিছু ঘটনা বলব আজ, কিছু এখনকার সময়কার। কিছু নাম পাল্টে দিতে হবে।

    অনেক দিন আগে কাঁকুলিয়া ক্রসিং পার হয়ে একটা রাস্তায় বড়সড় বাড়ির একতলায় ঘিঞ্জি দু'টো ছোট্ট ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভাড়া থাকতাম। আলো যথেষ্ট হলেও হাওয়া ব্যাপারটার সঙ্গ ধরত পাশের খোলা নর্দমার গন্ধ। অাশেপাশে পাকা বাড়ি এবং বস্তি সব রকমই ছিল। বাড়িওয়ালা দাদু দিদার দুই ছেলে উকিল। একটি মেয়ে বিয়ের পরে হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় থাকত। এরা সবাই মানুষ ভালো ছিল। সেই ১৯৭৯-১৯৮০ সালে সামাজিকতা জিনিসটা এত শুকিয়ে যায়নি। এখন তো বিশেষ করে উচ্চবিত্তদের ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে সহজ সামাজিক আদানপ্রদান বিশেষ চোখে পড়ে না। যাই হোক, ওই বাড়িটার উল্টো দিকে একটা বড় দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ির একতলাতে থাকতেন অসম্ভব সুপুরুষ এক দাদা ও দিদি। দাদাটির নাম ধরা যাক, সেবুদা। পাড়ায় সবাই বলত, সেবুদা ও তাঁর বোনের মধ্যে কথাবার্তা নেই। সেবুদা কিছু দিন আমাকে অঙ্ক করিয়েছিলেন। খুব ভালো অঙ্ক বোঝাতেন।

    যাই হোক, সেবুদা কী একটা লম্বা মতো বাদ্যযন্ত্র ভালো বাজাতে পারতেন এবং শেখাতেনও। মুখে লাগিয়ে সেটা বাজাতে হয়। রোজ বিকেলে ওঁদের বারান্দায় বেশ কয়েকটা ছেলে এসে হাজির হত। শেখা চলত। সেই সমবেত সুর সাধনায় আমরা মাঝেমাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম। ওপর তলায় থাকতেন সেবুদার কাকার পরিবার। তাদের বাড়িতে আমি মাঝেমাঝে হারমোনিয়াম বাজাতে যেতাম। মা তার স্কুলের এক শিক্ষিকার গানের স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ফল কিছু হয়নি। শেখানো সব গানই জীবন থেকে মুছে গেছে। না শেখা গানগুলোই যখনতখন গুনগুন করি।

    টবিন রোডের কাছে এ কে মুখার্জি রোডের সরকারি আবাসনেও বিচিত্র সব প্রতিবেশী ছিলেন। এক ভদ্রমহিলা আমাদের টিভিতে সিনেমা দেখতে আসতেন। বীরভূমের এক গন্ডগ্রামে তাঁর আসল বাড়ি। তিন সন্তান সহ বিপত্নীক এক সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরে তাঁর নিজেরও দুটি ছেলে হয়। টিভি দেখার জন্য ইনি আমাদের বাড়িতে এসে খাটের ওপর দু' পা দিয়ে একটু হেঁটে নিতেন। তারপর বসতেন। যে কোনো ব্যাপারে অবাক হলে বলতেন "হেই মা গো"। এটা নিবিড় গ্রামীণ অভিব্যক্তি। যেখানে সেখানে অশালীন কথাও বলতেন তিনি।

    আমাদের ব্লকেই তিন তলায় থাকত নবনীতারা। নবনীতা বাবা-মায়ের একটাই মেয়ে। দেখতে পুরো চিনে মেয়েদের মতো। ওর বাবা ডাবলু বি সি এস অফিসার ছিলেন, মা করপোরেশনের স্কুলে পড়াতেন। নবনীতার মা ওকে কত যত্নই না করতেন। শীতকালে গরম জলে স্নান করা আবশ্যক কিন্তু গ্যাসের গরম জলে স্নান করলে চামড়া খারাপ হয়ে যায় বলে কাকিমার বিশ্বাস। ওকে স্নান করানোর জলটা তিনি রোদে রেখে দিতেন। নবনীতাকে আরেকটা অভ্যাস করানো হয়েছিল। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এঁটো হাতে ফল খেত সে। তাতে নাকি স্বাস্থ্য ভালো হয়।

    নবনীতা আমার বোনের খুব বন্ধু ছিল। পরে ওরা গড়িয়ার দিকে বাড়ি করে উঠে ঢ়ায়। সেই নবনীতা, বাবা মায়ের অাদরের কুতুন দু'টি সন্তান রেখে মারা গেল। লিভারের ক্যান্সার হয়েছিল। ওর কথা মনে পড়লে এত কষ্ট হয়!

    আমাদের ঠিক সামনের ব্লকে থাকত একটা চালবাজ, বদমাইশ লোক। সে নিজের ফ্ল্যাটটাকে অদ্ভুতভাবে সাজিয়েছিল। বাথরুমের দরজায় লেখা বাথরুম, রান্নাঘরের দরজায় কিচেন, শোওয়ার ঘরের দরজায় বাথরুম। আমি তখন বেশ ছোট। এক দিন ওদের জানলা থেকে হাতে করে আমাকে কী একটা দেখাচ্ছিল আর বলছিল - এটা দেখেছ? আমি না বলাতে বলেছিল, এটা আখরোট। তখন আমি ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়তাম। আমাদের সাদামাটা সংসারের খাদ্যতালিকায় আখরোট কখনোই প্রবেশ করেনি। তাই চিনতাম না। এই লোকটার সব কথা এখানে বলতে পারছি না।

    সময়ের রাস্তা ধরে এবার অনেকটা এগিয়ে আসি। পাইকপাড়ার কথা বলি। আমাদের একতলার প্রতিবেশী - ভাইপো সোহম সরকার আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। এঁর অনুমতি সহ আসল নামটা ব্যবহার করছি। যাই হোক, ছোট্ট সোহম আমার কাছে পড়তে আসত এবং আমাকে মারধর করে নিজেই কাঁদত। এক দিন এরকম হওয়ার পর আমাদের পাশের ফ্ল্যাট থেকে জেঠিমা খোঁজ নিতে চলে এসেছিলেন। ওঁদের ভয় হয়েছিল, আমি বোধহয় সোহমকে মারছি। এই সোহম এখন অবেক বড়, খুব ভালো ব্রিজ খেলে, জুনিয়র ন্যাশনাল ব্রিজ চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। এখন অবশ্য তার নিজের জগৎ হয়ে গেছে বলে আমাকে দেখতেই পায় না। পাঁচ বছরের ছোট্ট সোহম মেরুন প্যান্ট স্যুট পরে একটা পলিথিনের প্যাকেটে বইখাতা নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমার কাছে পড়তে আসছে; এই দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে।

    সোহম যখন ছোট ছিল, ওর সামনে সরাসরি কোনো চেনা মানুষের নাম উল্লেখ করে কিছু বলতাম না আমরা। বাচ্চা ছেলে, কোথায় কী বলে বসবে! একবার সোহমের সামনে দোতলার শান্তিময় ব্যানার্জিবাবু সম্পর্কে কিছু বলা হচ্ছিল। মা ব্যানার্জিবাবুর নাম উল্লেখ না করে বলেছিল- মি. ব্যানার্জি এলে তবে এ ব্যাপারটা বোঝা যাবে। সোহম শুনেটুনে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল - শান্তিময় ব্যানার্জি?!

    সোহমের মা খুব বুদ্ধিমতী। ননদসুলভ দুষ্টুমি থেকে আমি তাঁকে মাঝেমাঝে তেজী বৌদি বলে ডাকি। আমার মা তেজী বৌদিকে খুব ভালোবাসতেন। একবার হয়েছে কী, মা কোনো একটা বিয়েতে উপহার দেওয়ার জন্য একটা শাড়ি কিনেছে। শাড়িটা বৌদিকে দেখানো হয়নি এদিকে খুব শিগগিরি বৌদি সোহমকে নিয়ে সাত আট দিনের জন্য বাপের বাড়ি যাবে। গোছানো অার ট্রেন ধরার তাড়ায় ওপরে আসার সময় নেই। অথচ বৌদিকে শাড়িটা দেখাতেই হবে। কী করা যাবে? সহজেই একটা উপায় বেরিয়ে এল।

    ফোন করে বৌদিকে অামাদের চারতলার বারান্দার নিচে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলা হল। মুখ খোলা প্যাকেটে ভরা তাঁতের শাড়িটা দড়ির সঙ্গে মজবুত করে বেঁধে আমাদের চারতলার বারান্দা থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। বৌদি প্যাকেট খুলে দেখে নিল। বলল, ভালো হয়েছে। এবার একই পদ্ধতিতে শাড়িটা ওপরে তুলে নেওয়া হ'ল। মায়ের শান্তি!

    সেই দিনগুলো কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। মা আর বাবা চলে গেছেন। সোহম অনেক বড়, নিজের জগতে ব্যস্ত। প্রায়ই ব্রিজ টুর্নামেন্ট খেলতে ভিন রাজ্যে যায়। তেজী বৌদি ওপরে বেশি আসেন না। তবু সম্পর্কের মানবিক দিকটুকু প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। ৷ বাবার মৃত্যুর সাত আট মাস পরে আমি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। বুকে শ্লেষ্মা জমে চূড়ান্ত অ্যাজমা। তখন সোহম আর বৌদিই রাত পোনে এগারোটা নাগাদ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং "প্রতিবেশী শেষ গতি" বললে ভুল হ'বে না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রৌহিন | 2401:4900:7356:2671:95c7:499f:2ff7:739f | ১৫ মার্চ ২০২৪ ০৯:২৫529381
  • কতই রঙ্গ দেখু দুনিয়ায়, ভাইরে -
  • Subhas Ghosal | 2405:201:403a:4041:1c61:11a9:c048:3a7f | ২০ এপ্রিল ২০২৪ ১১:০৬530808
  • ভারী সুন্দর লাগলো , খুব টানটান ঝরঝরে গদ্যে লেখা। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন